চাকমা ভাষাচর্চা কোন পথে

পার্বত্য চট্টগ্রামে ১১টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার রয়েছে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি। ভাষিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে সংখ্যাগতভাবে এ দেশে বাংলা ভাষার পরে চাকমা ভাষার অবস্থান (২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, চাকমা জনগোষ্ঠী চার লাখ ৪৪ হাজার)। ভাষাগত দিক থেকে চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষা অনেকটা কাছাকাছি। অনেক ভাষাবিদ তঞ্চঙ্গ্যা ভাষাকে চাকমা ভাষার উপভাষা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে একটু গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে এ দুটি ভাষার মধ্যে উচ্চারণগত ভিন্নতা ছাড়া তেমন কোনো পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না। পার্বত্য চট্টগ্রামে ১১টি ভিন্ন ভাষাভাষী জাতির মধ্যে চাকমারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। চাকমাদের আবাসস্থল পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়াও ভারতের মিজোরাম, অরুণাচল, ত্রিপুরা, আসাম ও মিয়ানমারে রয়েছে। সমগ্র পৃথিবীতে প্রায় ছয় লাখ লোক চাকমা ভাষায় কথা বলে। মূলত চাকমা ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় বৃহৎ ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত জাতিগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে চাকমা ও মারমাদের ছাড়া আর কোনো গোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষার বর্ণমালা নেই।
চাকমা ভাষার লেখনরীতি ‘মন খমে’র অনুরূপ। চাকমাদের নিজস্ব বর্ণমালা আছে, তবে এর সংখ্যা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। যেমন, ড. জি এ গ্রিয়ারসন তাঁর ‘লিঙ্গুয়েস্টিক সার্ভে অব ইন্ডিয়া’ গবেষণায় (১৯০৩) চাকমা ভাষায় ৩৩টি বর্ণমালার কথা উল্লেখ করেছেন। সতীশ চন্দ্র ঘোষ তাঁর চাকমা জাতি (১৯০৯) গ্রন্থে ৩৭টি বর্ণমালার কথা বলেছেন। অন্যদিকে, নোয়ারাম চাকমা ১৯৫৯ সালে তাঁর চাকমা বর্ণমালার পত্তম শিক্ষা নামক শিশুপাঠ্য বইয়ে ৩৯টি বর্ণমালার কথা উল্লেখ করেছেন। বর্তমানে চাকমা ভাষায় ৩৩টি বর্ণমালা ব্যবহূত হচ্ছে।
চাকমারা একসময় তান্ত্রিক বৌদ্ধমতে বিশ্বাসী ছিলেন। এ মতের অনুসারী লুরি বা পুরোহিতেরা চাকমা বর্ণমালার সাহায্যে তাঁদের ধর্মগ্রন্থ আঘরতারা রচনা করেছিলেন। এ আঘরতারা গ্রন্থটি চাকমাদের সবচেয়ে প্রাচীন পুঁথি হিসেবে আজও বিবেচিত হয়ে থাকে। তা ছাড়া তাহ্লিক শাস্ত্র বা চিকিৎসাশাস্ত্রে চাকমা বৈদ্যরা (পল্লি চিকিৎসক) চাকমা লিপি ব্যবহার করতেন, যেটি বংশপরম্পরায় ও তাঁদের শিষ্যদের মাধ্যমে এর ব্যবহার আজও অব্যাহত রয়েছে।
আঠারো শতকের (১৭৭৭) দিকে চাকমা সাধক কবি শিবচরণ তাঁর গোজেন লামা গীতিকাব্যটি চাকমা বর্ণমালায় রচনা করেছিলেন। তাই ধারণা করা হয়, চাকমা সাহিত্য ও তাহ্লিক শাস্ত্রচর্চায় চাকমা বর্ণমালা ব্যবহারের প্রচলন বহু আগে থেকে শুরু হয়েছে। অন্যদিকে, ১৮৬০ সালে খ্রিষ্টান মিশনারিজদের উদ্যোগে এলাহাবাদ থেকে চাকমা বর্ণমালায় বাইবেলের অনুবাদ করা হয়। এই উদ্যোগের মূল উদ্দেশ্য ধর্ম প্রচার হলেও এটি চাকমা বর্ণমালার অন্যতম স্বীকৃতি ছিল, যেটি চাকমা বর্ণমালার ভিত্তিকে আরও মজবুত করেছে। এ ছাড়া ১৯৪০ সালের শুরুর দিকে রাঙামাটি হাইস্কুলের ইংরেজ শিক্ষক মি. মিলার চাকমা সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েদের বাংলা হরফে চাকমা ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষাদানের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর এ উদ্যোগকে ধর্মান্তঃকরণের প্রচেষ্টা মনে করে সে সময়ের চাকমা সমাজ প্রবলভাবে এর বিরোধিতা করেছিল। বিরোধিতা সত্ত্বেও পরবর্তীকালে মি. মিলার ‘চাকমা প্রাইমার’ নামে একটি শিশুপাঠ্য বই প্রকাশ করেছিলেন। তবে স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে সুগত চাকমা প্রথমবারের মতো চাকমা বাঙলা কধাতারা নামে একটি চাকমা-বাংলা অভিধান রচনা করেছেন। এটিই চাকমা ভাষার প্রথম অভিধান হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
১৯৭৮ সালে সরকারি উদ্যোগে পার্বত্য জেলায় উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সেখানকার জাতিসত্তাগুলোর ভাষা, সাহিত্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা চর্চা শুরু হয়। এ ছাড়া ১৯৮১ সালের গঠনলগ্ন থেকে সাহিত্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘জুম ইসথেটিকস কাউন্সিল’ সংক্ষেপে ‘জাক’ পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিগোষ্ঠীগুলোর সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে আজ পর্যন্ত নিরলসভাবে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। ২০০১ সালে জাক-এর সহায়তায় মোস্তাফা জব্বার চাকমা বর্ণমালার প্রথম সফটওয়্যার তৈরি করেন। উল্লেখ্য, নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে পদায়নকৃত সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের কাজের সুবিধার্থে বিশেষ ব্যবস্থায় তাঁদের চাকমা-মারমা-ত্রিপুরা ভাষা শেখানো হতো।
১৯৯৭ সালে চুক্তি স্বাক্ষরের আগে পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর মাতৃভাষার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি ছিল না। কিন্তু পার্বত্য চুক্তির খ খণ্ডের ৩৩ নম্বর ক্রমিকের খ(২) নম্বর উপ-অনুচ্ছেদে প্রাথমিক পর্যায়ে মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের কথা উল্লেখ থাকায় বাংলা ভিন্ন অন্যান্য ভাষাভাষীর মাতৃভাষা প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করেছে। এ স্বীকৃতির অংশ হিসেবে রাঙামাটি জেলা পরিষদ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বেশ কিছু শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের চাকমা ভাষা ও বর্ণমালা চর্চার প্রশিক্ষণ দেয়। এ ছাড়া বর্তমানে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা মাতৃভাষায় প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষাদানের কর্মসূচি তাদের কর্মপরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করেছে।
আমরা জানি, ভাষার লিখিত চর্চা না থাকলে ভাষার বিকাশ ও শ্রীবৃদ্ধি ঘটে না। এ দেশের ক্ষুদ্র জাতিগুলোর সাহিত্য চর্চা বাংলা হরফে হলেও অনেক ক্ষেত্রে উচ্চারণগত সমস্যার সমাধান বাংলা দ্বারা সম্ভব নয়। তাই বাংলা হরফে চাকমা সাহিত্য চর্চা করতে গেলে ভাষার মূল উচ্চারণ পরিবর্তিত হয়ে এর অর্থ ভিন্ন হওয়ার যথেষ্ট ঝুঁকি থাকে। কিন্তু এসব সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সম্ভাবনার বিষয় হলো, পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিশুরা মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা লাভের অধিকার লাভ করেছে। এর ফলে ২০১০ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতিতেও বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর ধারাবাহিকতা ধরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০১৪ সাল থেকে পাঁচটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষাদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের দ্বারা এ দেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর নৃ-ভাষাবৈজ্ঞানিক সমীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ উদ্যোগ যথাযথভাবে পরিচালিত হলে এ দেশের বিলুপ্তপ্রায় অনেক ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষা ও বর্ণমালা সংরক্ষণ ও পুুনরুজ্জীবন করা সম্ভব হবে বলে অনেকে আশা প্রকাশ করছেন। কেননা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মূল লক্ষ্যই হলো বিশ্বের সব ভাষার নমুনা সংরক্ষণ ও মৃতপ্রায় ভাষাকে পুনরুজ্জীবিত করা।
পুলক বরণ চাকমা: সহকারী পরিচালক, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট।
pulakchakma21@gmail.com
তথ্যসূত্র: প্রথম আলো, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৩

No comments

Theme images by 5ugarless. Powered by Blogger.