বৌদ্ধ ধর্মে ইশ্বর ও বিশ্বতত্ব

স্মরণাতীত কাল থেকে মানুষের জ্ঞান পিপাসু ও কৌতুহলী মন বিভিন্ন জনের কাজে জগতের সৃষ্টি ও সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে আসছেন। বিভিন্ন জ্ঞানী, দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিকগণ এখনও সে প্রশ্নে বিভিন্ন মত পোষণ করে থাকেন। তবুও জগতের সৃষ্টি  রহস্যের মূলে এবং জাগতিক ও অতিজাগতিক কর্মকান্ডের পিছনে সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বও আছেন। এ বিশ্বাস মানুষের দীর্ঘদিনের। মানুষের এ বিশ্বাস আর দৃঢ় হয়েছে ঈশ্বর সমর্থিত ধর্মগুলোর মাধ্যমে। পৃথিবীর অন্যতম জ্ঞানী লোক শিক্ষক গৌতম বুদ্ধের নিকট ও সমস্ত দার্শনিক প্রশ্ন উত্থাপিত হলে এ নিয়ে দুঃখজর্জরিত মানুষের মাথা ঘামানোকে তিনি সম্পুর্ণ নিরর্থক মনে করতেন। তাঁর মতে, এ সমস্ত দার্শনিক প্রশ্ন সম্পুর্ণ অবান্তর, এতে জীবন সমস্যার সমাধান হয় না। এতদসত্ত্বেও মানুষের ভ্রান্ত ধারণা ও মিথ্যাদৃষ্টি নিরসনকল্পে মাঝে মাঝে তিনি সুন্দর উপমা ও যুক্তির সাহায্যে সহজ ভাষায় এ জাতীয় প্রশ্নের উত্তর প্রদান করতেন। যেমন জাগতিক কার্যেও নিয়ন্ত্রক ও মুক্তিদাতা হিসেবে ঈশ্বরকে তিনি অস্বীকার করেছেন। তাই বৌদ্ধ ধর্মে ঈশ্বরের স্থান নেই।
বৌদ্ধ ধর্মের মতে, প্রত্যেক কার্যের কারণ আছে, কিন্তু চূড়ান্ত কারণ বলে কিছু নেই। সুতরাং  চূড়ান্ত কারণ রুপে ঈশ্বরের আস্তিত্ব স্বীকার করার কোন প্রয়োজন হয় না। ইশ্বরের স্বরুপ ও মানুষের সাথে তার সম্পর্ক নির্ণয় করার জন্য সুদূর প্রাচীনকাল থেকে দার্শনিকরা যে চেষ্টা করে আসছেন, তাতে মানবিক বৃদ্ধির কসরত ব্যতীত অন্য কোনো উপকার হয়েছে বলে মনে হয় না। বৌদ্ধধর্মে কোন অদৃশ্য অলৌকিক বা বাহ্য শক্তির ভূমিকা নেই। মানুষ সাধারণ দৈনন্দিন কার্যাবলী থেকে চিরমুক্তি নির্বাণ লাভ পর্যন্ত আপন কর্মফলের আওতাধীন। এখানে স্বীয় প্রচেষ্টায় চূড়ান্ত নৈতিক অগ্রগতি সাধনের মাধ্যমে নির্বাণ লাভের কথা বলা হয়েছে। তাই বৌদ্ধধর্মে আত্মশক্তি ভিন্ন অন্য কোনো শক্তির উপর নির্ভর না করে সেই নৈতিক অগ্রগতির সাধনের জন্য কতকগুলো জীবন ধারনের নীতিমালা দেখা যায়। নৈতিক অগ্রগতির জন্য ঈশ্বরের সাহায্যে প্রয়োজন নেই। অধিকন্তু ঈশ্বও যদি সকল কিছুর কারণ হন, তিনি যদি সর্বশক্তিমান হন এবং তাঁর ইচ্ছায় যদি জগতের সকল কিছুই ঘটে থাকে, তবে মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা কোথায়? এবং মানুষ সৎ আচরণের ছাড়পত্র বা নারকীয় ভয়ের দোহাই দিয়ে মানুষকে পরিচালিত করার মধ্যে স্বীয় কর্তৃত্ব বজায় রাখার এক ধরনের সুকৌশল দৃষ্টিগোচর নয় কি?
কোন কোন দার্শনিককে এমনও ভাবতে দেখা গিয়েছে যে, ঈশ্বর আছেন যদি, তবে তিনি কি ব্যক্তি না শক্তি? নিরাকার না সাকার? কিন্ত ব্যক্তি বলেই বেশি লোকে মানে এবং এটা স্বাভাবিকও বটে। এতে মানুষ আরাম পায়। শক্তিতে বুদ্ধি বিমোহিত হয়ে  পড়ে। ব্যক্তি ঈশ্বর স্বীকার করলে- তিনি মানুষের মতো হবে সাকার স্বরুপ। আবার অন্য কোন প্রাণীতে তাঁকে কল্পনা করা হলে, তা যদি সচেতন হয় তবে অনন্তরুপে বিদ্যামান ধরে নেয়া মুস্কিল হয়। আবার ব্যক্তির এককালে বহুরুপ অশিদ্ধ। এজন্য ঈশ্বরের রুপ চিন্তার পক্ষেও নিরাপদ নয়। অনেকে ঈশ্বরকে দয়াময়, করুনাময় রুপেও চিন্তা করে থাকেন। কিন্ত এতেও অনেকে আপত্তি করে থাকেন। পরের দুঃখ অপনোদনের ইচ্ছার নাম করুণা। অন্যের দুঃখে করুণার উদ্রেক হয়। নিষ্ঠুরতার উপশম করা করুণার কাজ। পরের দুঃখ অসহনতা করুণার স্বভাব সকল প্রাণী দুঃখ হতে মুক্ত হোক, এরূপ যার অন্তর, তিনিই কারুণিক। কারুণিক আমিত্ব জ্ঞানের অতীত। যিনি সংসার সৃষ্টি করলেন, স্বর্গ নরক সৃষ্টি করলেন, জাতি-জরাব্যাধি মৃত্যু সৃষ্টি করলেন, শোক, তাপ, দুঃখ, দৌমনস্য, সুবুদ্ধি, কুবুদ্ধি সৃষ্টি করলেন, তিনি আবার কিরূপে করুণাময়? ছেলেদের ন্যায় একজন বড় ক্রীড়ানক মাত্র। আবার অনেকে ঈশ্বরকে নিরাকার, নির্বিকার, নির্বিকল্প, নিরূপাধি রূপেও চিন্তা করেন। তিনি যদি নির্বিকার, নির্বিকল্প, তবে বিচিত্র সংসার রচনা তাঁর কাজ নহে। অধিষ্ঠান ও বিকল্পাত্মক এবং বিকারাত্মক যদি বলা হয়, তিনি অধিষ্ঠান করেন না, সংসার তাঁর স্বভাব হতে স্বঃনিষ্ক্রান্ত, তাহলে তিনি নির্বিকার কিরুপে? অনেকে সক্রিয় শক্তিরুপের তার কল্পনা করে থাকেন। যদি তিনি শক্তি, তবে নিরাকার। এই শক্তিই অন্তর্জগৎ। শক্তি এবং অন্তর্জগতে কোন ভেদ নেই। এই পথও কম জটিল নয়। এই শক্তি কি স্বয়ং জাত? জাত হলেই যে উভয় কোটি সসীম হয়ে পড়ে। শক্তির ন্যায় তবে কি ক্রিয়াজগৎ সকোটিক? কিন্তু একদা জগৎ ছিল না এবং একদা জগৎ ও থাকবেও না এ মতবাদ বিজ্ঞ ব্যাক্তির নয়। জগৎ কোন সময় ছিল না, কোন সময় হতে জগতের উৎপত্তি পশ্চাদানুসরণ করলে এর কোন কখনও আদি পাওয়া যাবে না। যার আদি নেই তা অনাদি, সুতরাং অসৃষ্ট। অতএব সংসার কার্যকারণ প্রবাহমাত্র।
এই সংসার আদৌ সৃষ্ট কিনা- অনেক মহাপুরুষ এ বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। যদি সংসার সৃষ্ট না হয়, তবে ¯্রষ্টার ধারনা নিরর্থক। সংসার সৃষ্ট স্বীকার করলে, ¯্রষ্টার হয় পূর্বকোটি সাদিত অর্থাৎ একদা ঈশ্বর ছিলেন না, অতপর সৃষ্টি করেই তিনি ঈশ্বর হলেন। সৃষ্টির পূর্বে তিনি ছিলেন কিনা, যদি ছিলেন কিনা, যদি ছিলেন কি ছিলেন- এর কোন সংজ্ঞা হয় না। সংসার না হতে তিনি কোথা থেকে সৃষ্টি করলেন? এরূপ প্রশ্নের উত্তরে বুদ্ধি বিমোহিত হয়। তাঁর অবস্থিতির জন্য অন্তত ছোট বিন্দুটিও যে কল্পনা করতে হয়। এই ছোট বিন্দু ঈশ্বরের পূর্বে কোথা থেকে এলো। আর অগ্রসর হওয়া নিরাপদ নয়।
ঈশ্বরই সংসার সৃষ্টি করলেন যদি, তবে তিনি সংসার স্বভাবিশিষ্ট। কারণ তাঁর স্বভাব হতেই এ সংসার সৃষ্ট হয়েছে। যদি ঈশ্বর সূর্য সৃষ্টি করেন, তবে সূর্যও ঈশ্বরের স্বভাববিশিষ্ট অন্যদিকে সৌরজগৎ প্রথম থেকেই ভঙ্গুর স্বভাব রূপে দেখা যায়, উদয় ব্যয়তা নিত্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। সুতরাং সমধর্মী ঈশ্বর ভঙ্গুর ও উদয় ব্যয়শীল এবং অনিত্য। সাধারণ জীব অপেক্ষা তাঁর কোনই আলাদা বৈশিষ্ট্য নেই। জন্ম-জরা-ব্যাধি ও মৃত্যুও অধীন।
ঈশ্বরের মধ্যে জগৎ সৃষ্টির শক্তি কর্মের কারণে হয়, অথবা বিনা কারণে? কর্মের কারণে হলে তবে সহেতুকই হয়। পুনরায় ঈশ্বরের কাজ কি? যদি কর্মের কাজ কি? যদি কর্মের কারণে না হয়- তবে অহেতুক সৃষ্টি হয়ে থাকে। এটা সঙ্গত নয়। যদি ঈশ্বর হেতুক সৃষ্টি হয় তবে যখন ঈশ্বর। এটাও ঠিক নয়, কারণ উভয়েই অনাদি হয়ে পড়েন প্রতীত্যসমুৎপাদের ন্যায়। আবার প্রশ্ন উঠে- তিনি প্রয়োজনে না নিষ্প্রয়োজনে জগৎ সৃষ্টি করেন। প্রয়োজন হলে- প্রয়োজনের প্রতি তিনি অনীশ্বর। সুতরাং তাঁকে জগদীশর কিরূপে বলা যায়। আবার নিষ্প্রয়োজনে হলে বালকের ক্রীড়াতুল্য হয়ে পড়েন।
 বৌদ্ধদের মতে, ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য যে সকল যুক্তি সাধারণত দেয়া হয় সেগুলি গ্রহণযোগ্য নয়। ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন প্রমাণের মধ্যে একটি প্রমাণ হলো, আদি কারণ বিষয়ক যুক্তি। এ যুক্তি অনুসারে জগতের একটি স্বয়ংসৃষ্ট আদি কারণ বা চূড়ান্ত কারণ আছে। কিন্তু বৌদ্ধরা এ চূড়ান্ত কারণে বিশ্বাস করে না। তাদের মতে  জগতের কারণ জগতই। জাগত ও প্রাণীদের সৃষ্টিকর্তা রূপে ঈশ্বরকে ধরে নিলে ঈশ্বরের সৃষ্টিকর্তা সম্বন্ধেও প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। অথচ সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কীয় এ জাতীয় অন্তহীন প্রশ্নের কোন সদুত্তর পাওয়া যায় না। তাই স্বয়ংসৃষ্ট চূড়ান্ত কারণের ধারনাও আত্মবিরোধপূর্ণ। জগতের প্রাণীসমূহের শারীরিক ও গুণগত বৈষম্য যেমন বড়-ছোট, জ্ঞানী-মূর্খ, সুন্দর-বিশ্রী, ধনী-দরিদ্র হওয়ার পিছনে কাজ করছে, কোনো ঈশ্বর নয়, বরং তাদের স্বীয় কর্মফল। আর এই জাগতিক প্রাণপ্রবাহের মুলে বিবর্তনবাদের মত রয়েছে প্রতীত্যসমুৎপাদের দ্বাদশ নিদান বা ভবচক্র- যার কার্যকারণ শৃঙ্খলে মানুষ জন্ম থেকে জন্মান্তরে প্রবেশ করে। সর্বশেষ ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে আর যে প্রমাণটি দেয়া হয়- তা উদ্দেশ্যবাদ বিষয়ক যুক্তি। এ যুক্তি অনুসারে ঈশ্বর জগতের সৃষ্টিকর্তা। আমরা জানি ঈশ্বর পূর্ণ এবং জগত অপূর্ণ। ঈশ্বর যদি পূর্ণ হন, তবে তিনি কেমন করে অপূর্ণ জগত সৃষ্টি করেন? খেয়ালবশতঃ ঈশ্বর এ জগৎ সৃষ্টি করতে পারেন না। কারণ এ জগতে নিয়মশৃঙ্খলা বিদ্যমান। কিন্তু খেয়ালবশত যে কাজ করা হয়, তাতে নিয়মশৃঙ্খলা থাকে না।
তাই ঈশ্বর নিয়ে তর্কাতর্কি বা দার্শনিক তত্ত্বের সৃষ্টি না করে বৌদ্ধধর্ম ঈশ্বরের নিরপেক্ষ থেকেছে। বৌদ্ধ ধর্ম কর্ম বিধানকে সকলের উপর স্থান দিয়েছে। কর্মবাদের সাহায্য জগতে জীবের দুঃখদুর্দশার ব্যাখা করা যায়, কর্মের ফলে জীবের জন্ম পুনর্জন্ম হয় এবং সুকর্মের ফলেই সে মুক্ত হয়। কার্যকারণ নিয়মাধীন এই কর্মচক্রে বাহ্য কারও নিয়ন্ত্রণ বা প্রভাব নেই। মানুষ তার নিজের ¯্রষ্টা, তার কর্মই তার সৃষ্টিকর্তা। অপরাধমূলক কাজের ক্ষমা করার কেউ নেই। মৃত্যুর পর মানুষের ভালমন্দের তালিকা দেখে পুরস্কার বা শাস্তি প্রদান করার জন্য স্বর্গে বা অন্য কোথাও ঈশ্বর বসে নেই। এরূপ ব্যক্তিগত ঈশ্বরের কল্পনাও বৌদ্ধ ধর্মে স্থান পায়নি। বৌদ্ধ ধর্মে ঈশ্বরের প্রয়োজনও নেই। মানবিক প্রয়োজনেই বাইরে বুদ্ধ যেতে চাননি কোনদিন।
 ঈশ্বরাদি সম্পর্কীয় প্রশ্নের উত্তরে বুদ্ধ বলতেন- এরূপ অনাবশ্যকীয় বিষয়ে সময় নষ্ট করা নিষ্ফল। তিনি বলতেন যদি কোন লোক বিষাক্ত তীর নীক্ষেপে বিদ্ধ হয়ে এরূপ বলতে শুরু করেন যে, তীরটি কিসের তৈরি, কোত্থেকে এল, এটা সুঁচালো না ভোঁতা এবং তীর নিক্ষেপকারীর জাতি, ধর্ম, গোত্র, বর্ণ ও বয়স ইত্যাদি না জেনে তিনি তীরটি উৎপাটন করবেন না ; তবে এ সমুদয় বিষয় জানার পূর্বেই তীরাঘাতে অথবা বিষক্রিয়ায় হয়ত বা তাঁর  মৃত্যু হবে। সেরুপ বুদ্ধ ও দুঃখময় মানব জীবনের দুঃখ সমুদয় নিরোধ করার জ্ঞান ও মুক্তিপথ প্রদর্শন করেছেন। তীরতত্ত্ব বিচার না করে তীরবিদ্ধ মানুষের যেমন আশু প্রয়োজন তীর উৎপাটন, তেমনি দুঃখ বিদ্ধ মানুষেরও আশু প্রয়োজন সে প্রদর্শিত পথে দুঃখ মুক্তির চেষ্টা করা। এভাবে মুক্ত হলে সে সত্যাসত্য জানতে পারবে। এর আগে প্রয়োজনাতিরিক্ত জানতে চাইলে সেই তীরবিদ্ধ লোকটির ন্যায় তীরের উপাদান ও তীর নিক্ষেপকারীর সন্ধান করতে করতে তার সীমাবদ্ধ জীবন বৃথাই শেষ হবে।
বুদ্ধ বলেছেন- তিনি যা জেনেছেন এর সামান্য অংশ মাত্র মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন এবং যা প্রকাশ করেছেন তা অরণ্যের অসংখ্যে পাতার মধ্যে এক মুটি পাতার সাথে তুলনীয়। মানবের মুক্তির পক্ষে যা আবশ্যক তা সমস্তই তিনি বলেছেন। বুদ্ধ তাঁর আসল লক্ষ্যে নিবদ্ধ রেখেছিলেন মানুষের দুঃখমুক্তির এই আশু ও বাস্তব প্রয়োজনের দিকেই। তাই ঈশ্বর বা ব্রহ্ম আছে কি নেই, তাঁহার স্বরুপ কি ইত্যাদি প্রশ্ন জিজ্ঞাসিত হলে বুদ্ধ প্রশ্নকর্তাকে পাল্টা প্রশ্ন করে উত্তর সন্ধানের সহায়তা করতেন। যেমন ঈশ্বরের প্রশ্নের বুদ্ধ উদায়ীকে বলছেন- ধরা যাক কোনো এক ব্যক্তি এদেশের কোন এক সুন্দরী নারীকে ভালবেসে তাকে পেতে চায়। এখন সেই ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করা যাক : আচ্ছা, তুমি যে মেয়েটিকে ভালবাস- সে কোন বংশের সম্ভ্রান্ত, ব্রাক্ষণ, ধনী না শূদ্র তা কি জান ?
লোকটি উত্তরে বলল : না, জানি না।
আবার প্রশ্ন  হলো : মেয়েটির বা তার গোত্রের নাম জান কি? অথবা সে লম্বা, বেঁেট না মাঝারি বা তার গায়ের রং কালো না ফর্সা, অথবা মেয়েটি কোন জায়গায় বাস করে জান কি?
উত্তর হলো : না, কিছুই জানি না।
: তাহলে তুমি সেই মেয়েটিকে ভালবাস- যাকে তুমি দেখনি এবং যার সম্বন্ধে তুমি কিছু জান না।
: হ্যাঁ, মহাশয় তা ঠিক।
: তা যদি সত্য হয় তাহলে একথা কি বলা চলে না মেয়েটিকে তোমার ভালবাসার কথা অর্থহীন প্রলাপ ছাড়া আর কিছু নয়?
 লোকটি এবার বলল : হ্যাঁ, মহাশয়, তা যথার্থ বলেছেন। সুতরাং অজ্ঞাত ঈশ্বরের প্রতি ভালবাসা ও অনুরুপ প্রলাপের মতো।
অনুরুপ আরেক প্রশ্নে বাশিষ্টকে বুদ্ধ বুলেছেন- কোন চৌরাস্তার মোড়ে এক লোক সিঁড়ি তুলছে একটি কল্পিত প্রসাদে প্রবেশ করার জন্য। লোকটিকে জিজ্ঞেস করা যাক : আপনি যে প্রসাদে প্রবেশ করার জন্যে সিঁড়ি তুলেছেন সেই প্রাসাদটি কোন দিকে আপনি বুলতে পারেন? পূর্বদিকে, দক্ষিণ দিকে, পশ্চিম দিকে না উত্তর দিকে? অথবা সেই প্রাসাদটি কি রকম- উঁচু, নিচু না মাঝারি? এসব প্রশ্নের উত্তরে যদি লোকটি বলে- আমি এসব কিছুই জানি না, তাহলে কি বলা চলে যে লোকটি সম্পুর্ন অদৃশ্য ও অজ্ঞাত প্রাসাদে উঠার জন্যেই সিঁড়ি তৈরি করছে। ঈশ্বর সম্বন্ধে এভাবেই বুদ্ধ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য উপমার সাহায্যে সহজ উত্তর দিয়ে ভ্রমাত্মক ধারণার নিরসন করেছেন। সুতরাং বুদ্ধ ঈশ্বরের প্রশ্নে কখনও সর্বতোভাবে নীরব ছিলেন না ; ইন্দ্রয়গ্রাহ্য উপমা ও গভীর যুক্তির সাহায্যে ভ্রান্ত বিশ্বাস দূরীকরণের জন্যে তিনি চেষ্টা করেছেন।
তথাকথিত দার্শনিক পাশ্নে বুদ্ধ অনাসক্ত ও উদাসীন ছিলেন। তাই দেখা যায়, দশটি দার্শনিক প্রশ্নে বুদ্ধ সম্পুর্ন নীরব ছিলেন : (১) জগৎ কি মিথ্যা? (২) জগৎ কি অনিত্য? (৩) জগৎ কি সীমিত (৪) জগৎ কি অনন্ত? (৫) আত্মা ও দেহ কি ভিন্ন? (৬) আত্মা ও দেহ কি অভিন্ন? (৭) সত্য দ্রষ্টার কি জন্ম হয়?  (৮) তার কি পুনর্জস্ম হয় না? (৯) তাঁর কি পুনর্জন্ম হয় ও হয় না? (১০) তাঁর কি কি পুনর্জন্ম হয় ও হয় না- এমন নয়? এই নীরবতার কারণ সম্বন্ধে অঙ্গুত্তর নিকায়ে বুদ্ধ বলেছেন- উত্তর প্রদানের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রশ্নের ধরন মুলতঃ চার প্রকার। যেমন- (ক) কোন কোন প্রশ্ন আছে যার উত্তর সরাসরি হ্যাঁ না বললেই চলে। (খ) কোন কোন প্রশ্নের উত্তর দেয়ার পূর্বে প্রশ্নের সবিশেষ বিশ্লেষন অপরিহার্য। (গ) আবার কোন কোন প্রশ্নের মোকাবেলা করতে হয় পাল্টা প্রশ্ন দিয়ে যাতে প্রশ্নকর্তা নিজের উত্তর খুঁজে পায়। সর্বশেষ (ঘ) এমন প্রশ্ন আছে যার কোন উত্তর দেয়া চলে না। শেষোক্ত ধরনের প্রশ্ন উত্তর দাতাকে ফাঁদে ফেলার জন্য দূরভিসন্ধিমূলকও হতে পারে। যেমন কেউ যদি কাউকে প্রশ্ন করে আপনি কি আপনার বউকে মারার সময় মোটা লাটি বা চিকন লাটি ব্যবহার করেন? উত্তরে এখানে একদিকে মোটা বা চিকন লাঠি বলা যেমন মুষ্কিল তেমনি হ্যাঁ বা না বলাও মুষ্কিল। কারণ যে কোনো ক্ষেত্রে বউকে মারা স্বীকৃতি প্রদান করবে। তাই বুদ্ধ যে সকল প্রশ্নের উত্তর দিতেন না। তার মুল রহস্য এখনো নিহিত। তাছাড়া যে সব কুট প্রশ্ন তাঁর জীবনাদর্শের পক্ষে অপ্রাসঙ্গিক তার উত্তর দেয়াও তিনি প্রয়োজন বোধ করেননি। জীবন সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে এদের নিরর্থকতার কথা যুক্তি দিয়ে তিনি শিষ্যদের বুঝাতেন। বুদ্ধ এটা খুব স্পষ্টভাবেই উপলবিÍ করেছিলেন বলে তিনি তথাকথিত দার্শনিক প্রশ্নে নিজেকে আবদ্ধ করেননি। তিনি মনে করতেন এসব প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামানো কতিপয় অন্ধকে বিরাটিকায় এক হাতিকে স্পর্শ করতে দেয়া সামিল। কোন অন্ধই যেমন হাতির আসল রুপ বুঝতে সক্ষম হবে না, ঠিক তেমনি দার্শনিক প্রশ্নগুলোর সঠিক কোন উত্তর কখনও মিলেবে না। তাই বুদ্ধের প্রধান বিষয় শুষ্ক তত্ত্ববিচার নয়, দুঃখ থেকে মুক্তি লাভের উপায় উদ্ভাবন করা।
শুধু যে বুদ্ধ জীবন ও ধর্ম ক্ষেত্রে ঈশ্বরকে অস্বীকরা বলেছেন তা নয়, বুদ্ধ পূর্ব বা বুদ্ধোত্তর অনেক জ্ঞানী ও দার্শনিক ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন। এছাড়া আজেকের অনুসন্ধিৎসু বিজ্ঞানীও প্রচুর অনুসন্ধানের পরও এ সম্পর্কে কোন সদুত্তর পাচ্ছে না। বিখ্যাত কপিল মুনি তার সাংখ্য দর্শনে, কনাদমুনি বৈশেষিবী দর্শনে, মহর্ষি জৈমিনী মীমাংসা দর্শনে, ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করেননি। মু-ক উপনিষদ ও কটোপডনিষদে ঈশ্বরকে শক্তিহীন বলে বর্ণনা করা হয়েছে। বেদান্তসূত্রের শঙ্করভাষ্যে (২/২/১৪-১৫) অজ্ঞ মানবের উপাসনাথেই ঈশ্বরকে আবার শক্তিমান বলে উল্লেখ করা হয়েছে। রামকৃঞ্চ পরহংসদেব ব্রহ্মকে নির্লিপ্ত বা নির্গুন বলেছেন। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, সগুণ ঈশ্বরই মানবের চুড়ান্ত ধারণা, কিন্তু যুক্তি এ ধারণার সন্তুষ্ট হতে পারে না। ন্যায় দর্শন ঈশ্বরকে স্বীকরা করলেও তাঁকে সৃষ্টিকর্তা বলে স্বীকার করেনি। বেদান্ত দর্শন ব্যতীত অন্য কোনো দর্শনে সগুন ঈশ্বরের কথা নেই। নির্গুন ঈশ্বরের অর্থ তবে কিছ্ ুনা বললে চলে। নির্গুন ব্রহ্মের বর্ণনায় তাঁর প্রতি সচরাচর প্রযুক্ত সর্বপ্রকার বিশ্লেষণ অনাবশ্যক ও অযোক্তিক। সেই নির্গুন ব্রহ্ম এক জ্ঞানবান বলা যেতে পারে না। কারণ চিন্তা সসীম জীবের জ্ঞান লাভের উপায়, শুধুমাত্র তাকে সৃষ্টিকর্তাও বলা যেতে পারে না।
 ফিউবার ব্যাক বলেছেন, “ঈশ্বও নেই এটা দিবলোকের মত পরিষ্কার ; এমন কি ঈশ্বর থাকতেই পারে না।”
জন ফাস্টার ‘চাল মারস নেচারেল থিওলজি’ নামক গ্রন্থে ঈশ্বরকে অস্বীকার করেছেন। ফিজিকাস ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ না পেয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
ভলতেয়ার ও ঈশ্বর সম্পর্কে এই মত পোষণ করে বলেছেন, ঈশ্বর না থাকলেও একজন ঈশ্বকে সৃষ্টি করে নিতে হবে।
জন স্টুয়ার্ট মিল বলেন, তিনি ঈশ্বররের সর্বশক্তিমানত্ত্বের প্রমাণ পাননি। ঈশ্বর বিষয়ক ধারণা যে অসার ও অযৌক্তিক তা আধুনিক বিজ্ঞানও দেখতে পাচ্ছে।
সুতরাং, জগতের আদি কারণ রূপে ঈশ্বরকে ধরে নেয়া যায় যে ভ্রমাত্মক ও অযোক্তিক বিজ্ঞানেরর নানা তথ্যে তা প্রকাশ পাচ্ছে। ঈশ্বর বিশ্ববাসীদের মধ্যে ঈশ্বরের স্বরুপ নিয়েও বহু মতভেদ আছে। কেউ বলেন ঈশ্বর স্বর্গের সিংহাসনে সমাসীন, কেউ বলেন ঈশ্বরের প্রকৃতি নিরাকার। কারও মতে, ঈশ্বর প্রাকৃতিক শক্তি অভাব বিশিষ্ট, আর কারও মতে তিনি পরমাণু সদৃশ, আকার কেউ ‘আমিই’ ঈশ্বর বলতে কুন্ঠিত নয়। ঈশ্বরকে মুলধন করে তাই মানুষ ভাব জগতে আজ আর বিশেষ সুবিধা করতে পারছে না। তাই বুদ্ধের যুক্তি নির্ভর মানবিক চিন্তাধারা আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের আলোকেও সমুজ্জ্বল।
শুষ্ক দার্শনিক তত্ত্ব ও ঈশ্বরকে স্থান না দিয়ে বৌদ্ধথ ধর্মে তাই কর্মকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। কেউ যদি অপরাধমূলক কাজ না করে তাহলে পুলিশ বা বিচারকে ভয় কি? সুতরাং সে পুলিশ বা বিচারকে সেবা করবে না কর্মেও সেবা করবে? যদি কর্মফলদাতা একজন ঈশ্বর থাকেন তাহলে তিনিও কৃত কর্মানুসারে পুন্যের পুরস্কার বা পাপের শাস্তি প্রদান করবেনই। যদি বিচারে পক্ষপাতিত্ব করা হয় তবে তিনি ঈশ্বর পদবাচ্য হতে পারেন না। সুতরাং কর্মই একমাত্র বন্ধু, কর্মই একমাত্র স্মরনীয়। আবার সেই ঈশ্বরও যে কর্মেও আওতাধীন হবে না তার কি প্রমাণ? কর্মই ছায়ার ন্যায় জীবনের পর জীবন অনুসরন করে মানুষকে দুঃখমুত্তি প্রদান করে। যে জন্যে জ্ঞান ও সৎকর্মই বৌদ্ধদের একমাত্র করণীয়। বুদ্ধ মানব জীবনকে জনৈক বৃদ্ধের এক কাষ্ঠনির্মিত প্রাচীন প্রাসাদের সাথে তুলনা করেছেন। একদিনে এই প্রাসাদে যখন আগুন লাগে তখন বৃদ্ধেও পুত্রগণ ছিল খেলায় ও নেশায় মত্ত। বৃদ্ধ উপহারের লোভ দেখিয়ে তাদেরকে প্রাসাদের বাইরে নিয়ে আসে এবং জীবন রক্ষা করে। এ পৃথিবীতে মানুষের জীবন হচ্ছে প্রজ্বলিত প্রাসাদের মত- যে প্রাসাদ রোগ, শোক, জরা, ব্যাধি, মৃত্য, কামনা, বাসনা, ভোগবিলাস, রাগ, দ্বেষ ও হিংসার আগুনে সর্বদা দাউ দাউ করে জ্বলছে। আর মানুষ হলো প্রজ্জ্বলিত প্রাসাদের ভিতরে নেশায় মগ্ন বৃদ্ধের পুত্র সন্তান। এ প্রাসাদ থেকে বের হবার পথ তাদের জানা নেই। অথচ এই বের হবার পথটিকে আবিষ্কার করাই জীবনের প্রধান সমস্যা। জগৎ নিত্য হোক বা অনিত্য হোক, সৃষ্টিকর্তা থাকুক বা না থাকুক- তাতে এ সমস্যার সমাধান হয় না। তাতেই এসব দার্শনিক প্রশ্ন নিয়ে কালাতিপাত করা নিবুদ্ধিতারই পরিচায়ক।
ঈশ্বরের অনুপস্থিতির জন্য অনেকে বৌদ্ধ ধর্মকে শূন্যবাদা বা উচ্ছেবাদ বলে থাকে। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে বৌদ্ধ ধর্ম তা নয়। এটা সম্পুর্নরুপে সত্য নির্ভর যুক্তিবাদ। গৌতম বুদ্ধ  ব্রহ্মজাল সুত্রে তখনকার প্রচলিত ৬২ প্রকার মত আলোচনা করে বলেন- এর কোনটিই সত্য উপলদ্ধি মতবাদের পথ নয়, তিনি যা স্বয়ং উপলব্দি ও প্রত্যক্ষ করেছেন। জ্ঞানীগণই তা উপলব্দি করতে পারেন। তর্কের দ্বারা তা উপলব্দি হয় না। বুদ্ধ তাই দার্শনিক তত্ত্বের উপর কোনো গুরুত্ব দেননি; মানুষের মুক্তি প্রশ্নটি তাঁর কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। এদিক থেকে বিচার করলে ঈশ্বর নিরপেক্ষ বৌদ্ধধর্ম এক সার্থক জীবন ধর্ম ও দর্শন।

বিশ্বতত্ত্ব
সাধারণত বিশ্বতত্তের ব্যাখ্যায় দুটি পরস্পর বিরোধী মত দেখা যায়। একটি চেতনাবাদী ও অপরটি জড়বাদী। বিশ্বে সাধারণত দুই ভিন্ন শ্রেনী পদার্থ লক্ষ্য করা যায়। আমাদের দেহ অংশ জড় এবং মন অংশ চেতনা। আবার আমাদের  দেহমনের বাইরে যে অচেতন পদার্থ দেয়া যায় তা জড় । জড়বাদীরা কেবল জড়বস্তুর সাহায্যে বিশ্বের ব্যাখ্যা করেন। যেমন আধুনকি বৈজ্ঞানিক জড়বাদ। মনকেও তাঁরা জড়ের সাহায্যে ব্যাখা করেন। অন্যদিকে চৈতন্যবাদীরা কেবল চেতনা পদার্থের সাহায্যে বিশ্বকে ব্যাখা করেন। জড়বস্তুকেও তাঁরা মানসিক প্রকৃতি বলে ব্যাখা করেন। বুদ্ধের বিশ্বতত্ত্ব পরিকল্পনাকে চৈতন্যবাদী বলা যায়। তবে দার্শনিকেরা সাধারণত যেভাবে চৈতন্যবাদকে স্থাপন করেন, বুদ্ধ সেই পথে যাননি। তিনি তার তত্বটিকে স্থাপন করেছেন একেবারেই স্বতন্ত্রভাবে। এ প্রসঙ্গে সাধারণত দুই শ্রেণীর সত্তার অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়। এক শ্রেনীর সত্তা আছে যাদের অস্তিত্ব আমরা ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে উপলব্ধি করি। তাদের জ্ঞেয় বলা হয়। অনেকের শ্রেণীর সত্ত্বা আছে যারা এদের উপলব্দি করে যেমন মানুষের মন। তাকে জ্ঞাতা বলা যায়। তাদেরকে পরষ্পর সংস্পর্শে ঘটলে আমাদের জ্ঞান হয়। তাছাড়া মানুষের মন চিন্তাাও করে, সুখদুঃখ ইত্যাদি অনুভব করে। জ্ঞেয় বস্তুকে আমরা স্থিতিশীল সত্তা বলে ধরে নিই।
বুদ্ধের মতে, কিন্তু বিশ্বে নিত্য পদার্থ বলে কিছু নেই। একদিকে আত্মরুপে স্থায়ী পদার্থ যেমন নেই,  অন্যদিকে জ্ঞেয়রুপ কোন স্থায়ী বস্তুনেই। যা আছে তা জ্ঞাতা-জ্ঞেয় সম্বন্ধে প্রথিত কতকগুলি মানসিক অনুভূতি। সুতরাং বিশ্বের হয়ে দাঁড়ায় কতকগুলি জ্ঞান, অনভূতি ও চিন্তার পরষ্পর প্রথিত মালার মতো বা চৈতন্যেও প্রবাহ মাত্র।
এই দর্শনটি গড়ে উঠেছে বুদ্ধের প্রতীত্যসমুৎপাদ মতবাদের মধ্য দিয়ে। যে কার্যকার ধারার মধ্য দিয়ে মানুষ সংসারের জন্মলাভ করে এবং তাঁর অনুভূতি প্রবাহের মধ্যে দিয়ে বিশ্বরোধ গড়ে ওঠে, তারই এখানে বিস্তারিত ব্যাখ্যা আছ্ েপ্রতীত্য সমুৎপাদের অর্থ হলো একটির উপর নির্ভর করে আর একটির উৎপত্তি। পালিতে এর ব্যাখ্যা করা হয়েছে ‘ইমস্মিং সতি ইদং হোতি। ইমস্স উপপাদানা ইদং উপমজ্জতি’। অর্থাৎ এই হেতু এই হয়। এর উৎপত্তি হতে এর উৎপত্তি। একদিকে যা কারণ তাই অপর দিকে কার্য। এই কার্যকারণ পরস্পরার সংযোগ যেন একটি চক্র নির্মিত হয়েছে। তাই মানুষকে জন্ম হতে জন্মান্তরের ঘোরায়। তাই এর নাম ভবচক্র। এই কার্যকারণ মালাকে সংযোগে এখানে বিশ্বপ্রবাহের ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যা একদৃষ্টিতে মনে হবে কারণ তা অন্যদৃষ্টিতে কার্যেও ভূমিকা নেয়। এভাবে পরস্পর কার্য ও কারণ সম্বন্ধে যুক্ত হয়ে বারটি নিয়ামত এই তত্ত্ব অনুসারে জন্ম হতে জন্মান্তরে মানুষকে টেনে নিয়ে যায়। এই কার্যকারণকে নিদানও বলা হয়। বারটি কার্যকারণ এই সৃষ্টি প্রবাহের সাথে জড়িত থাকার একে দ্বাদশ নিদানও বলা হয়। সুতরাং, দ্বাদশ নিদান ও প্রতীত্যসমুৎপাদ একই তত্ত্ব। এ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেতে হলে এই কার্যকারণ মালাকে একটি চক্ররুপে কল্পনা করে নিতে হবে। অর্থাৎ যা নিয়ে শুরু হয়ে শেষের নিদানটি এর কাছে এসে থেমে যায়। এখানে অবিদ্যা হলো প্রথম নিদান আর জরা, মরণ হলো শেষ নিদান। অবিধ্যা মানুষকে জন্মের দিকে ঠেলে দেয়, আর জরা মরণ তাকে অবিদ্যার কোলে ঠেলে দেয় নতুন জন্মের প্রস্তুতি হিসেবে
এই আরটি নিদানের অর্থসহ একটি তালিকা হচ্ছে নি¤œরুপ:
১.    অবিদ্যা: ভ্রান্ত ধারণা
২.    সংষ্কার: গতিজীবনের পূব্যভিজ্ঞতার ছাপ/ গতকর্মের ছাপ।
৩.    বিজ্ঞান: চেতনা
৪.    নামরুপ: দেহমন সংগঠন/ মন ও দৃশ্যমান শরীরী পদার্থ
৫.    ষড়ায়তন: ছয় জ্ঞানেন্দ্রিয় অর্থাৎ পঞ্চ ইন্দ্রিয় ও মন
৬.    স্পর্শ: জ্ঞেয় সঙ্গে জ্ঞাতী রুপ মনের সংযোগ
৭.    বেদনা: অনুভূতি
৮.    তৃঞ্চা: আসক্তি/ভোগস্পৃহা
৯.    উপাদান: জাগতিক বস্তুর সংযোগতা
১০.    ভব: জন্মলাভের তীব্র বাসনা/ জন্মের প্রস্তুতি
১১.    জাতি: সংসারের জন্ম গ্রহণ
১২.    জরমরণ: জন্মের পরিণতি
অবিদ্যা হলো জন্ম-মরণ-জন্মান্তর চক্রের সন্ধিস্থল। একে ভিত্তি করেই নতুন জন্মের প্রস্তুতি নতুন জীবনকে ভিত্তিকরেই বিশ্বপ্রবাহের সৃষ্টি। অবিদ্যা বলতে ভ্রান্ত ধারণা বা অজ্ঞানকে বুঝায়। তা হতেই পরবর্তী নিদান সংষ্কারের উৎপত্তি। সুতরাং অবিদ্যা বলতে বুঝতে হবে জীবন যে দুঃখময়, জীবন যে আকর্ষণের বস্তু হবার যোগ্য নয়- এই জ্ঞানের অভাব। সংস্কার বলতে জীবনের প্রতি আকৃষ্ট করে। সংষ্কার অর্থে সাধারণতভাবে গত জীবনের পূর্বাভিজ্ঞার ছাপ বুঝায়। কিন্তু এখানে সংষ্কার শব্দ দ্বারা নতুন করে জন্ম গ্রহণ করার প্রবল বাসনাকে নির্দেশ করা হয়েছে। অবিদ্যাই এই সংষ্কার উৎপাদন করার কারণ।
পরের পাঁচটি নিদানকে অবলম্বন করেই বুদ্ধ বিশ্ব প্রবাহের ব্যাখা করেছেন। তিনি বিশ্বে কিছু স্থায়ী বা বিনশ্বর কিছু আছে বলে বিশ্বাস করতেন না। বৌদ্ধ মতে, আমরা যা কিছু দেখি বা জানি সবই নিসত্ত্ব অর্থাৎ সত্ত্বাহীন। যা  আছে তা হলো অনুভূতির ধারা। যে বিশ্বের আমরা উপলব্দি করি তাতে চিন্তা বা অনুভূতি দ্বারাই অতিরিক্ত কিছু পাওয়া যায় না। যে পাঁচটি নিদানের সাহয্যে বুদ্ধ এই ব্যাখা দিয়েছেন তা হলো: বিজ্ঞান, নামরুপ, ষড়ায়তন, স্পর্শ ও বেদনা। উক্ত নামরুপের মধ্যে বুদ্ধ পরিকল্পিত বিশ্বের প্রকৃতি বির্ধত আছে। অন্য চারটি নিদানের সংযোগেই এই বিশ্ব প্রবাহ গড়ে ওঠে। এই সবগুলি নিদানই মানুষের সংসারে জন্ম গ্রহণ করার পর ক্রিয়াশীল হয়।
এদের মধ্যে প্রথম নিদান হলো বিজ্ঞান। এই বিজ্ঞানের অর্থ হলো চেতনা বা অহংবোধ। আমি যে বিশ্ব হতে স্বতন্ত্র এই বোধ। বিশ্বের চেতনা বিকশিত হতে হলে একদিকে যেমন চাই জ্ঞেয় বস্তু, অন্য দিকে তেমন চাই জ্ঞাতরুপী সত্তা। এই বিজ্ঞান বা অহংবোধ সেই জ্ঞারুপী সত্ত্বার ভূমিকা পালন করে। জ্ঞেয়কে জানতে জ্ঞানের সহায়ক পদার্থের প্রয়োজন। তাই হলো ষড়ায়তন- চক্ষু, কর্ণ, নাসিক্কা, জিহ্বা ও স্পর্শ: এই পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয় ও মন। ভারতীয় দর্শনে মনকে যষ্ঠ ইন্দ্রিয়রুপে গণ্য করা হয়। এর পর প্রয়োজন এই জ্ঞানেন্দ্রিয় সঙ্গে জ্ঞেয় বস্তুর সংস্পর্শে। তাহলে তাদের সম্বন্ধে জ্ঞান ফুটে উঠবে। সে কারণে পরবর্তী নিদান স্পর্শ। জ্ঞানেন্দ্রিয়ের সাথে জ্ঞেয় বিষয়ের সংযোগ ঘটলে ফুটে ওঠে ইন্দ্রিয়ানুভূতি- যাকে বেদনা বলা জ্ঞেয়। এই ভাবে জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়ের সংযোগের ফলে বিশ্বপ্রবাহের সৃষ্টি হয়। তাই হলো নামরুপ। এই নামরুপ হলো বুদ্ধ বর্ণিত বিশ্বপ্রবাহ। নামরুপকে বিশ্লেষণ করলে পাঁচটি স্কন্ধ বা উপাদান পাওয়া যায়,  তা হচ্ছে :
১। রুপ: যার রুপ বা প্রটকাশ আছে অর্থাৎ ইন্দ্রগ্রাহ্য প্রকাশ আছে তাই রুপ।
২।বেদনা: বেদনা অর্থ এখানে ইন্দ্রিয়ানুভূতি। এর ভিত্তিতেই বিশেষ বস্তু সম্বন্ধে উপলব্দি হয়।
৩। সংজ্ঞা: ইন্দ্রিয়ের অনুভূতির সাহায্যে যে বিশেষ বস্তু সম্বন্ধে জ্ঞান উৎপাদিত হয় তাই হচ্ছে সংজ্ঞা। একে ইন্দ্রিয়জ জ্ঞান বলা যায়।
৪। সংস্কার : পূর্বাপর কর্ম বা অভিজ্ঞতার ছাপ যা প্রবল ইচ্ছা বা প্রবৃত্তির সৃষ্টি করে।
৫। বিজ্ঞান : চেতনা বা মননকাজ। বুদ্ধেঘর পরিকল্পনায় যাকে জ্ঞাতা-জ্ঞেয় সম্পর্কে গঠিত বিশ্ব বলা হয়-  তা হচ্ছে চেতন পরপম্পরায় ধারা। সেই চেতন পরপস্পরায় উপাদান হলো ইন্দ্রিয়ানুভ’ূতি (বেদনা)। এগুলি সংগঠিত হয় দুটি বিভিন্নধর্মী পদার্থের সংযোগ। একদিকে জ্ঞাতরুপী বিজ্ঞান এবং অন্যদিকে পঞ্চস্কন্দের অন্তর্ভুক্ত রূপ অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু। সুতরাং নামরুপই বিশ্ব বা সৃষ্টি।
সুতরাং, তৃতীয় নিদান বিজ্ঞান (অহংবোধ) কে ভিত্তি করেই গঠিত হয় নামরুপ। অর্থাৎ মানুষের চেতনাকে আশ্রয় করে অনুভূতির সম্পর্কিত চেতনাপ্রবাহ গড়ে ওঠে। নামরুপের পাঁচটি উপাদান বা স্কন্ধ হলো জ্ঞেয় বস্তুসমূহ। অপর চারটি উপাদান যথা বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞান দিয়ে গঠিত হয় তা অরুপী। এ সংগঠনের উপাদানগুলির দেহ নেই বলে তানা অরুপী। এভাবে জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়, রূপী ও অরূপীর সংযোগে গড়ে ওঠে চেতনা প্রবাহ। কিন্তু সেই সংযোগ ঘটাবার একটি অবলস্বন চাই। সেই অবলম্বন বা মাধ্যম হলো ষড়ায়তন অর্থাৎ জ্ঞানেন্দ্রিয়গুলি। তারাই জ্ঞেয়ের সঙ্গে জ্ঞাতার সংযোগ ঘটায়।
পরের নিদান স্পর্শ হলো সেই সংযোগ। সেই সংযোগ হতে উৎপন্ন হয় পরবর্তী নিদান বেদনা অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ানুভ’তি। সুতরাং নামরূপ বা চেতনাপ্রবাহের উৎপাদক হয়ে দাঁড়ায় ষড়ায়তন, স্পর্শ ও বেদনা। তারপরের দুই নিদান তৃষ্ণা ও উপাদানকে এক সাথে নেয়া যায়। চেতনাপ্রবাহ হতে বাঁচবার ইচ্ছা মনকে অধিকার করে বসে। তৃষ্ণা হলো জীবনের প্রতি আসক্তি বা বাসনা। তার ফলেই আসে উপাদান অর্থাৎ জাগতিক বস্তুর সংযোগতা। এই তৃষ্ণা ও জাগতিক বস্তুর সংযোগতা মানুষকে পরবর্তী জন্মের জন্য প্রস্তুত করে। ফলে সে নতুন করে অবিদ্যাপ্রসূত সংস্কার পুনরায় মানুষকে সংসার জীবনে আকর্ষণ করে। এভাবে ভবচক্র বা সংসার চক্র আবর্তিত হয়। বুদ্ধের প্রতীত্যসমুৎপাদ তত্ত্বের দুটি দিক আছে। একদিকে জন্ম হতে জন্মান্তরে মানুষ কীভাবে কার্যকারণ পরম্পরায় প্রভাবে আবর্তিত হয় তা দেখান হয়েছে। অপরদিকে বিশ্ব বা সৃষ্টিতত্ত্বের ধারণা কিভাবে গড়ে উঠেছে তা বলা হয়েছে। এ অংশেই বিশ্বতত্ত্ব সম্পর্কিত মূল চিন্তাটি পাওয়া যায়। প্রারম্ভেই বলা হয়েছে, বুদ্ধের বিশ্বতত্ত্বের প্রকৃতি হলো চৈতন্যবাদী। অর্থাৎ বুদ্ধের মতে মনের বাইরে মন নিরপেক্ষ কোনো সত্তা নেই। যাকে বহু বস্তু সমন্বিত বিশ্ব বলে ধারণা করা হয়- তা মানুষের চেতনার মধ্যে অনুভূতির প্রবাহ মাত্র। এই প্রতিপাদ্যের সমর্থনে বুদ্ধের একটি মন্তব্য এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে,
“আমি তোমাদের নিশ্চিত প্রত্যয়ে বলছি যে, এই তিন হাত দীর্ঘ মন ও চৈতন্য সমন্বিত মরণশীল দেহের মধ্যেই এ বিশ্বের বিকাশ, বিকার এবং বিনাশ সংঘটিত হয়ে থাকে”।  জগৎ ও মানুষের প্রারম্ভ সম্বন্ধে দীর্ঘ নিকায়ের অগঞঞ সূত্রে যে, বর্ণনা পাওয়া যায় তা বর্তমানকার বৈজ্ঞানিকদের বির্বতন সূত্রের সাথে প্রায় মিলে যায়। সেখানে বুদ্ধ বলেছেন, “লোকের (পৃথিবীর) বির্বতন হইবার পর জগৎ জলে জলময় ছিল, তখন চারদিকে গভীর অন্ধকার চাঁদ নাই, সূর্য নাই, নক্ষত্রনাই, রাত্রি দিনের অস্তিত্ব নাই, মাস পক্ষ ও প্রকট হয় না, ঋতুও না, বর্ষাও না, স্ত্রী পুরুষ না। গরম দুধ শীতল হইলে সরের মত রসা পৃথিবীর সৃষ্টি হইল, তখন চন্দ্র এবং সূর্য প্রকট হইল, নাগের ফণার মত পৃথিবী পাপড়ি মেলিল, মদ্রলতার জন্ম হইল এবং সত্ত (প্রাণী) মদ্রলতা খাইতে লাগল।” ব্রক্ষজাল সূত্রের এক জায়গায় জগৎ চক্রের চলাকালে কীভাবে সৃষ্টির বির্বতন ও দীর্ঘ পরিবর্তন হয় বুদ্ধ তা উল্লেখ করেছেন। তিনি আরও বলেছেন ব্যক্তি জীবনের ন্যায় এই বিশ্বব্রক্ষা- এবং জগৎ চক্রেরও উদয় লয় আছে। আমাদের পৃথিবীও একদিন ধ্বংস হবে। পূর্ববর্তী পৃথিবীরও তা হয়ে আসছিল এবং পুনর্বার তা হবে। তবে যেভাবেই জগৎ ও প্রাণীর সৃষ্টি হোক না কেন তা সবই কার্যকারণ নিয়মের শৃঙ্খলে গ্রথিত। সৃষ্টির আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত প্রাণপ্রবাহের মূলে প্রতীত্যসমুৎপাদের দ্বাদশ নিদান বা ভবচক্রের কারণে প্রাণীর জন্ম পুর্ণজন্মহয়ে আসছে।  

লেখক সাধনাজ্যোতি ভিক্ষু
হিল চাদিগাং বৌদ্ধ বিহার
 চট্টগ্রাম।

No comments

Theme images by 5ugarless. Powered by Blogger.