শ্রদ্ধাসুমনার কাহিনী
(পূর্ব প্রকাশের পর)
অনুবাদক প্রকাশ দেওয়ান।
(খ) শেষ জন্মে প্রব্রজ্যা জীবন গ্রহণ
পুণ্যবান গৃহপতি মহাকল অর্থাৎ ভবিষ্যৎ কোণ্ডাণ্য থের সারা জীবন ব্যাপী এ রকম কুশল কর্ম সম্পাদন করলেন। এভাবে তিনি মনুষ্যলোক থেকে চ্যুত হয়ে দেবলোকে এবং দেবলোক থেকে মনুষ্যলোকে জন্ম-জন্মান্তরে সংসারে পরিভ্রমণ করেন। যখন আমাদের গৌতম বুদ্ধ প্রায় আবির্ভাব হওয়ার সময়, তিনি অর্থাৎ ভবিষ্যৎ কোণ্ডাণ্য কপিলাবস্তুর অদূরে
‘ডোনাবত্তু’-র এক ব্রাহ্মণ পল্লীতে ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। নামকরণের সময় তরুণ ব্রাহ্মণের নাম রেখে দেয়া হল ‘কোণ্ডাণ্য’। তাঁর বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে ত্রিবেদ শাস্ত্রে পারদর্শীতা অর্জন করলেন এবং মহান ব্যক্তিদের মুখ, হাবভাব ইত্যাদি দেখে চরিত্র নির্ণয় করতে পারেন এমন বিদ্যায় সক্ষমতা অর্জন করলেন।
ঐ সময়ে আমাদের ভবিষ্যৎ বুদ্ধ গৌতম তুষিত স্বর্গলোক থেকে চ্যুত হয়ে কপিলাবস্তু নগরী রাজা শুদ্ধোধনের প্রধান রানী মহামায়ার নিকট জন্মগ্রহণ করেন। নতুন শিশুটির নামকরণের দিনে রাজা শুদ্ধোধন একশত আট ব্রাহ্মণ পুরোহিত রাজপ্রাসাদে আমন্ত্রণ জানালেন এবং তাঁদেরকে নতুন পোষাক-পরিচ্ছদসহ সুস্বাদু খাবার ও মিষ্টি পরিবেশন করা হল। এসব ব্রাহ্মণের মধ্য থেকে শুধুমাত্র আটজন ব্রাহ্মণ যাঁরা পাণ্ডিত্যের অধিকারী এমন ব্রাহ্মণকে নির্বাচন করা হল এবং তাঁরা ক্রমানুযায়ী আসন গ্রহণ করলেন। তারপর রাজা শুদ্ধোধন তাঁর শিশুপুত্র রাজ কুমার বৌধিসত্বকে শ্বেত বস্ত্র লিনেন কাপড় পরিধান করিয়ে ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের কাছে নিয়ে এলেন যাঁরা শিশুটির দেহের চিহ্ন পরীক্ষা করবেন। আটজনের মধ্যে যে ব্রাহ্মণ প্রথম সারীতে বসে আছেন, তিনি দু’অঙ্গুলী প্রদর্শনপূর্বক ভবিষ্যৎবাণী করলেন ঃ “যদি এ শিশুপুত্র সংসারে আবদ্ধ থাকেন, তবে তিনি রাজ চক্রবর্তী হবেন আর যদি তিনি সন্যাসব্রত পালন করেন, তবে তিনি অবশ্যই ত্রিলোক পুজ্য সম্যক সম্বুদ্ধ হবেন।” এভাবে দ্বিতীয়, তৃতীয় হতে সপ্তম ব্রাহ্মণ পুরোহিত একইভাবে দু’অঙ্গুলী প্রদর্শন করে ভবিষ্যৎবাণী করলেন। এ আট ব্রাহ্মণের মধ্যে কোণ্ডাণ্যই সবচেয়ে কনিষ্ঠ। এবার যখন তাঁর পালা, তিনি অত্যন্ত সাবধান হয়ে বিচক্ষণতার সহিত দেহের চিহ্নগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখলেন। তিনি মনে মনে কল্পনা করলেন যিনি রাজ চক্রবর্তী হবেন তাঁর তা হওয়ার মত পায়ের পাতার চিহ্নটি নেই, আর তাই তিনি শুধুমাত্র এ অঙ্গুলী প্রদর্শন করে অনেকটা সাহসিকতার সহিত ভবিষ্যৎবাণী করলেন ঃ “এ শিশুপুত্র সংসারে আবদ্ধ হওয়ার কোন লক্ষণ নেই, রাজ কুমার বাস্তবেই একজন সংসার ত্যাগী বুদ্ধ হবেন।”
এরপর ব্রাহ্মণ পুরোহিতদ্বয় তাঁদের নিজ নিজ গৃহে ফিরে গেলেন এবং তাঁদের পুত্রদের এ রকম বলেই নির্দেশনা দিলেন ঃ “হে প্রাণপ্রিয় পুত্রগণ, আমরা বয়োঃপ্রাপ্ত হয়েছি। আমরা রাজা শুদ্ধোধনের পুত্র রাজ কুমার সিদ্ধার্থের সময়ের সাথে সাথে বেচে থাকতেও পারি আবার নাও থাকতে পারি, যিনি ত্রিলোক পুজ্য সম্যক সম্বুদ্ধ হবেন। যখন দেখবে বয়োঃপ্রাপ্তিতে রাজ কুমার সিদ্ধার্থ গৃহ ত্যাগী সন্যাসী হয়ে সন্যাসব্রত পালন করছেন, তখন তোমরাও ভিক্ষু হয়ে তাঁর সাথে যোগ দিবে।”
রাজা শুদ্ধোধন তাঁর শিশুপুত্র রাজ কুমারকে শুরু থেকেই রাজ কর্মচারী নিয়োগ করে রক্ষাকারী বলয় সৃষ্টি করে অত্যন্ত আরাম-আয়েশের মধ্য দিয়ে লালন-পালন করতে থাকেন। যখন তাঁর বয়স ষোল বছর, তখন যশোধরার সাথে তাঁর বিয়ে হয়। উনত্রিশ বছর বয়সে তিনি অনেক পরিপক্ক হন এবং তিনি দেখলেন Ñ ‘ভোগে দুঃখের পরিণতি এবং ত্যাগেই মহিমা।’ যেদিন রাহুলের জন্ম হয়, সেদিনই রাত্রির মধ্যভাগে অশ্বরাজ কন্থক এবং তাঁর প্রিয় সারথী ছন্দককে নিয়ে বের হয়ে গেলেন Ñ নগর তোরণের বাইরে যেটি দেবগণ কর্তৃক খোলা হয়েছে। ঐ এক রাত্রিতেই তিনি কপিলাবস্তু, কোলীয় ও দেবদহ নগর অতিক্রম করলেন এবং অনোমা নদীর তীরে তিনি পাত্র-চীবর গ্রহণ করলেন যেগুলি ‘ঘটিকার ব্রহ্মা’ কর্তৃক দান করা হয়েছে। এরপর তিনি আশি বছর বয়সী ষাট বর্ষার একজন মহাস্থবিরের ন্যায় অত্যন্ত মোহনীয়রূপে রাজগৃহে এসে পৌঁছলেন। তিনি পিণ্ডচরণ করতে থাকেন এবং এক সময় পিণ্ডচরণ থেকে ফিরে পান্ধব পর্বতের এক ছায়ায় তাঁর ভোজন সম্পন্ন করলেন। যদিও রাজা বিম্বিসার তাঁকে তাঁর রাজ প্রাসাদে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন এবং তাঁর রাজ্যের অংশও দিবেন বলে প্রতিশ্র“তিবদ্ধ হয়েছেন, কিন্তু সিদ্ধার্থ তা প্রত্যাখ্যান করলেন। এরপর আলাড় কালাম ও রামপুত্র রুদ্রকের সাক্ষাৎ শেষে এভাবে পর্যটন করতে করতে এক সময় উরুবেলায় এসে উপণীত হলেন। এর মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দর্শন করে তিনি ভাবলেন ঃ “এ স্থানটি আধ্যাত্মিক সাধনার জন্য সর্বোত্তম।” এরূপ চিন্তা করে একটা মনোরম স্থান নির্বাচন করে তিনি ধ্যান-সাধনা শুরু করে দিলেন চরম কৃচ্ছসাধনের সংকল্প নিয়ে।
সিদ্ধার্থের (ভবিষ্যৎ বুদ্ধ) মহাভিনিস্ক্রমণের সময়, সকল ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের মধ্যে সর্ব কনিষ্ঠ কোণ্ডাণ্য গোত্রীয় সুদত্ত ব্রাহ্মণ ব্যতীত সকলেই স্বীয় কর্মানুসারে পরলোক গমন করেছেন। একমাত্র সর্ব কনিষ্ঠ কোণ্ডাণ্যই শারীরিকভাবে উপযুক্ত আছেন। সিদ্ধার্থ (বৌধিসত্ব) প্রব্রজ্যা গ্রহণপূর্বক বুদ্ধত্ব লাভের জন্য সাধনা করছেন এরূপ জ্ঞাত হয়ে তিনি পরলোকগত ঐ ব্রাহ্মণ পুরোহিত পুত্রদের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং বললেন ঃ “এ রকম উক্ত হয় যে, রাজ কুমার সিদ্ধার্থ সন্যাসব্রত পালন করছেন। নিঃসন্দেহে তিনি সম্যক সম্বুদ্ধত্ব প্রাপ্ত হবেন। যদি তোমাদের পিতারা জীবিত থাকতেন, তবে তাঁরা আজকে আগে-ভাগেই সন্যাসব্রত পালন করতে চলে যেতেন। অতএব চলে এস, যদি চাও। চলো, এ রকম মহান ব্যক্তির সান্নিধ্যে অবস্থান করে প্রব্রজিত ভিক্ষু হয়ে যায়।” কিন্তু সাত জনের সবাই এ ব্যাপারে একমত হতে পারলো না, অধিকন্তু তিনজন ব্যাপারটি প্রত্যাখ্যান করলো আর মাত্র অবশিষ্ট চারজন কোণ্ডাণ্যের অধীনে পাত্র-চীবর ধারণ করলো।
সন্যাসব্রত অবলম্বনের পর, এ পঞ্চ বর্গীরা পিণ্ডচরণের উদ্দেশ্যে গ্রাম, জনপদ ও দেশ-দেশান্তরে বিচরণ করতে করতে উরুবেলায় বোধিসত্ব সিদ্ধার্থের সাথে মিলিত হলেন। যখন বৌধিসত্ব ছয় বছর যাবৎ চরম কৃচ্ছসাধনের মধ্য দিয়ে কঠোর সাধনারত, তখন কঠোর সাধনারত সিদ্ধার্থকে দেখে তাঁরা ভাবলেন ঃ “সম্ভবতঃ ইনিই বুদ্ধত্ব লাভ করবেন। এখনই বুদ্ধত্ব লাভ করবেন!” এরূপ ভেবে সিদ্ধার্থকে প্রয়োজনীয় সেবা-যত্ন ও পরিচর্যা করতে লাগলেন।
ছয় বছরে তিনি বুঝতে পারলেন যে চরম কৃচ্ছসাধনের মধ্য দিয়ে কঠোর সাধনা আর্য মার্গ-ফল লাভ হয় না, যদিও তিনি একটি মাত্র তিল বা তন্ডুল খেয়ে দিন অতিবাহিত করতে লাগলেন। কোন কোন সময় খাদ্য না খেয়েই উপবাস থাকতেন এবং এতে তাঁর দেহ কঙ্কালসার হল। সর্বোপরি কাঞ্চনবর্ণ দেহ ঘোর কৃঞ্চবর্ণে পরিণত হল। তাঁর বত্রিশ প্রকার মহাপুরুষের লক্ষণাদি প্রায়ই বিলুপ্ত হল। তিনি অতিশয় দুর্বল হয়ে পড়লেন এবং প্রাণায়াম ধ্যানে প্রবেশ করতে অক্ষম হলেন। কেবলমাত্র চংক্রমণ করলেও ভূমিতে পড়ে যান। দেবতারা তাঁর দেহের লোমকূপ দিয়ে জীবনী শক্তিবর্ধক পুষ্টিকর ওজ পরিবেশন করে তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। এভাবে বোধিসত্ত্ব ছয় বছর যাবৎ কঠোর কৃচ্ছ সাধনা দ্বারা উপলব্ধি করলেন, উক্ত পদ্ধতিতে প্রকৃত বোধিজ্ঞান লাভ করা সম্ভব নয়। তিনি আরও উপলব্ধি করলেন, সত্ত্বগণের স্বভাব ধর্ম হল ঃ শ্রদ্ধাধিক্য কারণে মোহ প্রবেশ করে, প্রজ্ঞাধিক্য কারণে সবই ত্যাগ করে, বীর্যাধিক্য কারণে অস্থিরতা জাগে, সমাধি আধিক্যের কারণে কম্পিত হয় না এবং স্মৃতি মাত্র ব্যতিক্রম হয় না তা জ্ঞাত হয়ে সাধনা করতে হবে। তদ্রুপ নিয়মিত খাদ্য গ্রহণ করলে দেহ সুস্থ হবে এবং শ্রদ্ধা, প্রজ্ঞা, বীর্য ও সমাধি নিয়মিত হবে এবং সাধনায় সমতা আসবে। এরূপ চিন্তা করে পার্শ্ববর্তী গ্রামে ভিক্ষান্নে বের হয়ে অন্ন সংগ্রহ করে আহার্য গ্রহণ করতে থাকেন। পঞ্চবর্গীয় শিষ্যরা বোধিসত্ত্ব গৌতমের এরূপ পরিবর্তন লক্ষ্য করে তাঁকে ত্যাগ করে ঋষিপতন মৃগদাবে চলে গেলেন। কিছুদিন নিয়মিত আহারের পর তাঁর দেহের অবস্থার পরিবর্তন হল। তাঁর দেহ স্বাভাবিক অবস্থায় বত্রিশ প্রকার মহাপুরুষ লক্ষণ পূর্বের ন্যায় পরিষ্ফুট হল। দেহ বর্ণ পূর্ববৎ তপ্ত কাঞ্চণের ন্যায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বৈশাখী পূর্ণিমা যেদিন তিনি বুদ্ধত্ব লাভ করবেন, সেদিন মহাশ্রেষ্ঠীর নন্দিনী সুজাতা তাঁকে মধুর পায়াসান্ন দান করলেন। তখন তিনি নৈরঞ্জনা নদীতে ভিক্ষা পাত্রটি ভাসিয়ে দিলেন এবং উক্ত পাত্রটি বৌধিসত্ত্বের সত্যক্রিয়ার ফলে রাতের বিপরীত দিকে প্রবাহিত হয়ে নাগরাজ ‘কাল’-এর নিকট পৌঁছে। এভাবে বৌধিবৃক্ষের নীচে ধ্যানস্থ হয়ে বুদ্ধত্ব লাভ করলেন।
অনুবাদক প্রকাশ দেওয়ান।
(খ) শেষ জন্মে প্রব্রজ্যা জীবন গ্রহণ
পুণ্যবান গৃহপতি মহাকল অর্থাৎ ভবিষ্যৎ কোণ্ডাণ্য থের সারা জীবন ব্যাপী এ রকম কুশল কর্ম সম্পাদন করলেন। এভাবে তিনি মনুষ্যলোক থেকে চ্যুত হয়ে দেবলোকে এবং দেবলোক থেকে মনুষ্যলোকে জন্ম-জন্মান্তরে সংসারে পরিভ্রমণ করেন। যখন আমাদের গৌতম বুদ্ধ প্রায় আবির্ভাব হওয়ার সময়, তিনি অর্থাৎ ভবিষ্যৎ কোণ্ডাণ্য কপিলাবস্তুর অদূরে
‘ডোনাবত্তু’-র এক ব্রাহ্মণ পল্লীতে ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। নামকরণের সময় তরুণ ব্রাহ্মণের নাম রেখে দেয়া হল ‘কোণ্ডাণ্য’। তাঁর বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে ত্রিবেদ শাস্ত্রে পারদর্শীতা অর্জন করলেন এবং মহান ব্যক্তিদের মুখ, হাবভাব ইত্যাদি দেখে চরিত্র নির্ণয় করতে পারেন এমন বিদ্যায় সক্ষমতা অর্জন করলেন।
ঐ সময়ে আমাদের ভবিষ্যৎ বুদ্ধ গৌতম তুষিত স্বর্গলোক থেকে চ্যুত হয়ে কপিলাবস্তু নগরী রাজা শুদ্ধোধনের প্রধান রানী মহামায়ার নিকট জন্মগ্রহণ করেন। নতুন শিশুটির নামকরণের দিনে রাজা শুদ্ধোধন একশত আট ব্রাহ্মণ পুরোহিত রাজপ্রাসাদে আমন্ত্রণ জানালেন এবং তাঁদেরকে নতুন পোষাক-পরিচ্ছদসহ সুস্বাদু খাবার ও মিষ্টি পরিবেশন করা হল। এসব ব্রাহ্মণের মধ্য থেকে শুধুমাত্র আটজন ব্রাহ্মণ যাঁরা পাণ্ডিত্যের অধিকারী এমন ব্রাহ্মণকে নির্বাচন করা হল এবং তাঁরা ক্রমানুযায়ী আসন গ্রহণ করলেন। তারপর রাজা শুদ্ধোধন তাঁর শিশুপুত্র রাজ কুমার বৌধিসত্বকে শ্বেত বস্ত্র লিনেন কাপড় পরিধান করিয়ে ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের কাছে নিয়ে এলেন যাঁরা শিশুটির দেহের চিহ্ন পরীক্ষা করবেন। আটজনের মধ্যে যে ব্রাহ্মণ প্রথম সারীতে বসে আছেন, তিনি দু’অঙ্গুলী প্রদর্শনপূর্বক ভবিষ্যৎবাণী করলেন ঃ “যদি এ শিশুপুত্র সংসারে আবদ্ধ থাকেন, তবে তিনি রাজ চক্রবর্তী হবেন আর যদি তিনি সন্যাসব্রত পালন করেন, তবে তিনি অবশ্যই ত্রিলোক পুজ্য সম্যক সম্বুদ্ধ হবেন।” এভাবে দ্বিতীয়, তৃতীয় হতে সপ্তম ব্রাহ্মণ পুরোহিত একইভাবে দু’অঙ্গুলী প্রদর্শন করে ভবিষ্যৎবাণী করলেন। এ আট ব্রাহ্মণের মধ্যে কোণ্ডাণ্যই সবচেয়ে কনিষ্ঠ। এবার যখন তাঁর পালা, তিনি অত্যন্ত সাবধান হয়ে বিচক্ষণতার সহিত দেহের চিহ্নগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখলেন। তিনি মনে মনে কল্পনা করলেন যিনি রাজ চক্রবর্তী হবেন তাঁর তা হওয়ার মত পায়ের পাতার চিহ্নটি নেই, আর তাই তিনি শুধুমাত্র এ অঙ্গুলী প্রদর্শন করে অনেকটা সাহসিকতার সহিত ভবিষ্যৎবাণী করলেন ঃ “এ শিশুপুত্র সংসারে আবদ্ধ হওয়ার কোন লক্ষণ নেই, রাজ কুমার বাস্তবেই একজন সংসার ত্যাগী বুদ্ধ হবেন।”
এরপর ব্রাহ্মণ পুরোহিতদ্বয় তাঁদের নিজ নিজ গৃহে ফিরে গেলেন এবং তাঁদের পুত্রদের এ রকম বলেই নির্দেশনা দিলেন ঃ “হে প্রাণপ্রিয় পুত্রগণ, আমরা বয়োঃপ্রাপ্ত হয়েছি। আমরা রাজা শুদ্ধোধনের পুত্র রাজ কুমার সিদ্ধার্থের সময়ের সাথে সাথে বেচে থাকতেও পারি আবার নাও থাকতে পারি, যিনি ত্রিলোক পুজ্য সম্যক সম্বুদ্ধ হবেন। যখন দেখবে বয়োঃপ্রাপ্তিতে রাজ কুমার সিদ্ধার্থ গৃহ ত্যাগী সন্যাসী হয়ে সন্যাসব্রত পালন করছেন, তখন তোমরাও ভিক্ষু হয়ে তাঁর সাথে যোগ দিবে।”
রাজা শুদ্ধোধন তাঁর শিশুপুত্র রাজ কুমারকে শুরু থেকেই রাজ কর্মচারী নিয়োগ করে রক্ষাকারী বলয় সৃষ্টি করে অত্যন্ত আরাম-আয়েশের মধ্য দিয়ে লালন-পালন করতে থাকেন। যখন তাঁর বয়স ষোল বছর, তখন যশোধরার সাথে তাঁর বিয়ে হয়। উনত্রিশ বছর বয়সে তিনি অনেক পরিপক্ক হন এবং তিনি দেখলেন Ñ ‘ভোগে দুঃখের পরিণতি এবং ত্যাগেই মহিমা।’ যেদিন রাহুলের জন্ম হয়, সেদিনই রাত্রির মধ্যভাগে অশ্বরাজ কন্থক এবং তাঁর প্রিয় সারথী ছন্দককে নিয়ে বের হয়ে গেলেন Ñ নগর তোরণের বাইরে যেটি দেবগণ কর্তৃক খোলা হয়েছে। ঐ এক রাত্রিতেই তিনি কপিলাবস্তু, কোলীয় ও দেবদহ নগর অতিক্রম করলেন এবং অনোমা নদীর তীরে তিনি পাত্র-চীবর গ্রহণ করলেন যেগুলি ‘ঘটিকার ব্রহ্মা’ কর্তৃক দান করা হয়েছে। এরপর তিনি আশি বছর বয়সী ষাট বর্ষার একজন মহাস্থবিরের ন্যায় অত্যন্ত মোহনীয়রূপে রাজগৃহে এসে পৌঁছলেন। তিনি পিণ্ডচরণ করতে থাকেন এবং এক সময় পিণ্ডচরণ থেকে ফিরে পান্ধব পর্বতের এক ছায়ায় তাঁর ভোজন সম্পন্ন করলেন। যদিও রাজা বিম্বিসার তাঁকে তাঁর রাজ প্রাসাদে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন এবং তাঁর রাজ্যের অংশও দিবেন বলে প্রতিশ্র“তিবদ্ধ হয়েছেন, কিন্তু সিদ্ধার্থ তা প্রত্যাখ্যান করলেন। এরপর আলাড় কালাম ও রামপুত্র রুদ্রকের সাক্ষাৎ শেষে এভাবে পর্যটন করতে করতে এক সময় উরুবেলায় এসে উপণীত হলেন। এর মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দর্শন করে তিনি ভাবলেন ঃ “এ স্থানটি আধ্যাত্মিক সাধনার জন্য সর্বোত্তম।” এরূপ চিন্তা করে একটা মনোরম স্থান নির্বাচন করে তিনি ধ্যান-সাধনা শুরু করে দিলেন চরম কৃচ্ছসাধনের সংকল্প নিয়ে।
সিদ্ধার্থের (ভবিষ্যৎ বুদ্ধ) মহাভিনিস্ক্রমণের সময়, সকল ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের মধ্যে সর্ব কনিষ্ঠ কোণ্ডাণ্য গোত্রীয় সুদত্ত ব্রাহ্মণ ব্যতীত সকলেই স্বীয় কর্মানুসারে পরলোক গমন করেছেন। একমাত্র সর্ব কনিষ্ঠ কোণ্ডাণ্যই শারীরিকভাবে উপযুক্ত আছেন। সিদ্ধার্থ (বৌধিসত্ব) প্রব্রজ্যা গ্রহণপূর্বক বুদ্ধত্ব লাভের জন্য সাধনা করছেন এরূপ জ্ঞাত হয়ে তিনি পরলোকগত ঐ ব্রাহ্মণ পুরোহিত পুত্রদের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং বললেন ঃ “এ রকম উক্ত হয় যে, রাজ কুমার সিদ্ধার্থ সন্যাসব্রত পালন করছেন। নিঃসন্দেহে তিনি সম্যক সম্বুদ্ধত্ব প্রাপ্ত হবেন। যদি তোমাদের পিতারা জীবিত থাকতেন, তবে তাঁরা আজকে আগে-ভাগেই সন্যাসব্রত পালন করতে চলে যেতেন। অতএব চলে এস, যদি চাও। চলো, এ রকম মহান ব্যক্তির সান্নিধ্যে অবস্থান করে প্রব্রজিত ভিক্ষু হয়ে যায়।” কিন্তু সাত জনের সবাই এ ব্যাপারে একমত হতে পারলো না, অধিকন্তু তিনজন ব্যাপারটি প্রত্যাখ্যান করলো আর মাত্র অবশিষ্ট চারজন কোণ্ডাণ্যের অধীনে পাত্র-চীবর ধারণ করলো।
সন্যাসব্রত অবলম্বনের পর, এ পঞ্চ বর্গীরা পিণ্ডচরণের উদ্দেশ্যে গ্রাম, জনপদ ও দেশ-দেশান্তরে বিচরণ করতে করতে উরুবেলায় বোধিসত্ব সিদ্ধার্থের সাথে মিলিত হলেন। যখন বৌধিসত্ব ছয় বছর যাবৎ চরম কৃচ্ছসাধনের মধ্য দিয়ে কঠোর সাধনারত, তখন কঠোর সাধনারত সিদ্ধার্থকে দেখে তাঁরা ভাবলেন ঃ “সম্ভবতঃ ইনিই বুদ্ধত্ব লাভ করবেন। এখনই বুদ্ধত্ব লাভ করবেন!” এরূপ ভেবে সিদ্ধার্থকে প্রয়োজনীয় সেবা-যত্ন ও পরিচর্যা করতে লাগলেন।
ছয় বছরে তিনি বুঝতে পারলেন যে চরম কৃচ্ছসাধনের মধ্য দিয়ে কঠোর সাধনা আর্য মার্গ-ফল লাভ হয় না, যদিও তিনি একটি মাত্র তিল বা তন্ডুল খেয়ে দিন অতিবাহিত করতে লাগলেন। কোন কোন সময় খাদ্য না খেয়েই উপবাস থাকতেন এবং এতে তাঁর দেহ কঙ্কালসার হল। সর্বোপরি কাঞ্চনবর্ণ দেহ ঘোর কৃঞ্চবর্ণে পরিণত হল। তাঁর বত্রিশ প্রকার মহাপুরুষের লক্ষণাদি প্রায়ই বিলুপ্ত হল। তিনি অতিশয় দুর্বল হয়ে পড়লেন এবং প্রাণায়াম ধ্যানে প্রবেশ করতে অক্ষম হলেন। কেবলমাত্র চংক্রমণ করলেও ভূমিতে পড়ে যান। দেবতারা তাঁর দেহের লোমকূপ দিয়ে জীবনী শক্তিবর্ধক পুষ্টিকর ওজ পরিবেশন করে তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। এভাবে বোধিসত্ত্ব ছয় বছর যাবৎ কঠোর কৃচ্ছ সাধনা দ্বারা উপলব্ধি করলেন, উক্ত পদ্ধতিতে প্রকৃত বোধিজ্ঞান লাভ করা সম্ভব নয়। তিনি আরও উপলব্ধি করলেন, সত্ত্বগণের স্বভাব ধর্ম হল ঃ শ্রদ্ধাধিক্য কারণে মোহ প্রবেশ করে, প্রজ্ঞাধিক্য কারণে সবই ত্যাগ করে, বীর্যাধিক্য কারণে অস্থিরতা জাগে, সমাধি আধিক্যের কারণে কম্পিত হয় না এবং স্মৃতি মাত্র ব্যতিক্রম হয় না তা জ্ঞাত হয়ে সাধনা করতে হবে। তদ্রুপ নিয়মিত খাদ্য গ্রহণ করলে দেহ সুস্থ হবে এবং শ্রদ্ধা, প্রজ্ঞা, বীর্য ও সমাধি নিয়মিত হবে এবং সাধনায় সমতা আসবে। এরূপ চিন্তা করে পার্শ্ববর্তী গ্রামে ভিক্ষান্নে বের হয়ে অন্ন সংগ্রহ করে আহার্য গ্রহণ করতে থাকেন। পঞ্চবর্গীয় শিষ্যরা বোধিসত্ত্ব গৌতমের এরূপ পরিবর্তন লক্ষ্য করে তাঁকে ত্যাগ করে ঋষিপতন মৃগদাবে চলে গেলেন। কিছুদিন নিয়মিত আহারের পর তাঁর দেহের অবস্থার পরিবর্তন হল। তাঁর দেহ স্বাভাবিক অবস্থায় বত্রিশ প্রকার মহাপুরুষ লক্ষণ পূর্বের ন্যায় পরিষ্ফুট হল। দেহ বর্ণ পূর্ববৎ তপ্ত কাঞ্চণের ন্যায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বৈশাখী পূর্ণিমা যেদিন তিনি বুদ্ধত্ব লাভ করবেন, সেদিন মহাশ্রেষ্ঠীর নন্দিনী সুজাতা তাঁকে মধুর পায়াসান্ন দান করলেন। তখন তিনি নৈরঞ্জনা নদীতে ভিক্ষা পাত্রটি ভাসিয়ে দিলেন এবং উক্ত পাত্রটি বৌধিসত্ত্বের সত্যক্রিয়ার ফলে রাতের বিপরীত দিকে প্রবাহিত হয়ে নাগরাজ ‘কাল’-এর নিকট পৌঁছে। এভাবে বৌধিবৃক্ষের নীচে ধ্যানস্থ হয়ে বুদ্ধত্ব লাভ করলেন।
No comments
Post a Comment