বুদ্ধের চার সিদ্ধান্ত : প্রথম খন্ড

বুদ্ধের উপদেশাবলী বুঝতে হলে বুদ্ধের মূল চার সিদ্ধান্ত জানাটা খুবই জরুরী। সিদ্ধান্তগুলো হল :
১. ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার না করা।
২. আত্মাকে ‘নিত্য’ স্বীকার না করা।
৩. কোন গ্রন্থকে স্বতঃপ্রমাণ হিসেবে স্বীকার না করা।
৪. জীবন প্রবাহকে স্বীকার করা।
১. ঈশ্বরের অস্তিত্বে স্বীকার না করা :-
জগতের স্রষ্টা ও নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব বুদ্ধ অস্বীকার করেছিলেন। তাঁর মতে- ‘জগতের সৃষ্টি হয়েছে প্রাকৃতিক নিয়মে। জগৎ নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে প্রকৃতি জগতের স্বাভাবিক নিয়ম দ্বারা।’ কেউ কেউ মনে করেন, ঈশ্বর জগতের স্রষ্টা, যেমন কুম্ভকার মৃতপাত্রের স্রষ্টা। ঈশ্বর সর্বব্যাপী। ঈশ্বর স্রষ্টা হলে তিনি কুম্ভকারের মত মাটি ও মৃতপাত্র হতে পৃথক। ঈশ্বর যদি তাঁর সৃষ্টি থেকে পৃথক হন, তবে তিনি সর্বব্যাপ্ত হতে পারেন না।
ঈশ্বর যদি সর্বশক্তিমান হন, তাঁর ইচ্ছাতেই যদি মানুষের কাজ-কর্ম নির্ধারিত হয়, তবে অসট কাজের জন্য মানুষ কেন দায়ী হবে?
মনুষ্য জগতের বাইরের অন্যান্য প্রাণী, যাদের ভাল-মন্দ বিচার-বোধ নেই, তাদের কাজ-কর্মের জন্য ঈশ্বর কীভাবে তাদের দায়ী করবে?
পৃথিবীতে সুখের চেয়ে দুঃখের পরিমাণ বেশি। তবে কি ঈশ্বর যতটা দয়ালু, তারচেয়ে বেশি নিষ্ঠুর?
সমস্ত ঘটনার পিছনে কার্য-কারণ থাকে। বুদ্ধের এই সর্বব্যাপী কার্য-কারণ তত্ব ‘প্রতীত্যসমুৎপাদবাদ’ নামে পরিচিত। কার্য-কারণ সম্পর্ক ছাড়া মানসিক জগতের বা বাইরের জগতের কোন কিছু ঘটা সম্ভব নয়। আমাদের জীবনে যে দুঃখের ‘প্রতীত্য’ বা প্রাপ্তি ঘটে তার পেছনেও আছে ‘সমুৎপাদ’ বা উৎপত্তির কারণ। কারণ দুটি। ১. তৃষ্ণা ও ২. অবিদ্যা। ইন্দ্রিয়সুখের প্রতিটি তৃষ্ণাই মানুষ্কে লোভী, নিষ্ঠুর ও হত্যাকারী করে তোলে। দুঃখ যেমন আছে, দুঃখ নিবারণের উপায়ও তেমনি আছে। দুঃখ বিনাশের পথ হিসেবে বুদ্ধ অষ্টাঙ্গিক মার্গের উপদেশ দিয়েছেন।
মানুষের জীবনে দুঃখ অনিবার্য, বুদ্ধের এই মতবাদ দুঃখবাদ নামে পরিচিত। অবিদ্যাকে দুঃখবাদের একটি কারণ বলে বুদ্ধ উল্লেখ করেছেন, এ’কথা আমরা আগেই জেনেছি। অবিদ্যা বলতে তিনি বলেছেন সঠিক জ্ঞানের অভাব বা সম্যক জ্ঞানের অভাব, সত্য সম্বন্ধে অজ্ঞানতা, স্রেষ্ঠ-সত্য না জানা। আমাদের জানতে হবে, চার মহাভূত পৃথিবী, জল, বায়ু, অগ্নি থেকেই জগতের সবের সৃষ্টি, ধ্বংসে সবই এই চারে বিলীন হয়। ইন্দ্রিয় সম্পর্কিত বিজ্ঞানকে জানতে হবে। ছয় ইন্দ্রিয় হল- চক্ষু, শ্রবণ, ঘ্রাণ, জিহ্বা, ত্বক ও মন। বিজ্ঞান হল চেতনা বা মনেরই নাম। বুদ্ধের কথায়, ‘আমাদের যাবতীয় দুঃখের কারণ তৃষ্ণা ও অবিদ্যা। দুঃখ ঈশ্বরের রুষ্টতা থেকে আসে না। ঈশ্বর মানুষের মনোজগতের কল্পনা।’

No comments

Theme images by 5ugarless. Powered by Blogger.