পার্বত্য চট্টগ্রামে থেরবাদ বৌদ্ধ ধর্মের জাগরণে মহান ভিক্ষুসংঘের ভূমিকা

-    ড. জিনবোধি ভিক্ষু

 সুচনা ঃ ইতিহাস হচ্ছে যে কোন জাতি-গোষ্ঠির অতীত কথা। অতীতের ধারাবাহিক ঘটনা প্রবাহ, ইতিবাচক-নেতিবাচক-ইতিকথা- যার ভিত্তি ভূমিতে দাঁড়িয়ে বর্তমানের নির্মাণ । কোন মহান জাতি ধর্ম, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সমাজ ব্যবস্থায় সুনিয়ন্ত্রিত আচার, অনুশীলন প্রবর্তিত করেছিল, ইতিহাস তারই কাহিনীর উজ্জ্বল প্রকাশ । ইতিহাস নিজ সৃষ্টি মহিমায় মহিমাম্বিত এবং অতীতের গৌবরে গৌববান্বিত এক সত্যের আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত । ইতিহাস এবং ঐতিহ্য জাতির চলার পথ প্রর্দশক এবং ভবিষ্যতে অতীতের দৃষ্টান্ত সৃষ্টি জাতির শুভ সঙ্গীরুপে হুশীয়ারী সংক্ষেতের ধারক ও বাহক ।  যে সকল জ্ঞানী ও গুণীজনেরা জাতির মুক্তি সাধনে আত্মত্যাগী, মানব সভ্যতার বিকাশে ও শিক্ষা-সংস্কৃতি প্রসারে আমরণ সংগ্রাম করে গিয়েছে, তাঁদের লক্ষ্য অর্জনের কাহিনী ইতিহাসের পাতায় স্বণাক্ষরে লেখা থাকবে। বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌমত্ব গণতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ একটি দেশ। বাংলাভাষা রাষ্ট্রীয় ভাষা নামে স্বীকৃত হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন উপ-ভাষা রয়েছে । দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার ও ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম সংযোগ স্থল হল ‘বাংলাদেশ’। বিশ্বের প্রধান চার ধর্মাবলম্বী বৌদ্ধ, মুসলিম, হিন্দু ও খ্রিষ্টানের বসবাস এই ‘বাংলাদেশে’। বৌদ্ধরা এদেশের আদি অধিবাসী । এই দেশের প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিশেষতঃ প্রাচীন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় পরিবর্তন বিবর্তনে বৌদ্ধ ও বৌদ্ধধর্ম যুগ যুগ ধরে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে এখনও সেই ধারা অব্যাহত আছে । বৌদ্ধ মূলতঃ শান্তপ্রিয় জাতি। সম্প্রীতিতে সহাবস্থান তাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য । কালের বিবর্তনে যদিও নানা উত্থান-পতন হয়েছে তাতেও তারা প্রাচীন সংস্কারগত কারণে বিশেষতঃ বুদ্ধ ও তাঁর নৈতিকতাকে অন্তরে ধারণ করে মৈত্রী চেতনা, সাম্যভাব সর্বোপরি অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী । বৌদ্ধজনগণ এদেশে স্মরণাতীত কাল থেকে বসবাস করে আসতেছে । বাংলাদেশের বৌদ্ধ জনগোষ্ঠি চারটি ভাগে বিভাজন করা হয়েছে। যথা-
১.    সমতলীয় বাঙ্গালি বৌদ্ধ ।
২.    পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী বা পাহাড়ি বৌদ্ধ ।
৩.    সমতলীয় রাখাইন বৌদ্ধ এবং
৪.    উত্তবঙ্গের ওরাঁও আদিবাসী বৌদ্ধ ।
এই সকল বৌদ্ধদের মধ্যে জনসংখ্যার দিক থেকে আদিবাসী বা পাহাড়ি বৌদ্ধরা সর্বাধিক । বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের চট্টগ্রামে, কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা সমূহের এদের বসতি ইদানিং উত্তরবঙ্গের ওরাঁও আদিবাসী বৌদ্ধ জনগোষ্ঠি হিসেবে আত্ম প্রকাশ করতে শুরু করেছে । প্রাচীন বিকৃতি বৌদ্ধধর্ম ত্যাগ করে বুদ্ধের মৌলিক নীতি থেরবাদী ধর্মে দীক্ষিত হয়ে পুনজাগরণের ধারাকে ধারণ করে চলেছে এটা আরেকটি শুভ লক্ষণ বলা যায় । বৌদ্ধরা সংখ্যায় স্বল্প হলেও সমগ্র বিশ্ববৌদ্ধ ধর্মদর্শন ও সভ্যতার ইতিহাসে যুগান্তকারী মাইল স্টোন সৃষ্টিকারী বৌদ্ধরাই উত্তরাধিকারী ।
রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান এই তিনটি পার্বত্য জেলা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম গঠিত । এই তিনটি পার্বত্য জেলার দশ ভাষা-ভাষী ১৩টি জুম্ম বা পাহাড়িদের বসবাস ; এগুলি হলো- চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, ম্রো বা মুরং, বম, খুমী, খ্যায়ং, রাখাইন, চাক, তঞ্চঙ্গ্যা, লুসাই বা কুকি, রিয়াং, উসুই বা পাংখোয়া।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তারা আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি নয় উপজাতি নামে স্বীকৃত । এসব ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা গুলো নৃ-তাত্বিক বিচারে মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠির অর্ন্তভূক্ত । এ প্রসঙ্গে প্রফেসর বেসইনে পিয়ের বলেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের এই উপজাতীয় লোকেরা মানব জাতিতত্ত্বের দিক থেকে পূর্ব পাকিস্থানের (বর্তমান বাংলাদেশ) অন্যান্য স্থায়ী বাসিন্দাদের থেকে আলাদা । এদের সাদৃশ রয়েছে তিব্বত থেকে ইন্দোচীন পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলের পাহাড়িয়া লোকদের সঙ্গে । এরা খর্বকায় এদের গায়ের হাড়  উন্নত, মাথার চুল কালো, ছোট চোখ সর্বোপরি শারীরিক গঠন ও আকৃতির দিক থেকে এঁরা মঙ্গোলীয় জাতির বৈশিষ্ট্য লাভ করেছে (পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি প্রফেসর পিয়ের বেসেইনে অনুবাদ : অধ্যাপিকা সুপিয়া খান, বাংলা একাডেমী ঢাকা - ১৯৯৬,পৃ: ২)।   
পার্বত্য চট্টগ্রামের এক একটি আদিবাসী জনগোষ্ঠির উৎপত্তি, বিকাশ, ভাষা, সমাজ, ধর্ম ও সংস্কৃতির ইতিহাস অন্য আদিবাসীর জাতিসত্তা থেকে ভিন্ন স্বকীয় বৈশিষ্ট্য সমুজ্জ্বল । অতীব গৌরবের বিষয় হলো- তিন পার্বত্য জেলায় তিনজন রাজা বিদ্যমান । যথাক্রমে- (১) চাকমা রাজা, (২) বোমাং রাজা এবং (৩) মং রাজা । তাঁদের জন্য আলাদা আলাদা এলাকা রয়েছে । তিন পার্বত্য জেলায় বসবাসকারী (৪৮.২০%) বাঙ্গালি বাদে উপজাতির মধ্যে সংখ্যা চাকমা সর্ববৃহৎ (২৮.৭৫%), দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে যথাক্রমে মারমা (১৪.৭১%) ও ত্রিপুরা (৬.৩২%) জনগোষ্ঠী। ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি ও বাঙ্গালির অনুপাত ৯৩.৭ । কিন্তু ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে আদমশুমারি রিপোর্ট মতে, উপজাতি বাঙ্গালি অনুপাত হলো ৫১.৮৯, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাংখোয়া ভাষা ও সাহিত্যে সাওন ফরিদ, এইচ,এস,ডি, ও রাঙ্গামাটি,২০০৬ (পৃঃ ২৩-২৪) । আয়তন হলো- ১৩,২৯৫ বর্গ কিলোমিটার (৫০৮৯ বর্গ মাইল), আদিবাসী জনগোষ্ঠি গুলোর মধ্যে- চাকমা, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, খুমী, খ্যাং, মুরুং বা ম্ররাে সবাই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এবং ত্রিপুরা হিন্দু ধর্মাবলম্বী তবে কিছু কিছু ত্রিপুরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী । খুকি, পাংখোয়া, লুসাই, রিয়াং সহ অন্যান্য নৃগোষ্ঠির জনগণ প্রকৃতি পুজারী বা সর্ব প্রানবাদে বিশ্বাসী, এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠির জনগণের মধ্যে অনেকে বর্তমানে খ্রিষ্টান ধর্মের অনুসারী । তবে অতীতের তুলনায় বৌদ্ধধর্মের প্রতি প্রবল অনুরাগ শ্রদ্ধা, ভক্তি, ধ্যান-সাধনার অনুশীলন শাস্ত্রচর্চা, দানীয় প্রভাব অত্যন্ত ব্যাপক আকার ধারণ করেছে নির্দ্ধিধায় বলা যায় । এ ব্যাপারে আত্মত্যাগী আধ্যাত্মিক ধ্যান-সাধনায়রত এবং বুদ্ধের ত্রিপিটক শাস্ত্রে পারঙ্গম মহান ভিক্ষুসঙ্ঘের অবদান রয়েছে বেশি । এ বিষয়ে বিস্তারিত গবেষণা প্রয়োজন । বুদ্ধের সমসাময়িক এবং পরবর্তীকালে দেশে-বিদেশে বৌদ্ধ ধর্মের এত প্রসার তার মূলে প্রাজ্ঞ শাস্ত্রজ্ঞা ও সাধক ভিক্ষু-সংঘের ভূমিকা মূখ্য ছিল এবং আছে । এ প্রসঙ্গে কিঞ্চিৎ ধারণা দেয়া হলোঃ
এ সকল আধিবাসীদের জীবন-জীবিকার হাতিয়ার হলো প্রধাণত জুম চাষ । জুম চাষের দ্বারা অর্থ নৈতিক চাহিদা পূরণ এবং ব্যক্তিগত ও পারিবারিক অভাব-অনটন ঘুছানোর জন্য আপ্রাণ সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন । পঞ্চাশের দশক থেকে কিছুটা চাকুরি ও ব্যবসা বাণিজ্যের সাথেও সম্পৃক্ত হওয়ায় অনেকটা অর্থনৈতিক স্বাচ্ছল্যতা দেখা যায় । তাও চাহিদা অনুসারে অত্যন্ত অপ্রতুল । বর্তমানে ব্যাপকতা বেড়েছে বলা যায় । শিক্ষার হার খুবই কম, বর্তমান সরকারের পরিকল্পনানুসারে অনেকটা এগিয়ে অর্থ নৈতিকভাবে এখনও দুর্বল, বাস্তবতায় না দেখলে সঠিকভাবে তথ্য উপস্থাপন করা কঠিন । নিজস্ব সংস্কৃতি ও কৃষ্টি লালনে-পালনে-রক্ষণে খুবই সচেতন এবং আন্তরিক । খাদ্য দ্রব্যের কোন পরিবর্তন বা সংস্কার নেই নাপ্পি বা ছিদোল (এক প্রকার Shrimp Paste) অন্যতম প্রিয় খাদ্যের উপাদান, মদ্যপান (ঘরে তৈরী) নানা উৎসব অনুষ্ঠানের অপরিহার্য ও স্বীকৃত বিষয় । পরিবারের মেয়েরা তাঁতের কাপড় বোনে, মেয়েরা জাতি ভেদে পিনোন, থামি, খাদি, ব্লাউজ এবং পুরুষেরা লুঙ্গি, ফতুয়া, শার্ট ইত্যাদি পরিধান করে । সাধারণত মাচাং ঘরে বসবাস ইদানিং কিছু কিছু পাকা ও মাটির ঘর নির্মাণ করে বসবাস করতে দেখা যায় । বেশির ভাগ মাচাং ঘরেই তাঁদের বসবাস ।
ধর্মীয় রীতি-নীতি অতীতের কিছুটা কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও ধর্মান্ধতা থাকলেও বর্তমান থেরবাদ বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর থেকে প্রায় বুদ্ধের প্রকৃত ধর্ম বিষয়ে আগ্রহশীল । বিভেদ নেই। রাজমাতা কালিন্দী রাণীর ভাবাদর্শকে মনে প্রাণে গ্রহণ করেছে এবং ভিক্ষুসংঘের আদেশ নির্দেশ মেনে চলার চেষ্টা করে থাকে। বড়ুয়া বৌদ্ধরা শিক্ষা-দীক্ষায় উন্নত বলে দাবী করলেও মূলতঃ বুদ্ধের রীতি-নিয়মের প্রতি তেমন শ্রদ্ধাশীল নন । তাদের ভিক্ষুসংঘের মধ্যে বুদ্ধের ধর্ম-বিনয়ের প্রতি বিরোধ নেই। যদিও ধ্যানী ভিক্ষু ও কর্মী ভিক্ষুদের কিছু দুরত্ব দেখা যায় । ইদানিং তাও কমে এসছে এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে সবার অংশ গ্রহন দেখা যায় । বাঙ্গালি বৌদ্ধদের মধ্যে যথেষ্ট সংস্কার হলেও অথেরবাদীগণ বর্তমান থেরবাদী বলে জোর গলায় জনসমাজে প্রকাশ করে চলেছে এটাই দুর্ভাগ্য । বর্তমান উচ্চ শিক্ষিত ভিক্ষু গৃহীদের মধ্যেও সেই মানসিক দেখা যায় । পার্বত্য ভিক্ষু সংঘের মধ্যে তা নেই বরং মারমা ও চাকমা ভিক্ষু সংঘের ভেতরে থেরবাদ ধর্মের প্রতি কঠোর ব্রতপালনের প্রতি একাগ্রতা বেশী বলা যায় । এটা অত্যন্ত শুভ লক্ষণ । ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সমূহ যেভাবে দৃষ্টিনন্দন, শৈল্পিক, কারুকার্য খচিত হচ্ছে বৌদ্ধিক চিন্তা-চেতনায় তৈরী হয়েছে এবং হচ্ছে তা অভূতপূর্ব এবং সার্বজনীন ভাবে গ্রহণ যোগ্যতা লাভ করেছে । আমি তজ্জন্য সাধুবাদ জানাই । স্ব-জাতি, স্ব-সংস্কৃতি এবং স্বজাতির ছেলে-মেয়েদের উন্নত করার জন্য মহান ভিক্ষুসংঘ অসাধারণ অবদান রেখে চলেছে যা দেশে-বিদেশে প্রশংসনীয় এবং পরিব্যাপ্ত ।
১৮৬০খ্রিষ্টাব্দে পার্বত্য চট্টগ্রাম স্বতন্ত্র জেলা পরিণত হওয়াতে এই অঞ্চলের অধিবাসীরা প্রত্যক্ষ ভাবে ইংরেজ শাসনাধীন চলে যায় । ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশ বিভাগের সময় এই জেলা পূর্বপাকিস্থানের অর্ন্তভূক্ত হয় এবং ১৯৭১ খ্রিষ্ঠাব্দে স্বাধীনতার বাংলাদেশ অভ্যূত্থানের সাথে সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলাটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের একটি জেলা হিসেবে অর্ন্তভূক্ত হয় ।
বলা বাহুল্য, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন ভাষা-ভাষী জাতি সত্ত্বাদের মধ্যে চাকমা, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, চাক, খিয়াং, ও বড়ুয়া ইত্যাদি সম্প্রদায়ের লোকেরাই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হিসেবে পরিচিত বৌদ্ধ সম্প্রদায়ে ভূক্ত এই জাতিসত্ত্বার লোকগুলি বেশ কয়েক শতাব্দী ধরে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাস করে আসছে । চট্টগ্রামের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্ম্পক বহু প্রাচীন । চট্টগ্রাম ছিল আরাকান, ত্রিপুরা ও বাংলার রাজশক্তির শক্তি পরীক্ষা কেন্দ্ র। এই রণক্ষেত্রে ইউরোপ থেকে আগত পর্তুগীজ বণিকেরাও অংশ গ্রহণ করেছিল । প্রাথমিক যুগে আরাকান রাজশক্তি দক্ষিণের শঙ্ক নদী অতিক্রম করে । পরবর্তীতে মোগলেরা চট্টগ্রাম দখল করে নেয় । এই ভাবে বিভিন্ন সময়ে রাজশক্তির হাত বদল হয়ে ১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম ইংরেজদের করায়ত্ত হয় । আরো উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের চট্টগ্রাম একটি ঐতিহ্যবাহী থানার নাম রাঙ্গুনীরা । রাঙ্গুনীয়া শব্দটি বাংলা নয় । প্রাচীন বার্মার রাজধানী রেঙ্গুন এর সাথে তার উচ্চারণগত সাদৃশ্য রয়েছে । বার্মা বৌদ্ধ রাজ্য । রাঙ্গুনীয়াও বৌদ্ধ রাজ্য ছিল। এ প্রসঙ্গে আহাম্মদ হাসানের লেখা প্রণিধাণ যোগ্য । রাঙ্গুনীয়ার চাকমা রাজাদের আদি পুরুষদের শেরমুস্ত খাঁ ১৭৩৭ খ্রিঃ তিনি বর্তমান বান্দরবান জেলা আলীকদমে রাজত্ব করতেন । জাতে চাকমা হলেও তিনি মারমা রাজাদের মত মোগল সংস্কৃতির অনুরাগী ছিলেন বলে মনে হয় । স্বধর্মীয় আরাকান রাজাদের সামরিক চাপে অতিষ্ট হয়ে তিনি মোগদের সাথে মিত্রতা করেন । ১৭৩৯ খ্রিষ্টাব্দে মোগল সুবাদার শাহসুজা আরাকান রাজার হাতে নিহত হলে মোগল-মারমা শত্রুতার সুযোগে তিনি নিরুপদ্রবে রাজত্ব করেন । তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পালক পুত্র শুকদেব ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে রাজা হন । পলাশী যুদ্ধের পর মোগল ছত্র ছায়ার অবসানে তিনি চাকমা অধ্যুষিত রাঙ্গুনীয়ার পদুয়ার রাজধানী স্থানান্তরিত করে নিজেদের নামানুসারে শুকবিলাস নাম দেন । ১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দে নবাব মীরকাশিম ইংরেজদের হাতে চট্টগ্রামের শাসনভার অর্পণ করলেও শুকদেব রাঙ্গুনীয়ায় স্বাধীন রাজা ছিলেন । ১৭৭৬ খ্রিষ্টাব্দে শুকদেব রাজা মৃত্যুর পর শের দৌলত খাঁ রাঙ্গুনীয়ার রাজা হন । তিনিও রাঙ্গুনীয়ার স্বাধীন রাজা ছিলেন । ১৭৮২ খ্রিষ্টাব্দে শের দৌলত খাঁর মৃত্যৃর পর তাঁর পুত্র জান বক্স খাঁ রাঙ্গনীয়ার রাজা হন । ইংরেজদের আক্রমণের সময় ইছামতির মোহনায় বৃটিশ নৌ-অবরোধের মূখে সেনাপতি রানু দেওয়ান অাত্মসর্মপন করেন । ১৭৮৭ খ্রিষ্টাব্দে রাজা জান বক্স খাঁ গর্ভণর ওয়ারেন হেস্টিংসের ক্ষমা লাভ করে ইংরেজদের বশ্যতা স্বীকার করেন (মি: কন্টিনের রেভেনিই হিস্টি দ্রস্টব্য)।
এ পরিস্থিতিতে নিরাপত্তাজনিত কারণে রাজা জান বক্স খাঁ শুকবিলাস থেকে উত্তর রাঙ্গুনীয়ায় রাজধানী সরিয়ে নিয়ে রাজানগর নামককরণ করেন । ১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর পর ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর পুত্র টব্বর খাঁ রাঙ্গুনীয়ার রাজা হন । ১৮১২ খ্রিষ্টাব্দে রাজা ধরম বক্সের খাঁর মৃত্যুর পরে ১২ বছর সুখলাল দেওয়ান রাজ্যের দেখাশুনা করেন । ১৮৪৪ খ্রিষ্টাব্দে ধরম বক্সের বড়রাণী কালিন্দি রাজ্যের শাসনবার গ্রহন করেন । রাঙ্গুনীয়ার রানীর হার্টও কালিন্দী রাণীর রোড তাঁরই স্মৃতিবহ । লুসাই যুদ্ধে ইংরেজদের সহায়তা করার বিনিময়ে তিনি কর্ণফুলি ও ইছামতি নদীর শুল্ক চন্দ্রঘোনায় ও ইছামতির শুল্ক ঘাটচেকে আদায় করা হত । এখানে একটা বিষয় উল্লেখ্য যে, রাঙ্গুনীয়ার চাকমা রাজাদের হয়ত নিজস্ব চাকমা নাম ছিল । মোগল আমলের মুসলিম সংস্কৃতির ফ্যাশন গ্রহনে আরাকান রাজাদের মত চাকমা রাজারাও মুসলিম নামে পরিচিত হলেও বৃটিশদের অধীনতার পর চাকমা রাজারা নিজস্ব হিন্দু নাম গ্রহণ করার সে রেওয়াজ এখনো বজায় আছে ।
১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে রাণী কালিন্দীর মৃত্যুর পর রাজ বংশীয় হরিশ্চন্দ্রকে সরকার রাজা উপাধি সহকারে রাজা তথা জমিদারীর ভার অর্পণ করেন । ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে রাজা হরিশ্চন্দ্রের মৃত্যুর পর রাজ কুমার ভূবন মোহন সাবালক না হওয়া পর্যন্ত কোটর্স অব ওয়ার্ডস নামক ইংরেজদের এক সংস্থা জমিদারী দেখা শুনা করেন ।
রাজা হরিশ্চন্দ্রের আমলেই রাঙ্গুনীয়া চাকমা রাজা রাজধানী পার্বত্য চট্টগ্রামে রাঙ্গামাটিতে নিয়ে যান । কিন্তু রাঙ্গুনীয়াতে তাঁদের জমিদারী বহাল থাকে । রাজা হরিশ্চন্দ্রের সৎভাই নবচন্দ্র দেওয়ান রাজা নগরের রাজবাড়িতে থেকে যান, তাঁর পুত্র মোহিনী দেওয়ান রাজানগর ইউনিয়ন বোর্ডের মেম্বার ছিলেন । তার ছেলে তুষার দেওয়ান এখন বেতবুনিয়ার হেডম্যান ।
রাঙ্গুনীয়ার রাণীর হাট, রাজার হাট, পদুয়ার রাজার হাট ও রোয়াজা হাট রাঙ্গুনীয়ার চাকমাদের স্মৃতি হয়ে রয়েছে । বর্তমান প্রথম দিকে বৃটিশ শাসনাধীন রাঙ্গুনীয়ার ভারত শাসন আইনের আওতায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এগিয়ে যায় ।  এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, চাকমা রাজাদের রাজ্য বলতে প্রধাণত রাঙ্গুনীয়া বুঝালেও পার্বত্য চট্টগ্রাম, রাউজানও এর অর্ন্তভূক্ত ছিল বলে জানা যায় । (রাঙ্গুনীয়া স্মরণিকা, রাঙ্গুনীয়া সমিতি, ঢাকা, সম্পাদক, ডা: ফজলুর রহমান- ১৯৯৭, পৃষ্ঠা- ৫৭-৫৮)।
     রাঙ্গুনীয়ার গৌরবময় ইতিহাসের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের থেরবাদ বৌদ্ধ ধর্মে জাগরণে আরেক গৌরবদীপ্ত ইতিহাস গভীর ভাবে সম্পৃক্ত রয়েছে । চাকমা রাজা ধরমবক্স খাঁর মৃত্যুর পরে (১৮৩২ খ্রিষ্টাব্দে) মহিয়সী রাণী কালিন্দী প্রজাদের শাসন কার্যভার গ্রহণ করেন । তিনি ধর্মের প্রতি খুবই শ্রদ্ধাবতী ছিলেন । তাঁর আমন্ত্রণে হারবাং এর জন্ম জাত আরাকান থেকে আগত প্রখ্যাত বৌদ্ধ সংঘ মনীষা শাস্ত্রজ্ঞ শ্রীমৎ সারমিত্র বা সারমেধ মহাস্থবির ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দে বৈদ্য পাড়া হয়ে মহামুনি পাহাতলী গ্রামের ঐতিহাসিক চৈত্র সংক্রান্তি মেলায় আসলে সেখান থেকে রাজানগরে রাজ বিহারে আগমন করেন।  
মহামান্য সংঘরাজের মুখ নি:সৃত হিতোপদেশ বাণী ও বিনম্র ব্যবহারে তিনি (কালিন্দীরাণী) এতই অভিভূত হয়ে পড়ে ছিলেন যে, তারই সুফল স্বরুপ তিনি তাঁর নিকট বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন । প্রকৃতপক্ষে রাণী মহোদয় সেই দিনেই প্রাচীন তান্ত্রিক থেরবাদ ধর্মমত ত্যাগ করে থেরবাদী বৌদ্ধ আর্দশকে বরণ করে নিয়ে সমগ্র বৌদ্ধ সমাজগগণে নতুন করে এক নজির স্থান করেন । তখন থেকে সমগ্র পার্বত্যবাসী বৌদ্ধদের মধ্যে বিরাট প্রভাব বিরাজ করছিল । শ্রদ্ধা পরায়ণ রাণী তাঁর প্রতি অতিশয় প্রসন্ন হয়ে ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের শেষে রাজকীয় ঐতিহাসিক পুর্ণ্যাহ উপলক্ষে মহাসমারোহে মহামান্য সংঘরাজ সারমেধ মহাস্থবিরকে আরাকানী ভাষায় উপাধিযুক্ত সীলমোহর প্রদানে সম্মাণিত করেন । এর অর্থ হল- (1219 AF The Seal of Arakaness Sangharaja and Vibayachara) সংঘরাজের পক্ষে এটা তাঁর দ্বিতীয়বার রাজকীয় উপাধি লাভ । পূণ্য শীলা কলিন্দী রাণীর প্রদত্ত উপাধি গ্রহন করে তিনি আকিয়াব ফিরে গিয়ে ছিলেন । তখনও চট্টগ্রামে রাউলি পুরোহিতগণ থেরবাদ অনুসারে সমগ্রভাবে উপসম্পদা গ্রহন করতে সম্মত হতে পারেননি । কিন্তু সংঘরাজের আগমনে এবং বুদ্ধবাণীর উপদেশে শুনে যথেষ্ট প্রতিক্রিয়া এবং সচেতনতা জাগ্রতা হয়েছিল । তাঁর আগমনের পর পূর্ব বঙ্গীয় মহাযানী ধর্মাবলম্বী বৌদ্ধ সমাজে থেরবাদ ধর্মের পুনৎজাগরণ শুরু হয় এবং সংঘরাজ নিকায় নামে বুদ্ধের বিনয় সম্মত ভিক্ষুসংঘ ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে মহামুনি পাহাড়তলীর ঐতিহাসিক হাঙ্গার ঘোনায় সর্বপ্রথম সাতজন রাউলি* সাতজন রাউলি পুরোহিত হলো যথাক্রমে- ১) পাহাড়তলী সর্বজন শ্রদ্ধেয় জ্ঞানালংকার মাথে, ২) ধর্মপুরের হরি মাথে, ৩) মির্জাপুরের সুধন মাথে, ৪) গুমাইমদ্দনের দুরাজ মাথে, ৫) বিনাজুরীর হরি মাথে, ৬) পাহাড়তলী কমল ঠাকুর এবং ৭) দমদমার অভয়চরণ মাথে (মহাস্থবির)।
পুরোহিত নাম ধর্মীয় গুরুদেরকে উক্ত উদক সীমায় শুভ উপসম্পদা দিয়ে পরিশুদ্ধ সংঘ সদস্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।
১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দে মহিয়সী কালিন্দীর পূন: আমন্ত্রণে মহাস্থবির মহোদয় আরাকান, কক্সবাজার এবং রামু হতে ২৫ জন বিনয়ধর স্থবির-মহাস্থবির ভিক্ষু সংঘ নিয়ে রাজানগরে আগমন করেন । রাণীর অর্থানুকুল্যে ও আচার্য চন্দ্রমোহন মহাস্থবিরের অনলস প্রচেষ্টায় এবং সংঘরাজ সারমেধ মহাস্থবিরের পৌরহিত্যে রাঙ্গুণীয়ায় পবিত্র ভিক্ষু সীমা প্রতিষ্ঠিত হয় । এই সীমার ‘চিং’ নাম তাঁরই প্রদত্ত । এই সীমা বাংলাদেশীয় বৌদ্ধদের সর্বপ্রথম ঐতিহাসিক পাষাণ নির্মিত ভিক্ষু সীমা (ভিক্ষু শীলাচারশাস্ত্রী- চট্টগ্রামের বৌদ্ধধর্ম, চট্টগ্রাম- পৃষ্ঠা-৪৫)।
রাজনগর রাজবিহারে এবং মহামুনি পাহাতলী মহামুনি মন্দিরকে ভিত্তি করে সমতলীয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বসবাসরত বৌদ্ধদের মধ্যে থেরবাদ বৌদ্ধ ধর্মের জাগরণ ক্রমে ক্রমে বিভিন্ন প্রান্তে নবজোয়ারের শুভ সুচিত হয়েছিল ।
তখন থেকে সমতলীয় পার্বত্যবাসী বৌদ্ধদের মধ্যে নতুন করে অতীতের প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের ধারা শুরু হয় । ইতিপূর্বে যা ছিল সেই সম্পর্কে মহাপণ্ডিত রাহুল সাংস্কৃত্যায়ণ এর মতে, ‘সম্রাট কনিষ্কের সময় প্রথম বুদ্ধমূর্তি নির্মিত হয় । তখন মহাযান মতবাদ প্রচারের সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে বড় জাঁকজমকের সাথে বুদ্ধমূর্তি পূজা-অর্চনা চলতে থাকে এবং সেখানেই বহুশত বোধিসত্ত্বের মূর্তিও নির্মিত হয় । এই বোধিসত্ত্বদের তারা ব্রহ্মাণদের দেব-দেবীর আসন অর্পণ করেন । তারা এই বোধিসত্ত্বদের ‘তারা’ এবং প্রজ্ঞা পারমিতার বুদ্ধ দেব-দেবীও কল্পনা করেন । তখন তাদের ভাবনা করার জন্য অনেক স্তোস্ত্রাদিও রচিত হতে থাকে । তারা হীনযানের সূত্র হতে অধিক মাহাত্ম্যপূর্ণ নিজেদের সূত্র রচনা করেন । বহুশত পৃষ্টায় সূত্রগুলি শীঘ্রই পাঠ হয় না বলেই তারা প্রত্যেক সূত্র দুই তিন পদ্ধতিতে রচনা করেন । এই মহাযান মতবাদ (তন্ত্রযান, বজ্রযান ও মন্ত্রযান) সপ্তম/অষ্টম শতাব্দী পর্যন্ত চলতে থাকে । তখন তারা কেউ পন্হী (জুতা) নির্মাণ করতেন বলে ‘পন্হী পা; কেউ কম্বল পড়ে থাকতেন ‘কমড়ি পা; কেউ ওখল রাখতেন বলে ওখরী পা; বলা হত । এক কথায় তাদের বলা হত সিদ্ধযোগী । এই সব সিদ্ধযোগীরা বা লুলিরা জঙ্গলে তপস্যা করতেন । তারা জনসাধারণ হতে ঠিকই দূরে থাকতে চাইতেন, কিন্তু জনসাধারণ ততই তাদের কাছে যেতেন । লোকেরা এই সিদ্ধযোগীদের বোধিসত্ত্ব ও অন্যান্য দেবতাদের ন্যায় অলৌকিক ঋদ্ধি ও দিব্য শক্তির অধিকারী মনে করতেন । রাজারা নিজেদের কন্যাদের পর্যন্ত তাদের দান করতে দ্বিধাবোধ করতেন না (ভারত মে ও বৌদ্ধ ধরমকা উত্থান অর পতন, দিল্লী- ২০০১পৃঃ ১১)।
এই সকল গৃহী পুরোহিতরা বংশ পরষ্পরায় বৌদ্ধ সমাজে কালী পূজা, দুর্গা পূজা, মনসা পূজা ও প্রভৃতি পূজায় স্বহস্তে পশুবলি করতেন । এই প্রসঙ্গে ভারতীয় রাষ্ট্রপতি পুরষ্কারে ভূষিত পন্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির বলতেন । চট্টগ্রামের চাকমা রাজাদের কালী মন্দির ও শিব মন্দিরে পূজা করতে দেখে অনেকেই তাদেরকে অবৌদ্ধ মনে করতেন । বস্তুতঃ থেরবাদ ধর্মমত গ্রহণের পূর্বে বাংলার সকল বৌদ্ধরা নানা দেব-দেবীর পূজায় অভ্যস্ত ছিলেন (শাসন বংশ, অনুবাদ, পন্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির ,মূখবন্ধ, কলি- ,পৃষ্ঠায় -১৯৬২)।
মহান ভিক্ষু সংঘের অবদান ঃ বুদ্ধ ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার ও প্রসারের মূলে বুদ্ধ প্রমুখ মহান ভিক্ষুসংঘের ভূমিকা অতুলনীয় । বুদ্ধ সমেত ৬১ জন অর্হৎ শিষ্যদের নিয়ে তাঁর সাধনা লব্ধ জ্ঞান জীব জগতের মহান কল্যাণে বিশেষতঃ দুঃখ মুক্তির উপায় হিসেবে প্রচারাভিযান এখন অব্যহত রয়েছে । পৃথিবীতে যতদিন পাঁচজন ভিক্ষু সদস্য থাকবেন ততদিন বুদ্ধের ধর্মবাণী চিরঞ্জীব হয়ে থাকবে । রাজা-মহারাজা, ধনী-সাধারণ, দায়ক-দায়িকাগণ পৃষ্টপোষকতা করবেন ।
সম্ভবতঃ এ কারণে পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহোদয় বলেছেন, রাঙাগামাাটিতে যে সকল বৌদ্ধ আছেন তাঁহারা যদিও এখন চট্টগ্রামের বৌদ্ধদের শিষ্য, তথাপি তাহাঁদের মধ্যে এমন আচার ব্যবহার আছে । তাঁহাতে বোধ হয় তাঁহারা প্রাচীন ভারতীয় বৌদ্ধ; কিন্তু নিকটবর্তী চট্টগ্রামের বৌদ্ধদের সংশ্রবে আসিয়া তাঁহারা অনেক পরিমাণে হীনযান মত গ্রহন করিয়াছেন ( হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, ৩য় খণ্ড, রচনা সংগ্রহ কলি- পৃ:- ৩৬০)।
    পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমাদের মধ্যে থেরবাদ বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব ব্যাপক দেখা গেলেও মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, লুসাই চাকসহ আরো অনেক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠিরা একই ধর্মাবলম্বী । শুধুমাত্র ত্রিপুরা জনগোষ্ঠিদের হিন্দু ধর্মের আর্দশকে গ্রহণ করতে দেখা যায় । ত্রিপুরা সম্প্রদায় ব্যতীত অন্যান্য জনগোষ্ঠি স্মরণাতীত কাল থেকে বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী তাতে কোন সন্দেহ নেই । তবে থেরবাদ বৌদ্ধ
 ধর্ম প্রচার ও প্রসারের আগে তাঁদের ধর্ম ছিল মূল বৌদ্ধ ধর্মের বিবর্তিত তন্ত্রযান-মন্ত্রযান ও বজ্রযানের প্রভাব ছিল বেশী । এই তন্ত্রযান বৌদ্ধ ধর্ম গুরুদেরকে বলা হত লুরি । ইদানিং কোন কোন স্থানে চাকমাদের মধ্যে এই ‘লুরি’ দেখা যায় । এই ‘লুরি’ শব্দটি পাল যুগে রচিত ‘চর্যাগীতি’তে দেখা যায়। যেমন- ‘অদয় বঙ্গালে দেশ লুড়িউ’।
    চাকমাদের দু’টি প্রাচীন শাস্ত্র গ্রন্থ আছে । তমধ্যে একটি যোগ কালাম এবং অপরটি ভদকালাম। এই গ্রন্থ দু’টিতে নাথ যোগীদের অন্যতম গুরু গোরক্ষনাথের কথা উল্লেখ্য যোগ্য । চর্যাগীতিতে খানহ্ পা, সরহ পা, লুই পা (মৌননাথ বা মৎস্যে পা), হাড়ী পা প্রভৃতি ৮৪ (চুরাশি) জন সিদ্ধ যোগী বা লুরিদের কথা উল্লেখ রয়েছে (চর্যাগীতি পঞ্চাশিকা, পৃ: ৪৪)।
    দৈনন্দিন ধর্মীয় কাজে ব্যবহৃত চাকমা লুরিদের প্রণীত গ্রন্থ গুলিকে ‘আগতারা’ বলা হত । এগুলি মূলতঃ ভগবান বুদ্ধের উপদিষ্ট এক একটি সুত্রের এক একটি অংশ বিশেষ । সুত্র গুলি পালি, সংস্কৃত, চাকমা, ব্রহ্মী প্রভৃতি সংমিশ্রত ভাষায় রচিত । আবার দু’টি একটি বিশুদ্ধ পালি ভাষায়ও দেখা যায় । একাদশ শতাব্দীতে ব্রহ্মদেশের রাজা অনিরুদ্ধ তাঁর সাম্রাজ্যে থেরবাদ ধর্ম প্রতিষ্ঠা করার পর উক্ত ‘অরি বা লুরি’দের তাঁর দেশ থেকে বিতারিত করেন, এই গৃহী পুরোহিতরা চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে এসেছিলেন বলে উল্লেখ পাওয়া যায় । সম্ভবতঃ তারাই উক্ত ‘তারা’ গ্রন্থগুলি বহন করে  এনেছিলেন (ভিক্ষু শরণ পাল, বৌদ্ধধর্ম উত্থান-পতন ও চাকমা বৌদ্ধ সমাজ, কলি-২০০৯, পৃ: ১০১)।
    রাণী কালিন্দী তান্ত্রিক মতবাদ থেকে থেরবাদ ধর্মে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তা প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে সর্ব প্রকার সাহায্য সহযোগিতা দান করেন । ঐ সময় রাণীর পৃষ্ঠপোষকতায় নীল কমল ও ফুল চন্দ্র লোথক কর্তৃক বর্মী ভাষায় লিখিত ‘থাদুওয়াং’ (শাক্যবংশ) গ্রন্থের অনুবাদ করা হয় । যা “বৌদ্ধ রঞ্জিক” নামে গ্রন্থটি রাণীর মৃত্যু (১৮৭৩ ইং) বেশ কয়েক বছর পরে ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল (সুগত চাকমা: চাকমা পরিচিতি, রাঙ্গামাটি, ১৯৯৩০)।
    এই গ্রন্থটি বাংলা ভাষায় রচিত গৌতম বুদ্ধের প্রথম জীবন গ্রন্থ । থাদুওয়াং গ্রন্থে শাক্য সিংহ গৌতম বুদ্ধের অভিসন্ধি, অভিনিষ্ক্রমণ, বুদ্ধত্ব প্রাপ্তি, ধর্ম প্রচারক এবং পরিশেষে মহাপরিনির্বাণ প্রাপ্তি পর্যন্ত সমগ্র জীবন আখ্যান বর্ণিত হয়েছে ( দাসগুপ্ত, নলিনীনাথ, বাংলায় বৌদ্ধধর্ম, কলিকাতা-২০০১)।
    ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে চাকমারাণী পূণ্যশীলা কালিন্দী মহান পুণ্য পুরুষ সংঘ মনীষা সারমেধ মহাস্থবিরের নিকট থেরবাদী মতাদর্শে দীক্ষিত হওয়ার সময়ে কোন ‘লুরি’ তাঁর পূর্ব ধর্মমত ত্যাগ করে থেরবাদ আদর্শ গ্রহণ করেছেন বলে জানা যায়নি । রাণী কালিন্দীর থেরবাদে দীক্ষিত হওয়ার আনুমানিক সতের বছর পর দীননাথ চাকমা নামক জনৈক ‘লুরি’ তাঁর তান্ত্রিক ধর্মের বেড়াজাল ছিন্ন করে প্রথম থেরবাদী ভিক্ষু ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন । তাঁর ভিক্ষু নাম ছিল শ্রীমৎ বরমিত্র। দুর্ভাগ্য উপসম্পদা আচার্য কে, সন, তারিখ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি । ভিক্ষুত্ব গ্রহণের পর ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজগুরু পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন শ্রীমৎ রথবংশ নামে আর একজন ভিক্ষুর নাম পাওয়া যায় । এবং তিনিও রাজগুরু পদে সম্মাণিত ছিলেন । কাট্টলি নিবাসী পুনংচান চাকমা ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে উপসম্পদা গ্রহন করে শ্রীমৎ বিজয়ানন্দ ভিক্ষু নামে খ্যাত হয়ে ধর্ম প্রচারে মনোনিবেশ করেন । তিনিও ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজগুরু পদে মর্যাদা লাভ করে সদ্ধর্মের প্রচার ও প্রসারে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন । তাঁর গৃহী নাম ছিল কালা চোগা চাকমা । তিনি তখনকার দিনে বৌদ্ধ দেশ শ্রীলংকায় গিয়ে বৌদ্ধ শাস্ত্র অধ্যয়ন করে বিশেষ ব্যুৎপত্তি লাভ করেন । স্বদেশ প্রত্যাবর্তন পূর্বক বৌদ্ধ ধর্মের জাগরণে বিরল ভূমিকা পালন করেছিলেন । তাঁর উপসম্পদার গুরু ছিলেন রাজগুরু ধর্মরত্ন মহাস্থবির । তারপর ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে পালকধন নামে জনৈক চাকমা যুবক সংসার ধর্ম ত্যাগ করে প্রব্রজ্যাসহ ভিক্ষুত্ব ধর্ম গ্রহণ করে । তখন তাঁর নাম ছিলেন শ্রীমৎ প্রিয়রত্ন ভিক্ষু । ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে চাকমা রাজা ভূবন মোহন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বোয়লখালী দশবল বৌদ্ধ রাজবিহারে ১৯৩৪-১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজগুরু পদে ছিলেন । সেখানে ক্রমাগত সতের বছর অবস্থানকালীন অনেক ছাত্র শ্রমণকে তিনি এই বিহারে শিক্ষা প্রদান করেছিলেন । ছেলেদেরকে নিয়ে বিহারের চারিদিকে সুশোভন বৃক্ষ রোপন করে বিহারটি ছায়া সুশীতল তপোবন রুপ দান করেন । সেখান থেকে রাঙ্গামাটি রাজবিহারে অবস্থান করে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত ছেলেদেরকে আশ্রয় দিতেন এবং হাই স্কুলে পড়ার ব্যবস্থা করেছিলেন । তরুন মেধাবী ভিক্ষু শ্রামণদেরকে ধর্মীয় শিক্ষার জন্য চট্টগ্রাম এবং কলিকাতায় পাঠিয়ে দিতেন । এভাবে তিনি ত্রিশ ও চল্লিশের দশক গুলিতে এই জেলায় একটি সুসংহত ভিক্ষুসংঘ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অনেক অবদান রেখেছিলেন ।
১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে চাকমা রাজ পুর্ণ্যাহের সময় চাকমা সার্কেলের ভিক্ষুদের নিয়ে ‘পার্বত্য ভিক্ষু সমিতি’ নামে একটি সংস্থা গঠন করা হয়েছিল । পার্বত্য চট্টগ্রামের ধর্মীয় উন্নতি সাধনে এটা ছিল ভিক্ষুদের প্রথম সংস্থা । চট্টল ভিক্ষু সমিতি নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়েছিল । পুস্তিকা খানিতে বৌদ্ধ গৃহীদের ত্রিরত্ন বন্দনা, পঞ্চশীল গ্রহনসহ প্রাণী হত্যা ও সুরাপানের কুফল নিয়ে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাহিনী সন্নিবেশিত ছিল । এই সমিতির সভাপতি ছিলেন রাজগুরু ভদন্ত ধর্মরত্ন মহাস্থবির, সহ-সভাপতি ভদন্ত প্রিয়রত্ন মহাস্থবির, সম্পাদক ছিলেন ভদন্ত আনন্দমিত্র ভিক্ষু, যুগ্ম-সম্পাদক ছিলেন ভদন্ত বিমলানন্দ ভিক্ষু ।
ভদন্ত প্রিয়রত্ন মহাস্থবিরের শিষ্যবর্গের মধ্যে ভদন্ত আনন্দ ভিক্ষু, ভদন্ত বিমলানন্দ ভিক্ষু, ভদন্ত ক্ষান্তিবর ভিক্ষু, ভদন্ত শীলানন্দ ভিক্ষু, ভদন্ত রত্নজ্যোতি ভিক্ষু, ভদন্ত উদয়ানন্দ ভিক্ষু ও ভদন্ত দেবানন্দ ভিক্ষু প্রমূখের নাম উল্লেখযোগ্য । এদের মধ্যে ক্ষান্তিবর ভিক্ষু মহামুনি পালি টোলে ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করে সূত্রের আদ্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন । বিদ্যারত্ন ভদন্ত বিমলানন্দ ভিক্ষু কলিকাতায় ধর্মোদয় পালি কলেজ থেকে সুত্র, বিনয়, শেষ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে অভিধর্মের আদ্য ও মধ্য পাশ করেছিলেন । তিনি ‘আঘর তারা’ সম্পাদনের জন্য আরাকান ও ব্রহ্মদেশ ঘুরে আসেন । সেখানে তিনি ‘অরিন্তমা’ তারা নামে একটি তারা সংগ্রহ করেন । এই ‘অরিন্তমা’ তারাটি তৎকালীন ‘গৈরিকা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল । ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে ভদন্ত বিমলানন্দ ভিক্ষু অকাল মৃত্যু পার্বত্যবাসীদের অপুরনীয় ক্ষতি সাধন হয়েছিল । এর বছর খানেক পরে সদ্ধর্ম ও সমাজ হিতৈষী ভদন্ত প্রিয়রত্ন মহাস্থবির ও দেহত্যাগ করেন । ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর আরেক প্রিয় শিষ্য ভদন্ত আনন্দ মিত্র ইহলোক ত্যাগ করেন।
পন্ডিত ভদন্ত ক্ষান্তিবর মহাস্থবির সূত্র, বিনয় ও অভিধর্ম বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন । তিনি ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে রেঙ্গুনে অনুষ্টিত ৬ষ্ঠ সংগীতি অনুষ্টিত তৎকালীন পাকিস্থান বৌদ্ধ প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন । তিনি দীর্ঘকাল পর্যন্ত ত্রিপুরা রাজ্যে ভিক্ষুসংঘের সংঘনায়ক ছিলেন । ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তাঁর সাধন পীঠে দেহ ত্যাগ করেন ।
চাকমা রাজগুরু আচার্য ভগবান চন্দ্র মহাস্থবির (যিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি বিভাগে অধ্যাপক) রাজগুরু শ্রীমৎ ধর্মরত্ন মহাস্থবির আমৃত্যু পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং চট্টগ্রামের বৌদ্ধদের মধ্যে ধর্মীয় শিক্ষার অগ্রগতির ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখেছিলেন । রাজানগর রাজবিহারে দীর্ঘকাল অবস্থান করেন রাজগুরু ভগবানচন্দ্র মহাস্থবির রাজগুরু ধর্মরত্ন মহাস্থবির র্দীঘনিকায় এবং মহাপরিনির্বাণ গ্রন্থের লেখক আমৃত্যু সেখানে থেকে শুধু সাহিত্য সাধনা করেননি সমাজ সংস্কার ও সদ্ধর্মের জাগরনে অভূতপূর্ব পরিবর্তন সাধন করতে সক্ষম হয়েছিলেন । রাঙ্গামাটি আনন্দ বিহারে অধ্যক্ষ দার্শনিক বিশুদানন্দ মহাস্থবির সত্যদর্শন ও ভক্তি শততম গ্রন্থ প্রণেতা এবং উপ-সংঘরাজ বহুগ্রন্থ প্রণেতা সুগত বংশ মহাস্থবির কয়েক বছর সেখানে অবস্থান করে পার্বত্যবাসী বৌদ্ধদের পাশাপাশি বাঙ্গালি বৌদ্ধদের মধ্যে ধর্মীয় চেতনাকে উজ্জীবিত করে তুলেছিলেন । সকলের অতিশ্রদ্ধা ভাজন হয়েছিলেন । শ্রীমৎ জ্ঞানশ্রী মহাস্থবির (বর্তমান উপ-সংঘরাজ) ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে বোয়ালখালী দশবল বৌদ্ধবিহারে কয়েক বছর অবস্থান করে ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে ‘র্পাবত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রম’ এবং ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে রাঙ্গামাটি ‘মোনঘর’ নামে আশ্রম প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আন্তরিক সহযোগিতা করে অত্র এলাকার ছেলে-মেয়েদেরকে আধুনিক শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষার সুযোগ সুবিধা দিয়ে শিক্ষার আলো বঞ্চিতদেরকে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষার পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন । তার প্রত্যক্ষ সুফল স্বরুপ কলিকাতায় ‘শিশু করুনা সংঘ’ এবং ঢাকাস্থ ‘বনফুল আদিবাসী গ্রীন হার্ট স্কুল কলেজে’র প্রতিষ্ঠাদ্বয় যথাক্রমে কর্মবীর শ্রীমৎ বিমলতিষ্য মহাস্থবির এবং কর্মবীর শ্রীমৎ প্রজ্ঞানন্দ মহাস্থবির দেশ-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত সাংঘিত ব্যক্তিত্ব যাঁদের দ্বারা হাজার হাজার আদিবাসী পার্বত্য এলাকার ছেলে-মেয়েরা বর্হিবিশ্বের প্রতিষ্ঠা লাভ করতে সক্ষম হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে । এ জাতীয় সমাজ-সদ্ধর্মে সেবামূলক কার্যক্রম যে কোন জাতির জন্য অতীব শুভ সংবাদ । বিশ্বের যত বৌদ্ধ দেশ আছে সব দেশের আত্মত্যাগী মহান ভিক্ষুসংঘ অতি উচ্চ শিক্ষিত, শাস্ত্রজ্ঞ, গবেষক এবং লেখক হিসেবে স্ব-জাতি, স্ব-সংস্কৃতি এবং স্বদ্ধর্মের উন্নতিতে অসাধারণ অবদান রেখে চলেছেন । ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কলম্বাস আমেরিকা আবিস্কার করার অনেক আগে আত্মত্যাগী এবং ধর্ম প্রচারক বৌদ্ধ ভিক্ষুরাই আমেরিকা আবিস্কার করেছিল। এটা ভিক্ষুদের জন্য অতি আত্মশ্লাগার বিষয় । বলতে দ্বিধা নেই চট্টগ্রামের বাঙ্গালি বৌদ্ধ ভিক্ষুরা শিক্ষা-দীক্ষায় ধ্যানে-জ্ঞানে, শাস্ত্রে অসাধারণ পণ্ডিত, সাধক, লেখক, সাহিত্যক, কর্মবীর হিসেবে বিগত শতাব্দীতে দেশে-বিদেশে শাসন সদ্ধর্মের স্তম্ভ হিসেবে সুনাম-সুখ্যাতির শীর্ষে আরোহন করেছেন । এখনও কিছু কিছু প্রভাব থাকলেও আগের তুলনায় কম বললেও ভূল হবে না । পঞ্চাশের দশক থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে কয়েক জন অসাধারণ পুণ্য পুরুষ ত্রিপিটক শাস্ত্রজ্ঞ মহান সাধক এবং সমাজ-সদ্ধর্ম সংস্কারক সাংঘিক মহিষীদের আর্বিভাব সত্যিই গৌবরবের বিষয় । তম্মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবির এবং সাধকশ্রেষ্ঠ আর্য পুরুষ সাধনানন্দ মহাস্থবির মহোদয় (বনভান্তে) অন্যতম।
রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবির ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে রাঙ্গামাটি বর্তমান বিলাইছড়ি উপজেলাধীন কুতুবদিয়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত ও ধার্মিক পরিবারে  জন্ম গ্রহণ করেন । তাঁর পিতার রুদ্রসিং কার্ব্বারী এবং মাতা ইছামতি তঞ্চঙ্গ্যা । তাঁর গৃহী নাম ছিল ফুল নাথ তঞ্চঙ্গ্যা । ১৮৩৮ খ্রিষ্টাব্দে ভদন্ত তিষ্য মহাস্থবিরের নিকট প্রব্রজ্যা এবং ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে শুভ উপসম্পদা গ্রহণ করেন । তাঁর প্রাথমিক শিক্ষাগুরু ছিলেন মন বাহাদুর । সেখানে থেকে রাঙ্গুনীয়া ইছামতি ধাতুচৈত্য বিহারের অধ্যক্ষ, শ্রীমৎ ধর্মানন্দ মহাস্থবিরের স্নেহ সান্নিধ্যে থেকে শাস্ত্র শিক্ষা এবং রাঙ্গুনীয়া হাইস্কুলে এবং পরে কোয়ে পাড়া হাই স্কুলে পড়াশুনা করেন । ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে উচ্চ শিক্ষার্থে বার্মায় (মিয়ানমার) লেংপেডং বিশ্ববিদ্যালয় ও কামইহেডা বিশ্ববিদ্যালয়ে দশ বছর লেখা-পড়া করে পালি সাহিত্যে এম, এ এবং ত্রিপিটক বিশারদ উপাধি প্রাপ্ত হন । বর্হিবিশ্বে তাঁর এই অর্জন অত্যন্ত প্রশংসার দাবী রাখে । ১৯৫৪-৫৬ খ্রিষ্টাব্দে  রেঙ্গুনে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ বৌদ্ধ মহাসংগীতিতে পাকিস্থানের প্রতিনিধি হয়ে সংগীতিকারক হিসেবে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন । এই সময় শ্রীমৎ সত্যপ্রিয় নামে অপর এক চাকমা ভিক্ষু এতে যোগদান করেন । তিনি শ্রীমৎ আনন্দ মহাস্থবিরের প্রিয় শিষ্য ছিলেন । ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে ২শে ডিসেম্বর রেঙ্গুন থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে এসে সর্ব প্রথম তাঁর জন্ম স্থান কুতুদিয়া গ্রামে পর্দাপণ করেন । তখন চাকমা রাজা ত্রিদিপ রায় এর আমন্ত্রণে তিনি রাঙ্গামাটি রাজ বিহারে আগমন করেন । কাপ্তাই বাঁধের জলে অধুনা নিম্মজ্জিত চাকমা রাজপ্রাসাদে অনতিদুরে প্রতিষ্ঠিত ছিল মনোরম গৌতমমুনি বিহার । সেই রাজবিহারে ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দে জানুয়ারী মাসের প্রথম সপ্তাহে ভদন্ত অগ্রবংশ মহাস্থবির মহাসমারোহে ধর্মীয় মর্যাদাপুর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রাজগুরু পদে বরণ করা হয় । ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে রাইংখ্যং এর বঙলতলী ক্যাং- এ কঠিন চীবর দানের ব্যবস্থা করেন । তিনি পার্বত্য চট্টল ভিক্ষু সমীতিকে পুনঃগঠন করেন, চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা সমপ্রদায়ের অনেক কুলপুত্রকে প্রব্রজ্যা দিয়ে তিনি ভিক্ষু ও শ্রামণ তৈরী করেন । তাঁর সদ্ধর্ম দেশনার উদ্বুদ্ধ সুদক্ষ ভিক্ষুর সংখ্যা সন্তোষজনক ভাবে দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে । বুদ্ধপূজা, কঠিন চীবরদান, সংঘদান, অষ্টপরিস্কার দানের মত ধর্মীয় অনুষ্ঠান ব্যাপক ভাবে প্রত্যেক এলাকায় প্রচলন করেন । ফল শ্রুতিতে এতদঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মের (সদ্ধর্ম) সমৃদ্ধি লাভ হতে থাকে । তিনি প্রায় ৫০টির মত ধর্মীয় পুস্তিকা রচনা করে ধর্মীয় সাহিত্যেও সমৃদ্ধি করেছেনে । তিনি ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে কলিকাতাস্থ ধর্মাঙ্কুর বৌদ্ধ বিহারে এবং শিশুকরুণা সংঘে কয়েক বছর অবস্থান করেন । তিনি সেখান থেকে ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে নেদাল্যান্ডে অনুষ্ঠিত Humen Right Confarence এবং ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে ২রা জুলাই থেকে ২রা আগষ্ট মাসে জেনেভায় অনুষ্টিত United Nations Economic and Social Council প্রভৃতি আন্তজার্তিক সম্মেলনে যোগদান করে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের উপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয় বিশ্ববাসীদের কাছে তুলে ধরেন । তাছাড়া তিনি বৃটেন, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, থাইল্যান্ড, শ্রীলংকা ও নেপাল প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করেন । এ ব্যাপারে যার ভূমিকা ছিল তিনি হলেন কর্মবীর বিমল তিষ্য মহাস্থবির । ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে ৩০ অক্টোবর কর্মবীর বিমল তিষ্য মহাথের ভারতের পশ্চিমবঙ্গ কলিকাতাস্থ উত্তর চব্বিশ পরগণা চকপাচুরিয়ায় রাজার হাট নামক স্থানে ‘বোধিচারিয়া বিদ্যালয়’ ও ‘শিশু করুণা সংঘ’ নামে অনাথ আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন । মূলতঃ ‘শিশু করুনা সংঘ’ শ্রীমৎ বিমল তিষ্য মহাস্থবির এবং রাজ গুরুর পরিকল্পনায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল । ১৯৮৬ সালে ভারতে আশ্রিত ২৫০ জন এতিম শিশুর অবিভাবকের দায়িত্ব প্রতিপালনের পালনের জন্য “পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘ ও মিরপুর শাক্যমুনি বৌদ্ধ বিহারের কর্তৃত্ব ও দায়িত্ব তাঁরই অনুজ ভদন্ত প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরোর হাতে তুলে দিয়ে ভারতে গমন করেন । ভদন্ত বিমল তিষ্য মহাথের ভারত সরকারের সহযোগিতা ও ফ্রান্স সরকারের অনুকম্পায় ৭২ জন আদিবাসী শিশুকে ফ্রান্সে পাঠিয়েছেন । এখানে উল্লেখ্য যে, এই ৭২ জন শিশুকে ফ্রান্সে পাঠানোর ব্যাপারে বাংলাদেশের সমস্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছিলেন ভদন্ত প্রজ্ঞানন্দ মহাথের । বর্তমানে এই শিশুরা ইউরোপের মত উন্নত রাষ্ট্র ফান্সে নাগরিকত্ব লাভ করে সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন ।  তিনি উক্ত প্রতিষ্ঠানের সভাপতি এবং বিমল তিষ্য ভন্তে পরিচালকের দায়িত্ব নিয়ে বর্তমান আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে পরিব্যাপ্ত হয়েছে । রাজগুরু কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে সম্মানি হিসেবে পন্ডিতি ভাতাও পেতেন।
মায়ানমার সরকার থেকে ‘আগ্গমহাসদ্ধম্মজ্যোতিকাধ্বজ’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন । ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি প্রত্যাবর্তন করে রাজ বিহারে অবস্থান করে সাত বছর স্ব-দায়িত্ব পালনের মধ্যে দিয়ে ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে অত্র বিহারে দেহত্যাগ করেন । এ মহামনীষীর স্মারক গ্রন্থের সম্পাদনার দায়িত্ব এবং জীবনী গ্রন্থ বর্তমান লেখকের দ্বারা প্রণীত হয়েছে । এই গুরু দায়িত্ব, কৃতজ্ঞতা ও মূল্যায়নের সৌভাগ্যও বটে। তাঁর মত বড়মাপের সমাজ সংস্কারক, সদ্ধর্ম সেবক নিবেদিতপ্রাণ সাংঘিক ব্যক্তিত্ব অতীব দুর্লভ।
সাধক শ্রেষ্ঠ আর্যপুরুষ সর্বজন পুজ্য ভদন্ত সাধনানন্দ মহাস্থবির (বনভান্তে) বৌদ্ধ জাতির জন্য অনন্য কীর্তিমান সাংঘিক পুরোধা । যাঁর কঠোর সাধনা, অনুভূতি, শীলজ্ঞান এবং অভূতপূর্ব দেশনা জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার কাছে অতিপূজ্য এবং সর্বজন শ্রদ্ধেয় মহান ব্যক্তি হিসেবে নন্দিত হয়েছেন । তাঁর মত কঠোর ধ্যান সাধক ভিক্ষু দ্বিতীয় খুঁজে পাওয়া কঠিন । অন্য দিকে নির্লিপ্ত, নিরাসক্ত এবং র্নিলোভ আদর্শ সাংঘিক পূন্য পুরুষ বর্তমান সময়ে অত্যন্ত বিরল।
১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে মগবান মৌজার মোরঘোনায় জন্ম গ্রহণ করেন । তার গৃহী নাম ছিল রথীন্দ্র চাকমা । পিতা হারুমোহন চাকমা এবং মাতা বীরপতি চাকমা । তার জন্ম দাতা পিতা-মাতা সেই যুগের শীলবান, শীলব্রতী ও ধার্মিক ছিলেন । বয়স বাড়ার সাথে সাথে আধুনিক শিক্ষায় সুশিক্ষিত করার মানসে স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন । সেখানে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করেন । শৈশবকাল থেকেই তিনি ভাবুক প্রকৃতির ছিলেন । নীরব জীবন যাপন করতে পছন্দ করতেন । সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বিভিন্ন জাতের পশু-পাখী হত্যা এবং বাজারে বিক্রয় করা তাঁর কোমল অন্তরে ভীষণভাবে পীড়া দিত এবং দুঃখ প্রকাশ করতেন । একদিন দেবদত্ত্বের দ্বারা আহত প্রাণী রাজকুমার সিদ্ধার্থ গৌতমের আশ্রয়ে গিয়ে তাঁর দ্বারা সুস্থ করে দেবদত্ত্ব সেই প্রাণী ফেরত চাওয়া সত্ত্বেও শাক্যরাজ্যের বিনিময়ে প্রাণীর জীবন রক্ষায় ভূমিকা রেখেছিলেন । বর্তমান সময়ে অলিক কল্পনা মাত্র । সেদিন তার কোমল অন্তরে সেই শিক্ষাটি গভীরভাবে বুঝতে পেরে নিজেই আত্মত্যাগ চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে, পটিয়া নিবাসী এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক শ্রী গজেন্দ্রলাল বড়ুয়ার আন্তরিক সহায়তায় ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ ভদন্ত দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান মহাস্থবির এর নিকট তিনি প্রব্রজ্যা ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন । ভদন্ত দীপঙ্কর মহাস্থবির ছিলেন সেই যুগের বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মধ্যে প্রথম বি,এ পাস এবং ত্রিপিটক বিশারদ উপাধি ধারী । রথীন্দ্র শ্রামণ কিছু সময় পর্যন্ত সেখানে পালি ও বাংলা ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করে পরিবেশগত কারণে তাকে মুক্তির পথ খুঁজতে সেখান থেকে বের হলে ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে কাপ্তাই এর পাশে ধনপাতার গভীর জঙ্গলে ধ্যানরত হয়ে পড়েন । দুঃভাগ্যবশতঃ ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে জলবিদ্যুৎ তৈরীর জন্য কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের দরুন বিস্তীর্ণ এলাকায় ব্যাপক জলমগ্ন হওয়ায় তিনি দীঘিনালায় চলে যান । তখন থেকে তিনি ভক্তদের দৃষ্টি গোচর হয় ।
১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে রাজগুরু অগ্রবংশের উদ্যোগে এবং ভিক্ষু সংঘের সহায়তায় তাঁকে উপসম্পদা প্রদান করা হয়েছিল । তিনি সুদীর্ঘকাল সেখানে ধ্যানচর্চা করে দুরছড়িতে চলে যান । সেখানেও ছয়/সাত বছর থেকে ধর্মপ্রাণ শ্রী অনিল বিহারী চাকমার (হেডম্যান) এর প্রার্থনায় তিনটিলায় চলে যান । ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে চাকমা রাজা দেবাশীষ রায়ের শ্রদ্ধা শীলা মাতা আরতি রায়ের আকুল আহব্বানে রাঙ্গামাটির রাজ বনবিহারে আগমন করেন । সেখানে তার ধর্মাভিযান শুরু হয় ব্যাপক ভাবে। এই সময় থেকে মননশীল মেধা ও সাধনা লব্ধ জ্ঞানে ১মও ২য় খন্ড দেশনা গ্রন্থ প্রকাশিত হয় । ইদানিং তাঁর অসংখ্য শিষ্য-প্রশিষ্য দেশে-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়ে সাধক পুরুষের আদর্শ ও অমৃতবাণী প্রচার ও প্রচারে অসাধারন ভূমিকা পালন করে চলেছেন। তাঁর জীবনে সবচেয়ে অমরকীর্তি বাংলা ভাষায় ত্রিপিটক গ্রন্থাবলী অনুবাদ ও প্রকাশের সুব্যবস্থা করেছেন। ভিক্ষু-শ্রামণদের জন্য হাসপাতাল এবং পুর্ণাঙ্গ প্রেস স্থাপনসহ শাসন সদ্ধর্মের কল্যাণে সুন্দর পরিবেশ সর্বোপরি বিশ্বশান্তি প্যাগোডা স্থাপনের অভিনব দৃষ্টিনন্দন শৈল্পিক নক্সা তৈরী করে গেছেন । বৌদ্ধ প্রধান প্রতিরুপ দেশ থাইল্যাণ্ডের বিশ্বখ্যাত “ধম্মকায়া ফাউন্ডেশনের” প্রতিনিধিদেরকে সর্বপ্রথম বর্তমান লেখককের ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশে এনে মৈত্রী সম্পর্ক তৈরী করেছিলেন । তারা রাজবন বিহারের নতুন করে বিশ্ব প্যাগোডা প্রতিষ্ঠার জন্য অভিনব ও দৃষ্টিনন্দন নক্সার তৈরীর ব্যাপারে সহায়তা  করেছেন । উল্লেখ্য যে এ ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় উপজেলায় প্রতিষ্ঠিত বৌদ্ধ বিহার সমূহের পূজা ও প্রার্থনার জন্য সর্ব মোট ২৫০টি অষ্টধাতু বুদ্ধ মূর্তি লেখকের মাধ্যমে বাংলাদেশে বৌদ্ধদের জন্য প্রদান করেছেন । তৎমধ্যে ৮০টি বুদ্ধ মূর্তি বনবিহারের শাখা সমূহে প্রদান করা হয়েছে । তৎজন্যে তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।  ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে ৩০ জানুয়ারি ঢাকা স্কয়ার হাসপাতালে  শারীরিক বাধ্যর্ক জনিত কারণে ইহলোক থেকে পরলোকে গমন করেন । রোগশর্য্যা থেকে দেহত্যাগ এবং পেটিকাবদ্ধ অনুষ্ঠান পর্যন্ত পাশে থেকে সেবা-যত্ন করার মহান সুযোগ লেখকের হয়েছে। প্রায় সকল অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে স্মৃতিচারণ করার সূবর্ণ সুযোগ লাভ করে কৃতার্থ বোধ করছি । বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার ও প্রচারের ক্ষেত্রে এ জাতীয় মহান কৃতি সাধক পুরুষের প্রয়োজন সমাধিক । 
মৈত্রী কামী শ্রদ্ধেয় শ্রীমৎ তিলোকানন্দ মহাস্থবির ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে শুভ উপসম্পদা গ্রহণ করে বাঘাই ছড়ি মগবান শাক্যমুনি বৌদ্ধ বিহারে অবস্থান করেন । তিনি ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে বাঘাইছড়ি কাচালং “শিশু সদন” নামে অনাথ আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে পাহাড়িদের শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধনে অনন্য ভূমিকা রেখে চলেছেন । এই মানব প্রেমী কল্যাণ মিত্র মহান ত্যাগদীপ্ত পুণ্য পুরুষের মানবতাবাদী কর্মকান্ডের স্বীকৃতি স্বরুপ ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দে চ্যানেল আই কর্তৃপক্ষ থেকে “সাদা মনের মানুষ” হিসেবে সম্মাণিত করে পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা বৌদ্ধ সমাজকে গৌরবান্বিত করেছেন । তিনি বর্তমান ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে ভিক্ষুসংঘ, বাংলাদেশ’ এর মাননীয় উপ-সংঘরাজ হিসেবে বরিত হয়ে শাসন সমাজের উন্নতিতে কাজ করে যাচ্ছেন।
১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে কর্মবীর সুমনালংকার মহাস্থবির কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয় ‘পার্বত্য বৌদ্ধ মিশন’। এই প্রতিস্থানের মাধ্যমে অত্র এলাকার অসংখ্য শিশু-কিশোর পড়াশুনা করে অনেকেই সরকারী-বেসরকারী ভাবে বিভিন্ন কর্মে জড়িত হওয়া ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন । তিনি বহু দেশ-বিদেশের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ গ্রহণ করেন । স্ব-জাতির অস্তিত্ব রক্ষায় তিনি প্রতিবাদী কন্ঠস্বর হিসেবে জাতির দুর্দিনে ঝাঁপিয়ে পড়তে দ্বিধা বোধ করেননি । তিনি দীর্ঘ বছর ‘পার্বত্য ভিক্ষুসংঘ, বাংলাদেশ’ সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন ।
 কর্মবীর জ্ঞনপ্রিয় ভিক্ষু ও শাসন প্রিয় ভিক্ষু’র যৌথ ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে “গিরি  ফুল শিশু সদন” প্রতিষ্ঠিত করে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত ছেলে-মেয়েদেরকে যুগোপযোগী শিক্ষায় সুশিক্ষিত করার জন্য বিশেষ অবদান রেখে চলেছেন ।
পার্বত্য চট্টগ্রামের দক্ষিণে বান্দরবান এলাকায় আলোকিত এবং সাংঘিক ব্যক্তিত্ব শ্রীমৎ উ,পঞ্ঞা জোত থের (বি,সি,এস) আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বৌদ্ধ ধর্মে শুভ উপসম্পদা গ্রহণ করে সমতলীয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের তরুণ তরুণীদের বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি প্রবল আকর্ষণ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন । তারই সুন্দর পরিকল্পনায় অত্র এলাকায় প্রথমত ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দে ‘মহাসুখ প্রার্থনা পুরণ’ বৌদ্ধ জাদি (স্বর্ণ মন্দির) ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন এবং ২০০০খ্রিঃ তা শুভ উদ্বোধন করা হয় ।
দ্বিতীয়ত ঃ রামজাদি মন্দিরের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে এবং শুভ উদ্বোধন করা হয় ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে । তাঁর জীবনে এই দুটি ঐতিহাসিক কর্মকান্ড মহান পূণ্যতীর্থে রুপলাভ করেছে । তাঁর উপদেশ এবং লেখা অপূর্ব । বুদ্ধের মৌলিক বিষয়বস্তুকে অবলম্বন করলে সমাজ ও জাতি আরো বেশি উপকৃত হবে আশা রাখি । অভিজাত ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের আলোকিত সন্তান হিসেবে সমাজ ও জাতি আরো অনেক কিছু প্রত্যাশা করে।
যে বিষয়টি না জানালে বর্তমান লেখাটি অপুর্ণ থেকে যাবে তা হলো- স্মরনাতীত কাল থেকে ঐতিহাসিক অন্যতম পুণ্যতীর্থ চিৎমরম বিহার যা সমতলীয় ও পার্বত্যবাসী আপামর বৌদ্ধদের জন্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি করার একমাত্র স্থান ছিল । অত্র বিহারের অধ্যক্ষ শ্রীমৎ পরাক্রমা মহাস্থিবের অবদান ছিল অবিস্মরণীয় । পরবর্তীকালে সর্বজন শ্রদ্ধেয় উ. পাণ্ডিতা মহাথের স্ব-জাতি ও স্বধর্মের উন্নতিতে অনেক ত্যাগ ও দুরদর্শিতার পরিচয় দেন । তাঁর মহাপ্রয়াণের পর লেখক তাঁর জীবনি বাংলায় লিপিবদ্ধ করে দেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল । বর্তমান ভদন্ত উ. পমোক্ষা মহাস্থবির মহোদয় সুযোগ্য উত্তরসুরী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন । 
১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত মানিকছড়ি মহামুনি মন্দিরটিও অত্র রাজ পরিবারের অন্যতম পুণ্যতীর্থ হিসেবে প্রতিবছর কার্তিক পূর্ণিমায় বিশাল মেলা বসে । এটি পঞ্চমতম রাজা নিপ্রু চাই মারমা কর্তৃক প্রতিষ্ঠা করা হয় । বর্তমানে শ্রীমৎ উত্তমা মহাস্থবির তা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছে । বহু ভিক্ষু শ্রামণদের ধর্মীয় ও উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে সহায়তা প্রদান করে যাচ্ছে । মহামুনি পাহাড়তলী গ্রামে প্রতিষ্ঠিত মহামুনি মন্দিরটিও (মং রাজার) বদান্যতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল । উল্লেখ্য যে, ১৮১৩ খ্রিষ্টাব্দে মহামুনি পাহাড়তলী গ্রামেরই পুণ্য পুরুষ চান্দা ঠাকুর নামে খ্যাত সুদুর আরাকানের মহামুনির অনুকরণে অত্র বিহারে বিশাল আকার বুদ্ধ মূর্তি নির্মাণ করেন সর্ব সাধারণের পূজা ও প্রার্থনার ব্যবস্থা করে অক্ষয় র্কীত্তি স্থাপন করে গেছেন । প্রবাদ আছে- ‘ছোট খাটো চান্দা ঠাকুর এত বুদ্ধি জানে, আকিয়াবের মহামুনি কদলপুরে আনে’। অত্র বিহারে প্রতি বছর চৈত্র সংক্রান্তিতে পার্বত্য অঞ্চলের চাকমা, মারমা, বড়ুয়া ইত্যাদি সম্প্রদায়ের বিশাল মিলন মেলা বসে । বান্দরবান উজানিপাড়া মহা বৌদ্ধ মন্দিরও একটি রাজপরিবারের দ্বারাই নির্মিত বৌদ্ধ বিহার । এখানে বহু ভিক্ষু-শ্রমণ ত্রিপিটক শাস্ত্রের উপর লেখা-পড়া করে থাকে । বর্তমানে বিহারাধ্যক্ষ উ. চান্দা ওয়ারা মহাস্থবির কর্তৃক পরিচালিত হয়ে থাকে । টেকনাফের নিলা এলাকায় মহাপণ্ডিত উ. পাণ্ডিতা মহাস্থবির একজন আন্তজার্তিকভাবে পরিচিত একজন সাংঘিক ব্যক্তিত্ব । তিনি লণ্ডণ থেকে বি, এ ডিগ্রি লাভ করেছিলেন । সেখানেও একটি প্রাচীন চৈত্য মন্দির (জাদী) আছে । প্রতিবছর মেলা বসে এবং বৌদ্ধদেশ মায়ানমার আরাকান থেকেও পূজা দেওয়ার অসংখ্য লোক সমাগম হয় । অত্র এলাকায় বসবাসকারী বৌদ্ধদের অস্তিত্ব রক্ষা, ধর্মীয় সংস্কার বিশেষতঃ শিক্ষার উন্নতি তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য ।
২০০০ খিষ্টাব্দে তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের ভিক্ষুদের দ্বারা ‘ত্রিরত্ন ভিক্ষু এসোশিয়েশন’ নামে আরেকটি সংস্থা গড়ে উঠেছে । সম্প্রতি বিলাইছড়ি এলাকায় ঐ সংস্থার নামে প্রায় পঞ্চাশ একর জমি সংগ্রহ করে বির্দশন ভাবনা কেন্দ্র স্থাপন পূর্বক জনকল্যাণ মূলক কার্যক্রম শুরু করেছে । রাজস্থলীর কর্মবীর ধর্মানন্দ মহাস্থবির এই সংস্থার সভাপতি এবং সম্পাদক বিনয় তিষ্য থেরো । তঞ্চঙ্গ্যা বৌদ্ধদের অন্যতম ধর্মীয় গুরু ভদন্ত ক্ষেমাঙ্কর মহাস্থবির অসাধারণ শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত ছিলেন । তিনি অভিধর্ম পিটকের কয়েকটি খণ্ড বাংলা ভাষায় অনুদিত করে প্রকাশ করে গেছেন । তিনি রাজানগর রাজবিহার এবং ওয়াগা বিহারসহ আরো বহু বিহারের সার্বিক উন্নয়নসহ সমাজ সংস্কারের বিরল ভূমিকা রেখেছিলেন ।
খাগড়াছড়ি সদর বেতছড়ি গ্রামে সম্প্রতি প্রায় পঞ্চাশ একর জমি নিয়ে রাজগুরু অগ্রবংশ ও সাধকশ্রেষ্ঠ বনভন্তের নামাঙ্কিত বির্দশন ভাবনা কেন্দ্র ও ভিক্ষু প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে । অত্র এলাকা তথা মহান ভিক্ষুদের জন্য অত্যন্ত শুভ সংবাদ । তাছাড়া আরো বহু প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে তথ্য না পাওয়ার জন্য তা উল্লেখ করা সম্ভবপর হয়নি । সঠিক তথ্য পাওয়া গেলে তাও পরবর্তীতে লিপিবদ্ধ করা হবে । আরো অসংখ্য নাম না জানা অনেক ভিক্ষুর কার্যক্রমের কথা তুলে ধরতে পারলাম না বলে দুঃখিত । পরবর্তীতে কৃতজ্ঞ চিত্তে তথ্যাদি ফেলে অবশ্যই স্বগৌরবে জন সমক্ষে প্রকাশ করার আশা রাখি ।
প্রসঙ্গতঃ  উল্লেখ্য যে, অষ্টম শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত ক্রমাগত চারশত বছর পাল রাজত্বের সময়কালকে বৌদ্ধ ধর্মের বিকাশের স্বর্ণ যুগ বলা হয়েছে । এদেশে পাল আমলে শিক্ষা, সংস্কৃতি , কৃষ্টি, সভ্যতা, স্থাপত্য ও শিল্পকলা বিকাশের অভূতপূর্ব  অবদান শুধু রেখে যাননি বরং পশ্চিমা দেশে যখন শিক্ষার আলো  প্রবেশ করেনি তখন এ বাংলায় চট্টগ্রামে পণ্ডিত বিহার, কুমিল্লাই শালবন বিহার, রাজশাহীতে সোমপুর বিহার এবং বগুড়ায় মহাস্থানগড় বিহার (বিশ্ববিদ্যালয়) পাল রাজাদের ঐকান্তিক পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে । এই সকল বিদ্যাপীঠে দেশ-বিদেশের অসংখ্য বিদ্যার্থীগণ এসে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান লাভের সুযোগ হয়েছিল । এসব বিদ্যাপীঠে বসে চুরাশি সিদ্ধাচার্যগণ চর্যাগীতি রচনা করে গেছেন । এ চর্যাগীতি থেকে বাংলা ভাষার গোড়া পত্তন হয়েছে । দুর্ভাগ্য বিষয় এয়োদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাসে অন্ধকারময় যুগ হিসেবে পরিচিত । উনবিংশ শতাব্দীর অথার্ৎ রেনেঁসার যুগ সন্ধিক্ষণ থেকে বৌদ্ধধর্মের ক্ষীণ প্রভাব অনেকটা জাগ্রত হলেও এ অঞ্চলে প্রচলিত বৌদ্ধধর্মকে আমরা বিকৃত বৌদ্ধধর্ম বলা যায় । না হিন্দু না মুসলিম এবং না বৌদ্ধ এই ছিল অবস্থান । ক্রমে তা বিবর্তিত হয়ে তান্ত্রিক মহাযানী বৌদ্ধধর্ম হিসেবে প্রাধান্য লাভ করেছিল । এখনও সেই প্রভাব কিছু কিছু এলাকায় দেখা যায় । বিংশ শতকের এই তিন পার্বত্য চট্টগ্রামে থেরবাদী বৌদ্ধ ধর্ম প্রতিষ্ঠা লাভ করার পর নতুন করে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার-প্রসারের ফলে সরল প্রাণ বৌদ্ধ সমাজের মধ্যে এক বিশাল প্রভাব পড়েছিল । শ্রী মুকুন্দ চাকমা তাঁর এক প্রবন্ধ থেরবাদী বৌদ্ধ ধর্মের বিকাশকালকে তিন ভাগে বিভাজন করে দেখিয়েছেন- যথা: ব্রিটিশ শাসনের শেষকাল পর্যন্ত রাজগুরু প্রিয়রত্ন মহাস্থবিরের থেরবাদী ধর্মের প্রতিষ্ঠাকাল। পাকিস্থানের শাসন আমলেকে বলতে পারি, অগ্রবংশ ভন্তের সংস্কার কাল এবং স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ সময়কে পার্বত্য ভিক্ষুসংঘ ও বনভন্তের সাম্প্রতিককাল ( রাজগুরু, সম্পাদক তেজবংশ স্থবি,২০০৮. পৃঃ ২৩০)।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার-প্রসারে সমাজ ও সংস্কৃতি রক্ষার্থে নিজের জীবন উৎর্সগ করে আরো যাঁরা অনন্য ভূমিকা রাখেন তাঁরা হচ্ছেন-  সংঘরাজ সুগত প্রিয় মহাথের ১৯৩২ খ্রিষ্ঠাব্দে  রুপকার বড়দাম গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। তার পিতার নাম যামিনী রঞ্জন চাকমা মাতা সুমিত্রা দেবী চাকমা।  তিনি ১৯৫৩ খ্রিষ্ঠাব্দে রাঙ্গামাটি রাজ বিহাবে শ্রীমৎ আনন্দ মোহন স্থবিরের নিকট প্রব্রজ্যা গ্রজন করেন। ১৯৫৪ খ্রিষ্ঠাব্দে শ্রীমৎ পুঞ্ঞাস্বামী  ভিক্খু প্রচেষ্ঠায় উপসম্পদা গ্রহন করেন । ২০০৮ খ্রিষ্ঠাব্দে রাঙ্গামটি রাজবিহারে সংঘরাজ রাজগুরু অগ্রবংশ মহাথেরোর জাতীয় অন্ত্যেষ্টিক্রয়া অনুষ্ঠানে  সংঘরাজ পদে অভিষিক্ত হন । ২০১০ খ্রিষ্ঠাব্দে পরলোক গমন করেন । সংঘরাজ ভদন্ত অভয়তিষ্য মহাথের, তিনি ১৯৩৫ খ্রিষ্ঠাব্দে শুভলং জুরাছড়ি ঘিলাতলী গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। তিনি ১৯৫৬ খ্রিষ্ঠাব্দে কার্তিক মাসে শ্রীমৎ প্রজ্ঞাসার মহাস্থবিরের নিকট প্রব্রজ্যা গ্রহন করেন। ১৯৫৮ খ্রিষ্ঠাব্দে শ্রীমৎ পঞ্ঞাস্বামী মহাস্থবিরের উপধ্যায়ত্বে উপসম্পদা গ্রহন করেন। ২০০৮ খ্রিষ্ঠাব্দে রাঙ্গামটি রাজবিহারে সংঘরাজ রাজগুরু অগ্রবংশ মহাথেরোর জাতীয় অন্ত্যেষ্টিক্রয়া অনুষ্ঠানে  উপ-সংঘরাজ পদে অভিষিক্ত হন । ২০১০ খ্রিষ্ঠাব্দে  সংঘরাজ সুগতপ্রিয় মহাথেরোর জাতীয় অন্ত্যেষ্টিক্রয়া অনুষ্ঠানে  সংঘরাজ পদে অভিষিক্ত হন । ২০১০ খ্রিষ্ঠাব্দে পরলোক গমন করেন উ.পাণ্ডিতা মহাথের (বরকল সদর বৌদ্ধ বিহার), শ্রদ্ধালংকার মহাথের ( ভেদভেদী সংঘরাম বিহার), বোধিপাল মহাথের (গামাড়ী ঢালা বনবিহার), সত্যনন্দ মহাথের (রাঙ্গাপানি মিলন বিহার), সুমনালংকার মহাথের (পার্বত্য বৌদ্ধ মিশন), ধর্মকীত্তি মহাথের (রাঙ্গাপানি মিলন বিহার), প্রজ্ঞালংকার মহাথের (বনসংঘ), চিত্তানন্দ মহাথের, পূর্নজ্যোতি মহাথের ( রাঙ্গামাটি মৈত্রী বিহার), নন্দপাল মহাথের (বনসংঘ), নন্দপাল মহাথের (লতিবান আর্দশ বৌদ্ধ বিহার), যবনা তিষ্য মহাথের, তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের আর্যানন্দ মহাস্থবির, রাজস্থলী মৈত্রী বিহারের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ শ্রীমৎ শান্ত জ্যোতি  মহাস্থবির প্রমূখ ভিক্ষু সংঘ।
 এখন আমরা এক বিংশ শতাব্দির চ্যালেঞ্জের দ্বার প্রান্তে উপনীত। প্রাচীন সংস্কারমুক্ত তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মকে অনেক পিছনে ফেলে থেরবাদী বৌদ্ধধর্মের আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে এগিয়ে চলেছে তা বৌদ্ধ জাতি তথা মহান ভিক্ষুসংঘের জন্য অত্যন্ত মঙ্গলময় বার্তা বলা যায় । এ ব্যাপারে অনেক উচ্চ শিক্ষিত এবং পণ্ডিত গৃহী সমাজ সংস্কারক, সংগঠক, সাহিত্যিকও লেখকদের অবদানও কম নয় । সীমাবদ্ধতারকারণে তাদের নাম লিপিবদ্ধ করতে পারলাম না বলে আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।


লেখেক পরিচিতি ঃ অধ্যাপক, পালি ও সংস্কৃত বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যায়, উপাধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহার, প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি, বুড্ডিস্ট রিচার্স এ- পাবলিকেশন সেন্টার।
(নন্দসার স্মারকে প্রকাশিত, ২৯ নভেম্বর ২০১৩ইং)

1 comment

Anonymous said...

খুব সুন্দর ইতিহাসমুলক প্রবন্ধ হয়েছে। আমি আরো আশা করবো এ জাতিয় প্রবন্ধ লেখা আমাদের উপহার দেয়ার জন্য।

Theme images by 5ugarless. Powered by Blogger.