পার্বত্য চট্টগ্রামঃ অশ্রু আর রক্তে লেখা নাম — শামসুজ্জোহা মানিক (পুনঃপ্রকাশিত)

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক

(১৯৯৬ সালে লিখা নিবন্ধটি পুনঃপ্রকাশ করা হল। এটি ‘ধর্ম ও শ্রেণীতত্ত্বের যাঁতাকলে বাঙ্গালী জাতি (জাতি ও জাতীয়তাবাদ বিষয়ক সংকলন)’ নামক সংকলন গ্রন্থ থেকে নেওয়া। গ্রন্থটি ‘বঙ্গরাষ্ট্র’-এর  ‘নির্বাচিত’ ও ‘গ্রন্থাগার’-এ দেওয়া আছে।)

অবশেষে কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনা তদন্তে সুপ্রীম কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, যারা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত তদন্ত কমিটি তাদের খুঁজে বের করবে এবং ভবিষ্যতে যাতে এই ধরনের ঘটনা আর না ঘটে সে ব্যাপারে পদক্ষেপ দিবে ।*

---------------------------------------------------------------------------------------------------------------
* তদন্ত্র কমিটি রিপোর্ট জমা দিলেও আজ পর্যন্ত তা প্রকাশ করা হয় নি। -  বঙ্গরাষ্ট্র
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------

হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক প্রতিবাদী তরুণী কল্পনা চাকমা অপহৃত হয়েছে গত ১২ জুন জাতীয় নির্বাচনের পূর্ব রাত্রিতে। অভিযোগ রয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন অফিসারের নেতৃত্বে একদল সশস্ত্র ব্যক্তি তাকে বাড়ী থেকে জোর করে ধরে নিয়ে যায়। তারপর কল্পনা চাকমা হারিয়ে গেছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বিগত দুই দশকের অধিক কাল ধরে এমন বহু কল্পনা চাকমা হারিয়ে গেছে। তাদের কথা এত কাল কেউ শোনে নি। বলতে দেওয়াও হয় নি। সংবাদপত্র চুপ করে থেকেছে। দেশের কোথায়ও প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর প্রায় শোনা যায় নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম যে এ দেশেরই একটা অংশ, যেখানে বাস করে ভিন্ন জাতিসত্তার লক্ষ লক্ষ মানুষ সমস্ত রকম মানবিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে, এই সত্যকে অস্বীকার করতে চাওয়া হয়েছে নানানভাবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ইত্যাদি জাতিসত্তার জনগণ, যারা জুম্ম নামেও পরিচিত, তারা কখন কোন অবস্থায় অস্ত্র ধরতে এবং ভারতের ত্রিপুরার শরণার্থী শিবিরগুলোতে দলে দলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল, সেই সত্যকে ঢেকে রাখতে চাওয়া হয়েছে নানান মিথ্যা আর কল্পকথার জাল বিস্তার করে। দিনের পর দিন, বৎসরের পর বৎসর এক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সরকারের যুদ্ধ অভিযানের পাশাপাশি চলেছে মিথ্যা প্রচার-অভিযান। এবং তার চেয়েও বড় কথা, পার্বত্য চট্টগ্রামকেই রাখতে চাওয়া হয়েছে সমস্ত জাতির দৃষ্টির আড়ালে। একদিকে অবিরাম মিথ্যা প্রচার করা হয়েছে সেখানকার অবস্থা এবং জনগণের সংগ্রাম সম্পর্কে, অপরদিকে সেখানকার মানবতার আর্তনাদকে নীরবতার ঢাকনা দিয়ে চেপে রাখা হয়েছে।

কিন্তু অবশেষে মিথ্যার সৌধ ধ্বসে পড়েছে। কল্পনা চাকমার অপহরণ জাতির বিবেককে এক বিরাট ঘা মেরে জাগিয়েছে। কল্পনা চাকমা অপহরণ এমন এক সময়ে ঘটেছে যখন দেশের রাজনীতিতে বড় রকম পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে। বাঙ্গালী জনগণের সুদীর্ঘ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একটা পর্যায়ে বিএনপি-এর প্রতারণাপূর্ণ ও স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটে এবং নির্বাচনের মাধ্যমে ২১ বৎসর পর আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসে। এমন এক সন্ধিক্ষণে কল্পনা চাকমার অপহরণ পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে জাতির দৃষ্টির সম্মুখে নিয়ে এসেছে। সহসা এত কালের নীরবতা ভেঙ্গে বাঙ্গালী জনগণের কণ্ঠ যুক্ত হ’ল জুম্ম জনগণের প্রতিবাদী কণ্ঠের সঙ্গে। সমগ্র জাতি জানতে শুরু করেছে এবং আরও জানবে কী ভয়ঙ্কর অত্যাচার সয়ে এসেছে এতটা কাল পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সন্তান জুম্ম জনগোষ্ঠী, যারা আমাদেরই ভাই ও বোন। তাদের অপরাধ একটাই ­ তারা ভিন্ন ভাষা, ধর্ম আর সংস্কৃতির মানুষ। এই অপরাধে মাটি ভেজানো হয়েছে তাদের অশ্রু আর রক্তে। ক্রমে পার্বত্য চট্টগ্রাম হয়ে উঠেছে অশ্রু আর রক্তের নাম। সেই নাম এক সময়ে হয়ে উঠেছে প্রতিরোধের নাম।

পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা

এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জাতিসত্তাসমূহের সমস্যা যে একটা জাতীয় সমস্যা সে কথা স্বীকার করতে আমাদের এত দীর্ঘ সময় লেগেছে। পাকিস্তান আমল থেকেই তাদের উপর নির্যাতন ও উৎসাদনের কর্মনীতি পরিচালিত হয়। কাপ্তাই জল বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নেবার পিছনেও মুখ্যত এই কর্মনীতিই ক্রিয়াশীল ছিল কিনা সেই প্রশ্ন করা যায়। আমাদের প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কাপ্তাই বাঁধ দিয়ে ’৬০-এর দশকে প্রায় এক লক্ষ জুম্মজনকে তাদের বাসস্থান থেকে উৎখাত করা হয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বিপুল পরিমাণ চাষযোগ্য জমিকে পানির নীচে তলিয়ে দেওয়া হয়। পাকিস্তান আমলে তাদের কথা বলবার কেউ ছিল না। পার্বত্য চট্টগ্রামবাসীদের দুঃখের কথা লেখার দায়ে* তরুণ ছাত্র মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে আইয়ূব সরকার আড়াই বৎসর কারাগারে আবদ্ধ করে রাখে। তবু পাকিস্তান আমলে ব্রিটিশ আমলে প্রবর্তিত আইন দ্বারা সেখানে সংখ্যালঘু জাতিসত্তার কিছু অধিকার সংরক্ষিত রাখা হয়েছিল। বহিরাগতদের বসতি স্থাপন শুরু হলেও তখনও সেখানে তাদের পক্ষে স্থানীয় অধিবাসীদের জমি দখল বা ক্রয় আজকের মত সহজসাধ্য ছিল না। এই প্রক্রিয়া প্রণালীবদ্ধভাবে ও ব্যাপকভাবে শুরু হয় বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকে। পাকিস্তান আমলেও তাদের জন্য যে ভূমি সংরক্ষণ আইন ছিল সেটিও রাখা হ’ল না। ১৯৭২-এর সংবিধানে পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম জনগোষ্ঠীর স্বাতন্ত্র্য ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের প্রতি সামান্যতম স্বীকৃতিও দেওয়া হ’ল না।

----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
* মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ প্রসঙ্গে একটা বড় লেখা লিখেছিলেন। পুলিশ সেটা চট্টগ্রামের পাথরঘাটাস্থ বান্ডেল রোডের পাহাড়ী ছাত্রাবাস ‘বিন্দু নিলয়’ তল্লাশী করে পায়; ফলে রাষ্ট্রবিরোধী অভিযোগে অভিযুক্ত করে তাঁকে নিবর্তনমূলক আইনে আটক করে। - লেখক
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

১৯৪৭ থেকে এ যাবৎ কাল পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সন্তানদের ইতিহাস হ’ল কখনও ইসলাম, কখনও বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ আবার কখনও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের নামে নির্মমভাবে নির্যাতিত ও উৎখাত হবার ইতিহাস। এই সুদীর্ঘ সময়েই তাদের জন্য কে কথা বলেছে, কয়জন বলেছে? এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে, পাকিস্তানীদের জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তার সরকারগুলোই একটা ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীকে এভাবে উৎপীড়ন ও উৎখাত করার পথ বেছে নিয়েছে। বাংলাভাষীদের সংখ্যার তুলনায় অতি ক্ষুদ্র এক জনগোষ্ঠী যারা এ দেশের জনসংখ্যার এক শতাংশেরও কম তারা কখন কোন্‌অবস্থায় অস্ত্র হাতে তুলে নিতে বাধ্য হয়েছে সে কথা আজ আমাদের ভাবতে হবে। ’৭২ থেকে এ পর্যন্ত কতজন পাহাড়ী বা জুম্ম নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে, কতজন নিরপরাধ জুম্মজনকে হত্যা করা হয়েছে তার হিসাব কি নেওয়া হয়েছে? ’৭২ সাল থেকে পাহাড়ীদের গ্রামগুলো বাংলাভাষী বহিরাগত বসতিস্থাপনকারীরা সশস্ত্র পুলিশ, বিডিআর-এর প্রহরায় ঘেরাও করত এবং সেখানে চালাত গণধর্ষণ, প্রহার ও লুট। এই প্রক্রিয়ার পরিণতিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জন-সংহতি সমিতির নেতৃত্বে পাহাড়ী জনগণ ১৯৭৫ সালে আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্র তুলে নেয়। ঠিক যেমনটি ১৯৭১-এ বাঙ্গালী জনগণ অস্ত্র তুলে নিয়েছিল পাক হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের বিরুদ্ধে। এইভাবে প্রণালীবদ্ধ ধর্ষণ, হত্যা, প্রহার, লুট, বিতাড়ন জন্ম দিল জুম্ম জনতার প্রতিরোধ যুদ্ধের। এ বড়ই অসম প্রতিরোধ যুদ্ধ। এক দিকে ৪/৫ লক্ষ মানুষের এক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী, যারা ঐতিহ্যিকভাবে নিরীহ, শান্তিপ্রিয়, সরল ও পশ্চাৎপদ; অপর দিকে উন্নত অস্ত্রসজ্জিত সেনাবাহিনী, বিডিআর, পুলিশ, আনসার, ভিডিপি ইত্যাদি সব মিলিয়ে লক্ষাধিক সশস্ত্র শক্তির উপস্থিতি।

জেনারেল জিয়ার আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামের আধিবাসী পাহাড়ীদের উৎখাত এবং সেই এলাকা বাংলাভাষীদের দ্বারা অধ্যুষিত করার লক্ষ্যে বহিরাগতদের বসতি স্থাপনের পরিকল্পিত পদক্ষেপ প্রথম দেওয়া হয়। জেনারেল এরশাদের আমলেও এই বসতি স্থাপন পরিকল্পনাকে এগিয়ে নেওয়া হয়। সরকারের উদ্যোগে ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত সময়ে তিনটি বৃহৎ আকারের অভিবাসন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী সরকারী উদ্যোগে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাজার হাজার পরিবারকে পার্বত্য চট্টগ্রামে অভিবাসন করা হয়। তাদের বিনা খরচে জমি, বাড়ী দেওয়া হয়। তাছাড়া তাদের জন্য থাকে রেশনসহ অন্যান্য বহুবিধ সুবিধা। সর্বাত্মক রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে পরিচালিত এই বহিরাগত অভিবাসন প্রক্রিয়ার ফলে ভূমি সন্তান জুম্মদের সঙ্গে বহিরাগত বাংলাভাষীদের সংখ্যাগত ভারসাম্যে মারাত্মক পরিবর্তন ঘটে। ১৯৬১ সালে লোক গণনা অনুযায়ী, পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাভাষী মুসলমানদের সংখ্যা ছিল ১২ শতাংশ। ১৯৭৪-এ এই সংখ্যা বেড়ে হয় ১৯ শতাংশ। ১৯৮১ সালে তা হয় ৩৮ শতাংশ এবং ১৯৯১ সালে ৪৪ শতাংশ। এই হারে বৃদ্ধি চলতে থাকলে শতাব্দীর শেষে পার্বত্য চট্টগ্রামে এই সংখ্যা পরিণত হওয়ার কথা ৫৬ শতাংশে। আর এইভাবে সুপরিকল্পিতভাবে নির্যাতন ও অভিবাসনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীকে সংখ্যালঘুতে পরিণত করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদের করতে চাওয়া হয়েছে নিজ ভূমিতে পরবাসী।

এই প্রক্রিয়ায় বহু পাহাড়ীকে হত্যা করা হয়। কারারুদ্ধ করা হয়। লোগাং-এর মত অনেক ক’টি গ্রামে গণহত্যা পরিচালনা করা হয়। বহু নারীকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা ধরে নিয়ে যায় এবং ধর্ষণ এবং বাধ্যতামূলকভাবে ধর্মান্তরিত করে বলে অভিযোগ রয়েছে। এই একই অভিযোগ রয়েছে অভিবাসনকারী বাংলাভাষীদের বিরুদ্ধেও। এইসব ঘটনার কোনটারই তদন্ত হয়েছে বলে জানা যায় নি। প্রতিকারের তো প্রশ্নই উঠে না। অবশ্য লোগাং গণহত্যার একটা তদন্ত হলেও প্রকৃত সত্যকে জনসমক্ষে তুলে ধরা হয় নি।

চাই সমস্যার দ্রুত সমাধান

পার্বত্য চট্টগ্রামের ঘটনাবলী জাতি হিসাবে আমাদের বিবেককে বিরাট প্রশ্নের সম্মুখীন করে। এটা কি বিস্ময়কর নয় যে, পাকিস্তান আমল থেকে এ পর্যন্ত এ দেশেরই ভূমি সন্তানদের প্রতি কি নিদারুণ অবজ্ঞা আর অবহেলা প্রদর্শন করা হয়েছে? এ দেশের প্রগতিশীল রাজনীতিকরা পর্যন্ত খুব কমই তাদের স্বার্থে কথা বলেছেন। বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে আমরা বহু কথা শুনলেও এ দেশেরই এক কোণে সুদীর্ঘ কালের পরিচালিত বৈষম্য ও বর্বর নিপীড়নের বিরুদ্ধে তাদের কণ্ঠ হতে সুদীর্ঘ কাল কোনও কিছু উচ্চারিত হতে শুনি নি।

আসলে এই বর্বরতার সমাজে দুর্বলরা সবখানে সবদিক থেকে মার খায়। সংখ্যালঘুরা দুর্বল আর তাই তারা সব ধরনের নিপীড়ন আর বৈষম্যের শিকার। হিন্দুরাও মার খায় সেই কারণে। কিন্তু তারা সাধারণত নীরব থাকে। থাকতে না পারলে তারা নীরবে দেশ ছেড়ে চলে যায়। সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো যখন তখন সুযোগ পেলে তাদের উদ্দেশ্যে উচ্চারণ করে ‘দেশ ছাড়ো’ ধ্বনি। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মতো নিগৃহীত হয় জাতিগত সংখ্যালঘুরা। তাদের সমস্যা আরও বেশী। তারা দেশের এক কোণে পড়ে থেকে সবার অজান্তে নিগৃহীত হয়। শিক্ষায়-সম্পদে পশ্চাৎপদ, নিরীহ-শান্তিপ্রিয় এবং অবিশ্বাস্য রকম সরল ও সত্যভাষী এই আদিবাসীরা বোবা পশুর মত মার খেতে খেতে এক সময় প্রতিবাদ আর প্রতিরোধে বিস্ফোরিত হয়। আর তাই সেখানে কল্পনা চাকমার মতো সাহসী নারীর জন্ম হয়। এবং অবশেষে বাঙ্গালী জাতিরও বিবেকের ঘুম ভাঙ্গে।

কল্পনা চাকমাকে নিয়ে অনেক কথা লেখা হয়েছে। বুদ্ধিজীবীসহ অনেকে অনেক বিবৃতি দিয়েছেন। বিভিন্ন সংগঠন এগিয়ে এসেছে। ঘটনার তদন্তে কমিটিও গঠন হয়েছে। কামনা করব তদন্তের মাধ্যমে সত্য উদঘাটিত হবে। সুতরাং কল্পনাকে নিয়ে এখানে বেশী কথা বলব না। শুধু বলব কল্পনা চাকমা অপহরণ এ দেশে সুদীর্ঘ কালের ধর্মীয় কিংবা জাতিগত সংখ্যালঘু নিপীড়নের একটা প্রকাশ মাত্র। এই একই সঙ্গে বেরিয়ে আসে এ দেশে নারীর প্রকৃত অবস্থা। কল্পনা চাকমাকে নিয়ে সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশন যে ব্যাখ্যাই দিক, সত্যটা অনুমান করতে কষ্ট হবার কথা নয়। গত ২১ বৎসর ধরে সেনাবাহিনী সেখানে যা করেছে তার কিছু বিবরণ যাদের জানা আছে তারা সহজেই ঘটনা অনুমান করতে পারবেন। এই সঙ্গে বিভিন্ন সংবাদপত্রে সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের বিবরণ থেকেও ঘটনা অনুমান করা যায়। গত ২৪ জুলাই ১৯৯৬ তারিখে কল্পনা চাকমা প্রসঙ্গে ২৪তম পদাতিক ডিভিশন সংবাদপত্রে যে বিবৃতি দেয় তা কিন্তু একটা বিষয় জাতির কাছে স্পষ্ট করে দিয়েছে, সেটা হ’ল পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা শাসন চলছে। রাজনৈতিক কর্তৃত্ব কিংবা বেসামরিক শাসন কর্তৃত্বের কাছে সেখানে শাসনভার থাকলে বিবৃতিটা তাদের কাছ থেকে আসত। এটা সত্যি খুবই দুর্ভাগ্যের যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে আজও সেনাতন্ত্র চলছে। সেনা শাসন যে কোনও সভ্য গণতান্ত্রিক দেশের জন্য কলঙ্কের ও লজ্জার। পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা শাসন বাংলাদেশের জন্যও কলঙ্কের।

বাংলাদেশের শাসক শ্রেণী পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সৃষ্টি করে বাইরের পৃথিবীতেও দেশের কলঙ্কের বোঝা বাড়িয়েছে। বিশেষত কল্পনা চাকমার অপহরণ ঘটনা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। একদিকে অভ্যন্তরে ক্রমবর্ধমান জনমত, অপর দিকে আন্তর্জাতিক চাপ পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার দ্রুত সমাধান সরকারের জন্য জরুরী করে তুলেছে।

সমাধান কোন্‌পথে?

আসলে পার্বত্য চট্টগ্রামকে সমস্যায় পরিণত করেছে বিগত সরকারগুলোর অদূরদর্শী কিংবা অমানবিক ও স্বৈরতান্ত্রিক কর্মনীতি ও দৃষ্টিভঙ্গী। পাকিস্তান আমলের প্রসঙ্গ এখানে আর নাই বা তুললাম। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর প্রথমে তাদের উপর জোর করে বাঙ্গালী পরিচয় চাপিয়ে দিতে চাওয়া হয়। অথচ এটা ছিল সম্পূর্ণ অন্যায়। বরং বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের জন্য সেটাই গৌরবের হ’ত যদি তার সঙ্গে এ দেশের সকল জাতিসত্তার স্বাতন্ত্র্য, সহাবস্থান ও সমমর্যাদার প্রতি স্বীকৃতি দেওয়া হ’ত। এই সত্য ভুলে যাওয়া হয়েছিল যে, বাংলাদেশ শুধু বাঙ্গালীর নয়, এ দেশে বসবাসকারী জুম্ম বা পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ীসহ সকল জাতিসত্তার রাষ্ট্র। অর্থাৎ একক জাতির জাতীয়তাবাদ না হয়ে আমাদের আদর্শ হওয়া উচিত বহুত্ববাদী বা সম্মিলিত জাতীয়তাবাদ। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার দূরপ্রসারী রাজনৈতিক সমাধানের একটি অপরিহার্য পূর্বশর্ত হ’ল এ দেশে বাঙ্গালী জাতিসত্তা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জুম্ম জাতিসত্তাসহ সকল জাতিসত্তার সহাবস্থান ও সমঅধিকারের মৌলনীতিকে স্বীকৃতি দান করা। পার্বত্য চট্টগ্রামবাসীর সুদীর্ঘ সংগ্রাম আমাদের এই শিক্ষা দিয়েছে।

একই সঙ্গে এই সংগ্রাম বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের স্বরূপ উন্মোচন করেছে। এটা স্পষ্ট করেছে যে, এই জাতীয়তাবাদ বাঙ্গালী ও জুম্মসহ সকল জাতিসত্তার লোকবাদী ও গণতান্ত্রিক চেতনা বিরোধী। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদীদের যুক্তি হ’ল বাংলাদেশ শুধু বাঙ্গালীর নয়, অন্যান্য জাতিসত্তারও দেশ। সুতরাং বাংলাদেশের সকল জাতিসত্তার মিলনের জন্য প্রয়োজন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের। এবং সেই সঙ্গে এই জাতীয়তাবাদ ধারণ করে সংখ্যাগুরু মুসলমান সম্প্রদায়ের স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য। আপাত দৃষ্টিতে নিরীহ ও উদার এই জাতীয়তাবাদের প্রবক্তারা বিগত একুশ বৎসর ধরে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে এমন এক দুইধারী তলোয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছে যা একদিকে অসাম্প্রদায়িক, লোকবাদী এবং গণতান্ত্রিক বাঙ্গালী চেতনাকে আঘাত করেছে, অপর দিকে আঘাত করেছে অবাঙ্গালী সংখ্যালঘু জাতিসত্তাসমূহের অস্তিত্ব ও মর্যাদাকে।

বহু অভিজ্ঞতার পর আজ আমাদের আত্মবিচার করতে হবে। ভুল আর অন্যায়ের বোঝা বাড়ানো যাবে না। উগ্র বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ যেমন পরিত্যাজ্য তেমন পরিত্যাজ্য উগ্র সাম্প্রদায়িক ও ভিন্ন জাতিদ্বেষী বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদও। এই উভয় জাতীয়তাবাদের আবরণে এত কাল প্রকৃতপক্ষে যে উগ্র সাম্প্রদায়িকতাবাদী চেতনা ও সংস্কৃতির লালন ও বিকাশ ঘটানো হয়েছে এখন তার অবসান ঘটাবার কাজ শুরু করতে হবে। বাংলাদেশকে পরিণত করতে হবে ভাষা, জাতিসত্তা ও ধর্মবিশ্বাস নির্বিশেষে এ দেশের অধিবাসী সকলের সমঅধিকার ভিত্তিক গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রে। সমাজের সকল বিবেকবান মানুষ চাইবেন সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানে আন্তরিক হবে। আন্তরিকতা থাকলে যে এ ধরনের সমস্যা সমাধান করা যায় তার দৃষ্টান্ত তো আমাদের প্রতিবেশী পশ্চিম বঙ্গেই আছে। দার্জিলিং জেলায় গোর্খা বা নেপালীদের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার আদায়ে কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের মত এত রক্ত ঝরাতে ও সংগ্রাম করতে হয় নি। পশ্চিম বঙ্গের বাম ফ্রন্ট সরকার দার্জিলিং-এ গোর্খাদের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবী মেনে নিয়ে সমস্যার শান্তিপূর্ণ মীমাংসা করেছিল। আমাদের দেশে সরকারগুলো অতীতে বাহুবলে সমস্যা সৃষ্টি করেছে এবং বাহুবলেই সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছে। ওই পথ এ দেশে আর যাদের ক্ষেত্রেই সফল হয়ে থাকুক, পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম জনগোষ্ঠীর বেলায় যে সফল হবে না তা যদি এখনও উপলব্ধি করা না যায় তবে সেটা হবে বোকার স্বর্গে বাস করার শামিল।

পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানের জন্য অত্যাবশ্যক হ’ল জুম্ম জনগোষ্ঠীর স্বাতন্ত্র্য ও জাতিগত অধিকারের প্রতি স্বীকৃতি দান এবং বাংলাদেশে তাদের মর্যাদার সঙ্গে বসবাস ও রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে অবাধে অংশগ্রহণের অধিকার প্রদান। এর জন্য দু’টো বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, পার্বত্য চট্টগ্রামকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করতে হবে। বস্তুত জুম্ম জনগোষ্ঠীর জন্য স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। কিন্তু এটি একটি পদক্ষেপ মাত্র। দ্বিতীয়টিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সেটি হ’ল জুম্ম জনগণ যাতে ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার না হন এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে নিজেদের অনুভব না করেন সেই জন্য বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আদর্শে সেকিউলার বা লোকবাদী নীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। বস্তুত স্বায়ত্তশাসনের অধিকার এবং সেই সঙ্গে সেকিউলার এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণকে মর্যাদা ও নিরাপত্তার সঙ্গে বাস করার অধিকার দিতে পারে।

এটা ঠিক যে, পূর্ববর্তী সরকারগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে অনেক জটিল করেছে। বিশেষত বাইরে থেকে সেখানে কয়েক লক্ষ বাংলাভাষী মুসলমান নিয়ে গিয়ে অবস্থাটাকে জটিলতর করা হয়েছে। সেই সঙ্গে আছে দীর্ঘ উৎপীড়নের ইতিহাস। তবু সরকার চাইলে এবং আন্তরিক হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব। পার্বত্য চট্টগ্রাম জন-সংহতি সমিতির সঙ্গে অস্ত্রবিরতির মেয়াদ দফায় দফায় বাড়ছে। কিন্তু আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করে লাভ নেই। অবিলম্বে ফলপ্রসূ আলোচনা শুরু করতে হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রামকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সমস্যা হিসাবে নিয়ে কয়েকটি পদক্ষেপ দিতে হবে। প্রথমত, তদন্তের নামে কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনা যাতে দীর্ঘসূত্রতার আবরণে ঢাকা না পড়ে তার ব্যবস্থা করতে হবে এবং দ্রুত দায়ী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে। শুধু তাই নয়, সেখানে জুম্ম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এত কাল যেসব অপকীর্তি করা হয়েছে সেগুলোর উপর শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে এবং এসব ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনা নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার করতে হবে এবং সেখানে বেসামরিক, গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বিশেষত সেখানে এত কাল যেসব অন্যায় হয়েছে সেগুলো যাতে দেশবাসী অবাধে জানতে পারে সেই জন্য সেখানে সকল মানবাধিকার কর্মêী, সাংবাদিক ও অন্যদের অবাধ চলাফেরার অধিকার দিতে হবে। সর্বোপরি, পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসন যা সেখানকার জনগণের প্রাণের দাবী তা অবিলম্বে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পদক্ষেপ দিতে হবে; এবং পদক্ষেপ দিতে হবে সেকিউলার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যাতে এ দেশের ধর্ম ও মতবাদ নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায় ও ব্যক্তি সমমর্যাদা ও অধিকার নিয়ে বাস করতে পারে। আজ আমাদের উপলব্ধি করতে হবে, পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনতার সংগ্রাম শুধু তাদের একার সংগ্রাম নয়। এই সংগ্রাম এ দেশের সকল নিপীড়িত ও লাঞ্ছিত নারীর মুক্তি অর্জন ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। এই সংগ্রাম সকল নির্যাতিত মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জনের সংগ্রাম। এই সংগ্রাম বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক ও সেকিউলার রাষ্ট্র ও সমাজ হিসাবে গড়ে তোলার সংগ্রাম। আর তাই বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক শক্তির পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে পাশ কাটিয়ে যাবার কোন উপায় নেই।

তথ্যসূত্রঃ
১. Mohiuddin Ahmad, Islamisation of the Hill Tracts : A Case of Majority Chauvinism, The Daily Star, Dhaka, June 29, 1996.
২. নীলোৎপল চৌধুরী, প্রসঙ্গঃ কল্পনা চাকমা সম্পর্কিত সেনাবাহিনীর ভাষ্য, দৈনিক ভোরের কাগজ, ঢাকা , জুলাই ২৮, ১৯৯৬।

রচনাঃ   ১৯৯৬
তথ্যসূত্র: http://www.bangarashtra.net, আপডেটঃ September 12, 2015, 12:00 AM, 

No comments

Theme images by 5ugarless. Powered by Blogger.