সামাজিক বিবর্তনের ধারায় বৌদ্ধ সংঘের বাস্তবতা- পর্ব ০১

By Upatisso Bhikkhu on Friday, December 27, 2013 at 5:32am
(অনেকদিন পাভিসবার গ্রুপে লেখা হয়না। আজকে একটু সময় সুযোগ পেয়ে নিজস্ব উপলব্ধি অক্ষরবন্ধী করার চেষ্টা করলাম। লেখাটি কিছুটা দীর্ঘ হতে পারে। প্রথম পর্ব দিলাম খুব সংক্ষেপে। সময় ও উৎসাহ পেলে পরবর্তী পর্বগুলো দেয়ার চেষ্টা করবো। এক্ষেত্রে মহান পাভিসবার সদস্যদের গঠনমূলক সমালোচনা পেলে খুশি হবো। )

সমাজ বিকাশের ইতিহাসে দেখা যায় পিতৃসত্তা যুগ পার হয়ে দাস যুগ তারপর সামন্ত যুগে এসে সম্পত্তি সামস্তিক থেকে ব্যক্তিক সম্পত্তিতে পরিণত হয়।  যেদিন থেকেই সম্পত্তি ব্যক্তিক মালিকানায় এসে যায় সেদিন থেকে সেই সম্পত্তি বাড়ানোর চেষ্টায় মানুষের মনে লোভের জন্ম নেয়। আর এই লোভ থেকে সমাজে বর্গভেদ, শোষণ, বৈষম্য, হিংসা, হানাহানি ইত্যাদি বেড়ে যায়। আদিম সাম্যবাদী সমাজ ও জনযুগে সম্পত্তির সামস্তিক মালিকানা ছিল। শিকার বা বনফল আহরণে যা পাওয়া যেত সেসব সকলেই একসাথে ভাগ করে উদরপূর্তি করত তৎকালীন জনগোষ্ঠীর সদস্যবৃন্দ। তখন কোন ব্যক্তি স্বার্থ বা ব্যক্তি সম্পত্তি ছিল না। তাই আত্নকেন্দ্রিকতা বা স্বার্থপরতা থেকে লোভ বা হিংসা হানাহানি শোষণ বৈষম্য ছিল না। এসব সামাজিক ব্যাধি দাসযুগে বিশেষ করে সামন্ত যুগে বেশি করে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। খ্রীস্টপূর্ব ষষ্ট থেকে পঞ্চম শতাব্দীতে অর্থাৎ বুদ্ধের সমসাময়িক কালে ভারত বর্ষে সামন্ত প্রথার পাশাপাশি প্রজাতন্ত্রের প্রচলন দেখা যায়। প্রাচীন অনেক জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে তৎকালীন শাক্যরাও এই প্রজাতন্ত্রের অনুসারি ছিল। কুমার সিদ্ধার্থের বাবা শুদ্ধধন প্রকৃত অর্থে কোন সামন্ত বা রাজা ছিলেন না। তিনি ছিলেন এই প্রজাতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার একজন সভ্য। তাই প্রজাতান্ত্রিক শাসনের অন্যতন বৈশিষ্ট্য সামস্তিক মালিকানা বুদ্ধের প্রবর্তিত সংঘে দেখা যায়। সংঘে অষ্টপরিস্কার বা আটটি জিনিস ব্যতীত অতিরিক্ত কোন জিনিস সংঘের কোন সদস্য সাঙ্ঘিক অনুমতি ছাড়া নিজের হেফাজতে রাখতে না পারার বিধান বিনয়ে দেখা যায়। ঐতিহাসিকদের মতে বুদ্ধ সম্পত্তির ব্যক্তিক মালিকানায় যে লোভ, হিংসা, অহংকার, দ্বেষ, শোষণ, বৈষম্য ইত্যাদির উৎস সেটা বুঝতে পারতেন। তাই তিনি সংঘে সম্পত্তির ব্যক্তি মালিকানার পরিবর্তে সামগ্রিক সাঙ্গিক মালিকানা নিয়ম প্রবর্তন করেন। যদিও প্রশ্ন থেকেই যায় যে বুদ্ধ কেন শুধুমাত্র সংঘেই এই নিয়ম আবশ্যক করেন ব্যপক স্বার্থে সমাজে প্রয়োগ করার চেষ্টার বদলে। কিন্তু দুঃখের বিষয় বুদ্ধের পরবর্তী মাত্র একশ বছর এই নিয়ম ছিল(রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে)। এরপর সংঘে সম্পত্তির ব্যক্তি মালিকানা প্রাধান্য পায় কিংবা চালু হয়। সমাজ পরিবর্তনের অনিবার্য কারণে উৎপাদনি শক্তির বিকাশের সাথে সাথে সমাজে সামন্ত ব্যবস্থার জায়গা ব্যপারবাদ এরপর পুঁজিবাদ দখল করে। এই পুঁজিবাদী যুগে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের(individualism) অবস্থা একসময় ব্যক্তি সর্বোচ্চবাদে পরিণত হয়। এই সময়ে ব্যক্তিক স্বার্থই মানুষকে পরিচালিত করে। সমাজের মধ্যে ও সমাজের সমর্থনে থাকা ভিক্ষু সংঘও এর প্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারেনি অনিবার্য কারণে। ভিক্ষু সংঘের মাঝেও ব্যক্তিক সম্পত্তি, ব্যক্তি স্বাধীনতা, ব্যক্তি সর্বোচ্চবাদিতা ঢুকে পড়ে। অষ্টপরিস্কার বা আটটি জিনিসের মালিকানার জায়গায় এখন ভিক্ষুরা কোটি টাকা সম্পত্তির মালিক হয় হচ্ছে। তাই অনিবার্য কারণে ব্যক্তিক সম্পত্তির উপজ লোভ, হিংসা, অহংকার, দ্বেষ, শোষণ, বৈষম্য ইত্যাদি বেড়েই যাচ্ছে। পবিত্র গেরুয়া বসন এখন তাই আত্নমুক্তি ও সামাজিক কল্যাণ চিন্তার চর্চাকারীদের ইউনিফরমের বদলে একটা ব্যক্তিক স্বার্থ চরিতার্থ করার মোক্ষম মূলধনে পরিণত হয়েছে। যদিও এখনো নিঃস্বার্থ আদর্শবাদী ভিক্ষুর অভাব নেই কিন্তু এদের ম্রিয়মান আলো আত্নমুখী ভিক্ষুদের স্বার্থালোর তুলনায় নিতান্ত নগণ্য বলা যায়। (চলবে........)

No comments

Theme images by 5ugarless. Powered by Blogger.