কথোপকথন : মনুষ্যত্ব বিকাশ
সোনা মনি চাকমা
উপজেলা নির্বাহী অফিসার, বিশ্বনাথ, সিলেট।
মানুষকে বলা হয় সৃষ্টির সেরা জীব।
কিন্তু কেন? মানুষ তো অন্যান্য প্রাণীর মত সহজাত প্রবৃত্তি নিয়ে জন্ম গ্রহণ
করেনা । অন্যান্য প্রাণীদের বেলায় তা নাও হতে পারে। একটি ছাগল/গরুর বাচ্চা
ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর পর তিড়িং বিড়িং করে লাফা লাফি করতে পারে, দৌঁড়াতে পারে।
ভূমিষ্ঠ হওয়ার থেকে মানুষকে হাঁটা-চলা, কথা বলা, খাওয়া-দাওয়া, লেখা-পড়া
সবকিছুই শিখতে হয়। প্রতিটি ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন করতে হয়। একটি শিশু
হাঁটা-চলা শিখতে প্রায় দুই বছর সময় লাগে। তার মস্তিষ্কের পূর্ণতা হতে পাঁচ
বছর লাগে। আর স্কুলে পড়তে যাওয়ায় উপযোগী হতে ছয় বছর লাগে। এভাবে সবকিছুই
শিখতে হবে।
মানব শিশুকে জন্মের আগ থেকে কত চিকিৎসক দেখভাল করে বিভিন্ন ব্যবস্থাপত্র দিয়ে গর্ভবর্তী মায়ের পরিচর্যা করতে হয়। জন্মের পর দুধ খাওয়াতে, আধো আধো কথা বলাতে ও হাঁটতে শেখাতে হয়। হাঁটতে গিয়ে পড়ে গেলে তাকে ধরে তুলে আবার হাঁটতে শেখানো; সাঁতার কাটা শেখানো; কথা বলা শেখানো; কথা বলায় পরিপক্ক হলে লেখা-পড়া শেখানো। জন্মের পর থেকে মানব শিশুকে এই সবকিছু শেখানোর জন্য একজন ব্যক্তির প্রয়োজন হয়। একজন ব্যক্তির সহযোগিতায় মানব শিশু পৃথিবীতে অনেক কিছু শিখতে পারে। এভাবে বংশ পরম্পরায় সহমর্মিতা ও একে অপরের সহযোগিতার মনোভাবের মধ্যে মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের মহিমা। যখন দেখা যায়, কোন মা একটি বিকলাঙ্গ শিশু জন্ম দেয়; তখন সেই বিকলাঙ্গ মানব শিশুকে পৃথিবীর আলো বাতাসে বাঁচিয়ে রাখার জন্য জন্মদাত্রী মা কত আপ্রাণ চেষ্টা করে। সে কখনো সেই শিশুকে মেরে ফেলার কথা চিন্তা করে না বা কোনো সন্তান ময়লার ডাস্টবিন কিংবা ময়লার গর্তে পড়ে সারা শরীর ময়লাবৃত হলেও তার মা কখনো সেই সন্তানকে ফেলে দিবে না বরং তুলে এনে ভালভাবে গোসল করিয়ে আবার কোলে তুলে নিবে- এখানেই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব। এটিই মানব প্রকৃতির ধর্ম। পৃথিবীতে এসে পরিণতবোধ হওয়ার পর চিন্তা করে দেখলাম- জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একজন মানুষকে কেবল শিখতে হয় এবং অর্জন করতে হয় নিজের চেষ্টায়- কোন কিছুই এমনিতেই পাওয়া যায় না।
জীবনকে টিকিয়ে রাখার জন্য নিরন্তর সংগ্রাম করে যেতে হয়। মানুষের মত অন্য কোন প্রাণীকে এত সংগ্রাম করতে হয় না। বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য উৎপাদন করা । আবার খাদ্য কীভাবে উৎপাদন করা যায় তার কলাকৌশল রপ্ত করা, জীবিকার প্রয়োজনে বিভিন্ন পেশা গ্রহণ করা। মানুষের পেশা কতই বিচিত্র! একজন এক একরকম পেশা নিয়ে জীবন ধারণ করে। কিন্তু অন্যান্য প্রাণীর কোন পেশাই নেই। এ নিয়ে কোন প্রাণী চিন্তাও করে না; আর মাথাও ঘামায় না। মানুষকে চিন্তা-ভাবনা করে জীবিকা বেছে নিতে হয়। মানুষই একমাত্র চিন্তাশীল প্রাণী। তাঁর চিন্তন ক্ষমতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনার দ্বারা ভালো পেশা গ্রহণ করে আরাম-আয়েসে জীবন যাপন করতে চায়। এক্ষেত্রে যারা অলস অথচ ভালো পেশা আশা করে তারা কখনও ভালো পেশা লাভ করতে পারে না। সে জন্য ভালো পেশা লাভের জন্য নিজেকে তৈরি করতে হবে এবং মনের প্রবল ইচ্ছাশক্তি থাকতে হবে। তবেই সফলকাম হতে পারবে।
যখন দাদুকে পা-ছুঁয়ে নমস্কার করতাম; তখন দাদু আমাকে আশীর্বাদ করে বলতেন, ‘‘তুমি মানুষের মত মানুষ হও।’’ আমি দাদুকে একদিন জিজ্ঞাসা করলাম- “দাদু, তাহলে আমি কি এখনও অমানুষ? দাদু বললেন, ‘‘না, তুমি অমানুষ নও, তবে পরিপূর্ণ মানুষ নও! পরিপূর্ণ মানুষ হতে তোমাকে কতগুলো মানবিক গুণাবলী অর্জন করতে হবে। যাকে আমরা এক কথায় মনুষ্যত্ববোধ বলে থাকি। মানুষ হলেও অনেকের এ মনুষ্যত্ববোধ থাকে না। এজন্য তোমাকে মনুষ্যত্ববোধ অর্জন করে মানুষের মত মানুষ হতে বলেছি।’’ দাদুকে আবার প্রশ্ন করলাম- “দাদু, মনুষ্যত্ববোধ কোথায় পাওয়া যায়? বাজারে কেনা-বেচা হয়? লন্ডন-আমেরিকায় পাওয়া যায়? নাকি আফ্রিকার গহীন অরণ্যে পাওয়া যায়?’’ দাদু বললেন- “আরে দাদু, মনুষ্যত্ববোধ কোন বস্তু নয় যে বাজারে কেনা-বেচা হয়; লন্ডন-আমেরিকায় পাওয়া যায় না; আর আফ্রিকার জঙ্গলে পাওয়ার কথাতো প্রশ্নেই আসে না। এটি প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যেই থাকে; সেটি তার আচার-আচরণ, কথা-বার্তা, কাজ-কর্মের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়। তুমি লক্ষ্য করলে দেখবে- কেউ কেউ মানুষের সাথে খারাপ আচরণ করে এবং নিকটাত্মীয়দের সাথে খারাপ ব্যবহার করে বিরাগভাজন হন। এমনকি অনেকে বাবা-মা’র সঙ্গেও দুর্ব্যবহার করে থাকে। এ ধরণের লোকদের মনুষ্যত্ববোধের অভাব থাকে। এজন্য মানুষ এমন আচরণ করে থাকে। প্রত্যেক মানুষকে মনুষ্যত্ববোধ অর্জন করতে হয়।’’ “দাদু, এটি অর্জনের সহজ পথ আছে কী’’? দাদু বললেন, ‘‘এটি অর্জনের সহজ পথ আছে; তবে রাতারাতি অর্জন সম্ভব নয়। ধীরে ধীরে অর্জন করতে হয়। যেমন- তুমি যদি একটি ফলের গাছ লাগাও; তাহলে সেটি বড় হতে সময় লাগবে। গাছটি বড় হয়ে ফল দিতে সময় লাগবে। গাছটি ফল দেওয়া পর্যন্ত তোমাকে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে। তুমি যদি অধৈর্য হয়ে রাগ করে গাছটি কেটে ফেল; তাহলে আর জীবনে ঐ গাছের ফল দেখবে না। একইভাবে মনুষ্যত্ববোধের বৈশিষ্ট্যগুলো তোমাকে ধৈর্য ধরে আয়ত্ত করতে হবে। মনুষ্যত্ববোধের উপকরণ সুশৃঙ্খল সমাজ ব্যবস্থা থেকে পাওয়া যায়। আর লেখা-পড়া তথা শিক্ষার মাধ্যমে অর্জন করা যায় বেশি। লেখাপড়া করে শুধু কাগজের সর্টিফিকেট লাভ করলে মনুষ্যত্ববোধের সৃষ্টি হয় না। মননশীল বই পড়তে হবে। বড় বড় মনীষীদের সৃজনশীল চিন্তা চেতনাকে লালন করতে হবে; ধারণ করতে হবে; আত্মস্থ করতে হবে। পৃথিবীর বড় বড় জ্ঞানী-গুণী মহামনীষীরা তাঁদের সৃজনশীল কর্ম, চিন্তা, আদর্শ লিপিবদ্ধ করে গেছেন। সেখান থেকে তাঁদের চিন্তার নির্যাসগুলো পড়ে উপলব্ধি করতে হবে।’’ “আচ্ছা দাদু, বই তো বই-ই। আবার মননশীল বই আর অন্যান্য বইয়ের মাঝে কোন পার্থক্য আছে কি?” “হ্যাঁ, অবশ্যই রকমফের আছে। মননশীল মানে হচ্ছে- যে বই মনকে ঙহ করে দেয় অর্থাৎ যে বই পড়লে মন সচেতন হয়, মন প্রজ্জ¦লিত হয় ও মানবসত্তা জেগে উঠে আর ভালো-মন্দের পার্থক্য বোঝার বিবেকবোধ সৃষ্টি করে। যাঁদের মনুষ্যত্ববোধ থাকে তাঁরা খুবই বিনয়ী হয়। আমরা অনেকে জানি প্রকৃত জ্ঞানীরা বিনয়ী হয়। প্রকৃত জ্ঞান অর্জনের মধ্য দিয়ে মনুষ্যত্ববোধ পরিশীলিত হয়।” “বিনয় মানে কি, দাদু?” “সহজ করে বলতে গেলে, ভদ্র, নম্র আচরণ করাকে বিনয় বলে। অর্থাৎ সমাজে যা বর্জনীয় এবং খারাপ বলে বিবেচিত সেগুলো পরিহার করে ভাল আচরণ করাই হচ্ছে বিনয়ের অংশ। ধর, তুমি একজন লোককে এমন কর্কশ ভাষায় গালিগালাজ করেছ- লোকটি মনে খুব কষ্ট পেয়েছে। যদি তুমি মনে কর যে, তোমার সাথে এ ধরণের আচরণকরলে তোমারও খারাপলাগবে বা তুমি মানুষের সাথে এ ধরণের আচরণ করলে তো অশোভনীয় মনেকরবে, তাহলে তুমি নিজেও অপরের সঙ্গে এরুপ আচরণ কখনও করবে না। মনে থাকবে তো?” “জ্বি হ্যাঁ। আচ্ছা দাদু তুমি এতকথা শিখলে কেমনে?” “ তুমি আমার সংগ্রহের বইয়ের টাকে দেখে যাও- এখানে সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাসসহ বিভিন্ন বিচিত্র ধরণের বই সংগ্রহ করেছি এবং পড়েছি। কেন বই পড়া উচিত এ বিষয়ে একজন লেখকের উদ্ধৃতি দেব- এতে তোমার ধারণা আরও পরিষ্কার হবে। ১৫৯৭ সালে ফ্রান্সিস বেকন নামে একজন ইংরেজ লেখক লিখেছেন-
‘চতুর ব্যক্তির কাছে লেখাপড়া কোনো মূল্য পায় না। নিরীহ লোকেরা লেখাপড়ার মুল্য বোঝে। বিজ্ঞ ব্যক্তিরা লেখাপড়া সঠিক কাজে লাগাতে জানে। যেহেতু লেখাপড়া কোনো ব্যক্তিকে উপযোগিতা সম্পর্কে ধারণা দেয় না। কীভাবে জ্ঞান ব্যবহার করতে হয় তা জানতে হবে বাস্তব অভিজ্ঞতার সাহায্যে। কোনো কিছু মিথ্যা প্রতিপন্ন করা কিংবা কোনো কিছু বিশ্বাস করার জন্য অধ্যয়ন নয়। বরং বিচার ও যাচাই এর জন্য অধ্যয়ন করতে হবে। কোনো কোনো পুস্তকের শুধু অংশবিশেষ পড়তে হয়; কোনো কোনো পুস্তক দ্রুত পড়ে যেতে হয়; কিছু কিছু বই পড়তে হয় আগাগোড়া এবং অত্যন্ত গুরত্ব সহকারে। অধ্যয়নের ফলে ব্যক্তিত্বের পূর্ণবিকাশ ঘটে; আলোচনা মানুষকে সতর্ক ব্যক্তিতে পরিণত করে; লেখালেখির অভ্যাস থাকলে স্মৃতিশক্তি প্রখর হওয়া চাই; আলোচনার অভ্যাস না থাকলে অজ্ঞতা লুকানোর কায়দা জানতে হবে। ইতিহাস গ্রন্থ পাঠ করলে একজন বিজ্ঞ হতে পারেন, কাব্য পাঠ করলে হতে পারেন রসিক, গণিত চর্চা করলে তীক্ষœধী, প্রাকৃতিক দর্শন পাঠ করলে হতে পারেন গভীর, নীতিশাস্ত্র চর্চা করলে হতে পারেন গুরুগম্ভীর এবং ন্যায় ও অলংকার শাস্ত্র পাঠ করলে বঙ্গানুবাদে সফল হওয়া যায়।’
এখন বল- এ উদ্ধৃতি থেকে কি বুঝলে?” “সে তো অনেক জানলাম, বুঝলাম- দাদু এবার আমাকে বল, তুমি এখন কোন ধরণের বই পড়তে পছন্দ কর?” “শোন, আমার বয়সতো কম হয় নি। এই বয়সে বেশিরভাগ স্মৃতি কথা, আত্মজীবনীমূলক বইই পড়তে বেশি ভালো লাগে। আমি যে সব স্মৃতিকথা ও আত্মজীবনীমূলক বই পড়েছি সেগুলোর নাম তোমাকে বলছি- কবি শামসুর রাহমানের ‘কালের ধুলোয় লেখা’, মোফাজ্জল করিম-এর ‘সোনালী সকাল, দুরন্ত দুপুর’, কলিম শরাফীর ‘ভরা থাক স্মৃতি সুধায়’, তপন রায় চৌধুরীর ‘বাঙালনামা’ শাহ এ এম এস কিবরিয়ার ‘পেছন ফিরে দেখা’ অন্নদাশংকর রায়ের ‘নব্বই পেরিয়ে’ আব্দুল মন্নান সৈয়দের ‘ভেসেছিলাম ভাঙা বেলায়’ শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’’ কাজী মোতাহার হোসেনের ‘স্মৃতিকথা’। তাহলে এই বয়সে আমি কোন ধরণের বই পড়ব? তোমার এখন শরৎ চন্দ্র, বিদ্যাসাগর, সুকুমার রায়, নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দের বই পড়ার বয়স হয়েছে। তবে তোমার মানসিক ও মানবিক বিকাশের জন্য তোমাকে দু একটি বইয়ের নাম দিচ্ছি এগুলো পড়ে নিও- ডেলকার্নেগীর রচনা, ডাঃ লুৎফর রহমানের রচনা, ড. হুমায়ুন আজাদের লেখা- ‘‘বুক পকেটে জোনাকী পোকা’’, ‘‘লাল নীল দীপাবলী’’, ‘‘কতো নদী সরোবর’’, ‘‘আব্বুকে মনে পড়ে’’, সুকান্ত সমগ্র, সুকুমার রায় সমগ্র, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সমগ্র। আর মনে রেখ, শুধু বইয়ের মাঝে ডুবে থাকলে হবে না- খেলাধুলাও করতে হবে। মাঝে মধ্যে ভালো সিনেমাও দেখতে পার। হারানো দিনের গান শুনতে পার। রবীন্দ্র সংগীত শুনতে পার। এতে মন উৎফুল্ল থাকবে। আর প্রত্যেকদিন খুব ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে বাহিরের খোলাআলো-বাতাসে পায়চারী করবে। আমার কথা মনে থাকবে?” “জ্বি দাদু। দাদু, এখন কোন বই পড়ছেন ?” “ইদানিং একটি চমৎকার বই পড়তেছি। সেটি হচ্ছে ইন্দিরা গান্ধীকে লেখা পন্ডিত জওহরলাল নেহরুর চিঠি- যেটি Glimpses of world History নামে বই আকারে প্রকাশিত হয়। এই বইটি ‘বিশ্ব ইতিহাস প্রসঙ্গ’ নামে বঙ্গানুবাদও পাওয়া যায়। এটি একটি অমূল্য বই, পড়ে যা মজা পাচ্ছি তা বলার মতো নয়। পন্ডি জওহরলাল নেহরু যখন বিভিন্ন কারাগারে বন্দী ছিলেন; তখন কারাগারে রুদ্ধ থাকা অবস্থায় দশ বছরের কন্যা ইন্দিরা গান্ধীকে বিশ্বজগৎ সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার জন্য এ পত্রগুলো লিখেছেন। সেই পত্রাবলী এখন আমরা জ্ঞানের আকর হিসেবে পড়ছি। তুমি সময় পেলে পড়ে নিও। এ বই পড়ে পৃথিবীর অনেক অজানা অধ্যায় উন্মোচিত হবে। ”
মানব শিশুকে জন্মের আগ থেকে কত চিকিৎসক দেখভাল করে বিভিন্ন ব্যবস্থাপত্র দিয়ে গর্ভবর্তী মায়ের পরিচর্যা করতে হয়। জন্মের পর দুধ খাওয়াতে, আধো আধো কথা বলাতে ও হাঁটতে শেখাতে হয়। হাঁটতে গিয়ে পড়ে গেলে তাকে ধরে তুলে আবার হাঁটতে শেখানো; সাঁতার কাটা শেখানো; কথা বলা শেখানো; কথা বলায় পরিপক্ক হলে লেখা-পড়া শেখানো। জন্মের পর থেকে মানব শিশুকে এই সবকিছু শেখানোর জন্য একজন ব্যক্তির প্রয়োজন হয়। একজন ব্যক্তির সহযোগিতায় মানব শিশু পৃথিবীতে অনেক কিছু শিখতে পারে। এভাবে বংশ পরম্পরায় সহমর্মিতা ও একে অপরের সহযোগিতার মনোভাবের মধ্যে মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের মহিমা। যখন দেখা যায়, কোন মা একটি বিকলাঙ্গ শিশু জন্ম দেয়; তখন সেই বিকলাঙ্গ মানব শিশুকে পৃথিবীর আলো বাতাসে বাঁচিয়ে রাখার জন্য জন্মদাত্রী মা কত আপ্রাণ চেষ্টা করে। সে কখনো সেই শিশুকে মেরে ফেলার কথা চিন্তা করে না বা কোনো সন্তান ময়লার ডাস্টবিন কিংবা ময়লার গর্তে পড়ে সারা শরীর ময়লাবৃত হলেও তার মা কখনো সেই সন্তানকে ফেলে দিবে না বরং তুলে এনে ভালভাবে গোসল করিয়ে আবার কোলে তুলে নিবে- এখানেই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব। এটিই মানব প্রকৃতির ধর্ম। পৃথিবীতে এসে পরিণতবোধ হওয়ার পর চিন্তা করে দেখলাম- জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একজন মানুষকে কেবল শিখতে হয় এবং অর্জন করতে হয় নিজের চেষ্টায়- কোন কিছুই এমনিতেই পাওয়া যায় না।
জীবনকে টিকিয়ে রাখার জন্য নিরন্তর সংগ্রাম করে যেতে হয়। মানুষের মত অন্য কোন প্রাণীকে এত সংগ্রাম করতে হয় না। বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য উৎপাদন করা । আবার খাদ্য কীভাবে উৎপাদন করা যায় তার কলাকৌশল রপ্ত করা, জীবিকার প্রয়োজনে বিভিন্ন পেশা গ্রহণ করা। মানুষের পেশা কতই বিচিত্র! একজন এক একরকম পেশা নিয়ে জীবন ধারণ করে। কিন্তু অন্যান্য প্রাণীর কোন পেশাই নেই। এ নিয়ে কোন প্রাণী চিন্তাও করে না; আর মাথাও ঘামায় না। মানুষকে চিন্তা-ভাবনা করে জীবিকা বেছে নিতে হয়। মানুষই একমাত্র চিন্তাশীল প্রাণী। তাঁর চিন্তন ক্ষমতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনার দ্বারা ভালো পেশা গ্রহণ করে আরাম-আয়েসে জীবন যাপন করতে চায়। এক্ষেত্রে যারা অলস অথচ ভালো পেশা আশা করে তারা কখনও ভালো পেশা লাভ করতে পারে না। সে জন্য ভালো পেশা লাভের জন্য নিজেকে তৈরি করতে হবে এবং মনের প্রবল ইচ্ছাশক্তি থাকতে হবে। তবেই সফলকাম হতে পারবে।
যখন দাদুকে পা-ছুঁয়ে নমস্কার করতাম; তখন দাদু আমাকে আশীর্বাদ করে বলতেন, ‘‘তুমি মানুষের মত মানুষ হও।’’ আমি দাদুকে একদিন জিজ্ঞাসা করলাম- “দাদু, তাহলে আমি কি এখনও অমানুষ? দাদু বললেন, ‘‘না, তুমি অমানুষ নও, তবে পরিপূর্ণ মানুষ নও! পরিপূর্ণ মানুষ হতে তোমাকে কতগুলো মানবিক গুণাবলী অর্জন করতে হবে। যাকে আমরা এক কথায় মনুষ্যত্ববোধ বলে থাকি। মানুষ হলেও অনেকের এ মনুষ্যত্ববোধ থাকে না। এজন্য তোমাকে মনুষ্যত্ববোধ অর্জন করে মানুষের মত মানুষ হতে বলেছি।’’ দাদুকে আবার প্রশ্ন করলাম- “দাদু, মনুষ্যত্ববোধ কোথায় পাওয়া যায়? বাজারে কেনা-বেচা হয়? লন্ডন-আমেরিকায় পাওয়া যায়? নাকি আফ্রিকার গহীন অরণ্যে পাওয়া যায়?’’ দাদু বললেন- “আরে দাদু, মনুষ্যত্ববোধ কোন বস্তু নয় যে বাজারে কেনা-বেচা হয়; লন্ডন-আমেরিকায় পাওয়া যায় না; আর আফ্রিকার জঙ্গলে পাওয়ার কথাতো প্রশ্নেই আসে না। এটি প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যেই থাকে; সেটি তার আচার-আচরণ, কথা-বার্তা, কাজ-কর্মের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়। তুমি লক্ষ্য করলে দেখবে- কেউ কেউ মানুষের সাথে খারাপ আচরণ করে এবং নিকটাত্মীয়দের সাথে খারাপ ব্যবহার করে বিরাগভাজন হন। এমনকি অনেকে বাবা-মা’র সঙ্গেও দুর্ব্যবহার করে থাকে। এ ধরণের লোকদের মনুষ্যত্ববোধের অভাব থাকে। এজন্য মানুষ এমন আচরণ করে থাকে। প্রত্যেক মানুষকে মনুষ্যত্ববোধ অর্জন করতে হয়।’’ “দাদু, এটি অর্জনের সহজ পথ আছে কী’’? দাদু বললেন, ‘‘এটি অর্জনের সহজ পথ আছে; তবে রাতারাতি অর্জন সম্ভব নয়। ধীরে ধীরে অর্জন করতে হয়। যেমন- তুমি যদি একটি ফলের গাছ লাগাও; তাহলে সেটি বড় হতে সময় লাগবে। গাছটি বড় হয়ে ফল দিতে সময় লাগবে। গাছটি ফল দেওয়া পর্যন্ত তোমাকে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে। তুমি যদি অধৈর্য হয়ে রাগ করে গাছটি কেটে ফেল; তাহলে আর জীবনে ঐ গাছের ফল দেখবে না। একইভাবে মনুষ্যত্ববোধের বৈশিষ্ট্যগুলো তোমাকে ধৈর্য ধরে আয়ত্ত করতে হবে। মনুষ্যত্ববোধের উপকরণ সুশৃঙ্খল সমাজ ব্যবস্থা থেকে পাওয়া যায়। আর লেখা-পড়া তথা শিক্ষার মাধ্যমে অর্জন করা যায় বেশি। লেখাপড়া করে শুধু কাগজের সর্টিফিকেট লাভ করলে মনুষ্যত্ববোধের সৃষ্টি হয় না। মননশীল বই পড়তে হবে। বড় বড় মনীষীদের সৃজনশীল চিন্তা চেতনাকে লালন করতে হবে; ধারণ করতে হবে; আত্মস্থ করতে হবে। পৃথিবীর বড় বড় জ্ঞানী-গুণী মহামনীষীরা তাঁদের সৃজনশীল কর্ম, চিন্তা, আদর্শ লিপিবদ্ধ করে গেছেন। সেখান থেকে তাঁদের চিন্তার নির্যাসগুলো পড়ে উপলব্ধি করতে হবে।’’ “আচ্ছা দাদু, বই তো বই-ই। আবার মননশীল বই আর অন্যান্য বইয়ের মাঝে কোন পার্থক্য আছে কি?” “হ্যাঁ, অবশ্যই রকমফের আছে। মননশীল মানে হচ্ছে- যে বই মনকে ঙহ করে দেয় অর্থাৎ যে বই পড়লে মন সচেতন হয়, মন প্রজ্জ¦লিত হয় ও মানবসত্তা জেগে উঠে আর ভালো-মন্দের পার্থক্য বোঝার বিবেকবোধ সৃষ্টি করে। যাঁদের মনুষ্যত্ববোধ থাকে তাঁরা খুবই বিনয়ী হয়। আমরা অনেকে জানি প্রকৃত জ্ঞানীরা বিনয়ী হয়। প্রকৃত জ্ঞান অর্জনের মধ্য দিয়ে মনুষ্যত্ববোধ পরিশীলিত হয়।” “বিনয় মানে কি, দাদু?” “সহজ করে বলতে গেলে, ভদ্র, নম্র আচরণ করাকে বিনয় বলে। অর্থাৎ সমাজে যা বর্জনীয় এবং খারাপ বলে বিবেচিত সেগুলো পরিহার করে ভাল আচরণ করাই হচ্ছে বিনয়ের অংশ। ধর, তুমি একজন লোককে এমন কর্কশ ভাষায় গালিগালাজ করেছ- লোকটি মনে খুব কষ্ট পেয়েছে। যদি তুমি মনে কর যে, তোমার সাথে এ ধরণের আচরণকরলে তোমারও খারাপলাগবে বা তুমি মানুষের সাথে এ ধরণের আচরণ করলে তো অশোভনীয় মনেকরবে, তাহলে তুমি নিজেও অপরের সঙ্গে এরুপ আচরণ কখনও করবে না। মনে থাকবে তো?” “জ্বি হ্যাঁ। আচ্ছা দাদু তুমি এতকথা শিখলে কেমনে?” “ তুমি আমার সংগ্রহের বইয়ের টাকে দেখে যাও- এখানে সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাসসহ বিভিন্ন বিচিত্র ধরণের বই সংগ্রহ করেছি এবং পড়েছি। কেন বই পড়া উচিত এ বিষয়ে একজন লেখকের উদ্ধৃতি দেব- এতে তোমার ধারণা আরও পরিষ্কার হবে। ১৫৯৭ সালে ফ্রান্সিস বেকন নামে একজন ইংরেজ লেখক লিখেছেন-
‘চতুর ব্যক্তির কাছে লেখাপড়া কোনো মূল্য পায় না। নিরীহ লোকেরা লেখাপড়ার মুল্য বোঝে। বিজ্ঞ ব্যক্তিরা লেখাপড়া সঠিক কাজে লাগাতে জানে। যেহেতু লেখাপড়া কোনো ব্যক্তিকে উপযোগিতা সম্পর্কে ধারণা দেয় না। কীভাবে জ্ঞান ব্যবহার করতে হয় তা জানতে হবে বাস্তব অভিজ্ঞতার সাহায্যে। কোনো কিছু মিথ্যা প্রতিপন্ন করা কিংবা কোনো কিছু বিশ্বাস করার জন্য অধ্যয়ন নয়। বরং বিচার ও যাচাই এর জন্য অধ্যয়ন করতে হবে। কোনো কোনো পুস্তকের শুধু অংশবিশেষ পড়তে হয়; কোনো কোনো পুস্তক দ্রুত পড়ে যেতে হয়; কিছু কিছু বই পড়তে হয় আগাগোড়া এবং অত্যন্ত গুরত্ব সহকারে। অধ্যয়নের ফলে ব্যক্তিত্বের পূর্ণবিকাশ ঘটে; আলোচনা মানুষকে সতর্ক ব্যক্তিতে পরিণত করে; লেখালেখির অভ্যাস থাকলে স্মৃতিশক্তি প্রখর হওয়া চাই; আলোচনার অভ্যাস না থাকলে অজ্ঞতা লুকানোর কায়দা জানতে হবে। ইতিহাস গ্রন্থ পাঠ করলে একজন বিজ্ঞ হতে পারেন, কাব্য পাঠ করলে হতে পারেন রসিক, গণিত চর্চা করলে তীক্ষœধী, প্রাকৃতিক দর্শন পাঠ করলে হতে পারেন গভীর, নীতিশাস্ত্র চর্চা করলে হতে পারেন গুরুগম্ভীর এবং ন্যায় ও অলংকার শাস্ত্র পাঠ করলে বঙ্গানুবাদে সফল হওয়া যায়।’
এখন বল- এ উদ্ধৃতি থেকে কি বুঝলে?” “সে তো অনেক জানলাম, বুঝলাম- দাদু এবার আমাকে বল, তুমি এখন কোন ধরণের বই পড়তে পছন্দ কর?” “শোন, আমার বয়সতো কম হয় নি। এই বয়সে বেশিরভাগ স্মৃতি কথা, আত্মজীবনীমূলক বইই পড়তে বেশি ভালো লাগে। আমি যে সব স্মৃতিকথা ও আত্মজীবনীমূলক বই পড়েছি সেগুলোর নাম তোমাকে বলছি- কবি শামসুর রাহমানের ‘কালের ধুলোয় লেখা’, মোফাজ্জল করিম-এর ‘সোনালী সকাল, দুরন্ত দুপুর’, কলিম শরাফীর ‘ভরা থাক স্মৃতি সুধায়’, তপন রায় চৌধুরীর ‘বাঙালনামা’ শাহ এ এম এস কিবরিয়ার ‘পেছন ফিরে দেখা’ অন্নদাশংকর রায়ের ‘নব্বই পেরিয়ে’ আব্দুল মন্নান সৈয়দের ‘ভেসেছিলাম ভাঙা বেলায়’ শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’’ কাজী মোতাহার হোসেনের ‘স্মৃতিকথা’। তাহলে এই বয়সে আমি কোন ধরণের বই পড়ব? তোমার এখন শরৎ চন্দ্র, বিদ্যাসাগর, সুকুমার রায়, নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দের বই পড়ার বয়স হয়েছে। তবে তোমার মানসিক ও মানবিক বিকাশের জন্য তোমাকে দু একটি বইয়ের নাম দিচ্ছি এগুলো পড়ে নিও- ডেলকার্নেগীর রচনা, ডাঃ লুৎফর রহমানের রচনা, ড. হুমায়ুন আজাদের লেখা- ‘‘বুক পকেটে জোনাকী পোকা’’, ‘‘লাল নীল দীপাবলী’’, ‘‘কতো নদী সরোবর’’, ‘‘আব্বুকে মনে পড়ে’’, সুকান্ত সমগ্র, সুকুমার রায় সমগ্র, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সমগ্র। আর মনে রেখ, শুধু বইয়ের মাঝে ডুবে থাকলে হবে না- খেলাধুলাও করতে হবে। মাঝে মধ্যে ভালো সিনেমাও দেখতে পার। হারানো দিনের গান শুনতে পার। রবীন্দ্র সংগীত শুনতে পার। এতে মন উৎফুল্ল থাকবে। আর প্রত্যেকদিন খুব ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে বাহিরের খোলাআলো-বাতাসে পায়চারী করবে। আমার কথা মনে থাকবে?” “জ্বি দাদু। দাদু, এখন কোন বই পড়ছেন ?” “ইদানিং একটি চমৎকার বই পড়তেছি। সেটি হচ্ছে ইন্দিরা গান্ধীকে লেখা পন্ডিত জওহরলাল নেহরুর চিঠি- যেটি Glimpses of world History নামে বই আকারে প্রকাশিত হয়। এই বইটি ‘বিশ্ব ইতিহাস প্রসঙ্গ’ নামে বঙ্গানুবাদও পাওয়া যায়। এটি একটি অমূল্য বই, পড়ে যা মজা পাচ্ছি তা বলার মতো নয়। পন্ডি জওহরলাল নেহরু যখন বিভিন্ন কারাগারে বন্দী ছিলেন; তখন কারাগারে রুদ্ধ থাকা অবস্থায় দশ বছরের কন্যা ইন্দিরা গান্ধীকে বিশ্বজগৎ সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার জন্য এ পত্রগুলো লিখেছেন। সেই পত্রাবলী এখন আমরা জ্ঞানের আকর হিসেবে পড়ছি। তুমি সময় পেলে পড়ে নিও। এ বই পড়ে পৃথিবীর অনেক অজানা অধ্যায় উন্মোচিত হবে। ”
No comments
Post a Comment