আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এবং আদিবাসী ভাষা

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন
প্রতি বছর অমর একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপনের নানা আয়োজনের মধ্যে অন্যতম একটি হলো সংবাদপত্রগুলোর বিশেষ সাময়িকী প্রকাশ। সেটা নানা কারণে বেশ গুরুত্বপূর্ণও। কেননা ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে যেমন রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ, তেমনি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পথরেখা নির্মাণের ক্ষেত্রেও সমান্তরালে গুরুত্বপূর্ণ। তাই সাহিত্য এবং সাহিত্যিকরা এই দিনে একটু বিশেষ আবেগে প্রকাশিত হবেন, সেটাই স্বাভাবিক এবং ন্যায্য। কিন্তু আমাকে ভীষণভাবে আগ্রহী করে তোলে যখন অবাঙালিরা, বিশেষ করে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর তরুণ-উদ্যোগী সাহিত্যকর্মীরা অমর একুশে স্মরণে কোনো বিশেষ প্রকাশনা বা লিটল-ম্যাগ প্রকাশ করে। তবে বাংলা ভাষার ঐতিহাসিক এ বিশেষ দিনটি আদিবাসীরা কেন বিশেষভাবে উদযাপন করে তা নিয়ে আমার সামনে বেশ কিছু জিজ্ঞাসা তৈরি হয়। ১৯৫২ সালে সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য ঢাকার রাজপথে প্রাণ দিয়েছিলেন, যার মধ্য দিয়ে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাও রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পায়। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের এ ইতিহাসের সঙ্গে আদিবাসী মানুষের ভাষার তো কোনো স্বার্থ রক্ষিত হয়নি। কেননা আদিবাসী মানুষের ভাষাকেও অন্যান্য ভাষার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়ার কোনো দাবি সেদিন উচ্চারিত হয়নি। তাহলে কেন আদিবাসী মানুষ এ মহান ‘একুশ’ উদযাপন করে? এ একুশের স্মরণে পত্রিকা প্রকাশ করে? এর মধ্য দিয়ে আদিবাসী মানুষের কোন রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক চরিত্রের পরিচয় পাওয়া যায়? ইত্যাকার নানা জিজ্ঞাসা আমার সামনে এসে হাজির হয়। এ লেখা মূলত সেসব জিজ্ঞাসার উত্তর খোঁজার এক ধরনের প্রয়াস মাত্র।
ইতিহাসের পরম্পরায় ‘একুশ’ কেবল স্বজন হারানোর বেদনায় সিক্ত কোনো অশ্রুবিন্দুর জন্মদিন নয়; এটি বাঙালির এবং এতদঞ্চলের অন্য জাতি-গোষ্ঠীর মানুষের, স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের অনুপ্রেরণায় বিপ্লবী চেতনার উদ্বোধনেরও দিন। তাই অত্যন্ত সঙ্গত এবং বোধগম্য কারণেই অমর ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ আমাদের জাতীয় জীবনের পঞ্জিকায় একটি মহত্তম ও শ্রেষ্ঠতম দিন। আর তার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আসে যখন ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ফলে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ আর কোনো বিশেষ দেশের বিশেষ জনগোষ্ঠীর বিশেষ ভাষার একটি ‘দিবস’ হয়ে থাকে না, এটা হয়ে উঠে সর্বজনীন এবং বিশ্বজনীন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ফলে ২০০০ সাল থেকে জাতিসংঘের সব সদস্য রাষ্ট্র যথাযথ মর্যাদায় একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করতে শুরু করে। এছাড়া ২০১০ সালের ২১ অক্টোবর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী খোদ জাতিসংঘ একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখে আন্তর্জাতিক ‘মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তাই যদিও অমর একুশের ইতিহাস এবং সে ইতিহাসের কিংবদন্তি হয়ে উঠার পেছনে বাঙালির একটি ঐতিহাসিক ভূমিকা রয়েছে, কিন্তু এর আন্তর্জাতিক মাতৃকতার কারণে সেটা এখন আর বাঙালির একার দিবস নয়। ফলে বাংলাদেশে বসবাসরত ভিন্ন ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীও অমর একুশকে একটি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালন করার রাজনৈতিক-দার্শনিক একটি জায়গা তৈরি হয়। তাছাড়া বাংলাদেশের চার দশকেরও বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে পাহাড়ে বসবাসরত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যকার যে বৈরী এবং নিপীড়নমূলক সম্পর্ক তার প্রভাব যে ভাষার ওপরও পড়ছে, সেটার প্রতিবাদ হিসেবেও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের একটা ন্যায্যতা তৈরি করে। তাই অমর একুশ, মহান একুশের চেতনা, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এবং আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষা রক্ষা ও ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিকে একই সঙ্গে একই সূত্রে গেঁথে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের এ প্রকাশনার লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে বিবেচনায় নিতে হবে। অন্যথায় এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য উপলব্ধি করা যাবে না। আমি মনে করি, এ প্রকাশনা কেবল একটি পত্রিকা নয়; বরং ভাষা হিসেবে আদিবাসী মানুষের ভাষার অস্তিত্ব, স্বাতন্ত্র্য, শক্তিমত্তা এবং সম্ভাবনাকে উপস্থাপন করার একটি পরিসর হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের অংশ হিসেবে এ ধরনের প্রকাশনার আয়োজন করা। এটা মূলত এক ধরনের সাংস্কৃতিক আন্দোলন, যা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক দর্শনের মধ্যে সাংস্কৃতিক প্রণোদনা হিসেবে কাজ করবে। কেননা সংস্কৃতি রাজনীতি-বিযুক্ত কিছু নয়; আবার রাজনীতি এক ধরনের সংস্কৃতিও বটে।
ইতিহাসের পাতায় ‘একুশ’ কীভাবে লিপিবদ্ধ আছে বা হয়েছে তা নিয়ে এবং এর ‘রাজনৈতিক ইতিহাস’ নিয়ে নানা কিসিমের বিতর্ক থাকলেও গণইতিহাসের ধারাবাহিকতায় ব্রাত্যজনের মুখে ফেরি হওয়া ইতিহাস থেকে আমরা কম-বেশি সবাই জানি, ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি মায়ের মুখের ভাষার জন্য এদেশের দামাল ছেলেরা বুকের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করেছিল। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঊর্দুকে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির ওপর চাপিয়ে দেয়ার প্রতিবাদের সেদিন এদেশের দামাল ছেলেরা ঢাকার রাজপথে ইতিহাসের নতুন অধ্যায় রচনা করেছিল নিজের জীবন দিয়ে মাতৃভাষা বাংলার সম্মান রক্ষা করে। বুকের রক্ত দিয়ে কিংবা নিজের জীবন উৎসর্গ করে মাতৃভাষার অস্তিত্ব রক্ষা করার নজির পৃথিবীর জ্ঞাত-ইতিহাসে আর একটিও নেই। তাই একুশের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার হিসেবে জীবন দিয়ে মাতৃভাষা রক্ষার যে উজ্জ্বল নজির সালাম, জব্বার, রফিক, বরকতরা স্থাপন করে গেছেন, সেটার যে রাজনৈতিক, দার্শনিক ও ঐতিহাসিক তাৎপর্য তা উপলব্ধি করাটা জরুরি। প্রতিরোধের যে দেদীপ্যমান তরিকা বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে এদেশের বীর সন্তানরা স্থাপন করে গেছেন, সেই প্রজ্বল ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে পাঠ করতে হবে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’কে এবং আদিবাসী মানুষের ভাষাকেন্দ্রিক দাবি-দাওয়াকে। একুশের যে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, দেশপ্রেমের যে বিরল দৃষ্টান্ত, প্রতিরোধের যে নির্ভীক প্রণোদনা এবং জাতীয়তাবোধের যে মনস্তাত্ত্বিক নির্মিতি তার সামগ্রিক দর্শন-চিত্রের আলোকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য এবং আদিবাসী মানুষের মাতৃভাষায় শিক্ষার দাবিকে উপলব্ধি করতে হবে। কেননা ‘একুশ’ আমাদের শিখিয়েছে কীভাবে মায়ের মুখের ভাষার জন্য সিনা-টান করে কামানের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়। ‘একুশ’ আমাদের শিখিয়েছে কীভাবে বুকের রক্ত দিয়ে মা ও মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে হয়। ‘একুশ’ আমাদের শিখিয়েছে মাতৃভাষার আন্দোলনের অন্তরালে সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে কীভাবে ঘাড়-মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হয়। তাই আদিবাসী মানুষেরও সেই রাজনৈতিক চেতনা রয়েছে, যা তাদের মাতৃভাষা রক্ষার জন্য প্রেরণা ও প্রণোদনা জোগায়। আদিবাসী মানুষেরও রয়েছে মাতৃভাষায় পড়াশোনা করে মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভ করার মানবিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার।
পরিশষে বলতে চাই ভাষাকে দমনের মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান যেমন একটি সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল, বাঙালিরাও আদিবাসী মানুষের ভাষার অধিকার নিয়ন্ত্রণ করে এক ধরনের সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস নিচ্ছে। তাই মহান একুশ এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য হচ্ছে জীবন দিয়ে হলেও মাতৃভাষার সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করা। পাহাড়ি আদিবাসীর ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য যেন আরেকটা একুশের জন্ম না হয়, সে দায়-দায়িত্ব রাষ্ট্রের। যে রাষ্ট্র রক্ত দিয়ে অন্যের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে মুক্ত হয়েছে, সে রাষ্ট্র কোনোভাবেই অন্যের ওপর সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালাতে পারে না। রাষ্ট্রের চরিত্র সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের এ রাজনৈতিক দর্শন যত দ্রুত ধারণ করবে, তত দ্রুত রাষ্ট্রের বসবাসরত বহু ভাষার, বহু সংস্কৃতির এবং বহু ধর্মের মানুষের সমমর্যাদার সহাবস্থান নিশ্চিত হবে। আদিবাসী ভাষার অবস্থানও অন্যান্য ভাষার মতো সমান গুরুত্ব ও মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হবে।
লেখক: গবেষক, অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
তথ্যসূত্র: http://www.manobkantha.com

No comments

Theme images by 5ugarless. Powered by Blogger.