বিশ্বশান্তির পেক্ষাপটে; পার্বত্য চট্টগ্রামে সমসাময়িক বৌদ্ধ ধর্মীয় শিক্ষা, সংস্কৃতি ও জীবন
পূর্ব প্রকাশের পর
পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর পারিবারিক ধারা
এক বা একাধিকম মানুষের একত্রীভূতভাবে মিলিত হয়ে একত্রে বসবাসের মাধ্যমে পরিবার সৃষ্টি হয়। যেখানে স্বামী-স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, জন্মদাতা, পিতা-মাতা, দাদু-ঠাকুরমাদের বসবাস ঘটে। পরিবারে সকল সদ্যদের মধ্যে বুঝাপড়া, নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে আন্তরিক হলে পরিবার, স্ন্দুর ও সৃশৃঙ্খল হয় এবং সার্বিক উন্নয়নে একে অপরের পরিপূরক হিসেবে স্ব-স্ব দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে এগিয়ে আসলে পর পর উন্নত ও গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। আলোকিত পরিবার ছাড়া সমাজ জীবন গঠন করা অসম্ভব। সমাজ বিনির্মাণের প্রথম সোপান হল পরিবার। পরিবার যদি উচ্চ শিক্ষিত উন্নত হয় সমাজ গঠনে দৃষ্টান্ত স্বরূপ হয়। তাই পিতা-মাতাকে যেমন নৈতিক শিক্ষায় সুশিক্ষিত এবং ধার্মিক হলে পরিবার সুখী সমৃদ্ধি ও শান্তিময় জীবন যাপনে সক্ষম হয়। এটাই বর্তমান সময়ে বেশি প্রয়োজন। জন্ম দাতা পিতামাতা হিসেবে নিজেদের ছেলেমেয়েদের গঠন এবং রক্ষা করার দায়দায়িত্ব সম্পর্কে অবশ্যই সচেতন হতে হবে। নতুবা পারিবারিক অস্তিত্ব ঠিকে রাথা কঠিন হবে। ছেলেমেয়েদের জীবনে আধুনিক শিক্ষা খুবই জুরুরী। অনেক সময় পরিবেশ ও পরিস্থিতির কারণে পিতামাতা উচ্চশিক্ষিত না হলেও শিক্ষানুরাগীতা ও স্বশিক্ষার সুশিক্ষিত হওয়াই সন্তান-সন্তুতি গঠনে অত্যন্ত কঠোর শাসক হিনেবে দায়িত্ব পালনে সচেতনতা পরিলক্ষিত হতে দেখা যায়। সে পরিবার অন্য পরিবার অন্য দশজনের চেয়ে একটু আলাদা এবং আচার আচরণে উন্নত স¦ভাবের হয়। তাই পরিবার যেমন উন্নত হয় এবং পিতামাতা সুখী যেমন হয় এবং ছেলে মেয়েরা পরিবারের যোগ্য উত্তসুরী হিসেবে যাবতীয় করণীয় কর্তব্য সম্পাদনীয় নিষ্ঠাবান হতে দেখো যায়। এখানেই পরিবারের সফলতা। আরো বেশী সফল হয় যদি দৈনন্দিন জীবন যাত্রাকালীন সময়ে ধর্মীয় নৈতিক শিক্ষায় সুশিক্ষিত করা গুরুপূজা গুরুশিক্ষা এবং জন্মদাতা পিতামাতার প্রতিমান্য ও শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্ঠি করা যায়। পারিবারিক উন্নতি ও উচ্চ শিক্ষায় মাধ্যমে সুখশান্তি আননয়ন যেমন সহজ হয় তেমনি সামাজিক সুখশান্তি অনেকটা নির্ভর করে। বাল্যকাল থেকে এভাবে জীবন গঠন করার সুযোগ ফেলে বড় হলেও সে আর্দশ রক্ষিত হয়। বেশী ভাগ ক্ষেত্রে জুম চাষ বয়ান শিল্পে আয়ের উপর জীবন জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। গুটি কয়েকজন ব্যবসা বানিজ্যের মাধ্যমে অর্থণেতিক সচ্ছলতা আনয়ন করে থাকেন। আর্দশ ও ধার্মিক পরিবার থেকে আদর্শ সন্তার তৈরী হয়।
পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ধারা
উন্নত সাংস্কৃতিক চর্চা মাত্রই উন্নত মানস গঠন করা। মুক্ত সংস্কৃতি ছাড়া নতুন কিছু সৃষ্টি করা যায় না। মুক্ত সাংস্কৃতিক চর্চায় মানুষের মন-মানসিকতা অনেক উন্নত এবং প্রসারিত হয়। মানুষের প্রতি মানুষের আন্তরিক ভালোবাসা গভীর সম্প্রীতি এবং নৈকট্যপূর্ণ হয়ে উঠে। সংস্কৃতি এমন এক সৃষ্টি যা দেশপ্রেম এবং স্বজাতি প্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। যোগ্য উত্তরসূরী তৈরিতে সহায়ক হয়। সভ্যতার ক্রমবিকাশে মুক্ত সংস্কৃতি চর্চার বিফলতা নেই। মুক্ত সংস্কৃতি চর্চা মানে নব নব সৃষ্টি। যা আলোকিত সমাজ বিনির্মাণে সহায়ক হয়। মান্যতা ও শ্রদ্ধাবোধ জাগায়। সুসভ্য জাতি গঠনে ভূমিকা রাখে। প্রাকৃতিক সম্পদ বাঁশ ও গাছ দ্বারা তারা বাদ্যযন্ত্রগুলো তৈরি করে। বনজ সম্পদগুলো তাদের সংস্কৃতিকে সম্দৃ করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সহায়তা করে। একদিকে অর্থনৈতিক উন্নতি এবং নিজস্ব সংস্কৃতি রক্ষা এবং পৃষ্ঠপোষকতা দান করার নতুন নতুন পরিবেশ তৈরি হলে পরস্পরের মধ্যে আন্তরিক ভালোবাসা ও সম্প্রীতি আরও সুদৃঢ় হয়। গান, নাটক, কৌতুক, কীর্তন, যাত্রা গান, গীতিনাট্য, নাচ ইত্যাদিই সাংস্কৃতির অঙ্গ। এগুলি রচনা করা পরিবেশন করা এবং অন্যকে শিক্ষার সুব্যবস্থা করা। প্রশ্ষিণ কেন্দ্রের মাধ্যমে যোগ্য উত্তরসুরী তৈরী করা। অঞ্চলের, মহল্লায়, সামাজিক অনুষ্ঠানে, ধর্মীয় ও বিভিন্ন সাংগঠনিক কার্যক্রমে এবং জাতীয় পর্যায়ে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড পরিবেশিত হয়ে থাকে। নিজস্ব মেধা, মননশীল অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাগুণে অনেকে জাতীয়ভাবে পরিচিতি ও মর্যদা লাভেরও ধন্য হয়। তখন পরিবেশ অনুকুল ওউন্নত হলেই সুসভ্য নাগরিক হিসেবে খ্যাত হয়। এই সব সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতার আলোকে নন্দিতও বরণ্য জীবনের অধিকারী হওয়া যায়।
প্রত্যক জাতি সত্ত্বার নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। চাকমা ও মারমাদের বার্ষিক উৎসব মহামুনি মেলা প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয়। বাংলা বর্ষের শেষে বৈসাবি উৎসব পালন করা। এটি পাহাড়িদের প্রধান সামাজিক উৎসব। কঠিন চীবর দান, বৈশাখী পূর্ণিমা প্রধান ধর্মী উৎসব। পুরুষরা ধুতি ও জামা পরে। তবে বর্তমানে এসব পরতে খুব কমই দেখা যায়। মাথায় পরে খবং নারীরা নিম্নাঙ্গে পরে পিনন বক্ষে খাদি তারা শাড়ী ব্লাউজও পরে। নারীরা উৎকৃষ্ট বুনন শিল্পী। তারা হাতের তৈরী নানা কারুকাজ খচিত বস্ত্র বোনে যার নাম আলাম। বাঁেশর বাঁশি তাদের প্রধান বাদ্য যন্ত্র, যাতে তারা তোলে প্রেমাবেগের কাতরতার সুর। তাদের প্রিয় ও প্রধান মহাকাব্যের বিষয় রাধামোহন ও ধনপতির বিরহ বিধুর প্রেম।
পাবর্ত্য চট্টগ্রামে চাকমা জাতির উৎসব গুলো বৈচিত্রময়। এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলীও নয়নাভিরাম। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক দৃশ্যপটও বদলে যায়। সেই সঙ্গে মানুষের মনে শিহরণ জেগে উঠে প্রতি বছর কঠিনচীবর দান, শবদাহ, জাতর্কম, রাজপূর্ণাহ, থানমানা ও চৈত্র সংক্রান্তি বা নববর্ষ পালনের আগ্রহে। তারা যুগ যুগ ধরে উক্ত উৎসব প্রতি পালন করে আসতেছে বংশ পরম্পরা। সেই ধারা আজও প্রচলিত রয়েছে। নি¤েœ সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি আলোচনা করা গেল।
রাজ পুণ্যাহ্ : উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে ‘রাজপ্রথা’বিলুপ্ত হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে ঐতিহ্যবাহী ‘রাজাগণ’ এখনো সামাজিক প্রধান হিসেবে শাসন কাজ পরিচালনা করছেন। রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার ১৭৭টি মৌজা নিয়ে ‘চাকমা সার্কেল’ গঠিত। ‘রাজ পুন্যাহ্’ হলো এমন একটি অনুষ্ঠান যেখানে ‘চাকমা রাজা’রাজ দরবারে আনুষ্ঠানিকভাবে বসেন এবং হেডম্যানদের নিকট হতে খাজনা আদায় করেন। পূর্বে এ অনুষ্ঠান প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হত। এ অনুষ্ঠানে রাজার অধীনস্থ হেডম্যান ও কার্বারীগণ খাজনা পরিশোধের পাশাপাশি রাজাকে বিভিন্ন উপটোকন অর্পণ করেন।
বৈসাবি বা বিঝু : পাহাড়ি বৌদ্ধদের প্রধান সামাজিক উৎসব বৈসাবি। চৈত্র মাসের শেষ দিন, বৈশাখ মাসের প্রথম দিন ও দ্বিতীয় দিন মোট তিন দিন এ উৎসব পালন করা হয়। মূলতঃ তথাগত বুদ্ধের আর্বিভাব, বুদ্ধত্ব লাভ ও মহাপরিনির্বাণ এ ত্রিস্মৃতি বিজরিত দিন বৈশাখী পূর্ণিমাকে কেন্দ্র করেই এই বৈসাবি উৎসব পালন করা হয়। যদিও সম্রাট আকবর বাংলা সাল গণনার প্রবক্তা। কথিত আছে আগেকার দিনে প্রথমে অগ্রহায়ণ মাসকে অগ্র বা প্রথম মাস হিসেবে গণনা করা হত। ভগবান বুদ্ধের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানোর জন্যই বৈশাখ মাস অগ্র মাস হিসেবে গণনা করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে পবিত্র প্রবারণা পূর্ণিমা বিশাল ভাবে বান্দরবানে প্রতিবছর পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনালয়ে মাননীয় মন্ত্রী বীরবাহাদুর উশৈসিং মহোদয়ের উদ্যোগে মহাসমারোহে উদযাপন করা হয়। এই মহতি অনুষ্ঠানে সরকারী বেসরকারী উর্ধতন কর্মকর্তাসহ হিন্দু, মুসলিম এবং খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের হাজার হাজার লোক সমবেত হয়ে আতিথেয়তা গ্রহন করে থাকে। যা বৌদ্ধ ঐতিহ্যকে লালন করে থাকে।
এ বৈসাবি উৎসবে হিংসা, বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে বন্ধুতের বন্ধন দৃঢ় হয়। সম্প্রীতির বন্ধন আরো জড়ালো হয়। একে অপরের বাড়ীতে বেড়াতে যায় আনন্দ উল¬াস করে । কিন্তু বর্তমানে পাবর্ত্য চট্টগ্রামে রাজনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ হওয়াই উৎসবটি প্রাণ খুলে উদ্যাপন করতে পরতেছে না। এদিকে সেনাবাহিনীও বাঙ্গালি সেটেলার পাহাড়িদের উপর নিপিড়ন অন্যদিকে জেএসএস ও উইপিডিএফ মধ্যে ভাতৃত্ব ঘাটি সংঘাত । এ সমস্ত কারণে সঠিক ভাবে জীবন ধারণ অসম্ভ হয়ে পড়েছে। উৎসব কিভাবে পালন করবে।
পার্বত্য এলাকায় মারমাদের সবচেয়ে জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড হলো জলখেলা। যা জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে কাছেও আর্কষণীয় বলা যায়। তাছাড়াও বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং রাজাদের মৃত্যুর পর শেষকৃত্যানুষ্ঠানে অতি সম্মাণ ও গৌরবের সঙ্গে দৃষ্ঠি নন্দন কারুকার্য খচিত সুউচ্চ আলং তৈরী করে তরুন-তরুণীদের নিজস্ব পোসাকে সুসজ্জিত হয়ে ধর্মীয় নৃত্য পরিবেশনসহ শোভা যাত্রা সহকারে শশ্মান ভূমিতে নিয়ে গিয়ে দাহাকার্য সম্পন্ন করা হয়। এটা আরেকটি বৌদ্ধ সংস্কৃতির বৈশিষ্ঠ্য যা অন্যকোন সম্প্রদায়ের মধ্যে দেখা যায় না।
পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সামাজিক ধারা
মানুষ মাত্রই সমাজবদ্ধ জীব। সমাজেই মানুষের প্রকাশ ও ক্রমবিকাশ হয়। সমাজ ছাড়া একীভূত হওয়া অসম্ভব। এক এবং একাধিক সমস্যা তথা পরিবারে মহামিলনে সমাজ হয়। ব্যক্তি পরিবার সমাজ একে অপরের পরিপূরক, সহায়ক, সম্পূরক এবং হরিহর আত্মা। সামাজিকভাবে মহামিলন এবং আনন্দ অপূর্ব। এটা একটি মহাশক্তিও বটে। এই সমাজকে সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে সমাজ সুসংগঠিত হয়। তখন যিনি অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে আন্তরিকভাবে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয় তখন তিনি নেতৃত্বের আসেন সমীচিন হতে দেখা যায়। নেতৃত্ব স্থানে ক্ষমতার আস্ফালন নয় সামাজিক ন্যায় নীতি প্রতিপালনে সুন্দর পরিসামাজিক ন্যায় নীতি প্রতিপালনে সুন্দর পরিবেশ তৈরি করা। পরস্পর পরস্পরে মিলে মিশে থাকা, অপপদে বিপদে সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া, রোগে শোকে একে অপরকে দেখা শোনা করা, সামাজিক কর্মকান্ডে এগিয়ে আসা, সমাজকে সমুন্নত করার নানা কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সুবুদ্ধি ও সুপরামর্শ দেওয়া। অর্থনৈতিক উন্নয়নে নানা কার্যক্রমে শুরু করা। ব্যবসা বাণিজ্যে সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করা। সমাজ সুসংগঠিত এবং ঐক্যবদ্ধ যে কোনো সমস্যার মোকাবেলা করা সহজ হয়। নৈতিকভাবে সামাজিক দায় দায়িত্বের প্রতি আন্তরিক হওয়া। অগ্রজের প্রতি মান্যতা, শ্রদ্ধাবোধ ও সম্মান প্রদর্শন করা।
বুদ্ধের শিক্ষার মূলমন্ত্র হলো-বুদ্ধ, ধর্ম, সংঘ এই ত্রিরতেœর শরণ নিতে। এই ত্রিরতেœর মর্মবাণীর মধ্যে নিহিত রয়েছে ঈড়সসঁহরঃু বা সমাজের ধারণা। অর্থাৎ শুধুমাত্র বুদ্ধ, ধর্ম নয় সংঘ বা সমাজও হবে জীবনের মন্ত্র। আপন হতে বাহির হয়ে সকলের সঙ্গে চলতে হবে পথ, তবেই পৌঁছান যাগে সেই পরম লক্ষ্যে। বুদ্ধের ধর্মই প্রথম সংঘ বা মঠ বা বিহার স্থাপিত করে সমবেত সাধনার আদর্শ স্থাপন করে। সংঘ বৌদ্ধ শ্রামণদের সমাজ এবং সেই সংঘের ঙৎফবৎ বা শৃঙ্খলা হচ্ছে বুদ্ধ নির্দেশিত জীবন পদ্ধতি। বৌদ্ধ শ্রমণকে সংঘের শরণ নিতে হয় শুধুই মন্ত্র হিসেবে নয় – এই সংঘই তার সাধনায় ক্ষেত্র, সংঘই তার জীবন পথ রচনা করে। সংঘ জীবনের আরও একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে এখানে সহ সাধক বা অন্যান্য শ্রামণদের সঙ্গে একত্রে বাস করার ফলে পরস্পর প্রতি ¯েœহ, ভালবাসা ও ভ্রাতৃত্বভাব গড়ে ওঠে বা আত্মকেন্দ্রিকতার সংকীর্ণ পরিম-ল থেকে মুক্ত হতে সাহায্য করে। ফলে ব্যক্তিগত মোক্ষ নয়, সমবেত নির্বাণ লাভ তার আদর্শ হয়ে ওঠে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সংঘ বা শ্রামণদের সমাজের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সমাজের সম্পর্ক কি? সংঘ কি সাধারণ মানুষের সমাজ থেকে একেবারেই স্বতন্ত্রভাবে থাকবে? না, – সাধারণ মানুষ বুদ্ধের সমাজ পরিকল্পনা থেকে বহির্ভূত নয়, – সংঘ এবং সাধারণ মানুষকে নিয়েই গঠিত হবে সমাজ। ত্রিরতেœর ‘বুদ্ধ’ এবং ‘ধম্মের’ কোন প্রত্যক্ষ প্রভাব বা সম্পর্ক সাধারণ মানুষের জীবনে সম্যকরূপে আলোকপাত নাও করতে পারে। কিন্তু সংঘ ও সাধারণ মানুষের সমাজ থাকে পাশাপাশি। স্বভাবতই সংঘ জীবনের উচ্চ আদর্শ ও শৃঙ্খলার প্রভাব সমাজ জীবনের প্রত্যেক স্তরে ছড়িয়ে পড়ে সহজে। সংঘ জীবনে যে শীলের অনুশীলন হয় তা সাধারণ মানুষের গৃহস্থ জীবনেও বিস্তৃত হতে থাকে। এইভাবে ধীরে ধীরে এক বৃহত্তর বৌদ্ধ সমাজ গড়ে ওঠে এবং শ্রামণ ও গৃহস্থ সকলেই শীল অনুশীলন করতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। সংঘ এবং গৃহস্থ সমাজ তখন পরস্পরের সহায়ক ও পরিপূরকরূপে কাজ করে। একদিকে সমাজের সাধারণ গৃহস্থরা সংঘের শ্রামণদের জীবন ধারণের ন্যূনতম চাহিদার বস্তু অন্ন দান দিয়ে, আতিথেয়তা প্রদর্শন করে কর্তব্য পালন করে। অন্যদিকে তেমনি সংঘের শ্রামণরাও সেই গৃহস্থ মানুষের জীবনে ধর্ম প্রবর্তকের ভূমিকা গ্রহণ করে, তাদের জীবনে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করে, তাদের সৎ পথে পরিচালিত করে। এইভাবে গড়ে ওঠে এক ন্যায় নিষ্ঠ ও সৎ সমাজ ব্যবস্থা, যেখানে বিরাজ করে শুধু শান্তি ও আনন্দ। সেই আনন্দময় সমাজের ভিত্তি হবে মৈত্রী ও প্রেম-সমস্ত প্রাণী জগতের প্রতি ভালবাসা। এখানে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য উল্লেখ করা যায়, “বিশেষ স্থানে গিয়ে, বিশেষ মন্ত্র পড়ে, বিশেষ অনুষ্ঠান করে মুক্তি লাভ করা যায়, এই বিশ^াসের অরণ্যে যখন মানুষ পথ হারিয়েছিল তখন বুদ্ধদেব এই অত্যন্ত সহজ কথটি আবিষ্কার ও প্রচার করবার জন্য এসেছিলেন যে, স্বার্থ ত্যাগ করে, সর্বভূতে দয়া বিস্তার করে, অন্তর থেকে বাসনাকে ক্ষয় করে ফেললে তবেই মুক্তি হয়, কোন স্থানে গেলে, বা জলে ¯œান করলে, বা অগ্নিতে আহুতি দিলে, বা মন্ত্র উচ্চারণ করলে হয় না। এই কথাটি শুনতে সরল, কিন্তু এই কথাটির জন্য একটি রাজপুত্রকে তার রাজ্যত্যাগ করে বনে বনে, পথে পথে, ফিরতে হয়েছে।’ এ কথা নিশ্চয়ই স্বীকার করতে হয় যে, “বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে জনসাধারণের প্রতি শ্রদ্ধা প্রবল হয়ে প্রকাশ পেয়েছে; এর মধ্যে শুধু মানুষের নয়, অন্য জীবেরও যথেষ্ট স্থান আছে।’ এভাবে বুদ্ধের ধর্মীয় মুক্ত চিন্তা চেতা নায় তাদের সামাজিক জীবন গঠনে আপ্রাণ চেষ্ঠা চালিয়ে যাচ্ছেন বলা যায়। অতীতের তুলনায় বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপট অনেকটা উন্নত বলা চলে।
পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর রাষ্ট্রীয় ধারা
পরিবার, সমাজ, সংগঠন এবং রাষ্ট্র সবই কিন্তু ব্যক্তি ও পরিবার থেকে গোড়াপত্তন হয়। সংখ্যাধিক্য সমাজ ব্যবস্থার সংগঠন তৈরি হয়। এর পরিব্যাপ্তিতে রাষ্ট্র বা দেশ গঠনের পরিকল্পনার সূত্রপাত। এই সামাজিক ন্যায় নীতি ও আদর্শ থেকে রাষ্ট্রেয় পরিকল্পনার সূত্রটি খুঁজে পাওয়া যায়। এই সামাজিক আদর্শ থেকেই রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার সূত্রটি খুঁজে পাওয়া যায়। রাষ্ট্র এক বৃহত্তর সমাজ ব্যবস্থা। যদি একটি ছোট গ্রাম বা জনপদ বুদ্ধ নির্দেশিত জীবন পদ্ধতি অনুসরণ করে শান্তি ও আনন্দের আবাস হয়ে উঠতে পারে তবে তা কোন রাজ্য রাষ্ট্র তথা বৃহত্তর সমাজের ক্ষেত্রেই বা অসম্ভব হবে কেন? যে বুদ্ধ সমগ্র প্রাণী জগতের নির্বাণ কামনা করেন তাঁর পক্ষে তাই একটি সর্ব জাগতিক বা সার্বভৌম রাষ্ট্র ব্যবস্থার পরিকল্পনা অত্যন্ত স্বাভাবিক। ঐতিহাসিকদের মতে, বুদ্ধ-সমকালীন ভারতবর্ষে প্রধানত: দুই ধরনের রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল, – রাজতন্ত্র এবং প্রজাতন্ত্র। কিন্তু বৌদ্ধধর্মে শাসন ব্যবস্থার প্রকার বা ধরণ অথবা কোন রাষ্ট্রনৈতিক তত্ত্বের কথা আলোচনা করা হয়নি। বুদ্ধ উপলব্ধি করেছিলেন যে কোন দেশের সামাজিক ও নৈতিক পুনর্গঠন করতে হলে সেই রাজ্যে একটি স্থিতিশীল ও সৎ সরকার থাকা প্রয়োজন। তাঁর প্রথম বক্তব্য ছিল এই যে দেশে এমন রাজা বা এমন শাসক থাকবেন যিনি নৈতিক ও আধ্যত্মিক আইন প্রণয়ন করে সমস্ত সমাজে এক সৎ পরিবেশ গড়ে তুলতে প্রয়াসী হবেন এবং যেখানে শ্রামণগণ ও সাধারণ মানুষ বাধাহীনভাবে ‘ধম্ম’ অনুসরণ করে নির্বাণের পথে অগ্রসর হতে পারবে। ঐতিহাসিক তথ্যে পাওয়া যায় যে বুদ্ধ তাঁর জীবদ্দশায় অনেক রাজ দরবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন। বিশেষত: কোশল ও মগধের রাজারা যে শুধু বুদ্ধের পৃষ্ঠপোষক ও সহায়ক ছিলেন তাই নয়, তাঁরা তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে নিজেদের জীবনেও শীল পালন করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। রাজা বা শাসক এবং জনসাধারণের মধ্যে যদি কোন মহৎ আদর্শ সম্বন্ধে বিরোধ না থাকে তবে সেই আদর্শ সহজেই সমাজের সর্বস্তর বিস্তৃতি লাভ করতে পারে। এই বিষয়ে Trevor Ling আরও বলেছেন,
পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর পারিবারিক ধারা
এক বা একাধিকম মানুষের একত্রীভূতভাবে মিলিত হয়ে একত্রে বসবাসের মাধ্যমে পরিবার সৃষ্টি হয়। যেখানে স্বামী-স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, জন্মদাতা, পিতা-মাতা, দাদু-ঠাকুরমাদের বসবাস ঘটে। পরিবারে সকল সদ্যদের মধ্যে বুঝাপড়া, নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে আন্তরিক হলে পরিবার, স্ন্দুর ও সৃশৃঙ্খল হয় এবং সার্বিক উন্নয়নে একে অপরের পরিপূরক হিসেবে স্ব-স্ব দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে এগিয়ে আসলে পর পর উন্নত ও গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। আলোকিত পরিবার ছাড়া সমাজ জীবন গঠন করা অসম্ভব। সমাজ বিনির্মাণের প্রথম সোপান হল পরিবার। পরিবার যদি উচ্চ শিক্ষিত উন্নত হয় সমাজ গঠনে দৃষ্টান্ত স্বরূপ হয়। তাই পিতা-মাতাকে যেমন নৈতিক শিক্ষায় সুশিক্ষিত এবং ধার্মিক হলে পরিবার সুখী সমৃদ্ধি ও শান্তিময় জীবন যাপনে সক্ষম হয়। এটাই বর্তমান সময়ে বেশি প্রয়োজন। জন্ম দাতা পিতামাতা হিসেবে নিজেদের ছেলেমেয়েদের গঠন এবং রক্ষা করার দায়দায়িত্ব সম্পর্কে অবশ্যই সচেতন হতে হবে। নতুবা পারিবারিক অস্তিত্ব ঠিকে রাথা কঠিন হবে। ছেলেমেয়েদের জীবনে আধুনিক শিক্ষা খুবই জুরুরী। অনেক সময় পরিবেশ ও পরিস্থিতির কারণে পিতামাতা উচ্চশিক্ষিত না হলেও শিক্ষানুরাগীতা ও স্বশিক্ষার সুশিক্ষিত হওয়াই সন্তান-সন্তুতি গঠনে অত্যন্ত কঠোর শাসক হিনেবে দায়িত্ব পালনে সচেতনতা পরিলক্ষিত হতে দেখা যায়। সে পরিবার অন্য পরিবার অন্য দশজনের চেয়ে একটু আলাদা এবং আচার আচরণে উন্নত স¦ভাবের হয়। তাই পরিবার যেমন উন্নত হয় এবং পিতামাতা সুখী যেমন হয় এবং ছেলে মেয়েরা পরিবারের যোগ্য উত্তসুরী হিসেবে যাবতীয় করণীয় কর্তব্য সম্পাদনীয় নিষ্ঠাবান হতে দেখো যায়। এখানেই পরিবারের সফলতা। আরো বেশী সফল হয় যদি দৈনন্দিন জীবন যাত্রাকালীন সময়ে ধর্মীয় নৈতিক শিক্ষায় সুশিক্ষিত করা গুরুপূজা গুরুশিক্ষা এবং জন্মদাতা পিতামাতার প্রতিমান্য ও শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্ঠি করা যায়। পারিবারিক উন্নতি ও উচ্চ শিক্ষায় মাধ্যমে সুখশান্তি আননয়ন যেমন সহজ হয় তেমনি সামাজিক সুখশান্তি অনেকটা নির্ভর করে। বাল্যকাল থেকে এভাবে জীবন গঠন করার সুযোগ ফেলে বড় হলেও সে আর্দশ রক্ষিত হয়। বেশী ভাগ ক্ষেত্রে জুম চাষ বয়ান শিল্পে আয়ের উপর জীবন জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। গুটি কয়েকজন ব্যবসা বানিজ্যের মাধ্যমে অর্থণেতিক সচ্ছলতা আনয়ন করে থাকেন। আর্দশ ও ধার্মিক পরিবার থেকে আদর্শ সন্তার তৈরী হয়।
পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ধারা
উন্নত সাংস্কৃতিক চর্চা মাত্রই উন্নত মানস গঠন করা। মুক্ত সংস্কৃতি ছাড়া নতুন কিছু সৃষ্টি করা যায় না। মুক্ত সাংস্কৃতিক চর্চায় মানুষের মন-মানসিকতা অনেক উন্নত এবং প্রসারিত হয়। মানুষের প্রতি মানুষের আন্তরিক ভালোবাসা গভীর সম্প্রীতি এবং নৈকট্যপূর্ণ হয়ে উঠে। সংস্কৃতি এমন এক সৃষ্টি যা দেশপ্রেম এবং স্বজাতি প্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। যোগ্য উত্তরসূরী তৈরিতে সহায়ক হয়। সভ্যতার ক্রমবিকাশে মুক্ত সংস্কৃতি চর্চার বিফলতা নেই। মুক্ত সংস্কৃতি চর্চা মানে নব নব সৃষ্টি। যা আলোকিত সমাজ বিনির্মাণে সহায়ক হয়। মান্যতা ও শ্রদ্ধাবোধ জাগায়। সুসভ্য জাতি গঠনে ভূমিকা রাখে। প্রাকৃতিক সম্পদ বাঁশ ও গাছ দ্বারা তারা বাদ্যযন্ত্রগুলো তৈরি করে। বনজ সম্পদগুলো তাদের সংস্কৃতিকে সম্দৃ করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সহায়তা করে। একদিকে অর্থনৈতিক উন্নতি এবং নিজস্ব সংস্কৃতি রক্ষা এবং পৃষ্ঠপোষকতা দান করার নতুন নতুন পরিবেশ তৈরি হলে পরস্পরের মধ্যে আন্তরিক ভালোবাসা ও সম্প্রীতি আরও সুদৃঢ় হয়। গান, নাটক, কৌতুক, কীর্তন, যাত্রা গান, গীতিনাট্য, নাচ ইত্যাদিই সাংস্কৃতির অঙ্গ। এগুলি রচনা করা পরিবেশন করা এবং অন্যকে শিক্ষার সুব্যবস্থা করা। প্রশ্ষিণ কেন্দ্রের মাধ্যমে যোগ্য উত্তরসুরী তৈরী করা। অঞ্চলের, মহল্লায়, সামাজিক অনুষ্ঠানে, ধর্মীয় ও বিভিন্ন সাংগঠনিক কার্যক্রমে এবং জাতীয় পর্যায়ে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড পরিবেশিত হয়ে থাকে। নিজস্ব মেধা, মননশীল অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাগুণে অনেকে জাতীয়ভাবে পরিচিতি ও মর্যদা লাভেরও ধন্য হয়। তখন পরিবেশ অনুকুল ওউন্নত হলেই সুসভ্য নাগরিক হিসেবে খ্যাত হয়। এই সব সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতার আলোকে নন্দিতও বরণ্য জীবনের অধিকারী হওয়া যায়।
প্রত্যক জাতি সত্ত্বার নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। চাকমা ও মারমাদের বার্ষিক উৎসব মহামুনি মেলা প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয়। বাংলা বর্ষের শেষে বৈসাবি উৎসব পালন করা। এটি পাহাড়িদের প্রধান সামাজিক উৎসব। কঠিন চীবর দান, বৈশাখী পূর্ণিমা প্রধান ধর্মী উৎসব। পুরুষরা ধুতি ও জামা পরে। তবে বর্তমানে এসব পরতে খুব কমই দেখা যায়। মাথায় পরে খবং নারীরা নিম্নাঙ্গে পরে পিনন বক্ষে খাদি তারা শাড়ী ব্লাউজও পরে। নারীরা উৎকৃষ্ট বুনন শিল্পী। তারা হাতের তৈরী নানা কারুকাজ খচিত বস্ত্র বোনে যার নাম আলাম। বাঁেশর বাঁশি তাদের প্রধান বাদ্য যন্ত্র, যাতে তারা তোলে প্রেমাবেগের কাতরতার সুর। তাদের প্রিয় ও প্রধান মহাকাব্যের বিষয় রাধামোহন ও ধনপতির বিরহ বিধুর প্রেম।
পাবর্ত্য চট্টগ্রামে চাকমা জাতির উৎসব গুলো বৈচিত্রময়। এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলীও নয়নাভিরাম। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক দৃশ্যপটও বদলে যায়। সেই সঙ্গে মানুষের মনে শিহরণ জেগে উঠে প্রতি বছর কঠিনচীবর দান, শবদাহ, জাতর্কম, রাজপূর্ণাহ, থানমানা ও চৈত্র সংক্রান্তি বা নববর্ষ পালনের আগ্রহে। তারা যুগ যুগ ধরে উক্ত উৎসব প্রতি পালন করে আসতেছে বংশ পরম্পরা। সেই ধারা আজও প্রচলিত রয়েছে। নি¤েœ সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি আলোচনা করা গেল।
রাজ পুণ্যাহ্ : উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে ‘রাজপ্রথা’বিলুপ্ত হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে ঐতিহ্যবাহী ‘রাজাগণ’ এখনো সামাজিক প্রধান হিসেবে শাসন কাজ পরিচালনা করছেন। রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার ১৭৭টি মৌজা নিয়ে ‘চাকমা সার্কেল’ গঠিত। ‘রাজ পুন্যাহ্’ হলো এমন একটি অনুষ্ঠান যেখানে ‘চাকমা রাজা’রাজ দরবারে আনুষ্ঠানিকভাবে বসেন এবং হেডম্যানদের নিকট হতে খাজনা আদায় করেন। পূর্বে এ অনুষ্ঠান প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হত। এ অনুষ্ঠানে রাজার অধীনস্থ হেডম্যান ও কার্বারীগণ খাজনা পরিশোধের পাশাপাশি রাজাকে বিভিন্ন উপটোকন অর্পণ করেন।
বৈসাবি বা বিঝু : পাহাড়ি বৌদ্ধদের প্রধান সামাজিক উৎসব বৈসাবি। চৈত্র মাসের শেষ দিন, বৈশাখ মাসের প্রথম দিন ও দ্বিতীয় দিন মোট তিন দিন এ উৎসব পালন করা হয়। মূলতঃ তথাগত বুদ্ধের আর্বিভাব, বুদ্ধত্ব লাভ ও মহাপরিনির্বাণ এ ত্রিস্মৃতি বিজরিত দিন বৈশাখী পূর্ণিমাকে কেন্দ্র করেই এই বৈসাবি উৎসব পালন করা হয়। যদিও সম্রাট আকবর বাংলা সাল গণনার প্রবক্তা। কথিত আছে আগেকার দিনে প্রথমে অগ্রহায়ণ মাসকে অগ্র বা প্রথম মাস হিসেবে গণনা করা হত। ভগবান বুদ্ধের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানোর জন্যই বৈশাখ মাস অগ্র মাস হিসেবে গণনা করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে পবিত্র প্রবারণা পূর্ণিমা বিশাল ভাবে বান্দরবানে প্রতিবছর পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনালয়ে মাননীয় মন্ত্রী বীরবাহাদুর উশৈসিং মহোদয়ের উদ্যোগে মহাসমারোহে উদযাপন করা হয়। এই মহতি অনুষ্ঠানে সরকারী বেসরকারী উর্ধতন কর্মকর্তাসহ হিন্দু, মুসলিম এবং খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের হাজার হাজার লোক সমবেত হয়ে আতিথেয়তা গ্রহন করে থাকে। যা বৌদ্ধ ঐতিহ্যকে লালন করে থাকে।
এ বৈসাবি উৎসবে হিংসা, বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে বন্ধুতের বন্ধন দৃঢ় হয়। সম্প্রীতির বন্ধন আরো জড়ালো হয়। একে অপরের বাড়ীতে বেড়াতে যায় আনন্দ উল¬াস করে । কিন্তু বর্তমানে পাবর্ত্য চট্টগ্রামে রাজনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ হওয়াই উৎসবটি প্রাণ খুলে উদ্যাপন করতে পরতেছে না। এদিকে সেনাবাহিনীও বাঙ্গালি সেটেলার পাহাড়িদের উপর নিপিড়ন অন্যদিকে জেএসএস ও উইপিডিএফ মধ্যে ভাতৃত্ব ঘাটি সংঘাত । এ সমস্ত কারণে সঠিক ভাবে জীবন ধারণ অসম্ভ হয়ে পড়েছে। উৎসব কিভাবে পালন করবে।
পার্বত্য এলাকায় মারমাদের সবচেয়ে জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড হলো জলখেলা। যা জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে কাছেও আর্কষণীয় বলা যায়। তাছাড়াও বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং রাজাদের মৃত্যুর পর শেষকৃত্যানুষ্ঠানে অতি সম্মাণ ও গৌরবের সঙ্গে দৃষ্ঠি নন্দন কারুকার্য খচিত সুউচ্চ আলং তৈরী করে তরুন-তরুণীদের নিজস্ব পোসাকে সুসজ্জিত হয়ে ধর্মীয় নৃত্য পরিবেশনসহ শোভা যাত্রা সহকারে শশ্মান ভূমিতে নিয়ে গিয়ে দাহাকার্য সম্পন্ন করা হয়। এটা আরেকটি বৌদ্ধ সংস্কৃতির বৈশিষ্ঠ্য যা অন্যকোন সম্প্রদায়ের মধ্যে দেখা যায় না।
পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সামাজিক ধারা
মানুষ মাত্রই সমাজবদ্ধ জীব। সমাজেই মানুষের প্রকাশ ও ক্রমবিকাশ হয়। সমাজ ছাড়া একীভূত হওয়া অসম্ভব। এক এবং একাধিক সমস্যা তথা পরিবারে মহামিলনে সমাজ হয়। ব্যক্তি পরিবার সমাজ একে অপরের পরিপূরক, সহায়ক, সম্পূরক এবং হরিহর আত্মা। সামাজিকভাবে মহামিলন এবং আনন্দ অপূর্ব। এটা একটি মহাশক্তিও বটে। এই সমাজকে সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে সমাজ সুসংগঠিত হয়। তখন যিনি অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে আন্তরিকভাবে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয় তখন তিনি নেতৃত্বের আসেন সমীচিন হতে দেখা যায়। নেতৃত্ব স্থানে ক্ষমতার আস্ফালন নয় সামাজিক ন্যায় নীতি প্রতিপালনে সুন্দর পরিসামাজিক ন্যায় নীতি প্রতিপালনে সুন্দর পরিবেশ তৈরি করা। পরস্পর পরস্পরে মিলে মিশে থাকা, অপপদে বিপদে সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া, রোগে শোকে একে অপরকে দেখা শোনা করা, সামাজিক কর্মকান্ডে এগিয়ে আসা, সমাজকে সমুন্নত করার নানা কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সুবুদ্ধি ও সুপরামর্শ দেওয়া। অর্থনৈতিক উন্নয়নে নানা কার্যক্রমে শুরু করা। ব্যবসা বাণিজ্যে সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করা। সমাজ সুসংগঠিত এবং ঐক্যবদ্ধ যে কোনো সমস্যার মোকাবেলা করা সহজ হয়। নৈতিকভাবে সামাজিক দায় দায়িত্বের প্রতি আন্তরিক হওয়া। অগ্রজের প্রতি মান্যতা, শ্রদ্ধাবোধ ও সম্মান প্রদর্শন করা।
বুদ্ধের শিক্ষার মূলমন্ত্র হলো-বুদ্ধ, ধর্ম, সংঘ এই ত্রিরতেœর শরণ নিতে। এই ত্রিরতেœর মর্মবাণীর মধ্যে নিহিত রয়েছে ঈড়সসঁহরঃু বা সমাজের ধারণা। অর্থাৎ শুধুমাত্র বুদ্ধ, ধর্ম নয় সংঘ বা সমাজও হবে জীবনের মন্ত্র। আপন হতে বাহির হয়ে সকলের সঙ্গে চলতে হবে পথ, তবেই পৌঁছান যাগে সেই পরম লক্ষ্যে। বুদ্ধের ধর্মই প্রথম সংঘ বা মঠ বা বিহার স্থাপিত করে সমবেত সাধনার আদর্শ স্থাপন করে। সংঘ বৌদ্ধ শ্রামণদের সমাজ এবং সেই সংঘের ঙৎফবৎ বা শৃঙ্খলা হচ্ছে বুদ্ধ নির্দেশিত জীবন পদ্ধতি। বৌদ্ধ শ্রমণকে সংঘের শরণ নিতে হয় শুধুই মন্ত্র হিসেবে নয় – এই সংঘই তার সাধনায় ক্ষেত্র, সংঘই তার জীবন পথ রচনা করে। সংঘ জীবনের আরও একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে এখানে সহ সাধক বা অন্যান্য শ্রামণদের সঙ্গে একত্রে বাস করার ফলে পরস্পর প্রতি ¯েœহ, ভালবাসা ও ভ্রাতৃত্বভাব গড়ে ওঠে বা আত্মকেন্দ্রিকতার সংকীর্ণ পরিম-ল থেকে মুক্ত হতে সাহায্য করে। ফলে ব্যক্তিগত মোক্ষ নয়, সমবেত নির্বাণ লাভ তার আদর্শ হয়ে ওঠে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সংঘ বা শ্রামণদের সমাজের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সমাজের সম্পর্ক কি? সংঘ কি সাধারণ মানুষের সমাজ থেকে একেবারেই স্বতন্ত্রভাবে থাকবে? না, – সাধারণ মানুষ বুদ্ধের সমাজ পরিকল্পনা থেকে বহির্ভূত নয়, – সংঘ এবং সাধারণ মানুষকে নিয়েই গঠিত হবে সমাজ। ত্রিরতেœর ‘বুদ্ধ’ এবং ‘ধম্মের’ কোন প্রত্যক্ষ প্রভাব বা সম্পর্ক সাধারণ মানুষের জীবনে সম্যকরূপে আলোকপাত নাও করতে পারে। কিন্তু সংঘ ও সাধারণ মানুষের সমাজ থাকে পাশাপাশি। স্বভাবতই সংঘ জীবনের উচ্চ আদর্শ ও শৃঙ্খলার প্রভাব সমাজ জীবনের প্রত্যেক স্তরে ছড়িয়ে পড়ে সহজে। সংঘ জীবনে যে শীলের অনুশীলন হয় তা সাধারণ মানুষের গৃহস্থ জীবনেও বিস্তৃত হতে থাকে। এইভাবে ধীরে ধীরে এক বৃহত্তর বৌদ্ধ সমাজ গড়ে ওঠে এবং শ্রামণ ও গৃহস্থ সকলেই শীল অনুশীলন করতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। সংঘ এবং গৃহস্থ সমাজ তখন পরস্পরের সহায়ক ও পরিপূরকরূপে কাজ করে। একদিকে সমাজের সাধারণ গৃহস্থরা সংঘের শ্রামণদের জীবন ধারণের ন্যূনতম চাহিদার বস্তু অন্ন দান দিয়ে, আতিথেয়তা প্রদর্শন করে কর্তব্য পালন করে। অন্যদিকে তেমনি সংঘের শ্রামণরাও সেই গৃহস্থ মানুষের জীবনে ধর্ম প্রবর্তকের ভূমিকা গ্রহণ করে, তাদের জীবনে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করে, তাদের সৎ পথে পরিচালিত করে। এইভাবে গড়ে ওঠে এক ন্যায় নিষ্ঠ ও সৎ সমাজ ব্যবস্থা, যেখানে বিরাজ করে শুধু শান্তি ও আনন্দ। সেই আনন্দময় সমাজের ভিত্তি হবে মৈত্রী ও প্রেম-সমস্ত প্রাণী জগতের প্রতি ভালবাসা। এখানে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য উল্লেখ করা যায়, “বিশেষ স্থানে গিয়ে, বিশেষ মন্ত্র পড়ে, বিশেষ অনুষ্ঠান করে মুক্তি লাভ করা যায়, এই বিশ^াসের অরণ্যে যখন মানুষ পথ হারিয়েছিল তখন বুদ্ধদেব এই অত্যন্ত সহজ কথটি আবিষ্কার ও প্রচার করবার জন্য এসেছিলেন যে, স্বার্থ ত্যাগ করে, সর্বভূতে দয়া বিস্তার করে, অন্তর থেকে বাসনাকে ক্ষয় করে ফেললে তবেই মুক্তি হয়, কোন স্থানে গেলে, বা জলে ¯œান করলে, বা অগ্নিতে আহুতি দিলে, বা মন্ত্র উচ্চারণ করলে হয় না। এই কথাটি শুনতে সরল, কিন্তু এই কথাটির জন্য একটি রাজপুত্রকে তার রাজ্যত্যাগ করে বনে বনে, পথে পথে, ফিরতে হয়েছে।’ এ কথা নিশ্চয়ই স্বীকার করতে হয় যে, “বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে জনসাধারণের প্রতি শ্রদ্ধা প্রবল হয়ে প্রকাশ পেয়েছে; এর মধ্যে শুধু মানুষের নয়, অন্য জীবেরও যথেষ্ট স্থান আছে।’ এভাবে বুদ্ধের ধর্মীয় মুক্ত চিন্তা চেতা নায় তাদের সামাজিক জীবন গঠনে আপ্রাণ চেষ্ঠা চালিয়ে যাচ্ছেন বলা যায়। অতীতের তুলনায় বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপট অনেকটা উন্নত বলা চলে।
পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর রাষ্ট্রীয় ধারা
পরিবার, সমাজ, সংগঠন এবং রাষ্ট্র সবই কিন্তু ব্যক্তি ও পরিবার থেকে গোড়াপত্তন হয়। সংখ্যাধিক্য সমাজ ব্যবস্থার সংগঠন তৈরি হয়। এর পরিব্যাপ্তিতে রাষ্ট্র বা দেশ গঠনের পরিকল্পনার সূত্রপাত। এই সামাজিক ন্যায় নীতি ও আদর্শ থেকে রাষ্ট্রেয় পরিকল্পনার সূত্রটি খুঁজে পাওয়া যায়। এই সামাজিক আদর্শ থেকেই রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার সূত্রটি খুঁজে পাওয়া যায়। রাষ্ট্র এক বৃহত্তর সমাজ ব্যবস্থা। যদি একটি ছোট গ্রাম বা জনপদ বুদ্ধ নির্দেশিত জীবন পদ্ধতি অনুসরণ করে শান্তি ও আনন্দের আবাস হয়ে উঠতে পারে তবে তা কোন রাজ্য রাষ্ট্র তথা বৃহত্তর সমাজের ক্ষেত্রেই বা অসম্ভব হবে কেন? যে বুদ্ধ সমগ্র প্রাণী জগতের নির্বাণ কামনা করেন তাঁর পক্ষে তাই একটি সর্ব জাগতিক বা সার্বভৌম রাষ্ট্র ব্যবস্থার পরিকল্পনা অত্যন্ত স্বাভাবিক। ঐতিহাসিকদের মতে, বুদ্ধ-সমকালীন ভারতবর্ষে প্রধানত: দুই ধরনের রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল, – রাজতন্ত্র এবং প্রজাতন্ত্র। কিন্তু বৌদ্ধধর্মে শাসন ব্যবস্থার প্রকার বা ধরণ অথবা কোন রাষ্ট্রনৈতিক তত্ত্বের কথা আলোচনা করা হয়নি। বুদ্ধ উপলব্ধি করেছিলেন যে কোন দেশের সামাজিক ও নৈতিক পুনর্গঠন করতে হলে সেই রাজ্যে একটি স্থিতিশীল ও সৎ সরকার থাকা প্রয়োজন। তাঁর প্রথম বক্তব্য ছিল এই যে দেশে এমন রাজা বা এমন শাসক থাকবেন যিনি নৈতিক ও আধ্যত্মিক আইন প্রণয়ন করে সমস্ত সমাজে এক সৎ পরিবেশ গড়ে তুলতে প্রয়াসী হবেন এবং যেখানে শ্রামণগণ ও সাধারণ মানুষ বাধাহীনভাবে ‘ধম্ম’ অনুসরণ করে নির্বাণের পথে অগ্রসর হতে পারবে। ঐতিহাসিক তথ্যে পাওয়া যায় যে বুদ্ধ তাঁর জীবদ্দশায় অনেক রাজ দরবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন। বিশেষত: কোশল ও মগধের রাজারা যে শুধু বুদ্ধের পৃষ্ঠপোষক ও সহায়ক ছিলেন তাই নয়, তাঁরা তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে নিজেদের জীবনেও শীল পালন করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। রাজা বা শাসক এবং জনসাধারণের মধ্যে যদি কোন মহৎ আদর্শ সম্বন্ধে বিরোধ না থাকে তবে সেই আদর্শ সহজেই সমাজের সর্বস্তর বিস্তৃতি লাভ করতে পারে। এই বিষয়ে Trevor Ling আরও বলেছেন,
‘a really enlightened monarchy, sympathetic to
Buddhism might have the further important, positive function of providing those
conditions and of helping to creat those attitudes among the people which would
facilitate the wide-spread acceptance of Buddhist prescription.” রাজা এবং জনসাধারণের মধ্যে এই পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সহযোগিতা ধর্মের প্রচার ও প্রসারের পথ সুগম করে তোলে।
একবার গৌতম বুদ্ধ তাঁর শিষ্যদের কাছে উপদেশ দেবার সময় বলেন যে রাজ্যের রাজা যদি অসৎ হন তার মন্ত্রীবর্গ ও অন্যান্য কর্মচারীগণও অসৎ হয়ে ওঠে। মন্ত্রী ও কর্মচারীগণ অসৎ হলে তার প্রভাব সমস্ত সমাজের উপরে পড়ে এবং পুরোহিত ও গৃহস্থ শ্রেণীর ব্যক্তিরাও ক্রমশ অসততার প্রকোপে অন্যায়ের পথে বা শাসক সৎ ন্যায়নিষ্ঠা হন তবে মন্ত্রী বা কর্মচারীগণ অসৎ পথে যাওয়ার সুযোগ পায় না। সমাজের উচ্চ স্তরে যদি সততা ও ন্যায়নিষ্ঠতার আদর্শ বিরাজ করে তবে তার প্রভাব সর্বস্তরে আলোর মত প্রতিফলিত হতে থাকে। কারণ সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা সহজাত প্রবণতা দেখা যায় যে তারা তাদের নেতা বা প্রধানের সমস্ত আচার আচারণকে অনুকরণ করার চেষ্টা করে। এমন কি এও দেখা যায় যে নেতা যদি বাঁকা হয়ে হাঁটেন তবে অন্যান্য অধিবাসীরা সেই চলন ভঙ্গি অনুকরণ করে বাঁকা হয়ে হাঁটতে শুরু করেছে। শাস্ত্রে বলা হয়েছে,
অগ্নিহোত্র মুখ যজ্ঞা সাবিত্রী ছন্দসো মুখম,
রাজা মুখম মনুস্্ সং নদীনং সাগরো মুখম।
সুতরাং শাসকবর্গের মধ্যে বা সমাজের উচ্চ স্তরে দুর্নীতি প্রবেশ করলে রোগ জীবাণুর মত তা সর্বত্র ছড়িয়ে যায়। বুদ্ধ তাই চেয়েছিলেন যে রাজা বা রাষ্ট্রপ্রধানগণ রাজ্যে এমন এক জীবন পদ্ধতির প্রবর্তন করবেন যা সমস্ত অধিবাসীর নৈতিক ও আধ্যাত্মিক চেতনাকে উন্নত করে তোলে। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে কোন সামাজিক বা রাষ্ট্রনৈতিক প্রতিষ্ঠানের স্থায়িত্ব নির্ভর করে তার নৈতিক সংগঠনের উপরে। সুতরাং যদি রাজা বা শাসক স্বয়ং বুদ্ধের নীতি অনুসরণ করেন এবং বুদ্ধ নির্দেশিত ধম্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্মের স্বীকৃতি দান করেন, সেখানে এই ধর্মের ব্যাপক প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে তীব্র বাধা উপস্থিত না হওয়াই স্বাভাবিক। যেখানে বৌদ্ধধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্মের মর্যাদা দেওয়া হয়নি এমন রাষ্ট্রেও যদি রাজা বা শাসকদল পরধর্মসহিষ্ণু ও সংবেদনশীল হন তবে শ্রমণ ও বৌদ্ধ জনসধারণের পক্ষে আপন ধর্ম আচরণ করা সহজ ও নির্বিঘœ হয়। ধর্ম জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠিত না হলে সমাজ জীবনে বা গার্হস্থ্য জীবনে তার ভিত্তি দৃঢ় হয় না। সুতরাং জাতীয় জীবনে ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে রাজা বা শাসকবর্গের সমর্থন ও সহায়তা অবশ্যই দরকার। গৌতম বুদ্ধ যে সমসাময়িক বহু রাজদরবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন তার মূল উদ্দেশ্য ছিল এইটি। ভারতবর্ষে হিন্দুধর্মের পুনরুত্থান হওয়ার আগে পর্যন্ত বৌদ্ধধর্ম তাই রাজন্যবর্গ, নগর প্রধান, শ্রেষ্ঠী ও ধনী ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাপকভাবে প্রসারিত হতে পেরেছিল। বুদ্ধের দেহাবসানের পর মৌর্য স¤্রাট অশোক, কুশান স¤্রাট কনিষ্ক, সাতবাহন রাজবংশের বহু রাজা এবং গুপ্ত সা¤্রাজ্যের স¤্রাটগণ এই বৌদ্ধধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। স¤্রাট হর্ষ বর্ধন ও গুপ্ত স¤্রাটগণ বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ না করলেও এই ধর্মের আদর্শের প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে মৌর্য স¤্রাট অশোক প্রমুখ নৃপতিবৃন্দের পৃষ্ঠপোষকতায় বৌদ্ধধর্ম ভারতের বাইরে চীন, জাপান, সিংহল এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন রাজ্যে বিস্তৃত হয়েছিল। চীন পরিব্রাজক হিউ-এন-সাঙের বিবরণে যে তথ্য পাওয়া যায় তাতে ভারতে এবং ভারতের বাইরে বৌদ্ধধর্মের বিস্তার লাভের পিছনে গুপ্ত স¤্রাটদের অপরিসীম অবদানের উল্লেখ রয়েছে। গুপ্ত যুগকে ভারতবর্ষের ইতিহাসের গৌরবময় অধ্যায় বলা হয়ে থাকে। সেই যুগে এই বৌদ্ধধর্মকে কেন্দ্র করেই ভারতীয় সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চার প্রভুত উন্নতি ঘটেছিল। বলা বাহুল্য রাষ্ট্রীয় সমর্থন ও সহায়তা ছিল সেই উন্নয়নের মূল ভিত্তি। তিন পার্বত্য জেলার তিন রাজন্যবর্গ অনেকটা বুদ্ধের নীতি আর্দশে এলাকার শাসনকার্য নিয়ন্ত্রণ করে চলেছেন।
রাজন্যবর্গের শাসন ব্যবস্থা
বুদ্ধের সময়কালীন ভারতবর্ষে ক্ষুদ্র ক্ষুদ ষোলটি রাজ্যর উল্লেখ পাওয়া যায়। যা ষোড়শ জনপদ নামে পরিচিত। অধুনা এক একটি জনপদগুলো রাষ্ট্র নামে স্বীকৃতি লাভ করে। রাষ্ট্রের উৎপত্তি বিষয়ে বুদ্ধের বক্তব্য বর্তমান রাষ্ট্র বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। পালি ‘সুত্তপিটক’ অন্তর্গত ‘দীঘ-নিকায়’ গ্রন্থের ‘অগগঞ্্ঞ সুত্তন্ত’ এ বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা রয়েছে (‘দীঘনিকায়’, ৩য় খ-, সম্পা, ভিক্ষু জগদীশ কাশ্যপ। নালন্দা, পালি পাবলিকেশন বোর্ড, ১৯৫৮, পৃ ৬৩ - ৭৬)। জনগণের প্রয়োজনে রাজতন্ত্র বা গণতন্ত্র এর জটিল প্রক্রিয়ার মধ্যে এক চরম অরাজকতার পরিবেশ উৎপত্তি হয় প্রথম রাষ্ট্রের। এই ‘সুত্তন্ত’ অনুসারে সেই অরাজক পরিস্থিতির মাঝেই জনগণ তাঁদের মধ্য থেকে একজন সুদর্শন শক্তিমান ও কর্মদক্ষ ব্যক্তিকে নির্বাচিত করে তাকে বললেন: হে সৌম্য! আসুন এবং কর্মভার গ্রহণ করুন। প্রকৃত দোষী ব্যক্তিকে শান্তি প্রদান করুন এবং রাজ্যসীমা থেকে বহিষ্কার করুন। পরিবর্তে আমরা আপনাকে আমাদের ফসলের একটি অংশ দেবো”। সকল জনগণ কর্তৃক সর্বসম্মতভাবে মনোনীত বলে তাঁর নাম হলো মহাসম্মত। এই প্রক্রিয়ার মধ্যেই সর্বপ্রথম রাজতন্ত্র এবং রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। আধুনিককালে রাষ্ট্রে উৎপত্তি বিষয়ে যে সকল মতবাদ রয়েছে, সেগুলি থেকে বুদ্ধের অভিজ্ঞতা অভিন্ন। পাশ্চাত্য রাষ্ট্র বিজ্ঞানী হক্স, লক, রুশো - এর চিন্তাধারার সঙ্গে বুদ্ধ ভাবনার অনেকটাই সাদৃশ্য রয়েছে। রাষ্ট্র মধ্যে সরকারের প্রাথমিক কর্তব্য হলো আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষা করা। রাজা বা শাসক হলেন প্রথমত: জনগণের ভৃত্য এবং জনগণের সদিচ্ছার উপরেই তাঁর কার্যকাল নির্ভর করে। বস্তুত: রাষ্ট্রচিন্তার পরিধিতে বুদ্ধোপদেশ আধুনিক প্রাসঙ্গিক চিন্তাভাবনার উৎস রূপে প্রতিভাত হয় (দি মহাবোধি ৭৫তম খ-, ডিসেম্বর, ১৯৬৭, সংখ্যা ১২, পৃ ৩৯০-৩৯৩। বড়–য়া, দীপক কুমার। অরিজিন অফ স্টেট ও বুড্ডিস্ট অ্যাপ্রোচ’)।
জনগণের সুশৃংখলতা, নিরাপত্তা, উন্নয়ন কর্মকান্ড এবং কল্যাণের জন্য বৌদ্ধ রাজন্যবর্ঘের সুশাসন অপরিহার্য। নতুবা পদে পদে এলাকার তথা দেশের শান্তি শৃংখলা বিনস্ত হয়। তখনই প্রজা সাধারণের মধ্যে দন্ড সংঘাত এবং নানা সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ে। রাজাদের সুশাসন বিষয়ে বুদ্ধোপদেশ দ্বারাই বৌদ্ধ ধর্মের প্রায়োগিক বা ব্যবহারিক শিক্ষার দিককে আলোচিত হয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে রাষ্ট্রীয় সুশাসন বা গুড গর্ভর্নেন্স একটি অধুনা প্রচলিত শব্দ হলেও বৌদ্ধ ধর্মের এর প্রয়োগ দেখা যায়। রাষ্ট্রেসুশাসন বলতে শুভ্র, সুশীল, সৎ ও পরিচ্ছন্ন শাসন ব্যবস্থা যা কল্যাণকামী রাষ্ট্রের অপরিহার্য অঙ্গ। সুশাসনের মুল লক্ষ্য হলো সামগ্রীকভাবে আপাত দুঃসাধ্য সর্বোত্তম ক্রমবর্ধমান মানবিক উন্নতি সুনিশ্চিত এবং তা বাস্তবায়িত করা। শাসন বা পরিচালনার এর মূথ্য উদ্দেশ্য নীতি নির্ধারণ ও বাস্তাবায়নে সুপরিকল্পনা গ্রহন করা। কিন্ত সুশাসনের কার্যক্রম হলো সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান সমুহের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে সে গুলিকে সর্বপ্রকার দুনীতিমুক্ত করে মানবধিকার রক্ষায় দৃষ্ঠান্ত রাখা।
১। অংশ গ্রহন (Participation) রাষ্ট্রে স্বশাসনের (ক) মুল কাঠামো দাড়িঁয়ে আছে রাষ্ট্রের সকল নরনারীর শাসন ব্যবস্থায় অংশ গ্রহনের উপর: (খ) এই অংশদারিত্ব প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রাতিষ্ঠানিক বা ব্যক্তিগতভাবে রাষ্টব্রবস্থায় সামিল করে (গ) এই নিরপেক্ষ অংশ গ্রহনের জন্য প্রয়োজন প্রাতিষ।ঠানিক ও ব্যক্তিগত বাক স্বাধীনতা এবং সুসংগঠিত সুশীল সমাজ।
২। আইনের শাসন (Rule of law) আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন (ক) নিরপেক্ষ, সৎ, আইন সম্মত বিধি ব্যবস্থা (খ) মানবাধিকার রক্ষায় পূর্ননিরাপত্তা, বিশেষ করে সংখ্যলঘু সম্পদায়ে লোকজনের: গ) স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমের নিরপেক্ষভাবে আইনের ব্যাখ্যা ও প্রয়োগ।
৩। স্বচ্ছতাা (Tranparency) সুশাসন ব্যববস্থায়ও স্বচ্ছতার তিনটি বিষয়ে প্রত দৃষ্টি দেওয়া হয়, যেমন (ক) আইন ওবিধি মোতাবেক কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তার রুপায়ন (খ) শাসন ব্যবস্থা সংক্রান্ত তথ্য দ্রুত লাভ করে যথাবিহিত ব্যবস্থা গ্রহন ও তার বাস্তাবায়ন, (গ) যেকোন বিষয়ে প্রর্ভতি তথ্য যে কোন নাগরিকের কাছে যেন সহজ লভ্য হয়।
৪। দায়বদ্ধতা (Responsiveness) সুশাসনের ফলে রাষ্ট্রীর সকল প্রতিষ্ঠান এবং নীতি নির্ধারকবৃন্দকে সুনির্দিষ্ট সময় সীমার মধ্যে কর্ম রুপায়নের জন্য দায়বদ্ধ থাকা।
৫। ঐক্যমত প্রতিষ্ঠা ( Consensus Orientational) এর জন্য প্রয়োজন (ক) সমাজের বিভিন্ন মতাবলম্বীদের মধ্যে মধ্যস্থতার দ্বারা এক অবাধ ঐক্যমতের ভিত্তি তে সহমতে উপনীত হওয়া । (খ) ঐক্যমত হয়ে দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহন ও তা রুপায়নে আগ্রহী হওয়া।
৬। সমদার্শতা ন্যায় বিচার এবং সর্বব্যাপকতা (Equity and Iclusiveness) সমাজরে মঙ্গল নির্ভর করে (ক) সকল ব্যক্তি যেন অনুভব করে তাদের সমাজে গুরুত্ব রয়েছে এবং তারা যেন সমাজের মুল ¯্রােত থেকে বিচ্ছিন্ন বোধ না করেন; (খ) সমল শ্রেণীর মানুষের, বিশেষ করে যারা পিছিয়ে আসেন তাদের উন্নতি ও মঙ্গলের সর্বপ্রকার সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা।
৭। কার্যকারিতা এবং দক্ষতা (Effctiveness and Efficiency) সুশাসনের অন্তনির্হিত অর্থ হলো; (ক) প্রাপ্ত সকল প্রকার সম্পদের সুব্যবস্থা করে বিধিব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠানের সাহায্যে সফল প্রদান, (খ) পরিবেশ সুরক্ষার দ্বারা প্রাকৃতিক সম্পদের ক্রমবর্ধমান ব্যবহার।
৮। উত্তর দায়বদ্ধতা (Accountabiity) সুশাসনের প্রাথমিকশর্ত হলো উত্তরদায়বদ্ধতা যার জন্য প্রয়োজন (ক) সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ।ঠান সমূহ এবং সুশীল সমাজ সকল কার্যকান্ডের দায়ভার গ্রহন করা; (খ) সদস্যদের প্রতি সাধারণ প্রতিষ্ঠান গুলি আর্থিক ও বাহ্যিক কর্মের জন্য দায়বদ্ধ থাকা।
বস্তুত সুশাসনের বাস্তব উদ্দেশ্যই হলো সর্বপ্রকার বিভেদ বৈষম্য যতদুর সম্ভব হ্রাস করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়রে বক্তব্যে মনোযোগী হয়ে বর্তমা ও আগামী সমাজ ব্যবস্থার উপযোগী সম্যক নীতি নির্ধারণ করা। সংক্ষেপে বলা যায় বুদ্ধের রাষ্ট্র চিন্তা ধারায় জনগণ শাসিত হলে অনেক সমস্যার দ্রুত সমাধান এবং ঐক্যবদ্ধ জীবন যাপনে সহায়ক হবে।
একবার গৌতম বুদ্ধ তাঁর শিষ্যদের কাছে উপদেশ দেবার সময় বলেন যে রাজ্যের রাজা যদি অসৎ হন তার মন্ত্রীবর্গ ও অন্যান্য কর্মচারীগণও অসৎ হয়ে ওঠে। মন্ত্রী ও কর্মচারীগণ অসৎ হলে তার প্রভাব সমস্ত সমাজের উপরে পড়ে এবং পুরোহিত ও গৃহস্থ শ্রেণীর ব্যক্তিরাও ক্রমশ অসততার প্রকোপে অন্যায়ের পথে বা শাসক সৎ ন্যায়নিষ্ঠা হন তবে মন্ত্রী বা কর্মচারীগণ অসৎ পথে যাওয়ার সুযোগ পায় না। সমাজের উচ্চ স্তরে যদি সততা ও ন্যায়নিষ্ঠতার আদর্শ বিরাজ করে তবে তার প্রভাব সর্বস্তরে আলোর মত প্রতিফলিত হতে থাকে। কারণ সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা সহজাত প্রবণতা দেখা যায় যে তারা তাদের নেতা বা প্রধানের সমস্ত আচার আচারণকে অনুকরণ করার চেষ্টা করে। এমন কি এও দেখা যায় যে নেতা যদি বাঁকা হয়ে হাঁটেন তবে অন্যান্য অধিবাসীরা সেই চলন ভঙ্গি অনুকরণ করে বাঁকা হয়ে হাঁটতে শুরু করেছে। শাস্ত্রে বলা হয়েছে,
অগ্নিহোত্র মুখ যজ্ঞা সাবিত্রী ছন্দসো মুখম,
রাজা মুখম মনুস্্ সং নদীনং সাগরো মুখম।
সুতরাং শাসকবর্গের মধ্যে বা সমাজের উচ্চ স্তরে দুর্নীতি প্রবেশ করলে রোগ জীবাণুর মত তা সর্বত্র ছড়িয়ে যায়। বুদ্ধ তাই চেয়েছিলেন যে রাজা বা রাষ্ট্রপ্রধানগণ রাজ্যে এমন এক জীবন পদ্ধতির প্রবর্তন করবেন যা সমস্ত অধিবাসীর নৈতিক ও আধ্যাত্মিক চেতনাকে উন্নত করে তোলে। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে কোন সামাজিক বা রাষ্ট্রনৈতিক প্রতিষ্ঠানের স্থায়িত্ব নির্ভর করে তার নৈতিক সংগঠনের উপরে। সুতরাং যদি রাজা বা শাসক স্বয়ং বুদ্ধের নীতি অনুসরণ করেন এবং বুদ্ধ নির্দেশিত ধম্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্মের স্বীকৃতি দান করেন, সেখানে এই ধর্মের ব্যাপক প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে তীব্র বাধা উপস্থিত না হওয়াই স্বাভাবিক। যেখানে বৌদ্ধধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্মের মর্যাদা দেওয়া হয়নি এমন রাষ্ট্রেও যদি রাজা বা শাসকদল পরধর্মসহিষ্ণু ও সংবেদনশীল হন তবে শ্রমণ ও বৌদ্ধ জনসধারণের পক্ষে আপন ধর্ম আচরণ করা সহজ ও নির্বিঘœ হয়। ধর্ম জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠিত না হলে সমাজ জীবনে বা গার্হস্থ্য জীবনে তার ভিত্তি দৃঢ় হয় না। সুতরাং জাতীয় জীবনে ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে রাজা বা শাসকবর্গের সমর্থন ও সহায়তা অবশ্যই দরকার। গৌতম বুদ্ধ যে সমসাময়িক বহু রাজদরবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন তার মূল উদ্দেশ্য ছিল এইটি। ভারতবর্ষে হিন্দুধর্মের পুনরুত্থান হওয়ার আগে পর্যন্ত বৌদ্ধধর্ম তাই রাজন্যবর্গ, নগর প্রধান, শ্রেষ্ঠী ও ধনী ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাপকভাবে প্রসারিত হতে পেরেছিল। বুদ্ধের দেহাবসানের পর মৌর্য স¤্রাট অশোক, কুশান স¤্রাট কনিষ্ক, সাতবাহন রাজবংশের বহু রাজা এবং গুপ্ত সা¤্রাজ্যের স¤্রাটগণ এই বৌদ্ধধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। স¤্রাট হর্ষ বর্ধন ও গুপ্ত স¤্রাটগণ বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ না করলেও এই ধর্মের আদর্শের প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে মৌর্য স¤্রাট অশোক প্রমুখ নৃপতিবৃন্দের পৃষ্ঠপোষকতায় বৌদ্ধধর্ম ভারতের বাইরে চীন, জাপান, সিংহল এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন রাজ্যে বিস্তৃত হয়েছিল। চীন পরিব্রাজক হিউ-এন-সাঙের বিবরণে যে তথ্য পাওয়া যায় তাতে ভারতে এবং ভারতের বাইরে বৌদ্ধধর্মের বিস্তার লাভের পিছনে গুপ্ত স¤্রাটদের অপরিসীম অবদানের উল্লেখ রয়েছে। গুপ্ত যুগকে ভারতবর্ষের ইতিহাসের গৌরবময় অধ্যায় বলা হয়ে থাকে। সেই যুগে এই বৌদ্ধধর্মকে কেন্দ্র করেই ভারতীয় সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চার প্রভুত উন্নতি ঘটেছিল। বলা বাহুল্য রাষ্ট্রীয় সমর্থন ও সহায়তা ছিল সেই উন্নয়নের মূল ভিত্তি। তিন পার্বত্য জেলার তিন রাজন্যবর্গ অনেকটা বুদ্ধের নীতি আর্দশে এলাকার শাসনকার্য নিয়ন্ত্রণ করে চলেছেন।
রাজন্যবর্গের শাসন ব্যবস্থা
বুদ্ধের সময়কালীন ভারতবর্ষে ক্ষুদ্র ক্ষুদ ষোলটি রাজ্যর উল্লেখ পাওয়া যায়। যা ষোড়শ জনপদ নামে পরিচিত। অধুনা এক একটি জনপদগুলো রাষ্ট্র নামে স্বীকৃতি লাভ করে। রাষ্ট্রের উৎপত্তি বিষয়ে বুদ্ধের বক্তব্য বর্তমান রাষ্ট্র বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। পালি ‘সুত্তপিটক’ অন্তর্গত ‘দীঘ-নিকায়’ গ্রন্থের ‘অগগঞ্্ঞ সুত্তন্ত’ এ বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা রয়েছে (‘দীঘনিকায়’, ৩য় খ-, সম্পা, ভিক্ষু জগদীশ কাশ্যপ। নালন্দা, পালি পাবলিকেশন বোর্ড, ১৯৫৮, পৃ ৬৩ - ৭৬)। জনগণের প্রয়োজনে রাজতন্ত্র বা গণতন্ত্র এর জটিল প্রক্রিয়ার মধ্যে এক চরম অরাজকতার পরিবেশ উৎপত্তি হয় প্রথম রাষ্ট্রের। এই ‘সুত্তন্ত’ অনুসারে সেই অরাজক পরিস্থিতির মাঝেই জনগণ তাঁদের মধ্য থেকে একজন সুদর্শন শক্তিমান ও কর্মদক্ষ ব্যক্তিকে নির্বাচিত করে তাকে বললেন: হে সৌম্য! আসুন এবং কর্মভার গ্রহণ করুন। প্রকৃত দোষী ব্যক্তিকে শান্তি প্রদান করুন এবং রাজ্যসীমা থেকে বহিষ্কার করুন। পরিবর্তে আমরা আপনাকে আমাদের ফসলের একটি অংশ দেবো”। সকল জনগণ কর্তৃক সর্বসম্মতভাবে মনোনীত বলে তাঁর নাম হলো মহাসম্মত। এই প্রক্রিয়ার মধ্যেই সর্বপ্রথম রাজতন্ত্র এবং রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। আধুনিককালে রাষ্ট্রে উৎপত্তি বিষয়ে যে সকল মতবাদ রয়েছে, সেগুলি থেকে বুদ্ধের অভিজ্ঞতা অভিন্ন। পাশ্চাত্য রাষ্ট্র বিজ্ঞানী হক্স, লক, রুশো - এর চিন্তাধারার সঙ্গে বুদ্ধ ভাবনার অনেকটাই সাদৃশ্য রয়েছে। রাষ্ট্র মধ্যে সরকারের প্রাথমিক কর্তব্য হলো আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষা করা। রাজা বা শাসক হলেন প্রথমত: জনগণের ভৃত্য এবং জনগণের সদিচ্ছার উপরেই তাঁর কার্যকাল নির্ভর করে। বস্তুত: রাষ্ট্রচিন্তার পরিধিতে বুদ্ধোপদেশ আধুনিক প্রাসঙ্গিক চিন্তাভাবনার উৎস রূপে প্রতিভাত হয় (দি মহাবোধি ৭৫তম খ-, ডিসেম্বর, ১৯৬৭, সংখ্যা ১২, পৃ ৩৯০-৩৯৩। বড়–য়া, দীপক কুমার। অরিজিন অফ স্টেট ও বুড্ডিস্ট অ্যাপ্রোচ’)।
জনগণের সুশৃংখলতা, নিরাপত্তা, উন্নয়ন কর্মকান্ড এবং কল্যাণের জন্য বৌদ্ধ রাজন্যবর্ঘের সুশাসন অপরিহার্য। নতুবা পদে পদে এলাকার তথা দেশের শান্তি শৃংখলা বিনস্ত হয়। তখনই প্রজা সাধারণের মধ্যে দন্ড সংঘাত এবং নানা সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ে। রাজাদের সুশাসন বিষয়ে বুদ্ধোপদেশ দ্বারাই বৌদ্ধ ধর্মের প্রায়োগিক বা ব্যবহারিক শিক্ষার দিককে আলোচিত হয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে রাষ্ট্রীয় সুশাসন বা গুড গর্ভর্নেন্স একটি অধুনা প্রচলিত শব্দ হলেও বৌদ্ধ ধর্মের এর প্রয়োগ দেখা যায়। রাষ্ট্রেসুশাসন বলতে শুভ্র, সুশীল, সৎ ও পরিচ্ছন্ন শাসন ব্যবস্থা যা কল্যাণকামী রাষ্ট্রের অপরিহার্য অঙ্গ। সুশাসনের মুল লক্ষ্য হলো সামগ্রীকভাবে আপাত দুঃসাধ্য সর্বোত্তম ক্রমবর্ধমান মানবিক উন্নতি সুনিশ্চিত এবং তা বাস্তবায়িত করা। শাসন বা পরিচালনার এর মূথ্য উদ্দেশ্য নীতি নির্ধারণ ও বাস্তাবায়নে সুপরিকল্পনা গ্রহন করা। কিন্ত সুশাসনের কার্যক্রম হলো সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান সমুহের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে সে গুলিকে সর্বপ্রকার দুনীতিমুক্ত করে মানবধিকার রক্ষায় দৃষ্ঠান্ত রাখা।
১। অংশ গ্রহন (Participation) রাষ্ট্রে স্বশাসনের (ক) মুল কাঠামো দাড়িঁয়ে আছে রাষ্ট্রের সকল নরনারীর শাসন ব্যবস্থায় অংশ গ্রহনের উপর: (খ) এই অংশদারিত্ব প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রাতিষ্ঠানিক বা ব্যক্তিগতভাবে রাষ্টব্রবস্থায় সামিল করে (গ) এই নিরপেক্ষ অংশ গ্রহনের জন্য প্রয়োজন প্রাতিষ।ঠানিক ও ব্যক্তিগত বাক স্বাধীনতা এবং সুসংগঠিত সুশীল সমাজ।
২। আইনের শাসন (Rule of law) আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন (ক) নিরপেক্ষ, সৎ, আইন সম্মত বিধি ব্যবস্থা (খ) মানবাধিকার রক্ষায় পূর্ননিরাপত্তা, বিশেষ করে সংখ্যলঘু সম্পদায়ে লোকজনের: গ) স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমের নিরপেক্ষভাবে আইনের ব্যাখ্যা ও প্রয়োগ।
৩। স্বচ্ছতাা (Tranparency) সুশাসন ব্যববস্থায়ও স্বচ্ছতার তিনটি বিষয়ে প্রত দৃষ্টি দেওয়া হয়, যেমন (ক) আইন ওবিধি মোতাবেক কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তার রুপায়ন (খ) শাসন ব্যবস্থা সংক্রান্ত তথ্য দ্রুত লাভ করে যথাবিহিত ব্যবস্থা গ্রহন ও তার বাস্তাবায়ন, (গ) যেকোন বিষয়ে প্রর্ভতি তথ্য যে কোন নাগরিকের কাছে যেন সহজ লভ্য হয়।
৪। দায়বদ্ধতা (Responsiveness) সুশাসনের ফলে রাষ্ট্রীর সকল প্রতিষ্ঠান এবং নীতি নির্ধারকবৃন্দকে সুনির্দিষ্ট সময় সীমার মধ্যে কর্ম রুপায়নের জন্য দায়বদ্ধ থাকা।
৫। ঐক্যমত প্রতিষ্ঠা ( Consensus Orientational) এর জন্য প্রয়োজন (ক) সমাজের বিভিন্ন মতাবলম্বীদের মধ্যে মধ্যস্থতার দ্বারা এক অবাধ ঐক্যমতের ভিত্তি তে সহমতে উপনীত হওয়া । (খ) ঐক্যমত হয়ে দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহন ও তা রুপায়নে আগ্রহী হওয়া।
৬। সমদার্শতা ন্যায় বিচার এবং সর্বব্যাপকতা (Equity and Iclusiveness) সমাজরে মঙ্গল নির্ভর করে (ক) সকল ব্যক্তি যেন অনুভব করে তাদের সমাজে গুরুত্ব রয়েছে এবং তারা যেন সমাজের মুল ¯্রােত থেকে বিচ্ছিন্ন বোধ না করেন; (খ) সমল শ্রেণীর মানুষের, বিশেষ করে যারা পিছিয়ে আসেন তাদের উন্নতি ও মঙ্গলের সর্বপ্রকার সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা।
৭। কার্যকারিতা এবং দক্ষতা (Effctiveness and Efficiency) সুশাসনের অন্তনির্হিত অর্থ হলো; (ক) প্রাপ্ত সকল প্রকার সম্পদের সুব্যবস্থা করে বিধিব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠানের সাহায্যে সফল প্রদান, (খ) পরিবেশ সুরক্ষার দ্বারা প্রাকৃতিক সম্পদের ক্রমবর্ধমান ব্যবহার।
৮। উত্তর দায়বদ্ধতা (Accountabiity) সুশাসনের প্রাথমিকশর্ত হলো উত্তরদায়বদ্ধতা যার জন্য প্রয়োজন (ক) সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ।ঠান সমূহ এবং সুশীল সমাজ সকল কার্যকান্ডের দায়ভার গ্রহন করা; (খ) সদস্যদের প্রতি সাধারণ প্রতিষ্ঠান গুলি আর্থিক ও বাহ্যিক কর্মের জন্য দায়বদ্ধ থাকা।
বস্তুত সুশাসনের বাস্তব উদ্দেশ্যই হলো সর্বপ্রকার বিভেদ বৈষম্য যতদুর সম্ভব হ্রাস করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়রে বক্তব্যে মনোযোগী হয়ে বর্তমা ও আগামী সমাজ ব্যবস্থার উপযোগী সম্যক নীতি নির্ধারণ করা। সংক্ষেপে বলা যায় বুদ্ধের রাষ্ট্র চিন্তা ধারায় জনগণ শাসিত হলে অনেক সমস্যার দ্রুত সমাধান এবং ঐক্যবদ্ধ জীবন যাপনে সহায়ক হবে।
ড. জিনবোধি ভিক্ষু, অধ্যাপক, পালি বিভাগ, চ্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments
Post a Comment