সম্যক দৃষ্টি বনাম মিথ্যাদৃষ্টি

ভিক্ষু বিপস্সী
শাক্যমুনি বৌদ্ধ বিহার, মিরপুর, ঢাকা।

শাক্যপুত্র গৌতম বুদ্ধ ভাসমান একত্রিশ লোকভূমির সমস্ত সত্ত্বগণের দুঃখমুক্তির লাভের যে পন্থা আবিষ্কার করেন-যার নাম আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ। এ অষ্টমার্গের প্রথম স্তরটি হচ্ছে সম্যকদৃষ্টি (Right View) । সম্যকদৃষ্টি (Right View) অর্থে যা সঠিক দর্শন, শুদ্ধ, নির্মল, নিষ্কলুষ দৃষ্টিকেই বুঝায়। এই সম্যকদৃষ্টি (Right View) লে․কিক ও লোকোত্তর ভেদে দু’প্রকার। লে․কিক সম্যকদৃষ্টি (Right View) কি? এটি এক প্রকার জ্ঞান যার দ্বারা সত্যানুযায়ী কেউ জানতে পারে যে, কর্মই আমার বন্ধু, কর্মই আমার ঘনিষ্ট আপনজন। আর লোকোত্তর সম্যকদৃষ্টি (Right View) কি? আর্যমার্গফল সংযুক্ত (স্রোতাপত্তি মার্গ ও ফল, সকৃদাগামী মার্গ ও ফল, অনাগামী মার্গ ও ফল, এবং অর্হৎ মার্গ ও ফল) প্রজ্ঞাই লোকোত্তর সম্যকদৃষ্টি (Right View) । অবিদ্যায় আচ্ছনড়ব সত্ত্বগণ ৬২ প্রকার মিথ্যাদৃষ্টি বা ভ্রান্তধারণা পোষণ করে তাতে আবদ্ধ থাকেন। সম্যকদৃষ্টি (Right View) দ্বারা ঐ সকল মিথ্যাদৃষ্টি বা অজ্ঞানতা দূরীভূত হয়। দৃষ্টি (View) বিশুদ্ধ না হলে দুঃখনিবৃত্তির মার্গে উনড়বীত হওয়া যায় না। ঠিক রঙীন চশমা পরলে যেমন বস্তুর প্রকৃত রূপ দেখা যায় না যে, রং-এর চশমা বস্তুও সেই রং-এর বলে মনে করা যায়, তেমনি জীবন সম্বন্ধে সত্যদর্শন করা যায় না। কোন উপদেশক যদি বলে আমার কথা নির্বিচারে বিনা তর্ক-বিতর্কে, অন্ধ হয়ে ঢালাওভাবে চোখ বুজে মেনে নাও, না মানলে কোন অদৃশ্য সত্ত্বা তোমাদের অসহ্য নারকীয় যন্ত্রণায় দন্ড দেবে, আর মানলে তোমাদের সমস্ত পাপ থেকে অব্যাহতি দেবে এবং স্বর্গীয় সুখের আর্শীবাদ দেবে- তাহলে মনে করবেন সেটা সম্যকদৃষ্টি (Right View) নয় মিথ্যা ধর্মেরই ছলনা।
পৃথকজন বা সাধারণ মানুষের পক্ষে কর্মফলে বিশ্বাসই সম্যকদৃষ্টি (Right View)। সত্যের চতুরঙ্গ বা চারি আর্য সত্যে (Four Noble Truth)। চারি আর্যসত্যে(Four Noble Truth)-র মধ্যে আছে ক) দুক্খ সচ্চ (The Truth of Suffering) বা দুঃখ আর্যসত্যে, খ) সমুদয় সচ্চ (The Truth of the Origin of Suffering) বা সমুদয় আর্যসত্যে, গ) নিরোধ সচ্চ (The Truth of the Cessation of Suffering) বা দুঃখ নিবৃত্তি আর্যসত্যে, ঘ) মগ্গ সচ্চ (The Truth of the Path or the Way leading to the Cessation of Suffering) বা দুঃখ নিবৃত্তির উপায় আর্যসত্যে। এ চারি আর্যসত্যে (Four Noble Truth)--র মধ্যে দুক্খ সচ্চ (The Truth of Suffering) বা দুঃখ আর্যসত্যে কি সম্যকভাবে জানা, সমুদয় সচ্চ (The Truth of the Origin of Suffering) বা সমুদয় আর্যসত্যে সম্পর্কে সম্যকভাবে জানা ; অপর দুই আর্যসত্যে সম্পর্কে না জানাই, সম্যকদৃষ্টি (Right View)-র বিপরীত হচ্ছে মিথ্যাদৃষ্টি (Superstition)| তাই এ আর্যসত্যে চতুরঙ্গ বা চারি আর্য সত্যে (Four Noble Truth) যর্থাথভাবে না জানলে সম্যকদৃষ্টি (Right View) হয় না।
আরও এ বিষয়ে আলোকপাত করলে আমরা পাই, এক সময় আয়ুস্মান ধর্ম সেনাপতি সারিপুত্র স্থবির সমবেত ভিক্ষুসংঘকে আহবান করে বললেন লোকে ‘সম্যকদৃষ্টি (Right View)Õ সম্যকদৃষ্টি (Right View) বলে! কিসে আর্যশ্রাবক(ভগবান বুদ্ধের উন্নত শিষ্য বা মার্গফললাভী) সম্যকদৃষ্টিসম্পন্ন হন, কিসে তাদের দৃষ্টি ঋজু (যাহা দ্বি-অন্ত বর্জন করে, মধ্যমপন্থা) হয়, কিসে অচলচিত্তপ্রসাদসম্পন্ন হন, কুশল ও অকুশল কি? আয়ুস্মান ধর্ম সেনাপতি সারিপুত্র স্থবির বললেন বন্ধু আর্যশ্রাবক (ভগবান বুদ্ধের উন্নত শিষ্য বা মার্গফললাভী)-গণ সম্যকদৃষ্টিসম্পন্ন হন, তাদের দৃষ্টি ঋজু (যাহা দ্বি-অন্ত বর্জন করে, মধ্যমপন্থা) হয়, অচলচিত্তপ্রসাদসম্পন্ন হন, কুশল ও অকুশল কি তাহাও জানেন। অকুশল কি? প্রাণিহত্যা অকুশল, অদত্তগ্রহণ অকুশল, কামে ব্যভিচার অকুশল, মিথ্যাবাক্য অকুশল, পিশুন বা ভেদ বাক্য অকুশল, পরুষ বা গালি, নিন্দা, মনঃপীড়া দায়ক বাক্য অকুশল, সম্প্রলাপ(বৃথা) বাক্য অকুশল, অভিধ্যা (লোভপ্রবৃত্তি) অকুশল, ব্যাপাদ(হিংসাপ্রবৃত্তি) অকুশল, মিথ্যাদৃষ্টি (Superstition) অকুশল।
কুশল কি? প্রাণিহত্যা থেকে বিরতি কুশল, অদত্তবন্তু গ্রহণ থেকে বিরতি কুশল, কামে ব্যভিচার থেকে বিরতি কুশল, মিথ্যা বাক্য থেকে বিরতি কুশল, পিশুন বাক্য থেকে বিরতি কুশল, পরুষ বাক্য থেকে বিরতি কুশল, সম্প্রলাপ (বৃথা) বাক্য থেকে বিরতি কুশল, অনভিধ্যা কুশল, অব্যাপাদ কুশল, সম্যকদৃষ্টি (Right View) কুশল।
সত্ত্বগণ কায়দ্বারে, বাক্য দ্বারে ও মনদ্বারে এই ত্রিবিধ দ্বারে কুশল ও অকুশল কর্ম সম্পাদন করে থাকে। সত্ত্বগণ প্রাণীহত্যা, চুরি, ব্যভিচার ত্রিবিধ এই কায় দুশ্চরিত্র করে। বাক্য দ্বারে মিথ্যা বাক্য, পিশুন-বাক্য, ককর্শ-বাক্য, ও নিরর্থক বাক্য এই চারি প্রকার বাচনিক দুশ্চরিত্র করে থাকে। মন দ্বারে লোভ, হিংসা ও নাস্তিকতা বা মিথ্যাদৃষ্টি (Superstition) মন দুশ্চরিত্র কর্ম নামে কথিত হয়।
শাক্যপুত্র গৌতম বুদ্ধ ভাসমান একত্রিশ লোকভুমির সত্ত্বগণের দুঃখ উপলব্দি করে একটি সুন্দর উপমা দ্বারা বুঝিয়েছেন। কোন এক দক্ষ জেলে মাছ ধরতে কোন একটি ছোট জলাশয়ে সুক্ষ্ম ছিদ্রবিশিষ্ট জাল নিক্ষেপ করে মনে মনে ভাবে যে, এই জালের সাহায্যে জলাশয়ের সকল বড় মাছগুলো ধরতে সক্ষম হবো। কারণ সে জেলে দেখে যে, তার জালে আবদ্ধ হয়ে বড় মাছগুলো ভাসতেছে বা লাফালাফি করছে। কোন মাছই মুক্ত হতে পারছে না। তখনকার বুদ্ধের সময়ে অনেকে ভিন্নমতাদর্শী বা মিথ্যাদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন । অজ্ঞতার কারণে ভূল শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়ে তৃষ্ণার জাল ছিড়তে অক্ষম; বুদ্ধ তাঁর সর্বজ্ঞতা জাল বিস্তার করে তাদেরকে সেই তৃষ্ণার জালে লাফালাফি করতে দেখে ৬২ (বাষট্টি) প্রকার মিথ্যাদৃষ্টি (Superstition) মতাদর্শীদের প্রত্যক্ষ করেছেন।
কর্মফলে অবিশ্বাস নাস্তিকতাই মিথ্যাদৃষ্টি (Superstition)। মিথ্যাদৃষ্টি (Superstition) কে এক কথায় বলা যায়, যা দ্বারা দুঃখ মুক্তি লাভের সম্ভাবনা নেই, যা মুক্তির রাস্তা বা পথ রুদ্ধ, সত্ত্বগণ তা মুক্তির রাস্তা মনে করে ভুল পথে আশ্রয় গ্রহণ করেন। যেমনি করে অক্টোপাস শিকার করতে গিয়ে তার সমস্ত অঙ্গ দিয়ে আঁকড়ে ধরে। প্রকৃতি আলম্বন অর্থাৎ একজন নারী পুরুষ তার দৈনিক রুপ রং নিয়ে বেড়ে উঠে এবং তার সেই রঙে মানুষ আসক্তিগ্রস্ত হয় বিশেষ করে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি। আর মানুষের যে আসক্তি সেটা হচ্ছে মোহ। এ দেহটা একটা অশূচি(৩২ প্রকার অশুচি) পদার্থে পরিপূর্ণ। সে প্রকৃতির দৈহিক রুপে মুগ্ধ হয়ে আসল সত্যকে খুঁজে পায় না। অতএব, যতোই ভোগে আসক্তি তৃপ্তি খুঁজে, তার ততোই আসক্তি ঘনীভূত হয়।
পালি অটঠকথার এক উপমা এখানে প্রণিধানযোগ্য। কোন এক দেশে জনৈক ধনাঢ্যের গৃহে অন্ধ, খঞ্জ, দীন-দুঃখীদের মাঝে মাঝে ভিক্ষা দেওয়া হতো। ভিক্ষায় তাঁদেরকে ভাল সুস্বাদু খাদ্য দ্বারা পরিবেশন করা হতো। বিষয়টি এক চল-চাতুর জানতে পেরে তার মনে খুব লোভ জন্ম নেয়। একদিন ঐ ধনাঢ্যের বাড়িতে ভিক্ষা গ্রহণের পর সমস্ত অন্ধকে একস্থানে সমবেত করে চতুর লোকটি বলল, “হে বন্ধুগণ! শুনেছ, অমুক গ্রামে অমুক ধনীর বাড়িতে আজ বিকালে বিরাট নিমন্ত্রণ। আর বাড়ির গৃহকর্তা তোমাদের সবাইকে নিয়ে যাবার জন্যে আমাকে পাঠিয়েছে। সুতরাং, তোমরা সবাই প্রস্তুত হও। তিনি আরও বললেন, তোমরা যেহেতু অন্ধ, আর তোমাদের পথ-দ্রষ্টা হিসেবে পথে কোন প্রকার কষ্ট না হয় আমাকে ভাল করে নিয়ে যেতে হবে।” পথতো অনেক দূর। এখানে বসে সকলে একটু জলযোগ করে নাও। চতুর লোকটি তাঁদের অজ্ঞাতসারে ভাল সুস্বাদু খাদ্য-দ্রব্য বেছে বেছে খেয়ে ফেলল, কিছূ ব্যাগে ভরে নিল। অতঃপর বলল, নিমন্ত্রণের বাড়ি অনেক দূর রাত হয়ে যাবে, তাতে পথে কষ্ট হবে। তারপর সকলকে সারিবদ্ধ করে দাঁড় করাল এবং একজনকে অন্যজনের হাত ধরিয়ে দিয়ে নিজে পথ প্রদর্শক হয়ে সামনে চলল। এবার চলতে চলতে চতুর লোকটি পলায়নের ফন্দি আঁটতে উপায় খুঁজতে লাগল। অনেক পথ অতিক্রম করে সম্মুখে গোলাকার বিশিষ্ট এক বিরাটকার মাটির উচু স্তুপ দৃষ্টিগোচরে আসল। ভাবলেন “এবার বুঝি আমার পালাবার উপায়।” এই মাটির চারদিকে কুন্ডলাকারে সামনের অন্ধের হাত পেছনের অন্ধের হাতে জড়িয়ে দিল এবং বলল “তাড়াতাড়ি হাঁট, এখনো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।” অন্ধগণ প্রাণপণে হাঁটতে হাঁটতে দিন গেল, রাত্রি আসল, কোথায় গেল পথ দ্রষ্টা, গন্তব্যস্থল কোথায় বা নিমন্ত্রণ স্থান কোন জায়গায়? অন্ধগণ ঐই বিরাটকার মাটির স্তুপকে কেন্দ্র করে সর্বক্ষণ ঘুরতে লাগল। এভাবে অবিশ্রান্ত ঘূর্ণায়মান। মিথ্যাদৃষ্টি পরায়ন ব্যক্তিগণ ঠিক (Superstition) অন্ধজনের সদৃশ। আমাদের মহামুনি গৌতম বুদ্ধও লক্ষাধিক চারি অসংখ্য কল্প পারমীসম্ভার পরপিূর্ণ করে সর্বজ্ঞতা লাভ করেন। লোকনীতিতে দৃষ্ট হয়- “কূপ মন্ডুক না দেখিয়া সাগরের নীড়/ কূপ জলকে ভাবে সে অতি সুগভীর/ সেই রূপ পন্ডিত মানী লভি অল্প জ্ঞান/ নিজে নিজে মনে করে যেন সে প্রধান।”
মিথ্যাদৃষ্টি (Superstition) কে প্রধানত চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। আবার এই চারটি মিথ্যাদৃষ্টি (Superstition) কে বিভিনড়ব প্রকারে বিভক্ত করে ৬২ (বাষট্টি) প্রকারে করা হয়েছে। যেমনঃ- ক) সৎকায়দৃষ্টি, খ) শাশ্বতদৃষ্টি, গ) উচ্ছেদদৃষ্টি ও ঘ) অক্রিয়াদৃষ্টি।
ক) সৎকায়দৃষ্টিঃ ‘সৎ’ অর্থে চিরস্থায়ী, ‘কায়’ অর্থে দেহ বা শরীর। অর্থাৎ, এই দেহটি নিজস্ব, আত্মার ধারনা, আত্মার নিত্য এরূপ জ্ঞানকে সৎকায়দৃষ্টি বলা হয়েছে। সংক্ষেপে আমিত্ববোধই সৎকায়দৃষ্টি। যেমনঃ আমি, আমার, স্ত্রী, পুত্র-কন্যা, ধন-সম্পদ ইত্যাদি। এভাবে আমি, আমার, স্ত্রী, পুত্র-কন্যা, ধন-সম্পদকে চিরস্থায়ী শাশ্বত অমর মনে করা। এই ‘আমি’ আসলে শুধু পঞ্চস্কন্ধকে বুঝায়। অর্থাৎ, রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞান এ পঞ্চ উপাদানকে। আবার এই পঞ্চস্কন্ধকে পাওয়া যায় ‘নাম’ এবং ‘রুপে’। একদা মিলিন্দ রাজ কর্তৃক নাগসেন ভন্তেকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বললেন যে, যত স্থুল পদার্থ (জড়) বিদ্যমান সমস্তই ‘রূপ’ এবং যত সূক্ষ্ম মানসিকধর্ম (চেতনা) আছে তৎসমস্তই ‘নাম’। সুতরাং, একে অপরকে ব্যতিত স্থির থাকতে পারে না। বেদনা সুখ-দুঃখের অনুভূতিকে বলা হয় বেদনা। সংজ্ঞা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতিকে জেনে যে প্রতীতি জন্মে তাই সংজ্ঞা। সংস্কার কার্যকারণ শৃঙ্খলায় সংস্কার মানে চেতনা। বিজ্ঞান চেতনা বা মনই বিজ্ঞান। ‘আমি’ এর মধ্যে অহংবোধ রয়েছে। ‘আমি’ ব্যতিত কেউ আতড়বাকে ভালোবাসতে পারে না; এবং তা না হলে সুখ ও কামনা করা যায় না। এই ‘আমিত্ব’ বোধে নিজেকে শ্রেষ্ঠত্ব মনে করে অন্যের উপর আধিপত্য করতে চরিতার্থ করে। নিজেকে শ্রেষ্ঠত্ব মনে করে অন্যজনকে হীনদৃষ্টিতে হিংসা, বিদ্রুপ, অবজ্ঞা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করবে। মিথ্যাদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিগণ চোখ, হাত-পা বাঁধা ব্যক্তি সদৃশ। তারা কোনোদিন বিশ্বব্রহ্মান্ডের সংসার চক্র থেকে বেরিয়ে দুঃখমুক্তি বা ভব পার হতে মুক্ত হতে পারে না।
খ) শাশ্বতদৃষ্টিঃ আমিত্ব (আমি+ আত্মা এই ‘আমি’ শব্দটা ‘নাম-রূপ’ (পঞ্চস্কন্ধ) পূর্বে ছিল, এখনও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে এরুপ মতাদর্শই শাশ্বতদৃষ্টি। অন্যভাবে বলতে গেলে শাশ্বতদৃষ্টি মানে আত্মার বিশ্বাসী। তাঁরা পুর্নজন্ম বিশ্বাস করেন বিধায় দান, শীল, ধ্যান-সমাধি করে থাকেন। কিন্তু কোন কোন শ্রামণ, ব্রাহ্মণ উৎসাহ, উদ্যোগ, অপ্রমাদ সঠিক চিন্তার দ্বারা চিত্ত সমাধিপ্রাপ্ত হয়ে এক জন্ম, পাঁচজন্ম, দশ. বিশ, ত্রিশ, একশ, হাজার, এক লক্ষ, লক্ষাধিক জন্ম স্মরণ করতে পারেন। আমি এইজন্মে অমুকস্থানে, এই বর্ণে, এই গোত্রে, এই পাপ-পুণ্য করেছি। এই স্থান হতে চ্যুত হয়ে অমুক স্থানে জন্ম নিয়েছি। এভাবে তিনি আত্মা শাশ্বত, জগত শাশ্বত, চ্যুত-উৎপন্ন হলেও তাঁরা মহাপৃথিবী, চন্দ্র, সূর্যের ন্যায় অস্তিত্ব শাশ্বত। বুদ্ধের সমসাময়িক মুক্তবুদ্ধির দার্শনিক ‘পকুধ কাচ্ছায়ন’ ছিলেন শাশ্বতবাদী। তিনি জগতের সমস্ত বস্তুকে নিত্য বলে মনে করতেন। তার মতে, এই দেহ স্তম্ভের ন্যায় অচল, অবিকৃত পরস্পরের হানি ঘটাতে অক্ষম।
গ) উচ্ছেদদৃষ্টিঃ উচ্ছেদ মিথ্যাদৃষ্টি ব্যক্তিগণ ইহলোক বিশ্বাসী হলেও তারা পরলোক বিশ্বাস করেন না। তাঁরা কর্মের কুশলাকুশল বিশ্বাস করেন না। তাঁরা বিশ্বাস করে কেউ যদি জন্ম ধারণ করে ভোগ-বিলাসে খেলে, নেচে গেয়ে জীবনাতিবাহিত করতে পারলে তাহলে জীবন স্বার্থক। পরকাল অবিশ্বাসী হয়ে ইহলোকে চুরি-ডাকাতি, রাহাজানি, ব্যভিচার, মিথ্যা (কটু, ভেদ, বৃথা) বাক্য, প্রভৃতি অকুশল কর্ম নিয়ে জীবনাতিবাহিত করেন। বুদ্ধের সমসাময়িক ছয়জন শাস্তার মধ্যে অন্যতম ‘অজিত কেশকম্বল’। তিনি গুরুর ভৎসনা সহ্য করতে না পেরে সন্ন্যাস অবলম্বন করেন। সে কেশ নির্মিত বস্ত্র দ্বারা শরীরকে আচ্ছাদিত করত বলে ‘অজিত কেশকম্বল’। সুকৃত-দুস্কৃত কর্মের বিপাক নেই, ইহ-পরলোক বিশ্বাস করতেন না। মানুষের মৃতদেহ শবযানে করে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়, শ্মশান পর্যন্ত তার কৃতিত্ব থাকে, চিতায় অগিড়ব পর্যন্ত তার অস্তিত্ব থাকে, অস্থিসমূহ ক্রমশ বিবর্ণ প্রাপ্ত হয়, চিতাভস্মে পরিণত হয়ে আর কিছুই বাকী থাকে না।
ঘ) অক্রিয়াদৃষ্টিঃ কুশল-অকুশল কর্মের বিপাকই অবিশ্বাস অক্রিয়াদৃষ্টি। অর্থাৎ ধর্মাচরণ, ব্রহ্মচর্যা পালন, দান, শীল, সমাধি তারা বিশ্বাস করেন না। মাতা-পিতা সেবা, ভিক্ষুসংঘ সেবা, জ্ঞনী-গুণী সেবা প্রভৃতি বিপাকের প্রতি অবিশ্বাস। অকুশল (বধ, হত্যা, চুরি-ডাকাতি, ব্যভিচার, মিথ্যা (বৃথা- কটু- ভেদ বাক্য), নেশাপান বলা, ক্ষতি, জুলুম, অত্যাচার তারা বিশ্বাস করেন না। তাই তাঁরা বেপরোয়া হয়ে নির্দ্ধিদায় অকুশল কর্মাদি করে থাকেন। বুদ্ধের সমসাময়িক এক শ্রেষ্ঠির ৯৯ (নিরানব্বই ) জন দাস ছিল। পরে তাঁর ঘরে আরও একজন আসায় একশত জন পূর্ণ হওয়ায় তার নাম হয় ‘পূরণ কাশ্যপ’। সে কাজে বিরক্ত হয়ে গভীর রাত্রে পলায়ন করে, দস্যুদের হাতে ধরা পড়লে তার সমস্ত বস্ত্র কেড়ে নেয়া হয়। অতঃপর, বিবস্ত্র অবস্থায় পাশে গ্রামে উপস্থিত হন, গ্রামে তাকে বস্ত্র দান করতে চাইলে সে বলল আমি সমস্ত বিদ্যায় পরিপূর্ণতা লাভ করেছি পাপ হতে লজ্জার উৎপত্তি হয়। কাজেই আমার বস্ত্রের প্রয়োজন নেই। তার মতে, পাপ-পুণ্য নেই। আবার কোনো কোনো শ্রমণ, ব্রাহ্মণ, পৃথগজন শ্রদ্ধাদত্ত অন্নাদি উপভোগ করে মিথ্যা জীবিকা নির্বাহে মিথ্যাদৃষ্টি আশ্রয় গ্রহন করেন। যথাঃ অঙ্গ দেখে শুভাশুভ নিরূপন (অঙ্গশাস্ত্র), নিমিত্ত্ অবলম্বণে প্রশ্নের উত্তরদান বা গণনা (নিমিত্ত শাস্ত্র), লক্ষ্মণ দৃষ্টে সে․ভাগ্যেদি নিরূপন (স্বপড়বতত্ত্ব, লক্ষ্মণতত্ত্ব), সরিষাদি মুখে নিয়ে মন্ত্র আবৃত্তি করে তা আগুনে নিক্ষেপ (মুখ হোম), আঙ্গুল বা অস্থি দেখে শুভাশুভ নিরূপণ (অঙ্গবিদ্যা), গৃহ বা ঘরের ভিটা দোষারোপ (বাস্তুবিদ্যা), ভূত-বদ্যের মন্ত্র (ভূতবিদ্যা), পক্ষী শব্দের অর্থ নির্ণয় (শকুনবিদ্যা), পরমায়ু গণনা (কাকবিদ্যা), রাজাগণ আক্রমণ করবে (অমুক দিনে শত্রু রাজার নিকট উপস্থিত হবেন), বাইরের রাজার আক্রমণ হবে, অপর পক্ষের পরাজয় হবে, অমুক সময়ে চন্দ্র-সূর্য্য গ্রহন হবে, ভূমিকম্প হবে, সুবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি হবে, সুভিক্ষ-দুর্ভিক্ষ হবে, আয়নায় দেবতা অবতরন করে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা (আদর্শপ্রশ্ন), কুমারী শরীরে দেবতা আশ্রয় করে প্রশড়ব জিজ্ঞাসা (কুমারিক প্রশ্ন), নপুংসককে পুরুষ করা, পুরুষকে নারীত্ব করা, জলধারা মুখ শুদ্ধি করা (আচমন) প্রভৃতি।
সর্বোপরি, আমাদের দর্শন সম্যক হবে। দর্শন তখনই সম্যক হয়, যখন আমরা মিথ্যাদৃষ্টি (Superstition) থেকে মুক্তি পেয়ে পরম সত্যকে যর্থাথতা দর্শন করতে পারি। সম্যক দর্শন এবং সম্যক জ্ঞান হচ্ছে একই মুদ্রার এপিট-ওপিট।

 শিক্ষার্থীঃ বি.এসসি কম্পিউটার সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (২য় বর্ষ)।
 Email: bbhikkhu_969@hotmail.com

No comments

Theme images by 5ugarless. Powered by Blogger.