প্রয়াত ভদন্ত জ্ঞানধ্বজা মহাথেরো’র সংক্ষিপ্ত জীবনালেখ্যঃ
- ভদন্ত প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো
ভদন্ত জ্ঞানধ্বজা মহাথেরো মহোদয়ের জন্ম ১৯৫৮ খ্রিঃ অব্দের ২ আগস্ট। জন্ম
স্থান কদমতলী, ৩নং বর্নাল। খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার মাটিরাঙ্গা উপজেলাধীন
৩নং বর্নাল ইউনিয়ন এর কদমতলী গ্রাম ছিল একটি বর্ধিঞ্চু গ্রাম। তাঁর পিতার
নাম মৃত চিন্তাধন চাকমা ও মাতা মৃত রজকিনী চাকমা। আশৈশব কালেই
পিতৃ-মাতৃহারা জ্ঞানধ্বজা মহাথেরো ১৯৭৪ খ্রি. অব্দের ১৬ মে তখনকার উদীয়মান
চাকমা ভিক্ষু ভদন্ত উঃ পা-িতা ভিক্ষুর নিকট শ্রামণের হিসেবে দীক্ষা গ্রহণ
করে বুদ্ধের শাসন-সদ্ধর্মে প্রবেশ করেন। তখন তাঁর বয়স ছিল ১৭ (সতের) বছর।
জাতীয় পরিচয়পত্র ও সেকেন্ডারী স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষার সনদপত্র অনুসারে
তাঁর জন্ম তারিখ নির্ধারিত হওয়ার কারণে সঠিক জন্ম তারিখ এর হের ফের হওয়া
স্বাভাবিক। আমার জীবনেও এরুপ ঘটনা ঘটেছে। আমার সঠিক জন্ম তারিখ ১২/০২/১৯৪৮
হলেও নবম শ্রেণীতে থাকাকালীন সেকেন্ডারী স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষার জন্য
ফরম পূর্ণকরণ কালীন দিঘীনালা হাই স্কুলের শ্রদ্ধেয় প্রধান শিক্ষক মহোদয়
কর্তৃক আমার জন্ম তারিখ ০১/০২/১৯৫২ ধরা হয়। আমাদের প্রয়াত ভদন্ত
জ্ঞানধ্বজার জন্ম তারিখ নির্ধারণের বেলায়ও অনুরুপ গণনার আশ্রয় গ্রহণ করা
হয়েছে কিনা জানা নেই। তাঁর জীবদ্দশায় বয়স সংক্রান্ত ব্যাপারে আমাদের মধ্যে
কোনো আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়নি।
ভিক্ষু সনদপত্র অনুসারে ভিক্ষু হিসেবে তাঁর উচ্চতর দীক্ষা গ্রহণের তারিখ ১৯৭৫ খ্রি. অব্দের ১৮ মে। শ্রামণের দীক্ষা গুরু ভদন্ত উঃ পা-িতা ভিক্ষু উচ্চতর দীক্ষা গ্রহণের দিনও আচরিয় হিসেবে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
তাঁর লেখাপড়া ঃ ভদন্ত জ্ঞানধ্বজা মহাথেরো উচ্চশিক্ষিত ছিলেন। তিনি ১৯৭৭ খ্রি. অব্দে সেকেন্ডারী স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা ১৯৭৯ খ্রি. অব্দে উচ্চতর মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা ও ১৯৮৪ খ্রি. অব্দে বি.এ. (ব্যাচেলর অব আর্ট) ডিগ্রী অর্জন করেন। ইংরেজী ও বাংলা উভয় ভাষায় তাঁর অশেষ দক্ষতা ছিল। বিশেষ করে ইংরেজী ভাষায় তাঁকে শব্দ ভা-ন্ডারগারিক হিসেবে আখ্যা দেয়া যায়। ইংরেজী ভাষায় এমন কোন শব্দ খুঁজে পাওয়া যেতো না- যা তিনি জানতেন না। তিনি একজন দক্ষ ব্যাকরণ বিশারদও বটে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ইংরেজী ভাষা ও ব্যাকরণের উপর তিনি ছাত্র/ছাত্রীদেরকে নব নব পদ্ধতি অবলম্বন পূর্বক এমনভাবে পাঠদান ও পাঠ পরিকল্পনা প্রণয়ন করে দিতেন- তা’তে তাঁর ছাত্র/ছাত্রীরা শতভাগ কৃতিত্বের সাথে ঐ বিষয়টি পাশ করার ক্যারিশমা দেখাতো। তাঁর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ইংরেজী ভাষা জ্ঞানে ঋদ্ধ ছাত্র/ছাত্রীরা ইংরেজী সাহিত্যে বিশ্ব বিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে বলে জানা যায়।
১৯৭৯ খ্রি. অব্দে ‘পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রমে’র উদ্যোগে অনাথাশ্রম আবাসিক উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। তার আগে এ অনাথাশ্রমের আশ্রিত এতিমরা ৫(পাঁচ) কিলোমিটার দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে ‘দিঘীনালা উচ্চ বিদ্যালয়ে’ পড়ালেখা করতে যেতে বাধ্য হতো। ভদন্ত জ্ঞানধ্বজা মহাথেরো ১৯৮১ খ্রি. অব্দে অনাথাশ্রম আবাসিক উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তখন থেকে তাঁর সাখে আমার পরিচয় ও হৃদ্যতা ক্রমশ বাড়তে থাকে। অতীব মর্মযাতনার বিষয় হল এই- ১৯৮৬ খ্রি. অব্দের ১৪ জুন ১৯৬১ খ্রি. অব্দে আমার গুরু মহামান্য পরমপূজ্য ভদন্ত জ্ঞানশ্রী মহাথেরো কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রম’ নবাগত বাঙ্গালী শরণার্থীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পুরোপুরি ধ্বংস স্তুপে পরিণত হয়। তখন পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রমে ৩০০ (তিনশত) জন এতিম ছাত্র আবাসিকভাবে অবস্থান করতো। অনাথাশ্রম আবাসিক উচ্চ বিদ্যালয়ে তারা নানা শ্রেণীতে অধ্যয়নরত ছিল। সেদিন ছাত্রদের ৬ (ছয়)টি আবাসিক ভবন, একটি বৌদ্ধ মন্দির নাম ধর্মোদয় বৌদ্ধ বিহার, একটি মেডিকেল সেন্টার, পাকঘরসহ ৩০০ (তিনশত) জন ছাত্র একসঙ্গে খাবার গ্রহণের ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন একটি ভোজনালয়, একটি টেকনিক্যাল স্কুল, একটি পাঠাগার পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ৩০০ (তিনশত) ছাত্রদের মধ্যে বান্দরবান পার্বত্য জেলা থেকে আগত ৫০ (পঞ্চাশ) জন ছাত্র রাতের অন্ধকারে পালিয়ে এসে রাঙ্গামাটিস্থ মোনঘর শিশু সদনে আশ্রয় নেয়। বাকী ২৫০ (দু’শত পঞ্চাশ) জন ১২ (বার) জন বৌদ্ধ ভিক্ষুর সাথে ভারতের পার্বত্য ত্রিপুরায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। ঐ ১২ (বার) জন বৌদ্ধ ভিক্ষুর মধ্যে ভদন্ত জ্ঞানধ্বজা মহাথেরো ছিলেন অন্যতম।
ভদন্ত জ্ঞানধ্বজা মহাথেরো ১৯৮৬ খ্রি. অব্দের ১৪ জুন হতে ১৯৯৭ খ্রি. অব্দে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের আগ পর্যন্ত দীর্ঘ ১২ বৎসর ভারতের পার্বত্য ত্রিপুরার করবুক শরণার্থী ক্যাম্পে মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হন। সীমিত পরিসরে তাকুম বাড়ী শরণার্থী ক্যাম্পেও তিনি শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন বলে জানা যায়। ঐ ক্যাম্পের ছাত্র/ছাত্রীদেরকে একত্রিত করে তিনি সেখানে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করার তাগিদ অনুভব করেন। তাঁর স্বপ্রতিষ্ঠিত স্কুলে তিনি নিজেই সেখানে শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত হন। বাংলাদেশে ফিরে আসার আগ পর্যন্ত তিনি সেখানে শিক্ষকতা পেশা অব্যাহত রাখেন।
১৯৯৭ খ্রি. অব্দের ২ ডিসেম্বর শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। অতঃপর ভারতের পার্বত্য ত্রিপুরায় আশ্রিত শরণার্থীদের প্রত্যাগমন প্রক্রিয়া শুরু হয়। ভদন্ত জ্ঞানধ্বজা মহাথেরো ভারত থেকে ফিরে এসে রাঙ্গামাটি আনন্দ বিহারে অন্তেবাসী ভিক্ষু হিসেবে আশ্রয় নেন।
১৯৯৮ খ্রি. অব্দের ডিসেম্বরের দিকে তিনি মোনঘরে গমন করেন। মোনঘর কার্যনির্বাহী পরিষদে তাঁকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত করা হয় এবং মোনঘর শিশু সদনের একটি আবাসিক ভবনের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। ২০০৪ খ্রি. অব্দের ৯ জুলাই পর্যন্ত ভদন্ত জ্ঞানধ্বজা মহাথেরো মোনঘর শিশু সদনের নানা পদে অধিষ্ঠিত থেকে এ এতিমখানায় আশ্রিত শিশুদের প্রভুত উপকার সাধন করেন।
২০০৪ খ্রি.অব্দের ৯ জুলাই আমি মিরপুরস্থ শাক্যমুনি বৌদ্ধ বিহারকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠিত বনফুল কমপ্লেক্সে ’বনফুল আদিবাসী গ্রিনহার্ট কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করি। ২০০৫ খ্রি. অব্দের জানুয়ারীর প্রথম ভাগে ভদন্ত জ্ঞানধ্বজা মহাথেরো উক্ত কলেজে স্কুল পর্যায়ে ইংরেজী ভার্সনের একজন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে ২০০৭ খ্রি. অব্দের ৩১ ডিসেম্বর তিনি উক্ত পদে ইস্তফা প্রদান করে তবলছড়িস্থ রাঙ্গামাটি আনন্দ বিহারে একজন অন্তেবাসী ভিক্ষু হিসেবে স্থায়ীভাবে অবস্থানের লক্ষ্য নিয়ে চলে আসেন।শারীরিকভাবে কিছুটা সুস্থ হলে তিনি রাঙ্গামাটিস্থ ’ঘাগড়া কলেজে’ খ-কালীন প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। মহাপ্রয়াণের আগ পর্যন্ত তিনি ঐ কলেজে ঐ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
২০১২ খ্রি. অব্দের ২৬ নভেম্বর মধ্যরাত্রে রাঙ্গামাটি সদর হসপিতালে তাঁর মহাপ্রয়াণ ঘটে। মহাপ্রয়াণের সময়কাল রাত ২ ঘটিকা।
দুঃখ মুক্তির অন্বেষণে ভদন্ত জ্ঞানধ্বজা ঃ ভদন্ত জ্ঞানধ্বজা মহাথেরো মুক্ত বিহঙ্গ সদৃশ ভিক্ষু জীবনে একাগ্রচিত্তে শীল-সমাধি ও প্রজ্ঞার সাধনায় সদা সর্বদা বিমন্ডিত থাকার চেষ্টা করেছিলেন। জ্ঞানান্বেষণ ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। অলস সময় কাটানো তাঁর ধাতে ছিল না। দিন ও রাতের অধিকাংশ সময় বই ছিল তাঁর একান্ত সঙ্গী। শুধু বুদ্ধের ধর্ম-দর্শনের বই নয়, নানা ধরনের জ্ঞানমূলক বই পড়া এবং সংগ্রহ করা ছিল তাঁর একমাত্র শখ। দান-দক্ষিণা হিসেবে প্রাপ্ত সমুদয় টাকা তিনি বই কেনায় ব্যয় করেছিলেন বলে আমার ধারণা। তাঁর মহাপ্রয়াণের পর তাঁর সংগ্রহ শালায় দুই সহস্রাধিক বই পাওয়া যায়। অনেক বই খুবই দুর্লভ- যা আমার গোটা জীবনের সংগ্রহ শালায়ও সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি।
পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ বাংলাদেশের সদস্যভুক্ত সংঘ সদস্যদের মধ্যে শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন বিনির্মাণের লক্ষে কি পদক্ষেপ গ্রহণ করা যৌক্তিক তা নিয়ে তিনি সব সময় ভাবতেন। সময় ও সুযোগ পেলে এ ব্যাপারে তিনি আমার সাথে এবং অপরাপরসংঘ সদস্যদের সাথে আলোচনায় ব্যাপৃত থাকতেন। সংঘের সুনাম সুযশ ও সুকীর্তি জনমানসে বিঘোষিত হলে তিনি পরম পুলক অনুভব করতেন। লোভ-দ্বেষ-মোহের বশবর্তী হয়ে কারো সাথে তাঁকে রাগারাগি করতে দেখা যায়নি। যথালাভে সন্তুষ্ট থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে ভিক্ষু জীবন অতিবাহিত করা ছিল তাঁর জীবনের ধর্ম ও ব্রত। ক্ষুদ্র স্বার্থ চরিতার্থ করার তাগিদে তিনি কারো বিরুদ্ধে সমালোচনা মুখর বা অঙ্গুলি নির্দেশ করতে কখনো দেখা যায়নি। কিন্তু সাংঘিক স্বার্থের ব্যাপারে তিনি আপোষহীন ছিলেন সব সময়।
শ্রুতময়ী ও চিন্তনময়ী জ্ঞান আহরণের পাশাপাশি ভাবনাময়ী জ্ঞান আহরণের ব্যাপারে তাঁর প্রযতœ ও সাধনা ছিল অমলিন। যুগ ধর্ম ও যুগ যন্ত্রণার তাগিদে ভাবনাময়ী জ্ঞান আহরণের অনুষঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামস্থ ভিক্ষু সংঘের মধ্যে ইতিমধ্যে অনেক অনেক মতভেদ ও দ্বিধা-বিভক্তি পরিলক্ষিত হয়। বিশ্ব বিখ্যাত ধ্যানগুরু সত্যনারায়ন গোয়েঙ্কাজীর উদ্যোগে বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ভাবনাময়ী জ্ঞানান্বেষণের লক্ষে ১০(দশ) দিনের ধ্যানানুশীলন কোর্স চালু করা হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিক্ষু মন্ডলীর মধ্যে অনেক ধ্যানগুরু বা বিদর্শনাচার্য্যের আবির্ভাব ঘটেছে। পৃথিবীর সর্বত্র ধ্যানগুরু গোয়েঙ্কাজীর উদ্যোগে বুদ্ধের নির্দেশিত “সতিপট্ঠানসুত্তের” ধ্যান পদ্ধতিকে অকৃত্রিম পবিত্রতায় অক্ষুন্ন রেখে শমথ ও বিদর্শন ধ্যানানুশীলনের কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে জাতি-ধর্ম-বর্ণ সম্প্রদায় নির্বিশেষে তাবৎ মানব জাতির কল্যাণে আত্মশক্তি ও আত্মানুসন্ধানের প্রাণবন্যা বয়ে যাচ্ছে। তার আংশিক জোয়ার বাংলাদেশের সমতল ও আদিবাসী উভয় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যেও বর্তমানে পরিলক্ষিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে ইঁচড়েপাকা বা অকালপক্ষ ধ্যানগুরুর আবির্ভাব ঘটেছে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের আনাচে কানাচে। তাঁদের মধ্যে কেউ ৭ (সাত) দিনের কেউ ১০ (দশ) দিনের কোর্স চালু করে ধ্যানীদেরকে ধ্যানানুশীলন দিয়ে চলেছেন।। বস্তুতঃ শমথ ও বিদর্শন (ওহংরমযঃ গবফরঃধঃরড়হ) উভয় ভাবনায় নিরবে নিভৃতে চিত্তের গতিবিধি, গোটা শরীরের মধ্যে যখন যে অনুভূতি উৎপন্ন হবে তা গভীর সম্প্রজ্ঞান সহযোগে লক্ষ্য রেখে উৎপন্ন অনুভূতির সফল পরিসমাপ্তি ঘটানোর একটি প্রক্রিয়া বিশেষ। এসব চিত্তজয়ের মধ্য দিয়ে আত্মজয়ের কার্যাদি নিরবে নিভৃতে সাধন করতে হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ কোথাও কোথাও গভীর ধ্যানানুশীলনের এক পর্যায়ে চরম অনুভূতির মোক্ষম সময়ে ব্যথা,ব্যথা,ব্যথা শব্দে যোগীদের মধ্যে চিল চিৎকার করার নির্দেশনাও ধ্যানগুরুরা দিয়ে থাকেন বলে শোনা যায়। এসব নির্দেশনার ফলে কুশল করতে গিয়ে অকুশলের পাল্লা ভারী হচ্ছে কিনা একমাত্র বিচক্ষণ ধ্যান যোগীরাই বলতে পারবেন এবং ‘কুসলং উপনিস্সয অকুসলং পবড্ঢতি,’ কে স্বাগত জানানো হচ্ছে কিনা- জানি না। তাঁরা শ্রদ্ধাবান ও শ্রদ্ধাশীলা দায়ক-দায়িকাদের কাছে নিজেদেরকে অনন্য সাধারণ ধ্যানগুরু হিসেবে প্রতিপন্ন করতে, পরিচয় দিতে দ্বিধা করেন না। এর থেকেও এক ধাপ উপরে উঠে কেউ কেউ নিজেদেরকে শ্রাবকবুদ্ধ, অনুবুদ্ধ, ষড়াভিজ্ঞালাভী অর্হৎ, আর্যপুরুষ হিসেবে পরিচয় দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেন না। আমাদের ভদন্ত জ্ঞানধ্বজা মহাথেরো এরূপ হীন মানসিকতা সম্পন্ন ভিক্ষুদের প্রতি ছিলেন সমালোচনামুখর। তিনি মনে করতেন দুঃখ মুক্তির লক্ষে ধ্যানানুশীলনের কিছু বিধিবদ্ধ পদ্ধতি রয়েছে। এ পদ্ধতি চিরন্তন, চিরকালীন ও সর্বজনীন। এ পদ্ধতি মানবপুত্র বুদ্ধ কর্তৃক আবিষ্কৃত, নির্দেশিত ও বিধিবদ্ধ। ধ্যানানুশীলনের বিধিবদ্ধ পদ্ধতির বাইরে গিয়ে অনেক ভিক্ষু ইদানীং ধ্যান কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা পূর্বক পুণ্যবান ও পুণ্যবতী দায়ক-দায়িকাদের দৃষ্টি আকর্ষণের প্রয়াস চালাচ্ছেন। ভদন্ত জ্ঞানধ্বজা মহাথেরো এরূপ চালবাজ ভিক্ষুদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পিছপা হতেন না। এদের বিরুদ্ধে তাঁর কন্ঠ থাকতো সব সময় সোচ্চার।
তাঁর দৃষ্টিতে একজন বিদর্শন সাধক কখনো চালবাজী করতে পারেন না। নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করার লক্ষে সাধারণ দায়ক দায়িকাদের মাঝে নিজেকে আকারে ইঙ্গিতে হলেও মার্গলাভী, অনুবুদ্ধ প্রভৃতি অভিধায় অভিষিক্ত বা অধিষ্ঠিত করার অপপ্রয়াস চালাতে পারেন না। যদি কোন ভিক্ষু বা ধ্যানগুরু বা বিদর্শন সাধক মার্গলাভী হন তাও সাধারণ জন সমক্ষে তা প্রচার না করার জন্য বুদ্ধের কঠোর নির্দেশনা ছিল। কারণ, সাধারণ জনগণ তা বিশ্বাস করলে তো ভালো কথা কিন্তু বিশ্বাস না করলে তাদের পাপ হতে বাধ্য। তাই করুণাঘন বুদ্ধের এরূপ কঠোর নির্দেশনা। প্রাতিমোক্ষের চতুর্থ পারাজিকার মধ্যে রয়েছে- “যো পন ভিক্খু অনভিজানং উত্তরি মনুস্্স ধম্মং অত্তুপনাযিকং অসমরিয ঞানদস্্সনং সমুদাচরেয্য ইতি জানামি, ইতি পস্্সামী’তি, ততো অপরেন সমযেন সমনুগ্্গহিযমানো বা অসমনুগ্্গ হিযমানো বা আপন্নো বিসদ্ধাপেক্খো এবং বদেয্য অজানেব আবুসো অব্বং জানামি, অপস্্সং পস্্সামি তুচ্ছং মুসা বিলপিন্তি, অঞ্্ঞত্র অধিমানা, অযম্পি পারাজিকো হোতি অসংবাসোতি।” অনুবাদের নির্যাস হল এই- যদি কোন ভিক্ষু ধ্যান বিমোক্ষাদি লোকোত্তর জ্ঞান লাভ না করা সত্ত্বেও নিছক লাভ সৎকারের আশায় ধ্যান বিমোক্ষাদি লোকোত্তর জ্ঞান লাভ করেছি বলে মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করে তবে তার পারাজিকা হতে বাধ্য। ভদন্ত জ্ঞানধ্বজা মহাথেরো সংঘ সমাজের এসব চালবাজী বিষয়সমূহ মোটেই গ্রহণযোগ্য মনে করতেন না। চরমভাবে নিন্দনীয় মনে করতেন। তাঁর দৃষ্টিতে শ্রাবকবুদ্ধ, অনুবুদ্ধ ও মার্গলাভীদের পরচর্চা, পরনিন্দা, পরছিদ্রান্বেষণ বাদ দিয়ে আত্মচর্চা, আত্ম সমীক্ষা, আত্মশুদ্ধি, আত্মঅন্বেষণ, আত্ম উন্নয়নে সদা সর্বদা নিরত থাকা উচিত। তিনি মনে করতেন- স্বঘোষিত শ্রাবকবুদ্ধ, অনুবুদ্ধ ও মার্গলাভীদের বাক্য সংযমতা কঠোর ভাবে থাকা উচিত। তাঁর মতে যার বাক্য সংযমতা নেই সে কোন ধরনের মার্গলাভী? তাঁর মতে কায় সংযম সাধু, চক্ষু সংযম সাধু, ঘ্রাণ সংযম সাধু, কর্ণ সংযম সাধু, জিহ্বা সংযম সাধু এবং মনো সংযম সাধু। এ ষড় সংযম যে মার্গলাভী অনুপুঙ্খ সুসংরক্ষণ করতে পারে সেই না সত্যিকার সাধু!
ভদন্ত জ্ঞানধ্বজা মহাথেরো মাত্র ৫৫ (পঞ্চান্ন) বছর বয়সে আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিলেন। তাঁর মতো একজন উচ্চশিক্ষিত ইংরেজী জ্ঞানে দক্ষ ভিক্ষুকে হারিয়ে পার্বত্য ভিক্ষু সংঘের তাবৎ ভিক্ষু মন্ডলীসহ অবিভক্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের পুণ্যবান ও পুণ্যশীলা দায়ক দায়িকারা আজ দিশেহারা ও হতাশ। পার্বত্য ভিক্ষু সংঘের যে অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়েছে তা কত যুগ পরে পূরণ হবে তা ভবিতব্যই জানে।
আজ ২২/০২/২০১৩ তারিখ শুক্রবার আনুষ্ঠানিকভাবে এ প্রয়াত সংঘ মনীষার শবদাহক্রিয়া অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তাঁর শেষ বিদায়ের দিনে পার্বত্য ভিক্ষু সংঘের পরমারাধ্য সংঘরাজ ভদন্ত অভয়তিষ্য মহাস্থবির মহোদয়, পরমারাধ্য উপ-সংঘরাজ শ্রদ্ধেয় ভদন্ত তিলোকানন্দ মহাস্থবির মহোদয় সহ পার্বত্য ভিক্ষু সংঘের তাবৎ ভিক্ষু মন্ডলী সকৃতজ্ঞচিত্তে উপস্থিত হয়েছেন। আমরা সমন্বিতভাবে তাঁর পারলৌকিক সদ্্গতি কামনা করবো। প্রত্যাশা রাখবো দুঃখ মুক্তির দুর্লভ হেতু সম্পত্তি তাঁর উৎপন্ন হোক।
প্রয়াত ভদন্ত জ্ঞানধ্বজা মহাথেরো মহোদয়ের শবদাহক্রিয়া অনুষ্ঠানকে অতিশয় পুণ্যপুত, স্মরণযোগ্য, হৃদয়গ্রাহী ও পার্বত্য ভিক্ষুসংঘের সংঘ শক্তিকে অনুপ্রাণীত ও সম্মানীত করার জন্যে পার্বত্য ভিক্ষু সংঘের পরমারাধ্য সংঘ মণীষা ভারতের কলকাতা শিশু করুণাসংঘের প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট ভদন্ত বিমল তিষ্য মহাস্থবির মহোদয় পার্বত্য ভিক্ষু সংঘের তাবৎ ভিক্ষু সংঘকে দান করার লক্ষে ৫০০ (পাঁচশত) সেট রংবস্ত্র বা চীবর সংগ্রহ করে রাঙ্গামাটি আনন্দ বিহারে পাঠানোর বিরল নজির স্থাপন করার পরাকাষ্টা দেখিয়েছেন। এ অনন্য সাধারণ কর্মযজ্ঞে কুশীলব হিসেবে অন্তরঙ্গভাবে জড়িত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী কুলপুত্র ভিক্ষু কুল গৌরব ভদন্ত ড. গিরিমানন্দ মহাথেরো মহোদয়। তিনি এবং পরমারাধ্য ভদন্ত বিমল তিষ্য মহাস্থবির মহোদয় ভারতের বুদ্ধগয়ায় স্থায়ীভাবে বসবাসরত থাই, মায়ানমার ও শ্রীলংকার দায়ক-দায়িকা সমিতির কাছে আবেদন করে এ ৫০০ (পাঁচশত) সেট চীবর সংগ্রহ করেছেন। আমরা পার্বত্য ভিক্ষু সংঘের তাবৎ ভিক্ষু মন্ডলী, পার্বত্য চট্টগ্রামের পুণ্যবান পুণ্যাশীলা দায়ক-দায়িকাবৃন্দ সকৃতজ্ঞচিত্তে থাই মায়ানমার ও শ্রীলংকার দায়ক দায়িকা সমিতির পাঠানো ৫০০ (পাঁচশত) সেট চীবর পুণ্যানুমোদনের মধ্য দিয়ে গ্রহণ করছি। আমরা পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ তাঁদের এ মহাদান সশ্রদ্ধচিত্তে গ্রহণ করে তাঁদের ইহলৌকিক সার্বিক কল্যাণ, মঙ্গল কামনা করছি। তাঁদের এ অনন্য মহাদানের আনিসংস দুঃখ মুক্তির হেতু অর্জনের কারণ হোক।
প্রয়াত ভদন্ত জ্ঞানধ্বজার শেষ কর্মস্থল ছিল রাঙ্গামাটিস্থ ঘাগড়া কলেজ। এ কলেজের অধ্যক্ষ মি. শ্যামল মিত্র চাক্মা ও প্রভাষক মি. কর্মসেন চাক্মা এবং এ কলেজের জ্ঞানধ্বজার গুণমুগ্ধ ছাত্র/ছাত্রীবৃন্দ জ্ঞানধ্বজার শবদাহক্রিয়া অনুষ্ঠানের জন্য ১০,০০০ (দশ হাজার) টাকা অনুদান ও প্রয়াত ভদন্তের পারলৌকিক সদ্্গতি কামনায় অষ্টপরিষ্কার দান করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। আমি তাঁদের এ শুভ উদ্যোগকে শ্রদ্ধাভরে স্বাগত জানাই।
প্রয়াত ভদন্ত জ্ঞানধ্বজা মহাথেরো মহোদয়ের শবদাহক্রিয়া অনুষ্ঠান ত্রুটিহীনভাবে সুসম্পাদনার প্রতি সহৃদয় দৃষ্টি রেখে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী মিঃ দীপংকর তালুকদার এম.পি. মহোদয় ২,০০,০০০/-(দুই লক্ষ) টাকা, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জিলা পরিষদের মাননীয় চেয়ারম্যান মিঃ নিখিল কুমার চাক্্মা মহোদয় ৫০,০০০/-(পঞ্চাশ হাজার) টাকা, ঢাকা মিরপুরস্থ বনফুল আদিবাসী গ্রিনহার্ট কলেজ কর্তৃপক্ষ ৪২,০০০/- (বিয়াল্লিশ হাজার) টাকা, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, দিঘীনালা, বাঘাইছড়ি, নানিয়ারচর জেলা ও উপজেলার ভিক্ষু সংঘ সহ পুণ্যবান ও পুণ্যাশীলা দায়ক দায়িকারা যথাসাধ্য অর্থদানের মধ্য দিয়ে প্রয়াত জ্ঞানধ্বজা মহাথেরো মহোদয়ের প্রতি নিখাদ ভালবাসার ও শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত রাখার নজির স্থাপন করেছেন- আমি তাঁদেরএ মহতী পুণ্য সংস্কৃতি সহ কর্ম সংস্কৃতিকে স্বাগত জানাই। তাঁরা সদাসর্বদা মঙ্গল ও কল্যাণ দর্শন করুক। তাঁদের দুঃখান্তসাধনের হেতু উৎপন্ন হোক। রাঙ্গামাটি আনন্দ বিহারের ও মৈত্রী বিহারের পুণ্যবান ও পুণ্যশীলা দায়ক দায়িকারা এ শবদাহক্রিয়া অনুষ্ঠানে আগত তাবৎ ভিক্ষু সংঘকে প্রাতঃরাশ ও দ্বিপ্রাহরিক ভোজন মিলে ৪(চার) বেলা নানাবিধ খাদ্য ভোজ্য ও আহারাদির মাধ্যমে পূজা করার সদিচ্ছা পোষণ করায়- তাঁদের এ অনন্য মহদ্্গতচিত্ত ও প্রশংসাধন্য নজিরকেও আমি শ্রদ্ধাভরে স্বাগত জানাই। জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে তাঁরা সদা সর্বদা মঙ্গল ও কল্যাণ দর্শন করুক। দুঃখ মুক্তির হেতু তাঁদের উৎপন্ন হোক।
পরিশেষে পার্বত্য ভিক্ষু সংঘে অন্তর্ভুক্ত মহা ভিক্ষু সংঘের প্রতি রইল আমার অমলিন শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। প্রয়াত ভদন্ত জ্ঞানধ্বজা মহাথেরোর প্রতি তাবৎ ভিক্ষু সংঘ দায়বদ্ধ দায়িত্ব প্রতিপালনের অনুষঙ্গে যে অনন্য সাধারণ নজির স্থাপন করলেন তাতে আমি সমুত্তেজিত অনুপ্রাণীত, অভিভুত। মহাসংঘ সব সময় ঐক্যবদ্ধ থাকুক- এ পবিত্র আশাবাদ ব্যক্ত করি।
ভিক্ষু সনদপত্র অনুসারে ভিক্ষু হিসেবে তাঁর উচ্চতর দীক্ষা গ্রহণের তারিখ ১৯৭৫ খ্রি. অব্দের ১৮ মে। শ্রামণের দীক্ষা গুরু ভদন্ত উঃ পা-িতা ভিক্ষু উচ্চতর দীক্ষা গ্রহণের দিনও আচরিয় হিসেবে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
তাঁর লেখাপড়া ঃ ভদন্ত জ্ঞানধ্বজা মহাথেরো উচ্চশিক্ষিত ছিলেন। তিনি ১৯৭৭ খ্রি. অব্দে সেকেন্ডারী স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা ১৯৭৯ খ্রি. অব্দে উচ্চতর মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা ও ১৯৮৪ খ্রি. অব্দে বি.এ. (ব্যাচেলর অব আর্ট) ডিগ্রী অর্জন করেন। ইংরেজী ও বাংলা উভয় ভাষায় তাঁর অশেষ দক্ষতা ছিল। বিশেষ করে ইংরেজী ভাষায় তাঁকে শব্দ ভা-ন্ডারগারিক হিসেবে আখ্যা দেয়া যায়। ইংরেজী ভাষায় এমন কোন শব্দ খুঁজে পাওয়া যেতো না- যা তিনি জানতেন না। তিনি একজন দক্ষ ব্যাকরণ বিশারদও বটে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ইংরেজী ভাষা ও ব্যাকরণের উপর তিনি ছাত্র/ছাত্রীদেরকে নব নব পদ্ধতি অবলম্বন পূর্বক এমনভাবে পাঠদান ও পাঠ পরিকল্পনা প্রণয়ন করে দিতেন- তা’তে তাঁর ছাত্র/ছাত্রীরা শতভাগ কৃতিত্বের সাথে ঐ বিষয়টি পাশ করার ক্যারিশমা দেখাতো। তাঁর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ইংরেজী ভাষা জ্ঞানে ঋদ্ধ ছাত্র/ছাত্রীরা ইংরেজী সাহিত্যে বিশ্ব বিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে বলে জানা যায়।
১৯৭৯ খ্রি. অব্দে ‘পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রমে’র উদ্যোগে অনাথাশ্রম আবাসিক উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। তার আগে এ অনাথাশ্রমের আশ্রিত এতিমরা ৫(পাঁচ) কিলোমিটার দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে ‘দিঘীনালা উচ্চ বিদ্যালয়ে’ পড়ালেখা করতে যেতে বাধ্য হতো। ভদন্ত জ্ঞানধ্বজা মহাথেরো ১৯৮১ খ্রি. অব্দে অনাথাশ্রম আবাসিক উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তখন থেকে তাঁর সাখে আমার পরিচয় ও হৃদ্যতা ক্রমশ বাড়তে থাকে। অতীব মর্মযাতনার বিষয় হল এই- ১৯৮৬ খ্রি. অব্দের ১৪ জুন ১৯৬১ খ্রি. অব্দে আমার গুরু মহামান্য পরমপূজ্য ভদন্ত জ্ঞানশ্রী মহাথেরো কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রম’ নবাগত বাঙ্গালী শরণার্থীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পুরোপুরি ধ্বংস স্তুপে পরিণত হয়। তখন পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রমে ৩০০ (তিনশত) জন এতিম ছাত্র আবাসিকভাবে অবস্থান করতো। অনাথাশ্রম আবাসিক উচ্চ বিদ্যালয়ে তারা নানা শ্রেণীতে অধ্যয়নরত ছিল। সেদিন ছাত্রদের ৬ (ছয়)টি আবাসিক ভবন, একটি বৌদ্ধ মন্দির নাম ধর্মোদয় বৌদ্ধ বিহার, একটি মেডিকেল সেন্টার, পাকঘরসহ ৩০০ (তিনশত) জন ছাত্র একসঙ্গে খাবার গ্রহণের ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন একটি ভোজনালয়, একটি টেকনিক্যাল স্কুল, একটি পাঠাগার পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ৩০০ (তিনশত) ছাত্রদের মধ্যে বান্দরবান পার্বত্য জেলা থেকে আগত ৫০ (পঞ্চাশ) জন ছাত্র রাতের অন্ধকারে পালিয়ে এসে রাঙ্গামাটিস্থ মোনঘর শিশু সদনে আশ্রয় নেয়। বাকী ২৫০ (দু’শত পঞ্চাশ) জন ১২ (বার) জন বৌদ্ধ ভিক্ষুর সাথে ভারতের পার্বত্য ত্রিপুরায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। ঐ ১২ (বার) জন বৌদ্ধ ভিক্ষুর মধ্যে ভদন্ত জ্ঞানধ্বজা মহাথেরো ছিলেন অন্যতম।
ভদন্ত জ্ঞানধ্বজা মহাথেরো ১৯৮৬ খ্রি. অব্দের ১৪ জুন হতে ১৯৯৭ খ্রি. অব্দে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের আগ পর্যন্ত দীর্ঘ ১২ বৎসর ভারতের পার্বত্য ত্রিপুরার করবুক শরণার্থী ক্যাম্পে মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হন। সীমিত পরিসরে তাকুম বাড়ী শরণার্থী ক্যাম্পেও তিনি শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন বলে জানা যায়। ঐ ক্যাম্পের ছাত্র/ছাত্রীদেরকে একত্রিত করে তিনি সেখানে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করার তাগিদ অনুভব করেন। তাঁর স্বপ্রতিষ্ঠিত স্কুলে তিনি নিজেই সেখানে শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত হন। বাংলাদেশে ফিরে আসার আগ পর্যন্ত তিনি সেখানে শিক্ষকতা পেশা অব্যাহত রাখেন।
১৯৯৭ খ্রি. অব্দের ২ ডিসেম্বর শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। অতঃপর ভারতের পার্বত্য ত্রিপুরায় আশ্রিত শরণার্থীদের প্রত্যাগমন প্রক্রিয়া শুরু হয়। ভদন্ত জ্ঞানধ্বজা মহাথেরো ভারত থেকে ফিরে এসে রাঙ্গামাটি আনন্দ বিহারে অন্তেবাসী ভিক্ষু হিসেবে আশ্রয় নেন।
১৯৯৮ খ্রি. অব্দের ডিসেম্বরের দিকে তিনি মোনঘরে গমন করেন। মোনঘর কার্যনির্বাহী পরিষদে তাঁকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত করা হয় এবং মোনঘর শিশু সদনের একটি আবাসিক ভবনের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। ২০০৪ খ্রি. অব্দের ৯ জুলাই পর্যন্ত ভদন্ত জ্ঞানধ্বজা মহাথেরো মোনঘর শিশু সদনের নানা পদে অধিষ্ঠিত থেকে এ এতিমখানায় আশ্রিত শিশুদের প্রভুত উপকার সাধন করেন।
২০০৪ খ্রি.অব্দের ৯ জুলাই আমি মিরপুরস্থ শাক্যমুনি বৌদ্ধ বিহারকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠিত বনফুল কমপ্লেক্সে ’বনফুল আদিবাসী গ্রিনহার্ট কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করি। ২০০৫ খ্রি. অব্দের জানুয়ারীর প্রথম ভাগে ভদন্ত জ্ঞানধ্বজা মহাথেরো উক্ত কলেজে স্কুল পর্যায়ে ইংরেজী ভার্সনের একজন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে ২০০৭ খ্রি. অব্দের ৩১ ডিসেম্বর তিনি উক্ত পদে ইস্তফা প্রদান করে তবলছড়িস্থ রাঙ্গামাটি আনন্দ বিহারে একজন অন্তেবাসী ভিক্ষু হিসেবে স্থায়ীভাবে অবস্থানের লক্ষ্য নিয়ে চলে আসেন।শারীরিকভাবে কিছুটা সুস্থ হলে তিনি রাঙ্গামাটিস্থ ’ঘাগড়া কলেজে’ খ-কালীন প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। মহাপ্রয়াণের আগ পর্যন্ত তিনি ঐ কলেজে ঐ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
২০১২ খ্রি. অব্দের ২৬ নভেম্বর মধ্যরাত্রে রাঙ্গামাটি সদর হসপিতালে তাঁর মহাপ্রয়াণ ঘটে। মহাপ্রয়াণের সময়কাল রাত ২ ঘটিকা।
দুঃখ মুক্তির অন্বেষণে ভদন্ত জ্ঞানধ্বজা ঃ ভদন্ত জ্ঞানধ্বজা মহাথেরো মুক্ত বিহঙ্গ সদৃশ ভিক্ষু জীবনে একাগ্রচিত্তে শীল-সমাধি ও প্রজ্ঞার সাধনায় সদা সর্বদা বিমন্ডিত থাকার চেষ্টা করেছিলেন। জ্ঞানান্বেষণ ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। অলস সময় কাটানো তাঁর ধাতে ছিল না। দিন ও রাতের অধিকাংশ সময় বই ছিল তাঁর একান্ত সঙ্গী। শুধু বুদ্ধের ধর্ম-দর্শনের বই নয়, নানা ধরনের জ্ঞানমূলক বই পড়া এবং সংগ্রহ করা ছিল তাঁর একমাত্র শখ। দান-দক্ষিণা হিসেবে প্রাপ্ত সমুদয় টাকা তিনি বই কেনায় ব্যয় করেছিলেন বলে আমার ধারণা। তাঁর মহাপ্রয়াণের পর তাঁর সংগ্রহ শালায় দুই সহস্রাধিক বই পাওয়া যায়। অনেক বই খুবই দুর্লভ- যা আমার গোটা জীবনের সংগ্রহ শালায়ও সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি।
পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ বাংলাদেশের সদস্যভুক্ত সংঘ সদস্যদের মধ্যে শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন বিনির্মাণের লক্ষে কি পদক্ষেপ গ্রহণ করা যৌক্তিক তা নিয়ে তিনি সব সময় ভাবতেন। সময় ও সুযোগ পেলে এ ব্যাপারে তিনি আমার সাথে এবং অপরাপরসংঘ সদস্যদের সাথে আলোচনায় ব্যাপৃত থাকতেন। সংঘের সুনাম সুযশ ও সুকীর্তি জনমানসে বিঘোষিত হলে তিনি পরম পুলক অনুভব করতেন। লোভ-দ্বেষ-মোহের বশবর্তী হয়ে কারো সাথে তাঁকে রাগারাগি করতে দেখা যায়নি। যথালাভে সন্তুষ্ট থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে ভিক্ষু জীবন অতিবাহিত করা ছিল তাঁর জীবনের ধর্ম ও ব্রত। ক্ষুদ্র স্বার্থ চরিতার্থ করার তাগিদে তিনি কারো বিরুদ্ধে সমালোচনা মুখর বা অঙ্গুলি নির্দেশ করতে কখনো দেখা যায়নি। কিন্তু সাংঘিক স্বার্থের ব্যাপারে তিনি আপোষহীন ছিলেন সব সময়।
শ্রুতময়ী ও চিন্তনময়ী জ্ঞান আহরণের পাশাপাশি ভাবনাময়ী জ্ঞান আহরণের ব্যাপারে তাঁর প্রযতœ ও সাধনা ছিল অমলিন। যুগ ধর্ম ও যুগ যন্ত্রণার তাগিদে ভাবনাময়ী জ্ঞান আহরণের অনুষঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামস্থ ভিক্ষু সংঘের মধ্যে ইতিমধ্যে অনেক অনেক মতভেদ ও দ্বিধা-বিভক্তি পরিলক্ষিত হয়। বিশ্ব বিখ্যাত ধ্যানগুরু সত্যনারায়ন গোয়েঙ্কাজীর উদ্যোগে বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ভাবনাময়ী জ্ঞানান্বেষণের লক্ষে ১০(দশ) দিনের ধ্যানানুশীলন কোর্স চালু করা হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিক্ষু মন্ডলীর মধ্যে অনেক ধ্যানগুরু বা বিদর্শনাচার্য্যের আবির্ভাব ঘটেছে। পৃথিবীর সর্বত্র ধ্যানগুরু গোয়েঙ্কাজীর উদ্যোগে বুদ্ধের নির্দেশিত “সতিপট্ঠানসুত্তের” ধ্যান পদ্ধতিকে অকৃত্রিম পবিত্রতায় অক্ষুন্ন রেখে শমথ ও বিদর্শন ধ্যানানুশীলনের কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে জাতি-ধর্ম-বর্ণ সম্প্রদায় নির্বিশেষে তাবৎ মানব জাতির কল্যাণে আত্মশক্তি ও আত্মানুসন্ধানের প্রাণবন্যা বয়ে যাচ্ছে। তার আংশিক জোয়ার বাংলাদেশের সমতল ও আদিবাসী উভয় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যেও বর্তমানে পরিলক্ষিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে ইঁচড়েপাকা বা অকালপক্ষ ধ্যানগুরুর আবির্ভাব ঘটেছে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের আনাচে কানাচে। তাঁদের মধ্যে কেউ ৭ (সাত) দিনের কেউ ১০ (দশ) দিনের কোর্স চালু করে ধ্যানীদেরকে ধ্যানানুশীলন দিয়ে চলেছেন।। বস্তুতঃ শমথ ও বিদর্শন (ওহংরমযঃ গবফরঃধঃরড়হ) উভয় ভাবনায় নিরবে নিভৃতে চিত্তের গতিবিধি, গোটা শরীরের মধ্যে যখন যে অনুভূতি উৎপন্ন হবে তা গভীর সম্প্রজ্ঞান সহযোগে লক্ষ্য রেখে উৎপন্ন অনুভূতির সফল পরিসমাপ্তি ঘটানোর একটি প্রক্রিয়া বিশেষ। এসব চিত্তজয়ের মধ্য দিয়ে আত্মজয়ের কার্যাদি নিরবে নিভৃতে সাধন করতে হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ কোথাও কোথাও গভীর ধ্যানানুশীলনের এক পর্যায়ে চরম অনুভূতির মোক্ষম সময়ে ব্যথা,ব্যথা,ব্যথা শব্দে যোগীদের মধ্যে চিল চিৎকার করার নির্দেশনাও ধ্যানগুরুরা দিয়ে থাকেন বলে শোনা যায়। এসব নির্দেশনার ফলে কুশল করতে গিয়ে অকুশলের পাল্লা ভারী হচ্ছে কিনা একমাত্র বিচক্ষণ ধ্যান যোগীরাই বলতে পারবেন এবং ‘কুসলং উপনিস্সয অকুসলং পবড্ঢতি,’ কে স্বাগত জানানো হচ্ছে কিনা- জানি না। তাঁরা শ্রদ্ধাবান ও শ্রদ্ধাশীলা দায়ক-দায়িকাদের কাছে নিজেদেরকে অনন্য সাধারণ ধ্যানগুরু হিসেবে প্রতিপন্ন করতে, পরিচয় দিতে দ্বিধা করেন না। এর থেকেও এক ধাপ উপরে উঠে কেউ কেউ নিজেদেরকে শ্রাবকবুদ্ধ, অনুবুদ্ধ, ষড়াভিজ্ঞালাভী অর্হৎ, আর্যপুরুষ হিসেবে পরিচয় দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেন না। আমাদের ভদন্ত জ্ঞানধ্বজা মহাথেরো এরূপ হীন মানসিকতা সম্পন্ন ভিক্ষুদের প্রতি ছিলেন সমালোচনামুখর। তিনি মনে করতেন দুঃখ মুক্তির লক্ষে ধ্যানানুশীলনের কিছু বিধিবদ্ধ পদ্ধতি রয়েছে। এ পদ্ধতি চিরন্তন, চিরকালীন ও সর্বজনীন। এ পদ্ধতি মানবপুত্র বুদ্ধ কর্তৃক আবিষ্কৃত, নির্দেশিত ও বিধিবদ্ধ। ধ্যানানুশীলনের বিধিবদ্ধ পদ্ধতির বাইরে গিয়ে অনেক ভিক্ষু ইদানীং ধ্যান কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা পূর্বক পুণ্যবান ও পুণ্যবতী দায়ক-দায়িকাদের দৃষ্টি আকর্ষণের প্রয়াস চালাচ্ছেন। ভদন্ত জ্ঞানধ্বজা মহাথেরো এরূপ চালবাজ ভিক্ষুদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পিছপা হতেন না। এদের বিরুদ্ধে তাঁর কন্ঠ থাকতো সব সময় সোচ্চার।
তাঁর দৃষ্টিতে একজন বিদর্শন সাধক কখনো চালবাজী করতে পারেন না। নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করার লক্ষে সাধারণ দায়ক দায়িকাদের মাঝে নিজেকে আকারে ইঙ্গিতে হলেও মার্গলাভী, অনুবুদ্ধ প্রভৃতি অভিধায় অভিষিক্ত বা অধিষ্ঠিত করার অপপ্রয়াস চালাতে পারেন না। যদি কোন ভিক্ষু বা ধ্যানগুরু বা বিদর্শন সাধক মার্গলাভী হন তাও সাধারণ জন সমক্ষে তা প্রচার না করার জন্য বুদ্ধের কঠোর নির্দেশনা ছিল। কারণ, সাধারণ জনগণ তা বিশ্বাস করলে তো ভালো কথা কিন্তু বিশ্বাস না করলে তাদের পাপ হতে বাধ্য। তাই করুণাঘন বুদ্ধের এরূপ কঠোর নির্দেশনা। প্রাতিমোক্ষের চতুর্থ পারাজিকার মধ্যে রয়েছে- “যো পন ভিক্খু অনভিজানং উত্তরি মনুস্্স ধম্মং অত্তুপনাযিকং অসমরিয ঞানদস্্সনং সমুদাচরেয্য ইতি জানামি, ইতি পস্্সামী’তি, ততো অপরেন সমযেন সমনুগ্্গহিযমানো বা অসমনুগ্্গ হিযমানো বা আপন্নো বিসদ্ধাপেক্খো এবং বদেয্য অজানেব আবুসো অব্বং জানামি, অপস্্সং পস্্সামি তুচ্ছং মুসা বিলপিন্তি, অঞ্্ঞত্র অধিমানা, অযম্পি পারাজিকো হোতি অসংবাসোতি।” অনুবাদের নির্যাস হল এই- যদি কোন ভিক্ষু ধ্যান বিমোক্ষাদি লোকোত্তর জ্ঞান লাভ না করা সত্ত্বেও নিছক লাভ সৎকারের আশায় ধ্যান বিমোক্ষাদি লোকোত্তর জ্ঞান লাভ করেছি বলে মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করে তবে তার পারাজিকা হতে বাধ্য। ভদন্ত জ্ঞানধ্বজা মহাথেরো সংঘ সমাজের এসব চালবাজী বিষয়সমূহ মোটেই গ্রহণযোগ্য মনে করতেন না। চরমভাবে নিন্দনীয় মনে করতেন। তাঁর দৃষ্টিতে শ্রাবকবুদ্ধ, অনুবুদ্ধ ও মার্গলাভীদের পরচর্চা, পরনিন্দা, পরছিদ্রান্বেষণ বাদ দিয়ে আত্মচর্চা, আত্ম সমীক্ষা, আত্মশুদ্ধি, আত্মঅন্বেষণ, আত্ম উন্নয়নে সদা সর্বদা নিরত থাকা উচিত। তিনি মনে করতেন- স্বঘোষিত শ্রাবকবুদ্ধ, অনুবুদ্ধ ও মার্গলাভীদের বাক্য সংযমতা কঠোর ভাবে থাকা উচিত। তাঁর মতে যার বাক্য সংযমতা নেই সে কোন ধরনের মার্গলাভী? তাঁর মতে কায় সংযম সাধু, চক্ষু সংযম সাধু, ঘ্রাণ সংযম সাধু, কর্ণ সংযম সাধু, জিহ্বা সংযম সাধু এবং মনো সংযম সাধু। এ ষড় সংযম যে মার্গলাভী অনুপুঙ্খ সুসংরক্ষণ করতে পারে সেই না সত্যিকার সাধু!
ভদন্ত জ্ঞানধ্বজা মহাথেরো মাত্র ৫৫ (পঞ্চান্ন) বছর বয়সে আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিলেন। তাঁর মতো একজন উচ্চশিক্ষিত ইংরেজী জ্ঞানে দক্ষ ভিক্ষুকে হারিয়ে পার্বত্য ভিক্ষু সংঘের তাবৎ ভিক্ষু মন্ডলীসহ অবিভক্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের পুণ্যবান ও পুণ্যশীলা দায়ক দায়িকারা আজ দিশেহারা ও হতাশ। পার্বত্য ভিক্ষু সংঘের যে অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়েছে তা কত যুগ পরে পূরণ হবে তা ভবিতব্যই জানে।
আজ ২২/০২/২০১৩ তারিখ শুক্রবার আনুষ্ঠানিকভাবে এ প্রয়াত সংঘ মনীষার শবদাহক্রিয়া অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তাঁর শেষ বিদায়ের দিনে পার্বত্য ভিক্ষু সংঘের পরমারাধ্য সংঘরাজ ভদন্ত অভয়তিষ্য মহাস্থবির মহোদয়, পরমারাধ্য উপ-সংঘরাজ শ্রদ্ধেয় ভদন্ত তিলোকানন্দ মহাস্থবির মহোদয় সহ পার্বত্য ভিক্ষু সংঘের তাবৎ ভিক্ষু মন্ডলী সকৃতজ্ঞচিত্তে উপস্থিত হয়েছেন। আমরা সমন্বিতভাবে তাঁর পারলৌকিক সদ্্গতি কামনা করবো। প্রত্যাশা রাখবো দুঃখ মুক্তির দুর্লভ হেতু সম্পত্তি তাঁর উৎপন্ন হোক।
প্রয়াত ভদন্ত জ্ঞানধ্বজা মহাথেরো মহোদয়ের শবদাহক্রিয়া অনুষ্ঠানকে অতিশয় পুণ্যপুত, স্মরণযোগ্য, হৃদয়গ্রাহী ও পার্বত্য ভিক্ষুসংঘের সংঘ শক্তিকে অনুপ্রাণীত ও সম্মানীত করার জন্যে পার্বত্য ভিক্ষু সংঘের পরমারাধ্য সংঘ মণীষা ভারতের কলকাতা শিশু করুণাসংঘের প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট ভদন্ত বিমল তিষ্য মহাস্থবির মহোদয় পার্বত্য ভিক্ষু সংঘের তাবৎ ভিক্ষু সংঘকে দান করার লক্ষে ৫০০ (পাঁচশত) সেট রংবস্ত্র বা চীবর সংগ্রহ করে রাঙ্গামাটি আনন্দ বিহারে পাঠানোর বিরল নজির স্থাপন করার পরাকাষ্টা দেখিয়েছেন। এ অনন্য সাধারণ কর্মযজ্ঞে কুশীলব হিসেবে অন্তরঙ্গভাবে জড়িত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী কুলপুত্র ভিক্ষু কুল গৌরব ভদন্ত ড. গিরিমানন্দ মহাথেরো মহোদয়। তিনি এবং পরমারাধ্য ভদন্ত বিমল তিষ্য মহাস্থবির মহোদয় ভারতের বুদ্ধগয়ায় স্থায়ীভাবে বসবাসরত থাই, মায়ানমার ও শ্রীলংকার দায়ক-দায়িকা সমিতির কাছে আবেদন করে এ ৫০০ (পাঁচশত) সেট চীবর সংগ্রহ করেছেন। আমরা পার্বত্য ভিক্ষু সংঘের তাবৎ ভিক্ষু মন্ডলী, পার্বত্য চট্টগ্রামের পুণ্যবান পুণ্যাশীলা দায়ক-দায়িকাবৃন্দ সকৃতজ্ঞচিত্তে থাই মায়ানমার ও শ্রীলংকার দায়ক দায়িকা সমিতির পাঠানো ৫০০ (পাঁচশত) সেট চীবর পুণ্যানুমোদনের মধ্য দিয়ে গ্রহণ করছি। আমরা পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ তাঁদের এ মহাদান সশ্রদ্ধচিত্তে গ্রহণ করে তাঁদের ইহলৌকিক সার্বিক কল্যাণ, মঙ্গল কামনা করছি। তাঁদের এ অনন্য মহাদানের আনিসংস দুঃখ মুক্তির হেতু অর্জনের কারণ হোক।
প্রয়াত ভদন্ত জ্ঞানধ্বজার শেষ কর্মস্থল ছিল রাঙ্গামাটিস্থ ঘাগড়া কলেজ। এ কলেজের অধ্যক্ষ মি. শ্যামল মিত্র চাক্মা ও প্রভাষক মি. কর্মসেন চাক্মা এবং এ কলেজের জ্ঞানধ্বজার গুণমুগ্ধ ছাত্র/ছাত্রীবৃন্দ জ্ঞানধ্বজার শবদাহক্রিয়া অনুষ্ঠানের জন্য ১০,০০০ (দশ হাজার) টাকা অনুদান ও প্রয়াত ভদন্তের পারলৌকিক সদ্্গতি কামনায় অষ্টপরিষ্কার দান করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। আমি তাঁদের এ শুভ উদ্যোগকে শ্রদ্ধাভরে স্বাগত জানাই।
প্রয়াত ভদন্ত জ্ঞানধ্বজা মহাথেরো মহোদয়ের শবদাহক্রিয়া অনুষ্ঠান ত্রুটিহীনভাবে সুসম্পাদনার প্রতি সহৃদয় দৃষ্টি রেখে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী মিঃ দীপংকর তালুকদার এম.পি. মহোদয় ২,০০,০০০/-(দুই লক্ষ) টাকা, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জিলা পরিষদের মাননীয় চেয়ারম্যান মিঃ নিখিল কুমার চাক্্মা মহোদয় ৫০,০০০/-(পঞ্চাশ হাজার) টাকা, ঢাকা মিরপুরস্থ বনফুল আদিবাসী গ্রিনহার্ট কলেজ কর্তৃপক্ষ ৪২,০০০/- (বিয়াল্লিশ হাজার) টাকা, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, দিঘীনালা, বাঘাইছড়ি, নানিয়ারচর জেলা ও উপজেলার ভিক্ষু সংঘ সহ পুণ্যবান ও পুণ্যাশীলা দায়ক দায়িকারা যথাসাধ্য অর্থদানের মধ্য দিয়ে প্রয়াত জ্ঞানধ্বজা মহাথেরো মহোদয়ের প্রতি নিখাদ ভালবাসার ও শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত রাখার নজির স্থাপন করেছেন- আমি তাঁদেরএ মহতী পুণ্য সংস্কৃতি সহ কর্ম সংস্কৃতিকে স্বাগত জানাই। তাঁরা সদাসর্বদা মঙ্গল ও কল্যাণ দর্শন করুক। তাঁদের দুঃখান্তসাধনের হেতু উৎপন্ন হোক। রাঙ্গামাটি আনন্দ বিহারের ও মৈত্রী বিহারের পুণ্যবান ও পুণ্যশীলা দায়ক দায়িকারা এ শবদাহক্রিয়া অনুষ্ঠানে আগত তাবৎ ভিক্ষু সংঘকে প্রাতঃরাশ ও দ্বিপ্রাহরিক ভোজন মিলে ৪(চার) বেলা নানাবিধ খাদ্য ভোজ্য ও আহারাদির মাধ্যমে পূজা করার সদিচ্ছা পোষণ করায়- তাঁদের এ অনন্য মহদ্্গতচিত্ত ও প্রশংসাধন্য নজিরকেও আমি শ্রদ্ধাভরে স্বাগত জানাই। জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে তাঁরা সদা সর্বদা মঙ্গল ও কল্যাণ দর্শন করুক। দুঃখ মুক্তির হেতু তাঁদের উৎপন্ন হোক।
পরিশেষে পার্বত্য ভিক্ষু সংঘে অন্তর্ভুক্ত মহা ভিক্ষু সংঘের প্রতি রইল আমার অমলিন শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। প্রয়াত ভদন্ত জ্ঞানধ্বজা মহাথেরোর প্রতি তাবৎ ভিক্ষু সংঘ দায়বদ্ধ দায়িত্ব প্রতিপালনের অনুষঙ্গে যে অনন্য সাধারণ নজির স্থাপন করলেন তাতে আমি সমুত্তেজিত অনুপ্রাণীত, অভিভুত। মহাসংঘ সব সময় ঐক্যবদ্ধ থাকুক- এ পবিত্র আশাবাদ ব্যক্ত করি।
No comments
Post a Comment