বুদ্ধ পূর্ণিমা এবং মানবিক মূল্যবোধ
প্রাচীন ভারতের উত্তরাঞ্চলে শাক্যদের একটি রাজ্য ছিল। তখন রাজ্যের রাজা ছিলেন শুদ্ধোদন ও রাণী মহামায়া। তাঁদের প্রথমে কোন সন্তানাদি ছিল না। অনেক সাধনার পর রাজা শুদ্ধোদনের ঔরসে ও রাণী মহামায়ার গর্ভে রাজপুত্ররূপে জন্ম নিয়েছিলেন ভাবী বুদ্ধ। তাঁর জন্মে সকলের সর্বার্থ সিদ্ধ হওয়ায় রাজকুমারের নাম রাখা হয় সিদ্ধার্থ। মহামায়া নিজ পিত্রালয়ে দেবদহ নগরে বেড়াতে যাবার পথে কপিলাবস্তুর অনতিদূরে লুম্বিনীর শালবৃক্ষ তলে সিদ্ধার্থের জন্ম হয়। জন্মের সপ্তাহন্তের পর তাঁর মাতার মৃত্যু হয়। শিশু সিদ্ধার্থের লালন-পালনের দায়িত্ব ন্যস্ত হয় বিমাতা গৌতমীর কাছে, এ কারণে সিদ্ধার্থের আর এক নাম হয় গৌতম। সিদ্ধার্থ গৌতম ষোল বছর বয়সে পিতা রাজা শুদ্ধোদনের অভিপ্রায়ে যশোধারার (গোপা) সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। সিদ্ধার্থকে সংসার জীবনে আকৃষ্ট করার জন্য তাঁর পিতা তিন ঋতুর ( গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত) উপযোগী তিনটি বিলাস বহুল বাসভবন নির্মাণ করালেন। কিন্তু তাঁর মন সব সময় চিন্তামগ্ন। রাজসুখে তাঁর বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। তিনি যে অনন্ত জন্মের পুণ্য শক্তির কর্ম সাধনায় অগ্রসরমান। সিদ্ধার্থের মনে যখন গাহর্স্থ্য জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা প্রবল আকার ধারণ করে ঠিক সেই মুহুর্তে তাঁর এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। সংবাদ শ্রবনে আনন্দের পরিবর্তে তিনি বলে উঠলেন ‘‘ রাহুই জন্ম নিল”। তাই তাঁর পুত্রের নাম রাখা হয় রাহুল। রাহুগ্রাসের ন্যায় রাহুলের জন্মে মায়ার বন্ধন গাঢ় হতে গাঢ়তর হবে বুঝতে পেরে তিনি সেদিনই গৃহত্যাগের মহাসংকল্প গ্রহণ করলেন। রাহুলের জন্ম সাতদিন পর অর্থাৎ ঊনত্রিশ বছর বয়সে সিদ্ধার্থ গৌতম রাজ ঐশ্বর্য বিসর্জন দিয়ে দুঃখ মুক্তির অন্বেষায় গৃহত্যাগ করেন এবং কঠোর সাধনায় মগ্ন হন। রাজ কুমার সিদ্ধার্থ বুদ্ধত্ব লাভের পূর্বে দৃঢ় সংকল্প করে বলেছিলেন-
‘এ আসনে দেহ মোর যাক শুকাইয়া,
চর্ম-অস্থি-মাংস যাক প্রলয়ে ডুবিয়া,
না লভিয়া বোধিজ্ঞান দুর্লভ জগতে
টলিবে না দেহ মোর এ আসন হইতে।’
সিদ্ধার্থ গৌতম বোধিলাভের এরূপ দৃঢ় সংকল্পে যখন ধ্যানে উপবেশন করেন তখন দুষ্টমতি মার (মানব মনের হীন প্রবনতা) সসৈন্যে তাঁর ধ্যান ভঙ্গ করার জন্য এগিয়ে আসল। কিন্তু মারের সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে বোধিসত্ত্ব গভীর ধ্যানে প্রবেশ করে। মন ক্রমশঃ ধ্যানের বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করে সুখ দুঃখের অতীত সহানুভূতিযুক্ত শুদ্ধ শান্ত চতুর্থ ধ্যানে মগ্ন হন। তিনি দর্পনের প্রতিফলিত বস্তুর মতো জন্ম-জন্মান্তরের চিত্র দেখতে লাগলেন। রাত্রির প্রথম যামেই এ প্রথম বিদ্যা তাঁর আয়ত্ত হল। দ্বিতীয় যামে দ্বিতীয় বিদ্যা- “চ্যুত্যেৎপত্তি” জ্ঞান লাভ হল অথার্ৎ তাঁর কাছে জন্মমৃত্যুর রহস্য উদ্ঘাটিত হয়ে গেল। তিনি দিব্য-দৃষ্টি মেলে প্রত্যক্ষ করলেন জীবজগতের আসা-যাওয়ার খেলা । তৃতীয় যামে হল “আস্রবক্ষয়” জ্ঞানের উদয়,অন্তরের সমস্ত মারসৈন্য বা রিপুগুলোকে নির্মূল করে তাঁর চিত্ত হল মুক্ত বন্ধনহীন। এখানেই তাঁর বুদ্ধ জীবনের বিকাশ, সাধনার পরিপূর্ণতা, কর্তব্যের অবসান- “নত্থি উত্তরি করণীযং” এরপর আর করণীয় কিছু নেই। যে সত্যের উপলব্দিতে মানুষের পরম শান্তি নির্বাণ দর্শন হয়। এ দিন হতে তিনি জগতে পরিচিত হলেন ‘‘বুদ্ধ’’ নামে। অবসান হলো বোধিসত্ত্বের জীবন। কোন পুণ্যবান সত্ত্ব অন্তরে বুদ্ধাঙ্কুর বীজ বপন হতে বুদ্ধত্ব লাভের পূর্ব মুহুর্তকে বলা হয় ‘‘বোধিসত্ত্ব’’।
তিনি আরো আবিষ্কার করলেন পৃথিবীর যাবতীয় দুঃখ প্রতীত্য সমুৎপাদ বা কার্য-কারণ শৃঙ্খলে আবদ্ধ। এ দুঃখ উৎপত্তির মূল কারণ মানুষের অবিদ্যা বা অজ্ঞানতা। এ অবিদ্যা থেকে জন্ম নেয় সংস্কার, সংস্কার থেকে বিজ্ঞান, বিজ্ঞান থেকে নামরূপ, নামরূপ থেকে ষড়ায়তন, ষড়ায়তন থেকে স্পর্শ, স্পর্শ থেকে বেদনা, বেদনা থেকে তৃষ্ণা, তৃষ্ণা থেকে উপাদান, উপাদান থেকে ভব, ভব থেকে জাতি (জন্ম), জাতি থেকে জরা, মরণ, শোক, পরিদেবন, দুঃখ, দৌর্মনস্য, হতাশা ইত্যাদি উৎপন্ন হয়। এরূপে সমস্ত দুঃখস্কন্ধের উৎপত্তি হয়। তাই এ দুঃখ থেকে পরিত্রানের উপায় অবিদ্যার ধ্বংস সাধন।
মহামানব বুদ্ধের আবির্ভাবে প্রাচীন ভারতবর্ষের আদিকাল হতে প্রবাহমান দাস প্রথা, জাতিভেদ প্রথা, যজ্ঞ প্রথা ও অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে সামাজিক অবস্থা পরিবর্তনের এক আন্দোলন গড়ে ওঠেছিল। বুদ্ধ তৎকালীন সমাজের এ কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ঘোষণা করলেন-
‘ন জটাহি ন গোত্তেন ন জচ্চা হোতি ব্রাহ্মণো,
যম্হি সচ্চঞ্চ ধম্মো চ সো সুচী সো চ ব্রাহ্মণো।’
অর্থাৎ , জটা, গোত্র বা জন্ম দ্বারা কেউ ব্রাহ্মণ হয় না, যাঁর মধ্যে সত্য, সুন্দর ও নীতিজ্ঞান
বিদ্যমান তিনিই পবিত্র এবং তিনিই ব্রাহ্মণ। তিনি আরো বলেন-
‘অত্তাহি অত্তনো নাথো
কোহি নাথো পরো সিয়া।’
নিজেই নিজের নাথ বা ত্রাণকর্তা, অর্থাৎ নিজের কর্মেই নিজের ভবিষ্যৎ নির্মিত হয়,
অন্যভাবে নয়।
এভাবে ব্যক্তি স্বাধীনতার কথা এবং মানুষের আত্ম প্রত্যয়ের মর্যাদা তথাগত বুদ্ধ এভাবেই ঘোষণা করেছিলেন। বুদ্ধ জাতি-ধর্ম-বর্ণের বেড়া ভেঙ্গে ফেলে মানুষকে মানবিক শক্তিতে বলীয়ান করণে প্রত্যয়দীপ্ত ছিলেন। তাই সামাজিক শ্রেণি বৈষম্য বিষয়ে বুদ্ধ বলেছিলেন-‘মানুষ কর্ম দ্বারাই কৃষক হয়, কর্ম দ্বারা শিল্পী হয়, কর্ম দ্বারা বণিক ও চোর হয়, যুদ্ধবাজ বা সন্ত্রাসী হয়। আবার কর্ম দিয়েই মানুষ পুরোহিত ও রাজা হয়।’ সুতরাং জন্মের কারণে কেউ হীন, অস্পৃশ্য ও অন্ত্যজ শ্রেণিভুক্ত হতে পারে না। মানুষের কর্মেই মানুষের পরিচয় নির্ধারিত হয়, মানবিক মূল্যবোধে প্রতিষ্ঠিত হতে না পারলে কেউ প্রকৃত মানুষ হয় না। তাই মানুষের পরিচয় কর্মে, জন্মের ভিত্তিতে নয়।
বুদ্ধের মহান আদর্শ ও বাণী কখনই কোন গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে নি। বুদ্ধের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে বৌদ্ধ সংঘে যাঁরা যোগদান দিয়েছিলেন এমনকি সংঘে যোগদানের পরবর্তী তাঁদের অবস্থানগত মর্যাদার ক্ষেত্রে কখনই জাতি-ধর্ম-বর্ণ সম্প্রদায়গত বৈষম্যের প্রশ্রয় দেওয়া হয়নি। বুদ্ধ মানুষ বলতে সমগ্র বিশ্ব মানবগোষ্ঠীকে বোঝাতেন। এজন্য তাঁর কোন বাণী ও নির্দেশনা কখনই কোন সম্প্রদায় কেন্দ্রিক পরিবেশিত হয়নি। বুদ্ধ বলেছেন-
‘মাতা যথা নিযং পুত্তং আযুসা এক পুত্তমনুরক্খে,
এবম্পি সব্বভূতেসু মানসং ভাবয়ে অপরিমাণং।’
অর্থাৎ মা যেমন তাঁর একমাত্র পুত্রকে নিজের জীবন দিয়ে রক্ষা করেন, তেমনি সকল
জীবের প্রতি অপ্রমেয় মৈত্রী ভাব পোষণ করবে।
বুদ্ধের এ শিক্ষা শুধু মানব জাতির জাতির জন্য নয়, সমস্ত প্রাণির সুখশান্তি অবস্থান নিশ্চিত করার জন্য । যা একবিংশ শতকের শান্তি, স্বস্তিময় রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনে অবদান রাখতে সক্ষম হবে । বুদ্ধ বলেছেন- ‘‘ যে ব্যক্তি আমার উপদেশাবলী যথাযথ অনুশীলন করে, সেই ব্যক্তিই আমাকে সর্বাপেক্ষা বেশি সম্মান করে।’’ আজকাল মানব ধর্ম বলতে যা বুঝায় বৌদ্ধ ধর্ম পুরোপুরি তাই, কেননা সত্যিকার অর্থে মানুষের মানুষ হওয়ার জন্য এ ধর্ম। যে ধর্ম মানুষকে ভালোবাসতে শেখায়।
মহামানব বুদ্ধের পক্ষে এই অনন্ত অসীম মৈত্রী করুণার ফল্গুধারা বহে চলা সম্ভব হয়েছে শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমার কল্যাণেই। বৌদ্ধধর্ম মানুষের চরিত্রকে সুন্দর করতে প্রভাবিত করে, সামাজিক জীবনকে গঠিত করে,ব্যক্তির মনে সামাজিক মূল্যবোধ সঞ্চারিত করে। বৌদ্ধধর্ম ব্যক্তিকে সামাজিক নিয়ম মেনে চলতে, অপরের চিন্তা ও অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে, সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে এবং চিন্তা ও কাজে বিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন হতে শিক্ষা দেয়। বুদ্ধের উপদেশ পরিপূর্ণভাবে অনুশীলন-অনুধাবনের মাধ্যমে প্রজ্ঞা অধিগত করাই বুদ্ধ পূর্ণিমার মৌলিক শিক্ষা।
ড. অমর কান্তি চাকমা
প্রভাষক, বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজ।
akchakma13@hotmail.com
No comments
Post a Comment