কাউখালি কলমপতিতে পাহাড়ি বৌদ্ধ গণহত্যা
অসীম চাকমা
(তথ্যসূত্র: অসীম চাকমার ফেইজবুক হতে সংগৃহীত)
বাংলাদেশ
স্বাধীনতার পর সর্বপ্রথম রাঙ্গামাটির পার্বত্য জেলা কাউখালি উপজেলা সদরে
কলমপতি ইউনিয়নে সেনাবাহিনীর সহায়তায় সেটেলার বাঙ্গালিরা পাহাড়ি উপর
গণহত্যার চালায়। কলমপতি ইউনিয়নের সাধারণ নিরীহ পাহাড়িদের উপর এই হত্যাযজ্ঞ
চালানো হয়, যা ইতিহাসে “কলমপতি হত্যাকা-” নামে পরিচিত। ১৯৮০ সালের ২৫ মার্চ
দিন-দুপুরে মিটিং আহবান করে সেনাবাহিনী। এই মিটিংয়ে উপস্থিত পাহাড়ি
জনসাধারণকে লাইলে দাঁড় করায়ে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
এর পরে সেনাবহিনীর প্রত্যক্ষ সহায়তায় সেটেলাররা দা, লাঠি, বল্লম ইত্যাদি
নিয়ে পাহাড়িদের উপর চড়াও হয়। তারা কলমপতির পুরো ইউনিয়নের কাউখালি, মুখপাড়া,
পোয়াপাড়া, কাউখালি বাজার, তোংপাড়া এবং হেডম্যান পাড়া আক্রমণ চালায়। শিশু,
বৃদ্ধ, মহিলা, পুরুষ যাকে সামনে পেয়েছে তাকেই হত্যা করে। ১৯৭১ সালের ২৫
মার্চে পাকিস্তানি সেনাদের ন্যায় স্বাধীন বাংলাদেশের সেনারাও ঝাঁপিয়ে পড়ে
সাধারণ নিরীহ পাহাড়িদের ওপর। যা অ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশান্যালের দুটি
রিপোর্টে এবং এন্টি স্লেভারি সোসাইটির একটি রিপোর্টে ঘটনাটি প্রকাশ পায়।
ঘটনার পূর্ব কাউখালী :
কাউখালী এলাকার জনৈক ব্যক্তি এভাবে বর্ণনা করে বললেন, আমাদের বাড়িটি রাস্তার পাশে (অর্থাৎ কাউখালী হাসপাতালের উত্তরপাশে) বাড়ির পাশে একটি বড় বটগাছ ছিল। গরমের সময় আমরা গ্রামবাসী ঐ বটগাছের নীচে জড়ো হতো। রাস্তার দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় লোকজনও গাছের নীচে বসে খানিকটা বিশ্রাম করতো। বিশ্রামের পর আবার নিজ নিজ গন্তব্য দিকের রাস্তা দিয়ে চলে যেতো। একদিন দেখা গেল, শত শত সেটেলার বাঙালি সেনা-পুলিশের সহযোগিতায় আমাদের পাড়ার দিকে আসতে থাকে। পরে দেখা গেল, সেটেলার বাঙালিরা সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় আমাদের গ্রামবাসীর জায়গায়, বাগান-বাগিচা কেটে ফেলে তার উপর ঘর-বাড়ি নির্মাণ শুরু করে দেয়। গ্রামবাসী অসহায়ভাবে নিরব দর্শক হয়ে তাঁকিয়ে থাকে। যারা প্রতিবাদ করে তাদেরকে সেটেলার ও সেনাবাহিনীর শাসায়, ভয় দেখায়, মারদোর করে। কাউখালীতে সেটেলাররা আসার পর থেকে আমাদের কারোর জীবনে কোনো নিরাপত্তা ছিলো না। সেটেলার বাঙালিরা দিনে-রাতে, সময়ে-অসময়ে রাস্তা দিয়ে চলাচল করতো। বটগাছের নীচে এসে চিৎকার করতো। তাদের চিৎকারে অনেক সময় রাতে আমাদের ঘুম ভেঙে যেতো। তারা আমাদের গ্রামবাসীর ক্ষেত থেকে তরি-তরকারী, ফলের গাছ থেকে ফল-মূল জোর করে নিয়ে যেতো। অনেক সময় বাড়িতে লোকজন না থাকলে ঘরে ঢুকে বাড়ির জিনিসপত্র চুরি করে নিয়ে যেতো। একদিন আমাদের বাইজ্যা বাঁশের বাগান থেকে কয়েকজন সেটেলার বাঙালি জোরপূর্বক বাইজ্যা বাঁশ কেটে নিয়ে যায়। প্রশাসনের নিকট বিচার দিলেও কোন বিচার পাই না। (সংবাদমন্থন ডটকম, “পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের বিরুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংগঠিত হিংসা ফিরে দেখা: কাউখালী হত্যাকান্ড (১৯৮০), মিঠুন চাকমা, ২৪ মার্চ ২০১৪ইং)।
ঘটনার সূত্রপাত:
ঘটনার বিবরণে জানা যায় যে, কাউখালি কলমপতি ঘটনার ৩ দিন আগে ১৯৮০ সালে, ২২ মার্চ, তারিখে শান্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা সেনাবাহিনীর উপর সফল আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে এক অফিসারসহ ২২জন সেনাসদস্যকে হত্যা করে। অপরদিকে, গেরিলারা অক্ষত থেকে সফল আক্রমণ চালিয়ে নিরাপদে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এই হামলার প্রতিশোধ নিতে সেনাবাহিনীরা কলমপতির বিভিন্ন গ্রামে পাহাড়িদের হত্যা করার পরিকল্পনা করে। কিন্তু সহজ, সরল, নিরহী পাহাড়িরা সেনাবাহিনীর এই নীল নক্সা কখনও বুঝতে পারেনি।
ঘটনার ক্ষয়ক্ষতি পরিমাণ:
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় যে, ১৯৮০ সালের ২৫ মার্চ কাউখালি কলমপতি সেনা জোনের জোন কমান্ডার কাউখালী স্কুল মাঠে মিটিং আহবান করে। ধর্মীয় সভার নামে কলমপতি ইউনিয়নের পাহাড়ি মুরব্বীদের জড়ো করানো হয়। এছাড়াও সকাল বেলায় ঘোষণা দেয়া হয়, পোয়াপাড়া বৌদ্ধ মন্দিরের সংস্কার কাজে সেনাবাহিনীরা সহায়তা করবে এবং সাধারণ পাহাড়িদের এই সংস্কার কাজের জন্য যাতে ডাকা হয়। সাধারণ পাহাড়িরা এতে সাড়া দিয়ে মিটিংয়ের স্থানে ও বৌদ্ধ বিহারে উপস্থিত হয়। সেনাবাহিনী উপস্থিত সবাইকে আটক করে এবং তাদের এক লাইনে দাঁড়াতে বাধ্য করা হয়। লাইনে দাঁড়ানো মাত্রই সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাদের ওপর ব্রাস-ফায়ার করে। এতে সঙ্গে সঙ্গে মারা যায় বাজার চৌধুরী কুমুদ বিকাশ তালুকদার, স্থানীয় স্কুল কমিটির সাধারণ সম্পাদক শরহিদর চাকমা সহ প্রায় শত ব্যক্তি। গুরুতর আহত হয়, ইন্দু কুমার চাকমা, পিটিয়া চাকমাসহ প্রায় ১২ জন। এদের রাঙ্গামাটি জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তারপরে বৌদ্ধ বিহারের সমবেত নিরীহ পাহাড়িদের উপর সেনাবাহিনীরা সেটলারদের লেলিয়ে দেয়।
ভাগ্যের জোড়ে বেঁচে যায় গুরুদাস চাকমা। তিনি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, পোয়াপাড়া হাই স্কুলের পশ্চিম কোণায় একমাত্র সেনাছাউনি ছিল। এর পিছন দিকে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ জনেরও বেশি লাশকে গণকবরস্থ করতে দেখেছিলেন। শুধুমাত্র ৪টি লাশ ময়নাতদন্তের জন্য রাঙ্গামাটি নিয়ে যাওয়া হয়।
এরপর সেনাবাহিনীর মদদেই সেটেলার বাঙ্গালিরা দা, লাঠি, বল্লম ইত্যাদি েেদশীয় অস্ত্র নিয়ে পাহাড়িদের উপর চড়াও হয়। তারা কাউখালির মুখপাড়া, পোয়াপাড়া, কাউখালি বাজার, তোংপাড়া এবং হেডম্যান পাড়াসহ বিভিন্ন পাহাড়িদের গ্রামে আক্রমণ চালায়। বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেয়ার আগে মূল্যবান জিনিস-পত্র লুণ্ঠন করে। শিশু, বৃদ্ধ, মহিলা যাকে সামনে পেয়েছে তাকেই হত্যা করেছে। প্রাক্তন সংসদ সদস্য চাইথোয়াই রোয়াজার বাড়িতেও মূল্যবান জিনিস-পত্র লুন্ঠন করা হয়। এছাড়াও মুখপাড়া কিয়াং, তোংপাড়া আনন্দ মোহন বৌদ্ধ মন্দির, পোয়াপাড়া মন্দির ভেঙ্গে ফেলে দেয়। বৌদ্ধ মন্দিরের মূল্যবান আসবাবপত্রসহ, স্বর্ণ, রৌপ্য ও পিতলের বৌদ্ধমূর্তি গুলো লুন্ঠন করে। সেটেলাররা হাতিরপাড়া ও কাউখালির দুইটি বৌদ্ধ মন্দির পুড়িয়ে দেয় । সেটেলারদের হামলার মুখে পাহাড়িরা দৌঁড়ে পালিয়ে গভীর জঙ্গলে আশ্রয় নেয়।
সেনাসদস্যরা হত্যাকান্ড শেষে তাদের ক্যাম্পে ৩০ জনের বেশি পাহাড়ি নারীকে জোর জবরদস্তি করে ধরে নিয়ে যায়। সন্ধ্যা সময় শিশু ও বৃদ্ধাদের ছেড়ে দেয়া হলেও তরুণীদের আটকে রাখে তাদের নিজেদের মনোরঞ্জনের জন্য। তাদের অনেকের আজও হদিস পাওয়া যায়নি। শিশুরা ও বৃদ্ধরা যখন সেনাছাউনি থেকে বাড়ি ফিরছিলো তখন সেটেলারদের দ্বারা তারাও আক্রমণের শিকার হয়ে নিহত হয়।
এই আক্রমণে ৩০০জনের এর অধিক হত্যা করা এবং আহত হয় সহ¯্রাধিক। হাজার হাজার লোকজন বিভিন্ন এলাকায় এবং এমনকি ভারতে পালিয়ে গিয়ে প্রাণ রক্ষার করে। হাজার একরের অধিক জায়গা-জমি-বসতভিটে সেটলাররা বাঙ্গালিরা পাহাড়িদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়। এখনও পাহাড়িরা নিজ নিজ বসত ভিটার ফিরে যেতে পারেনি। সেটলাররা বাঙ্গালিরা তাদের জায়গা-জমি দখল করে বসতি গড়ে তুলেছে। একটি তথ্যে জানা যায়, পুরো হত্যাকান্ডে ৩০০ জন পাহাড়ি লোক নিহত হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী এক ব্যক্তি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ঘটনার দিন সেটেলার বাঙালিরা আমাদের পাড়ায় এসে প্রথমে আমাদের বাড়িটি জ্বালিয়ে দেয়। পরে সেনা জওয়ানদের সহায়তায় সেটেলার বাঙালিরা একে একে গ্রামের সমস্ত ঘর-বাড়ি লুটপাট করে ও জ্বালিয়ে দেয়। আমাদের পাড়ার বৌদ্ধ বিহারটিও জ্বালিয়ে দেয়। মন্দিরের অধ্যক্ষ ভন্তে তার সাথে থাকার কারণে তিনি সেটেলার বাঙালিদের হামলার হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন। মন্দিরের ভন্তের সাথে তিনিও সেটেলার বাঙালিদের মুখোমুখি হন এবং ভন্তে হাতের দা দিয়ে প্রতিরোধ করায় দু’জনেই প্রাণে রক্ষা পেয়েছিলেন। নিজের জীবন বাঁচাতে গৃহত্যাগী ভিক্ষুকেও সেদিন দা হাতে নিয়ে প্রতিরোধ করতে হয়েছে (সংবাদমন্থন ডটকম, “পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের বিরুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংগঠিত হিংসা ফিরে দেখা: কাউখালী হত্যাকান্ড (১৯৮০), মিঠুন চাকমা, ২৪ মার্চ ২০১৪ইং)।
ঘটনা পরিদর্শন:
সংসদীয় কমিটির বিপরীতে স্বাধীনভাবে হত্যাকান্ডটি তদন্তের জন্য জাসদের এমপি জনাব শাহজাহান সিরাজ, বাবু উপেন্দ্র লাল চাকমা এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের আহ্বায়ক জনাব রাশেদ খান মেননসহ তিন সদস্য বিশিষ্ট এক সত্য অনুসন্ধানকারী টিম গঠন করা হয়। ঘটনার প্রায় এক মাস পর ২২ এপ্রিল ১৯৮০সালে টিমটি ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। তাঁদের আগমনের বার্তা পেয়ে কয়েক হাজার ক্ষতিগ্রস্থ পাহাড়ি কয়েক কিলোমিটার পাহাড়ি পথ পায়ে হেঁটে চেলাছড়া নামক স্থানে জড়ো হয়। সংসদীয় টিমের তাদের সাথে সাক্ষাৎ করে, অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়র ও দুর্ভোগের কথা শোনেন। তাঁরা প্লেকার্ড ও পোস্টারের মাধ্যমে হামলকারী দায়ী ব্যক্তিদের বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, মহিলাদের প্রতি অপমান-অস্মান ও নির্যাতন বন্ধের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা, বৌদ্ধ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর রক্ষা করা, ধর্মীয় নিয়মানুযায়ী মৃতদের দাহ করা এবং সেটেলারদের সমতলে ফিরিয়ে নেয়ারসহ ইত্যাদি দাবী জানায়।
এক সাক্ষাৎকারে টিমটি বলেন, “১৯৮০ সালের ২৫ মার্চ পার্বত্য চট্টগ্রামের বেতবুনিয়া থানার অন্তর্গত কমলপতি ইউনিয়নের কাউখালী বাজারে সেনাবাহিনীর একটি ইউনিউ যে গণহত্যা ও হিংসাতœক কার্যকলাপ চালিয়েছে, ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে আমরা তার প্রমাণ পেয়েছি। সদ্য আসা বসতিস্থাপনকারীরাও উপজাতীয়দের ওপর হত্যা ও লুন্ঠন কার্যে যোগ দিয়েছিল। এমনকি ঘটনার একমাস পরেও সমগ্র এলাকা জুরে সন্ত্রাসের রাজত্ব চলেছে। স্থানীয় প্রশাসন ও উপজাতীয় নেতৃবৃন্দের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা সত্বেও উৎখাত হওয়া হতভাগ্য উপজাতীয়রা তাদের গ্রামের ধ্বংসস্তুপে ফিরে আসতে সাহস করছে না। কারণ বসতিস্থাপনকারীরা ধরপাকড়, হেনস্থা, নরহত্যা, অগ্নি সংযোগ ও লুটতরাজ চালিয়ে যাচ্ছে এবং হুমকি দিচ্ছে”। (পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন কর্তৃক ২০০১ সালে ‘জীবন আমাদের নয়’ পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি ও মানবাধিকার- এই শিরোনামে বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়ে প্রকাশিত চারটি আপডেটের অখন্ড সংকলন থেকে নেয়া, পৃষ্ঠা-২৮)।
টিমের রিপোর্ট ও সুপারিশ:
১৯৮০ সালের ১ এপ্রিল তৎকালীন জাসদের সংসদ সদস্য উপেন্দ্র লাল চাকমা জাসদের ঢাকাস্থ দলীয় কার্যালয়ে এক সাংবাদিক সম্মেলনে কলমপতি হত্যাকান্ডের কথা প্রথমে প্রকাশ করেন। এরপর পার্বত্য চট্টগ্রামের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিবেচনার জন্য ৫ সদস্যের একটি সংসদীয় কমিটি গঠন করা হয়, সেখানে এমপি উপেন্দ্র লাল চাকমাকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি।
‘টিমের তিনজন বিরোধী সংসদ সদস্যের মতে, সরকার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে পাহাড়িদের ভিটেমাটি থেকে তাড়িয়ে তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধীকারের সঠিক আন্দোলনকে নশ্চাৎ করার জন্য পার্বত্য এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছে। সরকারি পরিকল্পনার মধ্যে উগ্রপন্থায় পাহাড়িদের ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা, ঐতিহ্য বিকৃত ও ধ্বংস করার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে এগুচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজমান সমস্যা হচ্ছে রাজনৈতিক সমস্যা এবং রাজনৈতিকভাবেই তা সমাধান করা উচিত। এটি নিপীড়িত, নিযার্তিত ও অত্যাচারিত পাহাড়িদের অধিকার সংরক্ষণ ও তা নিশ্চিত করার সমস্যা। টিমটি সরকারের কাছে পাহাড়ি জাতিসমূহের স্বীকৃতি ও তাদের স্বায়ত্তশাসন প্রদানের আহ্বান জানায় এবং একটি সুপারিশনামা পেশ করেন। তা হল :
১) কলমপতি ইউনিয়নে ২৫ মার্চ ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত ও ঘাতকদের শাস্তি প্রদান;
২) ক্ষতিগ্রস্থদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তাসহ নিজ জায়গায় পুনর্বাসন;
৩) ক্ষতিগ্রস্থ বৌদ্ধ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর পুনঃর্নিমাণসহ ক্ষতিপূরণ প্রদান ও ধর্মীয় অনূভুতিতে আঘাতহানার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা;
৪) সেটেলার বাঙ্গালিদের আগমন বন্ধ করা;
৫) যে সব সেটেলার ইতোমধ্যে পাহাড়ে বসতি গড়েছে তাদের অবিলম্বে ফিরিয়ে নেয়া;
৬) হাট-বাজার গুলোতে মালামাল আনা-নেয়ার ব্যাপারে বাঁধা প্রদান প্রত্যাহার করা।
পরিশেষে বলা যায় যে, উক্ত সুপারিশগুলো সরকার আমলে নেয়নি। তৎকালীন জিয়া সরকার এই ঘটনার বিচার তো করেনিই বরং হত্যাকারীদের মদদ দিয়েছে এবং রাষ্ট্রের এই সহায়তা পরবর্তী নিরীহ পাহাড়িদের গণহত্যাগুলোর পথকে প্রশস্ত করেছে। আজও পাহাড়িরা তাদের হারানো ভিটে ফিরে পাননি, সেখানে এখনও বাস করছে সেটেলার বাঙ্গালিরা। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকে এভাবেই পাহাড়িদের উচ্ছেদ চলেই চলেছে। পাহাড়ে সংঘটিত গণহত্যাগুলো হতে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় পাহাড়ের গণহত্যাগুলোর কথা, সাধারণ পাহাড়িদের নির্যাতন ও দুর্ভোগের কথা ভুলে গিয়ে নিজেদের মধ্য নিজেরাই খুন-খারাপীতে মদমত্ত রয়েছি। আমাদের জানতে হবে, শিক্ষা হবে, বুঝতে হবে, সতর্ক হতে হবে। নইলে আমাদের অস্তিত্ব আমরা কেউ রক্ষা করতে পারবো না।
তথ্যসূত্র:
১) জীবন আমাদের নয়, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অূমি ও মানবাধিকার, পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন, ২০০১ ইং, পৃ- ২৭, ২৮)।
২) সিএইচটিবিডি ডটওআরজি, “মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী গণহত্যাঃ প্রসঙ্গ পাহাড়” অজল দেওয়ান, ১৪ আগস্ট, ২০১৪ইং।
৩) ইষ্টিশন ডটকম, “কলমপতি (কাইখালি) হত্যাকা-ঃ রাষ্ট্রীয় মদদে পাহাড়ে প্রথম গণ হত্যা” অজল দেওয়ান, ১৬ আগস্ট, ২০১৪ইং।
৪) সিএউটি নিউজ ডটকম, “পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসের এদিন--”২৫ মার্চ, বুধবার, ২০১৫ইং।
৫) সংবাদমন্থন ডটকম, “পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের বিরুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংগঠিত হিংসা ফিরে দেখা : কাউখালী হত্যাকা- (১৯৮০), মিঠুন চাকমা, ২৪ মার্চ ২০১৪ইং।
৬) জুম্ম সংবাদ বুলেটিন, বুলেটিন ১৫, ৩য় বর্ষ, শুক্রবার, ৩১শে ডিসেম্বর,১৯৯৩ ইং।
৭) সিএউটিবিডি ডটকমনেট, “পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত গণহত্যা” ০৯ নভেম্বর, ২০১১ইং
ছবিটি প্রতিকী স্বরুপ ব্যবহার করা হয়েছে |
ঘটনার পূর্ব কাউখালী :
কাউখালী এলাকার জনৈক ব্যক্তি এভাবে বর্ণনা করে বললেন, আমাদের বাড়িটি রাস্তার পাশে (অর্থাৎ কাউখালী হাসপাতালের উত্তরপাশে) বাড়ির পাশে একটি বড় বটগাছ ছিল। গরমের সময় আমরা গ্রামবাসী ঐ বটগাছের নীচে জড়ো হতো। রাস্তার দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় লোকজনও গাছের নীচে বসে খানিকটা বিশ্রাম করতো। বিশ্রামের পর আবার নিজ নিজ গন্তব্য দিকের রাস্তা দিয়ে চলে যেতো। একদিন দেখা গেল, শত শত সেটেলার বাঙালি সেনা-পুলিশের সহযোগিতায় আমাদের পাড়ার দিকে আসতে থাকে। পরে দেখা গেল, সেটেলার বাঙালিরা সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় আমাদের গ্রামবাসীর জায়গায়, বাগান-বাগিচা কেটে ফেলে তার উপর ঘর-বাড়ি নির্মাণ শুরু করে দেয়। গ্রামবাসী অসহায়ভাবে নিরব দর্শক হয়ে তাঁকিয়ে থাকে। যারা প্রতিবাদ করে তাদেরকে সেটেলার ও সেনাবাহিনীর শাসায়, ভয় দেখায়, মারদোর করে। কাউখালীতে সেটেলাররা আসার পর থেকে আমাদের কারোর জীবনে কোনো নিরাপত্তা ছিলো না। সেটেলার বাঙালিরা দিনে-রাতে, সময়ে-অসময়ে রাস্তা দিয়ে চলাচল করতো। বটগাছের নীচে এসে চিৎকার করতো। তাদের চিৎকারে অনেক সময় রাতে আমাদের ঘুম ভেঙে যেতো। তারা আমাদের গ্রামবাসীর ক্ষেত থেকে তরি-তরকারী, ফলের গাছ থেকে ফল-মূল জোর করে নিয়ে যেতো। অনেক সময় বাড়িতে লোকজন না থাকলে ঘরে ঢুকে বাড়ির জিনিসপত্র চুরি করে নিয়ে যেতো। একদিন আমাদের বাইজ্যা বাঁশের বাগান থেকে কয়েকজন সেটেলার বাঙালি জোরপূর্বক বাইজ্যা বাঁশ কেটে নিয়ে যায়। প্রশাসনের নিকট বিচার দিলেও কোন বিচার পাই না। (সংবাদমন্থন ডটকম, “পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের বিরুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংগঠিত হিংসা ফিরে দেখা: কাউখালী হত্যাকান্ড (১৯৮০), মিঠুন চাকমা, ২৪ মার্চ ২০১৪ইং)।
ঘটনার সূত্রপাত:
ঘটনার বিবরণে জানা যায় যে, কাউখালি কলমপতি ঘটনার ৩ দিন আগে ১৯৮০ সালে, ২২ মার্চ, তারিখে শান্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা সেনাবাহিনীর উপর সফল আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে এক অফিসারসহ ২২জন সেনাসদস্যকে হত্যা করে। অপরদিকে, গেরিলারা অক্ষত থেকে সফল আক্রমণ চালিয়ে নিরাপদে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এই হামলার প্রতিশোধ নিতে সেনাবাহিনীরা কলমপতির বিভিন্ন গ্রামে পাহাড়িদের হত্যা করার পরিকল্পনা করে। কিন্তু সহজ, সরল, নিরহী পাহাড়িরা সেনাবাহিনীর এই নীল নক্সা কখনও বুঝতে পারেনি।
ঘটনার ক্ষয়ক্ষতি পরিমাণ:
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় যে, ১৯৮০ সালের ২৫ মার্চ কাউখালি কলমপতি সেনা জোনের জোন কমান্ডার কাউখালী স্কুল মাঠে মিটিং আহবান করে। ধর্মীয় সভার নামে কলমপতি ইউনিয়নের পাহাড়ি মুরব্বীদের জড়ো করানো হয়। এছাড়াও সকাল বেলায় ঘোষণা দেয়া হয়, পোয়াপাড়া বৌদ্ধ মন্দিরের সংস্কার কাজে সেনাবাহিনীরা সহায়তা করবে এবং সাধারণ পাহাড়িদের এই সংস্কার কাজের জন্য যাতে ডাকা হয়। সাধারণ পাহাড়িরা এতে সাড়া দিয়ে মিটিংয়ের স্থানে ও বৌদ্ধ বিহারে উপস্থিত হয়। সেনাবাহিনী উপস্থিত সবাইকে আটক করে এবং তাদের এক লাইনে দাঁড়াতে বাধ্য করা হয়। লাইনে দাঁড়ানো মাত্রই সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাদের ওপর ব্রাস-ফায়ার করে। এতে সঙ্গে সঙ্গে মারা যায় বাজার চৌধুরী কুমুদ বিকাশ তালুকদার, স্থানীয় স্কুল কমিটির সাধারণ সম্পাদক শরহিদর চাকমা সহ প্রায় শত ব্যক্তি। গুরুতর আহত হয়, ইন্দু কুমার চাকমা, পিটিয়া চাকমাসহ প্রায় ১২ জন। এদের রাঙ্গামাটি জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তারপরে বৌদ্ধ বিহারের সমবেত নিরীহ পাহাড়িদের উপর সেনাবাহিনীরা সেটলারদের লেলিয়ে দেয়।
ভাগ্যের জোড়ে বেঁচে যায় গুরুদাস চাকমা। তিনি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, পোয়াপাড়া হাই স্কুলের পশ্চিম কোণায় একমাত্র সেনাছাউনি ছিল। এর পিছন দিকে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ জনেরও বেশি লাশকে গণকবরস্থ করতে দেখেছিলেন। শুধুমাত্র ৪টি লাশ ময়নাতদন্তের জন্য রাঙ্গামাটি নিয়ে যাওয়া হয়।
এরপর সেনাবাহিনীর মদদেই সেটেলার বাঙ্গালিরা দা, লাঠি, বল্লম ইত্যাদি েেদশীয় অস্ত্র নিয়ে পাহাড়িদের উপর চড়াও হয়। তারা কাউখালির মুখপাড়া, পোয়াপাড়া, কাউখালি বাজার, তোংপাড়া এবং হেডম্যান পাড়াসহ বিভিন্ন পাহাড়িদের গ্রামে আক্রমণ চালায়। বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেয়ার আগে মূল্যবান জিনিস-পত্র লুণ্ঠন করে। শিশু, বৃদ্ধ, মহিলা যাকে সামনে পেয়েছে তাকেই হত্যা করেছে। প্রাক্তন সংসদ সদস্য চাইথোয়াই রোয়াজার বাড়িতেও মূল্যবান জিনিস-পত্র লুন্ঠন করা হয়। এছাড়াও মুখপাড়া কিয়াং, তোংপাড়া আনন্দ মোহন বৌদ্ধ মন্দির, পোয়াপাড়া মন্দির ভেঙ্গে ফেলে দেয়। বৌদ্ধ মন্দিরের মূল্যবান আসবাবপত্রসহ, স্বর্ণ, রৌপ্য ও পিতলের বৌদ্ধমূর্তি গুলো লুন্ঠন করে। সেটেলাররা হাতিরপাড়া ও কাউখালির দুইটি বৌদ্ধ মন্দির পুড়িয়ে দেয় । সেটেলারদের হামলার মুখে পাহাড়িরা দৌঁড়ে পালিয়ে গভীর জঙ্গলে আশ্রয় নেয়।
সেনাসদস্যরা হত্যাকান্ড শেষে তাদের ক্যাম্পে ৩০ জনের বেশি পাহাড়ি নারীকে জোর জবরদস্তি করে ধরে নিয়ে যায়। সন্ধ্যা সময় শিশু ও বৃদ্ধাদের ছেড়ে দেয়া হলেও তরুণীদের আটকে রাখে তাদের নিজেদের মনোরঞ্জনের জন্য। তাদের অনেকের আজও হদিস পাওয়া যায়নি। শিশুরা ও বৃদ্ধরা যখন সেনাছাউনি থেকে বাড়ি ফিরছিলো তখন সেটেলারদের দ্বারা তারাও আক্রমণের শিকার হয়ে নিহত হয়।
এই আক্রমণে ৩০০জনের এর অধিক হত্যা করা এবং আহত হয় সহ¯্রাধিক। হাজার হাজার লোকজন বিভিন্ন এলাকায় এবং এমনকি ভারতে পালিয়ে গিয়ে প্রাণ রক্ষার করে। হাজার একরের অধিক জায়গা-জমি-বসতভিটে সেটলাররা বাঙ্গালিরা পাহাড়িদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়। এখনও পাহাড়িরা নিজ নিজ বসত ভিটার ফিরে যেতে পারেনি। সেটলাররা বাঙ্গালিরা তাদের জায়গা-জমি দখল করে বসতি গড়ে তুলেছে। একটি তথ্যে জানা যায়, পুরো হত্যাকান্ডে ৩০০ জন পাহাড়ি লোক নিহত হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী এক ব্যক্তি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ঘটনার দিন সেটেলার বাঙালিরা আমাদের পাড়ায় এসে প্রথমে আমাদের বাড়িটি জ্বালিয়ে দেয়। পরে সেনা জওয়ানদের সহায়তায় সেটেলার বাঙালিরা একে একে গ্রামের সমস্ত ঘর-বাড়ি লুটপাট করে ও জ্বালিয়ে দেয়। আমাদের পাড়ার বৌদ্ধ বিহারটিও জ্বালিয়ে দেয়। মন্দিরের অধ্যক্ষ ভন্তে তার সাথে থাকার কারণে তিনি সেটেলার বাঙালিদের হামলার হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন। মন্দিরের ভন্তের সাথে তিনিও সেটেলার বাঙালিদের মুখোমুখি হন এবং ভন্তে হাতের দা দিয়ে প্রতিরোধ করায় দু’জনেই প্রাণে রক্ষা পেয়েছিলেন। নিজের জীবন বাঁচাতে গৃহত্যাগী ভিক্ষুকেও সেদিন দা হাতে নিয়ে প্রতিরোধ করতে হয়েছে (সংবাদমন্থন ডটকম, “পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের বিরুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংগঠিত হিংসা ফিরে দেখা: কাউখালী হত্যাকান্ড (১৯৮০), মিঠুন চাকমা, ২৪ মার্চ ২০১৪ইং)।
ঘটনা পরিদর্শন:
সংসদীয় কমিটির বিপরীতে স্বাধীনভাবে হত্যাকান্ডটি তদন্তের জন্য জাসদের এমপি জনাব শাহজাহান সিরাজ, বাবু উপেন্দ্র লাল চাকমা এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের আহ্বায়ক জনাব রাশেদ খান মেননসহ তিন সদস্য বিশিষ্ট এক সত্য অনুসন্ধানকারী টিম গঠন করা হয়। ঘটনার প্রায় এক মাস পর ২২ এপ্রিল ১৯৮০সালে টিমটি ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। তাঁদের আগমনের বার্তা পেয়ে কয়েক হাজার ক্ষতিগ্রস্থ পাহাড়ি কয়েক কিলোমিটার পাহাড়ি পথ পায়ে হেঁটে চেলাছড়া নামক স্থানে জড়ো হয়। সংসদীয় টিমের তাদের সাথে সাক্ষাৎ করে, অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়র ও দুর্ভোগের কথা শোনেন। তাঁরা প্লেকার্ড ও পোস্টারের মাধ্যমে হামলকারী দায়ী ব্যক্তিদের বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, মহিলাদের প্রতি অপমান-অস্মান ও নির্যাতন বন্ধের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা, বৌদ্ধ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর রক্ষা করা, ধর্মীয় নিয়মানুযায়ী মৃতদের দাহ করা এবং সেটেলারদের সমতলে ফিরিয়ে নেয়ারসহ ইত্যাদি দাবী জানায়।
এক সাক্ষাৎকারে টিমটি বলেন, “১৯৮০ সালের ২৫ মার্চ পার্বত্য চট্টগ্রামের বেতবুনিয়া থানার অন্তর্গত কমলপতি ইউনিয়নের কাউখালী বাজারে সেনাবাহিনীর একটি ইউনিউ যে গণহত্যা ও হিংসাতœক কার্যকলাপ চালিয়েছে, ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে আমরা তার প্রমাণ পেয়েছি। সদ্য আসা বসতিস্থাপনকারীরাও উপজাতীয়দের ওপর হত্যা ও লুন্ঠন কার্যে যোগ দিয়েছিল। এমনকি ঘটনার একমাস পরেও সমগ্র এলাকা জুরে সন্ত্রাসের রাজত্ব চলেছে। স্থানীয় প্রশাসন ও উপজাতীয় নেতৃবৃন্দের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা সত্বেও উৎখাত হওয়া হতভাগ্য উপজাতীয়রা তাদের গ্রামের ধ্বংসস্তুপে ফিরে আসতে সাহস করছে না। কারণ বসতিস্থাপনকারীরা ধরপাকড়, হেনস্থা, নরহত্যা, অগ্নি সংযোগ ও লুটতরাজ চালিয়ে যাচ্ছে এবং হুমকি দিচ্ছে”। (পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন কর্তৃক ২০০১ সালে ‘জীবন আমাদের নয়’ পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি ও মানবাধিকার- এই শিরোনামে বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়ে প্রকাশিত চারটি আপডেটের অখন্ড সংকলন থেকে নেয়া, পৃষ্ঠা-২৮)।
টিমের রিপোর্ট ও সুপারিশ:
১৯৮০ সালের ১ এপ্রিল তৎকালীন জাসদের সংসদ সদস্য উপেন্দ্র লাল চাকমা জাসদের ঢাকাস্থ দলীয় কার্যালয়ে এক সাংবাদিক সম্মেলনে কলমপতি হত্যাকান্ডের কথা প্রথমে প্রকাশ করেন। এরপর পার্বত্য চট্টগ্রামের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিবেচনার জন্য ৫ সদস্যের একটি সংসদীয় কমিটি গঠন করা হয়, সেখানে এমপি উপেন্দ্র লাল চাকমাকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি।
‘টিমের তিনজন বিরোধী সংসদ সদস্যের মতে, সরকার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে পাহাড়িদের ভিটেমাটি থেকে তাড়িয়ে তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধীকারের সঠিক আন্দোলনকে নশ্চাৎ করার জন্য পার্বত্য এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছে। সরকারি পরিকল্পনার মধ্যে উগ্রপন্থায় পাহাড়িদের ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা, ঐতিহ্য বিকৃত ও ধ্বংস করার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে এগুচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজমান সমস্যা হচ্ছে রাজনৈতিক সমস্যা এবং রাজনৈতিকভাবেই তা সমাধান করা উচিত। এটি নিপীড়িত, নিযার্তিত ও অত্যাচারিত পাহাড়িদের অধিকার সংরক্ষণ ও তা নিশ্চিত করার সমস্যা। টিমটি সরকারের কাছে পাহাড়ি জাতিসমূহের স্বীকৃতি ও তাদের স্বায়ত্তশাসন প্রদানের আহ্বান জানায় এবং একটি সুপারিশনামা পেশ করেন। তা হল :
১) কলমপতি ইউনিয়নে ২৫ মার্চ ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত ও ঘাতকদের শাস্তি প্রদান;
২) ক্ষতিগ্রস্থদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তাসহ নিজ জায়গায় পুনর্বাসন;
৩) ক্ষতিগ্রস্থ বৌদ্ধ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর পুনঃর্নিমাণসহ ক্ষতিপূরণ প্রদান ও ধর্মীয় অনূভুতিতে আঘাতহানার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা;
৪) সেটেলার বাঙ্গালিদের আগমন বন্ধ করা;
৫) যে সব সেটেলার ইতোমধ্যে পাহাড়ে বসতি গড়েছে তাদের অবিলম্বে ফিরিয়ে নেয়া;
৬) হাট-বাজার গুলোতে মালামাল আনা-নেয়ার ব্যাপারে বাঁধা প্রদান প্রত্যাহার করা।
পরিশেষে বলা যায় যে, উক্ত সুপারিশগুলো সরকার আমলে নেয়নি। তৎকালীন জিয়া সরকার এই ঘটনার বিচার তো করেনিই বরং হত্যাকারীদের মদদ দিয়েছে এবং রাষ্ট্রের এই সহায়তা পরবর্তী নিরীহ পাহাড়িদের গণহত্যাগুলোর পথকে প্রশস্ত করেছে। আজও পাহাড়িরা তাদের হারানো ভিটে ফিরে পাননি, সেখানে এখনও বাস করছে সেটেলার বাঙ্গালিরা। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকে এভাবেই পাহাড়িদের উচ্ছেদ চলেই চলেছে। পাহাড়ে সংঘটিত গণহত্যাগুলো হতে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় পাহাড়ের গণহত্যাগুলোর কথা, সাধারণ পাহাড়িদের নির্যাতন ও দুর্ভোগের কথা ভুলে গিয়ে নিজেদের মধ্য নিজেরাই খুন-খারাপীতে মদমত্ত রয়েছি। আমাদের জানতে হবে, শিক্ষা হবে, বুঝতে হবে, সতর্ক হতে হবে। নইলে আমাদের অস্তিত্ব আমরা কেউ রক্ষা করতে পারবো না।
তথ্যসূত্র:
১) জীবন আমাদের নয়, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অূমি ও মানবাধিকার, পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন, ২০০১ ইং, পৃ- ২৭, ২৮)।
২) সিএইচটিবিডি ডটওআরজি, “মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী গণহত্যাঃ প্রসঙ্গ পাহাড়” অজল দেওয়ান, ১৪ আগস্ট, ২০১৪ইং।
৩) ইষ্টিশন ডটকম, “কলমপতি (কাইখালি) হত্যাকা-ঃ রাষ্ট্রীয় মদদে পাহাড়ে প্রথম গণ হত্যা” অজল দেওয়ান, ১৬ আগস্ট, ২০১৪ইং।
৪) সিএউটি নিউজ ডটকম, “পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসের এদিন--”২৫ মার্চ, বুধবার, ২০১৫ইং।
৫) সংবাদমন্থন ডটকম, “পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের বিরুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংগঠিত হিংসা ফিরে দেখা : কাউখালী হত্যাকা- (১৯৮০), মিঠুন চাকমা, ২৪ মার্চ ২০১৪ইং।
৬) জুম্ম সংবাদ বুলেটিন, বুলেটিন ১৫, ৩য় বর্ষ, শুক্রবার, ৩১শে ডিসেম্বর,১৯৯৩ ইং।
৭) সিএউটিবিডি ডটকমনেট, “পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত গণহত্যা” ০৯ নভেম্বর, ২০১১ইং
No comments
Post a Comment