মূর্খকে নয়, জ্ঞানী ব্যক্তিকে কেন শ্রদ্ধা করবো? (Why should we pay homage to wise person, not to the ignorant?)



ভিক্ষু বিপসসী
শাক্যমুনি বৌদ্ধ বিহার, মিরপুর, ঢাকা।

দেব-মনুষ্যের শাস্তা মহামানব গৌতম বুদ্ধের দেশিত আটত্রিশ প্রকার মঙ্গল ধর্মের মধ্যে নিহিত আছে যে, “অসেবনা চা বালনং (Avoiding wrong company), পন্ডিতানঞ্চ সেবনা (Associating with the wise), পূজা চা পূজনীয়নং (Revering those to be revered)--এতং মঙ্গল মুত্তমং (Each is a great blessing.)| । অর্থাৎ, মুর্খ ব্যক্তির সংসর্গ ত্যাগ করা, পন্ডিত, জ্ঞানী, বিচক্ষণ, স্থিতধী, দূরদর্শীসম্পন্ন ব্যক্তিকে যর্থাথ সম্মান প্রদর্শন করা, পূজনীয় ব্যক্তিকে পূজা-সৎকার করা- মঙ্গলকর, সুখকর।
কে সেই মূর্খজন? পালি শব্দের ‘বাল’ অর্থ ‘মূখর্’ বা অজ্ঞানী, নির্বোধ ব্যক্তিকে বুঝায় । প্রচলিত অর্থে -লেখাপড়া না জানা লোককে বা অশিক্ষিতজনকে মূর্খ বলা হয়ে থাকে। কিন্তু বৌদ্ধ সাহিত্য এর দীর্ঘ অবতারনার দাবী রাখে। মানুষ তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশের উপর অনেকটা নির্ভর। পরিবেশ তাকে এমন মানসিক পর্যায়ে নিয়ে যায় তখন তার কাছে সময়ে যোগ-বিয়োগ কিংবা কর্মপ্রণালী সম্পূর্ণ একটানা যন্ত্রণা বলে মনে করে। এই পরিবর্তনশীল মানসিক যন্ত্রণা থেকে পরিত্রাণের জন্যে মানুষ দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে। বস্তুতপক্ষেঃ ইহ-পরকালের কল্যাণে সত্যপথ বা ভেলা কিন্তু পথিকের কাছে দীর্ঘ মনে হয়। এই দীর্ঘ ভেলা পাড়ি জমাতে জীবনের প্রতিটি মূহুর্তে ছোট-বড় টেউয়ের সম্মূখীন হতে হয়। আর এই ছোট-বড় টেউকে অতিক্রমের জন্য প্রয়োজন  হয় সৎ বন্ধু, সৎ গুরু, সৎ মিত্রের। এই সৎগুরু, সৎ মিত্রের সাহচর্যে মানুষের চরিত্র গঠনে এবং জ্ঞান সাধনায় উন্নতির দিকে নিয়ে যায় আধ্যাতিœক উৎকর্ষতায়। যদিও বা মূর্খজনের কাছে সদুপদেশ অনেকটা আতœঘাতী হয়ে দাঁড়ায়। তদুপরি মূর্খজনের অহংকার মরীচিকার সদৃশ। তাই সৎ বন্ধু নির্বাচনে বিজ্ঞতার পরিচয় দিতে হয়। মূর্খজন- কুল-জাত্যাভিমানী হয়ে রুপের অহংকার, ধন-সম্পদের অহংকার, পুত্র-কন্যার অহংকার করে আতœাভিমানী হয়ে থাকেন। কিন্তু এই মূর্খজন ধন-জন, পুত্র-কন্যা ‘আমি’ ‘আমার’ অস্তিত্বকে চিরস্থায়ী মনে করে। পক্ষান্তরে, মূর্খজন আজীবন আপাতমধুর পাপের ফুলঝুড়িতে আকর্ষিত হয়। সে তার চাল-চলন, কথাবার্তা, অঙ্গভঙ্গি এবং শক্তি সম্বন্ধে অনভিজ্ঞ। মূর্খজনের সঙ্গ বা বাস করা মানে যেকোন মুর্হূতে বিপদকে আহবান করা। শুধু তা নয় এই মূর্খজনকে দায়িত্বশীল ক্ষমতা ন্যস্ত করা মানে অশান্তির বীজ বপন করা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমাদের সমাজ ব্যবস্থা ঠিক এই মূর্খজনের হাতে অনেকটা জিম্মি হয়ে পড়েছে। তাঁদের অদক্ষতা, অদূরদর্শী চিন্তা-ভাবনা, আতœকেন্দ্রিক হয়ে প্রতিহিংসার বীষবাষ্প সৃষ্টি করা। আমাদের সমাজব্যবস্থা দিক-নির্দেশনার কুঁয়াশার চাঁদরে ঢেকে পড়েছে। এই মূর্খজন নিজে যেমন বিপদের সম্মুখীন হয়; অপরজনকেও বিপদের ফাঁদে ফেলায়। মূর্খজনের হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয় পড়ে, কাজে-কর্মে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন না। ফলে তাঁরা অপকর্মে লিপ্ত হয়ে নির্লজ্জ, ধূর্ত্ত, মদ্যপায়ী, ধর্ষন, লুন্ঠন, জুয়াখোর, কুহক, সন্ত্রাসীর মতো কার্যকলাপ সম্পাদন করতে দ্বিধাবোধ করেন না।
তাই ‘ধর্মপদে’ ‘বাল বগের্’ বর্ণিত হয়েছে-
“যাব জীবংপি চে বালো পন্ডিতং পয়িরূপাসতি,
ন সো ধম্মং বিজানাতি দব্বী সূপরসং যথা।”
অর্থাৎ, চামচকে যেমন সারা বছর সূপরসে ডুবে রাখলেও, তাতে চামচ সূপরসের স্বাদ পায় না, তেমনি মূর্খজন জীবনভর পন্ডিত, জ্ঞানীর সান্নিধ্য থাকলেও সত্যরস আস্বাদন করতে ব্যর্থ হয়। 
জ্ঞানীগন সবর্দা আতœচর্চা করেন। বুদ্ধের ‘পঞ্চনীতি’কে নৈমিত্তিক দু’বেলা আহারের ন্যায় প্রতিপালন করেন। তাঁরা কখনো পঞ্চনীতিকে লঙ্ঘন করেন না। এই পঞ্চনীতির ২২(বাইশটি) অঙ্গ বিদ্যমান।
    প্রাণীহত্যার ৫টি অঙ্গঃ
ক) প্রাণী হওয়া, খ) প্রাণী বলে ধারনা, গ) হত্যার চেতনা বা মন, ঘ) হত্যার উপক্রম ও ঙ) উপক্রমে হত্যা করা।
    চুরি করার ৫টি অঙ্গঃ
ক) পরপরিগৃহীত বস্তু, খ) পরপরিগৃহীত বলে গ্রহণ , গ) চুরি করবার চেতনা বা মন, ঘ) হরণ করবার চেতনা বা মন ও ঙ)  সেই উপক্রমে হরণ করা।
    মিথ্যাকামাচারের ৪টি অঙ্গঃ
ক) আগমনীয় বস্তু, খ) মৈথুন সেবনের চেতনা বা মন, গ) মার্গে মার্গে প্রতিপাদন, ঘ) ও সেবনের আস্বাদ অনুভব করণ।
    মিথ্যাবলার ৪টি অঙ্গঃ
ক) মিথ্যা বলার চেতনা বা মন, খ) মিথ্যা বলার চেষ্টা, গ) যাকে বলা হয়, ও ঘ) তাঁর জ্ঞাত হওয়া।
    সূরাদির ৪টি অঙ্গঃ
ক) সুরাদির মধ্যে গমনীয় বস্তু হওয়া, খ) পান করার চেতনা বা মন, গ) পানের চেষ্টা, ও ঘ) সেই চেষ্টায় পান করা।া করা।
অন্যদিকে জ্ঞানী ব্যক্তিরা সদা সর্বদায় অতি আগ্রহের সহিত দশ প্রকার শুভকর্মকে অনুশীলন চর্চা করে থাকেন।
সেই দশ প্রকার শুভকর্ম কায়দ্বার, বাক্যদ্বার ও মনদ্বার এই ত্রিদ্বারে কুশল-অকুশলাদি কর্ম সম্পাদন করে থাকেন। এই শুভকর্ম কি?
কায়-দ্বারে কর্ম ঃ যিনি হত্যা, ধ্বংস থেকে বিরত থেকে অন্যকে রক্ষা, সংরক্ষণ করে থাকেন। যিনি অন্যের জিনিস চুরি থেকে বিরত থেকে পরহিত, বদান্যতা, উদার হয়ে অন্যেকে দেওয়া অনুশীলন করেন।  যিনি বিবাহিত স্বামী বা স্ত্রী ব্যতীত অন্যের সাথে অসদাচারণ করে না, বরং অন্যের সাথে ভালো আচরণ করে।
বাক্য-দ্বারে কর্ম ঃ  তিনি অন্যকে মিথ্যা বলে না, বরং সত্যকে সর্বদা অনুশীলন করে।  তিনি কাউকে  মিথ্যা অপবাদ করে না, পিছনে নিন্দা করে না, বরং অন্যেকে নানা ভাবে মধুর সুরে মিলন করার সুচেষ্টা করেন।  তিনি গালিগালাজপূর্ণ, কটুক্তিপূর্ণ ভাষা থেকে বিরত থাকেন, বরং অন্যেকে নরম সূরে মার্জনা ভাষায় কথাবার্তা বলে থাকেন। তিনি পরচর্চা, প্রলাপ বকেন না, বরং শান্তভাবে, ন্যায়সঙ্গতভাবে নিজকে নিয়ন্ত্রণ করেন।
মন-দ্বারে কর্ম ঃ যে  লালসার সাথে অর্থহীনভাবে অন্যের জিনিস লোভ করে না, বরং অন্যেকে খোলামেলাভাবে সহৃদয় দিয়ে বিলিয়ে দেয়।  যে অর্থহীনভাবে কাউকে অনিষ্ট করে না, বরং অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়।  যে সঠিক উপলব্দির মাধ্যমে অনর্থকভাবে, অযৌক্তিকভাবে  কাউকে দর্শন করে না, বরং সর্বদা সঠিক দর্শন আতœ-অনুশীলন করেন। এজন্য করুণাঘন বুদ্ধ ‘সু-পুর্বাহ্ন সুত্রে’ বর্নিত করেছেন যে,
“পদকখিণং কায়কম্মং বাচাকম্ম্ং পদকখিণং,
পদকখিণং মনোকম্মং পনিধীতে পদকখিণা।”
বঙ্গার্থঃ তোমার কায়িক কর্ম প্রদক্ষিণ বা উন্নতি কর, বাচনিক কর্ম প্রদক্ষিণ বা উন্নতি কর, এবং মানসিক কর্ম প্রদক্ষিণ বা উন্নতি কর। জ্ঞানী, বিজ্ঞজন দূরদর্শী সম্পন্ন হয়ে সমাজ দেশ ও জাতির স্বার্থে সবসময় নিজকে আতœ নিয়োজিত রাখেন। তাঁরা ত্রিদ্বার (কায়দ্বার, বাক্যদ্বার, মনদ্বার) সংযমের মাধ্যমে অবিচল সমতা চিত্তে অন্যেকে ভালো কাজে প্রশংসা করেন, উদ্বুদ্ধ করেন। কাজেই তাঁরা সঠিক বাদ-বিচারের মধ্যদিয়ে সত্যের নির্যাসকে কষ্টিপাথরে যাচাই করে সামনে এগিয়ে যাবার মূল ভিত্তি বা কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেন। এরাই প্রকৃত কল্যাণমিত্র। অতএব, জ্ঞানীজনের কাছে মাথা নত করা মানে তাঁদের আহরিত জ্ঞানভান্ডারকে যর্থাথ অনুশীলন করা।


    শিক্ষার্থীঃ বি.এসসি কম্পিউটার সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (২য় বর্ষ)।


No comments

Theme images by 5ugarless. Powered by Blogger.