রোকেয়া লিটা’র ডুমুরের ফুল উপন্যাস এবং ধর্ষিত পাহাড়ের আদিবাসী সমাজ ও সংস্কৃতি

রোকেয়া লিটা’র দীর্ঘ ৮ মাসের পাহাড়ে অবস্থান করে গবেষনার ফলাফল এই “ডুমুরের ফুল” বইটি।বইটি ডুমুরের ফুল রাখার কারন এই লেখিকার ভাষ্যনুযায়ী : “ডুমুরের ফুল আসলে ফলের ভেতরে থাকে, বাইরে থেকে দেখা যায় না।

এই উপন্যাসে মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনীতি ও জীবনাচরণকে ভেতর থেকে উন্মোচন করা হয়েছে যা সচরাচর ঢাকায় বসে বা দুই/তিন দিনের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে বেড়াতে গিয়ে বোঝা যায় না। এজন্যই উপন্যাসটির নাম রাখা হয়েছে ডুমুরের ফুল”(তথ্যসুত্র:কালের কন্ঠ)

পাহাড়ের আদিবাসীদের নিয়ে দীর্ঘ ৮ মাস গবেষনার ফলাফলে এই ভদ্র মহিলা পাহাড়ের রাজনীতি ও জীবনচারকে ভেতর থেকেই উন্মেচন করতে গিয়ে যে,পাহাড়ের আদিবাসীদের আরো একবার ধর্ষন ও যে করেছেন তা এই ভদ্রমহিলার খেয়ালই করেননি।

পাহাড়ের আদিবাসী সমাজকে নিয়ে লেখা এই বইটি পড়ার দুর্ভাগ্য আমার হয়নি-তবে অনলাইনের বেশ কয়েকটা পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারের প্রেক্ষিতেই বইটি সম্পর্কে যথেষ্ট ধারনা পেয়েছি।যেখানে মুল টাইটেলটি কালের কন্ঠ পত্রিকা হেডলাইন করেছিলেন “ধর্ষন করলে শুকর জরিমানা” করে।

আদিবাসী সমাজে কোন যুবক-যুবতী যদি অবিবাহিত অবস্থায় প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে অসামাজিক ভাবে কোন অবৈধ সম্পর্ক করার সময় সমাজের চোখে ধরা পরে যায় তখন সমাজের যুবক শ্রেনীরা সমাজের পাড়া প্রধান কার্বারীর কাছে নিয়ে যায় এবং এই যুবক-যুবতীকে বিবাহের বন্ধনে আবদ্ধ করে জরিমানা হিসেবে শুকর জবাই করে বিবাহবন্ধন করিয়ে দেওয়া হয় আর সেই শুকরের মাংশ সহ পারাবারিক সামর্থ্যনুযায়ী খাবার এলাকার মানুষদের খাওয়ানো হয়।আর যদি কোন এক পক্ষ বিয়েতে দ্বিমত পোষন করেন সেই ক্ষেত্রে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করে বিয়েতে বাধ্য করা হয়।

কিন্তু আমাদের আদিবাসীদের ভাষাতে আমরা কখনো ধর্ষন শব্দটির সাথে পরিচিত ছিলাম না।তাই “ডুমুরের ফুল” বইটিতে আদিবাসীদের নিয়ে লেখা ধর্ষন শব্দটি লেখিকা কোন অর্থে প্রয়োগ করেছেন তা বুঝে ওঠতে পারছিনা।তবে লেখিকার ভাষ্যমতে আমাদের আদিবাসীদের নিয়ে লেখা এই উপন্যাসের মাধ্যমেই উপলদ্ধি করছি “ধর্ষন”কে।কারন এই বইটি যে ধর্ষন করেছে নিরীহ আদিবাসিদের সামাজিক ও সংস্কৃতি কে।

“পাহাড়ে ধর্ষণের ঘটনা যে ঘটছে না, তা কিন্তু নয়। হয়ত, এসব ঘটনার সাথে বাঙালীরাও জড়িত। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা একেবারেই ভিন্ন। প্রায় আট মাস পার্বত্যচট্টগ্রামে ছিলাম, দুজন পাহাড়ি মেয়ে ধর্ষণের ঘটনা আমার কানে এসেছে। আশ্চর্য্যজনক হলেও সত্যি যে, দুটি ঘটনাতেই অভিযোগ পাহাড়ি পুরুষের বিরুদ্ধে। আরও অবাক হয়েছিলাম যে বিষয়টি দেখে, দুটি ঘটনাই ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল, ধর্ষকের বিচার চেয়ে কোনো আন্দোলন নেই, নেই কোনো মিছিল, পত্রিকার পাতায়ও কোনো খবর নেই!! অথচ, ঢাকায় বসে আমরা শুধু খবর পাই, বাঙালীরা পাহাড়ি মেয়েদের ধরে এনে ধর্ষণের উৎসব পালন করছে। বুঝতে সমস্যা হয় না, এগুলোই হলো পাহাড়ের আসল রাজনীতি, এই রাজনীতির অনেকটা জুড়েই রয়েছে আমার উপন্যাস”-(সূত্র:-কালের কন্ঠ)

ধর্ষনের কথাটি কানে এসেছে কিন্তু কোন প্রমান ছাড়াই সেই কানে আসা কথা নিয়েই একটা চমৎকার উপন্যাস করেছেন এই লেখিকা।কিন্তু তিনি ৮ মাসেই “ডুমুরের ফুল” কে দেখতে পেয়েছেন কিন্তু দেখতে পাননি তুবাচিং মারমাকে ধর্ষনের পর হত্যা করাকে,দেখতে পাননি সুজাতা চাকমার সেই কোমলবতী শরীরের ধর্ষক কর্তৃক হত্যার শিকার করাকে,দেখনি পাননি রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলায় ২০১০ সালে ১৯-২০ ফেব্রুয়ারিতে আদিবাসী পল্লিতে অগ্নিসংযোগ করা সেই ৪৭০ পরিবারের এখনো ক্ষত না শুকানো হাহাকারকে,দেখতে পাননি সেই দিঘীনালা বাবুছড়ায় ১৯ আদিবাসী পরিবারকে উচ্ছেদ করে বিজিবি ক্যাম্প করা নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করা জুম পাহাড়ের আদিবাসীদের কে।

ডুমুরের ফুল উপন্যাসটি যে শুধু পাহাড়ের আদিবাসীদের সংস্কৃতিকে আঘাত করেছে তা নয় ভুল তথ্য দিয়ে আদিবাসীদের সম্পর্কে বিভ্রান্তি তথ্য নিয়ে উপন্যাস লিখে আদিবাসীদের মানহানিও করেছে এই উপন্যাসটি।তাই আমার অনুরোধ থাকবে দেশের বাঙ্গালি বন্ধুপ্রতিম দাদা ও প্রবাসী বাঙ্গালি দাদা ভাইরা আপনারা এই “ডুমুরের ফুল” উপন্যাসটি পড়ে আমাদের পাহাড়ের আদিবাসীদের সম্পর্কে ভুল ও করুচিপুর্ন সংস্কৃতি সম্পর্কে জানবেন।যা আমাদের সমাজের তেমন রীতি ও নেই,নীতি ও নেই।

একটা জাতিকে বিলুপ্তি ঘোষনা করতে সেই জাতির সংস্কৃতিকে আগেই বিলুপ্তি ঘটাতে হবে।তাই আমাদের সংস্কৃতিকে বিলুপ্তি ঘটাতেই “ডুমুরের ফুল” এর মতন উপন্যাস লেখা হয় যা আমাদের সম্পর্কে ভুল তথ্য দিয়ে রচনা করা হয়।

পাহাড়ের সম্পর্কে লিখতে হলে পাহাড়ের খুব কাছেই যেতে হবে,পাহাড়ের আদিবাসীদের খুব কাছে থেকেই দেখতে হবে,জানতে হবে আর তাদেরকে দেখেই জানতে পারবেন জীবন কি?

মোটরের সুইচ ছেড়ে দিয়ে পানির একটা বোতলে পানি ভরন করে নিয়ে সেই পানি তৃপ্ত নিয়ে পান করা জীবন আর দীর্ঘ পাহাড় ডিঙ্গিয়ে এক কলসি পানি নিয়ে বাচ্ছা কোলে করে পাহাড়ের ওপর ওঠে তৃপ্ত সহকারে সেই পানি পান করা সেই কষ্টময় জীবন-কখনো পেরেছেন কি উপলদ্ধি করতে?আমরা চাইনা সেই মোটরের সুইচের পানির বোতল আমরা চাই আমাদের মতন বাচতে,আমাদের মতন চলতে তবে “ডুমুরের ফুল” উপন্যাসের মতন আমার সংস্কৃতিতে আঘাত করে উপন্যাস লিখে আমাদের সমাজকে ধর্ষন করে বাচতে নয়।আমাদের পাশে না থাকুন,সহমর্মিতাও প্রকাশ না করুন কিন্তু এইভাবে মিথ্যাভাবে আমাদের সংস্কৃতিতে আঘাত করবেননা।

তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা রইল মিথ্যা ও বানোয়াট করে লেখা ধর্ষন ও শুকর জরিমানা করা বিষয়ে আমাদের আদিবাসী সমাজের বিয়ে নিয়ে আমাদের সংস্কৃতিকে আঘাত করা লেখিকা রোকেয়া লিটাদের উপন্যাস “ডুমুরের ফুল” উপন্যাসটির জন্য।
তথ্যসূত্র: http://eurobarta24.com, তেপান্তর লারমা অপু | রবিবার, ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ |

No comments

Theme images by 5ugarless. Powered by Blogger.