ধর্মীয় সমাজ ও সংস্কৃতি
বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলীয় ভূমি পার্বত্য চট্টগ্রাম। এ জেলাটি আশির দশকে খাগড়াছড়ি,রাঙ্গামাটিও বান্দরবান অঞ্চল ভেদে তিনটি জেলায় বিভক্ত করেন তখনকার সময়ের সামরিক শাসক রাষ্ট্রপতি জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। যিনি বর্তমানেও একজন রাজনীতিক হিসাবে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এবং ক্ষমতাসীন সরকারের অন্যতম শরীক দল। উত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম বা খাগড়াছড়ি মধ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম বা রাঙ্গামাটি এবং দক্ষিণ পার্বত্য চট্টগ্রাম বা বান্দরবান এ তিন অঞ্চলে যুগ যুগ ধরে বসবাসরত ভিন্ন ভাষাভাষী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিভিন্ন জাতি, বৈচিত্রময় সংস্কৃতিতে পরিপূর্ণ । পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল সমতল অঞ্চল থেকে সম্পূর্ন ভিন্ন । এখানকার জীবন জীবিকা, প্রাকৃতিক পরিবেশ বৈচিত্র্যময়। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে এ অঞ্চলটি পার্বত্যময় ও দুর্গম এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের শেষ সীমানা যার উত্তর পূর্বদিকে ভারত ও পূর্বাঞ্চলের কিছুঅংশ মায়ানমার সীমান্ত রয়েছে। সেই কারনে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় ইহা বিভিন্ন দিক থেকে পশ্চাদপদ রয়েছে। বিভিন্ন জাতির মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতি এরা লালন করে । তবে তার মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মীয় জনগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ট, কারন প্রধান ও সংখ্যাগরিষ্টের মধ্যে চাকমা, তংচঙ্যা,মারমা ও চাক এরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। পাবর্ত্য চট্টগ্রাম বাদেও বাংলাদেশের চট্টগ্রাম,বগুড়া, রংপুর , ঢাকা ও কুমিল্লার ময়নামতিতে বৌদ্ধ সভ্যতার জীবন্ত নিদর্শন রয়েছে। আমার আলোচনার বিষয়বস্তু হল এ অঞ্চলের বসবাসরত বৌদ্ধ জাতির বিশেষ করে চাকমাদের ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কৃতির পরিবর্তনের বিষয়টি পর্যালোচনা করা। বৌদ্ধ জনগোষ্টির র্ক্যকলাপ, ধর্মকর্ম, শিক্ষা , সাহিত্য,সংস্কৃতি ও সমাজ জীবনই তাদের ধর্মীয় সংস্কৃতির ইতিহাস। ইহা একটি গুরুত্বপূর্ন বিষয় কারন এর মাধ্যমেই একটি জাতির পরিচয় পাওয়া যায়। ইতিহাস এবং সংস্কৃতি পরষ্পর অবিচ্ছেদ্য ভাবে সম্পর্কযুক্ত হওয়ায় একটিকে বাদ দিয়ে অপরটি পরিপুর্ণভাবে আলোচনা করা যায় না কাজেই এ বিষয়টি ব্যপক এবং যথেষ্ট কঠিন বটে। আর চাকমা সমাজের ইতিহাস বা সংস্কৃতি সম্পর্কে আলোচনা করতে হলে সুদুর অতীতের দিকে অন্তত: কিছুটা হলেও তাকাতে হয়। চাকমাদের প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোন প্রামাণিক দলিল বা লিখিত গ্রন্থ পাওয়া যায় নাই। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লেখক কিছু কিছু বিষয় তুলে ধরেছেন। তবে এর মধ্যে ১৯০১ সালের দিকে প্রকাশিত বিশিষ্ট লেখক সতীশ চন্দ্র ঘোষ মহাশয়ের ”চাকমা জাতি” , ১৯৬৯ সালের দিকে প্রকাশিত স্বর্গগত শ্রদ্ধেয় বিরাজ মোহন দেওয়ানের ” চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত” এবং ভারতের লেখক সিদ্ধার্থ চাকমার ”পার্বত্য চট্টগ্রাম” নামক গ্রন্থগুলি পার্বত্য চট্টগ্রামের সামাজিক, রাজনৈতিক ইতিহাস ও চাকমা জাতির সংস্কৃতি বিষয় অধ্যয়নের ক্ষেত্রে বিরাট ভুমিকা রেখেছে। সমাজ সভ্যতা পরিবর্তনশীল, মানব জাতির ইতিহাসে প্রাচীন সভ্যতা ধীরে ধীরে পরিবর্তন হয়ে এখন আধুনিক সভ্যতায় পৌছেছে। সভ্যতা ক্রম বিকাশের এই হাজার বছরের ইতিহাসে কত জাতি ,ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম বিলুপ্ত হয়ে গেছে তার সঠিক তথ্য পাওয়া মুশকিল। বিশেষ করে ক্ষুদ্র জাতি, বর্ণ ও সংস্কৃতিগুলো বৃহৎ জাতির সংস্পর্শে সহজেই মিশে যায় অথবা বিলীন হয়ে যায় । সেজন্য নিজেদের সামাজিক রীতিনীতি , ধর্মীয় ও সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে আপন স্বকীয়তা ধরে রাখা বা টিকে রাখা দরকার। চাকমা বৌদ্ধ সমাজ থেকে অনেক কুসংস্কার দুরীভূত হলেও সমাজ জীবনে অন্যান্য সংস্কৃতির প্রভাব আজও লক্ষ্য করা যায় । বিশেষ করে হিন্দু ও মুসলমান সংস্কৃতির আচার অষ্টুষ্ঠানের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে,বাংলাদেশের চাকমাদের আচার অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে মুসলমানী সংস্কৃতি এবং হিন্দুস্থান বা ভারতের চাকমাদের ক্ষেত্রে হিন্দুস্থানী সংস্কৃতির প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। এক্ষেত্রে দেখা যায় বিবাহিত হিন্দু মেয়েরা যেমন সিথিতে সিদুর লাগায় এবং ঘরের গণ্ডির বাইরে কোথাও গেলে কপালে বড় লাল তিলক লাগায় অনুরুপভাবে চাকমা মেয়েরাও কোথাও গেলে একই সাজে সজ্জিত হয়। ভারতীয় চাকমাদের ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় হল- নববধু নিয়ে আসার সময় বরকে বরযাত্রী হিসাবে যেতে হয় যাহা বাংলাদেশী চাকমাদের ক্ষেত্রে প্রচলন নয় । মূলত: চাকমা সমাজের রীতিনীতিতে বর সঙ্গে গিয়ে বধূ নিয়ে আনার কোন রীতি আগে ছিল না যা বাংলাদেশী চাকমাদের এখনো নেই । তবে ভারতীয় চাকমা নারী সমাজ এখনো একটি বিষয় ধরে রেখেছে সেটি হল নিজস্ব পোষাক বা জাতীয় পোষাক পরিধান করা । অর্থাৎ যে কোন অনুষ্টানে অংশগ্রহনে তারা নিজেদের পোষাক পরিধান করেন । চাকমা বৌদ্ধরা থেরবাদী বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী । তাদের জাতকর্ম, বিবাহ, অন্ত্যোতিক্রিয়া , ধর্মীয় অনুষ্টান,ও নানাবিধ সামাজিক অনুষ্টানের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
জাতকর্মঃ গৃহে সন্তান ভুমিষ্ট হলে পরিবার ও গ্রামে একধরনের আনন্দের আমেষ সৃস্টি হয়। নবজাতককে একনজর দেখার জন্য গ্রামের মেয়েরা উৎসুক হয়ে পড়েন। সন্তান প্রসবের পর নবজাতক ও প্রসুতিকে পরম পানিতে স্নান করানো হয়। প্রসবের দিন থেকে পনের দিন পর্যন্ত প্রসূতি অশুচি থাকে। এজন্য সংসারের কোন কাজে সে হাত দেয় না ।এ পনের দিন পর্যন্ত প্রসূতির ঘরে উঠার প্রধান দরজার মুখে তুষের আগুন সহ বাশের চোঙ্গে সোনা রুপার পানি (ঘিলে কোজোই পানি) রাখা হয় যাতে কোন আগন্তুক ঘরে প্রবেশের সাথে সাথে পানি ছিটিয়ে পরিশুদ্ধ হতে পারে। আবার প্রসূতি নদীতে স্নান করতে বা কাপড়-চোপড় পস্কিার করতে গেলে সঙ্গে যে কোন একজন লোক সহ আনুষাঙ্গিক জিনিস পত্র নিয়ে যান, যেমন-দা,কাচি, আগুন বা হানি বেনা (পুরানো কাপড় রশির মত পাকিয়ে একপ্রান্তে আগুন ধরিয়ে জ্বালিয়ে রাখা) এভাবে পনের দিনের মাথায় একটি অনুষ্টান করা হয় এই দিনে নবজাতকের নামকরন করা হয় , আত্বীয় - স্বজনদের নিমন্ত্রন করে খাওয়ানো হয়, ধাত্রী বা ঔঝাকে (সন্তান ভুমিস্তের সময় যে প্রসবের কাজ তদারকি করে) অন্ন, বস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সম্মান জানানো হয়। নবজাতকের জন্মোত্তর সম্পুর্ন এই অনুষ্টানকে চাকমা ভাষায় ”কোজোই পানি ” বলা হয়। আধুনিক কালে কোজোই পানি অনুষ্টান হলেও আগেকার সংস্কৃতিগুলো অনুসরন করা হয় না । বর্তমানে প্রসব কাজে ঔঝার উপর নির্ভরশীলতা কমে গেছে, অধিকাংশই ডাক্তার , হাসপাতালে নিয়ে যান। আর কোজোই পানির সময় বৌদ্ধ ভিক্ষু সংঘের আমন্ত্রন জানিয়ে দানানুষ্ঠান করেন ।
বিবাহ ঃ চাকমা সমাজে বিবাহ অনুষ্ঠান কয়েকটি পর্বে বিভক্ত। চাকমাদের মধ্যে স্বগোত্রে বা স্বগোষ্ঠীতে বিবাহ হয় না । পিসী,মাসী, সিতুতো, মাসতুতো , চাচাত ফুপাত বোনের সাথে বিবাহ নিষিদ্ধ। ভিক্ষুদের বর্ষাবাসের সময় (আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে আশ্বিনী পুর্ণিমা) , জন্মমাসে, কার্তিক , পৌষ ও চৈত্র মাসে বিবাহ হয় না পাত্র পাত্রী নির্বাচনে উভয়ে উভয় পক্ষের গোজা, গোষ্ঠী , আর্থ সামাজিক অবস্থা ইত্যাদি বিস্তারিত আলাপ আলোচনা করেন । এভাবে পাত্র ও পাত্রী পক্ষের ১ম ও ২য় বার আলোচনায় সর্বসম্মতি হলে পাত্রী পক্ষ পাত্রের পক্ষকে দিন, ক্ষণ, তারিখ চুড়ান্ত করতে অনুমোদন দেন। পাত্রী পক্ষের অনুমোদন ক্রমে সুবিধামত তারিখে পাত্রের অভিভাবক গ্রামের বিজ্ঞ, গণ্যমান্য কয়েকজন ব্যক্তি নিয়ে কনের বাড়িতে যান, সঙ্গে ন্যুনতম এক এক জোড়া নারেকুল, সুন্দর ও লম্বা আখ ১টি, ভালো মানের বিস্কুট, মিষ্ঠি, শুকনো আখ এ দিন পাত্রীর অভিভাবকও তাদের গ্রামের গণ্যমাণ্য মুরুব্বির নিমন্ত্রন করেন । এ অনুষ্ঠানকে চাকমা ভাষায় ”তিন পুরা” বলা হয়। ”তিন পুরা” দিনেই বিয়ের চূড়ান্ত দিন,ক্ষণ, তারিখ অনুষ্টানের ধরণ , কনে সাজানোর সোনা,রুপার অলংকার সহ ইত্যাদি নির্ধারণ করা হয় । এ দিন থেকে বর এবং কনের বাড়ীতে বিয়ের অনুষ্ঠানের প্রস্তুতির জন্য ধুমধাম পড়ে যায় । বরের বাড়ী পুরাতন হলে গ্রামের সবাই সিমে নতুন বাড়ী মেরামত করা, বাড়ীর চারিদিকে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন , শৌচাগার তৈরী করা, পর্যাপ্ত চাল মজুদ করা , রান্না-বান্নার জন্য প্রয়েজনীয় হাড়ি-পাতিল গচ্ছিত রাখা ইত্যাদি ইত্যাদি কাজে গেরস্তি পরো মাস মহাব্যস্ত হয়ে পড়ে। দুর- দুরান্ত থেকে আপন লোকজন আগে থেকেই বিয়ের বাড়ীতে উপস্থিত থেকে এসব কাজে সহযোগিতা করেন । আর গ্রামের যুবক –যুবতি আন্তরিকতা ও আনন্দের সহিত এই কাজে এগিয়ে আসে। বিয়ের বাড়ী বাদেও গ্রামের পাড়া –পড়শীরাও নিজেদের বাড়ী মেরামত করেন, বিয়ের অথিতি আপ্যয়নের জন্য । যথা সময়ে কনে নিয়ে আসার জন্য শিশু , কিশোর , যুবক-যুবতি, প্রৌঢ়, বিজ্ঞ মুরুব্বী বয়সানুক্রমে এবং আনুপাতিক হারে সাজিয়ে একটি বরযাত্রী দল বা টিম গঠন করা হয় । নববধুকে সুন্দরভাবে সাজানোর জন্য বিশেষ পারদর্শী মহলিাকে এ টিমের মধ্যে অবশ্যই রাখতেহয়।
তাছাড়া, একজন শাবালা, বৌ ধরনী, ঘটক, উপস্থিত জ্ঞান সম্পন্ন একজন মুরুব্বি(যিনি দায়িত্বশীল এবং বিবাহ সংক্রান্ত যে কোন সমস্যার সমাধানে দ্রুত সিদ্ধান্ত দিতে পারদর্শী ও ক্ষমতা রাখেন) অবশ্যই অর্ন্তভুক্ত থাকতে হবে। বর এবং কনে উভয় পক্ষের বাড়ীতে অনুষ্টানের আয়োজন চলে। বরযাত্রী বিয়ের বাড়ীতে পৌছার আগে কনের পক্ষের লোকজন অথিতিদের শুভেচ্ছা জানাতে এগিয়ে আসেন। বাড়ীতে প্রবেশ করা দ্বারে পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা করে রাখা হয়। গৃহে প্রবেশ করার সাথে সাথে বাড়ীর লোকজন বরযাত্রী সবাইকে সাদর স্ভাষণ জানান । কশলাকুশল বিনিময়ের পর নববধু সাজানোর অলংকার, শাড়ী, পিনন,হাদি, সহ অন্যান্য বস্ত্রাদি একটা কুলার মধ্যে সাজিয়ে উপস্থিত গন্যমান্য ব্যক্তিদের সন্মুখে নিয়ে আসেন । মুরুব্বীরা গহনা ও অন্যান্য জিনিস পত্রাদির গুনাগুন পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখার পর সন্তুষ্টি প্রকাশ করিলে বরের পক্ষ থেকে বধুকে সাজিয়ে উপস্থিত গণ্যমাণ্য ব্যক্তি বর্গের সামনে নিয়ে আনা হয় । বয়োজ্যেষ্টরা সবাই বধুকে আর্শীবাদ প্রদান করেন । খাওয়া-দাওয়ার পর যাওয়ার পালা। সব আনুষ্টানিকতা ছাড়ার পরে যাত্রার প্রাক্কালে সাবালা উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে কনে নিয়ে যাবার হুকুম আছে নি? বলে উচ্চ স্বরে বলেন , তখন উপস্থিত সবাই সম্মতি সূচক প্রতিত্তোর দিলে বধু নিয়ে যাবার ক্ষেত্রে আর কোন বাধা রইল না । সাধারনত বরের পক্ষে যত জন লোক আসবে তার দ্বিগুন কনের পক্ষে লোক যাওয়ার নিয়ম। বিশেষ করে গোধুলী , সন্ধ্যা, বা রাত্রের দিকে বধুকে বরণ করে ঘরে তোলা হয় । কাজেই দুই বাড়ীর দুরত্ব এবং সময় বিবেচনা করে বরযাত্রী যাত্রা শুরু করে । কনের বাড়ী থেকে বরের বাড়ী যতদুর হোক না কেন মাঝপথে অবশ্যই বিশ্রাম নিতে হয়। সেখানে বরের পক্ষের লোকজনকে বিভিন্ন খাদ্য দ্রব্য দিয়ে আপ্যয়ন ও পরিবেশন করেন । অন্যদিকে বিয়ের ঘরে নববধুকে বরন করার জন্য পরিবারের লোকজনসহ গ্রামের লোকজন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকেন। বিয়ের বাড়ী বিশেষ সজ্জায় সজ্জিত করা হয় । ঘরে প্রবেশ করার মুল দরজার সম্মুখে দুই দিকে দুইটি সবুজ কলা গাছের চারা বসিয়ে সাদা সুতা দিয়ে রাস্তা বন্ধ করে রাখা হয় । বধু ঘরে না তোলা পর্যন্ত দুইধারে দুইটি পানিপুর্ণ কলসীর উপর মোম বাতি প্রজ্জলিত অবস্থায় থাকে। বরযাত্রী বাড়ীর প্রাঙ্গনে পৌছলেও শুভ লগ্ন না হওয়া পর্যন্ত বৌকে ঘরে তোলা হয় না। শূভক্ষণ অনুযায়ী বরের ছোট ভাই অথবা ছোট বোন নববধুর পা ধুয়ে ডান হাতের কনিষ্ট আঙ্গুলে সুতা বেধে বরের মা তার পুত্র বধুকে বরন করে ঘরে তোলেন । কিছুক্ষন পরে শাবালা উপস্থিত সকলের সম্মতি নিয়ে ”জোড়া বাধা” বা বিয়ের মুল কাজ করে দেন। এদিন গ্রামের লোকজন সবাই বিয়ের কাজে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন। অনেকে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে বরযাত্রী আনে এবং সারা রাত গান বাজনা ও বিশেষ নাটক ও পরিবেশন করা হয় । পরের দিন খাওয়া-দাওয়ার মুল অনুষ্ঠান । আমন্ত্রিত সকল অথিতিদের খাওয়ানোর সাথে সাথে কনের পক্ষের লোকজনকে িিবশেষ যতœ সহকারে আপ্যায়ন করা হয়। বরের মা তার বিয়াই -বিয়ানী কে অনুষ্ঠানের মুল রান্না করা মাছ মাংসের অংশ বিশেষ পাঠিয়েদেন। যেমনি কনের মাও পাঠিয়েছিলেন । খাওয়া-দাওয়া , সম্পুর্ন আনুষ্টানিকতা ছাড়ার পর এবার বিদায়ের পালা । কনের পক্ষে কোন একজন অভিভাবক বরের মা ,বাবার কাছে তাদের নববধুকে বুঝিয়ে দিয়ে যান যে , আজ থেকে আমার মেয়ে/বোন/আপনার ঘরের মেয়ে , আপনাদের দায়িত্বে দিয়ে গেলাম, তার জীবদ্দশায় সম্পুর্ন ভরন পোষণ , দেখা শুনার দায়িত্ব আপনার /আপনাদের । যথারীতি বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে কনের পক্ষের লোকজনকে বিদায় দেওয়া হয় ।তারাও যতজন লোক বরযাত্রী হিসাবে এসেছেন সবাই কনের পিত্রালয়ে গিয়ে বিদায় নিয়ে চলে যান যার যার ঘরে । ঠিক ৭ দিন পরে বর তার নববধুকে নিয়ে শ্বশুর বাড়ীতে বেড়াতে যান। বরের ঘনিষ্ট বন্ধু সহ সঙ্গেবাড়ীতে তৈরী পিঠা , মদ, ইত্যাদি শ্বশুরবাড়ীর জন্য নিয়ে যান। এভাবে সম্পন্ন হয় চাকমাদের বিবাহ অনুষ্টানের সামাজিকতার কাজ।
মৃত্যু ঃ চাকমাদের সমাজের মধ্যে কাহারো মৃত্যু ঘটিলে মৃতদেহ দাহ করা হয় । তবে শিশু হলে বা বসন্ত ঘঠিত রোগে কারোর মৃত্যু হলে তাহাকে কবর বা পুতে ফেলা হয়। মৃত্যু ঘটার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামে বা আশে পাশে এলাকায় সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে।মৃতের ঘরে এবং গ্রামের প্রতিটি ঘরের প্রধান দ্বারে তুষের আগুন রাখে, মরদেহ দাহ না করা পর্যন্ত এ আগুন জ্বালিয়ে রাখা হয় । মৃতের সংবাদ পাওয়ার সাথে সাথে গ্রামের সবাই সহযোগিতার কাজে এগিয়ে আসেন। ঢোল, বাদ্যযন্ত্র সংগ্রহ করে বাজানো হয় । মরদেহ সাধারনত একরাত ঘরে রাখা হয়। দুর দুরান্তের আত্বীয় স্বজন এসে যাহাতে একনজর দেখার সুযোগ পায় সেই জন্য মৃত্যু ঘটার সঙ্গে সঙ্গে দাহ ক্রিয়া করা হয় না । আবার যদি মঙ্গল বারে বিকাল বেলায় মৃত্যু ঘটে তাহলে দুই রাত অবশ্যই রাখতে হবে। কারন চাকমাদের সমাজে বুধবারে দাহ ক্রিয়া করা হয় না । মরদেহ বাড়ীর প্রাঙ্গনে রাখিয়া ভিক্ষু সংঘকে আমন্ত্রন করে ধর্মীয় মোতাবেক সুত্র প্রদান করেন অথবা শ্বশানে গিয়ে ভিক্ষুরা সুত্রপাত করেন । অবশ্য আগেকার দিনে অনেকে লুড়ি বা রাউলি দিয়ে এসব কাজ সম্পাদন করেন । চাকমাদের মৃতদেহ সৎকার করার রীতিনীতি অনেক জঠিল ্ নানা আনুষ্টানিকতার প্রক্রিয়া সম্পাদনের মধ্য দিয়ে দাহ ক্রিয়া সম্পাদন করা হয়। যেমন সূর্য পশ্চিম দিকে ঢলে না পরা পর্যন্ত মরদেহ ঘর থেকে বাহির করা হয় না । যথাসময়ে মৃতব্যক্তিকে বাড়ী থেকে বাহির করে বাড়ীর প্রাঙ্গনে রাখা হয় । সুষ্ঠু সবল একদল লোক জঙ্গলে গিয়ে কাচা বাশ ও লাকড়ী সংগ্রহ করে শ্বশানে নিয়ে যান। সেখানে মৃতদেহ পোড়ার জন্য লাকড়ির স্তুপ তৈরী করেন যাকে চাকমা ভাষায় বলা হয় ”রুভোকুর” চার কোনায় চার খুটিকে বলা হয় ”হুংগাছ”। রুভোকুর পূর্ব-পশ্চিম মুখী করে তৈরী করার নিয়ম । মৃতদেহ পুরুষ হলে পূর্ব এবং মহিলা হলে পশ্চিম মুখী করে রুবকুরের উপর তোলা হয় । শ্বশানে মৃতদেহকে রুবকুরের চর্তুদিকে বাশের তৈরী একটি বিশেষ গাড়ী দিয়ে সাত বার প্রদক্ষিণ করা হয় ইহার নাম” রাধাঘর ” । অপরদিকে নদী থেকে কলসী বা উল্টোভাবে কাটা বাশের চোঙ্গা দিয়ে পানি এনে বাড়ীর প্রাঙ্গনে মৃতদেহ কে স্নান করে দেওয়ার পর নতুন সাদা বস্ত্র দিয়ে আবৃত করা হয় , দর্শনার্থীরা মরদেহের বুকের উপর টাকা পয়সা দান করেন ।মরদেহকে শ্বশানে নিয়ে যাবার জন্য বাশ দিয়ে যে জিনিসটি তৈরী করা হয় তার নাম”আলংঘর” । বাড়ী থেকে শ্বশানে যাওয়া এবং চিতায় আগুন না দেওয়া পর্যন্ত বাদক দল ঢোল বাজাতে থাকেন। কথিত আছে , অনেক প্রাচীন কালে চাকমাদের রাজা ”সাধেং গিরি” যিনি একজন আধ্যাত্বিক সাধক ,জীবন্তাবস্থায় স্বর্গে গমনের প্রাক্কালে ডুমের বাজানো ২২৭ প্রকার ঢোলের তাল পরীক্ষা করেন । এর মধ্যে একটি ই তার পছন্দ হয়েছে যেটি বর্তমানে চাকমা সমাজে মানুষ মারা গেলে বাজানো হয়। রুভোহুুরের কিছু দুরত্বে চার কোনায় চারটি লম্বা কাচা বাশ যার মাথায় ঝোপ রেখে সাদা মার্কিন মাপড় টাঙিয়ে রাখা হয় যাতে মৃত ব্যক্তির ঠিক মুখের উপর কাপড়টি পরে সেভাবে বাশগুলো পুতে দিতে হবে। বাশগুলোকে বলা হয় ”তাঙোনো বাশ” আর ঝুলানো সাদা কাপড়টিকে বলা হয় ”চান্নুয়া কানি” । দাহ করার সময় কিছু লোক শ্বশানে থাকেন অর্থাৎ মৃত দেহটি সম্পুর্ন ভষ্মীভুত হওয়ার পরই তারা বাড়ীতে ফিরেন । রুভোকুরে সবাই আগুন দেওয়ার পর সকলের উদ্দেশ্য ৭ দিন পর মৃতের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া পালন উপলক্ষে সবাইকে নিমন্ত্রন জানানো হয়। দাহ ক্রিয়ায় অংশগ্রহনকারী সবাই অগ্নি দাহের পরে নদীতে গোসল করে বাড়ীতে চলে যান এবং তিতা জাতীয় রান্না মুখে দেন। মৃতের ঘরে আর এদিন চুলা জ্বলবেনা অর্থাৎ ঘরে রান্না বান্না করে খাওয়াদাওয়া চলবে না । পাড়ার লোকেরা তাদের সবা দাহ করার পরের দিন মৃতের পরিবারের লোক বা জ্ঞাতিবর্গ সকালে শ্বশানে গিয়ে একটি ছোট ঘর বানিয়ে দেন , ঘরের ভিতর কলসী ,দা, হাত পাখা, পানি কুত্তি, খাবার জিনিস , হাল্লোং , ভেরা সহ পারিবারিক বিভিন্ন সরঞ্জামাদি রেখে দেওয়া হয় , এর নাম ”চোবাশাল ঘর” এ ঘরের চারদিকে বিভিন্ন ফলের বীজ পুতে দেয়া হয়। মৃত ব্যক্তির ছেলে থাকলে বয়োজ্যেষ্টানুসারে সবাই মাথার চুল কামান বা ন্যারা করে চুল ফেলিয়ে দেন। এর পর তারা মৃত দেহের ভষ্ম বা অবশিষ্টাংশ কুড়িয়ে মাটির পাত্রে তোলেন এবং নদীতে ভাসিয়ে দেন। এদিন থেকে তারা ৭ দিন পর্যন্ত আধাবেলা আহার করে বা অষ্টশীলে থাকেন। দাহক্রিয়ার পর থেকে সাত দিন পরে যে অনুষ্টান করা হয় সেটিকে ”সাতদিন্ন্যা” বলা হয় । ধর্মীয় অনুশাসনের মোতাবেক এদিন ভিক্ষু সংঘ আমন্ত্রন করে উত্তম খাদ্য বস্তু দান করে এলাকার লোকজনকেও খাওয়ানো হয়।
ধর্মীয় উৎসব ঃ
কঠিন চীবর দান ঃ
চাকমা জাতি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হওয়ায় এদের অধিকাংশ ধর্মীয় উৎসব পূর্ণিমা কেন্দ্রিক । ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে কঠিন চীবরদান বৌদ্ধদের অন্যতম শ্রেষ্ট ধর্মীয়, সামাজিকও সাংস্কৃতিক উৎসব। ভিক্ষু সংঘের তিনমাস বর্ষাব্রত সমাপ্তির পর থেকে অর্থাৎ আশ্বিনী পূর্ণিমা থেকে কার্তিক পূর্ণিমা পর্যন্ত একমাস এ মহৎ দানানুষ্টান করা যায় ।
বৈশাখী পূর্ণিমা ঃ সিদ্বার্থ গৌতমের এই তিতিতে জন্ম লাভ, বুদ্ধত্ব বা বোধিজ্ঞান লাভ এবং মহাপরিণির্বŸান এ তিনটি গুরুত্বপূর্ন ঘটনা সংঘটিত হয়েছে বলে এ পূর্ণিমাকে বুদ্ধ পূর্ণিমা ও বলা হয় । সেজন্য এ দিনটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে উদযাপন করেন বৌদ্ধ জাতিরা ।
চৈত্র সংক্রান্তি বা বিঝু ঃ
বিঝু চাকমাদের অন্যতম সামাজিক , সাংস্কৃতিক উৎসব। চৈত্র মাসের শেষ দুই দিন এবং বাংলা নববর্ষের একদিন মোট তিন দিন বিঝু উৎসব উদযাপন করা হয় । সারা বছর বাড়ির লোকজন যে যেখানে থাকুক না কেন এ সময় অবশ্যই বাড়ীতে ফিরে এসে পরিবারের সকলের সাথে একত্রিত হয়ে যান। চৈত্র সংক্রান্তি সম্পর্কে প্রতি বছর অনেকে বিভিন্ন প্রকাশনা প্রকাশ করেন ।
মাথা ধোয়া ঃ মাথা ধোয়া একটি সামাজিক রীতি । আগেকার দিনে অধিকাংশ মানুষ কোন অমঙ্গল, অশুভ, আপদ- বিপদ থেকে রক্ষা পাবার জন্য এ অনুষ্টানটি করেন । গ্রামের ঔঝা বা বৈদ্য শ্রেনীর লোকেরা (এক ধরনের পুরোহিত ) এ রকম কার্যে পৌরহিত্য করেন ।
থানমানা পূজা ঃ বছরে একবার এ পূজা করা যায় । গ্রামের লোকজন সবাই মিলে একটি অংকের বাজেট তৈরী করে সামর্থ্য অনুযায়ী প্রদান করেন । এতে গ্রামের কাছাকাছি নদীতে কাচা বাশের বিভিন্ন ধরনের কারুকার্য বিশেষ করে ধান গাছ বানিয়ে নদীরকুলে টাঙিয়ে দেয়া হয়। এবং শুকর ও মুরগী বলি দেয়া হয় । এটা করা হয় গঙ্গা মায়ের উদ্দেশ্যে বৃষ্টি হওয়ার জন্য । বৃষ্টি হয়ে ক্ষেতের ফসল যাতে ভালো ফলন হয় ।
লেখক: দীপংকর চাকমা
লেখক: দীপংকর চাকমা
No comments
Post a Comment