মৃত শিশুকে লাইফ সাপোর্টে রেখে লাখ টাকা আদায়
ছোট্ট শিশু সুমাইয়া সাবা। বয়স এক বছর চার মাস। পরিবারের অভিযোগ ঠাণ্ডজনিত রোগে আক্রান্ত ছিলো শিশুটি। গত মঙ্গলবার রাতে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ঝিগাতলার জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ মেডিক্যালে। কর্তব্যরত চিকিৎসক দ্রুত শিশুটিকে আইসিইউতে ভর্তি করেন। কিন্তু ওই রাতেই শিশুটি মারা যায়। পরের দিন বুধবার বেলা ১১টায়ও পরিবারের সদস্যদের কাছে মৃত খবরটি দেয়া হয়নি। পরিবারের তরফ থেকে শিশুটির শারীরিক অবস্থা জানতে চাওয়া হলে, চিকিৎসকরা জানান শিশুটির অবস্থা আশঙ্কাজনক। এরপর শিশুটির স্বজনরা তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার কথা বললে আইসিইউ থেকে শিশুটিকে বের করতে গরিমসি করে কর্তৃপক্ষ। তারা জানান, শিশুটিকে দেয়া হবে না। এ নিয়ে স্বজনদের দৌড়ঝাপ আর হয়রানি চোখে পড়ে র্যাবের। র্যাবের সহায়তায় আইসিইউতে ঢুকে স্বজনরা শিশুটির নিথর দেহ দেখতে পান।
রাজধানীর বেশির ভাগ বেসরকারি হাসপাতালেই ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের (আইসিইউ) সেবার নামে এভাবেই চলছে রমরমা বাণিজ্য। গুরতর অসুস্থ রোগীকে হাসপাতালে নিলেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই কৌশলে নেয়া হচ্ছে আইসিইউতে। এরপর ঘণ্টা হিসেবে সেখান থেকে আদায় করা হচ্ছে মোটা অঙ্কের ফি। ঢাকা মেডিক্যালসহ সরকারি হাসপাতালগুলোতে আইসিইউর সঙ্কটকে কেন্দ্র করে এ ব্যবসা এখন তুঙ্গে। অনেক সময় রোগী মারা গেলেও লাইফ সাপোর্টে রাখার কথা বলে ওইসব হাসপাতালগুলো হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। আবার অনেক হাসপাতালেই নেই দক্ষ ডাক্তার, নার্স ও যন্ত্রপাতি। সব মিলিয়ে আইসিইউর নামে হাসপাতালগুলো পেতে রেখেছে প্রতারণার ফাঁদ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি ও কয়েকটি করপোরেট হাসপাতাল ছাড়া বেশির ভাগ হাসপাতালেই আইসিইউতে নেই প্রশিক্ষিত চিকিৎসক ও নার্স। নেই মানসম্পন্ন চিকিৎসা যন্ত্রপাতিও। এ কারণে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত নয়, সরকারি হাসপাতালের জন্য লাইন ধরে থাকেন বিত্তশালীরাও। তবে সেখানে আইসিইউর সিট পাওয়া সোনার হরিণ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারি কোনো নীতিমালা না থাকায় নিবিড় পারিচর্যার (ইনটেনসিভ কেয়ার) নামে একশ্রেণির প্রতারক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। একই সাথে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের নজরদারির অভাবে অসাধুরা একের পর এক তথাকথিত আইসিইউ-সিসিইউর নামে গড়ে তুলছে প্রতারণা কেন্দ্র। এসব আইসিইউ-সিসিইউতে দক্ষ জনবল, প্রয়োজনীয় অত্যাধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম, উপযুক্ত চিকিৎসক, প্রশিক্ষিত নার্স, টেকনিশিয়ান, পরীক্ষাগার কোনো কিছুই নেই।
র্যাব জানায়, মৃত রোগীকে ভর্তি রেখে পরিবারের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায়সহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ মেডিক্যাল সার্ভিসেস হাসপাতালকে সাড়ে ১১ লাখ টাকা জরিমানা করেছে র্যাব-২ এর ভ্রাম্যমাণ আদালত।
র্যাব-২ এর উপ-পরিচালক ড. দিদারুল আলম ও উপ-পরিচালক মেজর আতাউর রহমানের নেতৃত্বে র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করেন। এ সময় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ড. শাহজাহান, ড্রাগ অধিদপ্তরের ড্রাগ সুপার অজিউল্লাহ উপস্থিত ছিলেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, রাজধানীর উচ্চমান সম্পন্ন বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউ ও সিসিইউতে প্রতিদিনের খরচ ৬০ থেকে ৮০ হাজার টাকা। আর মাঝারি মানসম্পন্ন হাসপাতালের আইসিইউতে প্রতিদিন খরচ হয় ৪০ থেকে ৫৫ হাজার। তবে মান নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হাসপাতাল ও ক্লিনিকের আইসিইউতে চিকিৎসা খরচ ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। সরকারি হাসপাতালের আইসিইউ ও সিসিইউ’র স্বল্পতা থাকায় রোগীরা বাধ্য হয়েই দালাল চক্রের প্রলোভনে পড়ে নিম্নমানের আইসিইউতে যেতে বাধ্য হয়। রোগীদের আকৃষ্ট করতে এ সব প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের বিজ্ঞাপনসহ চালানো হয় নানা প্রচারণা। পাশাপাশি রয়েছে বিশাল এক দালাল চক্র। যারা কমিশনের বিনিময়ে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল থেকে ভাল সেবার আশা দিয়ে রোগীদের এসব জায়গায় নিয়ে যায়।
শিশু সুমাইয়ার মামা আহমেদ আওরাঙ্গজেব কবির নয়া দিগন্তকে বলেন, ঠাণ্ডজনিত রোগে আক্রান্ত হওয়ায় সুমাইয়াকে মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। তখন তারা বলছিলো যে শিশুটির নিউমোনিয়া হয়েছে। পরের দিন বুধবার বেলা ১১টার দিকে শিশুটির বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে চিকিৎসকরা তেমন কোনো উত্তর দিতে পারছিলেন না। আমরা তাদের কাছে শিশুটির সমস্যার কথা জানতে চাইলেও কোনো সদুত্তর দিতে পারছিলেন না। এ সময় আমরা সুমাইয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বারডেম হাসপাতালে নিতে চাইলে, তারা রোগী দিতে চায়নি। বলে, রোগী এখানেই থাকবে।
তিনি বলেন, এ সময় আল্লাহরই হুকুমে র্যাবের একটি দল ওই হাসপাতালে গেলে তারা বিষয়টি জানতে পান। আমরা র্যাবের দলের সাথে আইসিইউতে ঢুকলে র্যাবের বিশেষজ্ঞরা জানান, শিশুটি ওই রাতেই মারা গেছে।
তিনি অভিযোগ করেন, চিকিৎসকের অবহেলা আর মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতেই এই মরন ফাঁদ তৈরি করেছে কর্তৃপক্ষ।
আইসিইউ’র রমরমা বাণিজ্য
র্যাব-২ এর উপ-পরিচালক ড. দিদারুল আলম সাংবাদিকদের জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ওই হাসপাতালে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে র্যাব-২।
এ সময় দেখা যায়, গত মঙ্গলবার এক শিশু আইসিইউ রুমে মারা গেলেও শিশুটিকে জীবিত দেখিয়ে হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিৎসার নামে পরিবারের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিচ্ছে কর্তৃপক্ষ। এছাড়া অনভিজ্ঞ ডাক্তার দিয়ে শিশু রোগের চিকিৎসা করা, মেডিক্যাল বোর্ড গঠনের কোন ব্যবস্থা না থাকা, বায়োকেমিস্ট না থাকা, মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টের কোনো সার্টিফিকেট না থাকা, এইআইভি টেস্ট করার প্রয়োজনীয় মেশিন না থাকা, রি-এজেন্ট সংরক্ষণ করার জন্য ফ্রিজে নির্দিষ্ট তাপমাত্রা না থাকা, হাসপাতালের সিড়ি ঘর ল্যাব হিসেবে ব্যবহার করা, ল্যাব টেকনিশিয়ান না থাকাসহ বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ মেডিক্যাল সার্ভিসেসের ছয়জনকে আটক করা হয়।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হেলাল উদ্দিন বলেন, আটককৃতরা তাদের দোষ স্বীকার করায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯-এর ৫২, ৫৩, ৩৯ এবং ড্রাগ এ্যাক্ট ১৯৪০ অনুযায়ী জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশীপ মেডিক্যাল সার্ভিসেস হাসপাতালের সাথে সংশ্লিষ্ট ছয়জনকে সাড়ে ১১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। অনাদায়ে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড প্রদান করেছে আদালত। এর মধ্যে নজরুল ইসলাম, ডাঃ শরিফুজ্জামান, কাওসার ও লিজাকে দুই লাখ টাকা করে আট লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। জরিমানা অনাদায়ে প্রত্যেককে দুই মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়। এছাড়া, মনতেশ মন্ডলকে তিন লাখ টাকা জরিমানা করা হয়, অনাদায়ে দুই মাসের কারাদণ্ড এবং সুমন মন্ডলকে পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে এক মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়।
র্যাব জানান, আইসিইউতে একজন রোগীকে ওঠানো-নামানো, বিভিন্ন দিকে ঘোরানোসহ বিভিন্ন অবস্থানে রাখার জন্য বিশেষায়িত শয্যার দরকার। প্রত্যেক রোগীর জন্য পৃথক কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ভেন্টিলেটর এবং হৃদযন্ত্রের অবস্থা, শরীরে অক্সিজেন মাত্রা, কার্বন-ডাই অক্সাইড নির্গমণের মাত্রা, শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি, রক্তচাপ পরিমাপের জন্য দরকার হয় কার্ডিয়াক মনিটর। স্যালাইনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ মাত্রা নির্ধারণের জন্য দরকার ইনফিউশন পাম্প। আইসিইউতে হৃদযন্ত্রের গতি হঠাৎ থেমে গেলে তা চালু করার যন্ত্র প্রয়োজন হয় শক মেশিনও। পাশাপাশি আইসিইউতে কিডনি ডায়ালিসিস মেশিন, আল্ট্রাসনোগ্রাম, মুমূর্ষু রোগীর রক্তে বিভিন্ন উপাদানের মাত্রা নির্ধারণের জন্য এবিজি মেশিন থাকতে হবে। এছাড়া জরুরি পরীক্ষার জন্য আইসিইউর সাথে একটি অত্যাধুনিক ল্যাব থাকা প্রয়োজন। কিন্তু হাতেগোনা কয়েকটি হাসপাতালের আইসিইউ ছাড়া বেশিরভাগ হাসপাতালের আইসিইউতে নেই এ সব সুযোগ-সুবিধা।
তথ্যসূত্র: নয়া দিগন্ত, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬,বুধবার, ২০:১৯
No comments
Post a Comment