বিশ্বশান্তির পেক্ষাপটে; পার্বত্য চট্টগ্রামে সমসাময়িক বৌদ্ধ ধর্মীয় শিক্ষা, সংস্কৃতি ও জীবন

পূর্ব প্রকাশের পর
পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সার্বভৌমিক রাজতন্ত্রের ধারা
    পরিবারের প্রধান কর্তা যেমন পিতা এবং মাতা হয় গৃহী লক্ষ্মী বা দেবী। পিতা পরিবারের যাবতীয়
দ্বিতীয়ত: এই সমাজ বা রাষ্ট্র ব্যবস্থা যে কোন উদ্দেশ্যহীন অন্ধ প্রক্রিয়ায় প্রাকৃতিক নিয়মে গড়ে উঠবে এমন ধারণা ঠিক নয়। সমাজের সকল সদস্যের সচেতন এবং সক্রিয় প্রচেষ্টায় তাকে গঠন করতে হচে। শীল পালনের মাধ্যমেই একমাত্র সেই পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব। সুতরাং রাষ্ট্রপ্রধানকে এমন নীতি গ্রহণ করতে হবে বা এমন আদর্শ স্থাপন করতে হবে যা সমস্ত অধিবাসীকে শীল পালনে উদ্বুদ্ধ করে তোলে এবং আকাক্সক্ষা প্রশমিত ও পরিত্যাগ করে নির্বাণের পথে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। এই সচেতন ও উদ্দেশ্যবিশিষ্ট প্রক্রিয়া বাস্তবায়িত করার জন্য এক সর্বজন স্বীকৃতি নীতি ও দর্শন একান্ত প্রয়োজন যা রাষ্ট্রপ্রধানগণ, সাধারণ মানুষ ও শ্রমণগণ সমবেতভাবে আচরণ ও অনুসরণ করতে পারে। তথাগত সেই আদর্শ মানবসমাজকে উপহার দিলেন যা পরবর্তীকালে বৌদ্ধ ধর্ম ও বৌদ্ধ দর্শন রূপে পরিচিত হয়। বুদ্ধের এই সার্বভৌম সমাজ শ্রেণীহীন সমাজ সেখানে রাজ্য, সাধারণ মানুষ ও শ্রমণ সকলেই এক শ্রেণীভুক্ত, ‘a righteous universal monarchy in and universal society’ – বলেছেন অ.ক ডধৎফবৎ. এ কথা বলা হয়তো অসঙ্গত নয় যে আড়াই হাজার বছর আগে বুদ্ধই প্রথম সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার ধারণার জন্ম দিয়েছিলেন এবং তিনিই প্রথম জাতিভেদশূন্য শ্রেণীহীন সমাজের আদর্শ প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তবে তিনি যে পথ নির্দেশ করেছিলেন তা রক্তপিচ্ছিল বিপ্লবের পথ নয়, নয় হিংসার পথ। অহিংসা ছিল তাঁর মন্ত্র। বুদ্ধকে তাই অনেক ধর্মপ্রবর্তক না বলে সমাজ সংস্কারক আখ্যা দিয়েছেন। বুদ্ধের জীবনাবসানের পরে বৌদ্ধ ধর্মাধ্যক্ষগণ যে তন্নিহিত বৌদ্ধ শাস্ত্র রচনা করেন তাতে সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার একটা পূর্ণ ও সামগ্রিক চিত্র পাওয়া যায়। সেখানে ধর্মের সংরক্ষণ ও প্রনার রাজার কর্তব্য এবং তাঁর ব্যক্তিগত চরিত্র ও আচরণকে ন্যায়নিষ্ঠ করে উদাহরণ স্থাপন করতে হবে। ধর্ম ও ন্যায়পরায়নতাই হবে তাঁর প্রধান অস্ত্র, তরবারি নয়। এ বিষয়ে ট.ঘ এযড়ংধষ এর বক্তব্য তুলে ধরা যায়, “The most important contribution of the early Buddhist canonists to the store of our ancient thoughts consists in their `total’ application of principles of righteousness to the branches of the king’s internal and foreign administration.”
    প্রশ্ন জাগে, এই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সংঘ বা শ্রামণদের ভূমিকা কি হবে? শ্রমণদের কি রাজনীতি বা রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হওয়া উচিত? শাসক সাধারণ মানুষ ও শ্রমণদের নিয়েই যখন সমগ্র সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিকল্পনা তখন শ্রমণ তথা সঙ্ঘের কিছু কর্তব্য ও ভূমিকা রয়েছে এটা স্বাভাবিকভাবেই ধারণা করা যায়। এ ক্ষেত্রে সংঘ ও সংঘের তেমনি এক সমন্ধ স্থাপিত হতে পারে। অর্থাৎ রাজা বা শাসককে সংঘ পরিবহনের আর্থিক দায়দায়িত্ব ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দেওয়ার কর্তব্য পালন করতে সচেষ্ট হতে হবে। অপরপক্ষে, সংঘও সামাজিক ও  রাষ্ট্রনৈতিক জীবনে ‘ধম্ম’ প্রয়োগ ও প্রতিষ্ঠার বিষয়ে সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ শাসন ব্যবস্থা পরিচালনার ক্ষেত্রে রাজ্য ও শাসককে সঠিক পরামর্শ দান করে সহায়তা করতে আগ্রহী থাকবে। ব্যক্তিগতভাবে কোন শ্রমণের প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার অধিকার না থাকলেও সংঘ একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে অভিমত প্রকাশ করার বা নির্দেশ দানের অধিকারী অবশ্যই হতে পারে। কারণ সংঘ ও সংঘের সদস্য শ্রমণগণ রাষ্ট্রবহির্ভূত কোন প্রতিষ্ঠান নয় – সংঘ যৌথভাবে রাষ্ট্রেরই নাগরিক a collective body of citizens’.  সংঘের জীবনযাত্রা পৃথক হলেও সংঘ সমাজেরই অন্যতম অংশ। সমাজের ও রাষ্ট্রের কল্যাণ ও উন্নয়নে সক্রিয় অভিমত প্রকাশের ন্যায়সংগত দাবী ও দায়িত্ব সংঘের আবশ্যিকভাবেই থাকা উচিত। “The Sangha must also be able to draw attention to and freely criticize deviations from the ‘Dhamma’ on the part of the Government, the people and the plitical leaders” – বলেছেন বৌদ্ধ শ্রমণ সংঘরক্ষিত। তাঁর মতে রাষ্ট্রনীতি যখন অধ:পতিত হয়, শাসক যখন নীতিভ্রষ্ট হয়ে জাতিকে নি¤œগামী করে তোলে, ধর্ম যখন সমাজজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তখন সংঘ এক দুর্লঙ্ঘ্য দুর্গের মত সেই অধ:পতনের পথরোধ করে দাঁড়াতে পারে এবং ধম্মকে সুরক্ষিত করে রাখার চেষ্টা করে।
    বুদ্ধ যে ন্যায়নিষ্ঠ আদর্শে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেছিলেন সেখানে সংঘ তাই রাষ্ট্রনীতি থেকে দূরে নয় বরং শাসন ব্যবস্থার অন্যতম অংশীদার হিসেবে পাশাপাশি অবস্থান করে। রাজনৈতিক ও ধর্মীয় শাসনের এই সমন্বয়ই ছিল বুদ্ধের সার্বভৌম রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মূল আদর্শ। ধর্মও সেখানে সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে এক সার্বিক মানবতাবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত-বিশে^র সমস্ত প্রাণিজগতের মঙ্গল সাধনই যে ধর্মের মূল লক্ষ্য। মৌর্য স¤্রাট অশোক প্রথম এই ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রবর্তন করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বুদ্ধের সেই মহান ধর্মরাষ্ট্রের স্বপ্ন প্রথম বাস্তবায়িত হয় দুই হাজার বছর পরে বৌদ্ধ গেলুক-পা সম্প্রদায় লামা চোঙ-খা পার নেতৃত্বে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অধিকার করে নেয় এবং এৎধহফ ঐরবৎধৎপযু  বা সর্বোচ্চ ধর্মগুরু রাষ্ট্রপ্রধানের পদে অভিষিক্ত হন। প্রধান ধর্মগুরু দালাই লামা হলেন দায়িত্ব। বলা যায়, সংঘ হল রাজদরবার, ভিক্ষু, শ্রামণগণ হলেন রাষ্ট্রপরিচালক ও ধর্মচক্র হল রাষ্ট্রীয় নিশান। ধম্ম, সংঘ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার এই সম্মিলন এক নজীর স্থাপন করলো পৃথিবীর ইতিহাসে। ১৯৫৯ সালে চীন কর্তৃক অধিকৃত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এই সংঘ পরিচালিত রাষ্ট্রব্যবস্থা তিব্বতে প্রচলিত ছিল। বুদ্ধ ধম্ম সংঘ সেখানে এক ও অনন্য হয়ে গিয়েছিল।

পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বৌদ্ধ ধর্মীয় ধারা
    যুগে যুগে বৌদ্ধ ধর্ম (ব্দ্ধু ধর্ম) এমন এক প্রকার ধর্ম যা মানব সম্পদ উন্নয়নের অন্যতম সোপান বিশেষ। বৌদ্ধরা শান্তপ্রিয় জাতি, কম কথা লোক এবং কর্মে বিশ^াসী। খেটে খাওয়া এবং সদ্্ভাবে জীবন জীবিকা নির্বাহ করা তাদের জন্মগত স্বভাব। পার্বত্য এলাকায় বসবাসরত তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী মানুষেরা স্বভাবত সহজ-সরল, আন্তরিক ও সহানুভূতিশীল। তারা জন্মগতভাবে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। অনেকের মতে, ~more code of ethics than a religion” – অর্থাৎ বুদ্ধের উপদেশাবলীকে ধর্ম আখ্যা দেওয়ার চেয়ে নীতি শাস্ত্র বলাই সঙ্গত। সহজ কথায় – ঞযব ধিু ড়ভ ষরভব। অর্থাৎ জীবন চলার পদ্ধতিকে বোঝায়। এই জীবন পদ্ধতি কেবলমাত্র কোন ব্যক্তির একক জীবনে প্রযোজ্য নয় এবং ব্যক্তিকে সমাজ থেকে দূরে কেন নির্জন স্থানে গিয়ে তা পালন করার কথা বলা হয়নি। সমাজের মধ্যে বসবাস করে, সমাজের সমস্ত সদস্যকেই সেই জীবন পদ্ধতিতে অভ্যস্ত করে তোলার কথা বলা হয়েছে। বুদ্ধ নিদের্শিত পথ একক বা সমাজ-বিচ্ছিন্ন পথ নয় – এই পথ সমাজকেন্দ্রিক পথ। প্রাচীন কালে হিন্দু মুণি ঋষিগণ সমাজ সংসার ত্যাগ করে বনে জঙ্গলে, পর্বতে কন্দরে গিয়ে ধ্যান ও যোগ করতেন। ব্যক্তিগত মুক্তিই ছিল সেই সাধনার মূল লক্ষ্য। বুদ্ধ সেই ব্যক্তিকেন্দ্রিক সাধনার পথ পরিত্যাগ করে সামাজিক ও সামগ্রিক মুক্তি সাধনার পথ প্রদর্শন করলেন। এ বিষয়ে Trevor Ling বলেছেন, ““The teaching of the Buddha was not concerned with the private destiny of the individual, but with something much wider, the whole realm of sentient being, the whole of consciousness. This inevitably entailed a concern with social and political matters and these received a large share of attention in the teaching of the Buddha as it is represented in the Pali text.”

পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক ধারা
    পাহাড়ি জন গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক সমস্যাটা স্মরণাতীতকাল থেকে অত্যন্ত করুণ এবং জটিল বলা চলে। কারণযখন থেকে তাদের পার্বত্য এলাকায় বসতি  শুরু হয়েছে তখন থেকে প্রায় জুম চাষের মধ্যে দিয়ে অনেকটা জীবন জীবিকা নির্বাহ করতে হয়েছে। সবচেয়ে আনন্দ সংবাদ হলো পাহাড়ি জসগোষ্ঠীর মেয়েরা বয়নশিল্পে অভিজ্ঞ বলে নিজেদের পরিধেয় বস্ত্র নিরোই তৈরী করে । এখনও সেই চাহিদা পুরান করে লেছে। নতুবা তাদের দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন উন্নত ধরনের বস্ত্র ব্যবহার করা কঠিন হয়ে উঠত। বলতে পারি তারা ছোটকাল থেকে অত্যন্ত পরিশ্রমী ও ক্ষেতে খাওয়া মানুষ। তাই তারা অত্যন্ত সহজ সরলও জীবন যাপন করে এবং অথিতি পরায়ন। দুর্ভাগ্য  ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে কাপ্তাই জল বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রকল্পের কাজ শুরু হলে পার্বত্যবাসীদের জন্য আর্শীবাদের চেয়ে অভিশাপ গ্রস্থ হতে হয়েছে বেশী। চাষাবাদের শতশত একর জমি শুধূ নষ্ট হয়নি হাজার হাজার ঘরবাড়ী জলমগ্ন হয়েছে। বলতে পারি আশ্রয়লাভীর মধ্যে আশ্রহীনে পরিনত হয়েছে। দ্বিতীয়তঃ অনেক কষ্টের বিনিময়ে নানাজাতের ফলজও বনজ সম্পদ উৎপাদন করলেও যাতায়তের সুব্যবস্থা না থাকার কারণে উৎপাদিত পণ্যেন বাজার উচিত মুল্য পাওয়ার কোন সুযোগ নেই। তাই এখনও  অনেক পরিবার কোন রকমের কালাতিপাত করতে দেখা যায়। সে ক্ষেত্রে পারিবারিক ধন্যতা যেম প্রকট তেমনি সামাজিক জীবন যাপন উন্নত হওয়ার কোন সুযোগ নেই। তাই ঐ পরিবারে শিক্ষার আলো প্রবেশের অনুকুল পরিবেশ লক্ষ্যণীয় নয়। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সরকারী-আধাসরকারী এবং সাংগঠনিকভাবে তাদেরকে এগিয়ে নিয়ে আসার জন্য বিভিন্নভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া মানবিক কর্তব্য।  নতুবা যে তিমিরে আছে সে তিমিরেই থাকতে হবে।

পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর শিক্ষার ধারা
    পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর শিক্ষা অনুকুল পেিবশ অনেকটা ক্ষীণ।  জ্ঞানীরা বলেছেন, শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। কিন্তু শিক্ষা ছাড়া কোন জাতি উন্নত হতে পারেনা। তাও জ্ঞানীরা উচ্চস্বরে প্রকাশ করেছেন। বর্তমান সরকারের শ্লোগান হলো ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো জ¦ালিয়ে দেওয়া। অপ্রিয় হলেওে সত্য পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন প্রত্যন্ত দুর্গম এলাকায় শিক্ষার আলো প্রবেশ করেনি বললেও ভুল হবে না। কোনো কোনো এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও হাইস্কুলের কোনো ব্যবস্থা নেই। দু’এক জায়গায় হাইস্কুল প্রতিষ্ঠিত হলেও কলেজের নাম গন্ধ নেই। দু’একটা জায়গায় কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলেও যাতায়ত ব্যবস্থার দূরত্ব হিসাব করলে দৈনিক অতদূর পায়ে হেঁটে অথবা মোটর সাইকেলে করে যাতায়াত করে কলেজে লেখাপড়া করার মতো সামর্থ্য ও সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। বিশ্বায়নের যুগে সম্প্রতি দু’টো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যা সংখ্যানুপাতে অতি নগণ্য বলতে পারি, অন্যান্য উন্নত দেশের তুলনায় আধুনিক শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে পার্বত্য কতটুকু পিছিয়ে আছে বলাই বাহুল্য। যার পরিপ্রেক্ষিতে অর্থনৈতিক সমস্যা যেমন প্রখর তেমনিভাবে সংস্কৃতি ও ধর্মীয় চেতনাকে উজ্জীবিত করতে বার বার বাধাগ্রস্থ হচ্ছে বলেই মানবতা, মানবপ্রেম ও মানবকল্যাণ অনেকটা ম্লান হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয়। জনসংখ্য অনুপাতে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যায় সংখ্যা অত্যন্ত সীমিত। এ পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে উচ্চ শিক্ষায় সুশিক্ষিত করতে হলে সরকারী সাহায্য সহযোগিতার কোন বিকল্প নেই। বলতে পারি অতীতের তুলেনায় বর্তমান সরকার এব্যাপারে অনেকটা গুরুত্ব ভূমিকা পালন করে চলেছে তার জন্য সাধুবা ও ধন্যবাদ জানাই। ভবিয্যতে এধারা যাতে অব্যাহত থাকে এ আশা পোষন করি। ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে লোক গণনায় মোট শিক্ষিত লোকের সংখ্যা ছিল ৪৯,২৮০ জন। তৎমধ্যে ৩৪,৭৩৩ জন পুরুষ এবং ৫,৫৪৭ জন স্ত্রীলোক। শতকরা ১২% শিক্ষিত। ১৯০১ ইংরেজী লোক গণনার রিপোর্টে জানা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলায় তখন ৪৫% জন শিক্ষিত সংজ্ঞা লাভের যোগ্য ছিল। বান্দরবান জেলায় শিক্ষার হার ৩৫.৯%। পুরুষ ৪০.৩%, মহিলা ৩০.৯%। খাগড়াছড়ি জেলায় শিক্ষার হার ৪৪.০৭%। পুরুষ- ৫৪.১৯%, মহিলা- ৩৩.৬২%। রাঙামাটি জেলায় শিক্ষার হার ৪৩.৬০%; পুরুষ ৫১.৪৭%, মহিলা ৩৪.২১%। বর্তমানে আরো শিক্ষার হার যেমন অভিবৃদ্ধি হয়েছে তেমনি সুযোগ সুবিধা এবং স্কুল কলেজের সংখ্যাও বেড়ে চলেছে।

পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
    পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয় কঠিন এবং মারাতœক সমস্যা হচ্ছে রাজনৈতিক সমস্য। বৃটিশ আমলে কিছুটা সমস্যা থাকলেও তিন রাজন্যবর্গ বিভাজনের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের নেতৃত্বে অত্র এলাকা শাসন করার ক্ষমতা ও সুব্যবস্থা ছিল। পাকিস্থান সৃষ্টির মধ্য দিয়ে তিন পার্বত্য জেলার তিন রাজন্য বর্গের মাসন ক্ষমতা অনেকটা কমিয়ে দেয়। বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশে তিনপার্বত্য জেলার তিন রাজন্যবর্গের পদমর্যাদা ও সম্মাণ বিদ্যমান থাকলেও শাসন ক্ষমতার তেমন প্রভাব লক্ষ্যণীয় নয়। তাই দিন দিন পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর রাজনৈতকি প্রেক্ষাপট অত্যন্ত করুণ ও জটিল আকার ধারণ করেছে। এমতাবস্থা পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর চরম অসন্তোষের কারণে জনসংহতি সমিতরি আত্ম প্রকাশে মাধ্যমে রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরো ভয়াবহতা ধারণ করে। এর আসু সমাধানের লক্ষ্যে বর্তমান সরকারের উদ্যোগে বিগত ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখহাসিনার এবং জনসংহতি সমিতরি সভাপতি শ্রী জ্যোতিরিন্দ্রীয় বোধি লারমা (সন্তু লারমা) শান্তিচুক্তি স্বারক্ষরিত হয়। কিন্তু এব্যাপারে বর্তমান সরকারের শুভদৃষ্ঠিতে যথেষ্ঠ উন্নয়ন ও সরকারী ও বেসরকারী ভাবে কর্মজীবি ও  উচ্চ শিক্ষার সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি করলেও সবচেয়ে জটিল ও মারাত্মক হয়ে দাড়িয়েছে ভূমি সমস্যা। এ ভূমি সমস্যার সমাধান না হলে  আধো অন্যান্য সমস্যা সমাধান হবে বলে মনে হয় না। যার পরিপ্রেক্ষিতে পাহাড়ি জনগোষ্ঠির সার্বক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে বার বার। বলতে পারি বর্তমান সরকার এব্যপারে যথেষ্ট আন্তরিক হলেও সরকারী আমলাদের জটিলতা এবং প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের প্রভাবে এখনও পর্যন্ত ভূমি সমস্যা সমাধান যেমন বাধাগ্রস্থ তেমনি শান্তিচুক্তির পুরিপূর্ণ বাস্তরায়নও ঝুলে আছে। সরকার এবং পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে দ্রুত সমন্বয়ের মাধ্যমে বুঝা পাড়ার ব্যবস্থা না হলে অত্র এলাকায় রাজনৈতিক অবস্থা কোন ভাবে মঙ্গলজনক হবে বলে মনে হয় না। রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল না হলে সামাজিক সাংস্কৃুতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় জাগরণও অনেকটা বাধার সন্মূখীন হচ্ছে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

পাবর্ত চট্টগ্রামে রাজ গোড়াপত্তন, শাসন ব্যবস্থা ও বৌদ্ধধর্ম প্রচার ও প্রসারে রাজন্যবর্গে অবদান
প্রাচীন আরাকান রাজশক্তি দক্ষিণের শঙ্ক নদী অতিক্রম করে। পরবর্তীতে মোগলেরা চট্টগ্রাম দখল করে নেয়। এই ভাবে বিভিন্ন সময়ে রাজশক্তির হাত বদল হয়ে ১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম ইংরেজদের করায়ত্ত হয়। আরো উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের চট্টগ্রাম একটি ঐতিহ্যবাহী থানার নাম রাঙ্গুনীরা। রাঙ্গুনীয়া শব্দটি বাংলা নয়। প্রাচীন বার্মার রাজধানী রেঙ্গুন এর সাথে তার উচ্চারণগত সাদৃশ্য রয়েছে। বার্মা বৌদ্ধ রাজ্য। রাঙ্গুনীয়াও বৌদ্ধ রাজ্য ছিল। এ প্রসঙ্গে আহাম্মদ হাসানের লেখা প্রণিধাণ যোগ্য। রাঙ্গুনীয়ার চাকমা রাজাদের আদি পুরুষদের শেরমুস্ত খাঁ ১৭৩৭ খ্রিঃ তিনি বর্তমান বান্দরবান জেলা আলীকদমে রাজত্ব করতেন। জাতে চাকমা হলেও তিনি মারমা রাজাদের মত মোগল সংস্কৃতির অনুরাগী ছিলেন বলে মনে হয়। স্বধর্মীয় আরাকান রাজাদের সামরিক চাপে অতিষ্ট হয়ে তিনি মোগলদের সাথে মিত্রতা করেন। ১৭৩৯ খ্রিষ্টাব্দে মোগল সুবাদার শাহসুজা আরাকান রাজার হাতে নিহত হলে মোগল-মারমা শত্রুতার সুযোগে তিনি নিরুপদ্রবে রাজত্ব করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পালক পুত্র শুকদেব ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে রাজা হন। পলাশী যুদ্ধের পর মোগল ছত্র ছায়ার তিনি চাকমা অধ্যুষিত রাঙ্গুনীয়ার পদুয়ার রাজধানী স্থানান্তরিত করে নিজেদের নামানুসারে শুকবিলাস নামকরণ করেন। ১৭৫৮ খ্রিষ্টাব্দে নবাব মীরকাশিম ইংরেজদের হাতে চট্টগ্রামের শাসনভার অর্পণ করলেও শুকদেব রাঙ্গুনীয়ায় স্বাধীন রাজা ছিলেন। ১৭৭৬ খ্রিষ্টাব্দে শুকদেব রাজা মৃত্যুর পর শের দৌলত খাঁ রাঙ্গুনীয়ার রাজা হন। তিনিও রাঙ্গুনীয়ার স্বাধীন রাজা ছিলেন। ১৭৮২ খ্রিষ্টাব্দে শের দৌলত খাঁর মৃত্যৃর পর তাঁর পুত্র জান বক্স খাঁ রাঙ্গনীয়ার রাজা হন। ইংরেজদের আক্রমণের সময় ইছামতির মোহনায় বৃটিশ নৌ-অবরোধের মূখে সেনাপতি রানু দেওয়ান অতœসর্মপন করেন। ১৭৮৭ খ্রিষ্টাব্দে রাজা জান বক্স খাঁ গর্ভণর ওয়ারেন হেস্টিংসের ক্ষমা লাভ করে ইংরেজদের বশ্যতা স্বীকার করেন (মি: কন্টিনের রেভেনিই হিস্টি দ্রস্টব্য)।
এ পরিস্থিতিতে নিরাপত্তাজনিত কারণে রাজা জান বক্স খাঁ শুকবিলাস থেকে উত্তর রাঙ্গুনীয়ায় রাজধানী সরিয়ে নিয়ে রাজানগর নামককরণ করেন। ১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর পর ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর পুত্র টব্বর খাঁ রাঙ্গুনীয়ার রাজা হন। ১৮১২ খ্রিষ্টাব্দে রাজা ধরম বক্সের খাঁর মৃত্যুর পরে ১২ বছর সুখলাল দেওয়ান রাজ্যের দেখাশুনা করেন। ১৮৪৪ খ্রিষ্টাব্দে ধরম বক্সের বড়রাণী কালিন্দি রাজ্যের শাসনবার গ্রহন করেন। রাঙ্গুনীয়ার রানীর হার্টও কালিন্দী রাণীর রোড তাঁরই স্মৃতিবহ। লুসাই যুদ্ধে ইংরেজদের সহায়তা করার বিনিময়ে তিনি কর্ণফুলি ও ইছামতি নদীর শুল্ক চন্দ্রঘোনায় ও ঘাটচেকে আদায় করা হত। এখানে একটা বিষয় উল্লেখ্য যে, রাঙ্গুনীয়ার চাকমা রাজাদের হয়ত নিজস্ব চাকমা নাম ছিল। মোগল আমলের মুসলিম সংস্কৃতির ফ্যাশন গ্রহনে আরাকান রাজাদের মত চাকমা রাজারাও মুসলিম নামে পরিচিত হলেও বৃটিশদের অধীনতার পর চাকমা রাজারা নিজস্ব হিন্দু নাম গ্রহণ করার সে রেওয়াজ এখনো বজায় আছে।
১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে রাণী কালিন্দীর মৃত্যুর পর রাজ বংশীয় হরিশ্চন্দ্রকে সরকার রাজা উপাধি সহকারে রাজা তথা জমিদারীর ভার অর্পণ করেন। ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে রাজা হরিশ্চন্দ্রের মৃত্যুর পর রাজ কুমার ভূবন মোহন সাবালক না হওয়া পর্যন্ত কোটর্স অব ওয়ার্ডস নামক ইংরেজদের এক সংস্থা জমিদারী দেখা শুনা করেন।
রাজা হরিশ্চন্দ্রের আমলেই রাঙ্গুনীয়া চাকমা রাজা রাজধানী পার্বত্য চট্টগ্রামে রাঙ্গামাটিতে নিয়ে যান। কিন্তু রাঙ্গুনীয়াতে তাঁদের জমিদারী বহাল থাকে। রাজা হরিশ্চন্দ্রের সৎভাই নবচন্দ্র দেওয়ান রাজা নগরের রাজবাড়িতে থেকে যান, তাঁর পুত্র মোহিনী দেওয়ান রাজানগর ইউনিয়ন বোর্ডের মেম্বার ছিলেন। তার ছেলে তুষার দেওয়ান এখন বেতবুনিয়ার হেডম্যান।
রাঙ্গুনীয়ার রাণীর হাট, রাজার হাট, পদুয়ার রাজার হাট ও রোয়াজা হাট রাঙ্গুনীয়ার চাকমাদের স্মৃতি হয়ে রয়েছে। বর্তমান প্রথম দিকে বৃটিশ শাসনাধীন রাঙ্গুনীয়ার ভারত শাসন আইনের আওতায় রাজনৈতিক কর্মকা- এগিয়ে যায়।  এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, চাকমা রাজাদের রাজ্য বলতে প্রধাণত রাঙ্গুনীয়া বুঝালেও পার্বত্য চট্টগ্রাম, রাউজানও এর অর্ন্তভূক্ত ছিল বলে জানা যায়। ( রাঙ্গুনীয়া স্মরণিকা, রাঙ্গুনীয়া সমিতি, ঢাকা, সম্পাদক, ডা: ফজলুর রহমান- ১৯৯৭, পৃষ্ঠা- ৫৭-৫৮)।
     রাঙ্গুনীয়ার গৌরবময় ইতিহাসের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের থেরবাদ বৌদ্ধ ধর্মে জাগরণের আরেক গৌরবদীপ্ত ইতিহাস গভীর ভাবে সম্পৃক্ত রয়েছে। চাকমা রাজা ধরমবক্স খাঁর মৃত্যুর পরে (১৮৩২ খ্রিষ্টাব্দে) মহিয়সী রাণী কালিন্দী প্রজাদের শাসন কার্যভার গ্রহণ করেন। তিনি ধর্মের প্রতি খুবই শ্রদ্ধাবতী ছিলেন। তাঁর আমন্ত্রণে হারবাং এর জন্ম জাত আরাকান থেকে আগত প্রখ্যাত বৌদ্ধ সংঘ মনীষা শাস্ত্রজ্ঞ শ্রীমৎ সারমিত্র বা সারমেধ মহাস্থবির ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দে বৈদ্য পাড়া হয়ে মহামুনি পাহাতলী গ্রামের ঐতিহাসিক চৈত্র সংক্রান্তি মেলায় আসলে সেখান থেকে রাজানগরে রাজ বিহারে আগমন করেন। 
মহামান্য সংঘরাজের মুখনি:সৃত হিতোপদেশ বাণী ও বিন¤্র ব্যবহারে তিনি (কালিন্দীরাণী) এতই অভিভূত হয়ে পড়ে ছিলেন যে, তারই সুফল স্বরুপ তাঁর নিকট বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে রাণী মহোদয় সেই দিনেই প্রাচীন তান্ত্রিক থেরবাদ ধর্মমত ত্যাগ করে থেরবাদী বৌদ্ধ আর্দশকে বরণ করে নিয়ে সমগ্র বৌদ্ধ সমাজ গগণে নতুন করে এক নজির স্থান করেন। তখন থেকে সমগ্র পার্বত্যবাসী বৌদ্ধদের মধ্যে বিরাট প্রভাব বিরাজ করছিল। শ্রদ্ধা পরায়ণ রাণী তাঁর প্রতি অতিশয় প্রসন্ন হয়ে ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের শেষে রাজকীয় ঐতিহাসিক পুর্ণ্যাহ উপলক্ষে মহাসমারোহে মহামান্য সংঘরাজ সারমেধ মহাস্থবিরকে আরাকানী ভাষায় উপাধিযুক্ত সীলমোহর প্রদানে সম্মাণিত করেন। এর অর্থ হল- ১২১৯ অঋ ঞযব ঝবধষ ড়ভ অৎধশধহবংং ঝধহমযধৎধলধ ধহফ ঠরনধুধপযধৎধ) সংঘরাজের পক্ষে এটা তাঁর দ্বিতীয়বার রাজকীয় উপাধি লাভ। পূণ্য শীলা কলিন্দী রাণীর প্রদত্ত উপাধি গ্রহন করে তিনি আকিয়াব ফিরে গিয়ে ছিলেন। তখনও চট্টগ্রামে রাউলি পুরোহিতগণ থেরবাদ অনুসারে সমগ্রভাবে উপসম্পদা গ্রহন করতে সম্মত হতে পারেননি। কিন্তু সংঘরাজের আগমনে ও বুদ্ধবাণীর উপদেশে শুনে যথেষ্ট প্রতিক্রিয়া এবং সচেতনতা জাগ্রতা হয়েছিল। তাঁর আগমনের পর পূর্ববঙ্গীয় মহাযানী ধর্মাবলম্বী বৌদ্ধ সমাজে থেরবাদ ধর্মের পুনৎজাগরণ শুরু হয় এবং সংঘরাজ নিকায় নামে বুদ্ধের বিনয় সম্মত ভিক্ষুসংঘ ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে মহামুনি পাহাড়তলীর ঐতিহাসিক হাঙ্গার ঘোনায় সর্বপ্রথম সাতজন রাউলি* পুরোহিত হলো যথাক্রমে- ১) পাহাড়তলী সর্বজন শ্রদ্ধেয় জ্ঞানালংকার মাথে, ২) ধর্মপুরের হরি মাথে, ৩) মির্জাপুরের সুধন মাথে, ৪) গুমাইমদ্দনের দুরাজ মাথে, ৫) বিনাজুরীর হরি মাথে, ৬) পাহাড়তলী কমল ঠাকুর এবং ৭) দমদমার অভয়চরণ মাথে (মহাস্থবির)।
পুরোহিত নাম ধর্মীয় গুরুদেরকে উক্ত উদক সীমায় শুভ উপসম্পদা দিয়ে পরিশুদ্ধ সংঘ সদস্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।
১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দে মহিয়সী কালিন্দীর পূন: আমন্ত্রণে মহাস্থবির মহোদয় আরাকান, কক্সবাজার এবং রামু হতে ২৫ জন বিনয়ধর স্থবির-মহাস্থবির ভিক্ষু সংঘ নিয়ে রাজানগরে আগমন করেন। রাণীর অর্থানুকুল্যে ও আচার্য চন্দ্রমোহন মহাস্থবিরের অনলস প্রচেষ্টায় এবং সংঘরাজ সারমেধ মহাস্থবিরের পৌরহিত্যে রাঙ্গুণীয়ায় পবিত্র ভিক্ষু সীমা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সীমার ‘চিং’ নাম তাঁরই প্রদত্ত। এই সীমা বাংলাদেশীয় বৌদ্ধদের সর্বপ্রথম ঐতিহাসিক পাষাণ নির্মিত ভিক্ষু সীমা (ভিক্ষু শীলাচারশাস্ত্রী- চট্টগ্রামের বৌদ্ধধর্ম, চট্টগ্রাম- পৃষ্ঠা-৪৫)।
রাজনগর রাজবিহারে এবং মহামুনি পাহাতলী মহামুনি মন্দিরকে ভিত্তি করে সমতলীয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বসবাসরত বৌদ্ধদের মধ্যে থেরবাদ বৌদ্ধ ধর্মের জাগরণ ক্রমে ক্রমে বিভিন্ন প্রান্তে নবজোয়ারের শুভ সুচিত হয়েছিল।
তখন থেকে সমতলীয় ও পার্বত্যবাসী বৌদ্ধদের মধ্যে নতুন করে অতীতের প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের ধারা শুরু হয়। ইতিপূর্বে  যা ছিল সেই সম্পর্কে মহাপ-িত রাহুল সাংস্কৃত্যায়ণ এর মতে, ‘স¤্রাট কনিষ্কের সময় প্রথম বুদ্ধমূর্তি নির্মিত হয়। তখন মহাযান মতবাদ প্রচারের সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে বড় জাঁকজমকের সাথে বুদ্ধমূর্তি পূজা-অর্চনা চলতে থাকে এবং সেখানেই বহুশত বোধিসত্ত্বের মূর্তিও নির্মিত হয়। এই বোধিসত্ত্বদের তারা ব্রহ্মাণদের দেব-দেবীর আসন অর্পণ করেন। তারা এই বোধিসত্ত্বদের ‘তারা’ এবং প্রজ্ঞা পারমিতার বুদ্ধ দেব-দেবীও কল্পনা করেন। তখন তাদের ভাবনা করার জন্য অনেক স্তোস্ত্রাদিও ও রচিত হতে থাকে। তারা হীনযানের সূত্র হতে অধিক মাহাত্মাপূর্ণ নিজেদের সূত্র রচনা করেন। বহুশত পৃষ্টায় সূত্রগুলি শীঘ্রই পাঠ হয় না বলেই তারা প্রত্যেক সূত্র দুই তিন পদ্ধতিতে রচনা করেন। এই মহাযান মতবাদ (তন্ত্রযান, বজ্রযান ও মন্ত্রযান) সপ্তম/অষ্টম শতাব্দী পর্যন্ত চলতে থাকে। তখন তারা কেউ পন্হী (জুতা) নির্মান করতেন বলে ‘পন্হী পা; কেউ কম্বল পড়ে থাকতেন ‘কমড়ি পা; কেউ ওখল রাখতেন বলে ওখরী পা বলা হত। এক কথায় তাদের বলা হত সিদ্ধযোগী। এই সব সিদ্ধযোগীরা বা লুলিরা জঙ্গলে তপস্যা করতেন। তারা জনসাধারণ হতে ঠিকই দূরে থাকতে চাইতেন, কিন্তু জনসাধারণ ততই তাদের কাছে যেতেন। লোকেরা এই সিদ্ধযোগীদের বোধিসত্ত্ব ও অন্যান্য দেবতাদের ন্যায় অলৌকিক ঋদ্ধি ও দিব্য শক্তির অধিকারী মনে করতেন। রাজারা নিজেদের কন্যাদের পর্যন্ত তাদের দান করতে দ্বিধাবোধ করতেন না (ভারত মে ও বৌদ্ধ ধরমকা উত্থান অর পতন দিল্লী- ২০০১পৃঃ ১১)।
এই সকল গৃহী পুরোহিতরা বংশ পরষ্পরায় বৌদ্ধ সমাজে কালী পূজা, দুর্গা পূজা, মনসা পূজা ও প্রভৃতি পূজায় স্বহস্তে পশুবলি করতেন। এই প্রসঙ্গে ভারতীয় রাষ্ট্রপতি পুরষ্কারে ভূষিত পন্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির বলতেন। চট্টগ্রামের চাকমা রাজাদের কালী মন্দির ও শিব মন্দিরে পূজা করতে দেখে অনেকেই তাদেরকে অবৌদ্ধ মনে করতেন। বস্তুতঃ থেরবাদ ধর্মমত গ্রহণের পূর্বে বাংলার সকল বৌদ্ধরা নানা দেব-দেবীর পূজায় অভ্যস্ত ছিলেন (শাসন বংশ, অনুবাদ, পন্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির ,মূখবন্ধ, কলি- ,পৃষ্ঠায় -১৯৬২)।

বৌদ্ধ ধর্ম জাগরণে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ভূমিকা
    বুদ্ধ ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার ও প্রসারের মূলে বুদ্ধ প্রমুখ মহান ভিক্ষুসংঘের ভূমিকা অতুলনীয়। বুদ্ধ সমেত ৬১ জন অর্হৎ শিষ্যদের নিয়ে তাঁর সাধনা লব্ধ জ্ঞান জীব জগতের মহান কল্যাণে বিশেষতঃ দুঃখ মুক্তির উপায় হিসেবে প্রচারাভিযান এখন অব্যহত রয়েছে। পৃথিবীতে যতদিন পাঁচজন ভিক্ষু সদস্য থাকবেন ততদিন বুদ্ধের ধর্মবাণী চিরঞ্জীব হয়ে থাকবে। রাজা-মহারাজা, ধনী-গরীব, দায়ক-দায়িকাগণ পৃষ্টপোষকতা করবেন।
সম্ভবতঃ এ কারণে প-িত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহোদয় বলেছেন, রাঙ্গামাাটিতে যে সকল বৌদ্ধ আছেন তাঁহারা যদিও এখন চট্টগ্রামের বৌদ্ধদের শিষ্য, তথাপি তাহাঁদের মধ্যে এমন আচার ব্যবহার আছে, তাঁহাতে বোধ হয় তাঁহারা প্রাচীন ভারতীয় বৌদ্ধ; কিন্তু নিকটবর্তী চট্টগ্রামের বৌদ্ধদের সংশ্রবে আসিয়া তাঁহারা অনেক পরিমাণে হীনযান মত গ্রহন করিয়াছেন ( হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, ৩য় খ-, রচনা সংগ্রহ কলি- পৃ: ৩৬০)।
    পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধদের মধ্যে থেরবাদ বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব ব্যাপক দেখা গেলেও মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, লুসাই চাকসহ আরো অনেক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠিরা একই ধর্মাবলম্বী। শুধুমাত্র ত্রিপুরা জনগোষ্ঠিদের হিন্দু ধর্মের আর্দশকে গ্রহণ করতে দেখা যায়। ত্রিপুরা সম্প্রদায় ব্যতীত অন্যান্য জনগোষ্ঠি স্মরণাতীত কাল থেকে বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে থেরবাদ বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার ও প্রসারের আগে তাঁদের ধর্ম ছিল মূলতঃ বৌদ্ধ ধর্মের বিবর্তিত তন্ত্রযান-মন্ত্রযান ও বজ্রযানের প্রভাব ছিল বেশী। এই তন্ত্রযান বৌদ্ধ ধর্ম গুরুদেরকে বলা হত লুরি। ইদানিং কোন কোন স্থানে চাকমাদের মধ্যে এই ‘লুরি’ দেখা যায়। এই ‘লুরি’ শব্দটি পাল যুগে রচিত ‘চর্যাগীতি’তে দেখা যায়। যেমন- ‘অদয় বঙ্গালে দেশ লুড়িউ’।
    চাকমাদের দু’টি প্রাচীন শাস্ত্র গ্রন্থ আছে। একটি যোগ কালাম এবং অপরটি ভদকালাম। এই গ্রন্থ দু’টিতে নাথ যোগীদের অন্যতম গুরু গোরক্ষনাথের কথা উল্লেখ্য যোগ্য। চর্যাগীতিতে খানহ্ পা, সরহ পা, লুই পা (মৌননাথ বা মৎস্যে পা), হাড়ী পা প্রভৃতি ৮৪ (চুরাশি) জন সিদ্ধ যোগী বা লুরিদের কথা উল্লেখ রয়েছে (চর্যাগীতি পঞ্চাশিকা, পৃ: ৪৪)।
    দৈনন্দিন ধর্মীয় কাজে ব্যবহৃত চাকমা লুরিদের প্রণীত গ্রন্থ গুলিকে ‘আগতারা’ বলা হত। এগুলি মূলতঃ ভগবান বুদ্ধের উপদিষ্ট এক একটি সুত্রের এক একটি অংশ বিশেষ। সুত্র গুলি পালি, সংস্কৃত, চাকমা, ব্রহ্মী প্রভৃতি সংমিশ্রত ভাষায় রচিত। আবার দু’টি একটি বিশুদ্ধ পালি ভাষায়ও দেখা যায়। একাদশ শতাব্দীতে ব্রহ্মদেশের রাজা অনিরুদ্ধ তাঁর সা¤্রাজ্যে থেরবাদ ধর্ম প্রতিষ্ঠা করার পর উক্ত ‘অরি বা লুরি’দের তাঁর দেশ থেকে বিতারিত করেন, এই গৃহী পুরোহিতরা চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে এসেছিলেন বলে উল্লেখ পাওয়া যায়। সম্ভবতঃ তারাই উক্ত ‘তারা’ গ্রন্থগুলি বহন করে  এনেছিলেন (ভিক্ষু শরণ পাল, বৌদ্ধধর্ম উত্থান-পতন ও চাকমা বৌদ্ধ সমাজ, কলি-২০০৯, পৃ: ১০১)।
    রাণী কালিন্দী তান্ত্রিক মতবাদ থেকে থেরবাদ ধর্মে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তা প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে সর্ব প্রকার সাহায্য সহযোগিতা দান করেন। ঐ সময় রাণীর পৃষ্ঠপোষকতায় নীল কমল ও ফুল চন্দ্র লোথক কর্তৃক বর্মী ভাষায় লিখিত ‘থাদুওয়াং’ (শাক্যবংশ) গ্রন্থের অনুবাদ করা হয়। যা বৌদ্ধ রঞ্জিকা নামে গ্রন্থটি রাণীর মৃত্যু (১৮৭৩ইং) বেশ কয়েক বছর পরে ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল (সুগত চাকমা: চাকমা পরিচিতি, রাঙ্গামাটি, ১৯৯৩ইং)।
    এই গ্রন্থটি বাংলা ভাষায় রচিত গৌতম বুদ্ধের প্রথম জীবন গ্রন্থ। থাদুওয়াং গ্রন্থে শাক্য সিংহ গৌতম বুদ্ধের অভিসন্ধি, অভিনিষ্ক্রমণ, বুদ্ধত্ব প্রাপ্তি, ধর্ম প্রচারক এবং পরিশেষে মহাপরিনির্বাণ প্রাপ্তি পর্যন্ত সমগ্র জীবন আখ্যান বর্ণিত হয়েছে (দাসগুপ্ত, নলিনীনাথ, বাংলায় বৌদ্ধধমর্, কলিকাতা-২০০১)।
    ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে চাকমারাণী পূণ্যশীলা কালিন্দী মহান পুণ্য পুরুষ সংঘ মনীষা সারমেধ মহাস্থবিরের নিকট থেরবাদী মতাদর্শে দীক্ষিত হওয়ার সময়ে কোন ‘লুরি’ তাঁর পূর্ব ধর্মমত ত্যাগ করে থেরবাদ আদর্শ গ্রহণ করেছেন বলে জানা যায়নি। রাণী কালিন্দীর থেরবাদে দীক্ষিত হওয়ার আনুমানিক সতের বছর পর দীননাথ চাকমা নামক জনৈক ‘লুরি’ তাঁর তান্ত্রিক ধর্মের বেড়াজাল ছিন্ন করে প্রথম থেরবাদী ভিক্ষু ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। তাঁর ভিক্ষু নাম ছিল শ্রীমৎ বরমিত্র। দুর্ভাগ্য উপসম্পদা আচার্য কে, সন, তারিখ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ভিক্ষুত্ব গ্রহণের পর ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজগুরু পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন শ্রীমৎ রথবংশ নামে আর একজন ভিক্ষুর নাম পাওয়া যায়। এবং তিনিও রাজগুরু পদে সম্মাণিত ছিলেন। কাট্টলি নিবাসী পুনংচান চাকমা ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে উপসম্পদা গ্রহন করে শ্রীমৎ বিজয়ানন্দ ভিক্ষু নামে খ্যাত হয়ে ধর্ম প্রচারে মনোনিবেশ করেন। তিনিও ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজগুরু পদে মর্যাদা লাভ করে সদ্ধর্মের প্রচার ও প্রসারে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। তাঁর গৃহী নাম ছিল কালা চোগা চাকমা। তিনি তখনকার দিনে বৌদ্ধ দেশ শ্রীলংকায় গিয়ে বৌদ্ধ শাস্ত্র অধ্যয়ন করে বিশেষ ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। স্বদেশ প্রত্যাবর্তন পূর্বক বৌদ্ধ ধর্মের জাগরণে বিরল ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁর উপসম্পদার গুরু ছিলেন রাজগুরু ধর্মরতœ মহাস্থবির। তারপর ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে পালকধন নামে জনৈক চাকমা যুবক সংসার ধর্ম ত্যাগ করে প্রব্রজ্যাসহ ভিক্ষুত্ব ধর্ম গ্রহণ করে। তখন তাঁর নাম ছিলেন শ্রীমৎ প্রিয়রতœ ভিক্ষু। ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে চাকমা রাজা ভূবন মোহন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বোয়লখালী দশবল বৌদ্ধ রাজবিহারে ১৯৩৪-১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজগুরু পদে ছিলেন। সেখানে ক্রমাগত সতের বছর অবস্থান কালীন অনেক ছাত্র শ্রমণকে তিনি এই বিহারে শিক্ষা প্রদান করেছিলেন। ছেলেদেরকে নিয়ে বিহারের চারিদিকে সুশোভন বৃক্ষ রোপন করে বিহারটি ছায়া সুশীতল তপোবন রুপ দান করেন। সেখান থেকে রাঙ্গামাটি রাজবিহারে অবস্থান করে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত ছেলেদেরকে আশ্রয় দিতেন এবং হাই স্কুলে পড়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। তরুন মেধাবী ভিক্ষু শ্রামণদেরকে ধর্মীয় শিক্ষার জন্য চট্টগ্রাম এবং কলিকাতায় পাঠিয়ে দিতেন। এভাবে তিনি ত্রিশ ও চল্লিশের দশক গুলিতে এই জেলায় একটি সুসংহত ভিক্ষুসংঘ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অনেক অবদান রেখেছিলেন।
১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে চাকমা রাজ পুর্ণ্যাহের সময় চাকমা সার্কেলের ভিক্ষুদের নিয়ে ‘পার্বত্য ভিক্ষু সমিতি’ নামে একটি সংস্থা গঠন করা হয়েছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের ধর্মীয় উন্নতি সাধনে এটা ছিল ভিক্ষুদের প্রথম সংস্থা। চট্টল ভিক্ষু সমিতি নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়েছিল। পুস্তিকা খানিতে বৌদ্ধ গৃহীদের ত্রিরতœ বন্দনা, পঞ্চশীল গ্রহনসহ প্রাণী হত্যা ও সুরাপানের কুফল নিয়ে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাহিনী সন্নিবেশিত ছিল। এই সমিতির সভাপতি ছিলেন রাজগুরু ভদন্ত ধর্মরতœ মহাস্থবির, সহ-সভাপতি ভদন্ত প্রিয়রতœ মহাস্থবির, সম্পাদক ছিলেন ভদন্ত আনন্দমিত্র ভিক্ষু, যুগ্ম-সম্পাদক ছিলেন ভদন্ত বিমলানন্দ ভিক্ষু।
ভদন্ত প্রিয়রতœ মহাস্থবিরের শিষ্যবর্গের মধ্যে ভদন্ত আনন্দ ভিক্ষু, ভদন্ত বিমলানন্দ ভিক্ষু, ভদন্ত ক্ষান্তিবর ভিক্ষু, ভদন্ত শীলানন্দ ভিক্ষু, ভদন্ত রতœজ্যোতি ভিক্ষু, ভদন্ত উদয়ানন্দ ভিক্ষু ও ভদন্ত দেবানন্দ ভিক্ষু প্রমূখের নাম উল্লেখযোগ্য। এদের মধ্যে ক্ষান্তিবর ভিক্ষু মহামুনি পালি টোলে ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করে সূত্রের আদ্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। বিদ্যারতœ ভদন্ত বিমলানন্দ ভিক্ষু কলিকাতায় ধর্মোদয় পালি কলেজ থেকে সুত্র, বিনয়, শেষ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে অভিধর্মের আদ্য ও মধ্য পাশ করেছিলেন। তিনি ‘আঘর তারা’ সম্পাদনের জন্য আরাকান ও ব্রহ্মদেশ ঘুরে আসেন। সেখানে তিনি ‘অরিন্তমা’ তারা নামে একটি তারা সংগ্রহ করেন। এই ‘অরিন্তমা’ তারাটি তৎকালীন ‘গৈরিকা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে ভদন্ত বিমলানন্দ ভিক্ষু অকাল মৃত্যু পার্বত্যবাসীদের অপুরনীয় ক্ষতি সাধন হয়েছিল। এর বছর খানেক পরে সদ্ধর্ম ও সমাজ হিতৈষী ভদন্ত প্রিয়রতœ মহাস্থবির ও দেহত্যাগ করেন। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর আরেক প্রিয় শিষ্য ভদন্ত আনন্দ মিত্র ইহলোক ত্যাগ করেন।
পন্ডিত ভদন্ত ক্ষান্তিবর মহাস্থবির সূত্র, বিনয় ও অভিধর্ম বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন। তিনি ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে রেঙ্গুনে অনুষ্টিত ৬ষ্ঠ সংগীতি অনুষ্টিত তৎকালীন পাকিস্থান বৌদ্ধ প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন। তিনি দীর্ঘকাল পর্যন্ত ত্রিপুরা রাজ্যে ভিক্ষুসংঘের সংঘনায়ক ছিলেন। ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তাঁর সাধন পীঠে দেহ ত্যাগ করেন।
চাকমা রাজগুরু আচার্য ভগবান চন্দ্র মহাস্থবির (যিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি বিভাগে অধ্যাপক) রাজগুরু শ্রীমৎ ধর্মরতœ মহাস্থবির আমৃত্যু পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং চট্টগ্রাামের বৌদ্ধদের মধ্যে ধর্মীয় শিক্ষার অগ্রগতির ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখেছিলেন। রাজানগর রাজবিহারে দীর্ঘকাল অবস্থান করেন রাজগুরু ভগবানচন্দ্র মহাস্থবির, রাজগুরু ধর্মরতœ মহাস্থবির র্দীঘনিকায় এবং মহাপরিনির্বান গ্রন্থের লেখক আমৃত্যু সেখানে থেকে শুধু সাহিত্য সাধনা করেননি সমাজ সংস্কার ও সদ্ধর্মের জাগরণে অভূতপূর্ব পরিবর্তন সাধন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। রাঙ্গামাটি আনন্দ বিহারে অধ্যক্ষ দার্শনিক বিশুদানন্দ মহাস্থবির সত্যদর্শন ও ভক্তি শততম গ্রন্থ প্রণেতা এবং উপ-সংঘরাজ বহুগ্রন্থ প্রণেতা সুগত বংশ মহাস্থবির কয়েক বছর সেখানে অবস্থান করে পার্বত্যবাসী বৌদ্ধদের পাশাপাশি বাঙ্গালি বৌদ্ধদের মধ্যে ধর্মীয় চেতনাকে উজ্জীবিত করে তুলেছিলেন। শ্রীমৎ জ্ঞানশ্রী মহাস্থবির (বর্তমান উপ-সংঘরাজ) ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে বোয়ালখালী দশবল বৌদ্ধবিহারে কয়েক বছর অবস্থান করে ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে ‘র্পাবত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রম’ এবং ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে রাঙ্গামাটি ‘মোনঘর’ নামে আশ্রম প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আন্তরিক সহযোগিতা করে অত্র এলাকার ছেলে-মেয়েদেরকে আধুনিক শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষার সুযোগ সুবিধা দিয়ে শিক্ষার আলো বঞ্চিতদেরকে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষার পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। তার প্রত্যক্ষ সুফল স্বরুপ কলিকাতায় ‘শিশু করুনা সংঘ’ এবং ঢাকাস্থ ‘বনফুল আদিবাসী গ্রীন হার্ট স্কুল কলেজে’র প্রতিষ্ঠাদ্বয় যথাক্রমে কর্মবীর শ্রীমৎ বিমলতিষ্য মহাস্থবির এবং কর্মবীর শ্রীমৎ প্রজ্ঞানন্দ মহাস্থবির দেশ-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত সাংঘিত ব্যক্তিত্ব যাঁদের দ্বারা হাজার হাজার আদিবাসী পার্বত্য এলাকার ছেলে-মেয়েরা বর্হিবিশ্বের প্রতিষ্ঠা লাভ করতে সক্ষম হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে। এ জাতীয় সমাজ-সদ্ধর্মের সেবামূলক কার্যক্রম যে কোন জাতির জন্য অতীব শুভ সংবাদ। বিশ্বের যত বৌদ্ধ দেশ আছে সব দেশের আতœত্যাগী মহান ভিক্ষুসংঘ অতি উচ্চ শিক্ষিত, শাস্ত্রজ্ঞ, গবেষক এবং লেখক হিসেবে স্ব-জাতি, স্ব-সংস্কৃতি এবং স্বদ্ধর্মের উন্নতিতে অসাধারণ অবদান রেখে চলেছেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কলম্বাস আমেরিকা আবিস্কার করার অনেক আগে আতœত্যাগী এবং ধর্ম প্রচারক বৌদ্ধ ভিক্ষুরাই আমেরিকা আবিস্কার করেছিল। এটা ভিক্ষুদের জন্য অতি আতœশ্লাগার বিষয়। বলতে দ্বিধা নেই চট্টগ্রামের বাঙ্গালি বৌদ্ধ ভিক্ষুরা শিক্ষা-দীক্ষায় ধ্যানে-জ্ঞানে, শাস্ত্রে অসাধারণ প-িত, সাধক, লেখক, সাহিত্যক, কর্মবীর হিসেবে বিগত শতাব্দীতে দেশে-বিদেশে শাসন সদ্ধর্মের স্তম্ভ হিসেবে সুনাম-সুখ্যাতির শীর্ষৈ আরোহন করেছেন। এখনও কিছু কিছু প্রভাব থাকলেও আগের তুলনায় কম বললেও ভূল হবে না। পঞ্চাশের দশক থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে কয়েক জন অসাধারণ পুণ্য পুরুষ ত্রিপিটক শাস্ত্রজ্ঞ মহান সাধক এবং সমাজ-সদ্ধর্ম সংস্কারক সাংঘিক মহিষীদের আর্বিভাব সত্যিই গৌবরবের বিষয়। তম্মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবির এবং সাধকশ্রেষ্ঠ আর্য পুরুষ সাধনানন্দ মহাস্থবির মহোদয় (বনভান্তে) অন্যতম। 
ড. জিনবোধি ভিক্ষু, অধ্যাপক, পালি বিভাগ, চ্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Theme images by 5ugarless. Powered by Blogger.