দেশান্তরের সেই বাহাত্তর দেবশিশু
লিখেছেনঃ আরিফ জেবতিক (তারিখঃ শনিবার, ০২/০৪/২০১১ – ০৭:৫১)
একদা কোনো এক কালে সে অনেক দূরের পথ।
পাহাড়ের পর পাহাড় পার হলে, তারও পরে আবার পাহাড় এসে আকাশ ঢেকে দেয়। তখনো
সেখানে বিজ্ঞানের আবিষ্কারগুলো পৌঁছায়নি। নিঝুম নীরব পাহাড়ি রাস্তায় পায়ে
হেঁটে গ্রাম থেকে একটু বড় বাজারে আসতে অনেক দিন সময় লেগে যায়। সে রকমই একটি
স্থান রাঙামাটির দীঘিনালা, আশপাশের ছোট্ট ছোট্ট গ্রামের তুলনায় বেশ বড়
জনপদ। সেখানে সবুজ পাহাড়ের কোলে একটা ছোট্ট আশ্রম। সেই আশ্রমে খেলা করে
পাহাড়ি অনাথ শিশুরা। কারো বাবা নেই, কারো বা মা নেই, কারো দুজনেই আছে;
কিন্তু ঊষর পাহাদের দারিদ্র্যে নিজের সন্তানকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার সাধ্য
নেই। শিশুগুলোর আশ্রয় তাই দীঘিলানার এই ছোট্ট আশ্রমে। আশ্রমটির নাম ‘পার্বত্য চট্টল বুদ্ধ অনাথ আশ্রম’।
ছোট্ট শিশুরা সেখানে দিনমান খেলা করে,
লণ্ঠনের আলোয় বই পড়তে বসে প্রতি সন্ধ্যায়। আর শেখে মনুষত্বের বাণী, ‘অহিংসা
পরম ধর্ম।’, ‘জীবে দয়া করে যেই জন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।’এ রকম এক নিঝুম
শান্তির রাজ্যে এক দিন অহিংসাকে ঠেলে ফেলে হিংসার অশান্তি তার লকলকে জিভ
বের করে। রাষ্ট্রের নিয়ামক শক্তিরা কৌশলগত অবস্থান নেন। পার্বত্য অঞ্চলে
আদিবাসী নৃতাত্তি্বক জনগোষ্ঠীর একক সংখ্যাধিক্য তাদের মনে আশঙ্কার ছায়া
হানে। অথবা রাজনীতির হয়তো অন্য কোনো কূটচাল ছিল, সে আমাদের জানা নেই। এর
আগের দশকজুড়েই পার্বত্য অঞ্চলে শোনা যাচ্ছিল নতুন শব্দ ‘সেটেলার’। সমতলের
বাঙালিরা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সেখানে গিয়ে ঘর বাঁধছিল। শত বছর ধরে যে
ভূখণ্ডের উত্তরাধিকার ছিল পাহাড়িদের, সেই দাগ-খতিয়ান আর পিলার নম্বরের
কাজির খাতা ঘেঁটে সেই জমির মালিক হয়ে যায় সমতলের বাঙালিরা। কারণ একটাই,
পেছনে রয়েছে রাষ্ট্রযন্ত্রের আনুকূল্য। অতএব সংঘাত অনিবার্য ছিল।
শান্তিবাহিনীর নামে পাহাড়ের এক দল মানুষ অস্ত্র তুলে নেয়। আর সেটি ঠেকানোর
নামে পাহাড়ের চূড়ায় দেখা যায় রাষ্ট্রীয় বাহিনীর একচালা ক্যাম্প। অশান্তি
তখন এখানে-ওখানে। দুই পক্ষের সংঘাতে প্রাণের অপচয় অহর্নিশ। তেমনই কোনো এক
সংঘাতের পর রক্তের স্রোতে লাল হয় পাহাড়ের মাটি। সেটেলার আর সেটেলারদের
পিছু পিছু রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর একক আধিপত্য। দীঘিনালা তাই তখন চরম
অশান্তির শিকার। পাহাড়িরা দলে দলে রাষ্ট্রসীমা থেকে নির্বাসিত হয়ে আশ্রয়
নিচ্ছে পাশের দেশ ভারতে। তেমনি এক মধ্যরাতে আশ্রমের অধিকারীরা ডেকে তোলেন
শিশুদের। সবুজ পাহাড় আর নিরাপদ নয়। তাদের যেতে হবে এই দেশের সীমা ছেড়ে।
মধ্যরাতের অন্ধকারে একদল পাহাড়ি চুপচাপ পথ চলতে থাকে।
গহীন অন্ধকারে কোথাও ডেকে ওঠে একটা অচেনা
পাখি, সরসর শব্দে পাশ কাটিয়ে যায় কোনো এক বিষধর সাপ। আর সেই আশ্রমের শিশুরা
আশ্রমের অধিকারীদের সঙ্গে, নিজের মা-বাবা আর স্বজনদের কারো কারো সঙ্গে
রাতের অন্ধকারে পথ চলতেই থাকে, চলতেই থাকে…এখন তুমি কোথা আছ, কেমন আছ
পাহাড়ের সেই অন্ধকার রাতের অনেক অনেক বছর পরে, যখন শান্তিচুক্তির মোড়কে
শান্তিবাহিনীর অস্ত্র জমা নেওয়া শেষ, মিডিয়ায় উচ্চকিত হচ্ছে শান্তির বারতা,
সেই সময়ে এসে তেমনই এক শিশুর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় আমার। সেদিনের সেই
দেশত্যাগী শিশু আজ প্যারিসের ব্যস্ততম রাস্তায় দাঁড়ানো যুবক। নাম তাঁর
শান্তি চাকমা। আমার প্যারিসের বন্ধুরা জানায়, বাংলাদেশের সন্তান হলেও
শান্তি চাকমা বাংলা জানেন না মোটেও। শেখার সুযোগ হয়নি কোনো দিন। আমি অবাক
হই। রাষ্ট্র তার সবটুকু ঢেলে দিয়ে যখন শিক্ষার কথা বলছে, তখন এই আদিবাসী
যুবক কোথায় ছিলেন যে দুয়েকটা বাংলা শব্দও কোনো দিন বোধগম্য হলো না তাঁর। আর
তখনই আমি জানতে পারি দেশত্যাগী শিশুদের সেই ব্যথাতুর ইতিহাস। পুরোটা নয়,
ছাড়া ছাড়া। শান্তি চাকমা বা অন্য কেউই এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চান না।
বাংলাদেশ তাঁদের কাছে বড্ড বড় অভিমানের নাম, জীবনের পরতে পরতে নিত্য বয়ে
নেওয়া কষ্টের স্মৃতি। তাঁরা সেই স্মৃতি ভুলে যেতে চান, অথবা রেখে দিতে চান
একান্ত নিজের গল্প করে। তাই বাংলাদেশের এক সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলার কোনো উ
সাহ তাঁর নেই। তবু অনুরোধ আর চাপাচাপির পর, অজন্তা ইলোরা চাকমার আন্তরিক
চেষ্টার পর প্যারিসের চাকমা বন্ধুদের কয়েকজন মুখ খোলেন। সব তাঁদের মনেও
নেই, সে তো অনেক দিন আগের কথা, দিন-তারিখ কে মুখস্থ করে রেখেছে সেকালে!
জীবনের ওপর দিয়ে যে ঝড়ঝাপটা বয়ে গেছে, কে সেই দুঃখের দিনলিপি লিখে ভিন দেশে
অপেক্ষায় আছে? তবু ছাড়া ছাড়া সেই গল্পটুকুই শোনা হয় প্যারিসের এক বিষণ্ন
বিকেলে। কথা যাঁরাই বলেন, তাঁরা সবাই নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক। আজ এত দিন পরও
তাঁদের চোখে ভীতি খেলা করে। কে জানে, কখন কী হয়! কী প্রয়োজন নাম প্রকাশের,
কী দরকার পত্রিকায় ছবি দেওয়ার?
গল্প শুরুর পর ঃ কোন তারিখে তাঁরা বাংলাদেশ ছেড়ে
উদ্বাস্তু হয়েছিলেন, সেটি আজ আর কারোই মনে নেই। বয়স তখন কতই বা তাঁদের?
সবচাইতে ছোটটি মাত্র ছয় বছরের। এই শিশুরা যখন দেশ ছাড়ে, কারো কারো সঙ্গে
মা-বাবা ছিলেন, কারো আবার কেউই ছিল না আশ্রমের গুরু ছাড়া। পথ চলতে চলতে এক
দিন তারা বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ড ছেড়ে পেঁৗছে যায় ভারতের রাষ্ট্রসীমায়।
বাংলাদেশের উদ্বাস্তু আদিবাসীদের জন্য তখন
ভারতে গড়ে উঠেছে শরণার্থী শিবির। শিশুদের মাঝে যাদের সঙ্গে পরিবারের কেউ
ছিল, তাদের ঠাঁই হয় ঠাকুম ও যতনবাড়ি আশ্রয় শিবিরে। আর যাদের কেউ নেই?
আশ্রমের অধিকারী তাদের নিয়ে ওঠেন হরবুক নামের আরেকটি শিবিরে। তারপর? তারপর
দিন গড়ায়। পর-রাষ্ট্রের করুণার উপরে বেঁচে থাকে বাংলাদেশের সন্তানরা।
শিবিরের পরিবেশে সেই করুণার ছাপ। এ দেশে যারা গাছ আর পাহাড়ের ছায়ায় বড়
হয়েছে, শিবিরের ঘিঞ্জি পরিবেশে তাদের দমবন্ধ হতে থাকে। সমস্যা বেশি হয়
শিশুদের। পর্যাপ্ত খাবার নেই, চিকি সার ব্যবস্থা অপ্রতুল, আর পড়াশোনার তো
কোনো প্রশ্নই নেই। শরণার্থী শিবিরের ঘেরাটোপে ধুঁকতে থাকে তারা। গায়ের কাপড়
পুরনো হতে হতে খসে যায়, অভুক্ত শরীরে কংকালসার হয় পাহাড়ের বাতাসে পুষ্ট
দেহগুলো। কেউ জানে না তাদের গন্তব্য কোথায়?
অতঃপর ‘পার্তাজ’ পর্ব ঃ শিশুরা কবে দেশ ছেড়েছিল সঠিক তারিখ কেউই
বলতে পারেন না। কেউ বলেন ১৯৮৪, কেউ বলেন ১৯৮৫। বছরের পর বছর শরণার্থী
শিবিরে মানবেতর জীবনযাপন করতে করতে তারা কাটাচ্ছিল এক অনিশ্চয়তা ভরা জীবন।
এই সময়ে আশ্রমের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় বিশ্বের বড় বড় শিশু সংস্থার
সঙ্গে। তেমনই একটি সংগঠন ফ্রান্সের ‘পার্তাজ’ (PARTAGE)। সারা বিশ্বের
দুর্গত শিশুদের নিয়ে কাজ করে সংস্থাটি। আশ্রমের আবেদনে পার্তেজ সাড়া দেয়।
তাঁরা এই শিশুদের জন্য ফ্রান্সেই খুঁজে বের করে নতুন আশ্রয়। ফ্রান্সের
অপরিসীম দরদী কিছু মানুষ এসব শিশুর নতুন মা-বাবা হতে আগ্রহ প্রকাশ করেন।
আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে পুনর্বাসনের জন্য পার্তেজ ব্যবস্থা নেওয়ায়
শিশুদের যাত্রার প্রস্তুতি শুরু হয়। গল্পের এই পর্যায়ে আমি প্রশ্ন করি,
‘আপনাদের, যাঁদের মা-বাবা ছিলেন, তাঁরা যেতে দিলেন?’ চুপ হয়ে পড়ে চার পাশ।
কারো কারো চোখ ছলছল। জবাবটা দেয় অজন্তা ইলোরা চাকমা। বলে, ‘তুমি সে অবস্থা
বুঝতে পারবে না। আমাদের কোনো দেশ ছিল না। কোনো দিন নিজের বাড়িতে ফিরে যেতে
পারব, এমনটা দূরবর্তী স্বপ্নেও ভাবেনি কেউ। সবাই মেনেই নিয়েছিল, এই
শরণার্থী শিবিরে খেয়ে না খেয়ে ধুঁকতে ধুঁকতেই তাঁদের জীবন শেষ হয়ে যাবে। এই
সময় সবাই চেয়েছিল নিজেদের সন্তানদের এই উদ্বাস্তু জীবনের বাইরে নিয়ে যেতে।
কেউ তাই মানা করেনি, যতই কষ্ট হোক, নিজের সন্তানকে ছেড়ে দিয়েছে অনিশ্চিত
ভবিষ্যতের হাতে।’
আমি চুপ মেরে যাই। আসলেই সে কষ্ট বুঝতে
পারব না আমি। কী পরিস্থিতিতে একজন বাবা কিংবা মা তাঁর সন্তানকে অচেনা দূর
দেশে পাঠিয়ে দেন, সেটি কল্পনা করাও দুঃসাধ্য। এই বেদনা একান্তই তাঁদের,
যাঁরা জীবনের দামে এর মূল্য চুকিয়েছেন। আমি জিজ্ঞেস করি, ‘তারপর?’ তারপর
শিশুদের একসঙ্গে করা হয়। সব মিলিয়ে ৭২ জন। শেষ বেলায় তারা বিদায় নেয়
বাকিদের কাছ থেকে। জানে না কেউই, পিছু রেখে গেল যাদের, এ জীবনে তাদের
সঙ্গে আর কোনোদিন দেখা হবে কি না। আগরতলা থেকে দিলি্ল, তারপর উড়োজাহাজে
উড়ে ফ্রান্সের মাটিতে পা রাখা। অচেনা দেশ, অচেনা মানুষ, অচেনা ভাষা। হায়,
তবুও তো যেতেই হয়। আর কোনো উপায় তো ছিল না। দিনটি এখনো মনে আছে সবারই। ১৯৮৭
সালের ৬ অক্টোবর।
কেমন তোমার নতুন দেশ ঃ ফ্রান্সে আসার পরই শিশুদের তাদের নতুন
অভিভাবকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। ফরাসি মা-বাবারা এই হতভাগ্য শিশুদের কোলে
তুলে নেন অপার মমতায়। সবাইকেই স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়। পড়াশোনায় যে
সবাই খুব ভালো করেছে, এমন নয়। নিজের দেশ ছেড়ে অপরিচিত জায়গা, অপরিচিত ভাষায়
লেখাপড়া করতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে সবারই। আমি জিজ্ঞেস করি, ‘বাড়ির কথা মনে
পড়ত না?’ আবারো সবার চোখ ছলছল। একজন মৃদু গলায় বলেন, ‘মনে পড়ত না আবার!
অনেক মনে পড়ত। প্রায় সময়ই লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতাম।”যোগাযোগ ছিল?’ আমার এ রকম
মূর্খের মতো প্রশ্নে বিরক্ত হন কেউ কেউ। ‘যোগাযোগের কি কোনো উপায় ছিল?’
পাল্টা প্রশ্ন করেন একজন। আমি প্রসঙ্গ ঘুরাই, ‘বাড়ির কথা কী মনে পড়ত?”মনে
পড়া বলা যায় না ঠিক। ভাবতাম, ওরা বেঁচে আছে কি না। কেন যেন মনে হতো, কেউই
আর বোধ হয় বেঁচে নেই। আর ভাবতাম, ঠিকমতো খাবার পাচ্ছে কি না। জানেন, শিবিরে
এত্তো কম খাবার দিত! আর অন্য কিছুর তো কোনো কথাই নেই।’
আমি জানি না। আসলেই জানি না। এই দেশে শত শত
মিডিয়া উচ্চকণ্ঠে আমাদের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বারংবার উচ্চারণ করে।
আমরা, সাংবাদিকরা, অনুসন্ধানী রিপোর্টের কারণে সম্মানিত হই, পুরস্কার পাই।
টিভি চ্যানেলের ঝকঝকে স্টুডিওতে একের পর এক টকশো হয়, বইমেলায় উপচে পড়ে
হাজার হাজার বই; কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রের সেই বেদনার কথা সেখানে কখনোই বলা
হয়নি। আমরা আসলেই জানি না, বাংলাদেশ ছেড়ে উদ্বাস্তু হওয়া সেই আদিবাসীদের
জীবনসংগ্রাম কেমন ছিল, কিভাবে কাটত তাদের দিনকাল। মনের ভেতর গুমরে কাঁদে
স্বজনের মুখ ‘স্বজনদের খবর পেলেন কিভাবে? কবে দেখা হলো?’ জানতে চাই আমি।
নির্বাসিত এই শিশুদের কোনো উপায় ছিল না দেশে ফেরার। অনুমতিও ছিল না।
রাষ্ট্র এই শিশুদের পর করে দিয়েছে বহু আগেই, পাহাড় থেকে তাদের ফেলে দিয়েছে
ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ জীবন নদীতে। তবু তাদের ফরাসি মা-বাবারা খুব ভাবতেন কিভাবে
এই শিশুরা পাবে তাদের আত্মীয়-স্বজনের দেখা। যাদের মা-বাবা, ভাই-বোনদের
মধ্যে কেউ একজনও বেঁচে আছে, তার সঙ্গে কিভাবে দেখা করিয়ে দেওয়া যায় আবার!
তেমনি কয়েক ফরাসি মা-বাবার উদ্যোগে ১৯৯৫ সালে কলকাতায় আবার দেখা হয় এই
শিশুদের কয়েকজনের। এই সুযোগ পায় মাত্র গুটিকয়, বাকিরা জানতেও পারেনি ফেলে
আসা স্বজনরা আদৌ বেঁচে আছে কি না। শান্তিচুক্তির পথ ধরে দেশে ফেরা
দীর্ঘদিন পাহাড়ে অশান্তি চলার পর এক সময় শান্তির উদ্যোগ আসে। শেখ হাসিনার
উদ্যোগে শান্তিবাহিনীর সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ সরকার। পাহাড়ে কিছুটা
স্বস্তি ফেরে। সেই শান্তিচুক্তির পর দেশে ফিরতে থাকে উদ্বাস্তু শিবিরে থাকা
আদিবাসী মানুষগুলো। এই রীতিরই ধারাবাহিকতায় উদ্বাস্তু সেই ৭২ শিশুরও দেশে
ফেরার অনুমতি মেলে। তবে সবাই যে দেশ দেখে গেছে, এমন নয়। তবে বেশির ভাগই গত
কয়েক বছরে অন্তত একবার হলেও দেশে এসেছে। সেই পাহাড়ি গ্রাম, সেই নীরব- নিঝুম
সবুজ অনেকখানিই আর নেই। যে ভূমি ফেলে গেছে এক দিন, সেই ভূমিতে এখন সেটেলার
বাঙালির বসতভিটা। পাহাড়িরা সরে গেছেন আরো গভীরে, যেখানে এখনো আগ্রাসন তার
পুরো নখর মেলে আসেনি।
তবু ফিরে এসে দেখে গেছেন এই ভূমি। সেই
সুযোগে নিজেদের জনগোষ্ঠীতেও বিয়ে করেছেন অধিকাংশই। এই বিয়ে-সূত্রেই হয়তোবা
দেশ থেকে যাওয়া মমতাময়ী নারীদের তাগিদেই, দেশের আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে
যোগাযোগ রাখছেন অনেকে। আবার অনেকে স্রেফ ভুলতে চেয়েছেন অতীত ইতিহাস, শৈশবে
সেই যে নাড়ির বন্ধন ছিন্ন হয়েছে, তা আর নতুন করে জোড়া লাগাতে চাননি।
যায় দিন নির্বাসনের ঃ আড্ডায় আড্ডায় উঠে আসে আরো অনেক কথা। সব
বেদনা লেখা যায় না, সব কষ্ট উঠে আসে না কালো হরফে। বোকার মতোই জানতে চাই,
‘ফ্রান্সের দিনগুলো কেমন ছিল? বর্ণবাদ ছিল? পালক মা-বাবা কেমন ছিলেন?’ পালক
মা-বাবারা অনেক মমতাময় ছিলেন। হতেই হবে। কোনো এক অচেনা ভূখণ্ডের অচেনা
শিশুকে বুকে আগলে রাখার মহানুভবতা সবাই দেখাতে পারেন না। যাঁরা পারেন,
তাঁরা অনেক বড় মানুষ। সেই মানুষদের কাছে তো ভালো থাকবেই শিশুরা। নাহ, কারো
বিন্দুমাত্র অনুযোগ নেই। শুধু আছে এই মা-বাবাদের জন্য অনেক অনেক ভালোবাসা।
তাঁরা সারাটা জীবন বুকে আগলে রেখেছেন তাঁদের বাংলাদেশি সন্তানদের। অনেকেই
আজ আর বেঁচে নেই, যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁর এখনো মাথার ওপর ছায়া হয়ে আছেন। আর
বর্ণবাদী আচরণ? ফরাসি দেশে তেমনটা কখনোই অনুভব করেননি এই শিশুরা। না
স্কুলে, না কর্মক্ষেত্রে, না রাস্তাঘাটে। এখানকার মানুষ তাঁদের আলাদা করে
দেখেননি। শিশুদের একজন বলে বসলেন, ‘নিজের দেশেই যে আচরণ পেয়েছি, তার চাইতে
খারাপ আচরণ চাইলেও কি আর কেউ করতে পারবে?’ কী জবাব হয় এই প্রশ্নের, একরাশ
নীরবতা ছাড়া! এখন তুমি কোথায় আছ, কেমন আছ দেখে ভালো লাগে, হতভাগ্য এই
শিশুরা এখন ভালো আছেন। সবাই নিজ নিজ পেশায় প্রতিষ্ঠিত। চার জন মারা গেছেন
বিভিন্ন সময়ে। বেঁচে নেই মঞ্জুলাল ত্রিপুরা, মৃণাল কান্তি চাকমা,
জ্ঞানপ্রিয় চাকমা এবং সমরেশ্বর চাকমা। কিন্তু বাকি ৬৮ জন কমবেশি ভালো আছেন।
যে ভয়ংকর শৈশব তাঁরা পেরিয়ে এসেছেন, সেই স্মৃতি হয়তো এলোমেলো করেছে
খানিকটা, তবু সব সামলেসুমলে তাঁরা ভালোই আছেন ফ্রান্সের মাটিতে। প্রায়
অর্ধেকেই বিয়ে করেছেন দেশে ফিরে, নিজেদের সম্প্রদায়েই। ৯ জন ফরাসি কন্যাদের
মাঝ থেকেই বেছে নিয়েছেন জীবনসঙ্গিনী, একজন বিয়ে করেছেন বাঙালি, আরেকজন
শ্রীলঙ্কার মেয়ের গলায় পরিয়েছেন ভালোবাসার হার।
সন্তানসন্ততির পড়াশোনা আর নিজেদের কাজ
নিয়েই ব্যস্ত সবাই। একসঙ্গে নেই কেউই, বিস্তৃতফ্রান্সের বিভিন্ন এলাকায়
ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন তাঁরা। নিজেদের মাঝে যোগাযোগটাও তাই প্রাতিষ্ঠানিক কিছু
নয়। যাঁর সঙ্গে যাঁর ঘনিষ্ঠতা আছে, তাঁদের মাঝে যোগাযোগটা গাঢ়। বাকিদের
সঙ্গে হয়তো কালেভদ্রে দেখা হয়, অথবা হয়ই না। তবে নির্বাসনের কুড়ি বছর
উপলক্ষে তাঁরা আয়োজন করেছিলেন গেট টুগেদারের। সেখানে পরিবার-পরিজন নিয়ে
সবাই মিলেছিলেন একসঙ্গে। সারা দিন হইচই আর আনন্দের ফাঁকে একজন আরেকজনের
চোখে খুঁজে বেড়িয়েছেন সেই অনিশ্চয়তা ভরা যাত্রার দিনটির স্মৃতি।
কোন রাষ্ট্র তোমার পরিচয়ঃ আড্ডা শেষের আগে জানতে চেয়েছিলাম,
‘নিজেকে কোন দেশের সন্তান হিসেবে পরিচয় দিতে চান?’ চুপ করে থাকলেন সবাই।
শুধু একজন মৃদু গলায় অভিমান ফুটিয়ে বললেন, ‘ফ্রান্সই আমার দেশ। বাংলাদেশ তো
আমাকে তাড়িয়েই দিয়েছে, কিন্তু ফ্রান্স আমাকে দিয়েছে আশ্রয়, দিয়েছে
ভালোবাসা।’ বাধো বাধো কণ্ঠে আরেকজন বললেন, ‘তবু বাংলাদেশই আমাদের মা। মা
তাড়িয়ে দিলেও মা তো মা-ই। হয়তো কোনো দিন দেশে ফিরব না আমি, তবু বাংলাদেশকে
বুকে নিয়েই বেঁচে থাকব।’আমি শুনি আর দীর্ঘশ্বাস চাপি। হায় প্রিয় বাংলাদেশ
আমার, তোমার সন্তানকে তুমি তাড়িয়ে দিয়েছিলে! রাষ্ট্রের এই গ্লানি আমরা মুছব
কিভাবে!
No comments
Post a Comment