কোঠের পাড় ত্রিরত্নাংকুর বিহার পরিচিতি
ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধ অধ্যুষিত বদ্ধিষ্ণু একটি গ্রাম কোঠেন পাড়। সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা, ধন-ধান্যে সুসমৃদ্ধ। গ্রামটির প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী অতি মনোরম। এটি চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি থানার অন্তর্গত। এ কোঠের পাড় নামের পিছনে একটি বিরাট ঐতিহাসিক ঘটনা রয়েছে। স্থানীয় লোকের মতে, অতীতে এ জায়গায় মগরাজা সৈন্য-সামন্ত রাখার জন্য একটি দুর্গ তৈরী করেছিলেন। পুকুরের ন্যায় চারিদিকে প্রায় এক মাইল বিশিষ্ট দেওয়াল তৈরী করেছিলেন যা এখনও বিদ্যমান। চারি দেওয়ালে পরিবেষ্ঠিত বলে একে কোঠের পাড় বলা হয়।
এ কোঠের পাড় ভিতরের অংশে বড়ুয়াপাড়া। এ পাড়ার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে ত্রিরত্নাংকুর বৌদ্ধ বিহার। বিহারটি প্রথমে স্বর্গীয় বাবু চৈতন্যচরণ বড়ুয়ার কর্তৃক দানকৃত ভূমিতে ১৮৯০ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়। বিহারটি সম্প্রসারিত করার জন্য ক্রমান্বয়ে বুদ্ধকিংকর বড়ুয়া, ডা গোপেন্দ্র লাল বড়ুয়া, বৈকুন্ঠ বড়ুয়া, প্রফুল্ল রঞ্জন বড়ুয়া প্রয়াত শ্রীমৎ নিরোধানন্দ মহাথেরসহ একে একে ভূমি দান করেন। ফলে বিহারের বিবিধ অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে সুবিধা হয় এবং উন্নয়নে ধারা একধাপ এগিয়ে যায়। ১৮৯০ সাল হতে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত যারা বিহার পরিচালনা করে গেছেন তারা হচ্ছেন। প্রয়াত বাবু চৈতন্য চরণ, মেঘবর্ন, বৈকুন্ঠ, জগত চন্দ্র, বুদ্ধকিংকর বড়ুয়াপ্রমূখ।
এ বিহারের সর্ব প্রথম বিহারাধিপতি হিসেবে পর্দাপন ও অবস্থান করেন প্রয়াত শ্রীমৎ সুমঙ্গল মহাথের তারই কর্ম বিচক্ষণতায় ধীরে ধীরে বিহারের উন্নয়নের কাজ এগিয়ে যায়। এরপর একে একে পর্দাপন ও অবস্তান করেন প্রয়াত শ্রীমৎ জাগরণ মহাথের, শ্রীমৎ জিনবংশ মহাথের, শ্রীমৎ জ্ঞানলংকার মহাথের, শ্রীমৎ শ্রদ্ধানন্দ মহাথের, শ্রীমৎ জিনান্দ মহাথের, শ্রীমৎ প্রজ্ঞাবংশ মহাথের, শ্রীমৎ নিরোধানন্দ মহাথের, শ্রীমৎ প্রজ্ঞানন্দ স্থবির, শ্রীমৎ সুগতপ্রিয় মহাথের (বর্তমান)। এ বিহারে আমিও র্দীঘ ছয় বৎসর অবস্থান করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করার সুযোগ পেয়েছিলাম। তার জন্য বিহারাধ্যক্ষ ও গ্রামবাসীকে কৃতজ্ঞতা জানায়। তবে বিহার উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেন শ্রীমৎ নিরোধানন্দ মহাথের । ভূমিদান ও তোরণ তারই প্রত্যক্ষ প্রমাণ। বর্তমানে শ্রীমৎ সুগতপ্রিয় মহাথের কর্ম বিচক্ষণতায় বিহারটি পূনঃ নির্মাণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশী বৌদ্ধদের সর্ববৃহৎ ও মনোরম বিহারে পরিণত হয়েছে। এতে আমিও ভন্তে সহযোগিতা করার সুযোগ পেয়েছিলাম।
১৯৫৫ সালে বিহারটি সুষ্ঠ পরিচালনার জন্য বৌদ্ধ কল্যাণ সমিতি গঠন করা হয়। এতে একধারে যারা সভাপতিত্ব করে বিহারের উন্নয়নে পথ ত্বরান্বিত করেন তারা হলেন- প্রয়াত প্রাণহরি বড়ুয়া, বীরেন্দ্র লাল বড়ুয়া, চন্দ্রমোহন বড়ুয়া, পাঁচকুড়ি বড়ুয়া, ডাঃ অরবিন্দুবড়ুয়া, দীলিপ বড়ুয়া। পূনঃবার বাবু পাঁচ কুড়ি বড়ুয়া সভাপতির পদ গ্রহন করে বিহারটি পূনঃনির্মাণের কাজ সুচনা করেন।
এ কোঠের পাড় ত্রিরত্নাংকুর বিহারের পিছনে যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন তাদেরকে কৃতজ্ঞতা ও মূল্যায়ণ করা একান্ত কর্তব্য। আজকের বিশ্ব সভ্যতার দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় যে বিভিন্ন জাতি ভোবে শৌর্য, বীর্যের অধীকারী যারা সুসভ্য জাতি বলে মাথা উচু করে দাঁড়িয়েছেন তাদের এসব জাতির সভ্যতার মূলে রয়েছে প্রাচীন গ্রীক সভ্যতার অবদান। আজকের দর্শন, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, চিকিৎসা শাস্ত্র, জ্ঞান-বিজ্ঞানে যত শাখা-প্রশাখার কথাই বলি না কেন সব কিছুর মূল কেন্দ্র গ্রীক সভ্যতা। তাই গ্রীক সভ্যতার কাছে আজকের মানুষ অনেক ঋণী। গ্রীকদের এই অভাবিত উন্নতির মূলে রয়েছে, তারা প্রতিথযশা ব্যক্তিদের কার্যকলাপকে ইতিহাসে সংরক্ষণ করে রেখেছে, তাদের মূল্যায়ণ করেছে। তারা সম্মান দিয়েছিলেন দার্শনিক সক্রেটিশ, প্লেটো, এবয়, এরিষ্টটলকে। তারা ধারণ করে রেখেছে বিজ্ঞান ও দর্শনকে। এ মহান দার্শনিকদেরকে ইতিহাসে অমর করে রেখেছেন। তাই তারা পরবর্তী সময়ে বিশ্ব কর্তৃক নন্দিত হয়েছিলেন। সুতরাং দেখা যায় সমৃদ্ধি ও অগ্রগতির লাভের জন্য প্রথিত যশা ব্যক্তিদের স্মরণ ও মূল্যায়ণ করা একান্ত কর্তব্য।
১৯৯৯ সালে বিহারটি পূণঃ নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। সে সময় আমিও বিহারে অবস্থান করার জন্য আছি। সে সময় শ্রীমৎ সুগতপ্রিয় মহাথের ও বাবু পাঁচকুড়ি বড়ুয়া উভয়ে বিহার নির্মাণে নেতৃত্ব ভার গ্রহন করেন। বিহারটি নির্মাণ কাজ ক্রমান্বয়ে এগিয়ে যায়। কিন্তু হঠাৎ পাঁচ কুড়ি বড়ুয়ার মৃত্যুতে নির্মাণের কাজ ব্যহত হয়। সৃষ্টি হয় নানা প্রতিকুলতা উনার মুত্যৃতে ভন্তে মহোদয় খুব বিচলিত হলেন। এহেন মুর্হুহতে এগিয়ে আসেন পাঁচ কুড়ি বড়ুয়ার সুযোগ্য পুত্র সাংবাদিক বাবু কাঞ্চন বড়ুয়া ও বিশিষ্ট আইন জীবি বাবু শ্যামল বড়ুয়া । তবে অবশ্যই ইঞ্জিনিয়ারিং প্লানটা করেছেন প্রকৌশলী বাবু মৃনাল কান্তি বড়ুয়া ও শাক্যপদ বড়ুয়া যাবতীয় হিসাব নিকাশ করার ব্যাপারে বাবু হরিপদ বড়ুয়া ও অনন্য ভূমিকা রাখেন। এদের সমন্বয়য়ে আজ মনোরম ও সুবৃহৎ পরিসরে পরিণত হয়েছে।
এ বিহাটি পূণঃ নিমার্ণে গুরুত্বপূর্ণ অর্থসহায়ক ভূমিকা পালন করেন শ্রীমৎ প্রজ্ঞাবংশ মহাথের অবস্থান কালীন দায়ক/দায়িকার কর্তৃক মুষ্টি চাউলের তহবিল। বিহারের আওয়াতায় প্রায় দুইশত পরিবার দায়ক ভিক্ষুদের চর্তুপ্রত্যয় যোগাতেন। এখানে আইনজীবি, ডাক্তার, ইজ্ঞিনিয়ার, ব্যবসায়ী, বিদেশ প্রবাসী, কৃষক সব শ্রেণী পেশাজীবি লোক বসবাস করে। বিহারটি মোটমুটি মহাবিহার বলা যেতে পারে। কারণ এখানে পুষ্করিণী, বোধিবৃক্ষ, সীমাঘর, রয়েছে। অন্যদিকে একাধিক বৃহৎ বুদ্ধ মূর্তিও রয়েছে। তার মধ্যে পিতলের বুদ্ধমূর্তিটি অগ্রগণ্য। এ মূর্তিটি থাইল্যান্ড থেকে শ্রীমৎ শীলবংশ ভিক্ষুর সহায়তায় নিয়ে আসা হয়। শ্রীমৎ সুগতপ্রিয় মহাথের কর্তৃক পরিচালিত সন্ধ্যা কালিন যৌদ্ধ বন্দনার পরিষদ্ প্রতিদিন সন্ধ্যায় সমবেত বন্দনার কার্য সম্পাদন করা হয়। বিহারের সন্নিকটে একটি পালিটোলও রয়েছে। প্রয়াত বাবু দীলিপ বড়ুয়া ও বাবু বিজয় বড়ুয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় এই টোল গড়ে উঠে। এতে প্রতিদিন গ্রামের ছেলে-মেয়েদেরকে স্বধর্মে জাগ্রত করার জন্য ধর্মীয় বিষয় পাঠদান করা হয়।
পরিশেষে বলা যায় যে ত্রিরত্নাংকুর বিহারটি বর্তমানে গ্রামবাসী তথা বৌদ্ধ জন সাধারণ সার্বিক সহযোগিতায় বাংলাদেশী বৌদ্ধদের সর্ববৃহৎ ও মনোরম বিহারে পরিণত হয়। কৃতজ্ঞতার সাথে সম্মরণ করতে হয় যারা শতাব্দীকাল আগে বিহার প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। সে জন্য দার্শনিক টেনসন বলেছিলেন- মানুষের সত্যিকারের পরিচয় তার কীর্তির মধ্যে। পূর্নকীর্তি অর্জন করে যে মৃত্যুর বুকে ঢলে পড়ে সে ভাগ্যবাণ। কিন্তু যার কীর্তি বিরাট নয় কিছুটা গিয়ে সে হারিয়ে গেছে সেও পরিচয়হীন নয়। হয়ত কোন অনাগত দিয়ে নতুন একজন আসবে তার কীর্তিকে পরিপূর্নতার দিকে ভরিয়ে তুলতে। এ পৃথিবীর কোন সাধনাই বৃথা যায় না। এ বিহার পরিচিতি লেখতে গিয়ে যারা আমাকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন তাদেরকে আমি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে লেখা শেষ করলাম।
লেখক: সাধনাজ্যোতি ভিক্ষু
বি,এ (অনার্স) এম,এ. এম, এড.
No comments
Post a Comment