চাকমাদের ধর্মীয় সমাজ ও সংস্কৃৃতি
--দীপংকর চাকমা
ধর্ম ও সংস্কৃতি শব্দ দুইটি পরষ্পর গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত । একটিকে বাদ দিয়ে অপরটি পুরোপুরি আলাদা করে ভাবা বা বিশ্লেষণ করাপ কঠিন। সংস্কৃতির এই দুইটি দিক , একটি ধর্মীয় সংস্কৃতি অরপটি সামাজিক সংস্কৃতি । এ দুইটি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে জাতিগত স্বাতন্ত্র্য বা পরিচয় পাওয়া যায়। আরো একটু পরিষ্কার ভািষায় বলতে গেলে একটি জাতির পরিচয় বা স্বাতন্ত্র্য নির্ণয়ের ক্ষেত্রে যে কয়টি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান প্রয়োজন তার মধ্যে এই দুইটি অন্যতম ।
তবে মানব সভ্যতার এই সংস্কৃতি কখন থেকে গড়ে উঠেছে বা ভিন্ন ভিন্ন জাতির ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতিই বা কিভাবে সৃষ্টি হলো তার সুনির্দিষ্ট বা সঠিক বর্ণনা করা মুশকিল । কারন যেহেতু মানব সভ্যতার ইতিহাস অতি প্রাচীন, সেটা লক্ষ কিংবা কোটি নয় বরং কল্প-কল্পান্তর । এখন প্রশ্ন আসতে পারে কল্প কি? কল্পের সময় নির্ধারন কি রকম? জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব গৌতম বুদ্ধ এর যথার্থ ব্যাখ্যা দিয়েছেন - এইভাবে, এক এর ডান দিকে একশত আশিটা শুন্য বসালে যে সংখ্যা দাড়াঁয় তাহা হল এক অসংখ্যা। এখন ধরুন মানুষের আয়ুষ্কাল এক অসংখ্যা বছর, মানুষের চিত্তে রাগ, হিংসা, দ্বেষ, কুপ্রবৃত্তি ও মোহ বেড়ে যাওয়ার কারনে এক অসংখ্যা বছর আয়ুষ্কাল থেকে প্রতি একশত বছরে এক বছর কমতে থাকে। এভাবে কমতে কমতে মানবের পরমায়ু দশ বছরে নেমে আসবে, তখন পাপের ভারে পৃথিবী ধ্বংস হবে সেটা অস্ত্র দিয়ে মারামারি, দুভিক্ষের কারনে কিংবা দুরারোগ্য ব্যাধির কারনে হতে পারে । পুণ্যবান লোকেরাই একমাত্র পরিত্রাণ পাবেন। যাঁরা বেঁচে থাকবেন তাদের মনে সদভাব সৃষ্টি হবে পরষ্পর পরষ্পরকে আপন জ্ঞাতি ভাব জ্ঞান সৃষ্টি হবে। ফলত: মানুষের আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি পেতে থাকবে আরো প্রতি একশত বছরে এক বছর এবং দ্বিগুন হারে বৃদ্ধি পেতে পেতে এক অসংখ্য বছরে ইন্নীত হবে । ভগবান বুদ্ধ বলেছেন এভাবে মানুষের একবার উর্ধ্বগতি ও একবার নিন্মগতি হতে যে সময়টুকু লাগে তাহাই এক কল্প । যদিও ভারতীয় লেখক পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন তার রচিত “মানব সমাজ” নামক গ্রন্থে মানব জাতির ইতিহাস ও প্রারম্ভিক বিকাশের সময় বিশ লক্ষ বছর উল্লেখ করেছেন, তথাপি তার এই সময় জ্ঞানের উপর প্রশ্ন থেকে যায়। কারন তথাগত সম্যক সম্বুদ্ধ গৌতম বুদ্ধের জন্মের আগেও আটাশ বুদ্ধ এবং আরো অগনিত বুদ্ধের জন্মের কথা পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন। এই সময়ের হিসাব অগনিত এবং অপরিমেয়। কাজেই মানব জাতির জন্ম, সংস্কৃতির বিকাশ কিংবা সময়ের পরিধি রাহুলজীর যুক্তিকে খণ্ডন করে। তাই এই বিষয়ে বেশি তাত্ত্বিক পর্যালোচনা করা আমার পক্ষে কঠিন। সংস্কৃতির গোড়াপত্তন খুঁজতে গিয়ে আমি অনেক অতীতের দিকে ফিরে গেছি যাহার পর্যালোচনা ও তাত্ত্বিক বিশ্লেষন বেশ জটিল, যেহেতু আমার উদ্দেশ্য চাকমা সমাজের সাংস্কৃতিক বিশ্লেষন সুতরাং বর্তমান প্রেক্ষাপটেই এসে গেলাম। ধর্ম ও সামাজিক সংস্কৃতি একটি জাতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ দিক । কারন এই বিষয়গুলিই একটি জাতিকে টিকে রাখে, স্বাতন্ত্র্য সত্ত্বা নিয়ে। যে জাতি তার নিজস্ব সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলে তার আর কিছুই থাকে না, অন্য জাতি বা সংস্কৃতির পরিচয়েই পরিচিতি হতে হয়। সংস্কৃতি পরিবর্তনশীল, ঠিক আছে – কিন্ত তাহা যদি পুরোপুরি বিলীন হয়ে যায় অথবা একই জাতি সমাজের ভিন্ন ভিন্ন রীতি নীতি পালন করা হয় তাহলে একই জাতির পরিচিতি হলো কিভাবে ? রাজনীতি বিষয়ে ভিন্ন কৌশল,মত থাকতে পারে কিন্তু সমাজের মুল সংস্কৃতির বিষয়গুলি যদি ভিন্ন ভিন্ন হয় তাহলে অদুর ভবিষ্যতে সমাজ বিভক্ত হবে না তার নিশ্চয়তা কোথায় ?
সামাজিক সংসাকৃতির পাশাপাশি ধর্মীয় সংস্কৃতিরও ব্যপক পার্থক্য পরিলক্ষিত হচ্ছে । চাকমা সমাজে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত অর্থাৎ জন্ম, বিবাহ ও মৃত্যু উপলক্ষে যেসব রীতি নীতিপালন করা হতো তার অনেক কিছুই এখন আর পালন করা হয় না । অথবা অঞ্চল ভেদে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে পালন করা হয় । অতি সম্প্রতি আমি মাইসছড়ি, পূর্ব মানিকছড়ি নামক গ্রামে একটি শবদাহ অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহন করে তাদের অনুসৃত রীতিনীতি লক্ষ্য করি। চাকমা সমাজে সাধারনত মরদেহ “রুভঘরে” তোলার আগে “রাধাঘর” এর মাধ্যমে নাচিয়ে সাতবার প্রদক্ষিণ করে চিতার উপর তোলা হয়। এবং চিতার চার কোনায় চারটি “চান্নোকানি” বাঁশ পুতে দেওয়া হয়। লক্ষ্য করলাম তারা এসবের কোনটিই করেনি, আবার দাহ ক্রিয়ায় অংশ গ্রহনকারী সবাই নিজ নিজ হাতের লাকড়ি টুকরাগুলো আগুন ধরানো ছাড়াই রুভঘরে রেখে চলে গেলো । একমাত্র মৃতের ঘরের লোক এবং নিকটতম দু‘একজন বাদে বাকিরা সবাই এভাবে চলে যাওয়ায় আমি রীতিমত অবাক হই এবং আমার মনে কিছু প্রশ্নের উদ্রেগ হয়, তাহলে তো এখানে এত লোকের অংশ গ্রহনের কোন প্রযোজন ছিল না। যারা জঙ্গল থেকে গাছ-বাঁশ সংগ্রহ করে এনে রুভঘর তৈরী করেছে তারা এবং মাত্র কয়েকজন লোকেই এই শবদাহ কাজটা সমাধা করতে পারত। অন্যদিকে ধর্মীয় সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও অঞ্চলভেদে ভিন্ন পরিলক্ষিত হচ্ছে, অনেক ধর্মীয়গুরু নতুন নতুন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জন্ম দিচ্ছেন, এ- প্রসঙ্গে সম্প্রতি পানছড়ি উপজেলার তারাবন ভাবনা কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত “ছিমিতং” পূজা আমাকে আকৃষ্ট করে । যাহা ইতিপূর্বে শুনি নাই বা কেউ শুনেছে কিনা জানিনা এবং একজন স্থবির মহোদয় থেকে জানতে চেয়েছি যিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পালি সাহিত্যে এম এ পাশ করেছেন, তিনি বলেন- বৌদ্ধ সাহিত্যে কোথাও উল্লেখ আছে কিনা যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে ।
এখানে আরো একটি বিষয় আমি তুলে ধরতে চায়। বুদ্ধ ধর্মের বিশিষ্ট ধর্মীয় গুরু বান্দরবান পসস্রাম বৌদ্ধ বিহারের সুযোগ্য অধ্যক্ষ শ্রদ্ধেয় শ্রীমৎ উ. পঞঞা জোত্ থের মহোদয়ের অন্যতম শিষ্য শ্রদ্ধেয় শ্রীমৎ ভিক্ষু উ পঞঞা সীরি মহোদয়ের লিখিত “ ধর্মের বিশুদ্ধি চাইলে সত্যকে সত্য বলুন” নামে একটি ছোট প্রকাশনা বাহির হয় যা আমাকে আকৃষ্ট করে । এ প্রকাশনায় শ্রদ্ধেয় বনভান্তের বিভিন্ন সময়ে দেয়া ধর্ম দেশনার ভুল, মিথ্যা অরহত সেজে জনগনের সাথে প্রতারনা ও বুদ্ধের বানী গুলো বনভন্তের বানী নামে প্রকাশনার দায়ে তাকে এবং তার অনুচর দেরকে দায়ী করা হয়। বুদ্ধ ধর্মকে ভুল করে ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য আগামী প্রজন্মের উপর এর প্রভাব পড়বে বলে আশংকা ব্যক্ত করেছেন ভিক্ষু উ. পঞঞা সীরি মহোদয়। যে ভান্তের শিক্ষা ও অনুপ্রেরনায় সারা পার্বত্য চট্টগ্রাম সহ বর্হিবিশ্বেও ধর্মের আলো ছড়িয়ে পড়েছে বলে মনে করেন অনেকে আর তাহা যদি মিথ্যা হয় ? তাহা ভান্তের জীবিতাবস্থায় এই বিষয়গুলি তুলে ধরা উচিত ছিল। তবে শ্রদ্ধেয় প্রজ্ঞানন্দ মহোদয়ের লিখিত “পরচর্চা বনাম আত্মচর্চা” প্রবন্ধটি শ্রীমৎ উ. পঞঞা সীরি মহোদয়ের প্রকাশনাটি সমর্থন করে । কিন্ত প্রশ্ন হলো যে ধর্মীয় গুরু অর্ধ শতাব্দী পর্যন্ত সকল প্রানীর হিত ও মঙ্গলের উদ্দেশ্যে ধর্ম প্রচার করেছেন, তাহা যদি ভূল ও মিথ্যা প্রমাণিত হয় তাহলে চাকমাদের নিকট ভবিষ্যত সুখকর নয়। কিন্ত এখন প্রশ্ন হলো , তাহলে সামাজিক সংস্কৃতি বা ধর্মীয় সংস্কৃতির মুল বেশিষ্ট্য কি ?। এর উত্তর খুজতে গিয়ে আমাদেরকে আরো রাজনৈতিক সংস্কৃতির দিকে তাকাতে হবে। কিন্ত সেদিকেও কোন কুল কিনারা নাই । এক কথায় - রাজনীতি, ধর্ম ও সমাজ কোনটিই আমাদের ঠিক আছে বলে মনে হয় না। কারন ধর্ম সমাজ বা রাজনীতি এই তিনটির কোনটিই একক কারোর নির্দেশনা বা নেতৃত্বে আমাদের সমাজ নেই। যার যার খেয়াল খুশিমত চলতেছে। এভাবে চলতে থাকা মানে আগ্রাসী শক্তিকে সাহস যোগানো । আমি মনে করি এর থেকে মুক্তির উপায় আমাদেরকে খুজেঁ বাহির করতে হবে। বিশেষ করে যারা সমাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বা প্রতিনিধিত্ব করতেছেন তাদের ভুমিকা রাখা জরুরী দরকার এবং সেটা দেরী নয়, এখনই। একই জাতি গোত্র,সমাজ কেন আমরা ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক রীতি ধর্মীয় নীতি পালন করবো। ধর্মীয় সংস্কৃতির ক্ষেত্রে মহান ভিক্ষু সংঘের অনেক পণ্ডিত, প্রাজ্ঞ ভিক্ষু মহোদয় রয়েছেন, তারাঁ গোটা সমাজে এক ও অভিন্ন ধর্মীয় রীতিনীতি পালনের বিধি বিধান প্রবর্তন করতে পারেন।
লেখক : বাংলাদেশ বেতার,চট্টগ্রাম এর চাকমা ভাষায় রুপান্তরকারী ও কথিকা পাঠক।
(নন্দসার স্মারকে প্রকাশিত, ২৯ নভেম্বর ২০১৩ইং)
1 comment
চাকমাদের ক্ষেত্রে বৌদ্ধ ধর্ম ব্যপক ভাবে সুচনা করেছেন কিন্তু বেশি লেখক হওয়ায় কার দিকে কে নজর দিবে ভেবে অসক্ষমতা।চাকমাদের ক্ষেত্রে আমার হীনতা মনে হয়।আমরা নামে মাত্র কিন্তু ধর্মকে গ্রহনে অসক্ষমতা।কিন্তু অন্যান্য ধর্মবলাম্বীদের দেখ তারা কিভাবে নিজ ধর্ম ব্যপারে সচেতন।
Post a Comment