বাংলোদেশে থেরবাদ বৌদ্ধ ধর্ম: উত্থান-পতন-পুনরুত্থান

প্রফেসর ড. দীপংকর শ্রীজ্ঞান বড়ুয়া
প্রাচ্যভাষা (পালি ও সংস্কৃত) বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।
(পূর্ব প্রকাশের পর)
শিল্পময় রূপ। বগুড়া জেলার মহাস্থানে বলাইধাপ স্তূপের নিকট ধাতব মঞ্জুশ্রীমূর্তিটিও এ যুগের এবং এটাও মহাযান বৌদ্ধ ধর্মমতের অন্যতম প্রত্যক্ষ প্রমাণ। ষষ্ঠ শতকের প্রথম পাদে মহারাজ বন্যগুপ্ত সামন্তরাজ রুদ্রদত্তের অনুরোধক্রমে কিছু ভূমি দান করেছিলেন। এ দানের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল- আচার্য শান্তিদেবের জন্য রুদ্রদত্ত নির্মিত ও আর্য অবলোকিতেশ্বরের নামে উৎসর্গীকৃত আশ্রম-বিহারের সংরক্ষণ, এ বিহারে শান্তিদেব কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এবং মহাযানী ভিক্ষু-সংঘ কর্তৃক স্থাপিত বুদ্ধমূর্তির দৈনিক তিনবার দীপ-ধুপ-গন্ধ-পুষ্প সহকারে পূজার ব্যবস্থা এবং বিহারস্থ ভিক্ষু-সংঘের জন্য শয়নাসন ও চিকিৎসার সংস্থান করা। এখানে পূর্বে আরো একটি বিহার ছিল বলে জানা যায়। ষষ্ঠ শতকের প্রথমদিকে বাংলার পূর্ব প্রান্তে ত্রিপুরা জেলায় মহাযান ধর্মমত সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। গুণাইঘর লিপিতে তার প্রমাণ রয়েছে (রায়, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫০২-৩)। চীনা লেখক ওয়ান-হিউয়েন-সাঙ-এর বিবরণ থেকে জানা যায় যে আনুমানিক ৩৫২ - ৩৭১ খ্রিস্টাব্দে সিংহলের রাজা মেঘবর্ণ (চি-মি-কিয়া-পো-মো) সমুদ্রগুপ্তের কাছে প্রচুর উপঢৌকনসহ একজন দূত প্রেরণ করেন এবং বুদ্ধগয়ায় সিংহলের তীর্থ যাত্রীদের জন্য একটি মঠ (মন্দির) ও বিশ্রামাগার স্থাপনের অনুমতি প্রার্থনা করেন। সমুদ্র গুপ্ত অতি আনন্দের সাথে অনুমতি প্রদান করেন। বুদ্ধগুপ্তের সময়ে ৪৪৮ খ্রিস্টাব্দে মানকুয়ার বৌদ্ধ প্রতিমা লেখে একটি বুদ্ধমূর্তি প্রতিষ্ঠার কথা আছে। এছাড়া দ্বিতীয় কুমার গুপ্ত ও বুদ্ধগুপ্তের সময়ের দুটি বুদ্ধমূর্তি সারনাথে পাওয়া গেছে এবং এগুলোতে দুটি লেখ উৎকীর্ণ রয়েছে (সিনহা, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৬২৭)। গুপ্তযুগে স্থাপত্য শিল্পের বিকাশ ও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ যুগের বেশ কয়েকটি গুহা অজন্তা, ইলোরা ও ঔরঙ্গাবাদে এবং মধ্য প্রদেশের বাঘ-এ রয়েছে। অজন্তার দৃষ্টি নন্দন কয়েকটি গুহায় যে শিল্প কর্ম লক্ষ্য করা যায় তা যেমন অপূর্ব তেমনি শিল্প জগতে অনবদ্য সৃষ্টি। কাজেই উপরোক্ত আলোচনায় দেখা যায় গুপ্তযুগে বৌদ্ধ ধর্ম রাজাদের সক্রিয় পোষকতা না পেলেও সহযোগিতা লাভ করেছিল।

গুপ্ত যুগোত্তর ও পালযুগ   
খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকের প্রথম দশকে রাজা শশাঙ্ক গৌড়ের সিংহাসনে আরোহণ করেন। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত থেকে জ্ঞাত হওয়া যায়, রাজা শশাঙ্ক ব্রাহ্মণ্য-ধর্মের গোড়া সমর্থক ও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন; পক্ষান্তরে বৌদ্ধধর্ম বিদ্বেষী ছিলেন। তিনি বৌদ্ধধর্মের বিনাশ সাধনে আপ্রাণ প্রচেষ্টা করেছিলেন। বোধিবৃক্ষের মূলোৎপাটনসহ বৌদ্ধ মন্দির-বিহার ধ্বংস, বৌদ্ধ হত্যা, উৎপীড়ন ইত্যাদি দ্বারা বাংলাদেশসহ তাঁর রাজ্য থেকে বৌদ্ধধর্ম উৎখাত করার  চেষ্টা করেছিলেন বটে কিন্তু হাজার বছরের একটি ধর্মবিশ্বাস এবং বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর একটি সুপ্রতিষ্ঠিত ধর্মমতকে নিশ্চিহ্ন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকের বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য চীনা পরিব্রাজকদের বিবরণীতে পাওয়া যায়। পরিব্রাজকদের মধ্যে হিউয়েন সাঙের বিবরণই সমধিক প্রসিদ্ধ ও তথ্যসমৃদ্ধ। তিনি রাজা শশাঙ্কের মৃত্যুর কিছুকাল পরেই ৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে আগমন করেছিলেন। বৌদ্ধধর্ম চর্চার কেন্দ্রগুলো স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করার জন্য তিনি কজঙ্গল, পুণ্ড্রবর্ধন, সমতট, কর্ণসুবর্ণ, তাম্রলিপ্তি প্রভৃতি জনপদ পরিভ্রমণ করেছিলেন। তিনি কজঙ্গলে ছয়-সাতটি বিহারে ছয় শতাধিক ভিক্ষু বাস করতে দেখেছিলেন। কজঙ্গলের উত্তরাংশে গঙ্গার অনতিদূরে বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীর প্রতিমা সম্বলিত ইট ও পাথরের তৈরি একটি বৃহৎ মন্দিরের কথাও তিনি উল্লেখ করেছেন। পুণ্ড্রবর্ধনের বিশটি সংঘারামে তিনি হীনযান ও মহাযান সম্প্রদাযের তিন হাজারাধিক ভিক্ষু প্রত্যক্ষ  করেছিলেন। এ সময়কার সর্ববৃহৎ বিহারটি ছিল পুণ্ড্রবর্ধনের রাজধানীর তিন মাইল পশ্চিমে এবং এর নাম ছিল পো-সি-পো বিহার। এ বিহারে সাত শত ভিক্ষু বাস করতেন, তাঁদের মধ্যে অনেকে ছিলেন বিভিন্ন শাস্ত্রে সুপণ্ডিত। বিহারের অনতিদূরে ছিল একটি অবলোকিতেশ্বরের মন্দির। হিউয়েন সাঙ সমতট অঞ্চলে ত্রিশটি বিহার দেখেছিলেন এবং এসব বিহারে দুই হাজারের বেশি হীনযানী ভিক্ষু বাস করতেন। কর্ণসুবর্ণেও দশাধিক বিহারে দুই হাজারাধিক ভিক্ষু বসবাস করতেন। এঁরা ছিলেন সম্মতীয় বা সর্বাস্তিবাদী। কর্ণসুবর্ণের রাজধানীর অনতিদূরে রক্তমৃত্তিকা বিহার (লো-টো-মো-চিহ্) অবস্থিত ছিল। এ বিহারে বহু স্বনামখ্যাত ভিক্ষু-শ্রমণ বাস করতেন। হিউয়েন সাঙ জনশ্র“তির উপর নির্ভর করে বলেছেন যে, কর্ণসুবর্ণে বৌদ্ধধর্ম প্রচারিত হবার পূর্বেই জনৈক দক্ষিণ ভারতীয় বৌদ্ধ ভিক্ষুর সম্মানার্থে দেশের রাজা এই বিহার নির্মাণ করেছিলেন। তিনি তাম্রলিপ্তিতেও দশটির অধিক বিহার প্রত্যক্ষ করেছিলেন। এসব বিহারে এক হাজারের বেশি ভিক্ষু বাস করতেন। অথচ ফা-হিয়েন যখন বাংলাদেশে এসেছিলেন তখন তাম্রলিপ্তিতে বাইশটি বিহার ছিল। হিউয়েনের উনত্রিশ বছর পর অপর চীনা পরিব্রাজক ইৎ সিং (আগমন ৬৭৩ খ্রি:) যখন তাম্রলিপ্তিতে আগমন করেন তখন সর্বাস্তিবাদী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের প্রাধান্য ছিল। তিনি তখন সমতটে চার-হাজারাধিক ভিক্ষু-ভিক্ষুণী প্রত্যক্ষ করেছিলেন।
হিউয়েন সাঙের বিবরণ অনুযায়ী গবেষকগণ অনুমান করেন যে, তাঁর সময়ে অধিকাংশ বাঙালি শ্রমণই ছিলেন থেরবাদী বা হীনযানপন্থী, এক চতুর্থাংশের কিছু বেশি ছিলেন মহাযান মতের অনুসারী (রায়, প্রাগুক্ত পৃঃ ৫০৩; দাশগুপ্ত, প্রাগুপ্ত, পৃ: ৫০)। ইৎ সিঙ তাম্রলিপ্তির বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন। এতে জানা যায় যে, তখনকার ভিক্ষুগণের জীবন বৌদ্ধধর্মের উচ্চ আদর্শ ও বিধি-বিধানের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত। তাঁরা সংসার জীবন পরিহার করে চলতেন। ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীর দেখা হলে তাঁরা উভয়েই অত্যন্ত সংযত ও বিনয় সম্মত আচরণ করতেন। ভিক্ষুণীরা যখনই বাইরে যেতেন অন্তত দুইজন একত্রে যেতেন (মজুমদার, প্রাগুক্ত, পৃ: ২০১ : রায়, প্রাগুক্ত, পৃ: ৫০৪)।

 রাজা শশাংকের সমসাময়িককালে সমতটে খড়গবংশীয় কয়েকজন বৌদ্ধ রাজা আনুমানিক ৬৩০-৭০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যšত রাজত্ব করেছিলেন। এ বংশের রাজা খড়গোদ্যম. তাঁর পুত্র ‘জাতখড়গ, তাঁর পুত্র দেব খড়গ এবং তাঁর পুত্র রাজরাজ ভট্ট সকলেই মহাযানধর্মমতের পরিপোষক ছিলেন। খড়গ বংশের পরে সমতটে দেববংশীয় কয়েকজন রাজা আনু. ৭২০-৮২৫ খ্রি. পর্যন্ত রাজত্ব করেন। তাঁদের মধ্যে শ্রী শান্তিদেব, শ্রী বীরদেব, শ্রী আনন্দ দেব ও শ্রী ভবদেব নামে চারজন রাজার নাম জ্ঞাত হওয়া যায় যারা প্রত্যেকে বৌদ্ধধর্মের অনুসারী ও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। মূলত এ সময়েও মহাযান ধর্মমতই পোষকতা লাভ করেছিল। যদিও পাশাপাশি হীনযানী বৌদ্ধের সংখ্যা অধিক ছিল। গুপ্তযুগে ফা-হিয়েন (৪০৬-৪১১ খ্রি:) বাংলা তথা ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্মের যে জমজমাট অবস্থা লক্ষ্য করেছিলেন হিয়েন সাঙের সময়ে (৬৩০-৬৪৩ খ্রি:) তা অনেকটা হীনবল ও ম্রীয়মান হয়ে পড়েছিল। তিনি তখন বহু বিহার-সংঘারাম ভগ্ন কিংবা পরিত্যক্ত অবস্থায় দেখতে পান। রাজা শশাংকের মৃত্যুর পর প্রায় শতাধিক বছর বাংলার ইতিহাস একপ্রকার তমসাবৃত। তখন দেশে কোনো স্থায়ী রাজা ছিলেন না। প্রত্যেক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বণিকগণ নিজ নিজ এলাকা স্বাধীনভাবে শাসন করতেন। একজনকে হত্যা কিংবা অপসারণ করে অন্যজন শাসনভার গ্রহণ করতেন। দেশে চরম অস্থিরতা বিরাজ করত। জনসাধারণের দুর্দশার অšত ছিল না। এই অরাজকতার নাম ‘মাৎস্যন্যায়’। এই চরম দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্তি লাভের জন্য বাঙালি জাতি যে রাজনৈতিক বিজ্ঞতা, দূরদর্শিতা ও আত্মত্যাগের পরিচয় দিয়েছিল, ইতিহাসে তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। দেশের প্রবীণ নেতা ও বিজ্ঞ ব্যক্তিগণ পরস্পর বিবাদ-বিসম্বাদ ভুলে গিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে একজনকে স্বেচ্ছায় রাজা নির্বাচিত করলেন। নির্বাচিত সেই ব্যক্তির নাম গোপাল। গোপাল বাংলার রাজা নির্বাচিত হন ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে। এরপর মগধ জয় করে তিনি তাঁর রাজ্যভূক্ত করেন। গোপাল এবং তাঁর বংশের প্রায় সতের জন রাজা বাংলা মগধসহ একটি বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে দীর্ঘ চারশত বছর শাসন করেছিলেন। এ বংশের রাজাদের মধ্যে ধর্মপাল (৭৭০-৮১০ খ্রি:), দেবপাল (৮১০-৮৪৭ খ্রি:), মহীপাল (৯৭৭-১০২৭ খ্রি:), নয়পাল (১০২৭-১০৪৩ খ্রি:) প্রমুখ রাজন্যবর্গ ছিলেন পরাক্রমশালী। পাল বংশীয় সবকয়জন রাজাই ছিলেন বৌদ্ধ। বাংলার পালরাজগণ ভারতের বৌদ্ধধর্মের শেষ রক্ষক হিসেবে সমগ্র বৌদ্ধজগতে শ্রেষ্ঠ সম্মানের আসনে সমাসীন। তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় বৌদ্ধধর্ম বাংলা-বিহারে আরও চারশতাধিক বছর সগৌরবে বিরাজ করেছিল। পাল রাজগণ ছিলেন সকলেই মহাযান ধর্মমতের অনুসারী। ফলে তাঁদের প্রত্যক্ষ পোষকতায় মহাযান ধর্মমত ব্যাপক বি¯তার ও প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল; প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল শত শত বৌদ্ধ বিহার, মহাবিহার, নির্মিত হয়েছিল হাজার হাজার মহাযানী বৌদ্ধ মূর্তি। এসময়ে  মহাযান ধর্মমতও বিবর্তিত হয়ে সৃষ্টি হয় মন্ত্রযান, বজ্রযান, তন্ত্রযান, কালচক্রযান, সহজযান ইত্যাদি। পাল রাজত্বে বাংলা বিহারে কোনো হীনযানী বৌদ্ধ ছিলেন কিনা, থাকলেও তাদের কোনো তথ্য জানা যায় না। সম্ভবত তাঁদের সংখ্যা ধীরে ধীরে সংকোচিত হয়ে এসেছিল। যেহেতু পাল রাজাগণ মহাযানীদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন; সুতরাং অন্য মতের অনুসারী অর্থাৎ হীনযানীরাও হয়ত মহাযানে বিশ্বাসী হয়ে ওঠেছিল। অথবা স্বল্প সংখ্যক হীনযান মতাবলম্বী থাকলেও তাঁদের উল্লেখযোগ্য পদচারণা ছিল না।

বাংলায় বৌদ্ধধর্মের অন্ধকার যুগ
পাল সাম্রাজ্যের পতনের পর বর্মণ ও সেন বংশীয় রাজগণ বাংলার শাসনভার গ্রহণ করেন। সেন ও বর্মণ রাজাদের রাজত্বকালে বাংলায় বৌদ্ধধর্মের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে ঐতিহাসিক নীহার রঞ্জন রায় লিখেছেন,
        “ এই পর্বের বাঙলার সর্বব্যাপী সর্বগ্রাসী ধর্মই হইতেছে ব্রাহ্মণ্যধর্ম এবং সেই ব্রাহ্মণ্যধর্ম বেদ ও পুরাণ, শ্রুতি ও স্মৃতি দ্বারা শাসিত ও নিয়ন্ত্রিত এবং তন্ত্র দ্বারা উদ্ভুত। এই দেড়শত বৎসরের বাঙলার আকাশ একাতই ব্রাহ্মণ্যধর্মের আকাশ, বজ্রযানী, সহজযানী, কালচক্রযানী বৌদ্ধরা নাই, কিংবা তাঁদের ধর্মাচারণানুষ্ঠান তাঁহারা করিতেছেন না, এমন নয়, কিন্তু তাঁহাদের কণ্ঠ ক্ষীণ, শিথিল এবং কোথাও কোথাও নিরুদ্ধপ্রায়। বৌদ্ধ দেব-দেবীর মূর্তি বিরল। (বাঙ্গালীর ইতিহাস, প্রাগুক্ত, পৃ: ৫৪৩)।”
বর্মণ-সেন বংশীয় রাজন্যবর্গের বিদ্বেষপূর্ণ বিরোধিতার কারণে বৌদ্ধধর্মের শেষ আশ্রয়স্থল বাংলাদেশ থেকেও তিরোহিত হতে বাধ্য হয়। সচেতন প্রচেষ্টায় বৌদ্ধধর্ম, বৌদ্ধবিহার ও বৌদ্ধমূর্তি হিন্দুধর্মে বিলীন হয়ে যায়। এসময়ে তাঁরা শুধু বৌদ্ধদের অত্যাচার ও তাদের ধর্ম নষ্ট করে ক্ষাšত হয়নি। তারা এতকালের সঞ্চিত বৌদ্ধ ভান্ডারের সর্বৈব লুণ্ঠন করে লুণ্ঠিত দ্রব্যাদির উপর নিজেদের নামাঙ্কের ছাপ দিয়ে সামগ্রিকভাবে সর্ববিধ নিজস্ব করে নেয়। হিন্দুদের পরবর্তী ন্যায়,দর্শন,ধর্মশাস্ত্র ইত্যাদির মধ্যে এ লুণ্ঠনের পরিচয় পাওয়া যায়। এভাবে হিন্দুগণ কর্তৃক বৌদ্ধধর্মের ঐতিহ্যময় ইতিহাস বিলোপ প্রাপ্ত হয়েছে। এজন্য হিন্দুরাই একমাত্র দায়ী (সেন, দীনেশচন্দ্র, বৃহৎবঙ্গ, কলিকাতা, ১৩৪১, পৃ: ৮)।
বর্মণ-সেন রাজবংশের অবসানের পর খ্রিস্টীয় তের শতকের প্রথম পাদে তুর্কী মুসলিম সেনারা বাংলা অধিকার করেন। এসময়ে বাংলায় বৌদ্ধরা আরও নিষ্ঠুরতার শিকার হন। বর্মণ-সেনদের নিপীড়নে বৌদ্ধরা ইতিপূর্বেই নি:তেজ ও নি:প্রভ হয়ে গিয়েছিল। মুসলিম সেনাদের আক্রমণে এ পর্যায়ে তারা বাংলার বুক থেকে বিলীন হয়ে গিয়েছিল। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেন, “মুসলমান বিজয়ে বৌদ্ধ মন্দিরের ও বৌদ্ধ দর্শনের একেবারে সর্বনাশ হইয়া গেল। উহাতে ব্রাহ্মণদের প্রভাব বৃদ্ধি হইল বটে কিন্তু বৌদ্ধদের বদলে এখন মুসলমান মৌলবি ও ফকির তাহাদের প্রবল বিরোধী হইয়া উঠিল। সুতরাং দেশের যেখানে যাহার জোর বেশি সেখানে আধিপত্য বিস্তৃত হইয়া পড়িল। এইরূপে বাংলার অর্ধেক বৌদ্ধ মুসলমান হইয়া গেল এবং অপর অর্ধেক ব্রাহ্মণের শরণাপন্ন হইল, আর বৌদ্ধদিগের মধ্যে যাহারা তখন নিজের পায়ে দাঁড়াইবার চেষ্টা করিল মুসলমান ও ব্রাহ্মণ উভয় পক্ষ হইতেই তখন তাহাদের উপর নির্যাতন উপস্থিত হইল। ব্রাহ্মণেরা তাহাদিগকে অনাচরণীয় করিয়া দিলেন অর্থাৎ অসভ্য, বাগদি, কৈবর্ত, কিরাতের মধ্যে ফেলিয়া দিলেন; মুসলমানেরা তাহাদের উপর নানারূপ দৌরাত্নয করিতে লাগিল (হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রচনা সংগ্রহ, ৩য় খণ্ড, ১৯৮৪, পৃঃ ৪৯২-৯৩)।”

বাংলাদেশের দক্ষিণ- পূর্বাঞ্চলে     
        বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল বিশেষ করে বৃহত্তর চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা জেলায় (অংশ বিশেষ) বৌদ্ধধর্মের প্রচারকাল থেকে কখনো সম্পূর্ণরূপে উচ্ছেদ হয়নি। গবেষক আবদুল হক চৌধুরী আরাকানের প্রাচীন রাজাদের ইতিহাস ‘রাজোয়াং’-এর সূত্র উল্লেখ করে বলেছেন যে, ১৪৬ খ্রিস্টাব্দে মগধের চন্দ্র-সূর্য নামক একজন সামšত সৈন্যসেনা নিয়ে আদিম জড়োপাসক জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত ও পশ্চাৎপদ অঞ্চল চট্টগ্রাম-আরাকান অধিকার করে রাজপদে অধিষ্ঠিত হন। তিনি এ অঞ্চলে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেন। তখন থেকে খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতক অবধি চট্টগ্রাম ও আরাকান একটি অখন্ড রাজ্যরূপে আরাকানের চন্দ্র-সূর্য বংশীয় রাজবংশের রাজাদের দ্বারা শাসিত হয়েছিল। (চট্টগ্রামের বৌদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য, প্রবন্ধ বিচিত্রা, বাংলা একাডেমী, ঢাকা ১৯৯৫, পৃ: ১৩০)। ষষ্ঠ শতকে চট্টগ্রাম সমতটের খড়গ রাজবংশের বৌদ্ধ রাজাদের এবং সপ্তম শতকে সমতটের বৌদ্ধ দেব রাজবংশের রাজাদের দ্বারা শাসিত হয়েছিল। ৮ম শতকের প্রথমার্ধে আরাকানের এবং দ্বিতীয়ার্ধে বাংলার পাল বংশের রাজা ধর্মপালের শাসনাধীনে ছিল। নবম শতকে বৌদ্ধ হরিকেলরাজ কাšিতদেবের অধীন ছিল। তখন চট্টগ্রাম বৌদ্ধ জ্ঞান চর্চার কেন্দ্রস্থল ছিল। দশম শতকের প্রথমার্ধে চট্টগ্রাম পাট্টিকারা চন্দ্রবংশের রাজাদের শাসনাধীন ছিল। এসময়ে চট্টগ্রাম পন্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল। এটা ছিল মহাযান তথা তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম চর্চা ও প্রচারের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। পটিয়ার তিলোপাদ এর প্রধান ছিলেন। দশম শতকের মধ্যম সময়ে (৯৫৩ খ্রি:) আরাকানরাজ সুলত-ইং-চন্দ্র রাজ্যের উত্তর সীমাšতবর্তী ভূখন্ডের থুরতন বা সুলতানকে পরাজিত করে কুমিরার কাউলিয়া ছড়ার দক্ষিণ তীর পর্যšত অগ্রসর হয়ে একটি বিজয়¯তম্ভ স্থাপন করত তাতে চিৎ-তৌৎ-গৌং ( যুদ্ধ করা অনুচিত) বাণী উৎকীর্ণ করে আরাকানে ফিরে যান। দশম শতকের শেষ দিকে ত্রিপুরারাজ থেং থু ফা অল্প সময়ের জন্য চট্টগ্রাম অধিকার করেন।
উল্লেখযোগ্য যে, খ্রিস্টীয় দশম শতক পর্যšত চট্টগ্রাম দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় মহাযানের বিবর্তিত রূপ তন্ত্রযান-মন্ত্রযানই চর্চা হতো বেশি এবং সাধারণ জনগণও ছিল তন্ত্রযান-মন্ত্রযানের অনুসারী। থেরবাদ ধর্মমতের অনুসারী ছিল কিনা, থাকলেও তাদের কোনো সন্ধান পাওয়া যায় না।

১০৫৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রহ্মদেশের পগারাজ অনরহট (অনিরুদ্ধ) উত্তর চট্টগ্রাম ও ১০৫৯ খ্রিস্টাব্দে  পাট্টিকারা (কুমিলা) পর্যšত জয় করেন। এ সময়ে ব্রহ্মদেশ, আরাকান, চট্টগ্রাম এবং পাট্টিকারায় প্রচলিত মহাযান বৌদ্ধমত উচ্ছেদ করে হীনযান বা থেরবাদ বৌদ্ধমত প্রচার করেন। (জি,ই, হারভে; আউটলাইন অব বার্মিজ হিস্ট্রী= পৃ; ২১; হক চৌধুরী, প্রগুক্ত, পৃ: ১৩৪)। আহমদ শরীফ সাহেবও এ মতের সমর্থনে বলেন,” খ্রিস্টীয় চার পাঁচ শতক অবধি আরাকান-চট্টগ্রাম একক অঞ্চল রূপে ছিল এবং দশ শতক- অবধি আরাকান ও চট্টগ্রামে মহাযান (সর্বা¯িতবাদী বা বিজ্ঞানবাদী) মত চালু ছিল। তবে তখনো ব্রাহ্মণ্যবাদ ¤লান হয়নি, প্রবলই ছিল। অনোরহটার রাজত্বকালে পঁগায় রাজকীয় সমর্থনে শিন অরহ গুরুবাদী মহাযান ‘আরি’ মত উচ্ছেদ করে হীনযানী থেরবাদ (গুরুবাদ) প্রবর্তন করেন। অনোরহটা ( ১০৪৪-৭৭) আরাকান ও চট্টগ্রামাদি অঞ্চল পট্টিকের’র সীমা পর্যšত জয় করে সেখানেও থেরবাদ চালু করেন (চট্টগ্রামের ইতিহাস, আগমনী প্রকাশনী, ঢাকা-২০০১, পৃ:২৯)।

এরপর ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যšত চট্টগ্রাম মাঝে মধ্যে স্বল্প সময়ের বিরতি ব্যতীত আরাকানী রাজাদের দ্বারা শাসিত হয়েছিল। ঐতিহাসিক যুগ থেকে চট্টগ্রাম আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে ত্রিপুরা রাজাদের স্বল্পকালের জন্য শাসনাধীন ছিল সাতবার এবং দীর্ঘ প্রায় হাজারাধিক বছরকাল আরকানী বৌদ্ধ রাজাদের অধীনে ছিল। শেষবার ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে উত্তর চট্টগ্রাম মোগল শাসনাধীন হলে বহু আরাকানী মঘ ভিটেবাড়ি ছেড়ে দক্ষিণ চট্টগ্রামে ও আরাকানে আশ্রয় গ্রহণ করে। ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে  সমগ্র  চট্টগ্রাম মোগল সেনাপতির পুত্র আধু খায় পুর শের জামাল খাঁ কর্তৃক বিজিত হলে চট্টগ্রামে বৌদ্ধ ধর্মের চরম বিপর্যয় নেমে আসে। রাখাইন বা মঘ সম্প্রদায়ের অনেকে আরাকানে আশ্রয় গ্রহণ করলেও বাঙালি বৌদ্ধরা চট্টগ্রামেই থেকে যায়। তাদের মধ্যে অনেকে রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক কারণে ধর্মাšতরিত হতে বাধ্য হয়। ফলে স্বল্প সংখ্যক বৌদ্ধ চট্টগ্রাম এবং কুমিল্লা অঞ্চলে টিকে রয়েছে।

বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও অন্যান্য অঞ্চলে যে বৌদ্ধগণ রয়েছেন, তারা হীনযান বা থেরবাদ মতাবলম্বী। সেই একাদশ শতকে ব্রহ্মরাজ অনরহটা বা অনিরূদ্ধ কর্তৃক থেরবাদ মত পুন প্রতিষ্ঠার পর আর কখনো মহাযান ধর্মমত প্রচলিত হয়নি। তবে আরাকান শাসনের অবসানের পর বৌদ্ধধর্ম সমাজ ও সংস্কৃতিতে বহু হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতি অনুপ্রবেশ করে, যার ফলে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মতো তারাও দুর্গাপূজা, লক্ষীপূজা, শনিপূজা, কালিপূজা, বদরের সিন্নি, মানিক পীরের সিন্নি, সত্যপীরের সিন্নি, গাজু-কালুর গান, মাজারে মানত ইত্যাদি সম্পাদন করত। ভিক্ষুসংঘ যারা ছিলেন তাদের মধ্যে অধিকাংশ ধর্ম-বিনয়ে পারদর্শী ছিলেন না। বাংলা ভাষায় বা অক্ষরে কোনো ধর্মীয় গ্রন্থও ছিল না। তাঁরা আরাকানী অনুকরণে সূত্র পাঠ কিংবা শীলাদি প্রদান করতেন। খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতকে চকরিয়া নিবাসী চন্দ্রজ্যোতি মহাস্থবির নামে একজন বাঙালি ভিক্ষু সম্পর্কে জানা যায় যে, তিনি তরুন বয়সে ব্রহ্মদেশের মৌলমেনে উপনীত হয়ে দীর্ঘ বিশ বছর ধর্ম-বিনয়-অধ্যয়ন করে সেদেশীয় দশজন ভিক্ষুসহ একখানা চক্রাসন, তিনটি ত্রিভঙ্গ বুদ্ধমূর্তি ও কয়েকটি বুদ্ধের অস্থিধাতু নিয়ে আগড়তলার লালমাই পাহাড়ে উপস্থিত হন। আগড়তলার রাজবংশীয় বলিভীম আদিত্য নামক জনৈক শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তি তাঁদের জন্য বিহার নির্মাণ করে দান করেন। চন্দ্রজ্যোতি মহাস্থবির সেখানে ১৪ হাত দীর্ঘ একটি পরিনির্বাণ মূর্তি নির্মাণ করে বিনয়ানুকুল ভীক্ষুসীমা প্রতিষ্ঠা করেন। সেই সীমায় পর্যায়ক্রমে একশতজন ব্যক্তিকে উপসম্পদা প্রদান করা হয়। কথিত আছে চন্দ্রজ্যোতি মহাস্থবির  পাঁচ বছর পর  আগড়তলা হতে স্বদেশে আগমন করেন এবং সীতাকুন্ডের উঁচু পাহাড়ে একটি বুদ্ধমূর্তি প্রতিষ্ঠা করে মন্দির নির্মাণ করেন। অপর দুটির মধ্যে একটি চট্টগ্রাম শহরের রঙমহলে ও অন্যটি ঠেগরপূণিতে প্রতিষ্ঠা করেন। চক্রাসনটি পটিয়ার চক্রসালায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। (বি¯তারিত দেখুন ধর্মতিলক স্থবির প্রণীত সদ্ধর্ম রত্নাকর, ১৯৩৬, পৃ: ৩০৯-৩১৪)।

আরাকান ও চট্টগ্রামের মধ্যে অবাধ যোগাযোগ এবং অনেক আরাকানী ভিক্ষু চট্টগ্রামে বসবাসের ফলে চট্টগ্রামে থেরবাদের আর তখন কোনো বিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না। যে অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটেছিল তা শোধনে মহামান্য প্রথম সংঘরাজ সারমেধ মহাস্থবিরের অবদান চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে। সংঘরাজ সারমেধ মহাস্থবির ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে চকরিয়া থানার হারবাং গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত রাখাইন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে হারবাঙের তদানীšতন বিহারাধ্যক্ষ ভদšত শরণালংকার মহাস্থবিরের উপাধ্যায়ত্বে উপসম্পদা গ্রহণ করেন। তিনি ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে উপাধ্যায়সহ আরাকানে গমন করেন এবং ছেরাগ্যা নদীর দক্ষিণতীরে গদুভাঙ্গা খাড়ির উপকুলে সেখানকার দায়কগণ কর্তৃক নির্মিত বিহারে বাস করেন। গুরুর মৃত্যুর পর ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিহারের অধ্যক্ষের পদ গ্রহণ করেন। ( বি¯তারিত দেখুন মৎ প্রণীত বাঙালি বৌদ্ধদের ইতিহাস ধর্ম ও সংস্কৃতি, পৃ: ১২৭ )। পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রামের খ্যাতনামা পন্ডিত মাননীয় রাধাচরণ মহাস্থবিরের সাথে সারমেধ মহাস্থবিরের সাক্ষাৎ ঘটে ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় মতাšতরে বুদ্ধগয়ায়। রাধাচরণ মহাস্থবিরের আমন্ত্রণক্রমে সারমেধ মহাস্থবির ১৮৫৬ সালে চট্টগ্রামে আগমন করেন। এসময়ে তিনি চট্টগ্রামে বহু সভায় ধর্মদেশনা প্রদান করেন এবং তাঁর দেশনা বাংলায় অনুবাদ করে দিতেন রাধাচরণ মহাস্থবির। মাননীয় সারমেধ মহাস্থবির পুনরায় ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম আসেন এবং এসময়ে তাঁর নিকট অনেকে পুন উপসম্পদা গ্রহণ করেন। যারা তাঁর নিকট উপসম্পদা গ্রহণ করেন তারা হলেন “সংঘরাজ নিকায়” ভুক্ত ভিক্ষু তাঁরা তাঁর নিকট পুণ দীক্ষা গ্রহণ করেননি তাঁরা “মহাস্থবির নিকায়” নামে পরিচিতি লাভ করেন।

বর্তমানে বাঙালি বৌদ্ধদের দুটি নিকায় ও রাখাইন,মারমা ও চাকমা সম্প্রদায় দুটি নিকায় রয়েছে-একটি দোয়ারা নিকায় ও অন্যটি সুধর্মা নিকায়। দোয়ারা ও সুধর্মা নিকায়ের ভিক্ষুগণ সংঘরাজ ও মহাস্থবির উভয় নিকায়ের ভিক্ষুদের সঙ্গে বিনয়কর্ম সম্পাদন করেন। কিন্তু সংঘরাজ ও মহাস্থবির নিকায়ের ভিক্ষুদের মেলামেশা থাকলেও বিনয় কর্ম সম্পাদিত হয় না।

উপসংহার
বাংলাদেশে অতি অল্প সংখ্যক বৌদ্ধ বর্তমানে বাস করে। তারা আবার নৃতাত্ত্বিক ও জাতিসত্তায় এবং সংস্কৃতিতে বিভাজিত। যেমন-সমতলী বাঙালি বড়ুয়া বৌদ্ধ, রাখাইন বৌদ্ধ, আদিবাসী মারমা বৌদ্ধ, চাকমা বৌদ্ধ, তঞ্চংগ্যা বৌদ্ধ ইত্যাদি। খ্রিস্টীয় একাদশ শতক থেকে বৃহত্তর চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কুমিল্লা  ও আরাকানের রাজা অনরহট (১০৪০-১০৭৭ খ্রি:) বা অনিরুদ্ধ মহাযানের উচ্ছেদ সাধন করে যে থেরবাদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তার ধারাবাহিকতা এখনো চলমান। যদিও চট্টগ্রামে আরাকান শাসনের অবসানের পর বৌদ্ধধর্মে ও সমাজে বহু ভিন্ন ধর্মীয় সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করে থেরবাদ ধর্ম ও আদর্শকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ম্লান করেছিল, কিন্তু সংঘরাজ সারমেধ মহাস্থবিরের আগমন ও সংঘের সংস্কার সাধন এবং পরবর্তীতে আরো বহু মনীষীর আšতরিক প্রচেষ্টায় বর্তমানে প্রায় পরিশীলিত একটি থেরবাদ ধর্মমত বাংলাদেশে প্রচলিত আছে - একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

কোনো ব্যক্তি ভিক্ষু সে যে নিকায়েরই হোক না কেন, যদি সে থেরবাদী বিধান অনুশীলন না করে, তাহলে কারো কিছু করার নেই; তার প্রতিকার হয়তো সংঘ করতে পারেন। কোনো তথাকথিত ভিক্ষু যদি তার নৈতিক আদর্শ হতে চ্যুত হয়ে মহাযানী ভাবধারায় কিংবা কোন যানবিহীন ধারা বা আদর্শবর্জিত হয়ে বাস করে তাহলে তার জন্য সমগ্র নিকায় দায়ী হতে পারে না। এ ধরণের নীতি আদর্শ বর্জিত কিছু ভিক্ষু সবখানেই থাকতে পারে- এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। তবে এসব আদর্শহীন ধর্মবিনয় লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হলে বাংলাদেশে প্রচলিত থেরবাদ আদর্শ দীর্ঘকাল প্রবাহমান থাকবে বলে আমার বিশ্বাস। 

No comments

Theme images by 5ugarless. Powered by Blogger.