বেতছড়ি রিসসো কোসেই কাই সেন্টার সেটেলাররা ভেঙ্গে দিয়েছে

গত রাত্রে অথার্ৎ ১৬ জুলাই  সেটেলাররা বেতছড়ি রিসসো কোসেই কাই সেন্টারটি ভেঙ্গে দিয়েছে বলে জানা যায়। অথচ গত ২৩/০৬/১৪ইং পুলিশ সুপার কার্যালয় স্মারক নং - ১৬৮৫/ ২য় খন্ড মূলে উভয় পক্ষকে নোটিশের মাধ্যমে নালিশি জায়গায় স্থিতাবস্থাসহ শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার নির্দেশ প্রদান করা হয়। তদুপরি গত ১৫ জুলাই সহকারী পুলিশ কমিশনা কর্তৃক সভায় আবারও উভয় পক্ষকে একই নির্দেশ প্রদান করা হয়। তবুও সেটেলাররা আইন অমান্য করে সেন্টারটি ভেঙ্গে ফেলে দেয়। উল্লেখ্য গত ১৬ মে ১৪ইং বেতছড়ি রিসসো কোসেই কাই সেন্টার তৈরী করা হয়।

রিসসো কোসেই কাই হলো জাপান ভিত্তিক একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এর শাখা রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশেও এই সংগঠনটির বেশ কিছু শাখা আছে। ‘বেতছড়ি রিসসো কোসেই কাই’ হলো তার একটি।

খাগড়াছড়ি সদরে কমলছড়ি ইউনিয়নে ভূয়াছড়ি মৌজাধীন বেতছড়ি গ্রামে বেতছড়ি রিসসো কোসেই কাই-এর জমি রয়েছে। এই জমি এক সময় বেতছড়ি বৌদ্ধ মন্দিরের ছিল। ১৯৯১-৯২ সালে বৌদ্ধ মন্দিরসহ গ্রামের বাড়ীঘর ভেঙ্গে দিয়ে গ্রামবাসীকে এক জায়গায় জড়ো করে গুচ্ছগ্রামে বসবাস করতে বাধ্য করা হয়। এর ফলে মন্দিরের আওতাধীন আনুমানিক ৪০ একর পরিমাণ জমি পরিত্যক্ত ও অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকে। পরবর্তীতে সরকার গুচ্ছগ্রাম ভেঙ্গে দিলে গ্রামবাসীরা আবার নিজ জায়গায় ফিরে গিয়ে বসবাস শুরু করে। কিন্তু বিভিন্ন প্রতিকূলতা ও সীমাবদ্ধতার কারণে মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ ও মন্দিরের আওতাভুক্ত জমি ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি। তবে তৎকালীন মন্দিরের আওতাধীন জায়গায় রোপন করা ৫০ বছর বয়সী বটবৃক্ষসহ বিভিন্ন ফলজ ও বনজ গাছ এখনো বিদ্যমান রয়েছে।

এখানে উল্লেখ্য, পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন ১৯৯১ সালে প্রথমবারের মত পার্বত্য চট্টগ্রাম সফরের সময় বেতছড়ি এলাকা পরিদর্শন করেছিল, যার কথা তাদের রিপোর্ট লাইফ ইজ নট আওয়ার্স এ উল্লেখ রয়েছে। [পৃ: ১২৮, রিপোর্টের বাংলা অনুবাদ ‘জীবন আমাদের নয়’]

পূর্বেকার মন্দিরের এই জমিকে ভিত্তি করে গ্রামের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য গ্রামবাসীর সকলের সম্মতিতে “রিসসো কোসেই কাই, বাংলাদেশ”-এর সাথে যোগাযোগ করা হয়। আমাদের আমন্ত্রণে গত বছর, অর্থাৎ ২০১৩ সালের ২৩ জানুয়ারী “রিসসো কোসেই কাই- বাংলাদেশ” এর মিনিষ্টার দি রেভারেন্ড মিটসুয়ুকি আরিতোমি অত্র এলাকা পরিদর্শন করেন এবং “বেতছড়ি রিসসো কোসেই কাই, বাংলাদেশ” নামক শাখার অনুমোদন দেন।

এরপর বন্দোবস্তীর সুবিধার্থে বেতছড়ি রিসসো কোসেই কাই সেন্টারের অধীনে আর্য্য পুরুষ বনভান্তে বির্দশন শিক্ষা কেন্দ্র, জ্ঞানজ্যোতি কুঠির ও চিত্রসেন কুঠির নামে তিনটি প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়। এই সব প্রতিষ্ঠানের নামে উক্ত জমি বন্দোবস্তী পাওয়ার জন্য গত বছর অর্থাৎ ২০১৩ সালের ২২ নভেম্বর স্থানীয় হেডম্যানের সুপারিশসহ জেলা প্রশাসক বরাবরে আবেদন করা হয়। পরবর্তীতে উক্ত জায়গায় রিসসো কোসেই কাই-এর অর্থয়ানে Rissho Kosei-Kai Peace Pagoda, Technical Training Center, Meditation Training Center, Healthcare Complex, School & College, Old Care Hostel, Orphan Children Home নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।

দ্রুত উন্নয়ন কাজ শুরু করার আশায় রেভারেন্ড মিটসুয়ুকি আরিতোমি এ বছর ৯ জানুয়ারী আরও একবার জায়গাটি পরির্দশন করেন এবং এই বর্ষা মৌসুমে জমিতে বিভিন্ন ফলজ ও বনজ বৃক্ষের চারা রোপনের নির্দেশ দেন। তাঁর কথামত বর্ষা মৌসুমে বিভিন্ন চারা রোপনের জন্য গ্রামবাসী সেচ্ছাশ্রম দিয়ে উক্ত জায়গাটি পরিস্কার করে। এর পর গত ১৯ এপ্রিল রেভারেন্ড মিটসুয়ুকি আরিতোমি “বেতছড়ি রিসসো কোসেই কাই সেন্টারের” খাগড়াছড়ি শাখার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন।

কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয়, আনুষ্ঠানিকভাবে উক্ত ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের দিন ভূয়াছড়ি সাবজোনের দায়িত্বপ্রাপ্ত সুবেদার জনাব মোঃ ফজলুল স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার বাবু সত্যব্রত চাকমাকে ফোন করে ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের কাজ বন্ধ রাখতে বলেন। তবে কী কারণে বন্ধ রাখতে হবে তা তিনি জানাননি। উপরোক্ত সুবেদারের ফোনের পরপরই খাগড়াছড়ি থানার এসপি কয়েক জন পুলিশ সদস্য নিয়ে উক্ত জায়গায় উপস্থিত হন এবং গ্রামের কার্ব্বারীকে তাঁর সাথে দেখা করতে বলেন। কার্ব্বারী খবর পেয়ে তড়িঘড়ি করে দেখা করতে যান, কিন্তু তার আসা অবধি অপেক্ষা না করে এসপি সাহেব চলে যান।

গত ৮ মে রোজ বৃহস্পতিবার দিনের বেলা প্রচুর বৃষ্টিপাতের সুযোগ নিয়ে কতিপয় বাঙালি সেটেলার ভিত্তি প্রস্তর ভেঙে দেয় এবং রিসসো কোসেই কাই-এর সাইন বোর্ডটি খুলে নিয়ে যায়। শুধু তাই নয়, তারা রিসসো কোসেই কাই-এর জমি বেদখলের হীন উদ্দেশ্যে জমির ভূয়া দলিল তৈরি করে ১২ জন পাহাড়ির বিরুদ্ধে আদালতে তিনটি মামলা দেয়। মামলাকারীরা হলেন, মোঃ আছর উদ্দীন (৬০) পিতা জয়নুদ্দীন,  মামলা নং ৯২/২০১৪; ইউসুফ আলী (৪০) পিতা মৃত কাসেম আলী, মামলা নং ৮৫/২০১৪; মোছাঃ বানেচা বেগম (৩২) স্বামী আয়নাল হক, পিতা মৃত শামসুল হক, মামলা নং ৮৬/২০১৪। মামলায় যাদেরকে আসামী করা হয়েছে তারা হলেন- কীর্তিময় চাকমা, বীরবাহু চাকমা, অনিকা রঞ্জন চাকমা, সত্যব্রত চাকমা, সুনীল কান্তি চাকমা, সুমতি চাকমা, সোনাধন চাকমা, সুন্দর মোহন চাকমা, সন্তোষ দেওয়ান, নোবেল চাকমা, মন রঞ্জন চাকমা ও মিলন চাকমা।

এই বেতছড়ি এলাকায় সেটলারদের দ্বারা পাহাড়ি জমি বেদখলের ঘটনা নতুন নয়। গত ২০১২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর সেটেলাররা পাহাড়িদের জমি দখল করতে গেলে উভয়ের মধ্যে সংঘর্ষ হয় এবং সেটলাররা পাহাড়িদের প্রায় ৫০ একর জায়গা জোরপূর্বক দখল করে নেয়। এ ঘটনায় সেটলাররা উল্টো ৮ জন পাহাড়ির বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করে। গত ২৬ ফেব্রুয়ারী ২০১৪ কমলছড়ির সবিতা চাকমার হত্যাকা-কে কেন্দ্র করে সংঘটিত ঘটনার জের ধরে বিনা উস্কানিতে সেটলাররা জমি দখলের উদ্দেশ্যে উক্ত গ্রামের প্রায় ৪ কিলোমিটার পূর্বে “চৈত্য আদর্শ বৌদ্ধ বিহারে” হামলা চালিয়ে বিহারের বুদ্ধমূর্তিসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র ভাংচুর করে। এছাড়া সেটলাররা পার্শ্ববর্তী গ্রাম বেতছড়ি মুখ পাড়ায় মৃত স্বর্ণ মোহন চাকমার ছেলে চিগন চান চাকমার (৫ একর), মৃত সাধনমনি চাকমার ছেলে রবিন্দ্র লাল চাকমার (৪ একর), মৃত সেবেন্দ্র চাকমার ছেলে নিসু চাকমার (১ একর), মৃত পবিত্র চাকমার ছেলে নব পত্র চাকমার (২ একর) ও সেবেন্দ্র চাকমার ছেলে গজেন্দ্র চাকমা (২ একর) -- এই পাঁচ জন পাহাড়ি গ্রামবাসীর ১৪ একর ফলজ ও বনজ বাগান জোরপূর্বক দখল করে নেয়। বেদখলকারী সেটলাররা হলেন মো ইব্রাহিম সেট পিতা অজ্ঞাত, রোখেয়া বেগম, স্বামী মোঃ সাম্যা, পিতা আব্দুল খালেক, মোঃ ইব্রাহিম শেঠ ও উমর আলী, পিতা মৃত মোঃ সুরমাল আলী,  মোঃ অমর শেখ, পিতা মোঃ আব্দুল রহমান। ভূমি মালিকরা স্থানীয় আর্মী ক্যাম্প ও থানায় এর প্রতিকার চেয়েও কোন সুবিচার পায়নি।

এভাবে কতিপয় সেটলার প্রতিনিয়ত পাহাড়িদের জায়গাজমি দখল করে নিয়ে যাচ্ছে। এই ভূমি বেদখলে তারা স্থানীয় নিরাপত্তা বাহিনী ও প্রশাসনকেও তাদের পাশে রাখার চেষ্টা করে থাকে। বেতছড়ি রিসসো কোসেই কাই-এর জমিও তারা এভাবে বেদখলের জন্য চেষ্টা চালিয়ে আসছে। এই জমি ১৯৯২ সালের আগ পর্যন্ত বেতছড়ি বৌদ্ধ মন্দিরের আওতাধীন থাকলেও জমির বন্দোবস্তী সংক্রান্ত দলিলপত্র ছিল না। দলিল না থাকার কারণ হলো তখন তার প্রয়োজন পড়তো না। এখনো বহু পাহাড়ি বাপদাদার আমল থেকে জমি ভোগ দখল করে আসলেও তার মালিকানার দলিল নেই। তাছাড়া সরকার এক সময় জমি বন্দোবস্তী প্রদান বন্ধ করে দেয়। এই সুযোগে এক শ্রেণীর সেটলার জমির ভূয়া দলিল তৈরি করে পাহাড়িদের প্রথাগত ভোগদখলকৃত জমি হাতিয়ে নিচ্ছে।

এমতাবস্থায় ৩ জুন ২০১৪ রিসসো কোসেই কাই-এর জমি রক্ষার জন্য মাননীয় খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসকের নিকট প্রতিকার চেয়ে আবেদন করা হয়। আবেদনের অনুলিপি মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, মাননীয় আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান, তিন পার্বত্য আসনের মাননীয় সংসদ সদস্যগণ, বাংলাদেশে নিযুক্ত মাননীয় জাপানী রাষ্ট্রদূত, চট্টগ্রাম বিভাগের মাননীয় কমিশনার ও ২৪ পদাতিক ডিভিশনের মাননীয় জিওসিসহ গুরুত্বপূর্ণ ১৫ জনকে দেয়া হয়।

কিন্তু দুঃখের বিষয়, উক্ত জমি বেদখলের হাত থেকে রক্ষা করতে আজ পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। বরং গত ২৯ জুন ২০১৪ খাগড়াছড়ি সদর থানার এস আই মোঃ সালাহউদ্দিন জাবেদ ‘দুই পক্ষের বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত উভয় পক্ষকে নালিশীয় ভুমিতে স্থিতিবস্থা সহ শান্তি শৃংখলা বজায় রাখার’ নির্দেশ দিয়ে বেতছড়ি রিসসো কোসেই কাই সেন্টারকে চিঠি দেন। [পুলিশ সুপার কার্যালয় স্বারক নং- ১৬৮৫/২য় খন্ড]

তাই সেটলারদের বাধা ও প্রশাসনের অসহযোগীতার কারণে আমরা নিজস্ব জমিতে বহু প্রতীক্ষিত উন্নয়নমূলক কার্যক্রম এখনো শুরু করতে পারছি না। এখানে বলা দরকার, আমরা যখনই রিসসো কোসেই কাই-এর অর্থায়নে আমাদের বৌদ্ধ মন্দিরসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের জন্য কাজে হাত দিতে শুরু করি, তখনই কতিপয় সেটলার তাতে বাধা দেয় এবং ভূয়া দলিল সংগ্রহ করে উক্ত জমি তাদের বলে দাবি করে বসে।


No comments

Theme images by 5ugarless. Powered by Blogger.