সংসদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে ইউএনডিপি

অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে জাতীয় সংসদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থা ইউএনডিপি। বারবার তাগাদা দিয়েও অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ করতে না পারায় তারা সংসদ সচিবালয়ের সঙ্গে আপাতত আর কাজ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতেও নতুন প্রকল্পে অর্থায়ন করবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে।
সংসদ সচিবালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে গণতন্ত্র শক্তিশালী করার মহাপরিকল্পনা নিয়ে ইমপ্র“ভিং ডেমোক্রেসি থ্র“ পার্লামেন্টারি ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয় ইউএনডিপি। জুন ২০১০ থেকে জুন ২০১৪ পর্যন্ত পাঁচ বছর এ প্রকল্পের কাজ চলার কথা। এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮২ কোটি ৭ লাখ ৭৩ হাজার টাকা।
এ প্রসঙ্গে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, আইডিপি প্রকল্পে যদি কোনো অনিয়ম হয় তা তদন্ত করে দেখা হবে।
সাবেক স্পিকার ব্যারিস্টার মুহাম্মদ জমিরউদ্দিন সরকার বলেন, বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। এতে করে সংসদের ভাবমূর্তি ক্ষুন্নের পাশাপাশি বাংলাদেশেরও ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হবে।

প্রকল্পের প্রধান বা ন্যাশনাল প্রজেক্ট ডাইরেক্টর সংসদ সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব প্রণব চক্রবর্তী, অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থের অপব্যবহারের বিষয়টি এক বাক্যে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, প্রকল্প সফলভাবেই বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এসব বিষয়ে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী অবগত। তার অনুমোদন নিয়ে প্রকল্পের যাবতীয় কাজ করা হয়েছে। এখানে জোর করে টাকা খরচের বা অর্থের অপচয়ের কোনো সুযোগ নেই। সূত্র জানায়, প্রকল্প বাস্তবায়নের শুরুতেই সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এর এক পর্যায়ে কোরিয়ান দাতা প্রতিষ্ঠান কোয়েকা প্রকল্প থেকে তাদের গুটিয়ে নেয়। এই প্রকল্পে তাদের ২০ কোটি টাকা দেয়ার কথা ছিল। কোয়েকা অর্থ না দেয়ায় প্রকল্পের ব্যয় কমিয়ে ৬২ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়।

নয়ছয় করে এই টাকাও মাত্র তিন বছরে শেষ করা হয়। বাকি দুই বছর টাকা নেই বলে আর কোনো কাজ এগোয়নি। তিন বছরেই সব টাকা খরচ করে ফেললেও কাগজে-কলমে প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন দেখানো হয় ৬৮ ভাগ। কিন্তু বাস্তবে কাজ হয়েছে মাত্র ১৩ শতাংশ। সংসদ সচিবালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংসদ সচিবালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, সংসদ সচিবালয়ের সঙ্গে বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। সাধারণত একবার একটি কাজ শুরু হলে মাঝখানে সেই কাজ ফেলে রেখে গুটিয়ে নেয়ার কোনো উদাহরণ দাতা সংস্থা বা দেশগুলোর নেই। আইপিডি প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থের অপব্যবহারের কারণে ইউএনডিপি ক্ষুব্ধ হয়ে এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর নিজেরাই সরে দাঁড়িয়েছে। এতে করে জাতীয় এবং সংসদ সচিবালয় ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ওই কর্মকর্তা জানান, ইউএনডিপি যাতে আইপিডি প্রকল্পে আরও পাঁচ বছরের জন্য মেয়াদ বাড়িয়ে অর্থায়ন অব্যাহত রাখে সেজন্য বেশ চেষ্টা তদবির করেও লাভ হয়নি।

সূত্র জানায়, আইপিডি প্রকল্পের আওতায় জাতীয় সংসদ, সংসদ সচিবালয়, সংসদীয় ব্যবস্থা এবং সংসদীয় কমিটিগুলোর উন্নয়নসহ ১৭টি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ডাইরেক্টরি প্রণয়ন। সরকারি প্রতিশ্র“তি বাস্তবায়ন তদারকির জন্য সরকারি প্রতিশ্রুতি সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির গাইডলাইন প্রণয়ন ও প্রকাশনা। সরকারি প্রতিশ্র“তি সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির ডেটাবেজ প্রণয়ন ও সংসদের ওয়েসাইটে সংযুক্তি দেয়া। শিশু পার্লামেন্ট অধিবেশন, বাংলাদেশের নির্বাচনী এলাকা সম্পর্কে এবং জাতীয় সংসদে পিটিশন পদ্ধতি শীর্ষক গবেষণা ও পলিসি ব্রিফ, সংসদ সচিবালয়ের লাইব্রেরি ও গবেষণা শাখার উন্নয়নে সহযোগিতা দেয়া। সংসদ সচিবালয়ের প্রশিক্ষণ শাখার সক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা দেয়া। সংসদীয় জেন্ডার রিসোর্স তৈরিতে পরামর্শক নিয়োগ এবং ১৯৭২ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত স্পিকারের রুলিং একত্রিত করা এবং নবম জাতীয় সংসদের মেয়াদ সমাপ্তির প্রতিবেদন প্রকাশ করা। এছাড়া জাতীয় সংসদের কমিটি বিষয়ক বুকলেট প্রণয়ন, সংসদ সচিবালয়ের আইসিটি শাখার দক্ষতা উন্নয়নে টিওটি প্রশিক্ষণ এবং আইসিটি হেল্প ডেস্ক স্থাপন, জাতীয় সংসদের যোগাযোগ কৌশলপত্র প্রণয়ন, ই-ক্লিপিং তৈরিতে সংসদ লাইব্রেরিকে সহায়তা প্রদান, পার্লামেন্ট পোস্ট প্রণয়ন, এফএপিএডি কর্তৃক পরিচালিত অডিট রিপোর্ট এবং অভিও ভিজ্যুয়াল সরঞ্জাম কেনার বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত ছিল।

জানা গেছে, প্রকল্পের প্রায় সব টাকাই খরচ হয়ে গেলেও ১৭ পরিকল্পনার অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়নি। যদিও আইপিডির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে তারা অধিকাংশ পরিকল্পনাই বাস্তবায়ন করেছেন। বাস্তবে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ডাইরেক্টরি প্রণয়ন সম্ভব হয়নি পাঁচ বছরেও। সরকারি প্রতিশ্র“তি বাস্তবায়ন তদারকির জন্য সরকারি প্রতিশ্রুতি সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির গাইডলাইন প্রণয়ন হলেও এটি কোনো কাজে আসেনি। সরকারি প্রতিশ্র“তি সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির ডেটাবেজ প্রণয়ন ও সংসদের ওয়েসাইটে সংযুক্তির কথা থাকলেও তা হয়নি। বাংলাদেশের নির্বাচনী এলাকা সম্পর্কে এবং জাতীয় সংসদে পিটিশন পদ্ধতি শীর্ষক গবেষণা ও পলিসি ব্রিফ, সংসদ সচিবালয়ের লাইব্রেরি ও গবেষণা শাখার উন্নয়নে সহযোগিতা, সংসদ সচিবালয়ের প্রশিক্ষণ শাখার সক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা প্রদান প্রভৃতি পরিকল্পনাও খুব একটা এগোয়নি। অন্যান্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চিত্রও করুণ। বরং প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে মাত্র ৩৫ পৃষ্ঠার দুটি কর্মপরিকল্পনার বই তৈরি করতেই ব্যয় ধরা হয় ২৩ কোটি টাকা। এই ২৩ কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি করা কৌশলগত কর্মপরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে ১০ পৃষ্ঠার বাংলাদেশ পার্লামেন্ট সেক্রেটারিয়েট স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যান-২০১২-২০১৪ এবং ২৫ পৃষ্ঠার বাংলাদেশ পার্লামেন্ট সেক্রেটারিয়েট অ্যানুয়াল অ্যাকশন প্ল্যান-২০১২-২০১৩ নামে দুটি বই। আর এই বই দুটি প্রকাশে সময় নেয়া হয় প্রায় ৩ বছর। বাকি টাকা সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের বারবার স্টাডি ট্যুর এবং নানা নামে বিদেশ ভ্রমণেই ব্যয় হয় বলে অভিযোগ আছে। আর কিছু টাকা ব্যয় দেখানো হয় আন্তর্জাতিক ও দেশীয় পরামর্শকদের সম্মানী বাবদ।

প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলঙ্কা, ভারত, নিউজিল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া সফর করেছেন প্রায় ৪০ জন কর্মকর্তা। সংযুক্ত আরব আমিরাতে সংসদীয় গণতন্ত্র না থাকলেও সংসদীয় গণতন্ত্রের অভিজ্ঞতার জন্য দুবাইতে দুদফায় প্রশিক্ষণে গেছেন সংসদের ১৫ কর্মকর্তা। এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে প্রকল্প থেকে পদত্যাগের ঘটনাও ঘটে। প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক আবু আল হেলাল দুই বছরের মাথায় ২০১১ সালে প্রকল্প থেকে পদত্যাগ করেন।

জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ আসম ফিরোজ বলেন, অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। তিনি আরও বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়ম ও দুর্নীতি হলে অবশ্যই যারা এর সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদের শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।
এ প্রসঙ্গে সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সাধারণত দাতা প্রতিষ্ঠানগুলো অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে নিজেদের গুটিয়ে নিয়ে থাকে। ইউএনডিপির সরে যাওয়ার বিষয়টি সত্যিই দুঃখজনক।

জানা গেছে, প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে এমন নয়ছয় এবং অর্থ অপচয়ের মচ্ছবের এক পর্যায়ে ইউএনডিপির পক্ষ থেকে কয়েক দফায় প্রকল্পের অগ্রগতি জানতে অডিট হয়। প্র্রকল্প সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে তারা এ নিয়ে দফায় দফায় বৈঠকও করেন। গত মাসে ইউএনডিপির পক্ষ থেকে প্রকল্পের অগ্রগতি জানতে সাত দিনের সফরে আসেন রবার্ট নাকামুরা ও কার্ল ডি ফারিয়া। তারা প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থের অপব্যবহারের বিষয়টি খুঁজে পান। এরও আগে এ প্রকল্পের কাজের মূল্যায়ন করতে ইউএনডিপির পক্ষ থেকে বাংলাদেশে আসেন পিটার লিনিয়েনফেন্ড নামে আরেক ব্যক্তি। ১৩ থেকে ২৭ মে পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থান করেন তিনি। এ সময় কাজের মূল্যায়ন করতে তিনি স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, চিফ হুইপসহ সংসদ সচিবালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। শেষ পর্যন্ত তিনিও প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে সংশ্লিষ্টদের কাছে হতাশা প্রকাশ করেন। সূত্র জানায়, তাদের রিপোর্টের ভিত্তিতেই মূলত ইউএনডিপি সংসদ সচিবালয়ের সঙ্গে আর কোনো প্রকল্পে কাজ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

সূত্রঃ দৈনিক যুগান্তর

No comments

Theme images by 5ugarless. Powered by Blogger.