বিশ্বশান্তির পেক্ষাপটে; পার্বত্য চট্টগ্রামে সমসাময়িক বৌদ্ধ ধর্মীয় শিক্ষা, সংস্কৃতি ও জীবন


সুচনা ঃ ইতিহাস যে কোন জাতি-গোষ্ঠির অতীত কথা। অতীতের ধারাবাহিক ঘটনা প্রবাহ, ইতিবাচক-নেতিবাচক-ইতিকথা যার ভিত্তি ভূমিতে দাঁড়িয়ে বর্তমানের নির্মাণ। কোন মহান বা নেতা অথবা ব্যক্তির দ্বারা জাতি ধর্ম, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সমাজ ব্যবস্থায় সুনিয়ন্ত্রিত আচার, অনুশীলন প্রবর্তিত করেছিল, ইতিহাস তারই কাহিনীর উজ্জ্বল প্রকাশ। ইতিহাস নিজ সৃষ্টি মহিমায় মহিমাম্বিত এবং অতীতের গৌবরে গৌববান্বিত এক সত্যের আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত। ইতিহাস এবং ঐতিহ্য জাতির চলার পথ প্রর্দশক এবং ভবিষ্যতে অতীতের দৃষ্টান্ত সৃষ্টি জাতির শুভ সঙ্গীরুপে হুঁশীয়ারী সংকেতের ধারক ও বাহক।  যে সকল জ্ঞানী ও গুণীজনেরা জাতির মুক্তি সাধনে আতœত্যাগী, মানব সভ্যতার বিকাশে ও শিক্ষা-সংস্কৃতি প্রসারে আমরণ সংগ্রাম করে গিয়েছেন, তাঁদের লক্ষ্য অর্জনের কাহিনী ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌমত্ব গণতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ একটি দেশ। বাংলা ভাষা রাষ্ট্রীয় ভাষা নামে স্বীকৃত হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন উপ-ভাষা রয়েছে। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার ও ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম সংযোগ স্থল হল ‘বাংলাদেশ’। বিশ্বের প্রধান চার ধর্মাবলম্বী বৌদ্ধ, মুসলিম, হিন্দু ও খ্রিষ্টানের বসবাস এই ‘বাংলাদেশে’। বৌদ্ধরা এদেশের আদি অধিবাসী। এই দেশের প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিশেষতঃ প্রাচীন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় পরিবর্তন-বিবর্তনে বৌদ্ধ ও বৌদ্ধধর্ম যুগ যুগ ধরে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে এখনও সেই ধারা অব্যাহত আছে। বৌদ্ধরা মূলতঃ শান্তপ্রিয় জাতি। সম্প্রীতিতে সহাবস্থান তাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কালের বিবর্তনে যদিও নানা উত্থান-পতন হয়েছে তাতেও তারা প্রাচীন সংস্কারগত কারণে বিশেষতঃ বুদ্ধ ও তাঁর নৈতিকতাকে অন্তরে ধারণ করে মৈত্রী চেতনা, সাম্যভাব সর্বোপরি অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী। বৌদ্ধ জনগণ এদেশে স্মরণাতীত কাল থেকে বসবাস করে আসতেছে। বাংলাদেশের বৌদ্ধ জনগোষ্ঠি চারটি ভাগে বিভাজন করা হয়েছে। এই সকল বৌদ্ধদের মধ্যে জনসংখ্যার দিক থেকে আদিবাসী বা পাহাড়ি বৌদ্ধরা সর্বাধিক। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের চট্টগ্রামে, কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা সমূহের এদের বসতি, ইদানিং উত্তরবঙ্গের ওরাঁও আদিবাসী বৌদ্ধ জনগোষ্ঠি হিসেবে আতœ প্রকাশ করতে শুরু করেছে। প্রাচীন বিকৃতি বৌদ্ধধর্ম ত্যাগ করে বুদ্ধের মৌলিক নীতি থেরবাদী ধর্মে দীক্ষিত হয়ে পুনজাগরণের ধারাকে ধারণ করে চলেছে, এটা আরেকটি শুভ লক্ষণ বলা যায়। রাজনৈতিক জটিলতা এবং ভূমি সমস্যা ব্যতীত বুদ্ধের মহান শিক্ষার প্রতি গভীর আনুগত্য, শ্রদ্ধাশীল ও গুরুগত প্রাণ বিধায় অতীতের চেয়ে বর্তমানে অনেক অনেক শান্তিতে অবস্থান করছে নির্ধিধায় বলা যায়। বৌদ্ধরা সংখ্যায় স্বল্প হলেও সমগ্র বাংলাদেশ তথা বিশ্বে বৌদ্ধ ধর্মদর্শন ও সভ্যতার ইতিহাসে যুগান্তকারী মাইল স্টোন সৃষ্টিকারী বৌদ্ধরাই উত্তরাধিকারী।

পার্বত্য চট্টগ্রামের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান এই তিনটি পার্বত্য জেলা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম গঠিত। এই তিনটি পার্বত্য জেলার দশ ভাষা-ভাষী ১৩টি জুম্ম বা পাহাড়িদের বসবাস; এগুলি হলো- চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, ম্রো বা মুরং, বম, খুমী, খ্যায়ং, রাখাইন, চাক, তঞ্চঙ্গ্যা, লুসাই বা কুকি, রিয়াং, উসুই বা পাংখোয়া।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তারা আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি নয় উপজাতি নামে স্বীকৃত। এসব ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা গুলো নৃ-তাত্ত্বিক বিচারে মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠির অর্ন্তভূক্ত।
এ প্রসঙ্গে প্রফেসর বেসইনে পিয়ের বলেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের এই উপজাতীয় লোকেরা মানব জাতিতত্ত্বের দিক থেকে পূর্ব পাকিস্থানের (বর্তমান বাংলাদেশ) অন্যান্য স্থায়ী বাসিন্দাদের থেকে আলাদা। এদের সাদৃশ রয়েছে তিব্বত থেকে ইন্দোচীন পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলের পাহাড়িয়া লোকদের সঙ্গে। এরা খর্বকায় এদের গায়ের হাড় উন্নত, মাথার চুল কালো, ছোট চোখ সর্বোপরি শারীরিক গঠন ও আকৃতির দিক থেকে এঁরা মঙ্গোলীয় জাতির বৈশিষ্ট্য লাভ করেছে (পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি, প্রফেসর পিয়ের বেসেইনে অনুবাদ : অধ্যাপিকা সুপিয়া খান, বাংলা একাডেমী, ঢাকা- ১৯৯৬,পৃ: ২)।   
পার্বত্য চট্টগ্রামের এক একটি আদিবাসী জনগোষ্ঠির উৎপত্তি, বিকাশ, ভাষা, সমাজ, ধর্ম ও সংস্কৃতির ইতিহাস অন্য আদিবাসীর জাতিসত্তা থেকে ভিন্ন স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ভৌগলিক পরিচয়
    অবস্থান : বর্তমানে পাবর্ত্য চট্টগ্রাম ২১ ডিগ্রী ১৫" হতে ২৩ ডিগ্রী ৪৫" উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯১ ডিগ্রী ৫৪" হতে ৯২ ডিগ্রী ্র ৫০" পূর্ব দ্রাঘিমাংশ বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাংশের বিস্তৃত পবর্তমালা জুড়ে অবস্থিত। খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, বান্দরবান এই তিনটি জেলা নিয়ে গঠিত পাবর্ত্য চট্টগ্রাম বা ঈযরঃঃধমড়হম ঐরষষ ঞৎধপঃ’ং নামে পরিচিত।
    আয়তন নিশ্চিতভাবে সম্ভবত কেউ জানে না। এক মতে ৫,০৯৩ বর্গমাইল, আরেক মতে, ৫,১৩৮ বর্গমাইল বা ১,৩০০ বর্গ কি:মি:, মোটামুটি বাংলাদেশের দশ ভাগের একভাগ। ক্যাপ্টেন. টি. এইচ লুইন উল্লেখ করেছেন ৬,৭৯৬ বর্গ মাইল। ১৮৮১ সালের ১ সেপ্টেম্বর “চাকোমাস” রাজ্য (বর্তমান বৃহত্তম পার্বত্য চট্টগ্রাম) তিনটি সার্কেলে বিভক্ত করা হয়। যথা- চাক্মা সার্কেল, বোমাং সার্কেল, ও মং সার্কেল। সার্কেল অনুসারে এর আয়তন চাক্মা সার্কেল- ২,৪৯৭ বর্গ মাইল, বোমাং সার্কেল- ১,৯৩৪ বর্গ মাইল, মং সার্কেল- ৭০৪ বর্গ মাইল।
১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলাকে তিনটি জেলায় ভাগ করা হয়। যথা- খাগড়াছড়ি জেলা, মাঝখানে রাঙামাটি জেলা এবং দক্ষিণে বান্দরবান জেলা। খাগড়াছড়ি জেলার আয়তন ২,৬৯৯.৫৬ বর্গকিলোমিটার, রাঙ্গামাটি জেলার আয়তন ৬,১১৬.১৩ বর্গকিলোমিটার, বান্দরবান জেলার আয়তন ৪,৪৭৯.০৩ বর্গকিলোমিটার। এই জেলাকে আবার তিনটি সাবডিভিসনে ভাগ করা হয়েছে। যথা- (১) সদর সাবডিভিসন- রাঙ্গামাটি (চাক্মা সার্কেল), (২) বান্দরবান সাবডিভিসন- বান্দরবান (বোমাং সার্কেল), (৩) রামগড় সাবডিভিসন- রামগড় (মং সার্কেল)।
    ভৌগলিকভাবে পাবর্ত্য চট্টগ্রাম ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি পাবর্ত্য প্রদেশ ও মায়ানমারের পশ্চিম সীমান্তের সাথে সংযুক্ত। উত্তর ও উত্তর পশ্চিমে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, দক্ষিণে মায়ানমারের আরাকান প্রদেশ, উত্তর ও উত্তর-পূর্বে ভারতের মিজোরাম রাজ্য এবং পশ্চিমে বাংলাদেশের সমতল উপকূলীয় জেলা চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলা অবস্থিত।
আনুমানিক ৫৯০ খ্রিষ্টাব্দে চাকমা যুবরাজ বিজয়গিরি তাঁর সেনাপতি রাধামন চাক্মা কর্তৃক রোয়াংছড়ি (বর্তমান রামু) অক্সাদেশ (আরাকান সীমান্ত) খ্যাংদেশ (কাঞ্চননগর) ও কালজর (কুকিরাজ্য) অধিকার করে বিশাল রাজ্য “পাবর্ত্য রাজ্য” (চাকোমাস) প্রতিষ্ঠা করে। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে চাকমা রাজা জনুর রাজত্বের সময় রাজ্যসীমা পূর্বে নাম্রে (বর্তমান নাপ নদী) পশ্চিমে সীতাকুন্ড পাহাড়, দক্ষিণে সমুদ্র ও উত্তরে চাইচাল পর্বত শ্রেণী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
১৭৩৭ খ্রিষ্টাব্দে চাকমা রাজা শেরমুস্ত খাঁর রাজত্বকালে চট্টগ্রাম জেলাসহ পার্বত্য অঞ্চল তাঁর অধিকারে ছিল। তাঁর রাজ্যসীমা ছিল উত্তরে ফেনী নদী, দক্ষিণে শঙ্খ নদীর মধ্যবর্তী স্থান, পূর্বে লুসাই পাহাড়, পশ্চিমে নিজামপুর রাস্তা অর্থাৎ বর্তমান ট্রাংক রোড। ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ কোম্পানির কালেক্টর মিস্টার হেনরী ভোলেষ্টের বিবরণ অনুযায়ী পাবর্ত্য চট্টগ্রাম গেজেটেও পূর্বোক্ত সীমানা পরিদৃষ্ট হয় এবং সীতাকুন্ড পাহাড়ও এর অন্তর্ভূক্ত ছিল।
ক্যাপ্টেন. টি.এইচ লুইন উল্লেখ করেছেন, পশ্চিমে চট্টগ্রাম জেলা, দক্ষিণ ও পূর্বে  আরাকান প্রদেশর নীল পর্বতশ্রেণী এবং উত্তরে ফেনী নদী যা অর্ধ ত্রিপুরা রাজ্য থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পৃথক করে রেখেছে। উত্তর-পূর্বাংশের সীমান্ত সঠিকভাবে নির্দিষ্ট নয় তবে ঐদিকে স্বীকৃত বৃটিশ প্রভাবাধীন পার্বত্য উপজাতীয় অঞ্চল পর্যন্ত ধরা যায়। মোটামুটিভাবে চট্টগ্রাম জেলার সমভূমিতে প্রবেশ করার পূর্ব পর্যন্ত ফেনী, কর্ণফুলী, সাংগু, মাতামুহুরী ও তাদের উপনদীসমূহের জলধারা বেষ্টিত ভূ-ভাগ এই জেলার পরিসর।

    ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে লোকসংখ্যা গনণা অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট লোকসংখ্যা ৯,৭৪,৪৪৫ জন, উপজাতি ৬,৬৩,০৭৭ জন আর বাঙালি ৩,১১,৩৬৮ জন। চাক্মা ৩,০৬,৬১৬ জন, মারমা ১,৭৬,২৩০ জন, ত্রিপুরা ১,০২,৪৫৫ জন, মুরং ৩,২,০৯৮ জন, তঞ্চঙ্গ্যা ২,১,১৪০ জন, বোম ৫,৫৮৪ জন, পাংখু ১,৬৬৮ জন, খুমি ১,০৯ ১জন, উসাই ৯৬৬ জন, খিয়াং ১,৩২৯ জন, চাক ৭৯৮ জন, লুসাই ৬৬৯ জন ও রিয়াং ২,৪৩৪ জন।
শতকরা হিসেবে ৩০.৫৭% জন চাকমা, ১৬.৬০% জন মারমা, ৭.৩৯% জন ত্রিপুরা, অন্যান্য ৬.০৬% জন পাহাড়ি আর বাঙ্গালি ৩৯.৩৮% জন। বাংলাদেশের মোট জন সংখ্যার ০.৫% জন বসবাস করে। ১৯৭৯ সালে প্রবলভাবে বেড়ে যায় বাঙালি মুসলমানের সংখ্যা। তারা ঠিকে থাকলে কয়েক দশকে পাহাড় হয়ে উঠবে বাঙালি মুসলমানের। সার্কেল অনুযায়ী চাকমা সার্কেল- ১,৬৩,৫২৩ জন, বোমাং সার্কেল- ১,৩৫,১৩৪ জন, মং সার্কেল- ৮৬,৪২২জন।
খাগড়াছড়ি জেলায় বর্তমানে লোকসংখ্যা ৫,১৮,৪৬৩ জন, তার মধ্যে পুরুষ-২,৭১,১৩১ জন এবং মহিলা- ২,৪৭,৩৩২ জন (২০০১ সালের আদমশুমারি অনুসারে)। খাগড়াছড়ি সর্বমোট জনসংখ্যা ৬,১৩,৯১৩ বাঙালি ২,৯৬,৯২৬ পাহাড়ি ৩,১৫,১৬৭, চাকমা ১,৬১,৯৬০ ত্রিপুরা ৮৬,১৯৬ মারমা ৬৭,০১১ অন্যান্য ১৭,৪২১ জন (২০১১ সালের জরিপ মোতাবেক)।   
রাঙামাটি জেলায় মোট লোকসংখ্যা ৬,২০,২১৪ জন, পুরুষ ৩,২৫,৮২৩ জন, মহিলা ২,৯৪,৩৯১ জন (২০১১ সালের জরিপ মোতাবেক)। বান্দরবান জেলার মোট লোকসংখ্যা : ৪,০৪,০৯৩ জন। পুরুষ ২,১১,৬২৮ জন, মহিলা ১,৯২,৪৬৫ জন।
১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে লোকসংখ্যা ছিল মাত্র ১,২৪,৭৬২ জন। চাকমা সার্কেল ৪৮,৭৯২ জন। বোমাং সার্কেল ৪৪,০৭২ জন। মং সার্কেল ৩১,৮৯৮ জন। ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে জনসংখ্যা গণনায় ৩,৮৫,০৭৯ জন। সেখানে বর্তমানে লোখসংখ্যা ৯,৭৪,৪৪৫ জন।
    ১৩টি আদিবাসী। চাকমা, মারামা, ত্রিপুরা, মুরং, তঞ্চঙ্গ্যা, বৌম, পাংখু, খুমি, উসাই, খিয়াং, ছাক, লুসাই ও রিয়াং। প্রত্যেক আদিবাসীর রয়েছে নিজস্ব ভাষা, নিজেদের মধ্যে তাঁরা নিজেদের ভাষায় কথা বলেন, তবে ভিন্ন জাতির সাথে কথা বলেন বাংলা ও ইংরেজীতে। (সহায়ক গ্রন্থ: ১. চাকমা জাতি (জাতীয় চিত্র ও ইতিবৃত্ত), সতীশ চন্দ্র ঘোষ, পৃষ্ঠা-৩৩, ২০১০ইং, ২. পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি প্রক্রিয়ার ও পরিবেশ-পরিস্থিতির মূল্যায়ণ, মেজর জেনারেল (অবঃ) সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম বীর প্রতীক, পৃষ্ঠা-১৭-২০, ২০০১ইং,। ৩. চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চল ও তার অধিবাসীবৃন্দ, ক্যাপ্টেন টি.এইচ. লুইন, পৃষ্ঠা-১-৭, ১৯৯৬ ইং।, ৪. চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত, বিরাজ মোহন দেওয়ান, পৃষ্ঠা-১-ক হতে ৬-চ,  ১৯৬৯ইং।],
5. www.rangamati.gov.bd, 6. www.khagrachhari.gov.bd, 7.www.bandarban.gov.bd, ৮. শান্তিবাহিনী ও শান্তিচুক্তি, সালাম আজাদ, পৃষ্ঠা-১৪, ১৯৯৯ইং)


    স্বাধীন বাংলদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্ত সীমায় পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন পাহাড়ি জনগোষ্ঠী উপজাতিদের অবস্থান। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেমন অপূর্ব তেমনি প্রাকৃতিক সম্পদও প্রচুর। সু-উচ্চ পাহাড়ঘেরা সবুজ দৃশ্য শোভিত এলাকা হিসেবে দেশি-বিদেশি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বনজ ও ফলজ সম্পদের পর্যাপ্ততা শুধু নয় প্রচুর সম্ভাবনাময় খনিজ সম্পদও রয়েছে বলে ভূ-তত্ত্ববিদ এবং গবেষকদের অভিমত। মেধা ও মনন শক্তির পাশাপাশি তথ্য প্রযুক্তির প্রয়োগে এই মূল্যবান সম্পদ গুলো উত্তোলন করতে পারলে এলাকার অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক অবকাঠামোবৃদ্ধি, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় জাগরণ এবং দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি দ্রুততর হবে সন্দেহ নেই। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রচুর খাদ্যদ্রব্য, বৈদ্যুতিক সমস্যা দূরীকরণ, বনজ-ফলজ, পর্যটনকেন্দ্র ও মৎস্য সম্পদের চাহিদার সিংহভাগ পার্বত্য এলাকা থেকে পাওয়া যায়। যা না হলে এদেশের অসংখ্য মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য জোগান দেওয়া কঠিন হত। গাছ-বাঁশ থেকে শুরু করে বনজ-ফলজ দ্রব্যাদির প্রতিনিয়ত পার্বত্য চট্টগ্রমেরই উৎপাদিত সম্পদ। সে তুলনায় পার্বত্য এলাকায় বসবাসরত পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অনেক ধরনের সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত শুধু নয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসহায়ত্ব জীবন যাপন করতে দেখা যায়। সামগ্রিকভাবে চিন্তা করলে একজন নাগরিকের প্রাথমিক অধিকার হলো ‘শিক্ষা’। এ শিক্ষা বা জ্ঞানালো অর্জন ছাড়া কোন জাতি উন্নতি হতে পারে না। সরকারি ও বেসরকারিভাবে শিক্ষার অপ্রতুলতা এই এলাকার বসবাসরত জনগণ পিছিয়ে পড়ার প্রথম কারণ। স্বাধীনতার প্রায় ৪৮ বছর পরেও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন প্রত্যন্ত দুর্গম এলাকায় শিক্ষার আলো প্রবেশ করেনি বললেও ভুল হবে না। কোনো কোনো এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও হাইস্কুলের কোনো ব্যবস্থা নেই। দু’এক জায়গায় হাইস্কুল প্রতিষ্ঠিত হলেও কলেজের নাম গন্ধ নেই। দু’একটা জায়গায় কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলেও যাতায়ত ব্যবস্থার দূরত্ব হিসাব করলে দৈনিক অতদূর পায়ে হেঁটে অথবা মোটর সাইকেলে করে যাতায়াত করে কলেজে লেখাপড়া করার মতো সামর্থ্য ও সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। বিশ্বায়নের যুগে সম্প্রতি দু’টো বিশ্ববিদ্যালয়, একটি মেডিকেল কলেজ, কয়েকটি কারীগরী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যা সংখ্যানুপাতে অতি নগণ্য বলতে পারি, অন্যান্য উন্নত দেশের তুলনায় আধুনিক শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে পার্বত্য কতটুকু পিছিয়ে আছে বলাই বাহুল্য। যার পরিপ্রেক্ষিতে অর্থনৈতিক সমস্যা যেমন প্রখর তেমনিভাবে সংস্কৃতি ও ধর্মীয় চেতনাকে উজ্জীবিত করতে বার বার বাধাগ্রস্থ হচ্ছে বলেই মানবতা, মানবপ্রেম ও মানবকল্যাণ অনেকটা ম্লান হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয়। এ বিষয়ে পরে আলোচনায় আসছি।
    পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস ও ঐতিহ্য স্মরণাতীতকাল থেকে অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং ইতিহাসখ্যাত। ১৯৪৭ খ্রি: তথা দেশ বিভক্তির পূর্ব পর্যন্ত উপমহাদেশকে ব্রিটিশেরা প্রায় দু’শ বছর যাবত নিজেদের অধীনে উপনিবেশ এলাকা হিসেবে শাসন করেছিলেন। ব্রিটিশদের শাসনামলে পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসন কার্য সুষ্ঠুভাবে পচিালিত করার জন্য ৩জন রাজা নির্বাচিত করে ৩টি সার্কেলে বিভক্ত করা দেওয়া হয়েছে। সার্কেলগুলোর নাম হলো যথাক্রমে ১। মং সার্কেল, মানিকছড়ি (বর্তমানে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা), ২। বোমাং সার্কেল (বর্তমান বান্দরবান পার্বত্য জেলা) এবং ৩। চাকমা সার্কেল (বর্তমান রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা)। ব্রিটিশ এবং পাকিস্তান আমলে রাজাদের যে ক্ষমতা ছিল বর্তমানে চীফদের ঠিক ততটুকু ক্ষমতা আর নেই। তবু চিরাচরিত নিয়ম মোতাবেক রাজ প্রতিনিধিদের কর্তৃক বিভিন্ন দপ্তর পরিচালিত যেমন: ১। কৃষি বিভাগ, ২। ভূমি সম্পদ বিভাগ, ৩। মার্কেটিং বিভাগ, ৪। পশু পালন বিভাগ, ৫। বাজার চৌধুরী ও মৌজা প্রধানের দায়িত্ব পরিচালনা বিভাগ, ৬। সামাজিক বিভাগ, ৭। ধর্মীয় অনুষ্ঠান বিভাগ, ৮। আপ্যায়ন বিভাগ এবং ৯। রাজ নিরাপত্তা বাহিনী বা পুলিশ বিভাগ ইত্যাদি।

ঐতিহ্যবাহী চাকমা রাজাদের তালিকা : ১। রাজা বিজয়গিরি, ৯৯৫ খ্রি:, ২। রাজা বৈধ্বংগিরি, ১০৭৫ খ্রি:, ৩। বাঙ্গালি সর্দার, ১১১৮-১৯ খ্রি:, ৪। রাজা অরুণযুগ ১৩৩৩ খ্রি:, ৫। রাজা সুর্য্যজিত ১৩৮৩ খ্রি:, ৬। রাজা মানেকগিরি ১৪১৮ খ্রি:, ৭। রাজা কদম থংজা  খ্রি:, ৮। রাজা রদংসা খ্রি:, ৯। রাজা তৈন সুরেশ্বরী খ্রি:, ১০। রাজা জনু ১৫১৬ খ্রি:, ১১। রাজা সাত্তুয়া ১৬৩৮ খ্রি:, ১২। রাজা ধাবানা খ্রি:, ১৩। রাজা ধরম্যা খ্রি:, ১৪। রাজা মোগল্যা খ্রি:, ১৫। রাজা সুভল খাঁ ১৭১২খ্রি:, ১৬। রাজা ফতে খাঁ ১৭১৫ খ্রি:, ১৭। রাজা শের মুস্ত খাঁ ১৭৩৭ খ্রি:, ১৮। রাজা সুর্য্যজিত ১৩৮৩ খ্রি:।
বৃট্রিশ শাসনামলে চাকমা রাজাগণ : ১৯। রাজা শুকদেব রায়, ১৭৫৭ খ্রি:, ২০। রাজা সের দৌলত খাঁ, ১৭৭৬ খ্রি:, ২১। রাজা জানবক্স খাঁ, ১৭৮২খ্রি:, ২২। রাজা টব্বর খাঁ, ১৮০০খ্রি:, ২৩। রাজা জব্বর খাঁ, ১৮০২খ্রি:, ২৪। রাজা ধরম বক্স খাঁ, ১৮১২খ্রি:, ২৫। রাজমহিষী রাণী কালিন্দী, ১৮৪৪খ্রি:, ২৬। রাজা হরিশ্চন্দ্র, ১৮৭৩খ্রি:, ২৭। রাজা ভূবন মোহন রায়, ১৮৯৭খ্রি:, ২৮। রাজা নলিনাক্ষ রায়, ১৯৩৫খ্রি:।
পাকস্থান আমল : ২৯। মেজর রাজা ত্রিদিব রায়, ১৯৫৩খ্রি:, ২০। রাজা দেবাশীয় রায়, ১৯৭৭খ্রি: ( চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত, বিরাজ মোহন, ১৯৬৯ইং, ৬৮-১৫৬ পৃষ্ঠা)।

ঐতিহ্যবাহী মং রাজাদের তালিকা : ১। কংজয় ১৭৯৬ - ১৮২৬ খ্রি:, ২। ক্যজসাইন ১৮২৬ - ১৭৮০ খ্রি:, ৩। নরবধি ১৮৭০ - ১৭৮৯ খ্রি:, ৪। ক্যজপ্রু ১৭৮৯ - ১৮৮৩ খ্রি:, ৫। নিপ্রুসাইন ১৮৮৩ - ১৯৩৬ খ্রি:, ৬। রানী নেং উমা ১৯৩৬ - ১৯৫৩ খ্রি:, ৭। মংপ্রুসাইন ১৯৫৩ - ১৯৫৪ খ্রি:, ৮। মঙচীফ (অস্থায়ী) রানী নিহারদেবী ১৯৮৪ - ১৯৯১  খ্রি:, ৯। মঙচীফ (অস্থায়ী) পাইলাপ্রু চৌধুরী মার্চ ১৯৯১-২০০৯ খ্রি:, ১০। সাচিং প্রু চৌধুরী ২০০৯ ( সম্বোধি, সম্পাদক, ক্য সা চিং ও থিন হান মং, ২ মে ১৯৯১ইং, প্রবন্ধ- পার্বত্য খাগড়াছিিড়র মঙ রাজপরিবার, কং জঅং চৌধুরী লিংকন, ১৫ পৃষ্ঠা)।

ঐতিহ্যবাহী বোমাং সার্কেল রাজাদের নামের তালিকা ও সন তারিখ : ১। তবাং শোয়েথী ১৫৩১ - ১৫৫০ খ্রি:, ২। বরাঙ নঙ ১৫৫০ - ১৫৮১ খ্রি:, ৩। নাইন্দা বরাঙ ১৫৮১ - ১৫৯৯ খ্রি:  বরাঙ এর পুত্র।
চট্টগ্রাম অধিবাসী : ১৬৪১ খ্রি: হতে শুরু : ৪। মং চ প্যাই বোমাং ১৬৪১ - ১৬৩০ খ্রি: নাইন্দা বরাঙ এর পুত্র, ৫। মং গ্রই প্রু বোমাং ১৬৩০ - ১৬৬৫ খ্রি: মং চ প্যাই এর পুত্র,  ৬। হেরী প্রু বোমাং ১৬৬৫ - ১৬৭৮ খ্রি: মং গ্রই প্রু এর পুত্র, ৭। হেরী ঞো বোমাংগ্রী ১৬৮৭ - ১৭২৭ খ্রি: হেরী প্রু এর ভ্রাতাপুত্র।

বান্দরবান এর অধিবাসী : ১৮০৪ - ১৭২৭ খ্রি: হতে শুরু : ব্রিটিশ স্বীকৃতি ১৮২২ খ্রি: ৮। কং হ্লা বোমাংগ্রী ১৭২৭-১৮১১ খ্রি: হেরী ঞো এর পৌত্র, ৯। সাক থাই প্রু বোমাংগ্রী ১৮১১ - ১৮৪০ খ্রি: কং হ্লা প্রু এর পুত্র, ১০। কং হ্লা ঞো বোমাংগ্রী ১৮৪০-১৮৬৬ খ্রি: সাক থাই প্রু এর ভ্রাতুষ্পুত্র, ১১। মং প্রু বোমাংগ্রী ১৮৬৬ - ১৮৭৫ খ্রি: কং হ্লা ঞো জেঠতুত ভাই, ১২। সাক হ্লাই ঞো বোমাংগ্রী ১৮৭৫ - ১৯০১ খ্রি: মং প্রু এর ভ্রাতা,১৩। চা হ্লা প্রু বোমাংগ্রী ১৯০১ - ১৯১৬ খ্রি: সাক হ্লাই ঞোর ভ্রাতুষ্পুত্র, ১৪। মং সা ঞো বোমাংগ্রী ১৯১৬ - ১৯২৩ খ্রি: চা হ্লা প্রু এর জেঠতুত ভাই, ১৫। ক্য জাই প্রু বোমাংগ্রী ১৯২৩ - ১৯৩৩ খ্রি: মং সা ঞোর ভ্রাতুষ্পুত্র, ১৬। ক্য জ সাই বোমাংগ্রী ১৯৩৩-১৯৫৯ খ্রি: ক্য জাই প্রু এর পুত্র,  ১৭। মং শোয়ে প্রু বোমংগ্রী ১৯৫৯- ক্য জ সাই এর ভ্রাতা। ১৮। উচপ্রু, ২০১৮ খ্রি: (সম্বোধি, সম্পাদক, ক্য সা চিং ও থিন হান মং, ১৯৯০ইং, প্রবন্ধ মারমা সমাজ ও সংস্কৃতি, ক্য শৈ প্রু, ৪পৃষ্ঠা)।

    বর্তমান যুগ জ্ঞান প্রধান বৈজ্ঞানিক যুগ। প্রতিটি মানুষের মধ্যে স্বাধীন চিন্তা-চেতনা যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে গণতান্ত্রিক অধিকার। রাজা, মহারাজা থেকে শুরু করে সাধারণ নিরীহ মানুষ সবাই তার ন্যায্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত না হওয়াই সকলের প্রত্যাশা। সমবন্টন, সমভোগ, সমদৃষ্টি এবং পরস্পরের মধ্যে সমন্বয় সাধনের মধ্যে মানুষের মানবতা, মানবতা প্রেম, মানব কল্যাণ এবং মানব ধর্ম নিহিত। বিশে^র মধ্যে মানুষ একমাত্র প্রাণী যার মধ্যে একদিকে বুদ্ধিদীপ্ত চেতনা, অন্যদিকে বিবেকবোধ ও বিচারশীল গুণাবলীর অধিকারী। মানুষের স্বকীয় গুণ হিসেবে বাস্তবতা, যুক্তিসঙ্গত চিন্তা-ভাবনা, বিজ্ঞান মনস্কতা এবং নীতি আদর্শকে গুরুত্ব দিতে দেখা যায়। সেই আদর্শের মানুষ পরিবার, সমাজ, দেশ ও জাতিতে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দৃঢ় সংকল্প অটল। প্রতিটি মানুষের কম বেশি এই নৈতিকতাকে জাগাতে পারার মধ্যে মানব জীবনের স্বার্থকতা। রাজা হিসেবে রাজার নৈতিক দায়-দায়িত্ব এবং প্রজা সাধারণ হিসেবে রাজার প্রতি আনুগত্য ও শ্রদ্ধাশীল হলে সুন্দর ও সুশৃঙ্খলশীল অনুকুল পরিবেশ স্বাভাবিকভাবে এসে যায়। এক্ষেত্রে রাজার সুখ শান্তির চেয়ে প্রজাদের সুখ শান্তি প্রাধান্য পায় বেশি। তখন সমাজ ও দেশ সমুন্নত হতে বাধ্য। বিশ^ায়নের যুগে এটাই প্রতিটি মানুষের আন্তরিক কাম্য।
    স্বাধীন বাংলাদেশ মানে পরাধীনতার অক্টোপাস থেকে জাতিকে মুক্ত করা। এখন আর মাথা নত নয় উচ্চশিরে সহাবস্থান করা। স্ব-স্ব ন্যায্য অধিকারী স্ব-স্ব দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের মধ্য দিয়ে নিজেকে এবং দেশকে এগিয়ে যাওয়া। যেখানে স্বজাতি, স্বসংস্কৃতি, স্ব-ধর্ম, স্ব-সাহিত্য ইত্যাদিকে জানিয়ে তোলা। এখানে মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ এবং পাহাড়ি জনগোষ্ঠী বলে কোন ধরনের বিভাজন থাকবে না বরং সমান সুযোগ সুবিধা নিয়ে বসবাস করার অধিকার রাখে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলায় বসবাসরত পাহাড়ি জনগোষ্ঠী একই স্বাধীন দেশের নাগরিক এবং এদশের ভূমিজ সন্তান হলেও বিভিন্ন আন্দোলন, সংগ্রাম এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশেষ অবদানের কথা সর্বজন বিদিত। এদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য বৈদ্যুতিক চাহিদা, বনজ, ফলজ এবং পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে দেশের জনগণের চাহিদা পূরণে এতদাঞ্চলের অবদান কোনোভাবে ভুলবার নয় বরং এর বিপরীতে পার্বত্য এলাকায় বসবাসরত সাধারণ মানুষ্যের ভাগ্য উন্নয়নে আশানুরূপ অগ্রগতি হয়েছে এই দাবী করাটা ভুল। তাই শান্তি প্রতিষ্ঠার স্থানে অশান্তির আগুন দিন দিন বেড়ে চলেছে নিদ্বির্ধায় বলা যায়। অথচ পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর দ্বারা এই দেশের সর্বাধিক উন্নয়নে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এমন নজির নেই। বরং দেশের সার্বিক অগ্রগতিতে উন্নয়নের সিংহভাগ পার্বত্য অঞ্চল থেকে যাচ্ছে যা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। দেশের এত সম্ভাবনাময় এলাকা হওয়া স্বত্ত্বেও সেখানকার জনগণের দৈনন্দিন জীবন জীবিকার ধারা, শিক্ষা, সংস্কৃতি বর্তমান বিশে^র তুলনায় কত পিছিয়ে আছে বাস্তবে অনুসন্ধান তথা পরীক্ষা নিরীক্ষা না করলে সঠিক মন্তব্য করা কঠিন।
    পার্বত্য এলাকা স্বাধীন বাংলাদেশের একটি বিশাল অঞ্চল। তাঁদের নিজস্ব সংস্কৃতি, কৃষ্টি, সভ্যতার ছোঁয়া রয়েছে। যুগোপযোগী শিক্ষার অপ্রতুলতার দরুন অত্র এলাকা যতটুকু এগিয়ে যাওয়া দরকার ছিল সার্বিক বিবেচনায় অনেকটা দুর্বল শুধু নয় অর্থনৈতিক এবং আধুনিক শিক্ষার অগ্রগতি আশানুরূপ হয়েছে এই দাবী করাটা ভুল। এর প্রধানতম সমস্যা হলো রাজনৈতিক। এই রাজনৈতিক সংকট যদি বিদ্যমান থাকবে তখন শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় জাগরণটা বাধা স্বরূপ হয়েছে সন্দেহ নেই। রাজনৈতিক সমস্যাকে সামনে রেখে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমিজ সমস্যাটি আরও জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠেছে দিন দিন। এই মারাত্মক দুটো সমস্যার আশু সমাধান না হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি স্থাপন তো দূরের কথা সংস্কৃতি ও ধর্মীয় অগ্রযাত্রা সদা সর্বদা বিঘিœত হচ্ছে এবং হবে বলা যায়। বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানে আন্তরিক হলেও রাজনৈতিক এবং ভূমি সমস্যাটা অতি জটিল এবং কঠিনরূপ ধারণ করেছে, যা কখন, কিভাবে এর সমাধানে পৌঁছাবে তা নির্দিষ্ট করে বলাও মুশকিল। অতীতের তুলনায় বর্তমান সরকার এ ব্যাপারে অনেক দূর এগিয়েছে সন্দেহ নেই। তবে সরকারী জটিলতার গিট খোলা যত সহজ মনে হয় তত সহজ নয়। বর্তমান সরকারের সদিচ্ছা এবং পার্বত্য এলাকার জনপ্রতিনিধি তথা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মধ্যে পরস্পরের মত বিরুেেদর দরুন উভয়ের মধ্যে সমন্বয়, বোঝাপড়া এবং জনগণের সার্বিক হিতসুখ কামনায় যদি এগিয়ে না আসা  যায় তাহলে সময় সাপেক্ষ শান্তি ফিরে আসতে পারে তা নয় দেশের সার্বিক উন্নয়নে ও তরান্বিত হবে আশা করি। আমি ব্যক্তিগতভাবে বলতে পারি, পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি ফিরিয়ে আনতে না পারলে ভবিষ্যৎ হিংসা-বিদ্বেষের আগুন দিন দিন কমবে না বরং শতগুণ বাড়বে বৈকি? সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও জন্মদাতা পিতা-মাতা হিসেবে নিজেদের ছেলে-মেয়েদের গঠন এবং রক্ষা করার দায় দায়িত্ব সম্পর্কে অবশ্যই সচেতন হতে হবে। নতুবা পারিবারিক অস্তিত্ব ঠিকে থাকবে বলে মনে হয় না। ছেলে-মেয়েদের জীবনে পারিবারিক এবং ধর্মীং নৈতিক শিক্ষা খুবই জরুরী। অনেক সময় পরিবেশ ও পরিস্থিতির কারণে পিতা মাতা উচ্চ শিক্ষিত না হলেও স্বশিক্ষায় সুশিক্ষিত হওয়ায় সন্তান সন্ততিদেরকে গঠনে অত্যন্ত কঠোর ও শাসক হিসেবে দায়িত্ব পালনে সচেতনতা পরিলক্ষিত হতে দেখা যায়। সেই পরিবার অন্য দশের চেয়ে একটু আলাদা এবং আচার আচরণে উন্নত স্বভাবের হয়। তাই শেষ জীবনের সেই পিতা-মাতা সুখী যেমন হয় এবং ছেলে-মেয়েরা পরিবারের যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে যাবতীয় করণীয় কর্তব্য সম্পাদনে ও নিষ্ঠাবান হতে দেখা যায়। এখানেই পরিবারের সফলতা। এমন কি ছোটবেলা থেকে সকাল সন্ধ্যা প্রার্থনা, গুরুপূজা, গুরু শিক্ষা এবং পিতা মাতার প্রতিও মান্যতা ও শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টি করা। পরিবারের সুখ শান্তির মধ্য দিয়ে সামাজিক সুখ শান্তি অনেক নির্ভর করে। বাল্যকাল থেকে নিজেকে নৈতিক ও ধর্মীয় ভাবাদর্শে জীবন গঠিত না হলে বড় হলেও সেই আদর্শ রক্ষিত হয়। আদর্শ ও ধার্মিক পরিবার থেকে আদর্শ সন্তান তৈরি হয়। নতুবা ুন্দর জীবন বিনষ্ট হতে বাধ্য। বিশে^র উন্নয়ন স্বাধীন দেশের সঙ্গে তুলনা করলে বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রামে বনজ ও ফলজ সম্পদে শুধু নয় খনিজ সম্পদের অন্যতম স্থান হিসেবে বৈজ্ঞানিকদের অভিমত তা পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ও ভূমিজ সমস্যার জটিলতার দরুন আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির প্রয়োগের সুব্যবস্থা না থাকায় বাধাগ্রস্থ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। মেধা ও মনন শক্তিকে কাজে লাগাতে না পারার দরুন অর্থনৈতিক উন্নয়নটা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে প্রচুর পরিমাণে। এতে এলাকার জনগণের অর্থনৈতিক অভাব অনটন লেগেই আছে। শুধু তা নয় দেশের পর্যাপ্ত খনিজ সম্পদের উত্তোলন না হওয়ার ফলে দেশ পরনির্ভরশীল হয়ে পড়েছে নির্দ্বিধায় বলা যায়। এক্ষেত্রে সার্বিক বিবেচনা করে দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি চুক্তির দ্রুত সমাধান হওয়া প্রয়োজন।
    রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় অনুকুল পরিবেশ ফিরিয়ে আনা আদৌ সম্ভব নয়। এত প্রতিকুলতা থাকা স্বত্ত্বেও তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি দেশে বিদেশে সুনাম অর্জন করে চলেছে। খেলা ধুলায়ও এদের ছেলে মেয়েরা তুলনামূলক এগিয়ে। আসলে বলতে পারি নিজের মেধা দিয়ে গান, নাটক নিজেদের চেষ্ঠা প্রচেষ্ঠায় রচনা করা, পরিবেশ করা এবং অন্যকে শিক্ষার সুব্যবস্থা করা। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মাধ্যমে যোগ্য উত্তরসূরী তৈরি করা, অঞ্চলে, মহল্লায়, সামাজিক, ধর্মীয় পর্যায়ে সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল তৈরিতে যোগ্যতা বলে জাতীয়ভাবে পরিচিতি ও মর্যাদা লাভে ধন্য হয়। তখন পরিবেশ অনুকুল ও উন্নয়ত হলেই সুসভ্য নাগরিক হিসেবে খ্যাত হয়। এসব সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতার আলোকে উন্নত ও সুন্দর করেন জীবনের অধিকারী হওয়া যায়। রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা ফেলে দেশের স্বার্থে অনেক অবদান রাখতে সক্ষম তা নয় স্বজাতি ও সংস্কৃতির উন্নয়নে ও বিশ্ব পরিমন্ডলে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হবে। (চলবে)

 ড. জিনবোধি ভিক্ষু, অধ্যাপক, পালি বিভাগ, চ্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।


No comments

Theme images by 5ugarless. Powered by Blogger.