অন্তরঙ্গ স্মৃতির আলোকে শ্রীমৎ নন্দসার ভিক্ষু
শ্রী প্রগতি খীসা
সেদিন ছিল ৯ অক্টোবর ২০১৩ খ্রিস্টাব্দ। প্রতিদিনের ন্যায় নিজ অফিসের কার্যাদি সম্পাদন করছি কেমন যেন আধমরা মনে। জগতের অনিত্যতা, সামাজিক পারিপার্শ্বিকতা, সংঘাতময় জাতীয় জীবন এবং জীবনের ফেলে আসা অতীত স্মৃতি রোমন্তনে মাঝে মধ্যে কেন জানি মনে বিচলিত প্লাবণ ধারা বয়ে যায় অবচেতনে। সেদিনও কাজের ফাঁকে ফাঁকে কি যেন ভাবছি। কি যেন হারিয়েছি কিংবা কোথায় যেন থেমে গেছি অমন ভাবিত মনে ক্ষনেক্ষনে দিনটি অতীত হচ্ছে সেদিন। এমনি সময়ে হাতের সেলোফোনটি টিংটিং শব্দ করে জানান দিলো কে যেন ফোন করছেন আমাকে। সেলোফোনটি হাতে নিয়ে Hello বলার সাথে সাথে হিতকামী জ্ঞানপ্রিয় দাদা ঐ প্রাপ্ত থেকে কাতর কন্ঠে বলে উঠলেন, ও হে শুনোছো সবার প্রিয় শ্রদ্ধাভাজন শ্রীমৎ নন্দসার ভিক্ষু আর ইহ জগতে নেই। চলে গেছেন চিরতরে।
এ কঠিণ সংবাদ পেয়ে পরম শ্রদাষ্পদ ভদন্ত সুমনা লঙ্কার ভন্তেকে ফোন দিয়ে প্রিয় বিয়োগ দুঃখের সহভাগী হয়ে এ প্রিয় বিয়োগ দুঃখকে শক্তিতে পরিণত করতে উৎসাহ যোগালাম। যদিও প্রিয় বিয়োগ দুঃখ এত সহজে মুছে যাবার নয় । ভাবিনি এত সহসা তাঁর অন্তর্ধান হবে। এইতো মাত্র মাস তিনেক আগে আমার প্রিয়ভাজন শ্যালক ভূবনজিৎ চাকমা’র পারলোকিক শ্রাদ্ধক্রিয়া শেষে দাঁতকুপ্যা হতে ফেরার পথে ২ আগষ্ট ২০১৩ তারিখে এক পড়ন্ত বিকেলে পার্বত্য বৌদ্ধ মিশন মহাবিহারে গিয়ে দর্শন করে এসেছিলাম এই কার্তিমান মানুষটির সঙ্গে। ভগ্নদশা স্বাস্থ্য অথচ পরিপাটি গৈরিক বসন পরিধান করে অনেকটাই শায়িতাবস্থায় শমথ ভাবনায় নিমগ্ন দেখেছিলাম সেদিন। ১৫-১৬ বছর পর আমাকে দেখে ঠিক স্পষ্টভাবে চিনতে না পারলেও নামধাম পরিচয় দিয়ে ঠিকই চিনতে পারেন এবং স্বভাবগতভাবে কুশল বিনিময় করলেন। সেদিন প্রত্যক্ষ করলাম জীবন ও জগতকে নিয়ে হতাশাভাব তাঁর চোখে মূখে। আমি তাঁকে দর্শন করতে গিয়ে আশ্বস্থ করে এসেছিলাম, আপনি অচিরেই সুস্থ হয়ে উঠবেন, ভন্তে। বার্ধক্য জনিত কারণে শরীর একটু আধটুতো এমনই হয়। সংশয়ের কারণ নেই এভাবে বলতেই তিনিই বলে উঠলেন, আমি বোধই আর বেশী দিন বাঁচবো বলে মনে হয় না। সবাইতো একে একে চলে গেলো। আমাকেও চলে যেতে হবেই স্বাভাবিক নিয়মে। আমি বললাম না ভন্তে গৈরিক বসনধারী ভিক্ষুগণ অজেয়। তাঁরা মহাপ্রাণ।
ধন্য তাঁদের জীবন। আপনিইও ধন্য, এই সুখে বেঁচে থাকুন আপনি। বীর্যবান প্রাণশক্তিতে স্মৃতিভাবনায় আপনার এ সংশয় তিরোহিত হবে নিমিষেই। আরো নিরাময় দীর্ঘজীবি হোন এই বলে বিদায় নিয়ে চলে আসলাম সেদিন। তিনি পরিপক্ক একজন গৃহী ছিলেন। ইতোপূর্বে চোখের সামনে অনেক প্রিয়জনকে হারিয়েছেন। হারিয়েছেন প্রিয়তমা স্ত্রীকেও। উচ্ছল প্রাণ প্রিয় নাতি বিদ্যুত প্রভা চাকমা (বি,এস,সি) কেও হারিয়েছেন চোখের সামনে। কাজেই একজন গৈরিক বসনধারী ভিক্ষু হিসেবেতো জীবন ও জগতের প্রতি অনিহা সৃষ্টি হবে এটিই স্বাভাবিক।
এ মৃত্যু মহামৃত্যু। মৃত্যু ছিল তাঁর প্রত্যাশিত। যেন তিনি মনে প্রাণে প্রস্তুত ছিলেন মানব জীবনের অবধারিত অনিত্যতাকে আলিঙ্গন করার জন্য। কারণ ক্ষণ ভঙ্গুর মানব জীবনকে সার্থক করার প্রয়াসে অতন্ত্র কাফেলা এই শর্তবর্ষী নন্দসার ভন্তে। জীবনের সব দেনা পাওয়ানা পাঠ চুকিয়ে তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে, পারলোকিক জগতে। সেখান তিনি আর ফিরে আসবেন না কোন দিন। দুঃখ মুক্তির জন্য উপাসক-উপাসিকাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ করবেন না অমৃতময় সদ্ধর্ম দেশনা কিংবা ভিক্ষুত্ব বরণের পূবর্তণ গৃহী জীবনের প্রাণাধিক স্নেহভাজন পূত্র-কন্যা এবং অসংখ্যা আত্মীয় স্বজনদের সুখে দুঃখের আনন্দ বেদনার সমভাগীও হবেন না কখনো। তবে এ কথা সত্য যে, তিনি পারলোকিক সুখের জগত অর্থাৎ তথাগত বুদ্ধের দেশিত নির্বাণ সাক্ষাৎ করবেন। কারণ তাঁর বিশাল কর্মময় জীবনের সঞ্চিত পূণ্যরাশি অন্ততঃ এটিই প্রমাণ করে।
কে ছিলেন এই শ্রীমৎ নন্দসার ভিক্ষু ঃ
তৎকালীন বৃটিশ ভারতের পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার কাচালং অববাহিকা তারবর্তী লংগদু থানার তিনটিলা গ্রামটি ছিল ধনে ধান্যে পুষ্পভরা একটি বধিঞ্চু আদিবাসী বৌদ্ধ জনপদ। পার্শ্ববর্তী ১১নং পেতান্যামাছড়া ছড়া মৌজার প্রয়াত হেডম্যান প্রাণহরি তালুকদারের পিতামহদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠেছিল ঐতিহাসিক পেতান্যামাছড়া বৌদ্ধ বিহার। অবিভক্ত বৃটিশ-ভারতের এ বিহারটি ছিল কাচালং নদের অববাহিকা তারবর্তী অঞ্চলে প্রথম বৌদ্ধ বিহার। যেটি পরবর্তীকালে কাপ্তাই বাঁধের গভীর জলে জলমগ্ন হয়ে যায়। সলিল সমাধি ঘটে একটি ঐতিহাসিক প্রাচীণ বৌদ্ধ তীর্থস্থানের। এই হেডম্যান প্রাণহরি তালুকদার পরিবারেরই অতীব নিকটতম আত্মীয় ধীরেন্দ্র তালুকদার(শ্রীমৎ নন্দসার ভন্তের পূর্ব নাম)। চাকমা গোঝা গুত্তিভেদে তিনি ছিলেন পেজাংছিড়ি (অনেকের মতে পেডাংছড়ি) গোঝা ভক্ত চিকন্যা তালুকদারেরই অধঃস্থন পুরুষ ছিলেন এই ধীরেন্দ্র তালুকদার। তিনি ১৯০৯ সালে ভূমিপতি সম্ভ্রান্ত এক তালুকদার পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর বাবা রাম চন্দ্র তালুকদার ছিলেন¬¬¬¬¬¬¬ সদাচারী ও স্পষ্টভাষী শিক্ষানুরাগী এক ধীমান ব্যক্তি। বাবা মা উভয়েই ছিলেন অনুপম আদর্শের বৌদ্ধ উপাসক। স্থানীয় এম,ই স্কুলে পড়ালেখায় হাতে খড়ি তাঁর। তখনকার সময়ের বিদ্যাপীঠের অভাব তথা দূর্গম যোগাযোগের কারণে পড়ালেখায় খুব বেশি দূর এগুতে না পারলেও তিনি ছিলেন স্বশিক্ষায় শিক্ষিত। সাবলীলভাবে বাংলা ইংরেজি পড়তে ও লিখতে পারতেন। হস্তাক্ষর গুলো ছিল নজর কাড়ার মতো। ছিলেন সুদর্শন ও অমায়িক চেহারার অধিকারী। অন্য দশজনের মতো তিনিও সাংসারিক ধর্মে প্রবেশ করেছিলেন স্বাভাবিক বয়সে। উপযুক্ত পুত্র-কন্যা লাভ করে সাধ্যমত সবাইকে সাধারণ শিক্ষা ও ধর্মীয় শিক্ষা যথোপযুক্ত মানুষ করেছেন। তাঁর সুযোগ্য পুত্র অসীম কুমার তালুকদার পড়ালেখায় উচ্চ শিক্ষা লাভ করার পর ভিক্ষু হয়েছিলেন। ভিক্ষু না হয়ে ইচ্ছে করলেও তিনিও একজন পদ মর্যাদাধারী সরকারি চাকুরীজীবি হতে পারতেন। তা না করে এই অসীম কুমার তালুকদার যুবক বয়সে ভিক্ষু হয়েছেন। যিনি আজ শ্রীমৎ সুমনালঙ্কার ভিক্ষু নাম ধারণ করে বিশুদ্ধি বৌদ্ধ ধর্ম উচ্চতর শিক্ষার জন্য বার্মায় গিয়েছেন। সেখানে দীর্ঘ বহুবৎসর ধর্ম বিনয় শিক্ষা গ্রহণ সমাপনান্তে নিজ মাতৃভূমি পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রত্যাবর্তন করেন। স্বদেশে প্রত্যাবর্তণের পর তৎকালীন সময়ের পার্বত্য চট্টগ্রামের নিজ জাতি গোষ্টীর দুর্বিসহ জীবন যাপন দেখে মন বড়ই বিষাদে ভরে উঠে তাঁর। সমগ্র পার্বত্য গ্রাম জুড়েই তখন জন মানুষের হাকাকার। একদিকে হাজারে হাজার সহায় সম্বলহীন উদ্বাস্তু মানুষের স্রোত। শত শত পিতা-মাতা-হারা অনাথের করুন আর্তনাদ। অপরদিকে বৌদ্ধ ধর্মের সুশিক্ষার শিক্ষিত সুদেশক এবং শমর্থ ও বিদর্শন ভাবনায় পারঙ্গম বৌদ্ধ ভিক্ষু হিসেবে প্রসিদ্ধ বৌদ্ধ প্রধান দেশ থইল্যান্ড, জাপান, কোরিয়া, কম্বোডিয়া ইত্যাদি দেশের মায়াবী হাতছানি। হে সুমনালঙ্কার ভিক্ষু তুমি এসো বর্ষন করো বিশুদ্ধি ধর্মের বারিধরা। নিবারিত করো প্রকৃত বিশুদ্ধি ধর্ম বৌদ্ধ থেকে বঞ্চিত কোটি কোটি মানুষের অন্তর আতœা। এই সুখ ও আনন্দময় হাতছানি উপেক্ষা করে শুধুমাত্র এ অঞ্চলের স্বজাতীয় গরীব দুঃখী ছিন্নমূল ও অনাথ শিশুদের কল্যাণে খাগড়াছড়ি জেলা সদরের অখ্যাত পাইলট পাড়া গ্রামে আজ হতে প্রায় তিনযুগ আগে প্রতিষ্ঠা করলেন পার্বত্য বৌদ্ধ মিশন বৌদ্ধ বিহার। এ বিহারটি কেন্দ্র করে নিজ মেধায় ও আন্তরিক প্রচেষ্টায় তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন পার্বত্য বৌদ্ধ মিশন পালি কলেজ, পার্বত্য বৌদ্ধ মিশন অনাথালয়, ভোকেশন্যাল ট্রেনিং ইনিষ্ঠিটিউট, পার্বত্য বৌদ্ধ মিশন আবাসিক উচ্চ বিদ্যালয় এবং সর্বশেষ পার্বত্য বৌদ্ধ মিশন মেডিকেল ট্রেনিং ইনিষ্ঠিটিউট (ম্যাটস)।
সেখান থেকে ৪ (চার) বছর মেয়াদী মেডিকেল শিক্ষা শেষ করে উপ-সহকারী মেডিকেল অফিসার হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবার সুযোগ লাভ করতে পারবে সহজেই। এই সব মহৎগুণাবলী ক’জনের বা আছে? হ্যাঁ, আছে যাঁরা যোগ্য পিতা-মাতা তাঁদের পুত্র কন্যাগণ কেবল এ রকম গুণাধারীই হয়। তাঁরা এসব গুণ সম্পন্ন পুত্র মুখোদর্শনের জন্যেই প্রার্থনা করেন জন্ম জন্মান্তরে। বুদ্ধের ভাষায় যারা সাধারণ মানুষ তারা পার্থিব সুখের জন্য লালায়িত হন। সুখ অন্বেষণ করতে গিয়ে হাঁসি মুখে দুঃখকে আলিঙ্গন করেন। বর্তমান প্রতিযোগিতা মূলক বৈষয়িক ছন্দময় সমাজে অনার্য ধর্মের আচারণ চোখে পড়ে সবত্রই। বিহারে গিয়ে সবাই ভিক্ষুসংঘ ও বুদ্ধের পাদ মূলে বসে সকাতরে প্রার্থনা করে বসেন ভন্তে আশির্বাদ করবেন আমার ছেলেটি যেন ম্যাজিষ্ট্রেট, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়। বিসিএস পাশ করাতে পারি ইত্যাদি। কারণ ছেলেটি এসব ডিগ্রী অর্জন করতে পারলে সমাজে উচু স্থানে পাবে আর সেই ছেলের পিতা-মাতা হিসেবে তারাও বুক উচু করে বিচরণ করতে পারবে সমাজে। এই যে, পার্থিব সুখের প্রত্যাশায় পিতা-মাতারাই যে নিজ পুত্র কন্যাদের প্রচন্ড ভোগ বিলাস কিংবা অযাচিত কর্মের দিকে এগিয়ে যাবার জন্য প্রণোদণা যুগিয়ে থাকেন এটিই যে কোন কোন ক্ষেত্রে পুত্র-কন্যার জীবনে বিরূপ প্রভাব পড়ে তা কি তারা একটি বারও ভেবে দেখেছেন? আমি আমার জীবনে প্রত্যক্ষ করেছি অনেকের ছেলে ম্যাজিষ্ট্রেটের চাকুরী ছেড়ে দিয়ে অন্য চাকুরীতে চলে গেছেন কেবল মাত্র নৈতিকতা এবং বিবেক বুদ্ধির আতœ দংশনের কারণে। যদিও তারা বৌদ্ধ নয় তথাপিও পাপকে প্রচন্ডভাবে ভয় করে এমন ত্যাগ স্বীকার করেছেন। বান্দরবানের বোমাং রাজ পরিবারের সন্তান উচহ্লা বর্তমান উঃ পাঞঞা জোত থের তিনিতো অনুতপ্ত হয়ে বিচারকের চাকুরী ছেড়ে দিয়ে শেষ পর্যন্ত ভিক্ষু হয়ে গেছেন। ধীরেন্দ্র তালুকদার (নন্দসার ভিক্ষু)কে তো দেখেছি একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু সর্বপরি ধর্ম জগতের উচু নেতৃত্বের অধিকারী মহাস্থবির এর পিতা হিসেবে খুবই আনন্দ পেতেন এবং গর্ব করতেন। আমিতো মনে করি ধীরেন্দ্র তালুকদার নিঃসন্দেহে একজন মহাপ্রাণ ও আলোকিত মানুষ ছিলেন। সার্থক তাঁর সাংসারিক জীবন। একজন আদর্শবান যোগ্য পিতা ছিলেন তিনি একথাটি আমরা যেন ভুলে না যায়। এই ধীরেন্দ্র তালুকদারের মতো বর্তমান সমাজে এমন কি কোন বাবা-মা আছেন যারা বিহারে গিয়ে করজোড়ে প্রার্থনা করবেন তারা একজন বিসিএস পাশ করা ছেলের বাবা না হয়ে একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুর বাবা মা হবার জন্য প্রার্থনা করবেন। এই কীর্তিমান মানুষটির একটি পূত্রের কারণে সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধগণ আজ আলোকিত। দেশে-বিদেশে সমাদৃত একটি অখ্যাত গ্রাম পাইলট পাড়া।
সদ্ধর্ম ও মানব কল্যাণে কাজ করতে গিয়ে ভদন্ত সুমনালঙ্কার ভন্তে অনেক পরিশ্রম ও ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তাঁর আতœত্যাগের ফলে এতদুর এগিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন। আমরা তাঁর প্রতিটি কাজ কর্মে সহযোগিতা করতে পারি বা না পারি বিরোধিতা যেন না করি এ আদর্শ যদি ধারণ করতে পারি তাহলে তিনি জাতিকে অনেক কিছু উপহার দিতে সক্ষম হবেন। তিনিও আমাদের মতো একজন মানুষ হয়তোবা ক্ষ্রদ্রানুক্ষ্রদ্র ভূল থাকতেই পারে কিন্তু আমাদের জাতীয় স্বার্থে সেটি কোন কারনে আমলে নেবার মতো নয় এবং অবকাশ ও নেই। কারণ জাতি চেয়ে আছে এই কর্মবীরের পাণে। জয় তব অনিবার্য।
স্মৃতিতে অম্লাণ ধীরেন্দ্র তালুকদার (শ্রীমৎ নন্দসার ভিক্ষু)
তখন ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দ। সবে মাত্র ২য় শ্রেনীতে বি.এ পাশ করে ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে দর্শনে এম.এ ভর্তি হয়েছি। পাশাপাশি ১৮তম বিসিএস পরীক্ষার্থী হিসেবেও পরীক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণ করছি। এমন এসময় বর্তমান কানাডা প্রবাসী দয়ানন্দ ভিক্ষুর সাথে সাক্ষাৎ হলো ঢাকায় ধর্মরাজিক বিহারে। তিনি আমাকে জানালেন অচিরেই রাঙ্গামাটি আসবেন এবং রাঙ্গামাটি থেকে খাগড়াছড়ি পার্বত্য বৌদ্ধ মিশন মহা বিহারে যাবেন। আমি যেন তার সাথে সেখানে যায় এই নিশ্চয়তা চাইলেন। আমি তার বার বার অনুরোধে রাজী হয়ে গেলাম। বলাবাহুল্য যে, ইতোপূর্বে আমি কখনো এ বিহারে যায়নি এবং শ্রদ্ধাভাজন সুমনালঙ্কার ভন্তের সাথেও পরিচয় ছিলন াতখনও। যদিও তার জ্ঞান গরিমা ও সমাজ কর্মের কথা শুনে আমি আপ্লুত হতাম ভীষমভাবে। দয়ানন্দ ভিক্ষু ঢাকা হতে আসলে আমরা যথারীতি পার্বত্য বৌদ্ধ মিশনে চলে গেলাম। বর্তমান অষ্ট্রেলিয়ার মেলবোণ প্রবাসী জয়ানন্দ ভিক্ষুও গেলেন আমাদের সঙ্গে । গিয়ে দেখি চমৎকার বৌদ্ধ বিহার কমপে¬ক্স। শত শত অনাথ শিশু। খুব ভোরে এ সব অনাথ শিশুদের সুললিত কন্ঠে প্রার্থনার সুমধুর স্বরে ঘুম ভেঙ্গে যায় আমার। বিহারের উত্তর পাশে শিল্পী কনক চাঁপা চাকমার প্রতিষ্ঠিত সেমিপাকা বিল্ডিং এ প্রাথমিক ও জুনিয়র সেকশন মিলে পি,বিএম আবাসিক বিদ্যালয় খুলে বসেছেন তিনি। আবাসিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদটি শুন্য। পূর্বের প্রধান শিক্ষক নব কুমার বাবু চলে গেছেন পার্শ্ববর্তী খাগড়াছড়ি মিউনিমিপ্যাল হাইস্কুলে। পিবিএম আবাসিক বিদ্যালয়ের রেজিষ্ট্রারী কার্যক্রম তখনো কিছুই হয়নি। বিদ্যালয়ের ১০/১২ জন শিক্ষক নিয়োজিত আর শত শত অনাথ শিশুর মূলের দিকে তাখিয়ে ভদন্ত সুমনালঙ্কার ভন্তে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করতেই আমি রাজী হয়ে গেলাম। বেড়াতে গিয়ে হয়ে বসলাম বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। কাঁধে নিলাম বিদ্যালয় প্রধানের কঠিণগুরু দায়িত্ব। নবদমে রেজিষ্ট্রেরী কাজে হাত দিলাম। আমি আউট দোরে কাজ করতাম আর সহকর্মী রিপন চাকমা নিবিড়ভাবে চালিয়ে যেতেন বিদ্যালয়ের যাবতীয় একাডেমিক কর্মকান্ড। বিদ্যালয়ের কাজ করতে গিয়ে প্রচন্ডভাবে পারিপার্শ্বিকতার সম্মূখীন হয়েছি। কেউ যেন চাই না এখানে বিদ্যালয়টি হোক। প্রবল বাঁধা বিপত্তি অতিক্রম করে সেই বছরই বিদ্যালয়টি রেজিষ্ট্রেরী করে ফেলি এবং ১৯৮৮ সালে জানুয়ারী হতে উচ্চ বিদ্যালয় হিসেবে নবম শ্রেনীতে পাঠ দানের স্বীকৃতি অর্জন করি। অতঃপর পরের ঘটনা ব্যতীক্রম হিসেবে দেখা দিল। কর্মের বিপাক হেতু কেন জানি আমার ও আস্তে আস্তে দিন শেষ আসলো। নিজ হাতে গড়া বিদ্যালয়ে থাকা আমার ভাগ্যে সইলো না । মনোবেদনা নিয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে ফিরলাম। পরবর্তীতে আর কোনদিন বিদ্যালয়ে যাওয়া হয়নি আমার। কবির ভাষায় আমি এই বলে সৃষ্টি সুখের উল্লাসে গর্ববোধ করি যে, জীবনের ৩/৪টি বছর কর্মবীর সুমনালঙ্কার ভন্তের একান্ত সান্নিধ্যে অতিবাহিত করার সুযোগ পেয়েছি। তাঁর মহৎগত কর্মে আমিও অংশীদায় হয়ে কাজ করতে পেরে ধন্য মনে করি নিজেকে। কেউ স্বীকার করুক আর নহিবা করুক আমার মেধায় ও পরিশ্রমে অত্যন্ত স্বল্প সময়ে একটি পূণাঙ্গ বিদ্যালয় হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি আদায় করে নিতে সক্ষম হয়েছি। আজ বিদ্যালয়টি জেলার একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয় হিসেবে স্বগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে এর চেয়ে আর কিবা আনন্দ আছে আমার। এ বিদ্যালয়ে থাকাকালিন সময়ে প্রিয়ভাজন সুপ্রতীব দাদার (অজেয়ানন্দ) অশেষ ¯েœহ লাভ করেছি। পেয়েছি অবারিত সহযোগিতা। আমি মনে করি এ বিদ্যালয়টি আমার জীবনের এশটি শ্রেষ্ঠ কর্ম। বিদ্যালয়টির পেছনে ছুটতে গিয়ে এম,এ পাশ করা হয়নি এবং হারিয়েছি চাকুরি নেয়ার বয়সও। তথাপি আমার কোন দুঃখ নেই এসবইতো আমার কর্মের বিপাকের কারণ। এই বিদ্যালয়ে অবস্থানকালীন সময়ে বর্তমান নির্বাণ যাত্রী শ্রীমৎ নন্দসার ভিক্ষু (তখন ধীরেন্দ্র তালুকদার) কে একান্ত কাছে থেকে দেখেছি। আমি তাঁকে আজু হিসেবে সম্বোধন করতাম। খুব ভোরে তিনি ঘুম থেকে উঠে বুদ্ধের ধূপ বাতি জ্বালাতেন। দীর্ঘ সময় ধরে বন্দনা করতেন। নীরবে শমথ ভাবনার অভ্যাস করতেন তিনি। ধ্যানের নীরবতা ভেঙ্গে প্রত্যেক ভিক্ষুর সাথে দর্শন করে বন্দনা করে আসতেন। পড়তেন বুদ্ধের জাতকাবলী। মন দিয়ে ভিক্ষু সংঘের দেশনা শুনতেন আর যা শুনতেন তা নিজের জীবনে প্রয়োগ করতে অবিরাম চেষ্টা করতেন তিনি। মাঝে মধ্যে গুণগুণ করে সূত্রাবলী আবৃত্তি করতেন পরমানন্দে। এই দীর্ঘ দিনের অভ্যাসকে পূঁজি করে ৯৫ বছর বয়সে দূর্লভ ভিক্ষুত্ব জীবনে প্রবেশ করে ৯টি বছর সদ্ধম্ম সাসনে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে নির্বাণ পথের যাত্রা হলেন এই মহাপ্রাণ ভিক্ষু। তাঁর অনাগারিক জীবন চলাকালে তাঁর সাথে অনেক খোশগল্পে মেতে উঠেছি। মজা করে হেঁসেছি অনাবিল আনন্দে। সেই সব ফেলে আসা সুখের স্মৃতির মুর্হুত্বকলো আজ আমাকে খুব বেশি তাড়িত করছে রুদ্ধ আবেগে। সহজ সরল অকপট আলাপ চালিয়া এবং একজন বন্ধুবাসল মানুষ হিসেবে শুধু আমার কাছে কেন, গৃহী ভিক্ষু শাসনের সকলের কাছেই ছিলেন আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। অন্তরঙ্গ আলোকে তাঁর সঙ্গেঁ সে একদিন আমিও ছিলাম এটিই আমার পরম সৌভাগ্য বৈকী? মানুষ মরণশীল । মৃত্যু আমাদের অপরিহার্য পরিণতি। মৃত্যু মাত্রই বেদনাদায়ক। আজ তিনি নেই, তাঁর আদর্শ আছে সকলের সামনে। তাঁর মৃত্যুতে শুধু একজন সাংঘিক ব্যক্তিত্বের জীবণাবসান হয়নি জীবণাবসাণ হয়েছে একজন র্ শ্রেষ্ঠ অনুকরণীয় আদর্শ বাবার। তিনি গর্ব করতেন একজন ভিক্ষুর পিতা হিসেবে। এমন আদর্শবোধতা এ সমাজে বিরল। এই গর্বেই তো তিনি আজ নির্বাণ পথের শ্রেষ্ঠ মহাযাত্রী । জয়তু নন্দসার ভান্তে, প্রণমি তোমায় অন্তরের অন্তস্থল থেকে। নির্বাণ সাক্ষাৎতো তোমারই জন্য, খোলা অনিবার।
তৎকালীন বৃটিশ ভারতের পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার কাচালং অববাহিকা তারবর্তী লংগদু থানার তিনটিলা গ্রামটি ছিল ধনে ধান্যে পুষ্পভরা একটি বধিঞ্চু আদিবাসী বৌদ্ধ জনপদ। পার্শ্ববর্তী ১১নং পেতান্যামাছড়া ছড়া মৌজার প্রয়াত হেডম্যান প্রাণহরি তালুকদারের পিতামহদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠেছিল ঐতিহাসিক পেতান্যামাছড়া বৌদ্ধ বিহার। অবিভক্ত বৃটিশ-ভারতের এ বিহারটি ছিল কাচালং নদের অববাহিকা তারবর্তী অঞ্চলে প্রথম বৌদ্ধ বিহার। যেটি পরবর্তীকালে কাপ্তাই বাঁধের গভীর জলে জলমগ্ন হয়ে যায়। সলিল সমাধি ঘটে একটি ঐতিহাসিক প্রাচীণ বৌদ্ধ তীর্থস্থানের। এই হেডম্যান প্রাণহরি তালুকদার পরিবারেরই অতীব নিকটতম আত্মীয় ধীরেন্দ্র তালুকদার(শ্রীমৎ নন্দসার ভন্তের পূর্ব নাম)। চাকমা গোঝা গুত্তিভেদে তিনি ছিলেন পেজাংছিড়ি (অনেকের মতে পেডাংছড়ি) গোঝা ভক্ত চিকন্যা তালুকদারেরই অধঃস্থন পুরুষ ছিলেন এই ধীরেন্দ্র তালুকদার। তিনি ১৯০৯ সালে ভূমিপতি সম্ভ্রান্ত এক তালুকদার পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর বাবা রাম চন্দ্র তালুকদার ছিলেন¬¬¬¬¬¬¬ সদাচারী ও স্পষ্টভাষী শিক্ষানুরাগী এক ধীমান ব্যক্তি। বাবা মা উভয়েই ছিলেন অনুপম আদর্শের বৌদ্ধ উপাসক। স্থানীয় এম,ই স্কুলে পড়ালেখায় হাতে খড়ি তাঁর। তখনকার সময়ের বিদ্যাপীঠের অভাব তথা দূর্গম যোগাযোগের কারণে পড়ালেখায় খুব বেশি দূর এগুতে না পারলেও তিনি ছিলেন স্বশিক্ষায় শিক্ষিত। সাবলীলভাবে বাংলা ইংরেজি পড়তে ও লিখতে পারতেন। হস্তাক্ষর গুলো ছিল নজর কাড়ার মতো। ছিলেন সুদর্শন ও অমায়িক চেহারার অধিকারী। অন্য দশজনের মতো তিনিও সাংসারিক ধর্মে প্রবেশ করেছিলেন স্বাভাবিক বয়সে। উপযুক্ত পুত্র-কন্যা লাভ করে সাধ্যমত সবাইকে সাধারণ শিক্ষা ও ধর্মীয় শিক্ষা যথোপযুক্ত মানুষ করেছেন। তাঁর সুযোগ্য পুত্র অসীম কুমার তালুকদার পড়ালেখায় উচ্চ শিক্ষা লাভ করার পর ভিক্ষু হয়েছিলেন। ভিক্ষু না হয়ে ইচ্ছে করলেও তিনিও একজন পদ মর্যাদাধারী সরকারি চাকুরীজীবি হতে পারতেন। তা না করে এই অসীম কুমার তালুকদার যুবক বয়সে ভিক্ষু হয়েছেন। যিনি আজ শ্রীমৎ সুমনালঙ্কার ভিক্ষু নাম ধারণ করে বিশুদ্ধি বৌদ্ধ ধর্ম উচ্চতর শিক্ষার জন্য বার্মায় গিয়েছেন। সেখানে দীর্ঘ বহুবৎসর ধর্ম বিনয় শিক্ষা গ্রহণ সমাপনান্তে নিজ মাতৃভূমি পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রত্যাবর্তন করেন। স্বদেশে প্রত্যাবর্তণের পর তৎকালীন সময়ের পার্বত্য চট্টগ্রামের নিজ জাতি গোষ্টীর দুর্বিসহ জীবন যাপন দেখে মন বড়ই বিষাদে ভরে উঠে তাঁর। সমগ্র পার্বত্য গ্রাম জুড়েই তখন জন মানুষের হাকাকার। একদিকে হাজারে হাজার সহায় সম্বলহীন উদ্বাস্তু মানুষের স্রোত। শত শত পিতা-মাতা-হারা অনাথের করুন আর্তনাদ। অপরদিকে বৌদ্ধ ধর্মের সুশিক্ষার শিক্ষিত সুদেশক এবং শমর্থ ও বিদর্শন ভাবনায় পারঙ্গম বৌদ্ধ ভিক্ষু হিসেবে প্রসিদ্ধ বৌদ্ধ প্রধান দেশ থইল্যান্ড, জাপান, কোরিয়া, কম্বোডিয়া ইত্যাদি দেশের মায়াবী হাতছানি। হে সুমনালঙ্কার ভিক্ষু তুমি এসো বর্ষন করো বিশুদ্ধি ধর্মের বারিধরা। নিবারিত করো প্রকৃত বিশুদ্ধি ধর্ম বৌদ্ধ থেকে বঞ্চিত কোটি কোটি মানুষের অন্তর আতœা। এই সুখ ও আনন্দময় হাতছানি উপেক্ষা করে শুধুমাত্র এ অঞ্চলের স্বজাতীয় গরীব দুঃখী ছিন্নমূল ও অনাথ শিশুদের কল্যাণে খাগড়াছড়ি জেলা সদরের অখ্যাত পাইলট পাড়া গ্রামে আজ হতে প্রায় তিনযুগ আগে প্রতিষ্ঠা করলেন পার্বত্য বৌদ্ধ মিশন বৌদ্ধ বিহার। এ বিহারটি কেন্দ্র করে নিজ মেধায় ও আন্তরিক প্রচেষ্টায় তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন পার্বত্য বৌদ্ধ মিশন পালি কলেজ, পার্বত্য বৌদ্ধ মিশন অনাথালয়, ভোকেশন্যাল ট্রেনিং ইনিষ্ঠিটিউট, পার্বত্য বৌদ্ধ মিশন আবাসিক উচ্চ বিদ্যালয় এবং সর্বশেষ পার্বত্য বৌদ্ধ মিশন মেডিকেল ট্রেনিং ইনিষ্ঠিটিউট (ম্যাটস)।
সেখান থেকে ৪ (চার) বছর মেয়াদী মেডিকেল শিক্ষা শেষ করে উপ-সহকারী মেডিকেল অফিসার হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবার সুযোগ লাভ করতে পারবে সহজেই। এই সব মহৎগুণাবলী ক’জনের বা আছে? হ্যাঁ, আছে যাঁরা যোগ্য পিতা-মাতা তাঁদের পুত্র কন্যাগণ কেবল এ রকম গুণাধারীই হয়। তাঁরা এসব গুণ সম্পন্ন পুত্র মুখোদর্শনের জন্যেই প্রার্থনা করেন জন্ম জন্মান্তরে। বুদ্ধের ভাষায় যারা সাধারণ মানুষ তারা পার্থিব সুখের জন্য লালায়িত হন। সুখ অন্বেষণ করতে গিয়ে হাঁসি মুখে দুঃখকে আলিঙ্গন করেন। বর্তমান প্রতিযোগিতা মূলক বৈষয়িক ছন্দময় সমাজে অনার্য ধর্মের আচারণ চোখে পড়ে সবত্রই। বিহারে গিয়ে সবাই ভিক্ষুসংঘ ও বুদ্ধের পাদ মূলে বসে সকাতরে প্রার্থনা করে বসেন ভন্তে আশির্বাদ করবেন আমার ছেলেটি যেন ম্যাজিষ্ট্রেট, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়। বিসিএস পাশ করাতে পারি ইত্যাদি। কারণ ছেলেটি এসব ডিগ্রী অর্জন করতে পারলে সমাজে উচু স্থানে পাবে আর সেই ছেলের পিতা-মাতা হিসেবে তারাও বুক উচু করে বিচরণ করতে পারবে সমাজে। এই যে, পার্থিব সুখের প্রত্যাশায় পিতা-মাতারাই যে নিজ পুত্র কন্যাদের প্রচন্ড ভোগ বিলাস কিংবা অযাচিত কর্মের দিকে এগিয়ে যাবার জন্য প্রণোদণা যুগিয়ে থাকেন এটিই যে কোন কোন ক্ষেত্রে পুত্র-কন্যার জীবনে বিরূপ প্রভাব পড়ে তা কি তারা একটি বারও ভেবে দেখেছেন? আমি আমার জীবনে প্রত্যক্ষ করেছি অনেকের ছেলে ম্যাজিষ্ট্রেটের চাকুরী ছেড়ে দিয়ে অন্য চাকুরীতে চলে গেছেন কেবল মাত্র নৈতিকতা এবং বিবেক বুদ্ধির আতœ দংশনের কারণে। যদিও তারা বৌদ্ধ নয় তথাপিও পাপকে প্রচন্ডভাবে ভয় করে এমন ত্যাগ স্বীকার করেছেন। বান্দরবানের বোমাং রাজ পরিবারের সন্তান উচহ্লা বর্তমান উঃ পাঞঞা জোত থের তিনিতো অনুতপ্ত হয়ে বিচারকের চাকুরী ছেড়ে দিয়ে শেষ পর্যন্ত ভিক্ষু হয়ে গেছেন। ধীরেন্দ্র তালুকদার (নন্দসার ভিক্ষু)কে তো দেখেছি একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু সর্বপরি ধর্ম জগতের উচু নেতৃত্বের অধিকারী মহাস্থবির এর পিতা হিসেবে খুবই আনন্দ পেতেন এবং গর্ব করতেন। আমিতো মনে করি ধীরেন্দ্র তালুকদার নিঃসন্দেহে একজন মহাপ্রাণ ও আলোকিত মানুষ ছিলেন। সার্থক তাঁর সাংসারিক জীবন। একজন আদর্শবান যোগ্য পিতা ছিলেন তিনি একথাটি আমরা যেন ভুলে না যায়। এই ধীরেন্দ্র তালুকদারের মতো বর্তমান সমাজে এমন কি কোন বাবা-মা আছেন যারা বিহারে গিয়ে করজোড়ে প্রার্থনা করবেন তারা একজন বিসিএস পাশ করা ছেলের বাবা না হয়ে একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুর বাবা মা হবার জন্য প্রার্থনা করবেন। এই কীর্তিমান মানুষটির একটি পূত্রের কারণে সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধগণ আজ আলোকিত। দেশে-বিদেশে সমাদৃত একটি অখ্যাত গ্রাম পাইলট পাড়া।
সদ্ধর্ম ও মানব কল্যাণে কাজ করতে গিয়ে ভদন্ত সুমনালঙ্কার ভন্তে অনেক পরিশ্রম ও ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তাঁর আতœত্যাগের ফলে এতদুর এগিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন। আমরা তাঁর প্রতিটি কাজ কর্মে সহযোগিতা করতে পারি বা না পারি বিরোধিতা যেন না করি এ আদর্শ যদি ধারণ করতে পারি তাহলে তিনি জাতিকে অনেক কিছু উপহার দিতে সক্ষম হবেন। তিনিও আমাদের মতো একজন মানুষ হয়তোবা ক্ষ্রদ্রানুক্ষ্রদ্র ভূল থাকতেই পারে কিন্তু আমাদের জাতীয় স্বার্থে সেটি কোন কারনে আমলে নেবার মতো নয় এবং অবকাশ ও নেই। কারণ জাতি চেয়ে আছে এই কর্মবীরের পাণে। জয় তব অনিবার্য।
স্মৃতিতে অম্লাণ ধীরেন্দ্র তালুকদার (শ্রীমৎ নন্দসার ভিক্ষু)
তখন ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দ। সবে মাত্র ২য় শ্রেনীতে বি.এ পাশ করে ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে দর্শনে এম.এ ভর্তি হয়েছি। পাশাপাশি ১৮তম বিসিএস পরীক্ষার্থী হিসেবেও পরীক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণ করছি। এমন এসময় বর্তমান কানাডা প্রবাসী দয়ানন্দ ভিক্ষুর সাথে সাক্ষাৎ হলো ঢাকায় ধর্মরাজিক বিহারে। তিনি আমাকে জানালেন অচিরেই রাঙ্গামাটি আসবেন এবং রাঙ্গামাটি থেকে খাগড়াছড়ি পার্বত্য বৌদ্ধ মিশন মহা বিহারে যাবেন। আমি যেন তার সাথে সেখানে যায় এই নিশ্চয়তা চাইলেন। আমি তার বার বার অনুরোধে রাজী হয়ে গেলাম। বলাবাহুল্য যে, ইতোপূর্বে আমি কখনো এ বিহারে যায়নি এবং শ্রদ্ধাভাজন সুমনালঙ্কার ভন্তের সাথেও পরিচয় ছিলন াতখনও। যদিও তার জ্ঞান গরিমা ও সমাজ কর্মের কথা শুনে আমি আপ্লুত হতাম ভীষমভাবে। দয়ানন্দ ভিক্ষু ঢাকা হতে আসলে আমরা যথারীতি পার্বত্য বৌদ্ধ মিশনে চলে গেলাম। বর্তমান অষ্ট্রেলিয়ার মেলবোণ প্রবাসী জয়ানন্দ ভিক্ষুও গেলেন আমাদের সঙ্গে । গিয়ে দেখি চমৎকার বৌদ্ধ বিহার কমপে¬ক্স। শত শত অনাথ শিশু। খুব ভোরে এ সব অনাথ শিশুদের সুললিত কন্ঠে প্রার্থনার সুমধুর স্বরে ঘুম ভেঙ্গে যায় আমার। বিহারের উত্তর পাশে শিল্পী কনক চাঁপা চাকমার প্রতিষ্ঠিত সেমিপাকা বিল্ডিং এ প্রাথমিক ও জুনিয়র সেকশন মিলে পি,বিএম আবাসিক বিদ্যালয় খুলে বসেছেন তিনি। আবাসিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদটি শুন্য। পূর্বের প্রধান শিক্ষক নব কুমার বাবু চলে গেছেন পার্শ্ববর্তী খাগড়াছড়ি মিউনিমিপ্যাল হাইস্কুলে। পিবিএম আবাসিক বিদ্যালয়ের রেজিষ্ট্রারী কার্যক্রম তখনো কিছুই হয়নি। বিদ্যালয়ের ১০/১২ জন শিক্ষক নিয়োজিত আর শত শত অনাথ শিশুর মূলের দিকে তাখিয়ে ভদন্ত সুমনালঙ্কার ভন্তে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করতেই আমি রাজী হয়ে গেলাম। বেড়াতে গিয়ে হয়ে বসলাম বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। কাঁধে নিলাম বিদ্যালয় প্রধানের কঠিণগুরু দায়িত্ব। নবদমে রেজিষ্ট্রেরী কাজে হাত দিলাম। আমি আউট দোরে কাজ করতাম আর সহকর্মী রিপন চাকমা নিবিড়ভাবে চালিয়ে যেতেন বিদ্যালয়ের যাবতীয় একাডেমিক কর্মকান্ড। বিদ্যালয়ের কাজ করতে গিয়ে প্রচন্ডভাবে পারিপার্শ্বিকতার সম্মূখীন হয়েছি। কেউ যেন চাই না এখানে বিদ্যালয়টি হোক। প্রবল বাঁধা বিপত্তি অতিক্রম করে সেই বছরই বিদ্যালয়টি রেজিষ্ট্রেরী করে ফেলি এবং ১৯৮৮ সালে জানুয়ারী হতে উচ্চ বিদ্যালয় হিসেবে নবম শ্রেনীতে পাঠ দানের স্বীকৃতি অর্জন করি। অতঃপর পরের ঘটনা ব্যতীক্রম হিসেবে দেখা দিল। কর্মের বিপাক হেতু কেন জানি আমার ও আস্তে আস্তে দিন শেষ আসলো। নিজ হাতে গড়া বিদ্যালয়ে থাকা আমার ভাগ্যে সইলো না । মনোবেদনা নিয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে ফিরলাম। পরবর্তীতে আর কোনদিন বিদ্যালয়ে যাওয়া হয়নি আমার। কবির ভাষায় আমি এই বলে সৃষ্টি সুখের উল্লাসে গর্ববোধ করি যে, জীবনের ৩/৪টি বছর কর্মবীর সুমনালঙ্কার ভন্তের একান্ত সান্নিধ্যে অতিবাহিত করার সুযোগ পেয়েছি। তাঁর মহৎগত কর্মে আমিও অংশীদায় হয়ে কাজ করতে পেরে ধন্য মনে করি নিজেকে। কেউ স্বীকার করুক আর নহিবা করুক আমার মেধায় ও পরিশ্রমে অত্যন্ত স্বল্প সময়ে একটি পূণাঙ্গ বিদ্যালয় হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি আদায় করে নিতে সক্ষম হয়েছি। আজ বিদ্যালয়টি জেলার একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয় হিসেবে স্বগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে এর চেয়ে আর কিবা আনন্দ আছে আমার। এ বিদ্যালয়ে থাকাকালিন সময়ে প্রিয়ভাজন সুপ্রতীব দাদার (অজেয়ানন্দ) অশেষ ¯েœহ লাভ করেছি। পেয়েছি অবারিত সহযোগিতা। আমি মনে করি এ বিদ্যালয়টি আমার জীবনের এশটি শ্রেষ্ঠ কর্ম। বিদ্যালয়টির পেছনে ছুটতে গিয়ে এম,এ পাশ করা হয়নি এবং হারিয়েছি চাকুরি নেয়ার বয়সও। তথাপি আমার কোন দুঃখ নেই এসবইতো আমার কর্মের বিপাকের কারণ। এই বিদ্যালয়ে অবস্থানকালীন সময়ে বর্তমান নির্বাণ যাত্রী শ্রীমৎ নন্দসার ভিক্ষু (তখন ধীরেন্দ্র তালুকদার) কে একান্ত কাছে থেকে দেখেছি। আমি তাঁকে আজু হিসেবে সম্বোধন করতাম। খুব ভোরে তিনি ঘুম থেকে উঠে বুদ্ধের ধূপ বাতি জ্বালাতেন। দীর্ঘ সময় ধরে বন্দনা করতেন। নীরবে শমথ ভাবনার অভ্যাস করতেন তিনি। ধ্যানের নীরবতা ভেঙ্গে প্রত্যেক ভিক্ষুর সাথে দর্শন করে বন্দনা করে আসতেন। পড়তেন বুদ্ধের জাতকাবলী। মন দিয়ে ভিক্ষু সংঘের দেশনা শুনতেন আর যা শুনতেন তা নিজের জীবনে প্রয়োগ করতে অবিরাম চেষ্টা করতেন তিনি। মাঝে মধ্যে গুণগুণ করে সূত্রাবলী আবৃত্তি করতেন পরমানন্দে। এই দীর্ঘ দিনের অভ্যাসকে পূঁজি করে ৯৫ বছর বয়সে দূর্লভ ভিক্ষুত্ব জীবনে প্রবেশ করে ৯টি বছর সদ্ধম্ম সাসনে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে নির্বাণ পথের যাত্রা হলেন এই মহাপ্রাণ ভিক্ষু। তাঁর অনাগারিক জীবন চলাকালে তাঁর সাথে অনেক খোশগল্পে মেতে উঠেছি। মজা করে হেঁসেছি অনাবিল আনন্দে। সেই সব ফেলে আসা সুখের স্মৃতির মুর্হুত্বকলো আজ আমাকে খুব বেশি তাড়িত করছে রুদ্ধ আবেগে। সহজ সরল অকপট আলাপ চালিয়া এবং একজন বন্ধুবাসল মানুষ হিসেবে শুধু আমার কাছে কেন, গৃহী ভিক্ষু শাসনের সকলের কাছেই ছিলেন আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। অন্তরঙ্গ আলোকে তাঁর সঙ্গেঁ সে একদিন আমিও ছিলাম এটিই আমার পরম সৌভাগ্য বৈকী? মানুষ মরণশীল । মৃত্যু আমাদের অপরিহার্য পরিণতি। মৃত্যু মাত্রই বেদনাদায়ক। আজ তিনি নেই, তাঁর আদর্শ আছে সকলের সামনে। তাঁর মৃত্যুতে শুধু একজন সাংঘিক ব্যক্তিত্বের জীবণাবসান হয়নি জীবণাবসাণ হয়েছে একজন র্ শ্রেষ্ঠ অনুকরণীয় আদর্শ বাবার। তিনি গর্ব করতেন একজন ভিক্ষুর পিতা হিসেবে। এমন আদর্শবোধতা এ সমাজে বিরল। এই গর্বেই তো তিনি আজ নির্বাণ পথের শ্রেষ্ঠ মহাযাত্রী । জয়তু নন্দসার ভান্তে, প্রণমি তোমায় অন্তরের অন্তস্থল থেকে। নির্বাণ সাক্ষাৎতো তোমারই জন্য, খোলা অনিবার।
লেখক পরিচিতি ঃ শ্রী খীসা কবি ও সাহিত্যিক। সদস্য, ওয়াল্ড পোয়েটস সোসাইটি, এ্যানথেস, গস্কীস। ই-মেইল: infonetkhisa@gmail.com
(নন্দসার স্মারকে প্রকাশিত, ২৯ নভেম্বর ২০১৩ইং)
No comments
Post a Comment