প্রকৃত জীবন

অনুবাদক- প্রকাশ দেওয়ান


আমরা ভারসাম্য পীড়িত পৃথিবীতে বসবাস করি। এটি যেমন গোলাপ শোভিত নয়, তেমনি কন্টকময়ও নয়। গোলাপ সুন্দর, নরম ও সুরভিত বা সুগন্ধিযুক্ত, কিন্তু সে গোলাপ ফুলের ডাঁটা বৃদ্ধি ঘটে যা কাঁটায় পরিপূর্ণ। কারন গোলাপ যিনি ধারণ করবেন তাঁকে কাঁটা সহ্য করতে হবে। এতএব গোলাপ কাঁটাযুক্ত হলেও যে কেহ একে অপছন্দ করতে পারেন না।
যাঁরা সুখবাদী, তাঁরা মনে করেন যে এ পৃথিবী সম্পূর্ণরূপে গোলাপ শোভিত। আর যাঁরা দুঃখবাদী, তাঁরা মনে করেন যে এ জগৎ আসলে কন্টকময়। কিন্তু যাঁরা বাস্তববাদী, তাঁরা এ পৃথিবীকে পরিপূর্ণরূপে গোলাপ শোভিত মনে করেন না অথবা কন্টকময়ও মনে করেন না। অর্থাৎ সুন্দর গোলাপ যেমন থাকতে পারে তেমনি চতুর্দিকে তীক্ষè কাঁটাও থাকতে পারে।
যাঁরা বোধশক্তিসম্পন্œ, তাঁরা গোলাপের সৌন্দর্যে বিমোহিত হন না। কিন্তু তাঁরা গোলাপকে দেখে থাকেন ঠিক গোলাপ দেখতে যেমন দেখায়। কাঁটার স্বভাব ভালভাবে জ্ঞাত হয়ে তাঁরা একে দর্শন করে থাকেন ঠিক একে দেখতে যেমন দেখায় এবং যাতে তা আঘাতপ্রাপ্ত না হয়। সেজন্য পূর্ব সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আমাদের এ জগতে চারি ধরণের কাঙ্খিত ও অনাকাঙ্খিত জিনিসের উদ্ভব হয় কিন্তু কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রত্যেকেই এসব বস্তুর অবশ্যই মুখোমুখী হতে হবে। এগুলো হলো ঃ
১.    লাভ এবং অলাভ
২.    যশ এবং অযশ
৩.    নিন্দা এবং প্রশংসা
৪.    সুখ এবং দুঃখ।
১. লাভ এবং অলাভ ঃ
সাধারণ নিয়মে যাঁরা ব্যবসায়ী তাঁরা লাভ এবং অলাভ অর্থাৎ ক্ষতির সম্মুখীন হন। যখন তাঁরা লাভের মুখ দেখে থাকেন তখন স্বভাবতই তাঁরা আতœ প্রসন্ন হয়ে উঠেন। তাতে খারাপ কিছু চিন্তা করার অবকাশ নেই। এমন লাভের মুখ দেখলে স্বাভাবিকভাবে আনন্দ পাওয়ারই কথা যা গড়ে প্রত্যেক মানুষ এ রকম আনন্দ পেতে চেষ্টা করেন। এ ধরণের ক্ষণস্থায়ী আনন্দঘন মুহুর্ত বাদ দিলেও জীবনে বেঁচে থাকবার কোন স্বার্থকথা থাকবে না। প্রতিযোগিতামূলক এ বিশ্বে এটিই সত্য যে লোকজন তাঁদের মনে ফূর্তি যোগানের উদ্দেশ্যে কম-বেশী আনন্দ উপভোগ করবেন। এ সুখ যদিও বস্তুগত তা স্বাস্থ্য ও দীর্ঘ দিন বেঁচে থাকতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। কিন্তু সমস্যা তখনই সৃষ্টি হয় যখন অলাভ অর্থাৎ ক্ষতির মুখোমুখি হয়। মানুষ সব সময় লাভ চায়, অলাভ কেহ চায় না। মানুষ লাভকে আনন্দের সাথে গ্রহণ করে পক্ষান্তরে ক্ষতিকে সেভাবে গ্রহণ করতে পারেন না। অলাভ বা ক্ষতি প্রায়ই মানসিক অশান্তি ডেকে আনে এবং মাঝে মাঝে আতœ হত্যা প্রবণতার জন্ম দেয় যখন ক্ষতির পরিমাণ বেশী হয় বা নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করে থাকে। তাহলে দেখা যায় এর এরুপ প্রতিকূল অবস্থা। সেজন্য প্রত্যেককে উন্নত, নৈতিক সাহস এবং যথার্থ মানসিক ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। এ জীবনে প্রত্যেকের উত্থান-পতন আছে। প্রত্যেকেই ভাল ও মন্দের জন্য তৈরী থাকতে হবে। তখন হতাশার পরিমাণ কম হবে।
বুদ্ধের সময়ে এক সম্ভ্রান্ত মহিলা আয়ুষ্মান সারীপুত্র ও কিছু ভিক্ষুকে পিন্ড দানের সময় এক লোক তাঁকে অর্থাৎ মহিলাটিকে একটি চিরকূট তাঁর হাতে অর্পণ করলেন তাতে অর্থাৎ চিরকূটে একটি দুঃসংবাদ (মহিলাটির ব্যবসায়ী স্বামীর মৃত্যু সংবাদ – পথিমধ্যে ডাকাতের হাতে নিহত) উল্লিখিত আছে। মহিলাটি কোন ধরণের হতাশ না হয়ে উক্ত চিরকূটটি তাঁর কোমর গাটুনীতে রেখে দিলেন এবং ভিক্ষুদের স্বাভাবিকভাবেই আপ্যায়ন করলেন। এমন সময় আরও এক পরিচারিকা এক পট ঘি নিয়া ভিক্ষুদের উদ্দেশ্যে দান করবার সময় হঠাৎ অসাবধানতাবশতঃ এক ধাক্কায় দেহের সঙ্গে সংষ্পর্শ হয়ে ঘি পটটি নীচে পড়ে ভেঙ্গে গেল। তা দর্শনে স্বভাবতই মহিলাটি দুঃখ প্রকাশ করল। তখন আয়ুষ্মান সারীপুত্র সান্তনার বাণী শুনালেন এবং বললেন ঃ “সকল ভঙ্কুর জিনিস ভাঙ্গার জন্য দায়ী।” বিজ্ঞ মহিলা প্রত্যুত্তরে বললেন ঃ “ভন্তে, এ তুচ্ছ জিনিসে কি হয়!” আমি এইমাত্র এক চিরকূটে উল্লিখিত আমার স্বামীর মৃত্যু সংবাদ অবগত হয়েছি। আমি কোন প্রকারে ভারসাম্য না হারিয়ে তা গ্রহণ করেছি। আমি এ রকম দুঃসংবাদ সত্ত্বেও আপনাদের যথানিয়মে সকলকে আপ্যায়ন করে গিয়েছি। এমন সাহসী মহিলা সত্যিই প্রশংসার যোগ্য।
এক সময় এক গ্রামে বুদ্ধ ভিক্ষান্নে প্রবেশ করলেন। মার-এর প্রভাবে বুদ্ধ কোন ধরণের খাদ্য লাভ করতে পারেননি। মার যখন বুদ্ধকে তিরস্কারস্বরূপ প্রশ্ন করলেন তিনি কোন প্রকার ক্ষুধার্ত ছিলেন কিনা। বুদ্ধ প্রত্যুত্তরে বললেন ঃ “কোন ধরণের বাধা-বিপত্তি ছাড়া সুখেই আমরা জীবন-ধারন করি। অন্ন দাতার দানেই আমাদের সন্তুষ্ঠ থাকতে হয়।” অন্য এক উপলক্ষ্যে বুদ্ধ ও তাঁর শিষ্যমন্ডলী এক ব্রাহ্মণের আমন্ত্রণে বর্ষাবাস পালনের নিমিত্তে এক গ্রামে গিয়েছিলেন। কিন্তু ব্রাহ্মণ বুদ্ধ ও তাঁর শিষ্যমন্ডলীর প্রয়োজনীয় সেবা প্রদানের কথা অর্থাৎ তিনি তাঁর কর্তব্য পালনের কথা প্রায়ই ভূলে গিয়েছিলেন। উক্ত তিন মাস সময়ে যদিও আয়ুস্মান মো¹লায়ন তাঁর ঋদ্ধির প্রভাবে প্রয়োজনীয় খাদ্য-সামগ্রী লাভে সহায়তা করেছিলেন। এ ব্যাপারে বুদ্ধ কোন অভিযোগ করেননি।
এতএব অলাভ অর্থাৎ ক্ষতিকে প্রত্যেকে অবশ্যই পুরুষোচিত বীর্যের সহিত উৎফুল্লভাবে ধারণ করবার চেষ্টায় রত থাকতে হবে যদিও প্রত্যেকে অপ্রত্যশিতভাবে ঐসব অনাকাঙ্খিত বিষয়ের মুখোমুখি হতে হয়।
২. যশ এবং অযশ ঃ
যশ এবং অযশ হলো এমন এক অনিবার্য পার্থিব অবস্থা যা আমরা দৈনন্দিন জীবনে মুখোমুখি হই। যশ বা সম্মানকে আমরা সবাই স্বাগত জানাই আর অযশ বা অসম্মানকে আমরা ঘৃণাচিত্তে প্রত্যাখ্যান করে থাকি। যশ বা সম্মান আমাদের সুখী করায় আর বিপরীতদিকে অযশ বা অসম্মান আমাদেরকে দুঃখী করায়। আমরা সবাই বিখ্যাত হতে চাই। আমরা পত্রিকায় আমাদের ছবি দেখতে চায়। আমরা অনেক বেশী সন্তোষ প্রকাশ করে থাকি যখন আমাদের কার্যক্রম তা যতই গুরুত্বহীন হোক প্রচার মাধ্যমে যায়। অনেক সময় আমরা স্বার্থের কথা বিবেচনা করে অনুচিত প্রচার কার্যও চালিয়ে থাকি।
অনেকেই যে কোন মূল্যে যে কোন ম্যাগাজিনে তাঁদের ছবি দেখতে আগ্রহ প্রকাশ করে থাকে। যশ বা সম্মান অর্জনে কেউ কেউ আবার পুরষ্কার প্রদানে অথবা অনুদান দিতে প্রস্তুত থাকে। প্রচারের উদ্দেশ্যে কেউ কেউ শত শত ভিক্ষু বা এর চেয়েও বেশী ভিক্ষুকে ভিক্ষান্ন দিয়েতাঁদের উদারতা প্রদর্শন করে থাকেন। কিন্তু তাঁরা গরীব বা অসহায় বা সহায়সম্বলহীনদের পাশে এসে দাড়ান না এবং এদের দুর্দশায় পুরোপুরি উদাসীন থাকেন। এসবই মানুষের দৌর্বল্য অর্থাৎ নৈতিক ত্রুটি। অধিকাংশ লোকের পর্দার অন্তরালে উদ্দেশ্য থাকে। বলতে দ্বিধা নেই কারা যথার্থরূপে ভালো? কত জনই বা তাঁদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে যথার্থরূপে পরিশুদ্ধ? কত জনই বা সম্পূর্ণরূপে পরার্থপর বা স্বার্থহীন? আমাদের যশ বা সম্মানের পিছনে দৌড়াতে হবে না। যদি আমরা সম্মানের যোগ্য হই। এটি আপনা-আপনিই আমাদের কাছে চলে আসবে। মৌমাছি ফুলের আকর্ষণে আসবে। ফুল মৌমাছিকে ডেকে আনবে না। আমরা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী পরিমাণে সুখী হই যখন আমাদের যশ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু আমাদের অবশ্যই জ্ঞাত হওয়া উচিত যে যশ বা সম্মানও একদিন নিঃশেষ হয়ে যায়। যথা সময়ে তা বায়ুর সঙ্গে মিলিয়ে যায় বা অদৃশ্য হয়ে যায়।
অযশ বা অসম্মানই বা কিরূপ? এটিও মন-চিত্তে বা কর্ণে কোনটাতেই প্রীতিকর নয়। আমরা নিঃসন্দেহে উদ্বিগ্ন হই যখন অশ্রবণীয় বাক্য আমাদের কানে বিদ্ধ করে। সেই তথাকথিত অশ্রবণীয়, অন্যায্য ও সম্পূর্ণরূপে মিথ্যা ভাষণ আমাদের মনে কাঁটা দেয়। স্বাভাবিকভাবে একটি অট্টালিকা তৈরী করতে বছরের উপর সময়ের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। আধুনিক মারণাস্ত্র দিয়ে তা কিছু সময়ের মধ্যে সহজেই ধ্বংসস্তুপে পরিণত করা যায়। একটি ভাল যশ বা সুনাম তৈরী করতে বছরের পর বছর এমনকি জীবনের পুরো সময়টাই লাগতে পারে। এ কষ্টার্জিত সুনাম নিমেষেই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। কেহই ধ্বংসাত্মক মন্তব্য থেকে নিস্কৃতি রেহাই না যা অযশের ‘কিন্তু’ নামক একটি শব্দ থেকে শুরু হয়। উপমাস্বরূপ ঃ অনেকেই বলেন, “তিনি ভালো মানুষ।” তিনি খুবই ভারো ও মহৎ। তিনি এটি করেন বা ঐটিই কওে থাকেন। কিন্তু তাঁর সমস্ত ভালো রেকর্ড খারাপ হয়ে যায় শুধুমাত্র সেই তথাকথিত ‘কিন্তু’ দ্বারা। আপনি ধর্ম চর্চায় জীবন অতিবাহিত করেন কিন্তু আক্রমন, সমালোচনা থেকে কোন অবস্থাতেই মুক্ত হতে পারবেন না।
বুদ্ধের সময়ে নিন্দুকেরও অভাব ছিল না যদিও তিনি বিখ্যাত ছিলেন। বুদ্ধের কিছু বিরুদ্ধচারী এমন কুৎসা রটিয়ে দিলেন যে “এক মহিলা বিহারে রাত্রি যাপন করেছিলেন।” এ হীন প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর তারা জনসাধারণের কাছে মিথ্যা ভাষণ প্রচার করেছিলেন যে বুদ্ধ ও তাঁর শিষ্যমন্ডলী ঐ মহিলাটিকে হত্যা করে মৃতদেহ বিহারের ভিতরে নোংরা স্তুপে পুষ্প সজ্জিত করে লুকিয়ে রেখেছিলেন। গুপ্তচরেরা এ হত্যাকান্ডের তথ্য উদঘাটন করলেন এবং রাজা তৎক্ষণাৎ হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ জারী করলেন এবং উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করলেন। তারপরও বিরুদ্ধচারীরা থেমে নেই। তারা দেখলেন যে বুদ্ধের কাছে অনেকেই শরণাপন্ন হচ্ছেন তখন বিরুদ্ধচারীরা পুনরায় বললেন যে বুদ্ধ মা’য়ের ছেলেদের কেড়ে নিচ্ছেন, স্ত্রী’রা স্বামী’দের কাছে বঞ্চিত হচ্ছেন এমনকি বুদ্ধ রাজ্যের উন্নতিতে বাধার সৃষ্টি করছেন। বুদ্ধের চরিত্র হরণে এ সকল প্রচেষ্টা বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার পর তাঁর আপন চাচাতো ভাই দেবদত্তও বুদ্ধেও প্রতি ইর্ষাম্বিত হয়ে বুদ্ধকে পাহাড়ের উপর থেকে পাথর নিক্ষেপের মাধ্যমে হত্যা করতে প্রচেষ্টা চালালো কিন্তু এ প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো। তাহলে বুদ্ধের প্রতি যদি এমন ধরণের দুর্ভাগ্যের সৃষ্টি হয় আর আমরা যারা সাধারণ মানুষ তাঁদের অবস্থাই বা কি!
আপনি যতই পাহাড়ের পাদদেশে উঠবেন, ততই অন্যের চোখে আপনি সুস্পষ্ট হয়ে উঠবেন। আপনার পৃষ্ঠদেশ দৃষ্টিগোচর হবে কিন্তু আপনারসম্মুখভাগের অংশ লুক্কায়িত থাকবে। ছিদ্রান্বেষণকারীরা আপনার গুণাগুণ বাদ দিয়ে শুধুমাত্র ভূলগুলিই খুঁজতে থাকবেন। আপনাকে যখন সুস্পষ্টভাবে বা অন্য কোনভাবে হোক ভূলভাবে প্রদর্শন করা হবে, তখন নিম্নোক্ত উপমাটি স্মরণ করা যেতে পারে ঃ
“কারোর সঙ্গে সামান্য পরিচয়ে এবং আমার যদি কোন বিশেষ বিষয়ে ক্ষুদ্র জ্ঞান থেকে থাকে- তবে সমালোচনার মাত্রা হবে – “হাল্কা”  কিন্তু একটু যদি ভালো দক্ষতা থেকে থাকে তবে এর মাত্রা হবে খুবই গুরুতর আর যদি দক্ষতার মাত্রা চাপিয়ে যায় তবে হয়তো আমার বিরুদ্ধে দোষ চাপিয়ে দিবে।”
এসব ভূল ব্যাখ্যাকারীদের শুদ্ধ করতে শুধু শুধু সময় নষ্ট করবার কোন প্রয়োজনীয়তা নেই যদি না অবস্থা আপনাকে ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে বাধ্য করে। শত্রু তখনই সন্তুষ্ঠ হয় যদি সে দেখে যে আপনি আঘাত পেয়েছেন। এটিই সে প্রকৃতপক্ষে আশা করে। এ ব্যাপারে আপনি যদি উদাসীন থাকেন, তাহলে সে বলবে ঃ “কানে শুনতে পায় না অর্থাৎ আপনি বধির হয়েছেন।” তাহলে বুঝা যায় ঃ
১.    অন্যের দোষ-ত্রুটি দর্শনে আমাদের অন্ধের ন্যায় আচরণ করা উচিত।
২.    অন্যের অন্যায় সমালোচনা শুনলে আমাদের অন্ধের ন্যায় আচরণ করা উচিত।
৩.    অন্যকে গালি দিলে আমাদের বোবার মত আচরণ করা উচিত।
৪.    তাই মিথ্যা দোষারোপ, মিথ্যা রিপোর্ট, রটনা, জনশ্রুতি, উড়ো খবর ইত্যাদি বন্ধ করা এতই সহজ ব্যাপার নয়।
এ পৃথিবী কাঁটাযুক্ত এবং নুড়ি পাথরে পরিপূর্ণ। এগুলি সরানো প্রায়ই অসম্ভব ব্যাপার কিন্তু আমরা যদি এগুলি সরানোর চেষ্টার পরিবর্তে এমন বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও হাঁটতে থাকি, যদিও তা অসম্ভব ব্যাপার, এক জোড়া চটি জুতা পা’য়ে ধারণ করে অক্ষতভাবে হাঁটা উচিত। এ ধর্ম এভাবে উপদেশ দেয় ঃ
    ১. সিংহের মত হও যে কারোর গর্জন তোয়াক্কা করে না।
    ২. বায়ুর মত হও যা জালে আটকায় না।
    ৩. পদ্মের মত হও প্রস্ফুটিত হলেও কর্দম দ্বারা দুষিত হয় না।
    ৪. গন্ডারের মত একাকী বিচরণ করবে।
   ৫. বনের রাজা হয়েও সিংহরা ভয়হীন থাকেন। অন্যান্য প্রাণীকূলের গর্জন সত্ত্বেও বনের রাজা সিংহরা স্বভাবগতভাবে ভীত-সন্ত্রষ্ঠ হন না। 
  ৬. কুকুর ঘেউ ঘেউ করলেও মরুযাত্রীদল শান্তিপূর্ণভাবে পথ বেয়ে চলে। আমরা কর্দমময় পৃথিবীতে বসবাস করছি। অসংখ্য পদ্ম মাটি স্পর্শ না করে এরা এ পৃথিবীকে শোভন করছে। ঠিক তেমনি আমাদেরও দোষহীন ও মহৎ জীবন-যাপন করা উচিত।
  ৭. আমাদের মনে করতে হবে যে গোলাপের পরিবর্তে কর্দম আমাদের দিকে ছুড়ে মারা হচ্ছে।
   ৮. কঠিন হলেও আমাদের অনাসক্ত হওয়ার চেষ্টা করা উচিত। একাকী এসেছি আমরা, একাকী চলে যাবো। অনাসক্তিই এ পৃথিবীতে আসল সুখ।
    ৯. কাউকে বাক্যবানে আহত না করে সর্বোচ্চ ক্ষমতা দিয়ে অন্যের উপকার সাধন করে আমাদের পরিভ্রমণ করা উচিত।
   ১০. ইহা শুনতে অবাক হতে হয় যে মহৎ ব্যক্তিরাও হত্যাকান্ডের শিকার হন, বিষ পানে হত্যা করা হয়, ক্রুশবিদ্ধ করা হয়। এভাবে গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিসকে ‘হ্যামলক’ নামক বিষপানে হত্যা করা হয়েছিল।মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্তে তিনি বলেছিলেন ঃ “আমি মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছি আর আপনারা বেচে থাকবেন- কোনটি অপেক্ষাকৃত ভালো তা শুধু ভগবান বলতে পারবেন।” যীশু খ্রীষ্টকে নিষ্ঠুরভাবে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল আর ভারতের মহাত্মা গান্ধীকে গুলি ছুড়ে হত্যা করা হয়েছিল। তবে হ্যাঁ, বেশী ভালো হওয়াও খুব বেশী ভয়ঙ্কর। তাদের জীবনে তাঁরা সমালোচিত হয়েছেন, আক্রমনিত হয়েছেন এবং হত্যাকান্ডের মাধ্যমে প্রাণহীন দেহে পরিণত হয়েছেন। মৃত্যুর পরে তাঁরা দেবতার ন্যায় পুজিত ও সম্মানিত হয়েছেন। মহৎ ব্যক্তিরা সম্মান ও অসম্মানের তোয়াক্কা করেন না। তাঁরা সমালোচনার ভয়ে ভীত নন কারন তাঁরা নাম বা সম্মানের জন্য কাজ করেন না।
৩. নিন্দা এবং প্রশংসা ঃ
নিন্দা এবং প্রশংসা- দুটো পার্থিব জিনিস যা মানব জাতিকে প্রভাবিত করে। যখন প্রশংসা করা হয়, তখন স্বভাবতই মন প্রফুল্ল হয়ে উঠে। পক্ষান্তরে, যখন নিন্দা করা হয়, তখন মন বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে। এ অবস্থায় বুদ্ধ বলেন ঃ “বিজ্ঞরা নিন্দা বা প্রশংসাই হোক কোনটাতেই বেদনাক্লিষ্ট হন না।” ঠিক যেন শক্ত পাথরের ন্যায় বায়ু দ্বারা কম্পমান হলেও কখনও নড়ে না। প্রশংসা যদি প্রশংসার যোগ্য হয় তবে তা শুনতে ভাল লাগে। আর বিপরীতে যদি এমন প্রশংসা হয় যা প্রশংসার যোগ্য নহে, তবে তা শুনতে ভালো লাগার কথা নয় হয়ত তোষামোদের ন্যায় চল-চাতুরী মনে হবে বরং এসব অর্থহীন কথা-বার্তা কর্ণপাত না করাই ভালো। প্রশংসা এমন যে তা অনেক দূর পর্যন্ত গড়ায়। প্রশংসা আর যাই হোক একটি অনুগ্রহ সহজেই লাভ করা যায়। বক্তা বক্তব্য প্রদানের সময় কারও সম্পর্কে প্রশংসাসূচক বাক্য উচ্চারণ করলে তা শ্রুতমন্ডলীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে আর এভাবে বক্তা শ্রোতাদেরকে প্রশংসা করলে তা তাঁদের শুনতে ভালো লাগে আর নিন্দা করলে তা স্বাভাবিকভাবে তাঁদের শুনতে খারাপ লাগারই কথা। ভদ্র ও মার্জিতরা তোষামোদে আনন্দ লাভ করেন না আর অন্যের খোশামোদও পছন্দ হওয়ার কথা নয়। প্রশংসার যোগ্য যাঁরা তাঁদের দ্বিধাহীনভাবে প্রশংসা করা উচিত। আর যাঁরা নিন্দার যোগ্য, তাঁদেরকেও তাঁদের ভালোর জন্য করুণার বশবর্তী হয়ে দোষারোপ না করে ভূলগুলো ধরিয়ে দেয়া। বুদ্ধের সময়েও এমন অনেকেই ছিলেন যাঁরা বুদ্ধকে ভালোভাবে জানেন, তাঁরা বুদ্ধের গুণাগুণকে নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ হতে প্রশংসা করে থাকেন। উপালী নামধারী এক ধনশালী ব্যক্তি বুদ্ধের গুণরাশি গণনাপূর্বক প্রশংসা করে থাকেন যা এখনও তাঁর অনুসারীদের এক বিরাট অনুপ্রেরণা জোগায়।
তাহলে নিন্দা জিনিসটা কি ধরণের? এ ব্যাপারে বুদ্ধ বলেন ঃ
“যাঁরা বেশী বলেন তাঁরা নিন্দিত হবেন,
যাঁরা কম বলেন তাঁরাও নিন্দিত হবেন,
আর যাঁরা নীরব থাকেন তাঁরাও নিন্দিত হবেন।”
নিন্দা মনে হয় মানব জাতির এক সার্বজনীন উইল (দানপত্র)। বুদ্ধের মন্তব্যনুসারে এ পৃথিবীতে অধিকাংশ লোকই অনিয়মতান্ত্রিক। ঠিক যেন যুদ্ধক্ষেত্রে হস্তি পৃষ্ঠে বিদ্ধ হওয়া তীরের ন্যায়। এভাবে বুদ্ধও সকল অপমান সহ্য করেছেন। খারাপ লোকেরা সব সময় অন্যের ভালো ও সুন্দর দিকগুলো বাদ দিয়ে খারাপ দিকগুলো তুলে ধরতে সচেষ্ট থাকেন। একমাত্র বুদ্ধ ছাড়া কেহই যথার্থরূপে ভালো নয়। আবার কেহই পরিপূর্ণরূপে খারাপও নয়। আমাদের মধ্যে ভালো দিক যেমন আছে তেমনি মন্দ দিকও আছে। কাউকে গালি দেয়া বাআক্রমণের সময় যদি সে নীরব ভূমিকা পালন করে তবে বুদ্ধের পরিভাষায় বলতে হয় ঃ “সে নির্বান অর্জন না করলেও নির্বানের পথে রয়েছে।” প্রত্যেকেই উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে কিন্তু অন্যরা তা বাস্তবায়িত হতে দিবে কেন? তারা সে কাজের গতিরোধ করবে, বাধা সৃষ্টি করবে, সর্বোপরি কলুষিত করবে। তারা কখনও স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে দিবে না। অনেকেই আবার নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী অন্যকে সাহায্য করবে, হয়ত মাঝে মাঝে ঋণগ্রস্থ হয়ে বা সহায় সম্পদ বিক্রি করে বিপদের সময় বন্ধুকে রক্ষা করবে। কিন্তু পরে দেখা যায় – যাকে সাহায্য করা হয়েছে সে উক্ত সাহায্যকারীর দোষ খুঁজে বেড়ায়, ভয় দেখায়। তার চরিত্রে কলঙ্ক লেপন বা হরণ করে দেয় এবং তার পতনে আনন্দ লাভ পেয়ে থাকে। এ রকম ভুরি ভুরি উদাহরণ আমাদের সমাজে বিদ্যমান রয়েছে।
জাতকেও উল্লিখিত রয়েছে যে গুটিলা নামের এক সঙ্গীত শিল্পী তাঁরা সাধ্য অনুযায়ী এক শিষ্য শিল্পীকে শিখিয়েছিলেন কিন্তু অকৃতজ্ঞ শিষ্য তাঁর গুরুর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে চেয়েছিলেন। এক সময় এক ব্রাহ্মণ বুদ্ধকে তাঁর গৃহে আমন্ত্রন করেন। আমন্ত্রন পেয়ে বুদ্ধ যথাসময়ে তাঁর গৃহে গমণ করেন। কিন্তু দেখা যায় বুদ্ধকে আপ্যায়নের পরিবর্তে অত্যন্ত খারাপ ভাষায় অবজ্ঞা করেন। এমন সময় বুদ্ধ বিণীতভাবে প্রশ্ন করলেন ঃ “ব্রাহ্মণ, আপনার গৃহে কি অতিথী আগমন করেন?
হ্যাঁ, ব্রাহ্মণ প্রত্যুত্তরে জানালেন।
“তাঁরা যখন আসেন, তখন আপনি কি করেন?”
“ওহ, আমরা রুচিকর ও সুস্বাদু খাবার প্রস্তুত করে থাকি।”
“যদি তাঁরা আসতে অসমর্থ হয়?”
“কেন, আমরা আনন্দ চিত্তে এ খাবার পুনরায় গ্রহণ করি।”
“হ্যাঁ, ব্রাহ্মণ, আপনি আমাকে ভিক্ষান্নে ফাং করেছেন কিন্তু এখন গালি দিয়ে আপ্যায়ন করছেন। আমি কিছুই গ্রহণ করিনি। আপনি তা ফেরত নেন।” বুদ্ধ প্রতিশোধ নেন না। প্রতিশোধ না নিয়ে বুদ্ধ প্রশংসা করেন। ঘৃণা ঘৃণার মধ্য দিয়ে মীমাংশা হয় না কিন্তু তা ভালবাসার মাধ্যমে সমাধান হয়। বুদ্ধের ন্যায় এমন কোন ধর্মীয় গুরু নেই যিনি প্রশংসা লাভ যেমন করেছেন তেমনি কড়া সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছেন। এমন ভাগ্য শুধুমাত্র মহান ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এক মহিলাকে হত্যার দায়ে বুদ্ধকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। অবৌদ্ধরা বুদ্ধ ও তাঁর শিষ্যমন্ডলীকে এমন কড়া ধিক্কার দিয়েছিলেন যে এক সময় আয়ুস্মান আনন্দ বুদ্ধের কাছে উপস্থিত হয়ে অন্য গ্রামের উদ্দেশ্যে যাওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন।
“কিভাবে, আনন্দ, যদি ঐসব গ্রামের অধিবাসীরাও আমাদের একইভাবে ধিক্কার দেয়।”
“হ্যাঁ, তখন প্রভু, আমরা অন্য গ্রামে গমণ করবো।”
“তখন আনন্দ, সমগ্র ভারতবর্ষে আমাদের বসবাসের জায়গা হবে না। ধৈর্য্য ধর। ঐসব ধিক্কার আপনা-আপনিই শেষ হয়ে যাবে।”
মাগন্ডিয় নামে এক মহিলাকে যখন বুদ্ধ তাঁর সৌন্দর্যের অনিত্যতা সম্পর্কে দেশনা করছেন, তখন আবার তাঁর পিতা তাঁকে অর্থাৎ মাগন্ডিয়কে বুদ্ধের সঙ্গে বিবাহ দিতে চেয়েছিলেন। মহিলাটি বুদ্ধকে জনসমক্ষে হেয় প্রতিপন্ন করার মানসে কিছু উচ্ছৃঙ্খল লোক ভাড়া করেছিলেন। বুদ্ধ সেসব অপমান সহ্য করেছিলেন। অপমান করা মানব ধর্মে অনেকক্ষেত্রে একটা সাধারণ ব্যাপার। যত বেশী কাউকে অপমান করবেন তত বেশী এর মাত্রা প্রসারিত হবে। সক্রেটিস তাঁর স্ত্রী কর্তৃক প্রতিনিয়ত অপমানিত হতেন। যখনই সক্রেটিস তাঁর শিষ্যদের উপদেশ দিতে বের হতেন, তখনই তাঁর ধৈর্য্যহীনা স্ত্রী তাঁকে তীব্র ভাষায় গালিগালাজ করতেন। একদিন তাঁর স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাই তিনি তাঁর স্বভাবজাত ভাষা প্রয়োগ করতে পারলেন না। সক্রেটিস ঐদিন বিষন্ন মনে গৃহত্যাগ করলেন। তাঁর শিষ্যরা সেদিন তাঁকে জিজ্ঞাসা করল কেন আজ তাঁকে বিষন্ন দেখাচ্ছে! সক্রেটিস প্রত্যুত্তরে বললেন যে তাঁর স্ত্রী অসুস্থতা হেতু আজ তাঁকে গালি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
“হ্যাঁ, এ ধরণের অনাকাঙ্খিত গালিগালাজ শুনতে না পাওয়াতেই বুঝি আপনি বেশী খুশী হন।” শিষ্যরা মন্তব্য করে বসলো।
“ওহ না! যখন আমার স্ত্রী আমাকে গালাগাল করেন, তখন আমি ধৈর্য্য ধারণের সুযোগ লাভ করে থাকি। আজ আমি ঐ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলাম। এ কারনেই আজ আমাকে বিষন্ন দেখাচ্ছে! দার্শনিক সক্রেটিস এভাবে বলে গেলেন।
এসব কিছু সকলের জন্য শিণীয়। যখন গালিগালাজ করা হবে তখন আমাদের চিন্তা করা উচিত যে আমাদের ধৈর্য্য ধারণের সুযোগ করে দেয়া হ”েছ। কোন প্রকার দ্বন্দে লিপ্ত না হয়ে আমরা আমাদের শত্র”দের নিকট কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।
৪. সুখ এবং দুঃখ ঃ
সুখ এবং দুঃখ এ দুটো জিনিস খুবই শক্তিশালী যা মানব জীবনকে প্রভাবিত করে। ‘আরাম’ বাহিত কোন জিনিসই ‘সুখ’ নামে অভিহিত। আবার ধারণ করতে বা সহ্য করতে কঠিন এমন কিছু ‘দুঃখ’ নামে অভিহিত হয়। সাধারণতঃ সুখ বলতে একটা ইচ্ছা বা আকাঙ্খারই সন্তুষ্ঠকরণ। কোন আকাড়িখত জিনিস যত শীঘ্রই সম্ভব প্রাপ্তি ঘটলে তখন আমরা অন্য জিনিসের প্রতি মোহবিষ্ট হয়ে পড়ি। তখন ঐ জিনিসের প্রাপ্তি ঘটলে পুনরায় আমাদের মনে এক ধরণের অনুভূতি জাগ্রত হয়, একে সাধারনতঃ আমরা সুখ নামে আখ্যায়িত করে থাকি। তাই আমাদের স্বার্থপর আকাঙ্খা বা ইচ্ছা সব সময় অতৃপ্ত থাকে। কাম সুখ এর মধ্যে সর্বোচ্চ কিন্তু তা অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। সহায় সম্পদ কি মানুষকে খাঁটি সুখ দিতে পারে! যদি তাই হতো, তাহলে যাঁরা কোটিপতি, তাঁরা কেন সুখ পায় না! কিছু কিছু দেশ উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করেছে কিন্তু সুখ নামক সোনার হরিণ এখনও ধরাছোয়ার বাইরে যা শুধুমাত্র মনের মধ্যে অবস্থান করে।  (চলবে)

No comments

Theme images by 5ugarless. Powered by Blogger.