মাতৃদেবী গর্ভ সৃষ্টির আধার
অধ্যাপক ধর্মরক্ষিত মহাথের
এ বিশ্ব ব্রহ্মা- মাতৃ দেবী সদৃশ। তাই বৈদিক যুগ হতে সম্প্রতি মুনি ঋষি সাধক কবি সাহিত্যিক ভাবুক সকলেই মাতা-তথা মাতৃজাতিকে দেবীর আসনে প্রতিষ্ঠিত করে, মাতৃ গুণ কীর্তন করে আসছেন। পৃথিবীতে যে কয়েকজন মহাপুরুষ জন্ম নিয়েছেন তাঁদের মাতা ছিলেন পুণ্যশ্লে¬াকা, বিদুষী ধার্মিক এবং সদ্চরিত্রের অধিকারী। সে সব ধার্মিক প্রসবিনী নারীরাই গুণ ধর পুত্র প্রসব করে এ পৃথিবীকে মহামান্বিত করেছেন।
বৈদিক সংস্কৃত ও পালি সাহিত্য ব্যতীত ও পৃথিবীর বিভিন্ন সাহিত্যে মাতৃ জাতির গুণ কীর্তিত হয়েছে। পরিশুদ্ধ পাত্রে বিশুদ্ধ আহার্য দ্রব্য যেমন বিকৃত হয় না। তেমনি সতি সাধ্বী মাতৃজঠরে ধার্মিক পিতার বীর্যপাতে সদ্পুত্রের জন্ম হয়ে থাকে। এ কারণে মাতৃ লাভের জন্য কুমারীরা সতীত্বের ব্রত পরায়ণা হয়ে আপন মনুষ্য জীবনকে ধন্য করে। ভাবীকালে এহেন নারীই সৎ ধার্মিক পুত্র প্রসব করে, এ মলিন পৃথিবীকে ধন্য করে নিজেই মানুষের অন্তর জগতের বেদীমূলে আসন করে নেন যার ব্যাখ্যা দেওয়া কারো পক্ষে সম্ভব নয়। পালি সাহিত্যে বুদ্ধ মাতা মহামায়া, স্তন্য দায়িনী মাতা মহাপ্রজাপতি গৌতমী, রাহুল মাতা যশোধরা, সারিপুত্রের মাতা, মৌদ্গলায়নের মাতা, মোদ্গলীসহ আরো অনেক মাতা আছেন যাঁরা ধার্মিক পুণ্যশ্লোকা মহিলা ছিলেন বলেই বুদ্ধ শাসনে তাঁদের পুত্রদের প্রবেশের দ্বারা এ শাসন পৃৃথিবীতে আজও ধর্মজ্যোতি বিকশিত করে সমুন্নত রয়েছে। এরপরও মহাউপাসিকা বিশাখা, তাঁর পুণ্য প্রভায় বুদ্ধ শাসনের যে কৃতিত্ব রেখেছেন সে কারণে তিনি পালি সাহিত্যে একজন আদর্শ নারী রূপে চিহিৃত হয়ে রয়েছেন। এছাড়া থেরীগাথা গ্রন্থের যে কয়েকজন আত্মত্যাগী সাধিকা পালি সাহিত্যে আপনাদের সচ্চরিতা ও সাধনা দ্বারা অমরত্ব লাভ করেছেন। এঁদের মধ্যে থেরী ধম্মদীনা, সুমনা, উত্তরা, কৃশাগৌতমী, উৎপল বর্ণা, পুন্নিকা, আ¤্রপালি, রোহিনী, সুভা, ইসিদাসী ও সুমেধা অনন্যা।
সনাতন ধর্ম সাহিত্যে মাতা সম্পর্কে বলা হয়েছে Ñ‘পূজ্যতে মান্যত যা সা মাতা” অর্থাৎ যাকে মান্য করন এবং পূজা করা যায় তিনিই মাতা। পালি সাহিত্যেও মাতৃ বন্দনা গাথায় মাতার উচ্চ প্রসংশা করেছেন। মাতা কত ত্যাগ স্বীকার করে সন্তান গর্ভে ধারণ করেন এবং প্রসবের পর স্তন্য দুগ্ধ পান করিয়ে সন্তানকে লালন-পালন করেন সে কথা মাতৃ বন্দনায় পালি ভাষায় উচ্চারিত হয়েছে Ñ
“কত্বান কায়ে রুধিরং খীরং যা সিনেহ পূরিতা,
পায়েত্বা মং সংবড্ডেসি বন্দে তং মম মাতরং
দস মাসে উরে কত্বা খীরং পায়েত্বা বাড্ডেসি,
দিবারত্তিঞ্চ পোসেতি মাতুপাদং নামাম্যহং
যে মাতা নিজ রক্ত হতে উৎপন্ন স্নেহ পরায়ণ হয়ে দুগ্ধ পান করিয়ে আমাকে লালন পালন করিয়েছেন যে আমার মাতাকে আমি বন্দনা করছি। দশমাস গর্ভে ধারণ করে দুগ্ধদানে বর্ধনকারী ও রাত দিন ব্যাপীি পোষণকারিণী; সে আমার মাতার পদমূলে নমস্কার করছি।
একথা সর্ব্বৈ সত্য যে, জাগতিক জগতে মাতা পিতার দৈহিক মিলনের মাধ্যমেই মানব সন্তানরা জন্ম গ্রহণ করেন। তাই মাতা পিতার মধ্যে পিতা অপেক্ষা মাতার গুণ অনেক বেশি বলে সনাতন শাস্ত্রে উল্লে¬খিত। সনাতন ধর্মে বলা হচ্ছে, যে সমাজে নারী জাতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয় না, যে সমাজে নির্যাতিতা নারীর অশ্রু ঝরে, নারী জাতির সতীত্ব নষ্ট হয়, অপহরিত হয়, ধর্ষিত হয়, সে সমাজে অবনতি ঘটে। দেখা যায় লংকার রাজা রাবন সীতাকে হরণ করে এমন কি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানীরা বাঙালি নারী জাতির সম্ভ্রম নষ্ট করায় তাদেরকে বিরাট মূল্য দিতে হয়েছে। শাস্ত্রে একথাও উল্লে¬খ আছে যে; মাতৃ জাতিকে সম্মান করলে দেবতারাও সন্তুষ্ট হয়ে আশীর্বাদ প্রদান করলে সে সমাজের অপকার ও অমঙগল হয় না। তাই মনু শাস্ত্রে বলা হয়েছেÑ
যত্র-নার্য্যস্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতার
যত্রৈতাস্তু ন পূজন্তে সর্ব্বাস্তত্রা ফলার ক্রিয়া।
নারীর গুরুত্ব অত্যধিক বলেই সাহিত্যে, ধর্মীয় শাস্ত্রে, মাতার নাম উচ্চারিত হয়। মাতার নামে পুত্ররা পরিচিতি লাভ করে। যেমন সারিপুত্র, মৌদ্গলীপুত্র, কাত্যায়না, সীতারাম, লহ্মœী নারায়ণ কালিদাসের বিখ্যাত কাব্য গ্রন্থ রঘুবংশ গ্রন্থে বন্দনা গাথায় বলা হয়েছে-
“জগত পিতরৌ বন্দে পার্বতী পরমেশ্বরৌ।”
এতদ্ সত্ত্বেও চানক্য শ্লে¬াকে পিতাকে মাতা অপেক্ষা ঊর্দ্ধ স্থানে স্থান দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে,“পিতা ধর্মঃপিতা স্বর্গঃপিতাহি পরম তপঃ। পিতা প্রীতিমাপন্নে পিয়ন্তে সর্ব দেবতা” পিতাই ধর্ম পিতাই স্বর্গ এবং পিতাই পরম তপস্যা। পিতা সন্তুষ্ট হলে দেবতারাও সন্তুষ্ট হন। কিন্তু অন্যত্র মনু বলছে মাতা গর্ভধারণ এবং পোষণ করেন বলে তিনি গরীয়সী । যেমনÑ
গর্ভধারণ পোষাভ্যাং তাতাম্মাতা গরীয়সী
মনু সংহিতায় বলেছে-
“পিতুরপ্যধিকা মাতা গর্ভধারণ পোষনাৎ
অতো হি ত্রিষু লোকেষু নাস্তি মাতৃসমো গুরু।”
মাতা শব্দের বুৎপত্তি গত অর্থ হল- ‘মাতৃ, মান, পূজা করা + তৃচ-মখ) অর্থাৎ যিনি পূজিত হন। তিনিই মাতা। মাতা বাংলা শব্দ। অথচ এ শব্দ পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিকটও যেভাবে উচ্চারিত হচ্ছে এতে সৌসাদৃশ্য রয়েছে। যেমন- সংস্কৃত ভাষায় মাতা, পারসী ভাষায়-মাদর, গ্রীক ও ল্যাটিন ভাষায়-মাটর, জার্মান ভাষায় মূর্তের, ইংরেজীতে মাদার। বাংলায় মা।
বাংলা ভাষায় জনক-জননী রূপে মাতা-পিতাকে আখ্যায়িত করা হয়। এজন্য শাস্ত্রে উল্লে¬খ করা হয়েছে - জনক বা পিতা জন্ম দান করে অন্ন দিয়ে সন্তানকে পালন করে বলে পিতা গরীয়ান, পিতার অন্নেই পুত্র দেহ বর্ধিত হয়। এরপর মাতা গর্ভধারণ এবং পোষণ করেন বলে মাতা পিতা হতে অনেক গুণে বন্দিতা হন। এক্ষেত্রেও মাতাকে পিতা অনেক শ্রেষ্ঠতরা বলে গুণ কীর্তন করা হয়েছে।
শাস্ত্রে সপ্ত মাতার কথা উল্লে¬খিত হয়েছে- যেমন জননী, গুরুপতœী; ব্রাহ্মণী, রাজপতœী, গাভী, ধাত্রী, পৃথিবী। মাতা-পিতা নর-নারী রূপে বাংলা ভাষায় অত্যধিক প্রচলিত। তাই নারী জাতি মাতৃ জাতি সম পর্যায়ের শব্দ। বাংলা ও সংস্কৃত ভাষায় মাতা শব্দকে নানা ভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যেমন নারী জাতির জন্য স্ত্রী শব্দটি অত্যন্ত প্রচলিত। স্ত্রী শব্দটি স্তৈ ধাতু যোগে নিষ্পন্ন। এর অর্থ লজ্জা। নারী শব্দের বহুবিধ প্রতিশব্দ রয়েছে যেমন - বামা, অবলা, প্রকৃতি, সুন্দরী, প্রমদা, কামিনী, কামদা, লক্ষণা, যামিনী, মহিলা, দুহিতা, জায়া, মাতা, ভর্তা, মোহিণী, অর্ধাঙ্গিণী, রমণী, রতিদেবী। এসব শব্দের মধ্যে নারী শব্দ ঋগে¦দ গ্রন্থে নেই। তৈত্তিরীয় আরণ্যক শতপথ ব্রাহ্মণ গ্রন্থে নারী শব্দের উল্লেখ আছে। নারী শব্দ নৃ অথবা নর হতে এসেছে। নৃ+অস +দীন = নারী। নারী শব্দের প্রতিশব্দ ‘মা’ শব্দটি অত্যন্ত প্রকট। শাস্ত্রে মাতা কেন বলা হয় একটি শ্লোকে বলা হয়েছে। “পূজ্যতে মান্যতে যা সা মাতা” অর্থাৎ যাকে পূজা ও মান্য করা যায় সেই মাতা। ব্রহ্ম বৈবর্ত পুরাণে ষোল প্রকার মাতার কথার উল্লেখ আছে Ñ
“স্তনদাত্রী গর্ভধাত্রী ভক্ষদাত্রী গুরুরুপ্রিয়া,
অভিষ্টদেবপতœী চ পিতু: পতœী চ কন্যকা,
সগর্ভজা যা ভিগিনী পুত্রপতœী প্রিয়াপ্রসু,
মাতৃর্মাত্রা পিতুর্মাতা সহোদরস্স প্রিয়তথা,
মাতু পিতুশ্চ ভগ্নিণী মাতুলাণী তথৈব চ;
জনানং বেদবিহিতা মাতর পোষ্য স্মৃতা:”
স্তন্যদাত্রী, গর্ভধাত্রী, অন্নদাত্রী, গুরুপতœী ধর্মমাতা, বিমাতা, ভগ্নি পিতার পালিতা কন্যা সহোদর ভগি, পুত্রবধু; শ্বাশুড়ী, নানী, দাদী, ভ্রাতৃবধু পিসী, মাসী ইত্যাদি।
ধর্মসংগীতা গ্রন্থের উলে¬খ আছে-
আত্মামাতা গুরো পতœী ব্রাহ্মণী রাজপতিœকা,
ধেনুধাত্রী তথা পৃথ্বি সপ্তৈতা মাতর :স্মৃতা:
নিজের মাতা গুরুপতœী ব্রাহ্মণের স্ত্রী, রাজার বধু, গুরু, ধাত্রী এবং পৃথিবীও মাতার সৃদশ।
কুমারীদের কৌমারিত্ব নারী জাতির সতীত্ব হল মাতৃজাাতির ভূষণ। কৌমারিত্ব ও সতীত্ব হারালে মাতৃজাতির জীবন ধারণ নিরর্থক । এজন্য শাস্ত্রে বলা হয়েছে।
“আর্ত্তার্ত্বে মুদিতা হৃষ্টে প্রোষিতে মলিনা কৃশা, মৃতে ম্রিয়েত পত্যৌ সা স্ত্রী জ্ঞেয়া পতিব্রতা”। যে রমণী স্বামীর দুঃখের দুঃখিতা। স্বামীর সুখে সুখিণীা স্বামীর প্রবাসে মলিনা ও কৃশাঙ্গী হন এবং স্বামীর মরণে সহমৃতা হন। শাস্ত্রে তাকে পরিব্রত রমণী বলে।
আর্য সভ্যতার প্রথম যুগ হতে যে কয়েক পুণ্যশ্লে¬াকা মাতৃম-লী আপনাদের কর্মদ্বারা পৃথিবীতে আদর্শ স্থাপন করে প্রাত: স্মরণীয় হয়ে আছেন এঁেদর মধ্যে সতীত্ব মহিমান্বিত দক্ষরাজ কন্যা মহর্ষি কশ্যপের পতœী অন্যতমা। বিদূষী ও তাপসী নারী অরুন্ধতী ছিলেন ব্রহ্মার মানস কন্যা। ব্রহ্মবিদ্যা লাভে ধন্যা হন মহর্ষি বাল্মীকির পালিত কন্যা চিরকুমারী আত্রেয়ী। এরূপ ব্রহ্মবাদিণী গার্গী যাজ্ঞবলক্য এর সাথে শাস্ত্র আলোচনা করে অবিনশ্বর কীর্তি রেখে গেছেন। সম্রাট আশোকের অন্ধপুত্র কুনাল নিবার্সিত হলে কাঞ্চন মালাও স্বামীর সাথে নির্বাসন জীবন যাপন করে। প্রতিব্রতা সীতাও রামের বনবাসের সঙ্গিঁনী হয়ে নারী জাতির আদর্শকে সমুন্নত করেছেন। এরূপ মহাকবি কালিদাসের বিদূষী পতœী স্বীয় বিদ্যাবুদ্ধির জন্য বিদ্যাবতী মহারাজ বিক্রমাদিত্যের সভায় সম্মানিত হন। মাতৃকূলে মহিলাদের মধ্যে যশোধরা। বিষ্ণুপ্রিয়া, মৈত্রেয়ী-যশোদা, পটাচারার নাম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে হয়। এর সাথে পাঁচ প্রকার পিতার কথাও ধর্মশাস্ত্রে উলেল্লখিত।
অন্নদাতা, ভয়ত্রাতা, কন্যা দাতা, তথৈব চা, জনয়িতোপনুতা চ পঞ্চৈ তে পিতার:স্মৃতা,
অন্নদাতা ভয়ত্রাতা, কন্যাদাতা, উপবীত দাতা আর জন্মদাতা পিতা রূপে পরিচিত।
ত্রিপিটক গ্রন্থে অন্নদাত্রী হিসেবে যিনি মাতার আসনে অধিষ্ঠিতা হয়েছেন, তিনি হলেন শ্রেষ্ঠী কন্যা সুজাতা। গৌতম সিদ্ধার্থ কঠোর সাধনার পর বুদ্ধত্ব লাভ করার পূর্বে যখন ক্ষুধা-তৃষ্ণায় জর্জরিত হয়ে কঙ্কালসার অবসদেহ নিয়ে প্রাচীন বটবৃক্ষ তলে উপবিষ্ট হলেন, তখন শ্রেষ্ঠী কন্যা সুজাতা তাঁর মন বাসনা পূরণ কল্পে সিদ্ধার্থকে পায়সান্ন দান করেন। সে পায়স ভক্ষণে সিদ্ধার্থ দেহে শক্তি লাভ করেন। বোধিবৃক্ষ মূলে কঠোর সাধনায় রত হয়ে বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে সর্বতৃষ্ণা ক্ষয় করে পরম দুর্লভ বুদ্ধত্ব লাভ করত বুদ্ধ হলেন। এ ঘটনা দ্বারা অন্নদাত্রীরাও যে মাতা সৃদশ যা বলার অপেক্ষা রাখেনা। বর্তমান বৌদ্ধ সমাজেও লক্ষণীয় সে উপাসিকারাই বৌদ্ধ ভিক্ষু সমাজকে যেভাবে খাদ্য ভোজ্য পরিবেশেন করে যাচ্ছেন। এ ব্যাপারে পুরুষ অপেক্ষা মাতৃ জাতির ভূমিকাই সর্বাগ্রে স্থান করে নিয়েছে।
দ্বিতীয়: মহাউপাসিকা বিখাশা ভিক্ষুদের খাদ্য-ভোজ্যদান সহ বস্ত্র, ব্যবহার্য জিনিস পত্র সহ বাসোপযোগী পূর্বারাম দান করে বৌদ্ধ সাহিত্যে স্থান করে নিয়েছেন।
থেরী আম্রপালি ভগবান বুদ্ধসহ শিষ্যদের নিয়ন্ত্রণ পূর্বক লিচ্ছবী রাজ কুমাদের অনুরোধ উপেক্ষা করে পিন্ডদান করে যশস্বিনী হয়েছেন। এরূপ আরো অনেক মহিয়সী মহিলা বুদ্ধ সহ শ্রাবক সংঘকে অন্নদান করে মহাপুণ্যভাগী হয়েছেন, যা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
ধর্মদাত্রী হিসেবে মহাপ্রজাপতি গৌতমীর অবদান কোন মতে কম নহে। তিনি পাঁচশত শাক্য ললনাদেরকে নিয়ে আয়ুস্মান আনন্দের মধ্যস্থতায় ভগবান বুদ্ধের অনুমতি ক্রমে ভিক্ষুণী ধর্মে প্রব্রজিতা হয়ে বুদ্ধ শাসনের শ্রীবৃদ্ধি সাধন করেছিলেন। স্নেহের ড. জিনবোধি ভিক্ষুর মা সত্যি অতিশয় সহজ-সরল, ধর্মপরায়ণ, গুরুগত প্রাণ এবং আদর্শ মহিলা তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তাঁর সঙ্গে যতবার সাক্ষাৎ হয়েছে তাঁর আন্তরিকতা ও গুরুপূজার সুন্দর মানসিকতা দেখে আমি নিজেও অত্যন্ত অভিভূত হয়েছি। তাঁর চিন্তা-চেতনা এত সমাজ ও সদ্ধধর্মহিতৈষী যা কম উপাসক-উপাসিকার কাছ থেকে পাওয়া যায়। এছাড়াও সমাজ ও সদ্ধর্মের অগ্রগতিতে তাঁর অবদান ছিল অতুলনীয়। সেই ত্যাগের মধ্যে স্বার্থের লেশমাত্রই পরিলক্ষিত হয়নি। আত্মঅহংকার, আত্মাভিমান বলতে কিছুই ছিল না। সেদিক থেকে অতীতের ধার্মিক উপাসিকার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে এসেছেন আজীবন। তাঁর মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন তিনি সত্যিকারের পুণ্যবর্তী ও ধার্মিক উপাসিকার আদর্শকে লালন করতে না পারলে এ জাতীয় সমাবেশ, কর্মের স্বীকৃতি, আদর্শের মূল্যায়ণ আদৌ সম্ভব হত কিনা বলা কঠিন। এদিকে তিনি বরেণ্য ও স্মরণীয় মাতা হিসেবে অনেকের কাছে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন। একারণে মাতৃজাতির গুণ মহিমা সর্বকালে কীর্তিত হচ্ছে।
এ বিশ্ব ব্রহ্মা- মাতৃ দেবী সদৃশ। তাই বৈদিক যুগ হতে সম্প্রতি মুনি ঋষি সাধক কবি সাহিত্যিক ভাবুক সকলেই মাতা-তথা মাতৃজাতিকে দেবীর আসনে প্রতিষ্ঠিত করে, মাতৃ গুণ কীর্তন করে আসছেন। পৃথিবীতে যে কয়েকজন মহাপুরুষ জন্ম নিয়েছেন তাঁদের মাতা ছিলেন পুণ্যশ্লে¬াকা, বিদুষী ধার্মিক এবং সদ্চরিত্রের অধিকারী। সে সব ধার্মিক প্রসবিনী নারীরাই গুণ ধর পুত্র প্রসব করে এ পৃথিবীকে মহামান্বিত করেছেন।
বৈদিক সংস্কৃত ও পালি সাহিত্য ব্যতীত ও পৃথিবীর বিভিন্ন সাহিত্যে মাতৃ জাতির গুণ কীর্তিত হয়েছে। পরিশুদ্ধ পাত্রে বিশুদ্ধ আহার্য দ্রব্য যেমন বিকৃত হয় না। তেমনি সতি সাধ্বী মাতৃজঠরে ধার্মিক পিতার বীর্যপাতে সদ্পুত্রের জন্ম হয়ে থাকে। এ কারণে মাতৃ লাভের জন্য কুমারীরা সতীত্বের ব্রত পরায়ণা হয়ে আপন মনুষ্য জীবনকে ধন্য করে। ভাবীকালে এহেন নারীই সৎ ধার্মিক পুত্র প্রসব করে, এ মলিন পৃথিবীকে ধন্য করে নিজেই মানুষের অন্তর জগতের বেদীমূলে আসন করে নেন যার ব্যাখ্যা দেওয়া কারো পক্ষে সম্ভব নয়। পালি সাহিত্যে বুদ্ধ মাতা মহামায়া, স্তন্য দায়িনী মাতা মহাপ্রজাপতি গৌতমী, রাহুল মাতা যশোধরা, সারিপুত্রের মাতা, মৌদ্গলায়নের মাতা, মোদ্গলীসহ আরো অনেক মাতা আছেন যাঁরা ধার্মিক পুণ্যশ্লোকা মহিলা ছিলেন বলেই বুদ্ধ শাসনে তাঁদের পুত্রদের প্রবেশের দ্বারা এ শাসন পৃৃথিবীতে আজও ধর্মজ্যোতি বিকশিত করে সমুন্নত রয়েছে। এরপরও মহাউপাসিকা বিশাখা, তাঁর পুণ্য প্রভায় বুদ্ধ শাসনের যে কৃতিত্ব রেখেছেন সে কারণে তিনি পালি সাহিত্যে একজন আদর্শ নারী রূপে চিহিৃত হয়ে রয়েছেন। এছাড়া থেরীগাথা গ্রন্থের যে কয়েকজন আত্মত্যাগী সাধিকা পালি সাহিত্যে আপনাদের সচ্চরিতা ও সাধনা দ্বারা অমরত্ব লাভ করেছেন। এঁদের মধ্যে থেরী ধম্মদীনা, সুমনা, উত্তরা, কৃশাগৌতমী, উৎপল বর্ণা, পুন্নিকা, আ¤্রপালি, রোহিনী, সুভা, ইসিদাসী ও সুমেধা অনন্যা।
সনাতন ধর্ম সাহিত্যে মাতা সম্পর্কে বলা হয়েছে Ñ‘পূজ্যতে মান্যত যা সা মাতা” অর্থাৎ যাকে মান্য করন এবং পূজা করা যায় তিনিই মাতা। পালি সাহিত্যেও মাতৃ বন্দনা গাথায় মাতার উচ্চ প্রসংশা করেছেন। মাতা কত ত্যাগ স্বীকার করে সন্তান গর্ভে ধারণ করেন এবং প্রসবের পর স্তন্য দুগ্ধ পান করিয়ে সন্তানকে লালন-পালন করেন সে কথা মাতৃ বন্দনায় পালি ভাষায় উচ্চারিত হয়েছে Ñ
“কত্বান কায়ে রুধিরং খীরং যা সিনেহ পূরিতা,
পায়েত্বা মং সংবড্ডেসি বন্দে তং মম মাতরং
দস মাসে উরে কত্বা খীরং পায়েত্বা বাড্ডেসি,
দিবারত্তিঞ্চ পোসেতি মাতুপাদং নামাম্যহং
যে মাতা নিজ রক্ত হতে উৎপন্ন স্নেহ পরায়ণ হয়ে দুগ্ধ পান করিয়ে আমাকে লালন পালন করিয়েছেন যে আমার মাতাকে আমি বন্দনা করছি। দশমাস গর্ভে ধারণ করে দুগ্ধদানে বর্ধনকারী ও রাত দিন ব্যাপীি পোষণকারিণী; সে আমার মাতার পদমূলে নমস্কার করছি।
একথা সর্ব্বৈ সত্য যে, জাগতিক জগতে মাতা পিতার দৈহিক মিলনের মাধ্যমেই মানব সন্তানরা জন্ম গ্রহণ করেন। তাই মাতা পিতার মধ্যে পিতা অপেক্ষা মাতার গুণ অনেক বেশি বলে সনাতন শাস্ত্রে উল্লে¬খিত। সনাতন ধর্মে বলা হচ্ছে, যে সমাজে নারী জাতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয় না, যে সমাজে নির্যাতিতা নারীর অশ্রু ঝরে, নারী জাতির সতীত্ব নষ্ট হয়, অপহরিত হয়, ধর্ষিত হয়, সে সমাজে অবনতি ঘটে। দেখা যায় লংকার রাজা রাবন সীতাকে হরণ করে এমন কি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানীরা বাঙালি নারী জাতির সম্ভ্রম নষ্ট করায় তাদেরকে বিরাট মূল্য দিতে হয়েছে। শাস্ত্রে একথাও উল্লে¬খ আছে যে; মাতৃ জাতিকে সম্মান করলে দেবতারাও সন্তুষ্ট হয়ে আশীর্বাদ প্রদান করলে সে সমাজের অপকার ও অমঙগল হয় না। তাই মনু শাস্ত্রে বলা হয়েছেÑ
যত্র-নার্য্যস্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতার
যত্রৈতাস্তু ন পূজন্তে সর্ব্বাস্তত্রা ফলার ক্রিয়া।
নারীর গুরুত্ব অত্যধিক বলেই সাহিত্যে, ধর্মীয় শাস্ত্রে, মাতার নাম উচ্চারিত হয়। মাতার নামে পুত্ররা পরিচিতি লাভ করে। যেমন সারিপুত্র, মৌদ্গলীপুত্র, কাত্যায়না, সীতারাম, লহ্মœী নারায়ণ কালিদাসের বিখ্যাত কাব্য গ্রন্থ রঘুবংশ গ্রন্থে বন্দনা গাথায় বলা হয়েছে-
“জগত পিতরৌ বন্দে পার্বতী পরমেশ্বরৌ।”
এতদ্ সত্ত্বেও চানক্য শ্লে¬াকে পিতাকে মাতা অপেক্ষা ঊর্দ্ধ স্থানে স্থান দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে,“পিতা ধর্মঃপিতা স্বর্গঃপিতাহি পরম তপঃ। পিতা প্রীতিমাপন্নে পিয়ন্তে সর্ব দেবতা” পিতাই ধর্ম পিতাই স্বর্গ এবং পিতাই পরম তপস্যা। পিতা সন্তুষ্ট হলে দেবতারাও সন্তুষ্ট হন। কিন্তু অন্যত্র মনু বলছে মাতা গর্ভধারণ এবং পোষণ করেন বলে তিনি গরীয়সী । যেমনÑ
গর্ভধারণ পোষাভ্যাং তাতাম্মাতা গরীয়সী
মনু সংহিতায় বলেছে-
“পিতুরপ্যধিকা মাতা গর্ভধারণ পোষনাৎ
অতো হি ত্রিষু লোকেষু নাস্তি মাতৃসমো গুরু।”
মাতা শব্দের বুৎপত্তি গত অর্থ হল- ‘মাতৃ, মান, পূজা করা + তৃচ-মখ) অর্থাৎ যিনি পূজিত হন। তিনিই মাতা। মাতা বাংলা শব্দ। অথচ এ শব্দ পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিকটও যেভাবে উচ্চারিত হচ্ছে এতে সৌসাদৃশ্য রয়েছে। যেমন- সংস্কৃত ভাষায় মাতা, পারসী ভাষায়-মাদর, গ্রীক ও ল্যাটিন ভাষায়-মাটর, জার্মান ভাষায় মূর্তের, ইংরেজীতে মাদার। বাংলায় মা।
বাংলা ভাষায় জনক-জননী রূপে মাতা-পিতাকে আখ্যায়িত করা হয়। এজন্য শাস্ত্রে উল্লে¬খ করা হয়েছে - জনক বা পিতা জন্ম দান করে অন্ন দিয়ে সন্তানকে পালন করে বলে পিতা গরীয়ান, পিতার অন্নেই পুত্র দেহ বর্ধিত হয়। এরপর মাতা গর্ভধারণ এবং পোষণ করেন বলে মাতা পিতা হতে অনেক গুণে বন্দিতা হন। এক্ষেত্রেও মাতাকে পিতা অনেক শ্রেষ্ঠতরা বলে গুণ কীর্তন করা হয়েছে।
শাস্ত্রে সপ্ত মাতার কথা উল্লে¬খিত হয়েছে- যেমন জননী, গুরুপতœী; ব্রাহ্মণী, রাজপতœী, গাভী, ধাত্রী, পৃথিবী। মাতা-পিতা নর-নারী রূপে বাংলা ভাষায় অত্যধিক প্রচলিত। তাই নারী জাতি মাতৃ জাতি সম পর্যায়ের শব্দ। বাংলা ও সংস্কৃত ভাষায় মাতা শব্দকে নানা ভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যেমন নারী জাতির জন্য স্ত্রী শব্দটি অত্যন্ত প্রচলিত। স্ত্রী শব্দটি স্তৈ ধাতু যোগে নিষ্পন্ন। এর অর্থ লজ্জা। নারী শব্দের বহুবিধ প্রতিশব্দ রয়েছে যেমন - বামা, অবলা, প্রকৃতি, সুন্দরী, প্রমদা, কামিনী, কামদা, লক্ষণা, যামিনী, মহিলা, দুহিতা, জায়া, মাতা, ভর্তা, মোহিণী, অর্ধাঙ্গিণী, রমণী, রতিদেবী। এসব শব্দের মধ্যে নারী শব্দ ঋগে¦দ গ্রন্থে নেই। তৈত্তিরীয় আরণ্যক শতপথ ব্রাহ্মণ গ্রন্থে নারী শব্দের উল্লেখ আছে। নারী শব্দ নৃ অথবা নর হতে এসেছে। নৃ+অস +দীন = নারী। নারী শব্দের প্রতিশব্দ ‘মা’ শব্দটি অত্যন্ত প্রকট। শাস্ত্রে মাতা কেন বলা হয় একটি শ্লোকে বলা হয়েছে। “পূজ্যতে মান্যতে যা সা মাতা” অর্থাৎ যাকে পূজা ও মান্য করা যায় সেই মাতা। ব্রহ্ম বৈবর্ত পুরাণে ষোল প্রকার মাতার কথার উল্লেখ আছে Ñ
“স্তনদাত্রী গর্ভধাত্রী ভক্ষদাত্রী গুরুরুপ্রিয়া,
অভিষ্টদেবপতœী চ পিতু: পতœী চ কন্যকা,
সগর্ভজা যা ভিগিনী পুত্রপতœী প্রিয়াপ্রসু,
মাতৃর্মাত্রা পিতুর্মাতা সহোদরস্স প্রিয়তথা,
মাতু পিতুশ্চ ভগ্নিণী মাতুলাণী তথৈব চ;
জনানং বেদবিহিতা মাতর পোষ্য স্মৃতা:”
স্তন্যদাত্রী, গর্ভধাত্রী, অন্নদাত্রী, গুরুপতœী ধর্মমাতা, বিমাতা, ভগ্নি পিতার পালিতা কন্যা সহোদর ভগি, পুত্রবধু; শ্বাশুড়ী, নানী, দাদী, ভ্রাতৃবধু পিসী, মাসী ইত্যাদি।
ধর্মসংগীতা গ্রন্থের উলে¬খ আছে-
আত্মামাতা গুরো পতœী ব্রাহ্মণী রাজপতিœকা,
ধেনুধাত্রী তথা পৃথ্বি সপ্তৈতা মাতর :স্মৃতা:
নিজের মাতা গুরুপতœী ব্রাহ্মণের স্ত্রী, রাজার বধু, গুরু, ধাত্রী এবং পৃথিবীও মাতার সৃদশ।
কুমারীদের কৌমারিত্ব নারী জাতির সতীত্ব হল মাতৃজাাতির ভূষণ। কৌমারিত্ব ও সতীত্ব হারালে মাতৃজাতির জীবন ধারণ নিরর্থক । এজন্য শাস্ত্রে বলা হয়েছে।
“আর্ত্তার্ত্বে মুদিতা হৃষ্টে প্রোষিতে মলিনা কৃশা, মৃতে ম্রিয়েত পত্যৌ সা স্ত্রী জ্ঞেয়া পতিব্রতা”। যে রমণী স্বামীর দুঃখের দুঃখিতা। স্বামীর সুখে সুখিণীা স্বামীর প্রবাসে মলিনা ও কৃশাঙ্গী হন এবং স্বামীর মরণে সহমৃতা হন। শাস্ত্রে তাকে পরিব্রত রমণী বলে।
আর্য সভ্যতার প্রথম যুগ হতে যে কয়েক পুণ্যশ্লে¬াকা মাতৃম-লী আপনাদের কর্মদ্বারা পৃথিবীতে আদর্শ স্থাপন করে প্রাত: স্মরণীয় হয়ে আছেন এঁেদর মধ্যে সতীত্ব মহিমান্বিত দক্ষরাজ কন্যা মহর্ষি কশ্যপের পতœী অন্যতমা। বিদূষী ও তাপসী নারী অরুন্ধতী ছিলেন ব্রহ্মার মানস কন্যা। ব্রহ্মবিদ্যা লাভে ধন্যা হন মহর্ষি বাল্মীকির পালিত কন্যা চিরকুমারী আত্রেয়ী। এরূপ ব্রহ্মবাদিণী গার্গী যাজ্ঞবলক্য এর সাথে শাস্ত্র আলোচনা করে অবিনশ্বর কীর্তি রেখে গেছেন। সম্রাট আশোকের অন্ধপুত্র কুনাল নিবার্সিত হলে কাঞ্চন মালাও স্বামীর সাথে নির্বাসন জীবন যাপন করে। প্রতিব্রতা সীতাও রামের বনবাসের সঙ্গিঁনী হয়ে নারী জাতির আদর্শকে সমুন্নত করেছেন। এরূপ মহাকবি কালিদাসের বিদূষী পতœী স্বীয় বিদ্যাবুদ্ধির জন্য বিদ্যাবতী মহারাজ বিক্রমাদিত্যের সভায় সম্মানিত হন। মাতৃকূলে মহিলাদের মধ্যে যশোধরা। বিষ্ণুপ্রিয়া, মৈত্রেয়ী-যশোদা, পটাচারার নাম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে হয়। এর সাথে পাঁচ প্রকার পিতার কথাও ধর্মশাস্ত্রে উলেল্লখিত।
অন্নদাতা, ভয়ত্রাতা, কন্যা দাতা, তথৈব চা, জনয়িতোপনুতা চ পঞ্চৈ তে পিতার:স্মৃতা,
অন্নদাতা ভয়ত্রাতা, কন্যাদাতা, উপবীত দাতা আর জন্মদাতা পিতা রূপে পরিচিত।
ত্রিপিটক গ্রন্থে অন্নদাত্রী হিসেবে যিনি মাতার আসনে অধিষ্ঠিতা হয়েছেন, তিনি হলেন শ্রেষ্ঠী কন্যা সুজাতা। গৌতম সিদ্ধার্থ কঠোর সাধনার পর বুদ্ধত্ব লাভ করার পূর্বে যখন ক্ষুধা-তৃষ্ণায় জর্জরিত হয়ে কঙ্কালসার অবসদেহ নিয়ে প্রাচীন বটবৃক্ষ তলে উপবিষ্ট হলেন, তখন শ্রেষ্ঠী কন্যা সুজাতা তাঁর মন বাসনা পূরণ কল্পে সিদ্ধার্থকে পায়সান্ন দান করেন। সে পায়স ভক্ষণে সিদ্ধার্থ দেহে শক্তি লাভ করেন। বোধিবৃক্ষ মূলে কঠোর সাধনায় রত হয়ে বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে সর্বতৃষ্ণা ক্ষয় করে পরম দুর্লভ বুদ্ধত্ব লাভ করত বুদ্ধ হলেন। এ ঘটনা দ্বারা অন্নদাত্রীরাও যে মাতা সৃদশ যা বলার অপেক্ষা রাখেনা। বর্তমান বৌদ্ধ সমাজেও লক্ষণীয় সে উপাসিকারাই বৌদ্ধ ভিক্ষু সমাজকে যেভাবে খাদ্য ভোজ্য পরিবেশেন করে যাচ্ছেন। এ ব্যাপারে পুরুষ অপেক্ষা মাতৃ জাতির ভূমিকাই সর্বাগ্রে স্থান করে নিয়েছে।
দ্বিতীয়: মহাউপাসিকা বিখাশা ভিক্ষুদের খাদ্য-ভোজ্যদান সহ বস্ত্র, ব্যবহার্য জিনিস পত্র সহ বাসোপযোগী পূর্বারাম দান করে বৌদ্ধ সাহিত্যে স্থান করে নিয়েছেন।
থেরী আম্রপালি ভগবান বুদ্ধসহ শিষ্যদের নিয়ন্ত্রণ পূর্বক লিচ্ছবী রাজ কুমাদের অনুরোধ উপেক্ষা করে পিন্ডদান করে যশস্বিনী হয়েছেন। এরূপ আরো অনেক মহিয়সী মহিলা বুদ্ধ সহ শ্রাবক সংঘকে অন্নদান করে মহাপুণ্যভাগী হয়েছেন, যা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
ধর্মদাত্রী হিসেবে মহাপ্রজাপতি গৌতমীর অবদান কোন মতে কম নহে। তিনি পাঁচশত শাক্য ললনাদেরকে নিয়ে আয়ুস্মান আনন্দের মধ্যস্থতায় ভগবান বুদ্ধের অনুমতি ক্রমে ভিক্ষুণী ধর্মে প্রব্রজিতা হয়ে বুদ্ধ শাসনের শ্রীবৃদ্ধি সাধন করেছিলেন। স্নেহের ড. জিনবোধি ভিক্ষুর মা সত্যি অতিশয় সহজ-সরল, ধর্মপরায়ণ, গুরুগত প্রাণ এবং আদর্শ মহিলা তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তাঁর সঙ্গে যতবার সাক্ষাৎ হয়েছে তাঁর আন্তরিকতা ও গুরুপূজার সুন্দর মানসিকতা দেখে আমি নিজেও অত্যন্ত অভিভূত হয়েছি। তাঁর চিন্তা-চেতনা এত সমাজ ও সদ্ধধর্মহিতৈষী যা কম উপাসক-উপাসিকার কাছ থেকে পাওয়া যায়। এছাড়াও সমাজ ও সদ্ধর্মের অগ্রগতিতে তাঁর অবদান ছিল অতুলনীয়। সেই ত্যাগের মধ্যে স্বার্থের লেশমাত্রই পরিলক্ষিত হয়নি। আত্মঅহংকার, আত্মাভিমান বলতে কিছুই ছিল না। সেদিক থেকে অতীতের ধার্মিক উপাসিকার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে এসেছেন আজীবন। তাঁর মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন তিনি সত্যিকারের পুণ্যবর্তী ও ধার্মিক উপাসিকার আদর্শকে লালন করতে না পারলে এ জাতীয় সমাবেশ, কর্মের স্বীকৃতি, আদর্শের মূল্যায়ণ আদৌ সম্ভব হত কিনা বলা কঠিন। এদিকে তিনি বরেণ্য ও স্মরণীয় মাতা হিসেবে অনেকের কাছে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন। একারণে মাতৃজাতির গুণ মহিমা সর্বকালে কীর্তিত হচ্ছে।
No comments
Post a Comment