ডুমুরের ফুল! একটি বিজ্ঞাপন ও আমার ক্ষমা প্রার্থনা
তেপান্তর লারমা অপুঃ প্রথমে রোকেয়া লিটা আপাকে পাহাড়ের চাকমা আদিবাসী গোষ্টিদের ভাষায় জানায় জু-জু.বিশেষত যেহেতু আমি চাকমা জনগোষ্টির সন্তান,সেহেতু সালামটা চাকমা ভাষাতেই দিলাম আপাকে।
দ্বিতীয়ত আপার কাছ থেকে ক্ষমাপ্রার্থনা খুজছি এই ভেবে যে আপনার লেখায় “ডুমুরের ফুল” উপন্যাসের জন্য আমাদের চাকমা জনগোষ্টির(চাকমার একটু বেশিই প্রতিবাদি) ফেসবুক ব্যবহারকারি সহ পাহাড়ের মারমা,ত্রিপুরা সহ বেশ কয়েকটা আদিবাসী জনগোষ্টির কর্তৃক আপনাকে সামাজিক মিডিয়ায় ফেসবুকে ইনবক্সে,কমেন্ট বক্সে,আক্রমনাত্বষক ভাষা,হুমকি,ধর্ষনসহ নানা ধরনের খারাপ মন্তব্য প্রদান করার জন্য।
মানুষ জন্মের পরেই কালো,শ্যামলা, ফর্সার অধিকারী পায়। পিতা কিংবা মাতা ২জনের শারীরিক রঙ্গের ওপর নির্ভর করে থাকে শিশুটির গায়ের রঙ্গ।অবশ্যই অনেক সময় এর বিকল্প ও দেখা যায় বটে।অনেক সময় শিশুটি বড় হওয়ার সাথে সাথেই গায়ের রঙ্গের বা পরিবর্তন ঘটে।যা হোগ সেই রঙ্গ কালো,ফর্সা,শ্যামলা,কিংবা গায়ের চামড়ার রঙ্গের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
যাক প্রসঙ্গে আসি,ছোটবেলা থেকেই টিভির বিভিন্ন বিজ্ঞাপন চিত্রে এই চিত্রটা দেখে এসেছি,এখনো দেখছি।কালো হওয়াতে সেই মেয়েটার কোন ফ্রেন্ড নেই কিংবা চাকরি হচ্ছেনা কিংবা কোন ও কম্পিটিশনে ও টিকছেনা,হঠাৎ বান্ধবী কিংবা বন্ধুর মারফাতে কোন একটা ক্রিম মুখে মাখতেই ১ সপ্তাহে কিংবা ৪-৫ সপ্তাহের পর একদম ফর্সা মুখ হয়ে যায়,কপাটে জুটে সেই চাকরি,বান্ধবী জুটে কিংবা চাকরি জুটে যায় অথবা মিস চ্যাম্পিয়ন ও হয় কালো থেকে ফর্সা হওয়া সেই মেয়েটি।
হ্যা এইটা একট ক্রিম,কিংবা পাওডারের বিজ্ঞাপন।কিন্তু এই বিজ্ঞাপন যে কালো রঙ্গের মানুষের প্রতি বর্নবাদ করছে- নই কি? – তার মানে কালো হয়ে জন্মানোটাই অভাগা?কিংবা অপরাধ?তাই চাকরী জুটেনা,বান্ধবী থাকেনা,আর কোন কম্পিটিশনে জয় আসেনা?তার মানে কালো থেকে মুক্তি পেতেই হবে নই কি?
“ডুমুরের ফুল” যে শুধু একটা উপন্যাস কিংবা বই নই এটি আদিবাসী সমাজকে নিয়ে একটা বিজ্ঞাপন ও ,আপনার এই বই আদিবাসী সমাজের সংস্কৃতিকেও যে কতটুকু আঘাত করেছে,আঘাত করেছে জুম পাহাড়ে পিতার কষ্টে উপার্জিত অর্থ দিয়ে সমতলে পড়তে আসা আদিবাসী ছাত্রদের হৃদয়কে তা আপনি জানেন কি?যে সমাজ ধর্ষনের সাথে পরিচিত ও নেই সেই সমাজকে আপনার ভাষায় “ধর্ষন করলেই শুকর জরিমানা”.শুকর জরিমানা বিষয়টি সঠিক কিন্তু ধর্ষন বলতে কি বুঝিয়েছেন আপা?শুকর পরিমানা বিষয়টি করা হয় যখন কোন যুবক-যুবতী অসামাজিক ভাবে নিজেদের স্ব-ইচ্ছায় যৌনকাজে লিপ্ত হন এবং এমন অবস্থায় সমাজের চোখে ধরা পরে যায় তখনই।তখন সেই যুবক-যুবতীকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করিয়ে দিয়ে শুকর জরিমানা করা হয় এবং সেই শুকর দিয়েই তাদের বিবাহের মেলার আয়োজন করা হয়।তাহলে এটাই কি ধর্ষন? – শ্রদ্ধাভাজন আপা আপনাকে সমালোচনা করার মতন এই তরুন অনার্সের ছাত্রের আছে কিনা জানিনা কিন্তু এই টুকু জানি আপনার “ডুমুরের ফুল” উপন্যাসটি আমাদের সমাজকে ও”ধর্ষন” করেছে।হতাশাগ্রস্থ করেছে আমাদের মতন তরুন আদিবাসী ছাত্র ছাত্রীদদেরকে।আর আমাদের আদিবাসীদের মাঝে সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও করছে আপনার এই ডুমুরের ফুল।
“জ্যোতির কথায় অনেক ক্ষোভ আছে। তার কারনও আছে বটে। শুধু চাকরির কোটা নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রেও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে পাহাড়িরা। বেশিভাগ ক্ষেত্রেই চাকমা আর মারমারা কোটাগুলোতে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে। এমন অনেক সম্প্রদায় আছে যাদের কেউই কখনই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পর্যন্ত ভর্তির সুযোগ পায় নি। এদের মধ্যে খুমী, খিয়াং সম্প্রদায় অন্যতম। প্রত্যেকটি সম্প্রদায়ের ছেলে-মেয়েরাই যাতে কোটার আওতায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির সুযোগ পায় সে বিষয়টিও বেশ জরুরি হয়ে গেছে। তা না হলে পাহাড়ে এই ছোট জাত আর বড় জাত বিষয়ক বর্ণ বৈষম্যটা কখনই দূর হবে না। (ডুমুরের ফুল, সময় প্রকাশন)”
শ্রদ্ধাভাজন আপা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটাগুলোতে চাকমা আর মারমা নিজেদের মেধার বলেই ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে কিন্তু তা ক্ষমতার লড়াইয়ে নই,কিংবা বৈষম্যের শিকারের মাধ্যমে নই, তা হচ্ছে মেধার লড়াইয়ে।আপনার ভাষ্যনুযায়ী খুমি,খিয়াংরা সহ অনেক ছোটখাট সম্প্রদায় বৈষম্যের শিকার তাই তাদের সম্প্রদায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি সুযোগ পায়না।কিন্তু আপা উপন্যাস লিখার মতন জ্ঞান থাকা আপনার মতন লেখিকার ও এই বিষয়ে জ্ঞান থাকতে হবে যে,পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পাবলিক বাস না,যাত্রী পেলেই গাদা গাদা করে ওঠাবে,আর নামাবে।পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রাইভেদ কারের মতও না ক্ষমতা আর টাকা থাকলেই ভর্তি হতে পারবেন না।পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় মেধার লড়াইয়ের প্রতিষ্ঠান।যেখানে আপনার মেধায় আপনাকে বলে দিবে আপনি কি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য যোগ্য?সেইখানে তো বৈষম্যের প্রশ্নেই আসেনা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটা গুলোতে দেখলাম যে,ট্রাবেল কোটায় ২২টা সিটের জন্য চাকমা-নন চাকমা করে ১১ টা সিট করে ভাগ করে দেয়া হয়,আর আমার জানা মতে,ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্টির জন্য আলাদা ১-২ টা কোটা থাকে।যারা জাতিসত্বায় একদম কম (জানামতে ৩হাজারের কম)তারাই এই কোটাতে আওতাভুক্ত।নন -চাকমা কোটাতে বাকি বিভিন্ন গোষ্টির আদিবাসী ছাত্ররা নিজেদের মেধার বলেই সিট দখল করে থাকে সেইখানে বৈষম্যের কথা কিভাবে আনলেন বুঝতে পারলাম না আপা। – শ্রদ্ধাভাজন আপা,খুমি,খিয়াংদের সহ বেশ ছোট ছোট আদিবাসী গোষ্টির পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গুলোতে মেধায় টিকতে না পারাতে,আর চাকমা মারমাদের সম্প্রদায়ের মেধায় কোটাকে দখল করে রাখাকে বৈষম্য নিয়ে “ডুমুরের ফুল”এর খোজ পান তাহলে বিশ্বব্যাপি জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার পরও এইসব সম্প্রদায় যে আজ বিলুপ্তির মুখে,তার কারন ও সেই ডুমুরের ফুলের কেন খোজ পাননি আপা?
আপা আমরা আমাদের জাতিসত্বাকে যেইভাবে ভালোবাসি ঠিক তেমনি ভালোবাসি আমাদের সংস্কৃতিকেও।ভালোবাসি চিরসবুজ পাহাড় ঘেরা পার্বত্য চট্টগ্রামকে।আমরা জুম চাষ করে হলেও বাচতে চাই কিন্তু আমরা চাইনা কলম দিয়ে আমাদের সমাজকে ধর্ষন করে আমাদেরকে বাচিয়ে রাখতে।আমরা আমাদের মতই বাচতে চাই আপা।আমাদের সংস্কৃতিকে নিয়ে লিখার আগেই আমাদের একবার ও কি সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আপা?অসামাজিক অবস্থায় সমাজের চোখে পড়লে শুকর জরিমানা করাটা আমাদের সংস্কৃতির একটা অংশ ও কিন্তু সেই সংস্কৃতিকে যে আপনার সেই ধর্ষন শব্দটি আমাদের সমাজকে কাঠগড়ায় দাড় কড়াচ্ছে আপা? – আমাদের অপরাধ আমরা পাহাড়ি আমরা বাঙ্গালি না।আমাদের অপরাধ আমাদের জন্ম পাহাড়েই সমতলের বাঙ্গালীদের ঘরে না।তাই আজ আমদের সেই ক্রিম কিংবা পাওডারের বিজ্ঞাপনের মতই কালো থেকে মুক্তি পেতেই হবে,না হলে যে জীবনের মুক্তিই মিলবেনা।
পরিশেষে,ক্রিম ,পাওডারের বিজ্ঞাপন যেমনটা বিজ্ঞাপনের নির্দেশ করে,তেমনটা বর্নবাদের ও নির্দেশ করে।ঠিক তেমনটা ডুমুরের ফুল যেমনটা একটা উপন্যাসের বই তেমনটা পাহাড়ের আদিবাসীদের সমাজকে,সংস্কৃতিকে ধর্ষনের প্রতিক ও। – চেষ্টা করবো আপা আপনার বইয়ের কপি হাতে পাওয়ার পর সেই বইতে আমাদের সংস্কৃতিকে নিয়ে লেখার একটা যথাযথ উত্তর ও আমাদের মূল সংস্কৃতিকে নিয়ে আরো একটা উপন্যাসের জন্ম দিতে।যেখানে উল্লেখ করবো আমার সংস্কৃতির মূলদ্বারাকে,পাহাড়ের আদিবাসীদের জীবনধারাকে। আর তখনই দেখবেন আপনার লেখায় ডুমুরের ফুলের সেই সংস্কৃতিটা,জীবনধারাটা তে আমাদের বাস্তব জীবনের সাথে কতটুক যে,সাংঘর্ষিকতা ময়।
আমি লেখক নই তাই আমার কোন প্রকাশনার কোম্পানির সাথে পরিচিতি ও নেই।তাই আপনাকে একটা অনলাইনের পত্রিকাতে লেখার একটা লিংক শেয়ার করে দিবো।যেখানে আপনিই সব উত্তর পাবেন।
আবারো জুম পাহাড়ের আদিবাসী চাকমা সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যগত,সংস্কৃতিময় ভাষায় জু-জু(সালাম) জানাই আপা আপনাকে।
No comments
Post a Comment