নতুন বুদ্ধমূর্তি পেয়ে খুশি, দূর হয়নি মনের ক্ষত

কামরুল হাসান ও আব্দুল কুদ্দুস, কক্সবাজার থেকে | আপডেট: ০৩:০৩, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৩ | প্রিন্ট সংস্করণ
26
সীমা বৌদ্ধবিহারের দিকে তাকালেই চোখ ধাঁধিয়ে যায়। ঝকঝকে মেঝে আর দেয়াল। নতুন রঙের প্রলেপ সর্বত্র। উঠানে ঢুকতেই রঙের কড়া গন্ধ ধাক্কা দেয় নাকে। এর একটু দূরে উত্তর মিঠাছড়ি পাহাড়ের নিচে বিমুক্তি বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্রের বিশাল ফটক। ওপরে ১০০ ফুট লম্বা সিংহশয্যায় বুদ্ধের আধা শোয়া মূর্তি, নতুনের ছাপ তাতেও।আজ থেকে এক বছর আগে অর্থাৎ ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে ভয়াবহ হামলায় এসব মন্দিরসহ আশপাশের অনেক ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। সরকারি খরচে সেনাবাহিনীর দায়িত্বে রামু, উখিয়া ও টেকনাফে ১৯টি মন্দির নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে। এখন দলে দলে বুদ্ধের অনুসারীরা আসছেন, আসছেন পর্যটকও। ফেসবুকে আপত্তিকর ছবি যুক্ত করে ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগ তুলে এ হামলা চালানো হয়।নতুন বিহার, নতুন বুদ্ধমূর্তি ও বাড়িঘর পেয়ে আপাতত সবাই খুশি। তবে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের মনের ক্ষত রয়ে গেছে। সেদিনের হামলার ক্ষতিটা শুধু বৈষয়িক বা বস্তুগতই ছিল না, আঘাতটা তীব্রভাবে লাগে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মনে। তাঁদের বিশ্বাস টলে যায়, আর চুরমার হয়ে যায় নিরাপত্তার বোধও। এক বছরে তাতে কতটুকু জোড়া লেগেছে, তার জবাব পাওয়া গেল এই অঞ্চলের একজন ধর্মীয় গুরু সত্যপ্রিয় মহাথেরোর মুখ থেকে। গত শুক্রবার রাতে সীমাবিহারের ধর্মীয় আসনে বসা অশীতিপর এ বৃদ্ধ বললেন, ‘আমাদের শত্রু আরও বেড়েছে, দিনে দিনে আমরা আরও নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ছি। জানি না ভবিষ্যতে কী হবে!’
মহাথেরোর অভিযোগ, সেদিন যারা হামলা করেছিল, তারা এখন প্রকাশ্যে ঘুরছে। ৩ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর রামু সফরের সময় তারা মন্দিরের ভেতরে ঢোকার চেষ্টাও করেছিল। শুরু থেকেই এদের গ্রেপ্তারের দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু পুলিশ তাদের ধরেনি। এমনকি পুলিশ যে সাতটি মামলার অভিযোগপত্র দিয়েছে, তাতেও এদের আসামি করা হয়নি। উল্টো পুলিশ শত শত নিরীহ লোককে ধরে কারাগারে পাঠিয়েছে। কারাবাসের পর তারা বের হয়ে আসছে। তারাও কিন্তু স্থানীয় বৌদ্ধদের ওপর ক্ষিপ্ত হচ্ছে। মহাথেরো বললেন, ‘সব মিলে আমাদের শত্রু কয়েক গুণ বেড়ে গেছে।’
সত্যপ্রিয় মহাথেরো বললেন, ‘আওয়ামী লীগের লোকজন বলছেন, হামলা করেছে বিএনপি। আর বিএনপি বলে আওয়ামী লীগ। আমরা পড়েছি দুইয়ের মাঝে। জানি, এর বিচার কোনো দিনই পাব না। কিন্তু এ মুহূর্তে বিচারের আগে আমাদের দরকার স্থায়ী নিরাপত্তা। আপাতত এটুকু পেলেই বাঁচতে পারব।’
জেলা পুলিশ সূত্র জানায়, বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নিরাপত্তার জন্য রামুতে সার্বক্ষণিক বিজিবি মোতায়েন করা আছে। বিজিবির ২০০ সদস্য পাহারা দিচ্ছেন। এর পাশাপাশি পুলিশও আছে।
রামু, উখিয়া, সদর ও টেকনাফ উপজেলার বৌদ্ধমন্দির ভাঙচুর ও হামলার সাতটি মামলার অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। কিন্তু ৩৬৪ জন আসামির মধ্যে পরিচিত কেউ নেই। যাদের নাম দেওয়া হয়েছে, তাদের কাউকে চেনে না এলাকার লোকজন। আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের স্থানীয় নেতাদের পাশাপাশি টেকনাফের মন্দিরে হামলা ও ভাঙচুর মামলায় অভিযুক্ত হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও জামায়াতের নেতা নূর আহমদ আনোয়ারী, সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সলিমুল্লাহ বাহাদুরসহ অনেকে ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কিন্তু সাত মামলার অভিযোগপত্রে এঁদের কারও নাম নেই।
বৌদ্ধ নেতারা বললেন, হামলার ঘটনা নিয়ে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারকে প্রধান করে করা তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গত ফেব্রুয়ারি মাসে সরকারের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করে। এতে হামলার জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্যসহ ২০৫ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। কিন্তু আদালতে দাখিল করা পুলিশের সাত মামলার অভিযোগপত্রে চিহ্নিত কারও নাম নেই।
বৌদ্ধ নেতাদের অভিযোগ, এর আগে হামলার ঘটনায় অভিযুক্ত ১৬ জন অভিযুক্তের নাম তাঁরা পুলিশ সুপারের কাছে দিয়েছিলেন। এঁরা এলাকার আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগ, বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মী। বৌদ্ধরা মনে করেছিলেন, অভিযোগপত্রে তাঁদের নাম থাকবে। কিন্তু পুলিশ যেমন তাঁদের গ্রেপ্তার করছে না, তেমনি অভিযোগপত্রেও নাম দেয়নি।
জেলা পুলিশ সুপার মো. আজাদ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, রামু, উখিয়া ও টেকনাফে মন্দিরে হামলার ঘটনায় মোট ১৯টি মামলা হয়েছিল। সাতটি মামলায় ৩৬৪ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। এসব ছোটখাটো মামলা। তবে রামু ও উখিয়ার প্রাচীন বৌদ্ধবিহারে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের আরও ১২টি মামলার অভিযোগপত্র এক মাসের মধ্যে দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। প্রমাণ পাওয়া গেলে রাজনৈতিক দলের নেতাদের নামও যুক্ত করা হতে পারে। কিন্তু সমস্যা হলো, বৌদ্ধরা নাম বললেও সাক্ষ্য দিতে রাজি হচ্ছেন না। এখন পর্যন্ত একজন ভিক্ষুও সাক্ষ্য দিতে চাননি। সাক্ষ্য না দিলে আসামি শনাক্ত হবে কী করে?
বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট ফেডারেশনের কক্সবাজার জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক বঙ্কিম বড়ুয়া বলেন, ‘হামলার ১১ মাস পর সাত মামলায় অপরিচিত আসামি দেখে আমরা হতাশ হয়েছি। এ অবস্থায় সাক্ষ্য দিলে নিরাপত্তা দেবে কে?’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশ প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা বলেন, রাজনৈতিক নেতাদের নাম নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু সবুজ সংকেত না পাওয়ায় তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না পুলিশ।
একজন ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, কোটি কোটি টাকা খরচ করে ১৯টি বৌদ্ধবিহার পুনর্নির্মাণ করা নিয়েও মানুষের মাঝে সমালোচনা শুরু হয়েছে। সমালোচনার জবাবে প্রধানমন্ত্রীকে ১২টি মাদ্রাসা তৈরির ঘোষণা দিতে হয়েছে।
তবে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সালাহ উদ্দিন আহমদ বলেন, বৌদ্ধবিহারের উন্নয়নের সঙ্গে মাদ্রাসা উন্নয়ন প্রকল্পের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা অপপ্রচার।

No comments

Theme images by 5ugarless. Powered by Blogger.