বুদ্ধবংশ

অনুবাদক- বাবু প্রকাশ দেওয়ান

মহাস্থবিরগণের কাহিনী
আমি এখন কোণ্ডাণ্য মহাস্থবিরের কাহিনী ব্যাখ্যা করবো যা অঙ্গুত্তর নিকায়ভুক্ত টিকা অংশের একক নিপাতের “এটাদগ্গ বর্গ” থেকে নেয়া হয়েছে। গৌতম বুদ্ধের সময়ে তাঁর শিষ্যেদের মধ্যে অনুত্তর পুণ্যক্ষেত্র ভিক্ষু সংঘ সদস্যদের মধ্যে ‘কোণ্ডাণ্য মহাস্থবির’ই জ্যেষ্ঠ।

(১) কোণ্ডাণ্য মহাস্থবির
মহাস্থবিরগণের কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে আমি একে ৪ (চার) ভাগে বিভক্ত করেছি। যথাঃ (ক) অতীত জন্মে আশীর্বাদ প্রাপ্তি, (খ) শেষ জন্মে প্রব্রজ্যা জীবন গ্রহণ, (গ) কঠোর ধ্যান-সাধনায় মার্গ-ফল লাভ এবং
(ঘ) প্রত্যাশিত আসন (উচ্চ পদ) লাভ।

(ক) অতীত জন্মে আশীর্বাদ প্রাপ্তি
এ ভদ্র কল্পের বহু পূর্বে অর্থাৎ শত-সহস্র (লক্ষ) কল্পের পূর্বে তখনকার সময়ে উৎপন্ন Ñ পদুমুত্তর বুদ্ধের আবির্ভাব হয়। সে সময় পদুমুত্তর বুদ্ধ তাঁরই শত-সহ¯্র ভিক্ষু-শিষ্য পরিবেষ্টিত হয়ে গ্রাম থেকে নগরে এবং নগর থেকে রাজধানীতে পিণ্ডচরণে বের হন এবং এভাবেই অনুকম্পাপূর্বক মানবের দুঃখমুক্তি নির্বাণের পথে এগিয়ে নিয়ে যান। এভাবে প্রতিদিন পিণ্ডচরণ করতে করতে এক সময় তাঁর নিজ এলাকা “হংসবতি”তে পদার্পণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল ‘আনন্দ’ অর্থাৎ রাজা আনন্দ। আনন্দরাজ প্রিয় পুত্রের আগমনের সুসংবাদটি শুনলেন এবং যথাসময়ে তিনি বুদ্ধের অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করতে রাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ তাঁর নিজস্ব কিছু লোকবল পাঠিয়ে দিলেন। যেহেতু পদুমুত্তর বুদ্ধ রাজা আনন্দসহ সাধারন প্রজাদের উদ্দেশ্যে ধর্ম দেশনা করলেন এমন সময় কেহ কেহ ¯্রােতাপত্তি, কেহ কেহ সকৃতাগামী, কেহ কেহ অনাগামী এবং অবশিষ্টরা অর্হত্ব মার্গ-ফলে প্রতিষ্ঠিত হলেন।
অতঃপর আনন্দরাজ পরের দিনে পদুমুত্তর বুদ্ধকে সশিষ্যে নিজ রাজপ্রাসাদে মধ্যহ্ন ভোজের আমন্ত্রণ জানালেন এবং নির্দিষ্ট সময়ান্তে বার্তাযোগে পদুমুত্তর বুদ্ধকে সশিষ্যে মধ্যহ্ন ভোজের নিমিত্তে নিয়ে আসা হল এবং রাজপ্রাসাদে বুদ্ধসহ তাঁর শত-সহ¯্র ভিক্ষুসংঘের উদ্দেশ্যে এক মহাদান সম্পন্ন হল। মধ্যহ্ন ভোজের সমাপনান্তে পদুমুত্তর বুদ্ধ ভোজের প্রশংসা করে ধর্ম দেশনা প্রদান করলেন এবং যথারীতি বিহারে ফিরে গেলেন। একইভাবে এর পরের দিন সাধারণ প্রজাসাধারনের পক্ষ থেকে বুদ্ধসহ তাঁর শত-সহ¯্র ভিক্ষু-শিষ্যদের উদ্দেশ্যে এক মহাদান সম্পাদন করা হল। এর পরবর্তীতে রাজার দান দেয়ার পালা এবং এভাবেই রাজা এবং সাধারণ প্রজাদের পক্ষ থেকে দীর্ঘ দিন পর্যন্ত একর পর এক মহাদান সম্পাদিত হতে লাগল।
এমন সময় এক ‘গৃহপতি’ যিনি অনাগতে গৌতম বুদ্ধের সময়ে “কোণ্ডাণ্য” নামে পরিচিতি লাভ করবেন, তিনি এক ধনাঢ্য পরিবারে জন্মধারন করলেন। একদিন পদুমুত্তর বুদ্ধ যখন ধর্ম দেশনা প্রদান করছিলেন, তিনি প্রত্যক্ষ করলেন Ñ “হংসবতি” নগরের সাধারণ প্রজারা পুষ্প ও সুগন্ধিযুক্ত হস্তে এবং প্রয়োজনীয় দানীয় সামগ্রীসহ পদুমুত্তর বুদ্ধের উদ্দেশ্যে দান করলেন এবং তিনিও তাঁদের সঙ্গে যোগ দিলেন যেখানে পদুমুত্তর বুদ্ধ ধর্ম দেশনা করছিলেন।
এরই মধ্যে পদুমুত্তর বুদ্ধ ভিক্ষু-সংঘের মধ্যে জ্যেষ্ঠতম এক ভিক্ষুর নাম ঘোষণা করলেন যিনি চারিয়ার্য সত্য জ্ঞান লাভ করেছেন এবং এভাবে তাঁর শাসনে দুঃখ মুক্তি নির্বাণ অধিগত হলেন। যখন ‘গৃহপতি’ এ খবর শুনলেন Ñ তিনি মনে মনে ভাবলেন, “সত্যিই, কত ভাগ্যবান ঐ ভিক্ষু! এ রকম উক্ত হয়ে থাকে যে, বুদ্ধ ছাড়া এমন কোন ব্যক্তি নেই যিনি চারিয়ার্য সত্য জ্ঞান অধিগত করেছিলেন। তাঁর মত চারিয়ার্য সত্য জ্ঞান অধিগত করতে অন্যদের চেয়ে আমি যদি পূর্বেই প্রব্রজ্যা জীবন শুরু করি Ñ অনাগত বুদ্ধের শাসনে।” এ কথা ভাবতে ভাবতে ‘গৃহপতি’ পদুমুত্তর বুদ্ধের সমীপে উপস্থিত হলেন এবং বুদ্ধকে সশিষ্যে পরবর্তী দিবসের জন্য মধ্যহ্ন ভোজের আমন্ত্রণ করলেন এবং পদুমুত্তর বুদ্ধ অনুকম্পাপূর্বক নীরবে সদয় সম্মতি জ্ঞাপন করলেন।
পদুমুত্তর বুদ্ধ সশিষ্যে তাঁর আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন তা সম্যকরূপে জ্ঞাত হয়ে ‘গৃহপতি’ বুদ্ধকে বন্দনাপূর্বক যথারীতি গৃহে ফিরে এলেন। গৃহে ফিরে এসে রাতব্যাপী পুস্পসহ সুগন্ধী জাতীয় প্রয়োজনীয় দ্রব্য-সামগ্রীর সাজ-সজ্জায় মনোনিবেশ করলেন এবং যথাযথ সুস্বাদু খাদ্য-সামগ্রীর প্রস্তুতি কাজেও মনোনিবেশ করলেন। পরবর্তী দিন তিনি বুদ্ধকে সশিষ্যে অর্থাৎ শত-সহ¯্র ভিক্ষুকে তাঁর গৃহে পিণ্ডদান দিলেন। পিণ্ডদান শেষে তিনি বুদ্ধের পাদপদ্মে একান্তে বন্দনাপূর্বক ‘বংগ’ দেশে তৈরী সম্পূর্ণ নতুন এবং দৃঢ়-মসৃণ ত্রি-চীবর দান করলেন। অতঃপর তিনি মনে মনে যে রকম চিন্তা করলেন ঃ “আমি ছোট আসনের (পদ) দাবীদার নই, আমি চাই বড় (উচ্চ) আসন। এ দিনটির ন্যায় এক দিনের মহাদান হয়ত যথেষ্ট নয়, যদি আমি উচ্চ আসনের আকাঙ্খা করি বা দাবীদার হই। অতএব আমি পরবর্তী সপ্ত দিবস পর্যন্ত “মহাদান” সম্পাদন করে এ পদের বা আসনের দাবীদার বা আকাঙ্খা পোষণ করবো।
‘গৃহপতি’ এভাবে সাত দিন ব্যাপী “মহাদান” কার্য সম্পাদন করলেন। পিণ্ডদান শেষে তিনি তাঁর বস্ত্র-সামগ্রীর রক্ষিত ভাণ্ডারটি খুললেন/উন্মোচন করলেন এবং বুদ্ধের পাদপদ্মে নতশীরে বন্দনাপূর্বক ভাণ্ডারে রক্ষিত ত্রি-চীবরগুলো বুদ্ধসহ শত-সহ¯্র ভিক্ষু-শিষ্যদের উদ্দেশ্যে দান পর্ব সম্পাদন করলেন। এরপর পদুমুত্তর বুদ্ধের নিকট নতশীরে প্রার্থনা করলেন, “অসীম করণাময় হে বুদ্ধ, সপ্ত দিবস পূর্বে আপনি যাকে জ্যেষ্ঠতম ভিক্ষু হিসেবে ঘোষণা করেছেন, আমি কি তৎপরববর্তী বুদ্ধ শাসনে এ ত্রি-চীবরগুলো দানের মাধ্যমে চারিয়ার্য সত্য জ্ঞান অধিগমের মধ্য দিয়ে প্রথম ও জ্যেষ্ঠতম ভিক্ষু হতে সক্ষম হবো।” এ রকম উক্ত হয়ে তিনি বুদ্ধের পাদপদ্মে একান্তে বন্দনাপূর্বক নীরবে অবস্থান করতে থাকেন।
‘গৃহপতি’-এর এমন উচ্চাকাঙ্খার কথা শ্রবণে পদুমুত্তর বুদ্ধ তাঁর আপন দীব্য-চক্ষু জ্ঞানে পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন এবং শেষে বললেন ঃ “এ গৃহপতি বিপুল পরিমানে পুণ্য সঞ্চয় করেছেন অর্থাৎ কুশল কর্ম সম্পাদন করেছেন। তাঁর উচ্চাকাঙ্খা কি পূর্ণতা পাবে নাকি পাবে না?” অতঃপর তিনি পরিষ্কারভাবে জ্ঞাত হয়েছেন যে ঃ “তাঁর উচ্চাকাঙ্খা অবশ্যই পূর্ণতা পাবে।”
সত্যিই, আদৌ কোন বাধা নেই। ত্রিকালদর্শী বুদ্ধের দিব্য চক্ষু এমনকি পারমাণবিক কোন শক্তির কারণেও ঢাকতে পারবে না। এমনকি অতীত বা অনাগতে সকল ধরনের কার্যে কোটি কোটি কল্পের বাধা-বিপত্তি থাকলেও অথবা বর্তমানে সকল ধরনের কার্যে হাজার হাজার চক্রবালের বাধা সত্ত্বেও, এগুলোই বুদ্ধের দিব্য চক্ষুতে প্রতিফলিত হল। এ প্রকারেই তাঁর দিব্য চক্ষুতে কোন বাধা-বিপত্তি আছে বলে জ্ঞাত হলেন না, পদুমুত্তর বুদ্ধ এভাবেই তাঁর দিব্য চক্ষুতে দর্শন করলেন, “এখন থেকে শত-সহ¯্র/লক্ষ কল্প পরে এককভাবে ‘গৌতম’ নামে এক সম্যক সম্বুদ্ধের আবির্ভাব হবে। তখন এ ‘গৃহপতি’-এর আকাঙ্খা পরিপূর্ণতা পাবে!” এভাবে জ্ঞাত হয়ে বুদ্ধ ‘গৃহপতি’-এর ভবিষ্যৎবাণী করলেন, “হে গৃহপতি, “এখন থেকে লক্ষ কল্প পরে এককভাবে ‘গৌতম’ নামে এক ত্রিকালদর্শী সম্যক সম্বুদ্ধের আবির্ভাব হবে। যখন বুদ্ধ গৌতম “ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্র” প্রথম দেশনা করবেন, দেশনার শেষান্তে ১৮ (আটার) কোটি ব্রহ্মার সাথে তুমিও ¯্রােতাপত্তি-ফলে প্রতিষ্ঠিত হবে।”      

দু’ভ্রাতার গল্প : মহাকল ও চুলকল
শত-সহস্র/লক্ষ বর্ষ পর্যন্ত দীর্ঘ মেয়াদে পিণ্ডদানের মত কুশল কর্ম সম্পাদন করে ঐ ঐশ্বর্যশালী ‘গৃহপতি’ অর্থাৎ ভবিষ্যৎ ‘কোণ্ডাণ্য’ ইহকাল ত্যাগ করে দেবলোকে উৎপন্ন হলেন। যখন তিনি দেবলোক ও মনুষ্যলোকে গমনাগমন করতে থাকেন, তখন ৯৯,৯০৯ (নিরানব্বই হাজার নয়শত এবং নয়) কল্প বিগত হয়েছে। কথিত আছে ঃ এ সময়ে তিনি চারি অপায় রুদ্ধ/বন্ধ করে শুধুমাত্র দেবলোক ও মনুষ্যলোকে উৎপন্ন হয়েছেন। এমন দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর, এ ভদ্র কল্প থেকে পিছনে গননা করলে ৯১ (একানব্বই) কল্প অবশিষ্ট থাকে যখন ‘গৃহপতি’ অর্থাৎ ভবিষ্যৎ ‘কোণ্ডাণ্য’ রাজকীয় নগর ‘বন্ধুমতি’-র অদূরবর্তী এক নিভৃত পল্লীতে ‘মহাকল’ নামে এক গৃহস্থের পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেন। তাঁর একজন কনিষ্ঠ ভ্রাতা  ছিলেন যাঁর নাম ‘চুলকল’।
ঐ সময় ভবিষ্যৎ বিপর্শী বুদ্ধ ‘তুষিত’ দেবলোক থেকে চ্যুত হলেন এবং রাজা ‘বন্ধুমা’-র স্ত্রী মহারানী ‘বন্ধুমতি’-র গৃহে জন্মধারণ করেন। যথাসময়ে তিনি সম্যক সম্বুদ্ধ হলেন। যেহেতু ধর্ম প্রচারের জন্য মহা ব্রহ্মা কর্তৃক অনুরোধ করা হল। বুদ্ধ ভাবলেন এখন তিনি কাকে প্রথম ধর্ম দেশনা করবেন। তিনি দেখতে পেলেন তাঁরই নিজের কনিষ্ঠ ভ্রাতা রাজ কুমার খন্ধ এবং পুরোহিতের পুত্র তরুণ বয়সী তিষ্য। তিনি দেখলেন Ñ এ দু’জনই প্রথমে চারিয়ার্য সত্য জ্ঞান অধিগত করতে সক্ষম হবেন। তিনি এভাবে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন ঃ “আমি তাঁদের ধর্ম দেশনা করবো। আমি আমার পিতা রাজার কাছেও ধর্ম দেশনা করবো।” অতঃপর তিনি মহাবোধি হতে আকাশ মার্গে (পথে) বিচরণ করতে করতে ‘ক্ষেমা’ নামক মৃগদাবে অবতরণ করলেন। তিনি রাজ কুমার খন্ধ ও তিষ্যকে ডেকে পাঠালেন এবং তাঁদের দেশনা প্রদান করলেন, দেশনার শেষান্তে তাঁরা উভয়ই ৮৪ (চুরাশি) হাজার দেব পুত্রের সাথে অর্হত্ত্ব মার্গ-ফলে প্রতিষ্ঠিত হলেন। এ ঘটনা শুনে বুদ্ধের দর্শনে আসা ৮৪ (চুরাশি) হাজার গৃহপতিও ধর্ম দেশনা শ্রবণে যথাসময়ে অর্হত্ত্ব মার্গ-ফলে প্রতিষ্ঠিত হলেন। বিপর্শী বুদ্ধ খন্ধ থের ও তিষ্য থেরকে প্রধান শিষ্য হিসেবে নিয়োগ দিলেন এবং তাঁদের দু’জনকে যথাক্রমে ডান ও বাম পার্শ্বে রাখলেন বা আসন গ্রহণ করার অনুমতি প্রদান করলেন।
রাজা বন্ধুমা এ বার্তা পেয়ে তাঁর পুত্র বুদ্ধকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে উৎসাহী হলেন এবং তিনি মৃগদাবে উপস্থিত হলেন। বুদ্ধের ধর্ম দেশনা শ্রবণ করে ত্রি-রত্নের অর্থাৎ বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘের আশ্রয় নিলেন। তিনি পরের দিন বুদ্ধকে মধ্যহ্ন ভোজের আমন্ত্রণ জানালেন এবং বুদ্ধকে যথাযথ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে স্থান ত্যাগ করলেন। রাজ প্রাসাদে ফিরে এসে তাঁর মনে এক চিন্তা উদয় হল এভাবে ঃ “আমার জ্যেষ্ঠ পুত্র আগার থেকে অনাগারিক প্রব্রজ্যা নিয়েছেন এবং সম্যক সম্বুদ্ধ হয়েছেন। আমার দ্বিতীয় পুত্র বুদ্ধের ডান পার্শ্বস্থ স্থানে অবস্থান করে অগ্র শ্রাবক বা প্রধান শিষ্য হয়েছেন। পুরোহিতের পুত্র তরুণ তিষ্য বুদ্ধের বাম পার্শ্বস্থ স্থানে অবস্থান করে অগ্র শ্রাবক বা প্রধান শিষ্য হয়েছেন। অবশিষ্ট ৮৪ (চুরাশি হাজার) সাধারন লোক বা পৃথকজন আমার পুত্রের পাশাপাশি অবস্থান করে প্রব্রজ্যা বা ভিক্ষুত্ব জীবনে এসেছেন। অতএব আমার পুত্রের অধীনে সংঘ যেমন পূর্বে আমার অধীনে ছিল তেমনি বর্তমানেও আছে। আমি নিজেই তাঁদের চারি প্রত্যয় দানে এককভাবে দায়ী বা এটা আমার দায়িত্বের একটি অংশ। আমি চারি প্রত্যয় দানে আর অন্য কাউকেও সুযোগ দিব না।” এ রকম চিন্তা করে রাজা বিহারের তোরণ থেকে রাজ প্রাসাদের তোরণ পর্যন্ত পথের উভয় পার্শ্বে উচু প্রাচীরের সীমানা নির্মাণ করলেন এবং মোটা কাপড় দিয়ে আবৃত করলেন। তিনি ফেস্টুন দিয়ে ঝুলিয়ে দিলেন যেগুলো শক্ত ও পুরু এবং স্বর্ণখচিত তারকা চিহ্ন দিয়ে মোড়ানো এবং পুস্পসহ সুগন্ধী জাতীয় প্রয়োজনীয় দ্রব্য-সামগ্রী সাজ-সজ্জায় ব্যবহার করলেন। অতঃপর তিনি বার্তাযোগে বুদ্ধকে ডেকে পাঠালেন যে এখন মধ্যহ্ন ভোজের উপযুক্ত সময়। বিপর্শী বুদ্ধ সশিষ্যে রাজ প্রাসাদে আগমন করলেন যে পথ পরিপূর্ণরূপে আবৃত এবং পিণ্ডপাত সমাপনান্তে বিহারে ফিরে গেলেন। এ সময় বুদ্ধ দর্শন করার কারোর সুযোগ হল না। বুদ্ধকে খাদ্য-বস্তু দান করা এবং শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করার এমন সুযোগ কারোর কিভাবে হবে? সত্যিই, কারোর দর্শনের সুযোগ হলো না। তখন সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি কথা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এল ঃ
“জগতে বুদ্ধ উৎপত্তির সময় হতে এখন প্রায় ৭ (সাত) বছর ৭ (সাত) মাস বিগত হয়েছে কিন্তু আমাদের বুদ্ধ দর্শনের কোন ধরণের সুযোগ সৃষ্টি হয়নি যে পিণ্ডদান বলতে কি বুঝায় বা কিভাবে পিণ্ড দিতে হয়, বুদ্ধকে কিভাবে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে হয় এবং তাঁর দেশনা শ্রবণের সার্থকতা কি? প্রকৃতপক্ষে আমরা এসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত। রাজা ব্যক্তিগতভাবে বুদ্ধের চারি প্রত্যয় দান করছেন এ রকম চিন্তা করে যে “বুদ্ধ শুধুমাত্র আমার বুদ্ধ, ধর্ম শুধুমাত্র আমার ধর্ম এবং সংঘ শুধুমাত্র আমার সংঘ।” জগতের কল্যাণের জন্য বুদ্ধের আবির্ভার হয় শুধুমাত্র রাজার কল্যাণের জন্য নহে। অতএব বুদ্ধকে চারি প্রত্যয় দানের সুযোগ রাজা কি আমাদের হাতে দিবেন নাকি দিবেন না, যদি না দিতে ইচ্ছুক হন, তাহলে আমরা রাজার সাথে যুদ্ধ শুরু করতে প্রস্তুত আছি এবং কুশল কর্ম সম্পাদনে ‘সংঘ’-র অধিকার গ্রহণ করতেও রাজি। চলো, আমাদের অধিকার আদায় করতে যুদ্ধ শুরু করে দিই! কিন্তু একটি ব্যাপার লক্ষ্য রাখার বিষয় ঃ আমরা সাধারণ জনতা এককভাবে এতবড় কাজ সহজে করা সম্ভবপর হয়ে উঠবে না। অতঃপর চলো আমরা একজন দলনেতার সন্ধান করি, যে আমাদের পরিচালনা করতে সক্ষম হবেন।”
এভাবে তাঁরা প্রধান সেনাপতির বরাবর উপস্থিত হলেন এবং তাঁদের পরিকল্পনার কথা সরাসরি বলে ফেললেন ঃ “হে প্রধান সেনাপতি, আপনি কি আমাদের হয়ে কাজ করবেন নাকি রাজার পক্ষ অবলম্বন করবেন?” প্রধান সেনাপতি প্রত্যুত্তরে জানালেন ঃ “আমি আপনাদের হয়ে কাজ করবো কিন্তু একটা শর্ত আছে ঃ বুদ্ধের চারি প্রত্যয় দানে আপনাদের অবশ্যই প্রথম দিবসটি আমাকে দিতে হবে।” সাধারন জনতা এতে সম্মতি জ্ঞাপন করলো।
প্রধান সেনাপতি রাজার সন্নিধানে গিয়ে উপস্থিত হলেন এবং বললেন ঃ “মহান হে রাজ, প্রজা সকল আপনার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছেন।” রাজা কি হেতু প্রজারা ক্রুদ্ধ হয়েছেন তা তাঁর প্রধান সেনাপতির কাছ থেকে জানতে চাইলেন। সেনাপতি বললেন ঃ “কারণ আপনি একাই শুধুমাত্র বুদ্ধের কাছে চারি প্রত্যয় দান করতে পারেন এবং সাধারন প্রজা এতে কোন সুযোগ লাভ করেন না, তাই তাঁরা বলেন ঃ হে মহান রাজ, এখনও বেশী দেরী হয়নি, যদি তাঁদেরকে বুদ্ধের কাছে চারি প্রত্যয় দানের সুযোগ দেয়া হয়, তাঁরা আর কখনও ক্রুদ্ধ হবেন না। যদি তা না হয়, তাঁরা বললো যে তাঁরা আপনার বিরুদ্ধে রুখে দাড়াবে বা যুদ্ধ শুরু করে দিবে।” অতঃপর রাজা প্রত্যুত্তরে বললেন ঃ “হে সেনাপতি, আমিও যুদ্ধ শুরু করে দিব তবে কোন অবস্থাতেই ‘সংঘ’-কে হাতছাড়া করবো না।” “মহান হে রাজ,” রাজাকে কঠিন অবস্থাই ফেলে সেনাপতি বললেন। আপনার সৈন্য বাহিনী আপনার বিরুদ্ধে যাচ্ছেন। আপনি যুদ্ধ করতে কাকে ডাকবেন।” “আপনিও কি আমার সেনাপতি নন?” রাজা বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করলেন। “আমি প্রজাদের কাছ থেকে পৃথক হয়ে আপনার পক্ষে যুদ্ধ করতে পারবো না, মহান হে রাজ, প্রত্যুত্তরে সেনাপতি জানালেন।
অতঃপর রাজা অনুধাবন করলেন ঃ “জন¯্রােতই আসল। সেনাপতিও জনগনের অংশ।” এতএব রাজা একটা অনুরোধ করলেন এবং বললেন ঃ “এ ব্যাপারে, হে বন্ধুগণ, ‘সংঘ’-কে চারি প্রত্যয় দানে আমাকে আরও ৭ (সাত) বছর ৭ (সাত) মাস সুযোগ দেয়া হোক।” কিন্তু প্রজারা এতে রাজী হলেন না এবং রাজার অনুরোধ প্রত্যাখ্যাত হলো। এরপর রাজা তাঁর
প্রস্তাবিত চারি প্রত্যয় দানের সময়টি হ্রাস করতে করতে যেমন ঃ ছয় বছর, পাঁচ বছর ইত্যাদি থেকে পরিশেষে মাত্র সাত দিনে এসে থামলেন। তারপর প্রজারা সবাই একটা সম্মিলিত সিদ্ধান্তে এসে উপণীত হলেন এবং তাঁরা নিজেরাই বলতে লাগলেন, “এখন রাজা চারি প্রত্যয় দানে সাত দিনের সময় চেয়েছেন, তাঁর সাথে এত কঠোর হওয়া আমাদের ঠিক হবে না।”
রাজা বন্ধুমা সাত দিনের মধ্যে ‘সাত বছর সাত মাসের’ ন্যায় সকল ধরণের চারি প্রত্যয় দান করতে থাকেন। সাধারণ প্রজাদের দর্শনের সুযোগ না দিয়ে প্রথম ছয় দিন তিনি সকল দানীয় সামগ্রী দান করলেন। এরপর সাত দিনের মাথায় তিনি সকল সাধারণ প্রজাদের আমন্ত্রণ জানালেন এবং এ বলে মহাদানের মর্মার্থ কি তা সাধারণ প্রজাদের প্রদর্শন করলেন, “হে বন্ধুগণ, এ রকম মহাদান দিতে আপনারা কি সমর্থ হবেন?” “মহান হে রাজ,” সাধারন প্রজারা প্রত্যুত্তরে জানালেন ঃ “আপনার এ রকম মহাদান আমাদের খাজনার উপরই নির্ভরশীল, তাই নয় কি? তাঁরা জোর দিয়ে বললেন, “হ্যা, আমরা দান দিতে সক্ষম।” পরিশেষে রাজা অশ্র“ নয়নে বুদ্ধকে নতশীরে বন্দনা জানিয়ে বললেন ঃ “হে আমার প্রাণপ্রিয় পুত্র, মহান বুদ্ধ, আমি অন্যকে কোন ধরণের সুযোগ না দিয়ে শুধুমাত্র বুদ্ধ এবং এক লক্ষ আটষট্টি হাজার ভিক্ষুকে চিরদিনের জন্য চারি প্রত্যয় দানের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কিন্তু এখন বুদ্ধকে চারি প্রত্যয় দানে সাধারন প্রজাদের অনুমতি প্রদানে বাধ্য হয়েছি। প্রকৃতপক্ষে, সাধারন প্রজা আমার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছেন এবং চারি প্রত্যয় দানে তাঁদের অধিকার ও বঞ্চনার কথা অভিযোগ আকারে জানিয়েছেন। প্রিয় পুত্র, সম্যক সম্বুদ্ধ, আগামীকাল থেকে অনুকম্পাপূর্বক তাঁদের প্রতি সদয় হোন!”
পরবর্তী দিন, শর্তানুসারে প্রধান সেনাপতি বুদ্ধকে সশিষ্যে এক মহাদান দিবেন এবং এক্ষেত্রে শ্রদ্ধাসুমনের গল্পটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ঃ
 (চলবে)

No comments

Theme images by 5ugarless. Powered by Blogger.