রণাঙ্গনের সারিতে আমরা হবো সৈনিক -কল্পনা চাকমা
রণাঙ্গনের সারিতে আমরা হবো সৈনিক
পশ্চাৎপদ দেশে এমনকি অগ্রসর পুঁজিবাদী দেশেও নারী পুরুষের অধিকারের ক্ষেত্রে বাস্তবতা অনেক, বৈষম্য আরও অনেক বেশি। 📷বিশ্বের নারী সমাজ সুদীর্ঘকাল ধরে যে পুরুষ কর্তৃক নির্যাতিত হয়ে আসছে,বঞ্চনা ও অবহেলার শিকার হয়ে আসছে সে সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই। বিশ্বজুড়ে পশ্চাৎপদ দেশে ও সমাজে নারীদের পারিবারিক সামাজিক নিপিড়ন একই রকম। কিন্তু আমি মনে করি পার্বত্য চট্রগ্রামের পাহাড়ি মেয়েরা বেশী নির্যাতিত। কেননা, দীর্ঘকাল ধরে চলছে পাহাড়িদের জাতীয় অস্তিত্ব বিলুপ্ত করে দেয়ার ষড়যন্ত্র। এই পার্বত্য অঞ্চরে সবুজ স্যামল পাড়ের অন্তরালে রয়েছে বুকফাটা আর্তনাদ,গণবিদারী আর্তচিৎকার,একদিকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দশ ভাষাভাষী জনগোষ্ঠৌর জাতিয় অস্তিত্ব সংরক্ষণের জন্য গণসংগ্রাম এবং অন্যদিকে সেই সংগ্রামকে দমন করার জন্য সামরিক প্রচেষ্টা-পার্বত্য চট্রগ্রামকে পরিণত করেছে এক অগ্নিগর্ভ রণক্ষেত্রে। এখানে উগ্র বারুদ অত্যাচারে জনজীবন হয়েছে দুর্বিসহ। দীর্ঘ অত্যাচার নির্যাতন আর যন্ত্রণায় ক্ষত-বিক্ষত পার্বত্য জনতার আজ বেদনার্ত উচ্চারণ 'জীবন আমাদের নয়।' এই অবস্থায় বাংলাদেশের অপরাপর নারী সমাজের চাইতে পার্বত্য চট্রগ্রামের নারীদের অবস্থা করুণ। এরুপ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে নারীর ভূমিকা পালন অত্যন্ত কঠিন কাজ নিঃসন্দেহে। তারপরেও আমাদের অগ্নিপরীক্ষার মধ্যদিয়ে রাজনৈতিক কর্মকান্ড চালিয়ে যেতে হবে। রণাঙ্গণের সারিতে, মুক্তির মিছিলে সামিল হতে হবে। পার্বত্য চট্রগ্রামে পাহাড়ি নারীরা একদিকে সরকারি সেনাবাহিনী ও স্থানীয় বে- আইনী অনুপ্রবেশকারীদের দ্ধারা প্রতিনিয়ত ধর্ষণ,অপহরণ,শ্লীলতাহানি ও চরম লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছে। অন্যদিকে তাদেরকে সামাজিক বৈষম্য গন্ডিবদ্ধ জীবন যাপন ও পুরানো ধ্যান ধারণায় নিমজ্জ্বিত করে রাখা হয়েছে। আসলে পাহাড়ীদের আত্ননিয়ন্ত্রণাধিকার ব্যতিত পৃথকভাবে পার্বত্য চট্রগ্রামে পাহাড়ি নারীদের মুক্তি হতে পারে না। কাজেই নারীকে শোষণ নির্যাতন থেকে মুক্ত করতে হলে বিচ্ছিন্নভাবে শুধু নারীমুক্তি আন্দোলনের মাধ্যমে সম্ভব নয়। এ মুক্তি পুরুষ ও নারী জাতির একে অপরের মুক্তির সাথে সম্পকির্ত। তাই নারী ও পুরুষকে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করতে হবে, আত্ননিয়ন্ত্রাণাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। সেজন্য প্রত্যেক্ষ জুম্ম নারীকে নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে প্রকৃত নারী মুক্তি আন্দোলনে তথা আত্ননিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এগিয়ে আসতে হবে। অগ্রণী ভৃমিকা নিতে হবে। অবশ্যই ইতোমধ্যে স্বাধিকার আন্দোলনে সংগ্রামরত বিভিন্ন সাড়া পেয়ে পাহাড়ী নারী সমাজ কিছুটা হলেও ঐক্যবদ্ধ। যেহেতু চূড়ান্ত বিজয় এখনো অর্জিত হয়নি সেহেতু বিজয়ের জন্য আরো বেশি ঐক্যবদ্ধ হওয়া বর্তমান অবস্থায় অত্যন্ত জরুলি। আমরা এখনো সামাজিকভাবে, ধর্মীয়ভাবে,রাষ্ট্রীয়ভাবে ও রাজনৈতিকভাবে অবহেলিত। এদেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। এই বৃহওর অংশকে বাদ দিয়ে কোন উন্নয়নই সম্ভব নয়। আমরা চাই এমন একটা সমাজ ব্যবস্থা যেখানে নারী পুরুষের সমধিকার থাকবে। এক শ্রেণীর মানুষ অন্য শ্রেণীর মানুষকে শোষণ করতে পারবে না। এক জাতি অন্য জাতির উপর শোষণ নির্যাতন চালাতে পারবে না। সব মানুষই মানবিক গুনাবলিতে সমৃদ্ধ হবে এবং জীবন জীবিকাসহ সর্বক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সমান সুযোগ-সুবিধা পাবে। এ ধরনের বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই একমাত্র নারী মুক্তি সম্ভব।
আমাদের সামাজিক এবং পারিবারিক অবকাঠামো এমনভাবে তৈরী যে, নারীরা সচেতন হবার চেষ্টা করলে অনেকে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। শৃংখল ভেঙ্গে আসার চেষ্টা করলে অনেকে তাকে উচ্ছৃঙ্খলতা হিসাবে আখ্যায়িত করেন। আন্দোলনে সামিল হলে তাকে চরিত্রহীন বলে মনে করা হয়। কিন্তু এসব কুপমন্ডুকতায় আমরা বিচলিত নই।
বেগম রোকেয়া যেভাবে ঘুণেধরা সমাজ থেকে বিরিয়ে এসে নারী শিক্ষার আলো জ্বালিয়েছিলেন, বীরকন্যা প্রীতিলতা যেমনি কাঁধে অস্ত্র তুলে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন, জীবনকে উৎসর্গ করেছেন, সেভাবে জুম্ম নারী সমাজকে জাগাতে হবে। স্বাধিকার আদায়ের মহান সংগ্রামে নারীদের অংশগ্রহন নিশ্চিত করতে হবে। 📷 নারী অধিকার এমনি এমনি আসবে না। অধিকার কাোর দয়ার সামগ্রি নয়, অনুদানের বিষয় নয়। এ অধিকার অর্জন করতে হয়, ছিনিয়ে আনতে হয়। অধিকার বঞ্চিত পাহাড়িরা স্বাধীন বাংলাদেশে স্বতন্ত্র সত্ত্বা নিয়ে বেঁচে থাকতে চায় যা একমাত্র #স্বায়ত্বশাসন কায়েমের মাধ্যমে সম্ভব।
'পুরুষ অবরুদ্ধ আপন দেশে নারী অবরুদ্ধ নিজ নিবাসে ' এ অবস্থা আর কত দিন চলবে? আর আমাদের জুম্ম নারীদের অবস্থা বর্ণনা করার জন্য আমরা আর কতদিন বলব -
'সচল হয়েও অচল সে যে বস্তার চেয়েও ভারী মানুষ হয়ে ও সঙ- এর পুতুল পার্বত্য কোলের নারী '।
[ প্রথম প্রকাশ, স্বাধিকারঃ বুলেটিন নং-সাত, ২০ আগস্ট ' ৯৭ থেকে সংকলিত] ১০ জুন ২০১৭ সুনয় চাকমা মুলিম্মো
No comments
Post a Comment