ভিক্ষুদের সামাজিক কাজে উদাসীনতার অভিযোগ প্রসঙ্গে

উপতিষ্য ভিক্ষু

ভিক্ষু সমাজ আর দায়ক সমাজ পারস্পরিক নির্ভরশীল হলেও একজিনিস নয়। ভিক্ষুদের নিজস্ব একটা জীবন ব্যবস্থা আছে যা দায়ক সমাজ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভিক্ষুরাও মানুষ এবং সমাজেই বাস করে। তাই ভিন্ন জীবন ব্যবস্থা হলেও বিভিন্ন সামাজিক অসঙ্গতির স্বীকার তারাও কম বেশি হয় অনিবার্যভাবে। ফলত সামাজিক অসঙ্গতি সমাধানে তারাও তৎপর । তবে এই তৎপরতা দায়কদের তৎপরতার মত নয়। তাঁরা তাঁদের নিজস্ব অবস্থান থেকেই তাঁদের সাধ্যমত ধর্মীয় কাজের পাশাপাশি সামাজিক কাজ করে যায়। এখানে লক্ষ্য রাখা দরকার একটি শব্দ "সাধ্যমত"। কারণ সবাই ভিক্ষু হলেও একই রকম জ্ঞানী পণ্ডিত হবে এমন আশা আমরা করতে পারিনা। আর সকল ভিক্ষুর ওরিজিন হচ্ছে দায়ক সমাজ। দায়ক সমাজের বিভিন্ন রকমের ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে তাঁরা ভিক্ষু সমাজে আসে বলে তাঁদের মন মানসিকতায় পটভূমির শ্রেণীগত বৈশিষ্ট থেকেই যায়। কাজেই আপাত দৃষ্টিতে সকল ভান্তেকে একই ইউনিফর্মে দেখা গেলেও চিন্তায় চেতনায় একই রকম আশা করা বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়।
ভিক্ষু সমাজ বিশাল একটি সমাজ। তাকে জানার জন্য আপনার সাত দিন বা এক মাসের প্রব্রজ্যা জীবন কখনই যথার্থ নয়। আর উপরে উপরে দেখে জানার তো প্রশ্নই আসে না। আপনি যদি কোন বিহারে কিছুদিন শ্রমণ হওয়ার পর সেখানে যা দেখেছেন তার ভিত্তিতে পুরো ভিক্ষু সমাজকে মূল্যায়ন করার চেষ্টা করেন তাহলে আপনার অনুসিদ্ধান্ত যে ভুল হবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়।
বৌদ্ধ ধর্ম বিমুক্তি লাভের জন্য সন্ন্যাস ধর্মকে প্রাধান্য দিলেও সামাজিক কাজে এই ধর্ম উদাসীন নয়। এর প্রমাণ আমরা শুধু বৌদ্ধ ইতিহাসে কেন পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল ক্ষেত্রে দেখেছি এখনো দেখতে পায়। এ কথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক মানবিক পরিবেশ উন্নয়নে কোথাও ভিক্ষু সংঘের সুপ্রচেষ্টার স্পর্শ বাদ যায়নি। আজকে শিক্ষা বলি কিংবা রাজনীতি, অর্থনীতি, পরিবেশসহ সকল ক্ষেত্রে ভিক্ষু সংঘের অবদান আমরা অস্বীকার করতে পারিনা পারবনা।
ধর্মকে আদি সামন্ত যুগ থেকেই শাসক শ্রেণী বা সমাজের বুর্জোয়া শ্রেণী ব্যবহার করেছে বা করার চেষ্টা করেছে এটা সত্য। তাই বিভিন্ন সময় ধর্ম সমালোচিত হয়েছে শাসকের অস্ত্র হিসেবে। ক্ষুদ্র পরিধিতে দেখলে দেখা যায়, আমাদের জুম্ম সমাজেও ভিলেজ পলিটিক্স এর ক্ষেত্রে ধর্মকে সুক্ষভাবে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এর পাশাপাশি এটাও তো সত্য যে ধর্মকে কেন্দ্র করেই মানবিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে, যেখানে সমাজের অবহেলিত বঞ্চিতরা আশ্রয় পেয়ে উঠে আসার সুযোগ পায়। এই ধর্মকে কেন্দ্র করেই আমাদের মত ছোট জাতিগুলো ঠিকে থাকার প্লাটফর্ম পায়।
অনেকের যুক্তি বুদ্ধ তাঁর দর্শনকে এভাবে শিক্ষা দেননি যেভাবে এখন ভিক্ষুরা বিহারে বসে বসে খাচ্ছে রাজার চেয়েও আরামে!! তারা বুদ্ধের দর্শনকে সম্ভবত স্কুল কলেজের দর্শনের মত মনে করে!! কিন্তু বুদ্ধ দর্শনটাতো কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের মত নয়। এরকম হলে তো বুদ্ধ গৃহ ত্যাগ না করে প্লেটোর মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বানিয়ে শিক্ষা দিতেন। আর সাধারণ দর্শনকে বলতেন না গেইম অফ আর্গুমেন্ট বা তর্কের খেলা।
সবশেষে এটা বলবো মাথা ব্যাথার জন্য প্যারাসিটামল খাওয়াটা সমাধান হতে পারে, মাথা কেটে ফেলাটা নয়। ধর্মের অপব্যবহারকারীদেরকে সমালোচনা করা যেতে পারে কিন্তু ধর্ম বা এর বাহক পুরো সংঘকে নয়। পুরো সংঘই যদি দোষী সাব্যস্ত হবে তাহলে সংঘের নয়গুনের মধ্যে ''আহুনেয়্য, পাহুনেয়্য'' হল কেন?? অতএব পাপের সমালোচনা হোক নির্দিষ্টভাবে ধর্ম ও সমাজের স্বার্থে গণহারে সংঘকে নয়। সংঘের সমালোচনায় অকুশল হয় অনেক, কারণ এতে বুদ্ধও সমালোচিত হন। যাদের বৌদ্ধ ধর্ম ব্যাপারে ন্যুনতম জ্ঞান আছে তারা এটা বুঝেন। একে রাজনৈতিক দল বা মতবাদের সংঘে তুলনা চলে না।
সকলকে মেত্তা।
সব্বে সত্তা সুখিতা হন্তু।
২৮/১০/২০১৪

No comments

Theme images by 5ugarless. Powered by Blogger.