কথা ছিল পাহাড়ির ঘরে ঘরে বিদ্যুতের বাতি জ্বলবে,কিন্তু বাস্তবে অন্ধকারে রয়ে গেলো
আমেরিকান অর্থায়নে বিশ্বের বৃহত্তম জ্বলবিদ্যুৎ কেন্দ্র কাপ্তাই লেক
স্থাপন করা হয় ১৯৫৬-১৯৬২ ইংরেজী সনে। কথা ছিল পাহাড়ির ঘরে ঘরে বিদ্যুতের
বাতি জ্বলবে। আজ ৫৫ বছর পরেও বিদ্যুতের
আলো পৌঁছায় নি ৬০% ঘরে। পাহাড়ের চাহিদা না মিটিয়ে চলে আসে শহরের দিকে। এই
কাপ্তাই বাঁধে লুকিয়ে আছে লক্ষাধিক পাহাড়ির নিরব কান্না। যার সূত্র ধরে
শুরু হয়েছিল পাহাড়ি উচ্ছেদের সূচনা। পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি থেকে
উচ্ছেদের প্রথম বড় ধরনের মারাত্মক ঘটনা ষাটের দশকে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের
ফলে। প্রায় ৫৪ হাজার একর প্রথম শ্রেণীর ধানী জমি,যা মোট চাষযোগ্য জমির ৪০%
পানির নীচে চিরদিনের মত হারিয়ে গেল। লক্ষাধিক মানুষ উদ্বাস্তু হলো।
উদ্বাস্তুদের পূনর্বাসনের জন্য কাচালং সংরক্ষিত বনাঞ্চলের একটি অংশ
উন্মুক্ত করার পরও যোগাড় করা গেল মাত্র ২০ হাজার একর জমি, তাও নিম্ন মানের।
এই পরিমাণ জমির সাহায্যে পানির নীচে তলিয়ে যাওয়া জমির মাত্র এক-তৃতীয়াংশ
প্রতিস্থাপন করা গেছে। প্রতি পরিবারের জন্য বরাদ্দ হলো ৩ একর জমি যা তাদের
পুর্বের জমির পরিমাণের তুলনায় অর্ধেক । ক্ষতি পূরণের জন্য নির্ধারিত ছিল ৫১
মিলিয়ন ডলার কিন্তু প্রদত্ত ক্ষতিপূরণের পরিমান ছিল ২.৬ মিলিয়ন ডলার।
জনশ্রুতি আছে, প্রায় এক তৃতীয়াংশ উদ্বাস্তু ক্ষতিপূরণ পাওয়া থেকে বঞ্চিত
থেকেছে। ওদের সম্বন্ধে বরঞ্চ বলা হলো যে পাহাড়ীরা জঙ্গলের লতা পাতা খেয়ে
বেঁচে থাকবে। এদের ক্ষতিপূরণের দরকার নেই। ক্ষতিপূরণ নিয়ে যে দূর্নীতি
হয়েছে তা প্রদত্ত তথ্য থেকেই পরিষ্কার।
কাচালং সংরক্ষিত বনাঞ্চলের যে অংশ উন্মুক্ত
করে উদ্বাস্তুদের পূনর্বাসন দেয়া হলো তার প্রায় তিন- চতুর্থাংশ প্রতি বছর বর্ষাকালে জলমগ্ন হয়। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে মুক্তিযুদ্ধে পাহাড়িদের অসহযোগিতার অজুহাতে মুক্তিবাহিনীর একটি অংশ কর্তৃক পাহাড়ি হত্যার ঘটনায় সৃষ্ট অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সুযোগে খাগড়াছড়ি জেলার অন্তগর্ত রামগড় থানার ভারত সীমান্ত সংলগ্ন ফেনী উপত্যকায় কয়েক হাজার বাঙ্গালী রাষ্ট্র শক্তির পরোক্ষ সমর্থনে একযোগে বসতি স্থাপন করে।
নিরাপত্তার সংকটে দিশেহারা আদিবাসীদের
তাদের চোখের সামনে ভূমির বেদখল প্রক্রিয়া চেয়ে চেয়ে দেখে থাকা ছাড়া আর কোন গত্যন্তর ছিল না। এই জবরদস্তি ভূমি দখল ঘটনার এক দশক অতিক্রান্ত না হতেই এর চাইতেও ব্যাপকতর জবরদখলের নাটক মঞ্চায়িত হয়ে গেল পার্বত্য চট্টগ্রামে।
১৯৭৯ সনে গোপন এক সার্কুলারের মাধ্যমে বাংলাদেশের সমতল জেলাসমূহের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভূমিহীন, নদী ভাঙ্গনের শিকার প্রায় ৫ লক্ষ দরিদ্র বাঙ্গালীদের সরকারী উদ্যোগে জমির পাট্টা দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে এনে র্পূনবাসিত করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে চাষযোগ্য জমির অভাবে যেখানে কাপ্তাই বাঁধে ক্ষতিগ্রস্ত বাস্তুহারা উদ্বাস্তুদের পূনর্বাসিত করা যায়নি সেখানে এই অতিরিক্ত ৫ লক্ষ দরিদ্র ভূমিহীন বাঙ্গালী কৃষক কোথায় কী ভাবে পুর্নবাসিত হবে?
বাস্তবে যা হলো তা হচ্ছে হাজার হাজার আদিবাসীদের রের্কডকৃত কিংবা দখলে থাকা জমিতে এই সব দরিদ্র বাঙ্গালী কৃষকদের বসিয়ে দেয়া হল। কিন্তু এ ধরনের অস্বাভাবিক ঘটনা কী ভাবে ঘটে গেল? সরকার কি এমন কোন উদ্যোগ নিতে পারে যা বড় ধরনের মানবিক বির্পযয়ের কারণ হতে পারে?
দেশে কি এমন কোন আইন থাকতে পারে যার উপর ভর করে ব্যাপক হারে মানবাধিকার লংঘিত হতে পারে? দেশের ভূমি আইনে(সমতল অঞ্চল ও পার্বত্য চট্টগ্রাম) কি এমন কোন বিধান আছে যাতে একটি জনগোষ্ঠীকে উৎখাত করে অন্য একটি জনগোষ্ঠীক প্রতিস্থাপিত করা যেতে পারে?
আমরা দেশের প্রচলিত ভূমি আইনের দিকে দৃষ্টি দিতে পারি। বাংলাদেশের অপরাপর অঞ্চল ও পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি আইন অভিন্ন নয়। বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থাপনার ভিত্তি হিসেবে পূর্ববঙ্গ জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাসত্ত্ব আইন ১৯৫০, সার্ভে আইন ১৮৭৫, সার্ভে ও সেটেলম্যান্ট ম্যানুয়েল ১৯৩৫, প্রজাসত্ত্ব বিধিমালা ১৯৫৪ ও ভূমি ব্যবস্থাপনা ম্যানুয়েল ১৯৯০ ব্যবহৃত হয়ে আসছে যার কোনটিই পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি আইনের মূল ভিত্তি হলো The Chittagong Hill Tracts Regulations-১৯০০ যা সাধারণভাবে Hill Tracts Manual হিসেবে সমধিক পরিচিত। এটি শুধু ভূমি রাজস্ব নয়, সাধারণ প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থাপনারও ভিত্তি। এর ৩৪ বিধিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীসমুহের ভূমি ও ভূমি অধিকার সুরক্ষার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু ১৯৭১ সনের স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই পার্বত্য চট্টগামে অ- আদিবাসীদের জন্য ভূমি ও ভূমি অধিকার উন্মুক্ত করে দেয়ার জন্য ৩৪ বিধিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়।
মাত্র আট বছরের ব্যবধানে ১৯৭৯ সালে সরকারী উদ্যোগে পরিচালিত সেটেলারদের ব্যাপক পূনর্বাসন প্রক্রিয়াকে আইনসিদ্ধ করার লক্ষ্যে ৩৪ বিধিতে পূনরায় সংশোধনী আনা হয়। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা ও আদিবাসীদের ভূমি ও ভূমি অধিকারের রক্ষাকবচ হিসেবে ৩৪ বিধির যে আদিরূপ ছিল তার আর কিছুই বর্তমানে অবশিষ্ট থাকল না। পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি ব্যবস্থাপনায় ব্যবহৃত অন্যান্য আইনগুলো হলো Bazaar Fund Rules-1937, Chittagong Hill Tracts Land Acquisition Regulations-1958 ও Hill District Council Act 1989(amended)। কিন্তু ও সবই পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি আইনের একমাত্র উৎস নয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম আদিবাসীদের ভূমি ব্যবহারের ক্ষেত্রে শতাব্দী প্রাচীন কিচু প্রথাগত আইন। আছে যার কিছু কিছু লিখিত আইন বা নিবার্হী আদেশের মাধ্যমে স্বীকৃত হয়েছে অথবা আইনে পরিণত হয়েছে।
যেমন-বসতভিটার জন্য জমির অধিকার (রুল ৫০), গৃহস্থালী কাজে ব্যবহারের জন্য গাছ, বাঁশ ও অন্যান্য কম গুরুত্বপূর্ণ বনজ সম্পদ (রুল ৪১ ক, বন আইন ১৯২৭,Chittagong Hill Tracts Forest Transit Rules-1973)পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৯০০ শাসন বিধিতে ভূমি ও সম্পদের উপর কিছু প্রথাগত আইন পরোক্ষভাবে স্বীকৃত হয়েছে।
যেমন-জুম চাষের জন্য জুম ভূমির উপর অধিকার (রুল ৪১)। প্রথাগত আইনের উপর ভিত্তি করে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের আর্থ- সামাজিক জীবন পরিচালিত হয়ে আসছে শতবর্ষ ধরে। এই প্রথাগত আইনকে অস্বীকার করা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবন- পদ্ধতিকে অমর্যাদা করার সমতুল্য। একটি জনগোষ্ঠীর পরম্পরাগত জীবনাচারকে অস্বীকার কিংবা অর্মযাদা করার নৈতিক অধিকার কারোর থাকতে পারে কিনা সে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। পার্বত্য চট্টগ্রামে দু’ধরনের ভূমি প্রশাসন ব্যবস্থা বিদ্যামানঃ একটি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের জন্য এবং অপরটি পার্বত্য চট্টগ্রামের অবশিষ্ট অঞ্চলের জন্য। সংরক্ষিত বনের(২৪%) ভূমি প্রশাসন পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অধীনে বন বিভাগ নিয়ন্ত্রন করে।
পক্ষান্তরে সংরক্ষিত বনাঞ্চল বহির্ভুত পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য অঞ্চলের ভূমি প্রশাসন ব্যবস্থা ঐতিহ্যবাহী নেতৃত্ব (রাজা, হেডম্যান, কার্বারী), সরকারী প্রতিনিধি (জেলা প্রশাসক)ও স্থানীয় সরকার (পার্বত্য জেলা পরিষদ) সমন্বয়ে পরিচালিত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি প্রশাসন নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার প্রতিনিধি ও ঐতিহ্যবাহী নেতৃত্বের সমন্বয়ে যে যৌথ প্রশাসন
ব্যবস্থা তা কিন্তু অনেক দিনের পুরনো স্বতন্ত্র জেলা হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামের সৃষ্টির পর থেকে অদ্যাবধি এই ব্যবস্থা চলে আসছে। এখানে বলে রাখা ভাল যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি ব্যবস্থাপনায় ঐতিহ্যগতভাবে রাজা ও মৌজাপ্রধান হিসেবে হেডম্যানবৃন্দ বরাবরই
গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছেন যা বাংলাদেশের আর কোথাও দৃশ্যমান নয়। পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন ১৯৮৯ (সংশোধিত) এ বলা হয়েছেঃ আপাততঃ বলবৎ অন্য কোন আইনে যাই কিছু থাকুক না কেন- বন্দোবস্তীযোগ্য খাসজমিসহ যে কোন জায়গা- জমি জেলা পরিষদের পূর্বানুমোদন ব্যতিরেকে ইজারা প্রদান, বন্দোবস্ত, ক্রয়, বিক্রয় বা অন্যাবিধভাবে হস্তান্তর করা যাবে না। তবে সংরক্ষিত বনাঞ্চল, কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ এলাকা, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিল্প কারখানা ও সরকারের নামে রের্কডকৃত জমির ক্ষেত্রে এই বিধান প্রযোজ্য নয়।
পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনের দ্বারা সংরক্ষিত বনাঞ্চল (Reserved forest) ছাড়া রক্ষিত (Protected) ও অশ্রেণীভূক্ত বনাঞ্চল (Unclasified Forest) কে জেলা পরিষদের আওতাধীন করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে ঐতিহ্যগতভাবে চর্চিত জুম চাষ এখানকার অশ্রেণীভূক্ত বনাঞ্চলে গ্রামীণ সমাজের সমষ্টিগত মালিকানার প্রথা অনুসারে (Village Community Ownership) এখনো অবধি প্রচলিত আছে। এই প্রথা মায়ানমার, ভারত উত্তর পূর্বাঞ্চল এবং পাকিস্তানের বেলুচিস্থানের উপজাতীয় অধ্যুষিত অঞ্চলেও বিদ্যমান। পূর্বের একটি অনুচ্ছেদে ইতিমধ্যেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, সরকারের কোন একটি এজেন্ডার অংশ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামে বহিরাগতদের ব্যাপক
পূনর্বাসনের কার্যক্রমকে বৈধতা দেয়ার উদ্দেশ্যে Hill Tracts Manual এর ৩৪ বিধিতে তড়িঘড়ি করে গোপনে বেশ কিছু সংশোধন আনা হয়, যা নৈতিক বিচারে অগ্রহণযোগ্য। এই বিষয়ে পরবর্তীতে আলোকপাত করা হয়েছে। কিন্তু নির্ধারিত উদ্দেশ্য পূরণে ৩৪ বিধিতে সংশোধনী আনা সত্ত্বেও তা উদ্দেশ্যের (বহিরাগত পূনর্বাসন) বৈধতা দিতে ব্যর্থ হয়েছে নিম্নে যে সমস্ত কারণে সংশোধিত ৩৪ বিধি বহিরাগত পূনর্বাসন কার্যক্রমকে বৈধতা দিতে পর্যাপ্ত নয় তার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়া হলোঃ
১৯০০ শাসন বিধি রুল ৩৪ অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রামে কোন অ-পাহাড়ীর জমির মালিকানার অধিকার নাই। অতঃপর ১৯৭৯ সনের [৩৪(১)(ধ)(র)] বিধির সংশোধনীতে কেবলমাত্র পাহাড়ী ও অ-পাহাড়ী বাসিন্দা’র কাছে চাষযোগ্য সমতল জমি ও উদ্যান-ভূমি বন্দোবস্ত দেয়ার কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু এখানে যে সমস্ত অ-পাহাড়ীদের পূর্নবাসনের জন্য আনা হয়েছে তারা কেউই পার্বত্য চট্টগ্রামের বাসিন্দা নন। অতএব ৩৪(১)(ধ)(র) বিধির আওতায় যাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্নবাসিত করা হয়েছে তা আইনের চোখে বৈধ নয় । আরও বলা আছে, ৩৪(ন)বিধি অনুসারে রাবার চাষ ও বাণিজ্যিক বনায়নের জন্য ১০০% সেলামী ও প্রচলিত হারে কর প্রদান সাপেক্ষে, ৩৪(প) অনুসারে শিল্পায়নের জন্য ১০০% সেলামী ও নিদির্ষ্টভাবে নির্ধারিত কর প্রদান সাপেক্ষে, ৩৪(ফ) বসতবাড়ি নির্মাণের উদ্দেশ্যে ১০০% সেলামী ও নিদির্ষ্টভাবে নির্ধারিত কর প্রদান সাপেক্ষে, ভূমি দীর্ঘ মেয়াদে লীজ দেয়া হবে। ১৯৭৯-৮৩ সময়কাল সরকারী উদ্যোগে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে সেটেলার পূর্নবাসন কার্যক্রম শুধুমাত্র ৩৪(১) বিধির লংঘন নয়, আদিবাসীদের রের্কডকৃত জমি ১৯৫৮ সনের ল্যান্ড একুজিশন রেগুলেশন অনুযায়ী অধিগ্রহণ না করে, ম্যানুয়েলের ৩৪(৫),৩৪(৬) এর অনুসরণে কথিত জমির লীজ বাতিল না করে কিংবা ৫০(৩) ও ৫০(৪) বিধি অনুযায়ী জমি পূনরুদ্ধার না করে সেটেলারদের অধিকারে দিয়ে দেওয়া হয়।
সরকারের এই পদক্ষেপ পুরোপুরিভাবে বাংলাদেশের সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদের লংঘন। ৩২ অনুচ্ছেদে আইনের আশ্রয় ছাড়া কাউকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত না করার কথা বলা হয়েছে। শুধু তাই নয়, সেটলার পূনর্বাসন
কার্যক্রম সংবিধানে ২৮ অনুচ্ছেদেরও পরিপস্থী। কাপ্তাই বাঁধে ক্ষতিগ্রস্ত আদিবাসী পরিবার যারা অমানুষিক পরিশ্রম করে প্রকৃতির ভয়ংকর প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়ে লংগদু উপজেলার গুলশাখালী, আমতলী, গন্ডাছড়া, কালাপাকুজ্যা ইত্যাদি এলাকায় পাহাড়, জঙ্গল পরিষ্কার করে ও নীচু জলাভূমি থেকে চাষের জমি উদ্ধার করেছিল তারা আজ সেটেলারদের আগ্রাসনের মুখে ভিটে- জমি হারিয়ে কাচালং রিজার্ভের গভীরে অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার জীবন যাপন করছে।
বাংলাদেশ সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদে ধর্ম, বর্ণ ও গোষ্ঠীর কারণে রাষ্ট্র কর্তৃক কারোর প্রতি বৈষম্য না করার কথা বলা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম দীর্ঘ দিনের একটি প্রতিষ্ঠিত রীতি হলো কোন জমি বন্দোবস্তী কিংবা লীজ প্রদানের পূর্বে মৌজা হেডম্যানের সুপারিশ গ্রহণ অপরিহার্য। কিন্তু সেটেলারদের পূনর্বাসনের বেলায় এই রীতি অনুসরণ করা হয়নি। অন্যদিকে জুম ভূমি ও বনাঞ্চল, যা পার্বত্য আদিবাসীদের যৌথ সম্পদ, অনাবাসীদের কাছে লীজ দিয়ে এখানকার জনগনের সমষ্টিগত অধিকারকে হরণ করা হয়েছে। জুম ভূমির, যার অবস্থান অশ্রেণীভূক্ত বনাঞ্চলে, ব্যাপক অধিগ্রহণ আদিবাসী জীবিকার প্রধান ক্ষেত্রকে ক্রমাহত সংকুচিত করে চলেছে। মোট ৮৩ টি মৌজার দুই লক্ষ আঠার হাজার যার ৫০% এর গেজেট নোটিফিকেশন হয়ে গেছে। এ অধিগ্রহণকৃত অঞ্চলে কাপ্তাই বাঁধে ক্ষতিগ্রস্ত আদিবাসী ও অ-আদিবাসী উদ্বাস্তু ও জুমিয়া পূর্নবাসন প্রকল্পের আওতাধীন জমিও অন্তভুর্ক্ত। যৌথ সম্পদ বা সমাজের সম্পদের উপর সামাজিক মালিকানা ঐ সমাজে প্রচলিত বিধি, রীতি, রেওয়াজ, প্রথার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং এ সমস্ত লোকাচার বিষয়ে রাজা, হেডম্যান এবং কার্বারীবৃন্দ অভিজ্ঞ বিধায় কোন ব্যক্তির কাছে ঐ সব সম্পদের উপর অধিকার প্রদানের পূর্বে তাদের পরামর্শ গ্রহণ একটি প্রচলিত রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। ১৯০০ শাসনবিধির রুল ৩৯ এ উল্লেখ আছে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ডেপুটি কমিশনারকে সার্কেল চীফদের সাথে অন্তত বছরে দু’বার আলোচনায় বসতে হবে। ১৯৪৭ এর পর থেকে বিশেষ করে ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত ডেপুটি কমিশনারদের বিদায়ের পর এ ধরনের বৈঠক কখনই অনুষ্ঠিত হয়নি।
পার্বত্য চট্টগ্রামে পাঁচ লক্ষাধিক বহিরাগতদের পুর্নবাসনের মত একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে সরকার রাজাদের সাথে কিংবা অন্য কোন আদিবাসী নেতাদেরন সাথে পরার্মশেরও প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। এখানেও সরকার ১৯০০ শাসনবিধির চরম বরখেলাপ ঘটিয়েছেন। দ্রষ্টব্য যে, ১৯০০ শাসন বিধি আইনের সংজ্ঞা নির্ধারণমূলক কোন ঘোষণা নয়, বরং এটি পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচলিত আদিবাসী অধিকার নিয়ন্ত্রণের একটি নির্দেশিকা মাত্র। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে যদি কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে মনযোগী হতেন তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা আজকে এমনি একটি কঠিনতর অবস্থানে এসে দাঁড়াতো না। ১৯৭২ সনে বাংলাদেশে সরকার ILO Convention ১০৭ এ অনুসাক্ষর করেছিলেন। কিন্তু আশির দশকে সরকারের ব্যাপক সেটেলার পূনর্বাসন কার্যক্রম ঐ কনভেশনের ১১,১৩(১)ও১৩(২) অনুচ্ছেদ সমূহের পরিষ্কার লংঘন। ঐ অনু্চ্ছেদ সমূহে আদিবাসী ও উপজাতীদের দ্বারা পরম্পরাগতভাবে অধিকৃত জমির উপর তাদের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত মালিকানা স্বীকার করা হয়েছে এবং তারা যাতে অ- উপজাতী ও অ আদিবাসী কর্তৃক তাদের ভূমি থেকে উৎখাত না হয় তা প্রতিরোধে সরকারের দায়বদ্ধতার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ১৯৭৯-৮৩ সময়কা পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় তার ঠিক উল্টো ঘটনা ঘটেছে।
এভাবে সরকার তাঁর নিজের তৈরী আইন ও সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদ সমূহের ব্যত্যয় ঘটিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে Demographic Engineering এর যে নীতি গ্রহণ করেছে তাতে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রান্তিকরণের পাশাপাশি তাদের জাতিগত অস্তিত্ব ও পরিচয় সংকট হুমকির মুখে পড়েছে শতাব্দীর পরিক্রমায়। যখন আদিবাসী কৃষকসমাজ অনিবার্য কারণে জুম চাষ ছেড়ে ক্রমশঃ হাল চাষ ও পাহাড়ের ঢালু জমিতে উদ্যান চাষে অভ্যস্ত হচ্ছিল ঠিক তখনই সেটেলার পূর্নবাসনের উদ্বাস্তুতে পরিণত হলো।
আর্থিক পূনরুজ্জীবনের স্বপ্ন ভেঙ্গে গিয়ে অনিশ্চয়তাই হয়ে গেল তাদের নিয়তি। সেটেলাররা এখন পুর্নবাসিত। তারপরও তারা নিয়মিত সরকারী রেশন সুবিধা ভোগ করছে। কিন্তু উচ্ছেদ হওয়া আদিবাসীরা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আক্ষরিক অর্থেই উদ্বাস্তু হয়ে ঘুরে ফিরছে পাহাড়ে আর জঙ্গলে। পূর্নবাসনের নাম নেই, উদ্যোগ নেই। রেশন তো তাদের জন্য নিষিদ্ধ ফল।
উচ্ছেদ আর উদ্বাস্তুকরণ যেন আদিবাসীদের ললাট লিখন। এটি যেন একটি নিরবছিন্ন প্রক্রিয়া। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে পার্বত্য
চট্টগ্রাম নামক অঞ্চলে আদিবাসীদের কর্তৃত্ব হরণ। শুরু ব্রিটিশ শাসনামলে। রাজাদের কর্তৃত্ব তারা অনেকখানি হরণ করলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম ১৯০০ শাসনবিধি আদিবাসীদের অস্তিত্ব রক্ষায় কিছুটা হলেও কাজ দিয়েছিল। কিন্তু বিপত্তি ঘটে ১৯৪৭ এ ভারত- পাকিস্তান বিভক্তির পর।
কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের হাত ধরে যে মানবিক বির্পযয় আদিবাসীদের জীবনে নেমে এসেছিল, তাদের নিরূপদ্রুপ প্রশান্তি কেড়ে নিয়েছিল, ১৯৬৩ সনে পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসনতান্ত্রিক স্বীকৃতির প্রত্যাহারে আদিবাসী অধিকার ও কর্তৃত্বের অবসানের সূচনার মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলের মানবিক বঞ্চনার প্রাকার ক্রমশঃ আকাশমুখী হয়েছে। সেই প্রাকার দৈর্ঘ্যে, প্রস্থে, উচ্চতায় আরও বিশালকায় হয়েছে বাংলাদেশ শাসনামলে। এখন শুধু আদিবাসী কর্তৃত্বের বামনায়ন নয়, পার্বত্য চুক্তির প্রস্তাবনায় মুদ্রিত অঙ্গীকার উপজাতীয় অঞ্চল এর স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য রক্ষার মুন্ডুপাত করে ক্রমাগত অনাবাসীদের পূনর্বাসনের মাধ্যমে আদিবাসীদের সংখ্যালঘু করে নিজভূমে শুধু পরবাসী করার স্কীমের পালে জোর বাতাস ধরানো হয়েছে। সেদিন খুব বেশি দূরে নয়, যদি প্রতিরোধমূলক কোন পদক্ষেপ গৃহীত না হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে যে একসময় এগারটি ভিন্ন ভাষাভাষী ও সংস্কৃতিরন আদিবাসী জনগোষ্ঠী ছিল তার নিদর্শন খুঁজতে চট্টগ্রামের নৃ- তাত্ত্বিক জাদুঘরে যেতে হবে।
বিগত কয়েক দশক ধরে ১৯০০ শাসন বিধির
প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠী দেখিয়ে আদিবাসীদের জীবন নিয়ে নির্বিচার ছিনিমিনি খেলা হয়েছে। সরকারের ভ্রান্তনীতির কারণে আদিবাসীদের
পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে প্রখম উদ্বাস্তু হল ষাটের দশকে। প্রথম বছরে নতুন স্থানে গিয়ে কোন কিছু গুছিয়ে উঠার আগেই বাধেঁরনপানি ফুলে ফেপেঁ উঠলে শত শত আদিবাসী পরিবারের নতুন বসতি পানির নীচে তলিয়ে গিয়ে আবারও তাদের দ্বিতীয় দফায় উদ্বাস্তু করলো। জরিপের ভূলে মাশুল দিতে হল আদিবাসীদের। আবার তাদের তৃতীয় বারের মত উদ্বাস্তু হতে হল পার্বত্য চট্টগ্রামে লক্ষাধিক বাঙ্গালী পূনর্বাসনের সরকারী অপরিণামদর্শী নীতির ফলে। সরকারের এই পদক্ষের কারণে একটি দীর্ঘ মেয়াদী ইম্প্যাক্ট হিসেবে আমরা পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর ভূমি থেকে নিরব উচ্ছেদ প্রক্রিয়া প্রত্যক্ষ করছি।
আদিবাসীরা এভাবে বছরের পর বছর উচ্ছেদের মুখে পড়ছে তাদের নিজস্ব কোন কৃতকর্মের জন্য নয়। সরকারের ভ্রান্ত ও একপেশে নীতির কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা দিনের পর দিন খেসারত দিয়ে চলেছে।
কিন্তু এভাবে আর কতদিন? কতবার তারা এভাবে উচ্ছেদ হতে থাকবে? নৈতিক ও আইনী দৃষ্টিতে এই উচ্ছেদ প্রক্রিয়ার গ্রহণযোগ্যতা আদৌ আছে কিনা। আর কর্তৃপক্ষ কিংবা সরকারের ভুলের মাশুল বারে বারে কেন জনগণ দেবে?
ভুলের প্রায়শ্চিত্ত কি কেবল জনগণেরই করে যেতে হবে? ভুল সংশোধনের দায়বদ্ধতা কি সরকারের থাকতে নেই? পার্বত্য চট্টগ্রামে বহুদিন থেকেই এরকম অসংখ্য প্রশ্নের জন্ম হচ্ছে। এসব প্রশ্ন উঠছে কারণ সরকার কর্তৃক এই অঞ্চলের আদিবাসী ও স্থায়ী জনগোষ্ঠীর কিংবা তাদের সামাজিক নেতৃবৃন্দের সাথে পরামর্শ ব্যতিরেকে এখানকার প্রচলিত আইনি কাঠামোয় রক্ষিত আদিবাসীদের ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর অধিকার বলে প্রাপ্ত বিশেষ অধিকার একে একে কেড়ে নেয়ার কারণে।
কর্তৃপক্ষের এই দস্যুপনা অপরাধ হিসেবে গণ্য হয় না কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত আদিবাসীরা যখন ক্ষতির প্রশমনে তাদের হারানো অধিকার প্রর্ত্যাপণের কথা বলে তখন সেটি অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। কর্তৃপক্ষের এই অবস্থানের নৈতিক ভিত্তি কতখানি সে প্রশ্ন কি তোলা যায় না?
জানতে ইচ্ছে করে অতীতের মত আগামীতেও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে নীতি প্রণয়ণ কিংবা গ্রহণের ক্ষেত্রে সরকারের এই ভ্রান্তিবিলাস এর অবসান কি কখনই হবে না? শুরু করেছিলাম মহাশ্বেতা দেবীর একটি উক্তি দিয়ে। তার পূর্ব প্রজন্মের কাছে প্রশ্ন রাখেঃ কখনো বাঙ্গালী জাতিরনউত্তর প্রজন্ম যদি তার পূর্ব প্রজন্মের কাছে প্রশ্ননরাথে যে জাতি তাদের জাতিসত্ত্বার পরিচয় সম্মুন্নত রাখার সংকল্প নিয়ে অস্ত্র ধারণ করেছিল সে জাতির নেতৃত্বদানকারী সরকার কীভাবে দেশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাষিক ও সাংস্কৃতিক সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর জাতিগত পরিচয় মুছে ফেলার জন্য রাষ্ট্রীয় শক্তির অনৈতিক ব্যবহারে কোমর কষে নেমে পড়তে পারে, অধিকার আদায়ের সংগ্রামে পোড় খাওয়া একটি জাতি কী ভাবে এরূপ একটি অনায্য ও অসঙ্গত কাজে বিবেকের তাড়নায় প্রতিবাদে উচ্চকন্ঠ হতে পারে নি তার কী উত্তর পূর্বসূরী তার উত্তরসূরীদের জন্য রেখে যাবে?
তথ্যসূত্র: সিএইটি, জুম্মল্যাণ্ড
করে উদ্বাস্তুদের পূনর্বাসন দেয়া হলো তার প্রায় তিন- চতুর্থাংশ প্রতি বছর বর্ষাকালে জলমগ্ন হয়। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে মুক্তিযুদ্ধে পাহাড়িদের অসহযোগিতার অজুহাতে মুক্তিবাহিনীর একটি অংশ কর্তৃক পাহাড়ি হত্যার ঘটনায় সৃষ্ট অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সুযোগে খাগড়াছড়ি জেলার অন্তগর্ত রামগড় থানার ভারত সীমান্ত সংলগ্ন ফেনী উপত্যকায় কয়েক হাজার বাঙ্গালী রাষ্ট্র শক্তির পরোক্ষ সমর্থনে একযোগে বসতি স্থাপন করে।
নিরাপত্তার সংকটে দিশেহারা আদিবাসীদের
তাদের চোখের সামনে ভূমির বেদখল প্রক্রিয়া চেয়ে চেয়ে দেখে থাকা ছাড়া আর কোন গত্যন্তর ছিল না। এই জবরদস্তি ভূমি দখল ঘটনার এক দশক অতিক্রান্ত না হতেই এর চাইতেও ব্যাপকতর জবরদখলের নাটক মঞ্চায়িত হয়ে গেল পার্বত্য চট্টগ্রামে।
১৯৭৯ সনে গোপন এক সার্কুলারের মাধ্যমে বাংলাদেশের সমতল জেলাসমূহের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভূমিহীন, নদী ভাঙ্গনের শিকার প্রায় ৫ লক্ষ দরিদ্র বাঙ্গালীদের সরকারী উদ্যোগে জমির পাট্টা দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে এনে র্পূনবাসিত করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে চাষযোগ্য জমির অভাবে যেখানে কাপ্তাই বাঁধে ক্ষতিগ্রস্ত বাস্তুহারা উদ্বাস্তুদের পূনর্বাসিত করা যায়নি সেখানে এই অতিরিক্ত ৫ লক্ষ দরিদ্র ভূমিহীন বাঙ্গালী কৃষক কোথায় কী ভাবে পুর্নবাসিত হবে?
বাস্তবে যা হলো তা হচ্ছে হাজার হাজার আদিবাসীদের রের্কডকৃত কিংবা দখলে থাকা জমিতে এই সব দরিদ্র বাঙ্গালী কৃষকদের বসিয়ে দেয়া হল। কিন্তু এ ধরনের অস্বাভাবিক ঘটনা কী ভাবে ঘটে গেল? সরকার কি এমন কোন উদ্যোগ নিতে পারে যা বড় ধরনের মানবিক বির্পযয়ের কারণ হতে পারে?
দেশে কি এমন কোন আইন থাকতে পারে যার উপর ভর করে ব্যাপক হারে মানবাধিকার লংঘিত হতে পারে? দেশের ভূমি আইনে(সমতল অঞ্চল ও পার্বত্য চট্টগ্রাম) কি এমন কোন বিধান আছে যাতে একটি জনগোষ্ঠীকে উৎখাত করে অন্য একটি জনগোষ্ঠীক প্রতিস্থাপিত করা যেতে পারে?
আমরা দেশের প্রচলিত ভূমি আইনের দিকে দৃষ্টি দিতে পারি। বাংলাদেশের অপরাপর অঞ্চল ও পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি আইন অভিন্ন নয়। বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থাপনার ভিত্তি হিসেবে পূর্ববঙ্গ জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাসত্ত্ব আইন ১৯৫০, সার্ভে আইন ১৮৭৫, সার্ভে ও সেটেলম্যান্ট ম্যানুয়েল ১৯৩৫, প্রজাসত্ত্ব বিধিমালা ১৯৫৪ ও ভূমি ব্যবস্থাপনা ম্যানুয়েল ১৯৯০ ব্যবহৃত হয়ে আসছে যার কোনটিই পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি আইনের মূল ভিত্তি হলো The Chittagong Hill Tracts Regulations-১৯০০ যা সাধারণভাবে Hill Tracts Manual হিসেবে সমধিক পরিচিত। এটি শুধু ভূমি রাজস্ব নয়, সাধারণ প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থাপনারও ভিত্তি। এর ৩৪ বিধিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীসমুহের ভূমি ও ভূমি অধিকার সুরক্ষার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু ১৯৭১ সনের স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই পার্বত্য চট্টগামে অ- আদিবাসীদের জন্য ভূমি ও ভূমি অধিকার উন্মুক্ত করে দেয়ার জন্য ৩৪ বিধিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়।
মাত্র আট বছরের ব্যবধানে ১৯৭৯ সালে সরকারী উদ্যোগে পরিচালিত সেটেলারদের ব্যাপক পূনর্বাসন প্রক্রিয়াকে আইনসিদ্ধ করার লক্ষ্যে ৩৪ বিধিতে পূনরায় সংশোধনী আনা হয়। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা ও আদিবাসীদের ভূমি ও ভূমি অধিকারের রক্ষাকবচ হিসেবে ৩৪ বিধির যে আদিরূপ ছিল তার আর কিছুই বর্তমানে অবশিষ্ট থাকল না। পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি ব্যবস্থাপনায় ব্যবহৃত অন্যান্য আইনগুলো হলো Bazaar Fund Rules-1937, Chittagong Hill Tracts Land Acquisition Regulations-1958 ও Hill District Council Act 1989(amended)। কিন্তু ও সবই পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি আইনের একমাত্র উৎস নয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম আদিবাসীদের ভূমি ব্যবহারের ক্ষেত্রে শতাব্দী প্রাচীন কিচু প্রথাগত আইন। আছে যার কিছু কিছু লিখিত আইন বা নিবার্হী আদেশের মাধ্যমে স্বীকৃত হয়েছে অথবা আইনে পরিণত হয়েছে।
যেমন-বসতভিটার জন্য জমির অধিকার (রুল ৫০), গৃহস্থালী কাজে ব্যবহারের জন্য গাছ, বাঁশ ও অন্যান্য কম গুরুত্বপূর্ণ বনজ সম্পদ (রুল ৪১ ক, বন আইন ১৯২৭,Chittagong Hill Tracts Forest Transit Rules-1973)পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৯০০ শাসন বিধিতে ভূমি ও সম্পদের উপর কিছু প্রথাগত আইন পরোক্ষভাবে স্বীকৃত হয়েছে।
যেমন-জুম চাষের জন্য জুম ভূমির উপর অধিকার (রুল ৪১)। প্রথাগত আইনের উপর ভিত্তি করে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের আর্থ- সামাজিক জীবন পরিচালিত হয়ে আসছে শতবর্ষ ধরে। এই প্রথাগত আইনকে অস্বীকার করা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবন- পদ্ধতিকে অমর্যাদা করার সমতুল্য। একটি জনগোষ্ঠীর পরম্পরাগত জীবনাচারকে অস্বীকার কিংবা অর্মযাদা করার নৈতিক অধিকার কারোর থাকতে পারে কিনা সে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। পার্বত্য চট্টগ্রামে দু’ধরনের ভূমি প্রশাসন ব্যবস্থা বিদ্যামানঃ একটি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের জন্য এবং অপরটি পার্বত্য চট্টগ্রামের অবশিষ্ট অঞ্চলের জন্য। সংরক্ষিত বনের(২৪%) ভূমি প্রশাসন পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অধীনে বন বিভাগ নিয়ন্ত্রন করে।
পক্ষান্তরে সংরক্ষিত বনাঞ্চল বহির্ভুত পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য অঞ্চলের ভূমি প্রশাসন ব্যবস্থা ঐতিহ্যবাহী নেতৃত্ব (রাজা, হেডম্যান, কার্বারী), সরকারী প্রতিনিধি (জেলা প্রশাসক)ও স্থানীয় সরকার (পার্বত্য জেলা পরিষদ) সমন্বয়ে পরিচালিত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি প্রশাসন নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার প্রতিনিধি ও ঐতিহ্যবাহী নেতৃত্বের সমন্বয়ে যে যৌথ প্রশাসন
ব্যবস্থা তা কিন্তু অনেক দিনের পুরনো স্বতন্ত্র জেলা হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামের সৃষ্টির পর থেকে অদ্যাবধি এই ব্যবস্থা চলে আসছে। এখানে বলে রাখা ভাল যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি ব্যবস্থাপনায় ঐতিহ্যগতভাবে রাজা ও মৌজাপ্রধান হিসেবে হেডম্যানবৃন্দ বরাবরই
গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছেন যা বাংলাদেশের আর কোথাও দৃশ্যমান নয়। পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন ১৯৮৯ (সংশোধিত) এ বলা হয়েছেঃ আপাততঃ বলবৎ অন্য কোন আইনে যাই কিছু থাকুক না কেন- বন্দোবস্তীযোগ্য খাসজমিসহ যে কোন জায়গা- জমি জেলা পরিষদের পূর্বানুমোদন ব্যতিরেকে ইজারা প্রদান, বন্দোবস্ত, ক্রয়, বিক্রয় বা অন্যাবিধভাবে হস্তান্তর করা যাবে না। তবে সংরক্ষিত বনাঞ্চল, কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ এলাকা, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিল্প কারখানা ও সরকারের নামে রের্কডকৃত জমির ক্ষেত্রে এই বিধান প্রযোজ্য নয়।
পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনের দ্বারা সংরক্ষিত বনাঞ্চল (Reserved forest) ছাড়া রক্ষিত (Protected) ও অশ্রেণীভূক্ত বনাঞ্চল (Unclasified Forest) কে জেলা পরিষদের আওতাধীন করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে ঐতিহ্যগতভাবে চর্চিত জুম চাষ এখানকার অশ্রেণীভূক্ত বনাঞ্চলে গ্রামীণ সমাজের সমষ্টিগত মালিকানার প্রথা অনুসারে (Village Community Ownership) এখনো অবধি প্রচলিত আছে। এই প্রথা মায়ানমার, ভারত উত্তর পূর্বাঞ্চল এবং পাকিস্তানের বেলুচিস্থানের উপজাতীয় অধ্যুষিত অঞ্চলেও বিদ্যমান। পূর্বের একটি অনুচ্ছেদে ইতিমধ্যেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, সরকারের কোন একটি এজেন্ডার অংশ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামে বহিরাগতদের ব্যাপক
পূনর্বাসনের কার্যক্রমকে বৈধতা দেয়ার উদ্দেশ্যে Hill Tracts Manual এর ৩৪ বিধিতে তড়িঘড়ি করে গোপনে বেশ কিছু সংশোধন আনা হয়, যা নৈতিক বিচারে অগ্রহণযোগ্য। এই বিষয়ে পরবর্তীতে আলোকপাত করা হয়েছে। কিন্তু নির্ধারিত উদ্দেশ্য পূরণে ৩৪ বিধিতে সংশোধনী আনা সত্ত্বেও তা উদ্দেশ্যের (বহিরাগত পূনর্বাসন) বৈধতা দিতে ব্যর্থ হয়েছে নিম্নে যে সমস্ত কারণে সংশোধিত ৩৪ বিধি বহিরাগত পূনর্বাসন কার্যক্রমকে বৈধতা দিতে পর্যাপ্ত নয় তার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়া হলোঃ
১৯০০ শাসন বিধি রুল ৩৪ অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রামে কোন অ-পাহাড়ীর জমির মালিকানার অধিকার নাই। অতঃপর ১৯৭৯ সনের [৩৪(১)(ধ)(র)] বিধির সংশোধনীতে কেবলমাত্র পাহাড়ী ও অ-পাহাড়ী বাসিন্দা’র কাছে চাষযোগ্য সমতল জমি ও উদ্যান-ভূমি বন্দোবস্ত দেয়ার কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু এখানে যে সমস্ত অ-পাহাড়ীদের পূর্নবাসনের জন্য আনা হয়েছে তারা কেউই পার্বত্য চট্টগ্রামের বাসিন্দা নন। অতএব ৩৪(১)(ধ)(র) বিধির আওতায় যাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্নবাসিত করা হয়েছে তা আইনের চোখে বৈধ নয় । আরও বলা আছে, ৩৪(ন)বিধি অনুসারে রাবার চাষ ও বাণিজ্যিক বনায়নের জন্য ১০০% সেলামী ও প্রচলিত হারে কর প্রদান সাপেক্ষে, ৩৪(প) অনুসারে শিল্পায়নের জন্য ১০০% সেলামী ও নিদির্ষ্টভাবে নির্ধারিত কর প্রদান সাপেক্ষে, ৩৪(ফ) বসতবাড়ি নির্মাণের উদ্দেশ্যে ১০০% সেলামী ও নিদির্ষ্টভাবে নির্ধারিত কর প্রদান সাপেক্ষে, ভূমি দীর্ঘ মেয়াদে লীজ দেয়া হবে। ১৯৭৯-৮৩ সময়কাল সরকারী উদ্যোগে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে সেটেলার পূর্নবাসন কার্যক্রম শুধুমাত্র ৩৪(১) বিধির লংঘন নয়, আদিবাসীদের রের্কডকৃত জমি ১৯৫৮ সনের ল্যান্ড একুজিশন রেগুলেশন অনুযায়ী অধিগ্রহণ না করে, ম্যানুয়েলের ৩৪(৫),৩৪(৬) এর অনুসরণে কথিত জমির লীজ বাতিল না করে কিংবা ৫০(৩) ও ৫০(৪) বিধি অনুযায়ী জমি পূনরুদ্ধার না করে সেটেলারদের অধিকারে দিয়ে দেওয়া হয়।
সরকারের এই পদক্ষেপ পুরোপুরিভাবে বাংলাদেশের সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদের লংঘন। ৩২ অনুচ্ছেদে আইনের আশ্রয় ছাড়া কাউকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত না করার কথা বলা হয়েছে। শুধু তাই নয়, সেটলার পূনর্বাসন
কার্যক্রম সংবিধানে ২৮ অনুচ্ছেদেরও পরিপস্থী। কাপ্তাই বাঁধে ক্ষতিগ্রস্ত আদিবাসী পরিবার যারা অমানুষিক পরিশ্রম করে প্রকৃতির ভয়ংকর প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়ে লংগদু উপজেলার গুলশাখালী, আমতলী, গন্ডাছড়া, কালাপাকুজ্যা ইত্যাদি এলাকায় পাহাড়, জঙ্গল পরিষ্কার করে ও নীচু জলাভূমি থেকে চাষের জমি উদ্ধার করেছিল তারা আজ সেটেলারদের আগ্রাসনের মুখে ভিটে- জমি হারিয়ে কাচালং রিজার্ভের গভীরে অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার জীবন যাপন করছে।
বাংলাদেশ সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদে ধর্ম, বর্ণ ও গোষ্ঠীর কারণে রাষ্ট্র কর্তৃক কারোর প্রতি বৈষম্য না করার কথা বলা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম দীর্ঘ দিনের একটি প্রতিষ্ঠিত রীতি হলো কোন জমি বন্দোবস্তী কিংবা লীজ প্রদানের পূর্বে মৌজা হেডম্যানের সুপারিশ গ্রহণ অপরিহার্য। কিন্তু সেটেলারদের পূনর্বাসনের বেলায় এই রীতি অনুসরণ করা হয়নি। অন্যদিকে জুম ভূমি ও বনাঞ্চল, যা পার্বত্য আদিবাসীদের যৌথ সম্পদ, অনাবাসীদের কাছে লীজ দিয়ে এখানকার জনগনের সমষ্টিগত অধিকারকে হরণ করা হয়েছে। জুম ভূমির, যার অবস্থান অশ্রেণীভূক্ত বনাঞ্চলে, ব্যাপক অধিগ্রহণ আদিবাসী জীবিকার প্রধান ক্ষেত্রকে ক্রমাহত সংকুচিত করে চলেছে। মোট ৮৩ টি মৌজার দুই লক্ষ আঠার হাজার যার ৫০% এর গেজেট নোটিফিকেশন হয়ে গেছে। এ অধিগ্রহণকৃত অঞ্চলে কাপ্তাই বাঁধে ক্ষতিগ্রস্ত আদিবাসী ও অ-আদিবাসী উদ্বাস্তু ও জুমিয়া পূর্নবাসন প্রকল্পের আওতাধীন জমিও অন্তভুর্ক্ত। যৌথ সম্পদ বা সমাজের সম্পদের উপর সামাজিক মালিকানা ঐ সমাজে প্রচলিত বিধি, রীতি, রেওয়াজ, প্রথার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং এ সমস্ত লোকাচার বিষয়ে রাজা, হেডম্যান এবং কার্বারীবৃন্দ অভিজ্ঞ বিধায় কোন ব্যক্তির কাছে ঐ সব সম্পদের উপর অধিকার প্রদানের পূর্বে তাদের পরামর্শ গ্রহণ একটি প্রচলিত রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। ১৯০০ শাসনবিধির রুল ৩৯ এ উল্লেখ আছে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ডেপুটি কমিশনারকে সার্কেল চীফদের সাথে অন্তত বছরে দু’বার আলোচনায় বসতে হবে। ১৯৪৭ এর পর থেকে বিশেষ করে ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত ডেপুটি কমিশনারদের বিদায়ের পর এ ধরনের বৈঠক কখনই অনুষ্ঠিত হয়নি।
পার্বত্য চট্টগ্রামে পাঁচ লক্ষাধিক বহিরাগতদের পুর্নবাসনের মত একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে সরকার রাজাদের সাথে কিংবা অন্য কোন আদিবাসী নেতাদেরন সাথে পরার্মশেরও প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। এখানেও সরকার ১৯০০ শাসনবিধির চরম বরখেলাপ ঘটিয়েছেন। দ্রষ্টব্য যে, ১৯০০ শাসন বিধি আইনের সংজ্ঞা নির্ধারণমূলক কোন ঘোষণা নয়, বরং এটি পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচলিত আদিবাসী অধিকার নিয়ন্ত্রণের একটি নির্দেশিকা মাত্র। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে যদি কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে মনযোগী হতেন তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা আজকে এমনি একটি কঠিনতর অবস্থানে এসে দাঁড়াতো না। ১৯৭২ সনে বাংলাদেশে সরকার ILO Convention ১০৭ এ অনুসাক্ষর করেছিলেন। কিন্তু আশির দশকে সরকারের ব্যাপক সেটেলার পূনর্বাসন কার্যক্রম ঐ কনভেশনের ১১,১৩(১)ও১৩(২) অনুচ্ছেদ সমূহের পরিষ্কার লংঘন। ঐ অনু্চ্ছেদ সমূহে আদিবাসী ও উপজাতীদের দ্বারা পরম্পরাগতভাবে অধিকৃত জমির উপর তাদের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত মালিকানা স্বীকার করা হয়েছে এবং তারা যাতে অ- উপজাতী ও অ আদিবাসী কর্তৃক তাদের ভূমি থেকে উৎখাত না হয় তা প্রতিরোধে সরকারের দায়বদ্ধতার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ১৯৭৯-৮৩ সময়কা পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় তার ঠিক উল্টো ঘটনা ঘটেছে।
এভাবে সরকার তাঁর নিজের তৈরী আইন ও সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদ সমূহের ব্যত্যয় ঘটিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে Demographic Engineering এর যে নীতি গ্রহণ করেছে তাতে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রান্তিকরণের পাশাপাশি তাদের জাতিগত অস্তিত্ব ও পরিচয় সংকট হুমকির মুখে পড়েছে শতাব্দীর পরিক্রমায়। যখন আদিবাসী কৃষকসমাজ অনিবার্য কারণে জুম চাষ ছেড়ে ক্রমশঃ হাল চাষ ও পাহাড়ের ঢালু জমিতে উদ্যান চাষে অভ্যস্ত হচ্ছিল ঠিক তখনই সেটেলার পূর্নবাসনের উদ্বাস্তুতে পরিণত হলো।
আর্থিক পূনরুজ্জীবনের স্বপ্ন ভেঙ্গে গিয়ে অনিশ্চয়তাই হয়ে গেল তাদের নিয়তি। সেটেলাররা এখন পুর্নবাসিত। তারপরও তারা নিয়মিত সরকারী রেশন সুবিধা ভোগ করছে। কিন্তু উচ্ছেদ হওয়া আদিবাসীরা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আক্ষরিক অর্থেই উদ্বাস্তু হয়ে ঘুরে ফিরছে পাহাড়ে আর জঙ্গলে। পূর্নবাসনের নাম নেই, উদ্যোগ নেই। রেশন তো তাদের জন্য নিষিদ্ধ ফল।
উচ্ছেদ আর উদ্বাস্তুকরণ যেন আদিবাসীদের ললাট লিখন। এটি যেন একটি নিরবছিন্ন প্রক্রিয়া। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে পার্বত্য
চট্টগ্রাম নামক অঞ্চলে আদিবাসীদের কর্তৃত্ব হরণ। শুরু ব্রিটিশ শাসনামলে। রাজাদের কর্তৃত্ব তারা অনেকখানি হরণ করলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম ১৯০০ শাসনবিধি আদিবাসীদের অস্তিত্ব রক্ষায় কিছুটা হলেও কাজ দিয়েছিল। কিন্তু বিপত্তি ঘটে ১৯৪৭ এ ভারত- পাকিস্তান বিভক্তির পর।
কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের হাত ধরে যে মানবিক বির্পযয় আদিবাসীদের জীবনে নেমে এসেছিল, তাদের নিরূপদ্রুপ প্রশান্তি কেড়ে নিয়েছিল, ১৯৬৩ সনে পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসনতান্ত্রিক স্বীকৃতির প্রত্যাহারে আদিবাসী অধিকার ও কর্তৃত্বের অবসানের সূচনার মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলের মানবিক বঞ্চনার প্রাকার ক্রমশঃ আকাশমুখী হয়েছে। সেই প্রাকার দৈর্ঘ্যে, প্রস্থে, উচ্চতায় আরও বিশালকায় হয়েছে বাংলাদেশ শাসনামলে। এখন শুধু আদিবাসী কর্তৃত্বের বামনায়ন নয়, পার্বত্য চুক্তির প্রস্তাবনায় মুদ্রিত অঙ্গীকার উপজাতীয় অঞ্চল এর স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য রক্ষার মুন্ডুপাত করে ক্রমাগত অনাবাসীদের পূনর্বাসনের মাধ্যমে আদিবাসীদের সংখ্যালঘু করে নিজভূমে শুধু পরবাসী করার স্কীমের পালে জোর বাতাস ধরানো হয়েছে। সেদিন খুব বেশি দূরে নয়, যদি প্রতিরোধমূলক কোন পদক্ষেপ গৃহীত না হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে যে একসময় এগারটি ভিন্ন ভাষাভাষী ও সংস্কৃতিরন আদিবাসী জনগোষ্ঠী ছিল তার নিদর্শন খুঁজতে চট্টগ্রামের নৃ- তাত্ত্বিক জাদুঘরে যেতে হবে।
বিগত কয়েক দশক ধরে ১৯০০ শাসন বিধির
প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠী দেখিয়ে আদিবাসীদের জীবন নিয়ে নির্বিচার ছিনিমিনি খেলা হয়েছে। সরকারের ভ্রান্তনীতির কারণে আদিবাসীদের
পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে প্রখম উদ্বাস্তু হল ষাটের দশকে। প্রথম বছরে নতুন স্থানে গিয়ে কোন কিছু গুছিয়ে উঠার আগেই বাধেঁরনপানি ফুলে ফেপেঁ উঠলে শত শত আদিবাসী পরিবারের নতুন বসতি পানির নীচে তলিয়ে গিয়ে আবারও তাদের দ্বিতীয় দফায় উদ্বাস্তু করলো। জরিপের ভূলে মাশুল দিতে হল আদিবাসীদের। আবার তাদের তৃতীয় বারের মত উদ্বাস্তু হতে হল পার্বত্য চট্টগ্রামে লক্ষাধিক বাঙ্গালী পূনর্বাসনের সরকারী অপরিণামদর্শী নীতির ফলে। সরকারের এই পদক্ষের কারণে একটি দীর্ঘ মেয়াদী ইম্প্যাক্ট হিসেবে আমরা পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর ভূমি থেকে নিরব উচ্ছেদ প্রক্রিয়া প্রত্যক্ষ করছি।
আদিবাসীরা এভাবে বছরের পর বছর উচ্ছেদের মুখে পড়ছে তাদের নিজস্ব কোন কৃতকর্মের জন্য নয়। সরকারের ভ্রান্ত ও একপেশে নীতির কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা দিনের পর দিন খেসারত দিয়ে চলেছে।
কিন্তু এভাবে আর কতদিন? কতবার তারা এভাবে উচ্ছেদ হতে থাকবে? নৈতিক ও আইনী দৃষ্টিতে এই উচ্ছেদ প্রক্রিয়ার গ্রহণযোগ্যতা আদৌ আছে কিনা। আর কর্তৃপক্ষ কিংবা সরকারের ভুলের মাশুল বারে বারে কেন জনগণ দেবে?
ভুলের প্রায়শ্চিত্ত কি কেবল জনগণেরই করে যেতে হবে? ভুল সংশোধনের দায়বদ্ধতা কি সরকারের থাকতে নেই? পার্বত্য চট্টগ্রামে বহুদিন থেকেই এরকম অসংখ্য প্রশ্নের জন্ম হচ্ছে। এসব প্রশ্ন উঠছে কারণ সরকার কর্তৃক এই অঞ্চলের আদিবাসী ও স্থায়ী জনগোষ্ঠীর কিংবা তাদের সামাজিক নেতৃবৃন্দের সাথে পরামর্শ ব্যতিরেকে এখানকার প্রচলিত আইনি কাঠামোয় রক্ষিত আদিবাসীদের ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর অধিকার বলে প্রাপ্ত বিশেষ অধিকার একে একে কেড়ে নেয়ার কারণে।
কর্তৃপক্ষের এই দস্যুপনা অপরাধ হিসেবে গণ্য হয় না কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত আদিবাসীরা যখন ক্ষতির প্রশমনে তাদের হারানো অধিকার প্রর্ত্যাপণের কথা বলে তখন সেটি অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। কর্তৃপক্ষের এই অবস্থানের নৈতিক ভিত্তি কতখানি সে প্রশ্ন কি তোলা যায় না?
জানতে ইচ্ছে করে অতীতের মত আগামীতেও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে নীতি প্রণয়ণ কিংবা গ্রহণের ক্ষেত্রে সরকারের এই ভ্রান্তিবিলাস এর অবসান কি কখনই হবে না? শুরু করেছিলাম মহাশ্বেতা দেবীর একটি উক্তি দিয়ে। তার পূর্ব প্রজন্মের কাছে প্রশ্ন রাখেঃ কখনো বাঙ্গালী জাতিরনউত্তর প্রজন্ম যদি তার পূর্ব প্রজন্মের কাছে প্রশ্ননরাথে যে জাতি তাদের জাতিসত্ত্বার পরিচয় সম্মুন্নত রাখার সংকল্প নিয়ে অস্ত্র ধারণ করেছিল সে জাতির নেতৃত্বদানকারী সরকার কীভাবে দেশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাষিক ও সাংস্কৃতিক সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর জাতিগত পরিচয় মুছে ফেলার জন্য রাষ্ট্রীয় শক্তির অনৈতিক ব্যবহারে কোমর কষে নেমে পড়তে পারে, অধিকার আদায়ের সংগ্রামে পোড় খাওয়া একটি জাতি কী ভাবে এরূপ একটি অনায্য ও অসঙ্গত কাজে বিবেকের তাড়নায় প্রতিবাদে উচ্চকন্ঠ হতে পারে নি তার কী উত্তর পূর্বসূরী তার উত্তরসূরীদের জন্য রেখে যাবে?
তথ্যসূত্র: সিএইটি, জুম্মল্যাণ্ড
No comments
Post a Comment