অবহেলিত বাংলাদেশের রাখাইন বৌদ্ধ
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সৈনিক পটুয়াখালী জেলা রাখাইন সমাজকল্যাণ সমিতি প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার ৮২ বছর বয়সী ভাষাসৈনিক ভারাক্রান্ত মনে সম্প্রতি স্বপ্ন ও আফসোসের কথাগুলোই জানিয়েছেন অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলানিউজের কাছে। তার সেই সাক্ষাতকার এখানে হুবহু প্রকাশ করা হলো। -সম্পাদক।
‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, দিতে হবে দিতে হবে’-এমন দাবি নিয়ে বাংলা ভাষার জন্য রাজপথে নেমেছিলাম, মিছিলে মিছিলে আন্দোলন জমিয়ে তুলেছিলাম বৃহত্তর বরিশালে। ভাষা আন্দোলনের জন্য মানুষকে সোচ্চার করতে মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়েছি। বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে বাধার সম্মুখীন হলেও স্কুল পালিয়ে মিছিলে নেমেছি। সেদিন ভেবেছিলাম বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর আমাদের ভাষাও (রাখাইন) প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করবে। কোনো বৈষম্য ছাড়াই বাঙালিদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে পারবো। কিন্তু ভাষার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ তো দূরের কথা, আমরাই অস্তিত্ব সংকটে পড়ে গেছি।’
এক আফসোসের নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেলেন রাখাইন সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সংগ্রামরত ভাষাসৈনিক উ সুয়ে হাওলাদার।
‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ দাবিতে যখন ঢাকার রাজপথে তীব্র আন্দোলন-সংগ্রাম চলছিলো, তখন বরিশালে বাঙালিদের সঙ্গে মিলে রাষ্ট্র ভাষা বাংলা রাখার দাবিতে মিছিলে ১৮ বছর বয়সেই যোগ দেন উ সুয়ে হাওলাদার। আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে রাখাইন সম্প্রদায় উন্নতির সোপানে পা রাখতে পারবে, এমন স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরেও এই স্বপ্ন যেনো স্বপ্নই রয়ে গেল। পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার ৮২ বছর বয়সী এই ভাষাসৈনিক ভারাক্রান্ত মনে তার স্বপ্ন ও আফসোসের কথাগুলোই বললেন বাংলানিউজের কাছে।
রাখাইন সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে উ সুয়ে তৈরি করেছেন পটুয়াখালী জেলা রাখাইন সমাজকল্যাণ সমিতি। এই সংগঠনের সভাপতি পদে দায়িত্ব পালন করছেন তিনিই।
উ সুয়ে বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের পর থেকে স্থানীয় বাঙালিরা আমাদের ওপর অনেক অত্যাচার করে আসছে। আমাদের জায়গা-জমি, উপাসনালয়, শশ্মান সব জোরপূর্বক দখল করছে। আমাদের উচ্ছেদ করার জন্য মিথ্যা মামলা দিচ্ছে। এতে রাখাইনরা সর্বস্ব হারিয়ে এখান থেকে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। বড় দুঃখ লাগে এদেশের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করলাম, ভাষার জন্য আন্দোলন করলাম। অথচ আমরা আদিবাসীরাই আমাদের অধিকার পাই না। এই কি ফল? এই কি প্রতিদান?
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে কীভাবে যু্ক্ত হলেন? জবাবে এ ভাষাসৈনিক বলেন, তখন আমার বয়স ছিলো ১৮ বছর। বরিশাল ব্যাপ্টিস্ট মিশন স্কুল ম্যাট্রিকুলেশনের (এসএসসি) পরীক্ষার্থী ছিলাম। আন্দোলন-সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ার কারণে সে বছর পরীক্ষা দিতে পারিনি। মিছিলে নেমেছিলাম বরিশালের বাঙালিদের সঙ্গে।
বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলনে নামতে কোনো চেতনা কাজ করেছে উ সুয়ের মধ্যে? তার জবাব, আমি ভেবেছি আমাদের সমাজের কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষের মুক্তি এবং রাষ্ট্র ভাষা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আন্দোলনে নামা দরকার। এই দেশের প্রতি ভালোবাসাটাও অবশ্যই বড় কাজ করেছে। মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য বুকে সাহস নিয়েই আন্দোলন করেছি। সবাই যেন নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি আঁকড়ে রাখতে পারে সেটাই ছিলো আমার আন্দোলনের মূল লক্ষ্য। বরিশালের রাখাইনদের মধ্য থেকে আমি একাই এই সংগ্রামে নেমেছিলাম।
কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কি না জানতে চাইলে ভাষাসৈনিক উ সুয়ে বলেন, আমি ভাষা আন্দোলনের আগে থেকেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। সে সময় আমি ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে চলাফেরা করতাম। ১৯৫৭ সালে বরিশাল জেলায় আব্দুর রব সেরনিয়াবাদের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সঙ্গে ছিলাম। আমার মনে হয়েছিলো এটা একটি প্রগতিশীল দল, মেহনতি মানুষের দল। এজন্য অন্য বন্ধুদের সঙ্গে তাদের (ন্যাপ) পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। ১৯৭০ সালের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে অংশ নিয়েছি। ন্যাপের পক্ষ থেকে নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। সে সময় ওয়ালি খান, তার গ্রুপের প্রফেসর মোজাফ্ফর, পঙ্কজ ভট্টাচার্যও ছিলেন ন্যাপে। আমি তখন কুঁড়েঘরের পক্ষে নির্বাচনে অংশ নিয়েছি।
স্বাধীনতার পর রাখাইন সম্প্রদায়ের কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি না? আপনাদের আশার কোনো প্রতিফলন কি ঘটেছে?
উ সুয়ের আশাহত জবাব, এ আদিবাসী সম্প্রদায় (রাখাইন) ১৭৮৪ সাল থেকে বাংলাদেশে বসবাস করছে। এখানকার জঙ্গল কেটে, নদীর মাছ ও লতাপাতা নিয়েই জীবন ধারণ করে আসছি আমরা। ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তির কথা বললেন। কিন্তু স্বাধীনতার পর আমাদের সম্প্রদায়ের কোনো উন্নতি হয়নি। আমাদের সম্প্রদায়ের সবাই কিন্তু আশা করেছিলেন যে একটা পরিবর্তন আসবে। কিন্তু এ আশার কোনো প্রতিফলিত হচ্ছে না।
রাখাইনদের সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ কী? উ সুয়ে মনে করেন, ভাষা, সংস্কৃতি ধর্মের বিষয়ে আমরা একটু আলাদা। রাখাইনদের বিভিন্ন ধরনের উৎসব আছে। আমাদের রাখাইনরা গ্রামে বসবাস করে, এই গ্রামকে রক্ষার জন্য প্রত্যেক গ্রামে ন্যাতার পূজা করা হয়, স্থল দেবতা ও গঙ্গা, সূর্য, চন্দ্র, বাতাস, বৃষ্টি দেবতাদের আমরা পূজা করি। আমাদের খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থান একটু ভিন্ন। এগুলোতে যদি কোনো আঘাত আসে সেখানে থাকতে পারি না। কারণ আমাদের জমি নিয়ে দখল করছে স্থানীয়রা। এ বিষয়ে প্রশাসন নিরব থাকছে। অনেকে মগ বলে উপহাস করে আমাদের। এসব কারণেই আমাদের সংখ্যা শূন্যের কোঠায় চলে যাচ্ছে।
রাখাইন নেতা উ সুয়ে আরও বলেন, ব্রিটিশ পিরিয়ড থেকেই আমাদের জন্য ‘বেঙ্গল টেনেনসি অ্যাক্ট’ নামে একটা ভিন্ন আইন আছে। এটা স্পেশালি সমতলের আদিবাসীদের জন্য। এটি অনুসারে আইন প্রযোজ্য হচ্ছে না। ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং একটি কমিটির কথা প্রশাসনকে বলে আসছি। এটি না হলে আমরা আর এখানে থাকতে পারবো না। বিভিন্ন সময় মিষ্টি কথা বললেও কাজের বেলায় কিছু নেই।
ভাষাসৈনিক উ সুয়ে হাওলাদার বলেন, আমাদের মন্দির, শ্মশানের জায়গাগুলো বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের কোনো শ্মশান নাই। ভুয়া দলিল করে অনেকেই আমাদের জমি-জমা দখল করে নিয়েছে। আমরা খুব কষ্টে আছি। আদিবাসীদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে কিয়াং, ইন্দিরা এগুলো পুনঃরুদ্ধার করতে হবে।
রাখাইনদের একটি সুন্দর জীবন উপহার দিতে এবং তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান ভাষাসৈনিক উ সুয়ে।
সূত্র : ধম্মইনফো

No comments
Post a Comment