বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নির্দশন চর্ষাপদ

সাধনাজ্যোতি ভিক্ষু
বি,এ (অনার্স) এম. এ, এম. এড,

    বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারি আবিষ্কার আমাদের ভাষা ও সাহিত্যের ইতিবৃত্তে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। সেটি সংঘটিত হয়েছিল ১৯০৭ খৃষ্টাব্দে। ঐ সময়ে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (১৮৫৩-১৯৩১)নেপালের রাজদরবার থেকে একখানি প্রাচীন পুঁথি সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন। এই ঘটনার দশ বছর পরে তিনি বঙ্গীয় সাহিত্যে প্রকাশ করেন। বৌদ্ধ গান ও দোহা’ ঐ পুঁথির বিষয়বস্তু নিত্যের সম্পাদনায় প্রকাশ করেন। বৌদ্ধ গান ও দোহা নামে ঐ সংগ্রহ গ্রন্থটিতে ছিল দুই ধরণের জিনিস- একটি ধর্ম সম্পর্কীয় বিধি নিষেধ বিষয়ক, কিছু গান, অন্য গুলো দোহা। ধর্ম সম্পর্কীয় বিধি নিষেধ গুলোর নাম চর্যাচর্যবিনিশ্চয় অর্থাৎ ধর্ম সাধনার ব্যাপারে কোন গুলো আচরনীয় এবং কোনগুলো বর্জনীয়, তারই নির্দেশ আছে।   

 
    চর্যাপদ গুলো ধর্মাচরনের বিধি নিষেধ সংক্রান্ত বিষয়ের উপর রচিত হলেও মূলে সেগুলো গান এবং কাব্যাকারেই তা লিপিবদ্ধ। সুতরাং ধর্ম সাধকদের কাছে ধর্মগ্রন্থ হিসেবে তার অন্য মূল্য থাকলেও গীতিরস পিপাসু কাব্য-পাঠকদের কাছেও তার অন্য সার্থকতা এবং প্রয়োজনীয়তা আছে। ধর্মাচর্চাকারীরা এই চর্যাপদগুলো মধ্যে বিধৃত ধর্মোপদেশ বা ধর্মচর্চার ক্ষেত্রে কী কী আচরনীয় এবং কোন গুলোই বা অনাচরনীয় - সে সম্বন্ধে কতটুকু নির্দেশ পেয়েছেন বা সেই নির্দেশ শুদ্ধ চিত্তে পালন করে কতটুকু লাভবান হয়েছেন। আজ তা জানার উপায় নেই।  কিন্তু কাব্য পাঠক হিসেবে যারা চর্যাপদের রস আস্বাদন করতে চেয়েছেন এবং এখনও করছেন - তারা এর কাব্য মূল্য নিশ্চয় অস্বীকার করতে পারবেন না। তাই সাধারন পাঠকদের কাছে আজও চর্যাপদের প্রথম এবং প্রধান আকর্ষণ কাব্য হিসেবে, ধর্মগ্রন্থ হিসেবে নয়।  

  
    চর্যাপদের কবিতা গুলো পদ্যাকারে গ্রথিত গান, সেই জন্য চর্যাপদের অপর নাম চর্যাগান বা চর্যাগীতি। একজন কবি যেমন এই পদগুলো রচনা করেননি, তেমনি এক সুর এবং এক তালে এগুলো গেয় নয়। রচনাকাল সম্পর্কে কোন নির্দিষ্ট তারিখ ও পাওয়া যায়নি। যে সমস্ত পদকর্তার গান চর্যাগীতির সংগ্রহের মধ্যে সংকলিত হয়েছে তারা সবাই সিদ্ধাচার্য। মোট ২৩ জন সিদ্ধাচার্যের রচিত এক একাধিক পদাবলী নিয়ে প্রচলিত চর্যাপদের সংকলন সমাপ্ত। এই ২৩ জন সিদ্ধাচার্যেরা কে কয়েকটা গান রচনা করেছেন তার তালিকাটি হবে এই রকম - কাহ্যৃপাদ, বা কৃষ্ণচার্যের-১৩, ভুসুুকুপাদ-৮, সরহপাদ-৪, কুঞ্জুরীপাদ-৩, লুইপাদ, সমরপাদ, শান্তিপাদ, প্রত্যেকে দুইটি করে এবং আযর্দেব কন্ধনপাদ, কম্বলাসর, শুন্ডুরী বা গুড্ডরীপাদ, চাটিলপাদ,  জয়নন্দী, ডোম্বীপাদ, ডেন্টনপাদ, তন্ত্রীপাদ, তাড়কপাদ, দারিকপাদ, গুঞ্জরীপাদ, বিরুবাপাদ, বীণাপাদ, ভদ্রপাদ বা মহীধরপাদ প্রত্যেকের একটি করে গান চর্যাপদের মধ্যে সংকলিত হয়েছে।
    
চর্যাপদের আবিষ্কার: ১৯০৭ খৃঃ মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (১৮৫৩-১৯৩১) নেপালের রাজদরবার থেকে যে পুঁথিখানা সংগ্রহ করে আনেন তাতে দু’ধরনের বিষয় পাওয়া যায়- একটি ধর্ম সম্পর্কিত বিধি নিষেধ কিছু গান, অন্যগুলি দোহা ধর্ম সম্পর্কিত বিধি নিষেধ বিষয়ক। গানগুলো চর্যাচর্য বিনিশ্চয় দোহা গুলোর রচয়িতা সরোজ বজ্র ও কৃষ্ণাচার্য রচিত দোহা গুলো এক সাথে একই গ্রন্থে প্রয়োগ করায় হর প্রসাদ শাস্ত্রী এর নাম দিয়েছিলেন বৌদ্ধ গান ও দোহা। হর প্রসাদ শাস্ত্রী আনীত পুঁথিখানিতে পদের সংখ্যা ৪৬ টি একটি পদ অঙ্কিত। ফলে সেই সাথে ছেচঁল্লিশটি পদ। আচার্য প্রবোধচন্দ্র বাগচী চর্যাপদের যে তিব্বতি অনুবাদ আবিষ্কার করেন তাতে পদের  সংখ্যা - ৫১টি। এতে মনে হয় চর্যাপদের সংখ্যা ৫১টি ছিল, কোন কারণে বিনষ্ট হয়ে যাওয়ায় সাড়ে ছেচঁল্লিশটি পাওয়া গিয়েছে। সংগ্রাহক আরো জানান যে এ গানগুলো পাওয়ার সময় পর্যন্ত নেপালে বজ্রাচার্যরা নৃত্যগীত সহযোগে সেগুলো নিবেদন করতেন। নাচ গানের সময় হাতের লেখা পুঁথি ব্যবহার করা হতো, ব্যবহার করতে গিয়ে নষ্ট হয়ে গেলে পুনরায় নকল করে নেয়া হতো। চর্যাপদের কবিতাগুলো পদ্যাকারে রচিত গান। তাই চর্যাপদের অপর নাম চর্যাগান বা চর্যাগীতি। যে সকল পদকর্তার গান চর্যাগীতি সংগ্রহের মধ্যে সংকলিত হয়েছে তারা সবাই সিদ্ধাচার্য। মোট ২৩জন সিদ্ধাচার্যের রচিত পদগুলোর মধ্যে কাহৃপাদ (কৃষ্ণাচার্য)-১৩, ভুসুকুপাদ-৮, সরহপাদ-৪, কুক্কুরীপাদ ও লুইপাদ, সবরপাদ, শান্তিপাদ প্রত্যেকে ২টি করে এবং অন্যান্য সিদ্ধাচার্যের প্রত্যেকের একটি করে গান চর্যাপদের মধ্যে সংকলিত হয়েছে।

চর্যাপদের রচনাকাল : চর্যাপদের কাল নির্ণয় প্রসঙ্গে বিভিন্ন পন্ডিত বিভিন্ন মতবাদ প্রকাশ করেছেন। ডঃ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ডঃ প্রবোদ চন্দ্র বাকচী, ড.সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ড সুকুমারসেন প্রমূখ পন্ডিতগণ নানাদিক থেকে বিচার করে চর্যাগীতির কাল নির্ণয়ের প্রয়াস পেয়েছেন. তাঁদের বিচারে যে সাক্ষ্য প্রমাণাদি পাওয়া গেছে তা কিছুটা পরস্পর বিরোধী, পরিমাণে অল্প সর্বত্র স্পষ্ট ও নিঃসন্ধিদগ্ধ নয়।
    ডঃ সুকুমারসেন বলেছেন, শ্রীযুক্ত সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় ও প্রবোদ চন্দ্র বাগচী মহাশয়ের মতে, সিদ্ধাচার্যের কাল মোটামুটি দশম হতে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে পড়ে। ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ দুই তিন বা ততোধিক শতাব্দী পিছিয়ে নিতে চান। নানা কারণে সুনীতি বাবুর মতই সমীচিন বলে মনে হয়। (বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস- ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ পৃ-৬৬)।

    ডঃ এনামুল হক বলেছেন খৃঃ নবম হতে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে বাংলা ভাষা স্থায়ী রুপলাভ করেছিল। এই চারশত বছরই বাংলা ভাষার সৃজ্যমানকাল। বাংলা ভাষার এই সৃজ্যমান অবস্থার সামান্য নমুনা আমাদের হস্তগত হয়েছে।

    ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছাড়া অন্যান্য সবাই মনে করেন যে, চর্যার কবিগণ মোটামুটি ভাবে নবম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে বর্তমান ছিলেন। ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ মনীনাথ বা মৎসেন্দ্র নাথকে আদি সিদ্ধাচার্য বলে মনে করেন। তাঁর মতে, মৎসেন্দ্র নাথ সপ্তম শতকের মধ্যভাগে বর্তমান ছিলেন। জালন্ধরী শিষ্য কৃষ্ণাচার্য বা কানুপার সময় ৬৭৫ খৃঃ থেকে ৭৭৫ খৃঃ বলে তিনি অনুমান করেন।
   
     যে কোন ভাষার জন্ম তারিখ ঠিক করে বলা যায় না। কারণ দিনক্ষণ ঠিক করে কোন ভাষার জন্ম হয় না। বর্ষার সৃষ্টি হয় ধীরে ধীরে। দেশ, কাল ও পত্রাগত বিবর্তন ধারায় ক্রমিক অনুসরণ করে। সুতরাং কোন ভাষার জন্ম বা সাহিত্যের রচনাকালের একটি সময়কালের ব্যাপ্তি লক্ষ্য করা যেতে পারে।

    ফরাসী পন্ডিত সিলভ্যাঁ লেভীও অনুমান করেন, সৎসেন্দ্র নাথের সময় ৬৫০ খৃঃ পূর্বে । এ সব দিক বিবেচনা করে ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ চর্যাপদের রচনাকাল সপ্তম শতাব্দী থেকে শুরু হয়েছে বলে সিদ্ধান্ত করেছেন।

    চর্যাকারদের মধ্যে লুইপা’র সময়কাল অনেকটা নিশ্চিত। লুইপা ও দীপংকর শ্রীজ্ঞান সন্মিলিত ভাবে একটি বৌদ্ধ তাব্রিজ গ্রন্থ প্রনয়ন করেছিলেন। জানা গেছে দীপংকর শ্রীজ্ঞান ১০৬৮ খৃঃ তিব্বতে গিয়েছিলেন। লুইপা অতীশ দীপংকর সমসাময়িক ছিলেন। সুতরাং তিনি একাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বর্তমান ছিলেন। 


উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে চর্যাপদের রচনাকাল সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী কালে অনুমান করা যায়।

চর্যাপদের ধর্মমত: বৌদ্ধ তান্ত্রিক সহজিয়া ধর্মের সাধন রীতির নিগুঢ় সংকেতই চর্যাপদের প্রধান লক্ষ্য। গ্রন্থ নামেও এ লক্ষ্য স্পষ্টত অনুভব করা যায়। নেপালে প্রাপ্ত পুঁথিটিতে গ্রন্থের নাম বর্ণিত হয়েছে; চর্যাচর্য বিনিশ্চয় বলে অর্থাৎ পুঁথির পদগুলোর সাহায্যে কোনটি চর্য’ (আচরনীয়) আর কোনটি অ-চর্য (অনাচরনীয়) তা বিনিশ্চয় নির্নয় করা যেতে পারে। তবে বর্তমান প্রসঙ্গে গুহ সাধন মার্গীয় এক বিশেষ সম্প্রদায়ের চর্য ও অ-চর্য বর্ণিত হয়েছে।

    
    বৌদ্ধ ধর্মের দার্শনিক ভাষায় হীনযান ও মহাযান নামে দুটো ভাগ রয়েছে। যান শব্দের সাহায্যে পদ্ধতি বা পথ কিংবা বাহন বুঝানো হয়েছে। মহাযানী সাধন পন্থার পরিনামী উদ্দেশ্য নির্বাণ লাভ অর্থে অনস্তিত্বে বিলুপ্ত হওয়া নয়। বরং বুদ্ধত্ব লাভ মহাযানী দর্শন প্রত্যেক সত্ত্বার মধ্যে বুদ্ধত্ব লাভের সুপ্ত সম্ভাবনাকে স্বীকার করেছে ; সে সম্ভাবিত শক্তি বিকাশের বিভিন্ন স্তরে মহাজ্ঞান লাভ করে তবেই পরিনামে বুদ্ধত্বে প্রতিষ্ঠিত হতে হয়। 


    হীনযানদের দৃষ্টিতে নির্বাণ একটি অনস্তিত্ব মূলক অবস্থা ; বিপরীত পক্ষে মহাযানী দর্শনে বুদ্ধত্বের পরিকাপময় অপেক্ষাকৃত ইতিবাচক। মহাযানীরা ধর্মচেতনায় সর্বদিক থেকেই রক্ষণশীল বলেই তাদের বিপক্ষদলের অনুসৃত নীতি পদ্ধতিকে হীনযান নামে অভিহিত করেছিলেন। অপরপক্ষে তাদের নিজেদের ভাবনায় ধর্মমতের উদারতা পরম সহিষ্ণুতা গ্রহণ ও সমন্তয়ের ব্যাপক প্রবনতা ইত্যাদি ছিল বলে মহাযান যথার্থই মহাযান। অন্যদিকে বজ্রযানীরা মনে করেন নির্বাণ এর সত্ত্বা মতই তিনটি অবস্থায় স্থিত হতে পারে ১। শূন্য ২। বিজ্ঞান ও ৩। মহাসুখ। সর্বশূন্যতার মহাস্থানই এদের মতে নির্বাণ; এই নির্বিকার মহাজ্ঞানকে তারা ভাব-স্বভাব বলে উপমা করেছেন। আর নাম দিয়েছেন “মিরাত্মা”। মিরাত্মা হলেন দেবী অর্থাৎ নারী। বোধিচিত্ত হলেন দেব অর্থাৎ পুরুষ। নর-নারী দৈহিক মিলনের মাধ্যেমে চিত্তের এক পরম আনন্দ ময় আস্বাদন লাভের সম্ভবনা ঘটে বিধায় বজ্রযানীদের বিশ্বাস শরীরের মধ্যে যে অশরীরী আনন্দের সে ঐকান্তিক উপলব্ধিময় অবস্থাকে তাঁরা বলেছেন বোধিচিত্ত। অনেকে মনে করেন- এই বজ্রযান থেকে সহজযান এর উৎপত্তি। 


প্রথমত: এর সাধ্যও ছিল সহজ, সাধনও ছিল সহজ। প্রত্যেক জীবের প্রত্যেক বস্তুরই একটি সহজ স্বরুপ আছে। তাই সমুদয় পরিবর্তনশীলতার ভিতরে অপরিবর্তিত স্বরুপ। এই সহজ স্বরুপকে উপলব্ধি করে মহাসুখে মগ্ন হতে হবে তাই হলো এ পন্থা সাধকগণের মূল আদর্শ। এজন্য তারা হলেন সহজিয়া। 

দ্বিতীয়ত: তারা সাধন ভোজনের জন্য কোন বক্রকথা অবলম্বন করতেন না, তারা গ্রহন করতেন সরল, সোজা পথ, এজন্য সহজিয়া।   

    চর্যায় ধর্মচেতনায় অনুভূতি প্রধান ছিল বলে চর্যাকারদের ধর্মদৃষ্টি যে অন্য বিমুখ ছিল তা নয় চর্যায় ধর্মমত্তের একদিকে যেমন হিন্দু ব্রাহ্মণ্য তান্ত্রিক দেহবাদের ধারা অনেক পায় মনে বিকশিত, আচারানুষ্ঠান প্রধান বেদ ধর্মের অসারতার কথাও তেমনি বারংবার উল্লিখিত হয়েছে।


    চর্যাপদাবলীর সামান্য অবস্থার থেকে বোঝা যায় যে, সর্ব নিরপেক্ষ সহজই ছিল সহজিয়াগণের সাধ্য সাধনা অর্থাৎ রুপের মধ্যে যে একটি অরুপ সত্ত্বা রয়েছে তার প্রমাণ। চর্যাপদের চেতনায় মূল ভিত্তিতে ব্যবহারিক নিষ্ঠা গৌণ, ধ্যান অনুভব সিদ্ধমম্ময় আনন্দ ও মহাসুখের আস্বাদনই মূখ্য। এতে যুক্তিতর্কের চেয়ে আবেগ ভক্তি সমধিক।


    ভক্তিতদগত আন্তরিক আবেগময় স্বভাবই চর্যাপদাবলীকে যুক্তি বিচার নির্ভর ধর্মত্ত্বের পর্যায় থেকে হৃদয়ানুভূতির নিবিড় কাব্য লোকের রম্যভূমিতে এনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ধর্মদর্শনের সঙ্গে কাব্য সাহিত্যের উদ্দেশ্য ও প্রকরণগত পার্থক্য অত্যন্ত সুস্পষ্ট। সাহিত্যের জন্ম মনুষ্য হৃদয়ের আনন্দানুভূতির একান্ত গভীর প্রদেশে এর প্রকাশের উৎস সহজ হৃদয়ে সংবাদ রচনার আকাঙ্খায় এর যে কোনটির অভাবে যর্থাথ সাহিত্যের সৃষ্টি হয় না। তথাপি প্রাচীনতম সাহিত্যে সাধনায় ধর্মীয় অনুশাসন ও উপনীষদীয় প্রাসংগিকতা লক্ষ্য করা যায়। বাংলার পরবর্তী ধর্মীয় চেতনাকে চর্যাপদের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে সমালোচক ডঃ সুকুমার সেন বলেছেন, চর্যাগীতি গুলো বৈষ্ণব পদাবলীর পূর্বরুপ। পদাবলীর মত এতেও রাগ, রাগিনীয় উল্লেখ আছে এবং কাব্যের ভনীতা আছে। ভাবের দিক দিয়ে বিচার করে বৈষ্ণব সহজিয়া সাধকদের রাগাত্নিক পদের সঙ্গে চর্যাপদের মিল খুজেঁ পাওযা যায়।


চর্যাপদে জীবনবোধ ও ধর্মচেতনা কবি চিত্তের একান্ত একান্ত মর্মমূল থেকে উৎসারিত তবে এর ভাষা প্রয়োগ কবিদের চেতনা প্রয়াসের ফলশ্রুতি। সুপরিচিত বাহিক্য, স্থল অর্থের আবরণে গুরু গম্ভীর ধর্মচেতনা গুহৃ সংকেত গুলোকে আবৃত করাই এ ভাষা প্রয়োগের একান্ত উদ্দেশ্য। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রাসাদ শাস্ত্রী তাই চর্যাপদের ভাষাকে সন্ধ্যা ভাষা নামে অভিহিত করেছেন, সন্ধ্যা- ভাষা আলো আঁধার ভাষা, কতক আলো, কতক অনুকার, খানিক বোঝা যায়, খানিক বোঝা যায়না। অর্থাৎ এসকল উচ্চ স্তরের ধর্মকথার ভিতরে একটা অন্য ভাবের কথা আছে। আচার্য বিধুশেখর শাস্ত্রী বলেছেন- বৌদ্ধ শাস্ত্র গ্রন্থাদিতে অনুরুপ ভাষারীতিতে আবার অনেক ক্ষেত্রে অভিপ্রায়িক ভাষা বলেও চিহিৃত করা হয়েছে। অনুরুপ ভাষা রীতির প্রয়োগের মধ্য দিয়ে এমন কোথাও বলা হয় যে, এর বাইরের একটি সাধারণ অর্থ আছে, আবার এর একটি আভ্যন্তরীন গূঢ় অর্থের ব্যঞ্জনাও রয়েছে। আচার্য বিধুশেখর শাস্ত্রী ও ডঃ শশীভূষন দাশগুপ্ত উভয়েই একমত যে পূর্ববর্তী বাংলা ভাষা অভিজাতিক পরবর্তীকালের সন্ধ্যা ভাষায় রুপ পরিবর্তন লাভ করেছিল।

চর্যাপদ বাংলা ভাষার প্রাচীন নির্দশনের যুক্তি :
বিভিন্ন পন্ডিত, গবেষক, অধ্যাপক ও ভাষাবিদগণ নানা দিক থেকে গবেষণা, পর্যালোচনা ও ভাষা তাত্ত্বিক আলোচনায় একথা প্রকাশ করতে চেয়েছেন যে, চর্যাপদের ভাষা প্রকৃত পক্ষে প্রাচীন বাংলা ভাষা তথা বাংলা ভাষার আদি নির্দশন। তাঁদের যুুক্তি হলো- যারা চর্যাপদ গুলো রচনা করেছেন, সে সকল সিদ্ধাচার্যগণ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় ভাষ্য গ্রহণ করেছেন। অতএব প্রত্যেকের ভাষাতেই অল্প বিস্তর নব্য ভারতীয় আর্য ভাষার আর্দশ হিসেবে মনে করা যেতে পারে। সে হিসেবে সিদ্ধাচার্যগণের প্রত্যেকের ভাষায় ঐক্য ও রয়েছে, নব্য ভারতীয় ভাষা হলো- প্রাচীন ভারতীয় আর্যরা গৌর অপভ্রংশের গৌষ্ঠী হতে উৎপন্ন ভাষা। নব্যভারতীয় আর্য ভাষায় রয়েছে, মাগধী বা বিভারী, উড়িয়া এবং বঙ্গ কামরুপী। বঙ্গ কামরুপীর দুটি রুপ বাংলা ও আসামী। এ সকল ভাষায় রয়েছে আদিম প্রাকৃত। এ কারণে অন্য ভাষা গোষ্ঠী হতে উৎপন্ন নব্য ভারতীয় আর্যভাষা যেমন হিন্দি ইত্যাদি ভাষার সঙ্গে ও চর্যাপদের ভাষার খানিকটা সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। 

ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন- বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে বিচার করতে গেলে বৌদ্ধ গানের ভাষা হিসেবে এক সামগ্রিক রুপে চিহ্নিত করা যুক্তি যুক্ত নয়। কেননা, চর্যাকারগণ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে আর্বিভূত হয়েছিলেন। সুতরাং সকলের ভাষা ঐক্য সূত্রে গ্রথিত নয়। তিনি বলেছেন বৌদ্ধ গান মোট ২২জন কবির রচনা, তন্মধ্য কাহ্নপাদের রচনা ১২টি, ভুসুকুপাদের ৮টি, সরহপদের ৪টি, লূইপদ, বুক্কুরীপাদ, শান্তিপাদ ও শবরপাদের রচনা প্রত্যেকের দুটি করে। অবশিষ্ঠ গুলোর প্রত্যেকের এক একটি। (বাংলা সাহিত্যের কথা- ডমুহম্মুদ শহীদুল্লাহ পৃঃ৮৫-৮৮)। তাদের মধ্যে শান্তিপাদের ভাষা মৈথিলী এবং শহ্নপাদ সরহপাদ ও ভুসুকুপাদের ভাষা প্রাচীন বাংলা। ডঃসুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় চার্যার ভাষাকে পশ্চিম বঙ্গের আদর্শরুপ হিসেবে মনে করেছেন। তবে ডঃ মুহম্মুদ শহীদুল্লাহ মনে করেন যে, চর্যাপদের ভাষার সঙ্গে বাংলাদেশের প্রাচীন ভাষার সাদৃশ্যই বিশেষ ভাবে প্রকট । এ প্রসঙ্গে তিনি ভাষাতাত্ত্বিক আলোচন করে তার সিদ্ধান্তের উপর যুক্তি দেখিয়েছে। তাঁর উদাহরণ সমূহের একটি হচ্ছে, কুক্কুরী পাদের। একটি পদের ধরন নিজেরাই বাংলাদেশে ধরন যায় না । কিন্তু পশ্চিম বঙ্গেঁ ধরা যায় না। ডঃ মুহম্মুদ এনামুল হক বলেছেন, প্রত্যেক ভাষার একটা সৃজ্যমান কাল থাকে, তাহা শতাব্দীর একটা অতি দীর্ঘ সময়। খৃষ্টীয় নবম হতে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে বাংলা ভাষা স্থায়িরুপ লাভ করেছিল। এই চারশত বছরই বাংলা ভাষার সৃজ্যমান কাল। এই সমযের । একেবারেই গোড়ার দিকে বঙ্গঁ দেশে সংস্কৃত ছাড়া আরো দুটি ভাষা প্রচলিত ছিল- তাঁর একটি সৌরসেনী বা সৌসেনী অপভ্রংশ আর একটি মাগধি প্রাকৃত বা মাগধি অপভ্রংশ । এই মাগধী অপভ্রংশোরই পরিবর্তিত রুপ বাংলা ভাষা । বাংলা ভাষার সৃজ্যমান অবস্থায় সামান্য নমুনা আমদের হস্ত গত হয়েছে। এই নমুনাটুকুর নাম চর্যাচর্য বিনিশ্চয়। ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ দ্বারা নিঃসন্দেহ ভাবে প্রমানিত হয়েছে যে, চর্যাপদগুলির ভাষা সৃজ্যমান কালের বাংলা ভাষা। এদের ব্যাকরণরীতি ও বীতি ও বাবভঙ্গী সুস্পষ্ট ভাবে বর্তমান। (মুহম্মদ এনামুল হক মুসলিম বাংলা সাহিত্য পৃঃ৮)।

প্রফেসর অতীন্দ্র মজুমদার বলেছেন, বাংলা গীতি কাব্যের আদি লক্ষণ যদি কোথাও স্পষ্ট ভাবে ফুটে থাকে তবে তা চর্যাপদে। তাই বাংলা কাব্যের উষালগ্নে উজল জ্যোতিষ্কের মতো কিরন দিচ্ছে চর্যাপদ এবং সেই আলোকেই উদ্ভাসিত পরবর্তী বাংলা গীতিকাব্য গুলি। এই গীতি কাব্যর ধারা বাংলা সাহিত্য ও আজও অম্লান । (প্রফেসর অতীন্দ্র মজুমদার চর্যাপদ পৃঃ১৮}

প্রখ্যাত গবেষক আব্দুল আজীজ আল আমান বলেছেন, প্রাচীন ভাষায় চর্যাপদ প্রাচীন বাংলা ভাষার প্রাচীনতম সৃষ্টি। বাংলা ভাষা যখন অভিজাত রুপ পরিগ্রহ করে সাহিত্য ভাষায় উন্নতি হয়- সেই অভিজাত গর্ত্রী ভাষাদিয়েই রচিত হয় চর্যাপদ। সুতরাং চর্যাপদ হলো বাংলা ভাষার সাহিত্যিক রুপের প্রাচীনতম নিদর্শন । (পদক্ষেপ-আব্দুল আজিজ আল আমান পৃঃ১৫}


উপরোক্ত স্তরের ভাষা হলো প্রাচীন বাংলা, পালি এবং প্রাকৃতের অনুরূপ মাধ্যমে সাহিত্যিক ভাষায় রুপ পরিগ্রহ করে। চর্যাপদই এর প্রচীনতম নিদর্শন।


বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ । মনে হয় চর্যাকারগণ এর সঙ্গেই বাংলার প্রাণের ঘনিষ্ট সংযোগ থাকায় প্রায় অর্ধেকের বেশি চর্যাপদে নদী ও নৌকা চালনার কথা বর্নিত হয়েছে। এসব বিষয় চর্যা পদ গুলোর জম্ম স্থানের সাক্ষ্য বহন করে। এ সকল বিষয়ে আলোকে বলা যেতে পারে যে চর্যাপদ বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন।

----------------------------------------

3 comments

Ram Sankar said...

আপনার লেখা পড়াই যাচ্ছে না, এতই বানান ভুল। ণ-ত্ব, দীর্ঘ ঈ কারের কোন বালাই নেই। এছাড়া কিছু শব্দের অর্থ তো বোঝাই যাচ্ছে না। আপনি চাইলে সমস্ত ঠিক করে দিতে পারি।
যতদূর জানি লুইপা ‘অভিসময়বিভঙ্গ’ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন এবং দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান এর টীকা লিখেছিলেন।
একটি পদের ধরণ নজাই বাংলাদেশে ধরণ যায়না কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে ধরা যায়না। - এর অর্থ কি?

Ram Sankar said...

আমার মেইল আই ডি তো আপনি দেখতেই পেয়েছেন। যদি প্রয়োজন বোধ করেন তবে যোগাযোগ করতে পারেন।

Hill Chadigang said...

আপনার মন্তব্যে জন্য অসংখ্য কৃতজ্ঞা ও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। যতটুকু পারি সংশোধনের চেষ্ঠা করেছি। তবুও যদি ভূল পরিলক্ষিত হয় নিজ গুণে ক্ষমা করবেন।

Theme images by 5ugarless. Powered by Blogger.