বাংলাদেশে থেরবাদ বৌদ্ধধর্ম: উত্থান পতন পুনরুত্থান
প্রফেসর ড. দীপংকর শ্রীজ্ঞান বড়ুয়া
প্রাচ্যভাষা (পালি ও সংস্কৃত) বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।
ভূমিকা: বাংলাদেশে
বৌদ্ধধর্মের প্রচার, প্রসার, বিকাশ ও বিবর্তনের ধারাবাহিক ইতিহাস পাওয়া
যায় না। পরবর্তীকালে রচিত পিটক বহির্ভূত পালি সাহিত্য, বৌদ্ধ সংস্কৃত
সাহিত্য, চৈনিক পরিব্রাজকদের ভ্রমণ কাহিনী, বিভিন্ন প্রতত্বাত্ত্বিক
নিদর্শন এবং কিছু কিছু ইতিহাসাশ্রয়ী গ্রন্থ বা ঐতিহাসিক তথ্য থেকে
বাংলাদেশের বৌদ্ধধর্মের বিশেষ করে থেরবাদ বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে একটি
ধারাবাহিক বিবরণ অত্র নিবন্ধে উপস্থাপন করার প্রয়াস নেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য
যে, মহামতি গৌতমবুদ্ধের প্রাচীন ধর্মমত হচ্ছে থেরবাদ বা হীনযান এবং
পরবর্তীকালে মহাসাংঘিক মতবাদের উদ্ভব ঘটে। মৌর্য সম্রাট অশোকের (খ্রি: পূ:
২৭৩-২৩২) সময়ে থেরবাদ বারটি এবং মহাসাংঘিক ছ’টি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
অশোকের পৃষ্ঠপোষকতায় মোগ্গলিপুত্ত তিস্স থেরর নেতৃত্বে সংঘ বিশোধনের পর
গৌতমবুদ্ধের মূল থেরবাদ ধর্মমত প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তবে মহাসাংঘিক বৌদ্ধমত
যে সম্পূর্ণরূপে উচ্ছেদ হয়ে গিয়েছিল এ কথা বলা যায় না; কেননা পরবর্তীকালে
সম্রাট কনিষ্কের (খ্রিস্টীয় ১ম শতক) সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় এ ধর্মমত চরম
বিকাশের সুযোগ লাভ করেছিল। আচার্য নাগার্জুন, বসুবন্ধু, অশ্বঘোষ, অসঙ্গ,
ধর্মকীর্তি, শান্তিদেব, শীলভদ্র, অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান প্রমুখ পন্ডিতগণ এই
ধর্মমতের উপর প্রচুর গ্রন্থাদি রচনা করেন। এর উপর ভিত্তি করে বর্তমানে
বিশ্বব্যাপী প্রধানত থেরবাদ বা হীনযান এবং মহাসাংঘিক বা মহাযান- এই দুই
বৌদ্ধ ধর্মমত প্রচলিত রয়েছে।
বুদ্ধ ও অশোকযুগ ঃ পিটকগ্রন্থ সংযুক্ত নিকায়ে উল্লেখ আছে যে, বুদ্ধ
একবার সুম্ভভূমির (সুহ্মভূমি) অন্তর্গত সেতক নামক নগরে আগমন করে কিছুদিন
অবস্থান করে ধর্ম প্রচার করেছিলেন। তেলপত্ত জাতকেও (১ম খন্ড, জাতক নং ৯৬)
সুমভ্ বা সুহ্ম জনপদের নামোল্লেখ রয়েছে। এজনপদটি গঙ্গা-ভাগীরথীর পশ্চিম
তীরবর্তী দক্ষিণতম ভূখন্ড, অর্থাৎ বর্তমান বর্ধমানের দক্ষিণাংশ, হুগলীর
বহুলাংশ পশ্চিম এবং হাবড়া জেলা নিয়ে গঠিত ছিল বলে ঐতিহাসিকগণ মনে করেন।
(রায়, নীহার রঞ্জন; বাঙ্গালীর ইতিহাস, আদিপর্ব, কলিকাতা, ১৩৫৬, পৃঃ ১১৭)।
অঙ্গুত্তর নিকায়ের ‘কজঙ্গল’ নামে একটি সূত্র থেকে জানা যায়, বুদ্ধ একসময়
কজঙ্গলার সুবেসু বনে কিছুদিন অবস্থান করেছিলেন। হিউয়েন সাঙ চম্পা হতে
কজঙ্গল গিয়েছিলেন। বর্তমান এ জনপদের নাম কাঁকজোল। এটা প্রাচীন অঙ্গ, উত্তর
রাঢ় ও গৌড়ের মধ্যবর্তী রাজমহলের পার্শ্ববর্তীতে অবস্থিত ছিল। ঐতিহাসিকগণও
কজঙ্গলকে বঙ্গের অন্তর্গত বলে অভিহিত করেছেন। সংস্কৃত বিনয় গ্রন্থে এ সীমা
পুড্রবর্ধন পর্যন্ত বলে উল্লেখ আছে। (রায়, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১০০ ও ৪৯৪)।
সুত্তপিটকের অঙ্গুত্তর নিকায়ে বঙ্গান্তপুত্ত নামে এক খ্যাতনামা বৌদ্ধ
আচার্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। অপরদিকে পিটকগ্রন্থ থেরগাথা ও সংযুক্ত নিকায়ে
বঙ্গীশ নামে একজন প্রতিভাবান ভিক্ষুর উল্লেখ রয়েছে। তিনি ছিলেন স্বভাব কবি।
তাঁর কবিত্বের প্রতিভা ছিল অসাধারণ; তাৎক্ষণিক স্বরচিত কবিতাচ্ছন্দে তিনি
বুদ্ধ ও বুদ্ধ-শিষ্যদেরগুণগান রচনা করে সকলকে অভিভূত করে দিতেন। প-িতদের
ধারণা বঙ্গান্তপুত্ত ও বঙ্গীশ বঙ্গদেশের অধিবাসী ছিলেন বলেই এরূপ নামে
অভিহিত হয়েছিলেন। (Malalasekara, G.P; Dictionary of Pali Proper
Names,Vol. II, P. 803)| Ae`vb kZK (Mitra, R.L.; The Sanskrit Buddhist
Literature of Nepal; Royal Asiatice Society of India, Calcutta,1971, pp.
73, 237) এবং একাদশ শতকের কবি ক্ষেমেন্দ্র রচিত বোধিসত্ত্বাবদান কল্পলতা
(অনুবাদ-শরৎ চন্দ্র দাশ, কলিকাতা, ১৩৩৮, পৃ: ২৬৫-৭১) নামক গ্রন্থদ্বয় থেকে
জানা যায়, শ্রাবস্তী নিবাসী বুদ্ধের একনিষ্ঠ ভক্ত শ্রেষ্ঠী অনাথপিন্ডিকদের
কন্যা ‘সুমাগধা’কে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল পুড্র্রবর্ধন রাজ্যের বৃষভদত্ত নামক
জনৈক নিগণ্ঠনাথপুত্রের অনুসারীর সাথে। তাঁর শ্বশুর বাড়ির সকলেই ছিলেন
জৈনধর্মমতে বিশ্বাসী। কিন্তু সুমাগধা ছিলেন আজন্ম গৌতম বুদ্ধের ধর্মে
একান্তভাবে আস্থাশীল। এক সময় সুমাগধা ধ্যানযোগে বুদ্ধ প্রমুখ ভিক্ষু-সংঘকে
নিমন্ত্রণ করলে তিনি পাঁচশত ভিক্ষু-শিষ্যসহ আকাশমার্গে পুড্রবর্ধন নগরে
সুমাগধার শ্বশুর বাড়িতে উপনীত হন। বুদ্ধের উপদেশ শুনে সুমাগধার শ্বশুরবাড়ির
লোকজন বুদ্ধের নিকট দীক্ষা গ্রহণ করেন। হিউয়েন সাঙ বলেছেন যে, বুদ্ধ দীর্ঘ
ছয়মাস বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যথাক্রমে পুড্রবর্ধন (উত্তরবঙ্গ), সমতট
(পূর্ববঙ্গ), তাম্রলিপ্তি (দক্ষিণ বা দক্ষিণ পশ্চিম বঙ্গ) ও কর্ণসুবর্ণ
(পশ্চিমবঙ্গ) রাজ্যে ধর্মপ্রচার করেছিলেন। হিউয়েন সাঙ তাঁর ভ্রমণ-কাহিনীতে
আরো উল্লেখ করেছেন যে, তিনি উপরোক্ত জনপদ বা রাজ্যগুলো পরিদর্শনকালে অশোক
কর্তৃক নির্মিত বহু স্তূপ প্রত্যক্ষ করেছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম-দ্বিতীয়
শতকে রচিত দিব্যাবদান গ্রন্থে জানা যায় যে, মধ্যদেশের পূর্বসীমা পুড্রবর্ধন
নগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল (Law, B.C; Geography of Early Buddhism, Delhi
1973, pp.1-2)|
১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে মহাস্থানে প্রাপ্ত ব্রাহ্মী শিলালিপি থেকে জ্ঞাত হওয়া যায় যে, মৌর্য আমলে পুড্রবর্ধন বর্তমান মহাস্থান একটি প্রসিদ্ধ শাসনকেন্দ্র ছিল এবং এখানে একজন ‘মহামাত্র’ বা প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিযুক্ত ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক যুগের প্রথম সূচনা হয় চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের (খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতক) শাসনামল থেকে। তিনিই প্রথম তৎকালীন ভারতবর্ষের অধিকাংশ অঞ্চল জয় করে এক বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পন্ডিতদের ধারণা সমগ্র বাংলাদেশ তখন মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল (আহমেদ, নাজিমউদ্দিন; মহাস্থান, ময়নামতি ও পাহাড়পুর, ঢাকা, ১৯৯৭, পৃঃ ৬)। মহাস্থানে প্রাপ্ত ব্রাহ্মী-শিলালিপিখানি মৌর্যসম্রাট অশোক কর্তৃক প্রজ্ঞাপ্ত বলে স্থিরকৃত হয়েছে। এ লিপিতে ছবগ্গীয় বা ষড়বর্গীয় থেরবাদী ভিক্ষুদের উল্লেখ রয়েছে। এ শিলালিপির মাধ্যমে দুর্ভিক্ষ প্রপীড়িত জনসাধারণের প্রতি রাজকীয় কোষাগার এবং শষ্যভান্ডার থেকে তেল, ধান, গন্ডক ও মূদ্রা সাহায্যদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ নির্দেশনামা থেকে প্রমাণিত হয় যে, পুড্রবর্ধন রাজ্য মৌর্যসাম্রাজ্যভূক্ত ছিল কিংবা মৌর্যসম্রাটের আজ্ঞাবহ সামন্তরাজ্য ছিল।
খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় বা তৃতীয় শতকে পুড্রবর্ধনে বৌদ্ধধর্ম প্রসারের একটি পরোক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায় সাঁচী স্তূপের দুটি দানলিপি থেকে। এ লিপিদ্বয় থেকে জানা যায়, পুঞবঢন বা পুড্রবর্ধনবাসী ঋষিনন্দন নামে জনৈক পুরুষ এবং ধর্মদত্তা নাম্মী জনৈক মহিলা সাঁচী স্তূপের বেষ্টনী ও তোরণ নির্মাণে অর্থ দান করেছিলেন। তাঁরা বৌদ্ধ ধর্মানুরাগী বা বুদ্ধের অনুসারী ছিলেন বলেই এ মহৎ দানকার্যে অংশগ্রহণ করেছিলেন(Epigraphia of Indica, Vol. II, No. 102, p. 108; No. 217, P. 380)| বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের আরো ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায়, খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকে উৎকীর্ণ নাগার্জুনকোণ্ডায় একটি শিলালিপি থেকে। এ শিলালিপিতে অন্যান্য দেশের নামের তালিকার সাথে থেরবাদী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের অন্যতম আবাস হিসেবে বঙ্গের নামোল্লেখ রয়েছে ((Epigraphia of Indica, Vol.I, XX, p. 22)
অপরদিকে মহাযান সাহিত্যে ষোড়শজন মহাস্থবিরের নাম রয়েছে, এঁদের মধ্যে কালিক থের ছিলেন তাম্রলিপ্তিবাসী বাঙালি ভিক্ষু। সম্ভবত তিনি প্রাক গুপ্তযুগের ব্যক্তি ছিলেন (রায়, প্রাগুক্ত, পৃ: ৪৯৫)।
প্রাক্-গুপ্তযুগের মেদিনীপুর জেলার তমলুক থেকে আবিস্কৃত হয়েছে খরোষ্ঠী-ব্রাহ্মী অক্ষরে উৎকীর্ণ একটি অস্থিখন্ড। এ লেখটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এটা সম্ভবত ‘ধর্মীয় দান’ রূপে প্রদত্ত হয়েছিল। লেখটির সম্পাদক অধ্যাপক ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনা অনুযায়ী লেখপাঠ হল ‘চেতগোঠ’। অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় এ শব্দটির অর্থ করেছেন ‘চেত’ (চৈত্ত>চেত্ত>চেত) এবং ‘গোঠ’ (গোঠ>গোষ্ঠী) অর্থাৎ মিলনস্থল; অর্থাৎ চৈত্য নামক একটি বৌদ্ধধর্ম সম্প্রদায়ের উপাসকদের মিলনস্থল। এই চৈত্যক বা চেতীয় গোষ্ঠী ছিল মহাসাংঘিক সম্প্রদায়ের অন্যতম শাখা। মহাবস্তু অবদানে এই শাখার কার্যাবলী সম্পর্কে উল্লেখিত হয়েছে যে, স্তুপ প্রদক্ষিণ বা চৈত্য উপাসনার ধর্মীয় বিধিই এই বৌদ্ধ সম্প্রদায় বিশেষের ধর্মাচরণের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। এজন্য এগোষ্ঠীকে ‘চৈত্যক’ বলা হত। খ্রিস্টীয় প্রথম কয়েক শতকে এ চৈত্যক গোষ্ঠী বৌদ্ধধর্মের বিবর্তনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। উল্লেখিত খরোষ্ঠী-ব্রাহ্মী লেখটির সময়কাল নাগার্জুনকোণ্ডা ও অমরাবতীর লেখগুলোর সাথে সামঞ্জস্য ও সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়ায় সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় যে, খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতক নাগাদ অন্ধ্র প্রদেশের মৌলকেন্দ্র থেকে এই ‘চৈত্যক’ গোষ্ঠীর কিছু উপাসক বঙ্গ অঞ্চলে অভিবাসিত হয়ে প্রাক-গুপ্ত বঙ্গে তাঁদের দ্বিতীয় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে চন্দ্রকেতুগড়ে আবিস্কৃত ভগ্নবুদ্ধের বা বোধিসত্ত্বের মূর্তিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মূর্তিতত্ত্বের শৈলীগত বৈশিষ্ট্য বিল্লেষণ করে অধ্যাপক সরস্বতী এটাকে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকের বলে সনাক্ত করেছেন (ইতিহাস অনুসন্ধান : প্রবন্ধ-প্রাক-গুপ্তবঙ্গে বৌদ্ধধর্মের আবির্ভাব, সরিতা ক্ষেত্রী, ২০০০, পৃ: ৮৭-৮৮)। এ ঐতিহাসিক বিষয়টি প্রমাণ করে যে, প্রাক গুপ্তযুগে বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্ম প্রতিষ্ঠাপিত হয়েছিল।
অপরদিকে পিটক বহির্ভূত পালি সাহিত্য বিশেষ করে বংশ সাহিত্য পাঠে জানা যায়, বুদ্ধ বোধিজ্ঞান লাভের আট বছর পর গবম্পতি থেরর প্রার্থনায় মিয়ানমারের (বার্মা) প্রাচীন রামঞ্ঞ রাষ্ট্রের সুধর্মপুরে উপনীত হয়েছিলেন। (মহাস্থবির, ধর্মাধার; অনুঃ শাসনবংস পৃঃ ৫৫) এবং সেখানে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেছিলেন। মিয়ানমারে প্রাপ্ত এক শিলালিপিতে উল্লেখ আছে যে, বুদ্ধ সেদেশে গমন কালে তাঁর সাথে বিশ হাজার অর্হৎ ভিক্ষু সঙ্গী ছিলেন (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫৫)। পালি মহাবগ্গ মতে (অনুঃ পৃঃ ৪-৫) গৌতম বুদ্ধের বুদ্ধত্ব লাভের সপ্তম সপ্তাহের শেষ দিন তপস্সু ও ভল্লিক নামে দুজন মধুবণিক মধু ও মধুপিষ্ঠক দিয়ে বুদ্ধকে পূজা করেছিলেন। এ দু’জন ছিলেন বুদ্ধের প্রথম গৃহী উপাসক। পন্ডিতেরা অনেকে মনে করেন তাঁরা ছিলেন উরিষ্যার অধিবাসী। অপরপক্ষে Dr. Earrnest Halenyi এবং U Thein Haing দাবী করেছেন যে, তপস্সু ও ভল্লিক বণিকদ্বয় মিয়ানমারের অধিবাসী ছিলেন। তাঁরা বাণিজ্যার্থে ভারতে গমন করেছিলেন এবং বুদ্ধের বোধিজ্ঞান লাভের পর তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটেছিল। তাঁরা বুদ্ধকে মধু ও মধু পিষ্ঠক দান করেছিলেন; বুদ্ধ তাঁদেরকে আটটি কেশধাতু প্রদান করলে তাঁরা ইয়াঙ্গুন শহরের সোয়েডাগন প্যাগোডায় উক্ত কেশধাতু প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বুদ্ধ যদি স্বয়ং মিয়ানমারে গমন করে থাকেন তাহলে তাঁকে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম হয়েই যেতে হয়েছিল, কারণ তখন এটাই ছিল মিয়ানমারে যাবার প্রশস্ত ও সহজ পথ। কাজেই তখন চট্টগ্রামে বৌদ্ধধর্ম প্রচারিত হওয়া স্বাভাবিক। এছাড়া, কিংবদন্তী আছে যে, বুদ্ধ স্বয়ং একবার চট্টগ্রামের হস্তীগ্রামে এসে পক্ষকাল অবস্থান করে ধর্ম প্রচার করেছিলেন। সেই হস্তীগ্রাম পটিয়ার হাইদগাঁও বলে মনে করা হয়। এখানে একটি বুদ্ধমন্দির বা কেয়্যাংও ছিল (আলম, ওহিদুল; চট্টগ্রামের ইতিহাস (প্রাচীনকাল থেকে আধুনিককাল), চট্টগ্রাম, ১৯৮২, পৃঃ ৮)। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদও উল্লেখ করেছেন যে, বৌদ্ধরা এদেশের আদি অধিবাসী (ইসলামাবাদ, পৃঃ ১২)। পূর্ণ চন্দ্র চৌধুরীও একই মতে বিশ্বাসী। তাঁর মতে, মগধদেশ হতে বৌদ্ধধর্মের প্রচারকগণ পূর্ব দেশে এসে ধর্ম প্রচার করেন এবং চট্টগ্রামে বৌদ্ধধর্ম প্রাচীনতম ধর্ম। (চট্টগ্রামের ইতিহাস, চট্টগ্রাম, ১৯২০, পৃঃ ২)।
বৌদ্ধসাহিত্য মহাবংস মতে (W. Geiger, ed.; Mahavamsa. PTS. London, 1958, ch. XII)তৃতীয় সঙ্গীতি সমাপ্তির পর সম্রাট অশোক বিভিন্নœদেশে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য প্রচারক (ধর্মদূত) প্রেরণ করেছিলেন। তখন সোন ও উত্তর ভিক্ষুর নেতৃত্বে একটি প্রচারকদল প্রেরিত হয়েছিল সুবর্ণভূমি বা বর্তমান মিয়ানমারে। কিংবদন্তী অনুযায়ী ধারণা করা হয়, তাঁরা চট্টগ্রাম হয়ে আরাকান ও মিয়ানমার গিয়েছিলেন। পথিমধ্যে তাঁরা চট্টগ্রামে কিছুকাল অবস্থান করে ধর্ম প্রচার করেছিলেন। বিষয়টি প্রচলিত ধারণা বা কিংবদšতী হলেও যুক্তিপূর্ণ।
অশোক কর্তৃক ধর্মদূত প্রেরিত দেশসমূহের তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই। এছাড়া অশোকের কোনো শিলালিপিতেও (ধর্মলিপি) বাংলাদেশের নাম পাওয়া যায় নি। একারণে কোনো কোনো গবেষক মনে করেন যে, অশোকোত্তর যুগে বৌদ্ধধর্ম বাংলাদেশে প্রচারিত হয়েছিল। অপরপক্ষে ঐতিহাসিক ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার, ড. নীহার রঞ্জর রায় প্রমুখ মনে করেন যে, অশোকের আগেই বৌদ্ধধর্ম প্রাচীন বাংলায় কোনো কোনো স্থানে বিস্তার লাভ করেছিল (মজুমদার, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২০৯ ; রায়, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪৯৪-৯৬)। নলিনীনাথ দাশগুপ্ত মনে করেন যে, মগধ ও বাংলার ভৌগোলিক অবস্থান এত কাছাকাছি মে, বুদ্ধের জীবিতকালেই মগধ হতে বৌদ্ধধর্মের ঢেউ এসে বাংলাকে পাবিত করা মোটেই অসম্ভব নয়, যদিও তার বিজ্ঞান সম্মত প্রমাণ নেই। (বাংলায় বৌদ্ধধর্ম, এ, মুখার্জী এন্ড কোং; কলিকাতা, ১৩৫৫ বঙ্গাব্দ, পৃ: ৩৫) পূর্বোক্ত মহাস্থানগড়ে প্রাপ্ত শিলালিপিখানি মৌর্য সম্রাট অশোক কর্তৃক বিজ্ঞাপিত বলে ক্যানিংহাম মনে করেন। যদিও এটাতে মূলত আপদকালীন সময়ে রাজ্যবাসীকে সাহায্য প্রদানের নির্দেশ রয়েছে। এছাড়া অশোক-পরবর্তী যুগে হিউয়েন সাঙ, ইৎ সিঙ প্রমুখ চৈনিক পরিব্রাজকগণ বাংলাদেশের সর্বত্র যে যে স্থানে গৌতম বুদ্ধ ধর্মোপদেশ দান করেছিলেন সেই সেই স্থানে মৌর্য সম্রাট আশোক কর্তৃক নির্মিত ¯ূÍপগুলো প্রত্যক্ষ করেছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন। এছাড়া বাংলাদেশ মগধের অতি নিকটতর একটি রাজ্য। তখন এটা মগধ সাম্রাজ্যের অধীনে থাকাও বিচিত্র নয়; বিশেষ করে মৌর্য সম্রাট অশোকের সময়ে তো বটেই। অপরদিকে বুদ্ধ মহাবোধি প্রাপ্তির পর আদি-মধ্য-অন্তকল্যাণকর নৈবার্ণিক ধর্ম দিকে দিকে প্রচার করার জন্য নবদীক্ষিত ষাটজন ভিক্ষুকে নির্দেশ দিয়ে নিজেও বিভিন্ন এলাকায় ধর্ম প্রচারে বের হয়েছিলেন; দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছর ধর্ম প্রচারের সময় তিনি এবং তাঁর শিষ্যগণ বাংলাদেশে আগমন করা অত্যন্ত যুক্তি সঙ্গত বলেই মনে হয়। নিরেট ঐতিহাসিক দলিল না থাকলেও উপরোক্ত যুক্তিগুলো উপেক্ষা করার নয়। বাংলার যুবরাজ বিজয় সিংহ সেই বুদ্ধের সময় কালেই শ্রীলংকায় রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে বৌদ্ধধর্ম প্রচারে সহায়তা করেছিলেন, সিংহলী কিংবদন্তী এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়।
উপর্যুক্ত আলোচিত বৌদ্ধ ঐতিহ্য, পালি ও বৌদ্ধ সংস্কৃত সাহিত্য, প্রচলিত কিংবদন্তী, চৈনিক পর্যটকদের বিবরণ, ঐতিহাসিক ও গবেষকদের অভিমতের পরিপ্রেক্ষিতে এটা বলা যায় যে, বুদ্ধের সময়কাল খ্রিঃ পূঃ ৬ষ্ঠ শতক থেকে খ্রিঃ পূঃ ৩য় শতকের মধ্যে বৌদ্ধধর্ম বাংলাদেশে প্রচারলাভ করেছিল এবং মৌর্য সম্রাট অশোকের সময়ে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। পরবর্তীতে স্থানীয় রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এটি সমগ্র বাংলাদেশে একটি প্রধান ধর্ম হিসেবে দীর্ঘকাল বেঁচেছিল এবং এদেশের সমাজ, ধর্ম, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, সভ্যতা প্রভৃতির সামগ্রিক বিকাশে অসীম অবদান রেখেছিল। উল্লেখ্য যে, এ সময়ে প্রচারিত ধর্মমত ছিল মূল থেরবাদ ।
১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে মহাস্থানে প্রাপ্ত ব্রাহ্মী শিলালিপি থেকে জ্ঞাত হওয়া যায় যে, মৌর্য আমলে পুড্রবর্ধন বর্তমান মহাস্থান একটি প্রসিদ্ধ শাসনকেন্দ্র ছিল এবং এখানে একজন ‘মহামাত্র’ বা প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিযুক্ত ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক যুগের প্রথম সূচনা হয় চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের (খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতক) শাসনামল থেকে। তিনিই প্রথম তৎকালীন ভারতবর্ষের অধিকাংশ অঞ্চল জয় করে এক বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পন্ডিতদের ধারণা সমগ্র বাংলাদেশ তখন মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল (আহমেদ, নাজিমউদ্দিন; মহাস্থান, ময়নামতি ও পাহাড়পুর, ঢাকা, ১৯৯৭, পৃঃ ৬)। মহাস্থানে প্রাপ্ত ব্রাহ্মী-শিলালিপিখানি মৌর্যসম্রাট অশোক কর্তৃক প্রজ্ঞাপ্ত বলে স্থিরকৃত হয়েছে। এ লিপিতে ছবগ্গীয় বা ষড়বর্গীয় থেরবাদী ভিক্ষুদের উল্লেখ রয়েছে। এ শিলালিপির মাধ্যমে দুর্ভিক্ষ প্রপীড়িত জনসাধারণের প্রতি রাজকীয় কোষাগার এবং শষ্যভান্ডার থেকে তেল, ধান, গন্ডক ও মূদ্রা সাহায্যদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ নির্দেশনামা থেকে প্রমাণিত হয় যে, পুড্রবর্ধন রাজ্য মৌর্যসাম্রাজ্যভূক্ত ছিল কিংবা মৌর্যসম্রাটের আজ্ঞাবহ সামন্তরাজ্য ছিল।
খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় বা তৃতীয় শতকে পুড্রবর্ধনে বৌদ্ধধর্ম প্রসারের একটি পরোক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায় সাঁচী স্তূপের দুটি দানলিপি থেকে। এ লিপিদ্বয় থেকে জানা যায়, পুঞবঢন বা পুড্রবর্ধনবাসী ঋষিনন্দন নামে জনৈক পুরুষ এবং ধর্মদত্তা নাম্মী জনৈক মহিলা সাঁচী স্তূপের বেষ্টনী ও তোরণ নির্মাণে অর্থ দান করেছিলেন। তাঁরা বৌদ্ধ ধর্মানুরাগী বা বুদ্ধের অনুসারী ছিলেন বলেই এ মহৎ দানকার্যে অংশগ্রহণ করেছিলেন(Epigraphia of Indica, Vol. II, No. 102, p. 108; No. 217, P. 380)| বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের আরো ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায়, খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকে উৎকীর্ণ নাগার্জুনকোণ্ডায় একটি শিলালিপি থেকে। এ শিলালিপিতে অন্যান্য দেশের নামের তালিকার সাথে থেরবাদী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের অন্যতম আবাস হিসেবে বঙ্গের নামোল্লেখ রয়েছে ((Epigraphia of Indica, Vol.I, XX, p. 22)
অপরদিকে মহাযান সাহিত্যে ষোড়শজন মহাস্থবিরের নাম রয়েছে, এঁদের মধ্যে কালিক থের ছিলেন তাম্রলিপ্তিবাসী বাঙালি ভিক্ষু। সম্ভবত তিনি প্রাক গুপ্তযুগের ব্যক্তি ছিলেন (রায়, প্রাগুক্ত, পৃ: ৪৯৫)।
প্রাক্-গুপ্তযুগের মেদিনীপুর জেলার তমলুক থেকে আবিস্কৃত হয়েছে খরোষ্ঠী-ব্রাহ্মী অক্ষরে উৎকীর্ণ একটি অস্থিখন্ড। এ লেখটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এটা সম্ভবত ‘ধর্মীয় দান’ রূপে প্রদত্ত হয়েছিল। লেখটির সম্পাদক অধ্যাপক ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনা অনুযায়ী লেখপাঠ হল ‘চেতগোঠ’। অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় এ শব্দটির অর্থ করেছেন ‘চেত’ (চৈত্ত>চেত্ত>চেত) এবং ‘গোঠ’ (গোঠ>গোষ্ঠী) অর্থাৎ মিলনস্থল; অর্থাৎ চৈত্য নামক একটি বৌদ্ধধর্ম সম্প্রদায়ের উপাসকদের মিলনস্থল। এই চৈত্যক বা চেতীয় গোষ্ঠী ছিল মহাসাংঘিক সম্প্রদায়ের অন্যতম শাখা। মহাবস্তু অবদানে এই শাখার কার্যাবলী সম্পর্কে উল্লেখিত হয়েছে যে, স্তুপ প্রদক্ষিণ বা চৈত্য উপাসনার ধর্মীয় বিধিই এই বৌদ্ধ সম্প্রদায় বিশেষের ধর্মাচরণের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। এজন্য এগোষ্ঠীকে ‘চৈত্যক’ বলা হত। খ্রিস্টীয় প্রথম কয়েক শতকে এ চৈত্যক গোষ্ঠী বৌদ্ধধর্মের বিবর্তনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। উল্লেখিত খরোষ্ঠী-ব্রাহ্মী লেখটির সময়কাল নাগার্জুনকোণ্ডা ও অমরাবতীর লেখগুলোর সাথে সামঞ্জস্য ও সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়ায় সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় যে, খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতক নাগাদ অন্ধ্র প্রদেশের মৌলকেন্দ্র থেকে এই ‘চৈত্যক’ গোষ্ঠীর কিছু উপাসক বঙ্গ অঞ্চলে অভিবাসিত হয়ে প্রাক-গুপ্ত বঙ্গে তাঁদের দ্বিতীয় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে চন্দ্রকেতুগড়ে আবিস্কৃত ভগ্নবুদ্ধের বা বোধিসত্ত্বের মূর্তিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মূর্তিতত্ত্বের শৈলীগত বৈশিষ্ট্য বিল্লেষণ করে অধ্যাপক সরস্বতী এটাকে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকের বলে সনাক্ত করেছেন (ইতিহাস অনুসন্ধান : প্রবন্ধ-প্রাক-গুপ্তবঙ্গে বৌদ্ধধর্মের আবির্ভাব, সরিতা ক্ষেত্রী, ২০০০, পৃ: ৮৭-৮৮)। এ ঐতিহাসিক বিষয়টি প্রমাণ করে যে, প্রাক গুপ্তযুগে বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্ম প্রতিষ্ঠাপিত হয়েছিল।
অপরদিকে পিটক বহির্ভূত পালি সাহিত্য বিশেষ করে বংশ সাহিত্য পাঠে জানা যায়, বুদ্ধ বোধিজ্ঞান লাভের আট বছর পর গবম্পতি থেরর প্রার্থনায় মিয়ানমারের (বার্মা) প্রাচীন রামঞ্ঞ রাষ্ট্রের সুধর্মপুরে উপনীত হয়েছিলেন। (মহাস্থবির, ধর্মাধার; অনুঃ শাসনবংস পৃঃ ৫৫) এবং সেখানে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেছিলেন। মিয়ানমারে প্রাপ্ত এক শিলালিপিতে উল্লেখ আছে যে, বুদ্ধ সেদেশে গমন কালে তাঁর সাথে বিশ হাজার অর্হৎ ভিক্ষু সঙ্গী ছিলেন (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫৫)। পালি মহাবগ্গ মতে (অনুঃ পৃঃ ৪-৫) গৌতম বুদ্ধের বুদ্ধত্ব লাভের সপ্তম সপ্তাহের শেষ দিন তপস্সু ও ভল্লিক নামে দুজন মধুবণিক মধু ও মধুপিষ্ঠক দিয়ে বুদ্ধকে পূজা করেছিলেন। এ দু’জন ছিলেন বুদ্ধের প্রথম গৃহী উপাসক। পন্ডিতেরা অনেকে মনে করেন তাঁরা ছিলেন উরিষ্যার অধিবাসী। অপরপক্ষে Dr. Earrnest Halenyi এবং U Thein Haing দাবী করেছেন যে, তপস্সু ও ভল্লিক বণিকদ্বয় মিয়ানমারের অধিবাসী ছিলেন। তাঁরা বাণিজ্যার্থে ভারতে গমন করেছিলেন এবং বুদ্ধের বোধিজ্ঞান লাভের পর তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটেছিল। তাঁরা বুদ্ধকে মধু ও মধু পিষ্ঠক দান করেছিলেন; বুদ্ধ তাঁদেরকে আটটি কেশধাতু প্রদান করলে তাঁরা ইয়াঙ্গুন শহরের সোয়েডাগন প্যাগোডায় উক্ত কেশধাতু প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বুদ্ধ যদি স্বয়ং মিয়ানমারে গমন করে থাকেন তাহলে তাঁকে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম হয়েই যেতে হয়েছিল, কারণ তখন এটাই ছিল মিয়ানমারে যাবার প্রশস্ত ও সহজ পথ। কাজেই তখন চট্টগ্রামে বৌদ্ধধর্ম প্রচারিত হওয়া স্বাভাবিক। এছাড়া, কিংবদন্তী আছে যে, বুদ্ধ স্বয়ং একবার চট্টগ্রামের হস্তীগ্রামে এসে পক্ষকাল অবস্থান করে ধর্ম প্রচার করেছিলেন। সেই হস্তীগ্রাম পটিয়ার হাইদগাঁও বলে মনে করা হয়। এখানে একটি বুদ্ধমন্দির বা কেয়্যাংও ছিল (আলম, ওহিদুল; চট্টগ্রামের ইতিহাস (প্রাচীনকাল থেকে আধুনিককাল), চট্টগ্রাম, ১৯৮২, পৃঃ ৮)। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদও উল্লেখ করেছেন যে, বৌদ্ধরা এদেশের আদি অধিবাসী (ইসলামাবাদ, পৃঃ ১২)। পূর্ণ চন্দ্র চৌধুরীও একই মতে বিশ্বাসী। তাঁর মতে, মগধদেশ হতে বৌদ্ধধর্মের প্রচারকগণ পূর্ব দেশে এসে ধর্ম প্রচার করেন এবং চট্টগ্রামে বৌদ্ধধর্ম প্রাচীনতম ধর্ম। (চট্টগ্রামের ইতিহাস, চট্টগ্রাম, ১৯২০, পৃঃ ২)।
বৌদ্ধসাহিত্য মহাবংস মতে (W. Geiger, ed.; Mahavamsa. PTS. London, 1958, ch. XII)তৃতীয় সঙ্গীতি সমাপ্তির পর সম্রাট অশোক বিভিন্নœদেশে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য প্রচারক (ধর্মদূত) প্রেরণ করেছিলেন। তখন সোন ও উত্তর ভিক্ষুর নেতৃত্বে একটি প্রচারকদল প্রেরিত হয়েছিল সুবর্ণভূমি বা বর্তমান মিয়ানমারে। কিংবদন্তী অনুযায়ী ধারণা করা হয়, তাঁরা চট্টগ্রাম হয়ে আরাকান ও মিয়ানমার গিয়েছিলেন। পথিমধ্যে তাঁরা চট্টগ্রামে কিছুকাল অবস্থান করে ধর্ম প্রচার করেছিলেন। বিষয়টি প্রচলিত ধারণা বা কিংবদšতী হলেও যুক্তিপূর্ণ।
অশোক কর্তৃক ধর্মদূত প্রেরিত দেশসমূহের তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই। এছাড়া অশোকের কোনো শিলালিপিতেও (ধর্মলিপি) বাংলাদেশের নাম পাওয়া যায় নি। একারণে কোনো কোনো গবেষক মনে করেন যে, অশোকোত্তর যুগে বৌদ্ধধর্ম বাংলাদেশে প্রচারিত হয়েছিল। অপরপক্ষে ঐতিহাসিক ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার, ড. নীহার রঞ্জর রায় প্রমুখ মনে করেন যে, অশোকের আগেই বৌদ্ধধর্ম প্রাচীন বাংলায় কোনো কোনো স্থানে বিস্তার লাভ করেছিল (মজুমদার, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২০৯ ; রায়, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪৯৪-৯৬)। নলিনীনাথ দাশগুপ্ত মনে করেন যে, মগধ ও বাংলার ভৌগোলিক অবস্থান এত কাছাকাছি মে, বুদ্ধের জীবিতকালেই মগধ হতে বৌদ্ধধর্মের ঢেউ এসে বাংলাকে পাবিত করা মোটেই অসম্ভব নয়, যদিও তার বিজ্ঞান সম্মত প্রমাণ নেই। (বাংলায় বৌদ্ধধর্ম, এ, মুখার্জী এন্ড কোং; কলিকাতা, ১৩৫৫ বঙ্গাব্দ, পৃ: ৩৫) পূর্বোক্ত মহাস্থানগড়ে প্রাপ্ত শিলালিপিখানি মৌর্য সম্রাট অশোক কর্তৃক বিজ্ঞাপিত বলে ক্যানিংহাম মনে করেন। যদিও এটাতে মূলত আপদকালীন সময়ে রাজ্যবাসীকে সাহায্য প্রদানের নির্দেশ রয়েছে। এছাড়া অশোক-পরবর্তী যুগে হিউয়েন সাঙ, ইৎ সিঙ প্রমুখ চৈনিক পরিব্রাজকগণ বাংলাদেশের সর্বত্র যে যে স্থানে গৌতম বুদ্ধ ধর্মোপদেশ দান করেছিলেন সেই সেই স্থানে মৌর্য সম্রাট আশোক কর্তৃক নির্মিত ¯ূÍপগুলো প্রত্যক্ষ করেছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন। এছাড়া বাংলাদেশ মগধের অতি নিকটতর একটি রাজ্য। তখন এটা মগধ সাম্রাজ্যের অধীনে থাকাও বিচিত্র নয়; বিশেষ করে মৌর্য সম্রাট অশোকের সময়ে তো বটেই। অপরদিকে বুদ্ধ মহাবোধি প্রাপ্তির পর আদি-মধ্য-অন্তকল্যাণকর নৈবার্ণিক ধর্ম দিকে দিকে প্রচার করার জন্য নবদীক্ষিত ষাটজন ভিক্ষুকে নির্দেশ দিয়ে নিজেও বিভিন্ন এলাকায় ধর্ম প্রচারে বের হয়েছিলেন; দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছর ধর্ম প্রচারের সময় তিনি এবং তাঁর শিষ্যগণ বাংলাদেশে আগমন করা অত্যন্ত যুক্তি সঙ্গত বলেই মনে হয়। নিরেট ঐতিহাসিক দলিল না থাকলেও উপরোক্ত যুক্তিগুলো উপেক্ষা করার নয়। বাংলার যুবরাজ বিজয় সিংহ সেই বুদ্ধের সময় কালেই শ্রীলংকায় রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে বৌদ্ধধর্ম প্রচারে সহায়তা করেছিলেন, সিংহলী কিংবদন্তী এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়।
উপর্যুক্ত আলোচিত বৌদ্ধ ঐতিহ্য, পালি ও বৌদ্ধ সংস্কৃত সাহিত্য, প্রচলিত কিংবদন্তী, চৈনিক পর্যটকদের বিবরণ, ঐতিহাসিক ও গবেষকদের অভিমতের পরিপ্রেক্ষিতে এটা বলা যায় যে, বুদ্ধের সময়কাল খ্রিঃ পূঃ ৬ষ্ঠ শতক থেকে খ্রিঃ পূঃ ৩য় শতকের মধ্যে বৌদ্ধধর্ম বাংলাদেশে প্রচারলাভ করেছিল এবং মৌর্য সম্রাট অশোকের সময়ে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। পরবর্তীতে স্থানীয় রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এটি সমগ্র বাংলাদেশে একটি প্রধান ধর্ম হিসেবে দীর্ঘকাল বেঁচেছিল এবং এদেশের সমাজ, ধর্ম, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, সভ্যতা প্রভৃতির সামগ্রিক বিকাশে অসীম অবদান রেখেছিল। উল্লেখ্য যে, এ সময়ে প্রচারিত ধর্মমত ছিল মূল থেরবাদ ।
গুপ্তযুগ
মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার পূর্ব অর্থাৎ আনুমানিক খ্রিস্টীয় ৩য় শতক পর্যন্ত দীর্ঘ পাঁচশ বছরের মধ্যে পূর্ব ভারতের (বাংলাদেশ) ইতিহাস সম্পর্কে বিশেষ কোনো ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায় না। বঙ্গদেশে ও উড়িষ্যায় কুষাণ যুগের কিছু মুদ্রা আবিষ্কৃত হওয়ায় কেউ কেউ মনে করেন যে বঙ্গদেশ কুষাণ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। একথা অনস্বীকার্য যে, কুষাণ সম্রাট কণিষ্ক একজন শক্তিশালী শাসক ছিলেন এবং তিনি একটি বিরাট সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়েছিলেন। অনেকের ধারণা বাংলাদেশও সম্রাট কণিষ্কের সাম্রাজ্যভূক্ত ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে, কণিষ্কের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় জলান্ধরে যে চতুর্থ বৌদ্ধ মহাসঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়েছিল এতে মহাযান বা মহাসাংঘিক সম্প্রদায় পোষকতা লাভ করেছিল এবং সঙ্গীতি শেষে কণিষ্কের পৃষ্ঠপোষকতায় মহাযান ধর্মমত মধ্য এশিয়াসহ চীন, কোরিয়া, জাপান প্রভৃতি দেশে প্রসার লাভ করেছিল। সম্ভবত এসময়েই বাংলাদেশে মহাযান ধর্মমতের প্রচার ঘটে থাকবে। তবে ইতিপূর্বে প্রচারিত থেরবাদ বৌদ্ধমতও পাশাপাশি প্রচলিত ছিল। ফা-হিয়েন, হিউয়েন সাঙ প্রমুখ চীনা পরিব্রাজকদের ভ্রমণ বৃত্তান্তে এর সমর্থন মিলে। কণিষ্কের সময়ে বাংলাদেশ সম্পূর্ণ কিংবা আংশিক এলাকাও যদি কণিষ্ক-সাম্রাজ্যভূক্ত হয়ে থাকে তা হলে নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, তাঁর সময়ে বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্মের প্রসার ঘটেছিল। ঐতিহাসিকগণ মনে করেন যে, রাজ্যজয় ও সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য কণিষ্কের যে খ্যাতি প্রচলিত আছে, তার তুলনায় অনেক বেশি তিনি খ্যাত হয়ে আছেন ‘শাক্যমুনি’র ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতার জন্য। এজন্যে কণিষ্কের রাজত্বকালে বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে এক যুগাšতকারী পরিবর্তন সাধিত হয়েছে বলে গবেষকগণ মনে করেন (সিন্হা, প্রাগুক্ত, ৩৫৮-৫৯)।
খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকের শেষান্তে অথবা চতুর্থ শতকের গোড়ার দিকে গুপ্ত সাম্রাজ্যের পত্তন হয়। ধারণা করা হয় যে, খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকের অব্দে অথবা চতুর্থ শতকের প্রারম্ভে গুপ্ত বংশীয় আদিপুরুষ শ্রীগুপ্ত মগধে রাজত্ব করতেন। আবার কারো কারো মতে গুপ্তগণ বাঙালি ছিলেন এবং প্রথমে বাংলাদেশেই রাজত্ব করতেন। তবে এ দুই অভিমতের পক্ষে কোনো জোড়ালো যুক্তি বা তাথ্যিক প্রমাণ পাওয়া যায় নি (মজুমদার, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩৩-৩৪)। শ্রীগুপ্তের পুত্র ঘটোৎকচ, তাঁর পুত্র চন্দ্রগুপ্ত এবং তাঁর পুত্র সমুদ্রগুপ্ত ও পৌত্র দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বহুরাজ্য জয় করে একটি বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এবংশীয় সম্রাটগণ খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। গুপ্ত সম্রাজ্যের প্রারম্ভে বাংলাদেশের কিছু কিছু অংশ স্বাধীন ছিল। গবেষকগণ মনে করেন যে, সমুদ্রগুপ্তের রাজত্বকালে সমগ্র বাংলাদেশ গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল কিংবা গুপ্ত সাম্রাজ্যের আনুগত্যাধীন ছিল (চৌধুরী, কিরণ চন্দ্র; ভারতের ইতিহাস কথা, কলিকাতা,১৯৯৫, পৃঃ ৪৮৭)। উত্তরবঙ্গে গুপ্তযুগের কতিপয় আবিষ্কৃত তাম্রশাসন থেকে জানা যায় বাংলাদেশের উত্তরাংশ নিয়ে সম্রাট প্রথম চন্দ্রগুপ্তের আমলে গুপ্ত সাম্রাজ্যের একটি ‘ভূক্তি’ বা প্রদেশ গঠিত ছিল। এটা ‘পুড্রবর্ধন ভূক্তি’ নামে পরিচিত ছিল এবং সম্রাট কর্তৃক নিযুক্ত প্রদেশপালের দ্বারা শাসিত হত। তবে এ বিষয় নিশ্চিত যে, গুপ্ত সম্রাটগণ দীর্ঘকাল প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বাংলাদেশ শাসন করেছিলেন।
গুপ্তবংশীয় সম্রাটগণ ছিলেন ব্রাহ্মণ্যধর্মের অনুসারী। স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা ছিলেন ব্রাহ্মণ্যধর্মের পৃষ্ঠপোষক। গুপ্ত বংশীয় শাসনামলকে ‘ব্রাহ্মণ্যধর্মের পুনরুজ্জীবনের যুগ’ বলা হয়। তবে গুপ্তবংশীয় রাজারা অন্যান্য ধর্মমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সহানুভূতিশীল ছিলেন। এ সময়ে বৌদ্ধধর্মের প্রতিও গুপ্ত বংশীয় কোনো কোনো শাসকের পৃষ্ঠপোষকতা লক্ষ্য করা যায়। নালন্দা মহাবিহার ও সারনাথ বৌদ্ধ বিহারের ধর্ম, শিক্ষা ও সংস্কৃতি সাধনার পেছনে গুপ্তরাজদের পোষকতা ছিল। চীনা পরিব্রাজক ইৎ সিঙের ভ্রমণ কাহিনী থেকে জানা যায় যে, মহারাজ শ্রীগুপ্ত চীন দেশীয় বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জন্য গঙ্গার তীর ধরে নালন্দা হতে চল্লিশ যোজন পূর্বে মি-লি-কিয়া-সি-কিয়া-পো-নো নামে একটি ধর্মস্থান (মন্দির) নির্মাণ করে মন্দিরের ব্যয়ভার নির্বাহের জন্য চল্লিশটি গ্রামসহ দান করেছিলেন (রায়, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩৬০)।
এ মন্দির ‘চীনা মন্দির’ নামে খ্যাত ছিল। উক্ত মন্দিরটি স্থাপিত হয়েছিল মৃগস্থাপন (মৃগশিখাবন) স্তুপের কাছে। বৌদ্ধ গ্রন্থে উল্লেখ আছে মৃগস্থাপন স্তুপটি বরেন্দ্র বা বরেন্দ্রীতে অবস্থিত ছিল। এ তথ্য যদি সঠিক হয় তাহলে গুপ্তরাজদের প্রারম্ভিক সময়েও বাংলাদেশের কিয়দংশ তাঁদের শাসনাধীন ছিল। আবার ডি,সি, গাঙ্গুলী মৃগস্থাপন বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলায় এবং সুধাকর চট্টোপাধ্যায় মালদহ জেলার অন্তর্ভূক্ত বলে মত প্রকাশ করেছেন।
গুপ্ত শাসনামলে খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকের প্রথম পাদে চৈনিক পরিব্রাজক ফা-হিয়েন (৩৯৯ খ্রিস্টাব্দে) বৌদ্ধ ধর্মের উৎসভূমি ভারতবর্ষে আগমন করে ১৪ বছর ভারতবর্ষ, শ্রীলংকা ও যবদ্বীপ পরিভ্রমণ শেষে ৪১৩ খ্রিস্টাব্দে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি গঙ্গার পথ ধরে চম্পা হতে বাংলাদেশে এসেছিলেন এবং তাম্রলিপ্তি বন্দরে দুই বছর অবস্থান করে বৌদ্ধ সূত্র ও প্রতিমা চিত্র নকল করেছিলেন। এ সময়ে তিনি তাম্রলিপ্তিতে ২২টি মহাবিহারে অসংখ্য বৌদ্ধ ভিক্ষু প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তখন তাম্রলিপ্তিতে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব প্রতিপত্তি বেশ ছিল। এ সময়ের কয়েকটি বৌদ্ধমূর্তিতে বৌদ্ধধর্মের সমৃদ্ধির প্রমাণ পাওয়া যায়। পূর্ব ভারতীয় গুপ্তশৈলীর একটি বিশিষ্ট নিদর্শন রাজশাহী জেলার বিহরৈল গ্রামে প্রাপ্ত দন্ডায়মান বুদ্ধমূর্তিটি মহাযান সম্প্রদায়ের
(চলবে)
মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার পূর্ব অর্থাৎ আনুমানিক খ্রিস্টীয় ৩য় শতক পর্যন্ত দীর্ঘ পাঁচশ বছরের মধ্যে পূর্ব ভারতের (বাংলাদেশ) ইতিহাস সম্পর্কে বিশেষ কোনো ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায় না। বঙ্গদেশে ও উড়িষ্যায় কুষাণ যুগের কিছু মুদ্রা আবিষ্কৃত হওয়ায় কেউ কেউ মনে করেন যে বঙ্গদেশ কুষাণ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। একথা অনস্বীকার্য যে, কুষাণ সম্রাট কণিষ্ক একজন শক্তিশালী শাসক ছিলেন এবং তিনি একটি বিরাট সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়েছিলেন। অনেকের ধারণা বাংলাদেশও সম্রাট কণিষ্কের সাম্রাজ্যভূক্ত ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে, কণিষ্কের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় জলান্ধরে যে চতুর্থ বৌদ্ধ মহাসঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়েছিল এতে মহাযান বা মহাসাংঘিক সম্প্রদায় পোষকতা লাভ করেছিল এবং সঙ্গীতি শেষে কণিষ্কের পৃষ্ঠপোষকতায় মহাযান ধর্মমত মধ্য এশিয়াসহ চীন, কোরিয়া, জাপান প্রভৃতি দেশে প্রসার লাভ করেছিল। সম্ভবত এসময়েই বাংলাদেশে মহাযান ধর্মমতের প্রচার ঘটে থাকবে। তবে ইতিপূর্বে প্রচারিত থেরবাদ বৌদ্ধমতও পাশাপাশি প্রচলিত ছিল। ফা-হিয়েন, হিউয়েন সাঙ প্রমুখ চীনা পরিব্রাজকদের ভ্রমণ বৃত্তান্তে এর সমর্থন মিলে। কণিষ্কের সময়ে বাংলাদেশ সম্পূর্ণ কিংবা আংশিক এলাকাও যদি কণিষ্ক-সাম্রাজ্যভূক্ত হয়ে থাকে তা হলে নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, তাঁর সময়ে বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্মের প্রসার ঘটেছিল। ঐতিহাসিকগণ মনে করেন যে, রাজ্যজয় ও সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য কণিষ্কের যে খ্যাতি প্রচলিত আছে, তার তুলনায় অনেক বেশি তিনি খ্যাত হয়ে আছেন ‘শাক্যমুনি’র ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতার জন্য। এজন্যে কণিষ্কের রাজত্বকালে বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে এক যুগাšতকারী পরিবর্তন সাধিত হয়েছে বলে গবেষকগণ মনে করেন (সিন্হা, প্রাগুক্ত, ৩৫৮-৫৯)।
খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকের শেষান্তে অথবা চতুর্থ শতকের গোড়ার দিকে গুপ্ত সাম্রাজ্যের পত্তন হয়। ধারণা করা হয় যে, খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকের অব্দে অথবা চতুর্থ শতকের প্রারম্ভে গুপ্ত বংশীয় আদিপুরুষ শ্রীগুপ্ত মগধে রাজত্ব করতেন। আবার কারো কারো মতে গুপ্তগণ বাঙালি ছিলেন এবং প্রথমে বাংলাদেশেই রাজত্ব করতেন। তবে এ দুই অভিমতের পক্ষে কোনো জোড়ালো যুক্তি বা তাথ্যিক প্রমাণ পাওয়া যায় নি (মজুমদার, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩৩-৩৪)। শ্রীগুপ্তের পুত্র ঘটোৎকচ, তাঁর পুত্র চন্দ্রগুপ্ত এবং তাঁর পুত্র সমুদ্রগুপ্ত ও পৌত্র দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বহুরাজ্য জয় করে একটি বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এবংশীয় সম্রাটগণ খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। গুপ্ত সম্রাজ্যের প্রারম্ভে বাংলাদেশের কিছু কিছু অংশ স্বাধীন ছিল। গবেষকগণ মনে করেন যে, সমুদ্রগুপ্তের রাজত্বকালে সমগ্র বাংলাদেশ গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল কিংবা গুপ্ত সাম্রাজ্যের আনুগত্যাধীন ছিল (চৌধুরী, কিরণ চন্দ্র; ভারতের ইতিহাস কথা, কলিকাতা,১৯৯৫, পৃঃ ৪৮৭)। উত্তরবঙ্গে গুপ্তযুগের কতিপয় আবিষ্কৃত তাম্রশাসন থেকে জানা যায় বাংলাদেশের উত্তরাংশ নিয়ে সম্রাট প্রথম চন্দ্রগুপ্তের আমলে গুপ্ত সাম্রাজ্যের একটি ‘ভূক্তি’ বা প্রদেশ গঠিত ছিল। এটা ‘পুড্রবর্ধন ভূক্তি’ নামে পরিচিত ছিল এবং সম্রাট কর্তৃক নিযুক্ত প্রদেশপালের দ্বারা শাসিত হত। তবে এ বিষয় নিশ্চিত যে, গুপ্ত সম্রাটগণ দীর্ঘকাল প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বাংলাদেশ শাসন করেছিলেন।
গুপ্তবংশীয় সম্রাটগণ ছিলেন ব্রাহ্মণ্যধর্মের অনুসারী। স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা ছিলেন ব্রাহ্মণ্যধর্মের পৃষ্ঠপোষক। গুপ্ত বংশীয় শাসনামলকে ‘ব্রাহ্মণ্যধর্মের পুনরুজ্জীবনের যুগ’ বলা হয়। তবে গুপ্তবংশীয় রাজারা অন্যান্য ধর্মমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সহানুভূতিশীল ছিলেন। এ সময়ে বৌদ্ধধর্মের প্রতিও গুপ্ত বংশীয় কোনো কোনো শাসকের পৃষ্ঠপোষকতা লক্ষ্য করা যায়। নালন্দা মহাবিহার ও সারনাথ বৌদ্ধ বিহারের ধর্ম, শিক্ষা ও সংস্কৃতি সাধনার পেছনে গুপ্তরাজদের পোষকতা ছিল। চীনা পরিব্রাজক ইৎ সিঙের ভ্রমণ কাহিনী থেকে জানা যায় যে, মহারাজ শ্রীগুপ্ত চীন দেশীয় বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জন্য গঙ্গার তীর ধরে নালন্দা হতে চল্লিশ যোজন পূর্বে মি-লি-কিয়া-সি-কিয়া-পো-নো নামে একটি ধর্মস্থান (মন্দির) নির্মাণ করে মন্দিরের ব্যয়ভার নির্বাহের জন্য চল্লিশটি গ্রামসহ দান করেছিলেন (রায়, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩৬০)।
এ মন্দির ‘চীনা মন্দির’ নামে খ্যাত ছিল। উক্ত মন্দিরটি স্থাপিত হয়েছিল মৃগস্থাপন (মৃগশিখাবন) স্তুপের কাছে। বৌদ্ধ গ্রন্থে উল্লেখ আছে মৃগস্থাপন স্তুপটি বরেন্দ্র বা বরেন্দ্রীতে অবস্থিত ছিল। এ তথ্য যদি সঠিক হয় তাহলে গুপ্তরাজদের প্রারম্ভিক সময়েও বাংলাদেশের কিয়দংশ তাঁদের শাসনাধীন ছিল। আবার ডি,সি, গাঙ্গুলী মৃগস্থাপন বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলায় এবং সুধাকর চট্টোপাধ্যায় মালদহ জেলার অন্তর্ভূক্ত বলে মত প্রকাশ করেছেন।
গুপ্ত শাসনামলে খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকের প্রথম পাদে চৈনিক পরিব্রাজক ফা-হিয়েন (৩৯৯ খ্রিস্টাব্দে) বৌদ্ধ ধর্মের উৎসভূমি ভারতবর্ষে আগমন করে ১৪ বছর ভারতবর্ষ, শ্রীলংকা ও যবদ্বীপ পরিভ্রমণ শেষে ৪১৩ খ্রিস্টাব্দে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি গঙ্গার পথ ধরে চম্পা হতে বাংলাদেশে এসেছিলেন এবং তাম্রলিপ্তি বন্দরে দুই বছর অবস্থান করে বৌদ্ধ সূত্র ও প্রতিমা চিত্র নকল করেছিলেন। এ সময়ে তিনি তাম্রলিপ্তিতে ২২টি মহাবিহারে অসংখ্য বৌদ্ধ ভিক্ষু প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তখন তাম্রলিপ্তিতে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব প্রতিপত্তি বেশ ছিল। এ সময়ের কয়েকটি বৌদ্ধমূর্তিতে বৌদ্ধধর্মের সমৃদ্ধির প্রমাণ পাওয়া যায়। পূর্ব ভারতীয় গুপ্তশৈলীর একটি বিশিষ্ট নিদর্শন রাজশাহী জেলার বিহরৈল গ্রামে প্রাপ্ত দন্ডায়মান বুদ্ধমূর্তিটি মহাযান সম্প্রদায়ের
(চলবে)
No comments
Post a Comment