শ্রদ্ধাসুমনার কাহিনী
(পূর্ব প্রকাশের পর)
অনুবাদক প্রকাশ দেওয়ান।
অনুবাদক প্রকাশ দেওয়ান।
যে দিনটি সেনাপতির জন্য নির্দিষ্ট (বরাদ্দ) ছিল, তিনি এক ডিক্রী (আইন) জারী করে তাঁর মহাদানটি তত্ত্বাবধান করে বললেন, “সাবধানতা অবশ্যই নিতে হবে যাতে কোন ব্যক্তি এক চা চামচ পরিমাণ ভাতও দেয়ার সুযোগ না পায়।” এমন সময় তিনি তাঁর চারিপার্শ্বস্থ এলাকায় নজরদারী রাখতে প্রহরী নিয়োগ করলেন। ঐ দিনটিতেই ‘বন্ধুমতি’-র এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর বিধবা পতœী অত্যন্ত অসহায় হয়ে ক্রন্দন করছিলেন। কারন তিনি প্রথম দিনে তাঁর দানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন। তিনি তাঁরই কন্যাকে কাতরস্বরে অভিযোগ করে বললেন, যে কিনা তাঁরই সহচরী বান্ধবীদের সাথে খেলা শেষে সবেমাত্র গৃহে ফিরে এসেছে ঃ “হে আমার প্রাণপ্রিয় নন্দিনী, যদি তোমার পিতা জীবিত থাকতেন, আজকে আমিই প্রথম বুদ্ধকে পিণ্ডদানে সুযোগ লাভ করতাম।” মেয়েটি এ ব্যাপারে কোন প্রকারের ভনিতা না দেখিতে প্রত্যুত্তরে বললেন ঃ “ওহ আমার ¯েœহময়ী মাতা, দয়া করে এ ব্যাপারে চিন্তা করো না! আমি কিছু একটা করবো যাতে বুদ্ধ সশিষ্যে আমাদের প্রথম পিণ্ড গ্রহণ ও ভোজন করতে পারেন।”
এরপর মেয়েটি জলহীন দুগ্ধ মিশ্রিত সুস্বাদু খাদ্য-বস্তু দামী স্বর্ণ পাত্রে পরিপূর্ণ করলেন। তিনি খাদ্য-বস্তুকে সুস্বাদু করতে আরও যোগ করলেন দধি, মিষ্টি ইত্যাদি। তিনি এটিকে অন্য একটা স্বর্ণ পাত্রে আবৃত করলেন Ñ ঝাকুনী দিয়ে উপর-নীচ পর্যবেক্ষণ করলেন এবং পুস্পমাল্য দিয়ে উভয় স্বর্ণ পাত্রকে দৃঢ়ভাবে বেধে দিলেন যাতে এটিকে একটা পুস্প বলের (গোলক) মত দেখায়। যখন বুদ্ধ নগরে প্রবেশ করলেন, তখন মেয়েটি তাঁর সহচরীদের সাথে নিয়ে পুস্প গোলকটি মস্তকের উপর রেখে বাড়ীর আঙ্গিনা ছেড়ে চলে গেলেন। পথিমধ্যে মেয়েটি এবং তোরণ রক্ষকের মধ্যে যে সংলাপটি সংগঠিত হয়েছিল তা নিুরূপ ঃ
রক্ষক ঃ হে মেয়ে, এদিকে এসো না!
মেয়ে ঃ প্রিয় চাচা, আপনি আমাকে যেতে নিষেধ করছেন কেন?
রক্ষক ঃ সেনাপতির আদেশে আমরা এখানে পাহাড়াদার নিযুক্ত হয়েছি যাতে কেহই পিণ্ডদানে যেতে না পারে।
মেয়ে ঃ কিন্তু চাচা, আপনি কি আমাদের হস্তে কোন ধরণের খাদ্য-বস্তু দেখতে পান, যা আমাকে ভিতরে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারেন?
রক্ষক ঃ আমরা শুধুমাত্র পুস্প গোলক দেখতে পায়।
মেয়ে ঃ আচ্ছা, আপনার সেনাপতি কি পুস্প গোলক দান করাটাওনিষেধ করেছেন?
রক্ষক ঃ যেহেতু পুস্প গোলক দান, এটি বিধি-নিষেধের আওতায় পড়ে না।
অতঃপর মেয়েটি রক্ষককে বললেন, “তাহলে এখন চলে যান। আমাদের বাধা দিবেন না।” এভাবে বলে মেয়েটি বুদ্ধের কাছে চলে গেলেন এবং তাঁর পুস্প গোলকটি বুদ্ধকে দান করলেন এবং বললেন ঃ মহান করুণাময় হে বুদ্ধ, অনুকম্পাপূর্বক আমার পুস্প গোলকটি গ্রহণ করুন।” বুদ্ধ এক পলক রক্ষকের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকে ইশারা দিয়ে পুস্প গোলকটি আনতে বললেন। মেয়েটি বুদ্ধকে নতশীরে বন্দনা করে বললেন ঃ
“মহান হে বুদ্ধ, সংসারের সমস্ত জীবনব্যাপী আমি যেন অভাব ও চিন্তামুক্ত হয়ে অবস্থান করি। এ পুস্প গোলকের ন্যায় আমি যেন সকলের নিকট ভালবাসার পাত্র হয়ে থাকতে পারি এবং ভবিষ্যৎ জন্ম-জন্মান্তরে ‘সুমনা’ নাম ধারণ করি।”
যেহেতু বুদ্ধ প্রত্যুত্তরে বললেন, “তুমি সুখী হও, তোমার আশা পূর্ণ হোক।” মেয়েটি আনন্দিত হয়ে বুদ্ধকে নতশীরে বন্দনা করে স্থান ত্যাগ করলেন।
এরইমধ্যে বুদ্ধ সেনাপতির গৃহাভিমূখী হলেন এবং নির্দিষ্ট আসনে বসে পড়লেন। সেনাপতি বুদ্ধকে পিণ্ডদান দিলেন। বুদ্ধ সহস্তে তাঁর পাত্রটি আবৃত করলেন। সেনাপতি চিন্তা করলেন যে বুদ্ধ এটি গ্রহণ করেননি কারন এখনও সব ভিক্ষু এসে পৌছাননি। যখন সবাই এসেছেন, সেনাপতিকে বলা হয়েছিল যে সবাই উপস্থিত হয়ে নির্দিষ্ট আসনে বসে আছেন। বুদ্ধ বললেন ঃ “আমরা ইতিমধ্যেই একটা পিণ্ড গোলক গ্রহণ করেছি যেটি আমরা পথিমধ্যে পেয়েছি। যখন পুস্পে আবৃত গোলক থেকে পুস্প সরিয়ে নেয়া হচ্ছিল, তখন দুগ্ধ মিশ্রিত সুস্বাদু খাদ্য-বস্তু দেখতে পাওয়া গেল। এরইমধ্যে সেনাপতির তরুণ কর্মচারী যে পুস্প গোলকটি নিয়ে এসেছেন, তিনি বললেন ঃ “হে সেনাপতি, আমি এক সম্ভ্রান্ত নারী কর্তৃক প্রতারিত হয়েছি যিনি আমাকে বলেছেন যে এটি একটি ঠিক পুস্প গোলক।” দুগ্ধ মিশ্রিত সুস্বাদু খাদ্য-বস্তু বুদ্ধ থেকে শুরু করে সকল ভিক্ষুর জন্য পর্যাপ্ত ছিল। পরিশেষে বুদ্ধ একটি দেশনা দিয়ে বিহারে ফিরে গেলেন।
যখন বুদ্ধ স্থান ত্যাগ করলেন, তখন সেনাপতি তাঁর কর্মচারীর কাছ থেকে মেয়েটি সম্পর্কে জেনে নিলেন এবং তাঁকে বলা হল যে মেয়েটি এক সম্ভ্রান্ত বণিকের কন্যা। কি বিজ্ঞ নারী সে! যদি এমন বিজ্ঞ মেয়ে গৃহাস্থলীর কাজ-কর্ম দেখাশুনা করেন, সুখানুভুতি লাভে কোন গৃহপতির এত কঠিন বিষয় নয়। মেয়েটির প্রতি প্রশংসাসূচক কথা বলে ইতিমধ্যে সেনাপতি মেয়েটিকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করতে সক্ষম হলেন এবং গৃহে গৃহকত্রী হিসেবে স্থান দিলেন। তাঁকে উভয় বাড়ীর সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেয়া হল অর্থাৎ তাঁর পিতার এবং সেনাপতির। তিনি জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত বুদ্ধকে দান দিলেন এবং যখন তিনি ইহলোক ত্যাগ করলেন, তখন দেবলোকে উৎপন্ন হলেন। ঐ সময়ে দেবলোকে হাটু অবধি পুষ্প বৃষ্টি হয়েছিল। এমনকি তিনি সেখানেও তাঁর নাম নিয়ে গিয়েছেন এবং তাই সেখানে সকলে তাঁকে “সুমনা দেবী” নাম দিয়েছেন।
সুমনা দেবীর একানব্বই কল্প পর্যন্ত চারি অপায় পথ রুদ্ধ হয়েছিল। জন্ম-জন্মান্তরে মনুষ্য ও দেবলোকে উৎপন্ন হয়ে যেখানে পুনঃজন্ম লাভ করুক না কেন সেখানে অনবরত পুস্প বৃষ্টি হতো এবং তিনি সুমনা দেবী বা সুমনা কুমারী নামে পরিচিতি লাভ করতেন। বর্তমান বুদ্ধ অর্থাৎ গৌতম বুদ্ধের শাসনে জন্ম-ধারণ করে তিনি কোশল রাজার প্রধান রানী হয়েছিলেন এবং যুগপথরূপে তিনি যেদিন জন্ম-ধারণ করেছেন, সেদিনই তাঁর পূর্ব জন্মের পঞ্চশত সহচরীবৃন্দও কোশল রাজার বিভিন্ন মন্ত্রীর গৃহস্থে জন্ম-ধারণ করেছেন। ঐ সময়েও হাটু অবধি ব্যাপকভাবে পুস্প বৃষ্টি হয়েছিল।
এমন অবস্থা দর্শনে রাজা চিন্তা করলেন, “আমার মেয়ে তাঁর অতীত জন্মে অবশ্যই এক অপূর্ব পুণ্য পারমী সম্পন্ন করেছে” এবং তিনি খুবই আনন্দিত হলেন। “আমার মেয়ে নিজেই তাঁর নাম এনেছে” এবং তিনি তাঁর মেয়েকে ‘সুমনা’ নাম ধারণ করতে অনুমতি দিলেন। তিনি মনে মনে কল্পনা করলেন, “আমার মেয়ে অবশ্যই একাকী জন্ম-ধারণ করেননি।” রাজা তাঁর কন্যার জন্ম সহচরীদের নগরের চারিদিকে খুঁজতে লাগলেন এবং শুনলেন যে পঞ্চশত মেয়ে শিশু একই সময়ে জন্ম-ধারণ করেছেন। রাজা এ পঞ্চশত মেয়ে শিশুদের খাদ্য ও সেবাসহ লালন-পালনের যাবতীয় দায়-দায়িত্ব নিজ কাধে বহন করলেন। তিনি এমন আদেশও জারী করলেন যে প্রতি এক মাস অন্তর ঐ পঞ্চশত মেয়ে শিশুদের অবশ্যই তাঁর রাজকন্যার কাছে আনতে হবে।
যখন রাজ কুমারী সুমনা সাত বছরের বয়স, তখন ধনাঢ্য ব্যক্তি অনাথপিণ্ডিক জেতবন বিহারের নির্মাণ শেষে বুদ্ধকে সশিষ্যে শ্রাবস্তীতে নিয়ে এলেন। অনাথপিণ্ডিক কোশল রাজার কাছে চলে গেলেন এবং বললেন ঃ “মহান হে রাজ, বুদ্ধ গৌতম অনুত্তর পুণ্যক্ষেত্র ভিক্ষু সংঘসহ আমাদের নগরী
শ্রাবস্তীতে চলে আসার অর্থ হচ্ছে আপনার ও আমার জন্য গৌরবের বিষয়। অতএব আপনি অনুগ্রহপূর্বক রাজ কুমারী সুমনা এবং তাঁর পঞ্চশত সহচরীকে জলপূর্ণ পাত্র, পুস্প ও সুগন্ধী নিয়ে সেখানে পাঠান বুদ্ধকে সশিষ্যে অভ্যর্থনা জানাতে। রাজা প্রত্যুত্তরে বললেন, “এটি খুবই ভাল উদ্যোগ,” এবং ধনাঢ্য ব্যক্তি অনাথপিণ্ডিক যেভাবে বলেছেন কোশল রাজাও ঠিক সেভাবে কাজ করলেন। রাজার আদেশ পেয়ে সুমনা তাঁর পঞ্চশত সহচরীকে নিয়ে বুদ্ধের সমীপে উপস্থিত হলেন এবং পুষ্প, সুগন্ধী ইত্যাদি জাতীয় দ্রব্য নিয়ে বুদ্ধকে নতশীরে বন্দনা করলেন এবং উপযুক্ত স্থানে বসে পড়লেন। যখন বুদ্ধ সুমনাসহ তাঁর পঞ্চশত সহচরীকে ধর্ম দেশনা প্রদান করেন, তখন তাঁরা সবাই একত্রে ¯্রােতাপত্তি-ফলে প্রতিষ্ঠিত হলেন। এভাবে আরও পঞ্চশত মেয়ে, পঞ্চশত নারী এবং পঞ্চশত উপাসক বুদ্ধের ধর্ম সভায় ধর্ম দেশনা শ্রবণ করে তাঁরাও একত্রে সবাই ¯্রােতাপত্তি-ফলে প্রতিষ্ঠিত হলেন। এভাবে ঐদিনই বুদ্ধের শ্রাবস্তীতে জেতবন বিহারে আগমনের সময়, সেখানে পৌঁছার পূর্ব মুহূর্তে পথিমধ্যে দু’হাজার ব্যক্তি ¯্রােতাপত্তি আর্যে পরিণত হয়েছেন।
যখন রাজ কুমারী সুমনার বয়স পরিপক্ক হয়েছে, তখন কোশল রাজ তাঁকে পঞ্চশত রাজকীয় রথ প্রদান করলেন যেগুলি অপরূপ সাজে-সজ্জিত যাতে তিনি বা তাঁর সহচরীরাও যে কোন স্থানে ভ্রমণে ব্যবহার করতে পারেন। ঐ সময়ে তিনজন নারী তাঁদের পিতার নিকট থেকে এসব রথ পেয়েছেন যেগুলি অপরূপ সাজে-সজ্জিত। তাঁরা হলেন ঃ
(১). রাজকমারী চুন্দি, রাজা বিম্বিসারের কন্যা,
(২). বিশাখা, ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ধনঞ্জয়ের কন্যা এবং
(৩). রাজ কুমারী সুমনা, কোশল রাজার কন্যা।
এটাই শ্রদ্ধাসুমনার কাহিনী।
যেভাবে উক্ত হয়েছে, রাজার নিকট থেকে অনুমতি পাওয়ার পর সেনাপতি বুদ্ধের কাছে এক বিরাট আকারের দান সম্পাদন করলেন, এরপর প্রজারা সবাই একত্রিত হয়ে রাজার চেয়েও অধিক পরিমাণে বুদ্ধকে সশিষ্যে এক মহাদান সম্পাদন করলেন। যখন সমগ্র নগরে এসব মহাদান সম্পাদন শেষ হয়েছে, তখন নগরের অদূরবর্তী গ্রামবাসীরা বুদ্ধকে সশিষ্যে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করবেন, কারণ এখন তাঁদের পালা।
অতঃপর গৃহপতি মহাকল তাঁরই কনিষ্ঠ ভ্রাতা চুলকলের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় বসলেন এবং বললেন ঃ “আগামীকাল আমাদের দান দেয়ার পালা। আমরা কি ধরণের দান দিতে পারি?” চুলকল প্রত্যুত্তরে বললেন, “ভাই, কি ধরণের দান দিলে ভাল হয়, তা আপনিই চিন্তা করুন।” তারপর মহাকল বললেন ঃ “প্রিয় ভাই, যদি তুমি আমার পরিকল্পনায় চল, তাহলে আমাদের জমির ষোল আনা শালী ধানই পরিপক্ক হয়েছে এবং আমরা কি এগুলির যথাযথ ব্যবহার করে বুদ্ধকে দান করতে পারি।” চুলকল তাঁর মতামত ব্যক্ত করলেন এবং বললেন ঃ “ভাই, আমরা যদি তাই করি, কেহই লাভবান হবো না। অতএব আমি এতে রাজি নই।”
তারপর মহাকল বললেন ঃ “যদি তুমি এতে সম্মত না হও, আমি আমার অংশের পুরোটা চাই।” এভাবে ষোল আনা জমি বিভক্ত হয়ে গেল এবং এতে প্রতি জনের ভাগে পড়েছে অর্ধেক অর্থাৎ আট আনা এবং দু’অংশের মাঝামাঝি ঘেরা দেয়া হয়েছে। তারপর মহাকল তাঁরই অংশের শালী ধান হতে বুদ্ধকে সশিষ্যে অগ্রদান দিলেন। এরইমধ্যে একটি অদ্ভুদ ঘটনা পরিলক্ষিত হল ঃ যেখান থেকে ধানের শীষ কাটা হয়, সেগুলি পূর্ববট বজায় থাকে যা দানেরই ফল। এভাবে তিনি নয়বার অগ্রদান দিয়েছেন এবং দানের ফলে তাঁর ধানের পরিমাণ কখনও কমে যায়নি, কিন্তু বাস্তবে এগুলির পরিমাণ দুই, তিন বা এর চেয়েও বেশী হয়েছে। বাস্তবিকপক্ষে, এগুলি অতীত জন্মের আশীর্বাদ হেতু ‘কোণ্ডাণ্য থের’-র কুশল কর্ম।
চলবে
No comments
Post a Comment