বুদ্ধ কালীন রাজগৃহ
বুদ্ধ কালীন রাজগৃহ
মূল লেখক- শ্রী অনন্ত কুমার
(হিন্দী থেকে বঙ্গানুবাদ ড. অমর কান্তি চাকমা)
(হিন্দী থেকে বঙ্গানুবাদ ড. অমর কান্তি চাকমা)
বুদ্ধের সময়ে রাজগৃহের পরিচয় : মহামানব
গৌতম বুদ্ধের সময় ভারতবর্ষ ষোড়শ মহাজনপদে বিভক্ত ছিল। এর মধ্যে মগধ,
বজ্জীসংঘ (বৈশালী গণরাজ্য), কোশল, অবন্তি ইত্যাদি জনপদগুলো শক্তিশালী জনপদ
হিসেবে পরিগনিত হতো। মগধের রাজধানী ছিল রাজগৃহ, বর্তমানে ইহা রাজগীর নামে
পরিচিত। পালি সাহিত্যে মগধের কয়েকজন প্রভাবশালী সম্রাটের নাম পাওয়া যায়।
এঁদের মধ্যে ধর্মপরায়ন বিম্বিসার এবং তাঁর তনয় অজাতশত্রু বুদ্ধের সময় মগধের
প্রতাপশালী রাজা ছিলেন। তাঁরা উভয়ে পূর্ব পুরুষদের রাজধানী রাজগৃহ থেকে
তাঁদের পুরাতন নিয়ম-নীতি অনুসারে রাজ্য পরিচালনা করতেন। ঐ সময় মগধ
সা¤্রাজ্যের অধীনে আশি (৮০) হাজার সমৃদ্ধশালী গ্রাম ছিল। মগধের সমস্ত শাসন
কার্য পরিচালনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল রাজগৃহে অর্থাৎ রাজগীরে। সম্রাট
অজাতশত্রুর শাসন কালে মগধ সাম্রাজ্য প্রভুত বিস্তার লাভ করে। তিনি
কোশলরাজ্যের একাংশ কাশী তাঁর বিশাল সাম্রাজ্যের সাথে সংযুক্ত করেন এবং
বজ্জীসংঘকে সমূলে ধ্বংস করে মগধের বিজয় নিশান গঙ্গার অপর পার পর্যন্ত
উড়িয়েছেন।
তখনকার মগধ সাম্রাজ্যের সীমানা পূর্বে চম্পা নদী, পশ্চিমে সোন নদী, উত্তরে গঙ্গা নদীর অপর পার এবং দক্ষিণে বিন্ধ্য পর্বত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এভাবে আমরা জানতে পারি যে, বুদ্ধের সময় মগধ সাম্রাজ্য প্রচ- শক্তিশালী ও সমৃদ্ধশালী ছিল, যার শাসন কার্য পরিচালনা করার গৌরব অর্জন করেছিল পবিত্র ভূমি রাজগীর।
পালি সাহিত্যের বিভিন্ন স্থানে রাজগীরের বর্ণনা পাওয়া যায়। কুটদন্ডসূত্রের বর্ণনানুসারে তৎকালীন পুণ্যভূমি রাজগীর খুবই উর্বর ছিল বিধায় এখানে প্রচুর পরিমানে শষ্য উৎপন্ন হতো এবং দেখতে এই নগরী অনিন্দ্য সুন্দর ছিল। রাজগীরের সমতল ভূমি ছাড়াও ঐতিহাসিক পর্বত, গুহা, ঝর্ণা, বন ও নদ-নদীর বর্ণনা পালি সাহিত্যের ছত্রে ছত্রে উল্লেখ পাওয়া যায়।
বুদ্ধের সময়ে ব্যবসা-বানিজ্যের ক্ষেত্রেও রাজগীর অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ নগরী ছিল। রাজগীর তখনকার প্রসিদ্ধ বানিজ্যিক নগরীর প্রধান প্রধান সড়কগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। এ সড়ক দিয়ে চম্পা, সাকেত, কৌশাম্বী, শ্রাবস্তী এবং কাশী ইত্যাদি বানিজ্যিক নগরী থেকে ব্যবসায়ীরা জিনিসপত্র নিয়ে এসে রাজগীরের সাথে ব্যবসা-বানিজ্য করতেন। রাজগীরের ব্যবসায়ীরাও উপরোক্ত স্থান সমূহের সাথে স্থলপথে ব্যবসা-বানিজ্য করতেন। এছাড়া জলপথেও ব্যবসা-বানিজ্য চলতো। বিভিন্ন জনপদের ব্যবসায়ীরা গঙ্গা নদীর নৌপথে জিনিজ পত্র নিয়ে আসতেন। ঐ সমস্ত মালামাল ক্রয়ের জন্য মগধ ও বজ্জীসংঘের (বৃজিদের) মধ্যে রীতিমত প্রতিযোগিতা চলতো। বজ্জীসংঘের রাজধানী বৈশালী গঙ্গা নদী বন্দরের নিকটবর্তী হওয়ার সুবাধে বৈশালীর ব্যবসায়ীরা রাজগীরের ব্যবসায়ীরা পৌঁছার আগেই নিজেদের পছন্দমত জিনিসপত্র বেছে বেছে কিনে নিয়ে যেত। পরে এসে রাজগৃহের ব্যবসায়ীরা অবশিষ্ট মালপত্র ক্রয় করলে তারা তেমন লাভবান হতো না। প্রায় সময় তাদের লোকসান হতো। এতে করে বৈশালী ও রাজগৃহ ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। মগধ ও বজ্জীসংঘের মধ্যে যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল তার কয়েকটি কারণের মধ্যে এটিও ছিল অন্যতম কারণ। এ যুদ্ধে মগধ জয়ী হয়। অধুনা পাটলিপুত্র ঐ সময় বিরান পাটলিগ্রাম ছিল।বজ্জীদের আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য সেই সময় মগধের সম্রাট অজাতশত্রু পাটলিগ্রামে এক দুর্গ নির্মাণ করেন। এই দুর্গ নির্মাণের পর এলাকাটি আবাদ হয় এবং এই পাটলিগ্রাম থেকে পাটলিপুত্রের উৎপত্তি। পাটলিপুত্র থেকে পাটনা নাম ধারণ করে বর্তমানে ইহা বিহার প্রদেশের রাজধানী। যে কোন সমৃদ্ধশালী রাজ্যের প্রাণকেন্দ্র রাজধানীকে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য একটি সুদৃঢ় দুর্গ অপরিহার্য। প্রকৃতির দানে রাজগৃহকে যেন এক অপ্রতিরোধ্য মনোরম দুর্গে পরিণত করেছে। রাজগৃহ এমন একটি জায়গায় অবস্থিত যার চতুর্দিকে পাহাড়ের প্রাচীরে ঘেরা, এখানে পাহাড় অতিক্রম না করে প্রবেশ করা যায় না। একারণে বাহিরের কোন শত্রু রাজগৃহকে আক্রমণ করা দুঃসাধ্য ছিল। তৎকালীন ভারতবর্ষে ষোড়শ মহাজনপদের যতগুলো রাজধানী ছিল, তার মধ্যে রাজগৃহ এমন একটি উপযুক্ত ও মনোমুগ্ধকর স্থান, যা এই নগরের সমস্ত কিছু প্রকৃতিগত ভাবে প্রাপ্ত। কিন্তু তা সত্ত্বেও তখনকার মগধ সা¤্রাজ্যের সম্রাটগণ শুধু প্রকৃতি দানের উপরই নির্ভর করেননি, পাহাড়ের অভ্যন্তরে এ রাজধানীকে তাঁরা নিজেদের পছন্দ মত করে অপূর্ব সৌর্ন্দয্যে সাজিয়েছেন, এর প্রবেশ দ্বারে ছিল বিশাল বিশাল কয়েকটি লৌহার ফটক। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে প্রবেশ দ্বার সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেওয়া হতো, যাতে করে রাত্রির অন্ধকারে চুপিসারে কেউ যেন ঢুকতে না পারে, ফটক বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর অনুমতি ব্যতিত কাউকে রাজধানীতে প্রবেশ করতে দেওয়া হতো না। একদিন কোশল রাজ প্রসেনজিৎ যখন স্বীয় পুত্র বিঢ়–ড়ব কর্তৃক প্রতারণার স্বীকার হয়ে ক্ষমতা চ্যুত হন, তখন তিনি নিরুপায় হয়ে সহযোগিতার প্রত্যাশায় রাজগৃহে চলে আসেন। ক্ষুধা-তৃষ্ণার্থ ও ক্লান্ত শরীর নিয়ে রাজা প্রসেনজিৎ যখন রাত্রিতে রাজগৃহে পৌঁছেন, ততক্ষণেই প্রবেশ দ্বারের প্রধান ফটক বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। যার কারণে বৃদ্ধ রাজা প্রসেনজিৎ সারারাত বাইরে অবস্থান করাতে ভোর না হতেই তাঁর জীবন প্রদীপ নিভে যায়। সকালে রাজা অজাতশত্রু প্রকৃত বিষয় জ্ঞাত হলে তিনি খুবই অনুতপ্ত হন। রাজগৃহে ক্ষমতা চ্যুত রাজা প্রসেনজিতের অন্তিম সৎকার করা হয়।
প্রাগৈতিহাসিক যুগ হতেই বিভিন্ন নামে রাজগীরকে পালি সাহিত্য ও অন্যান্য ধর্মগ্রন্থে বর্ণনা করা হয়েছে। প্রসিদ্ধ চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ তাঁর ভ্রমন কাহিনীতে রাজগীরকে কুশাগ্রপুরী নামে অভিহিত করেন। কোন কোন প-িত ইহাকে গিরিব্রজ নামেও বর্ণনা করেছেন। এদের মধ্যে রাজগীর, রাজগৃহ নামে সর্বাধিক পরিচিত ছিল। কারণ, কয়েক শতাব্দীকাল পর্যন্ত মগধ সা¤্রাজ্যের রাজধানী ছিল এ নামেই। ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকেও রাজগীর অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। তখন রাজত্ব করতেন ধর্মপ্রাণ রাজা বিম্বিসার এবং তাঁর পুত্র অজাতশত্রু। রাজগীরের পর্বতমালা ও এর গুহাসমূহে জড়বাদী চার্বাক থেকে শুরু করে উপনিষদিক অধিবিদ্যক (গবঃধঢ়যুংরপং ) দার্শনিক ও অনেক আধ্যাত্মিক সাধন ভজনকারী সাধু মহাত্মাদের সাধন ক্ষেত্ররুপে পরিণত হয়েছিল। এদের মধ্যে বিভিন্ন ধর্মের ছয়জন আচার্য বিশেষভাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। এ ধর্মাচার্যগণের অনেক শিষ্যম-লী ছিল।
তাঁরা স্ব স্ব মতবাদ স্বাধীনভাবে প্রচার করতেন। তখনকার সম্রাটগণ প্রত্যেক ধর্মাবলম্বীদেরকে সমদৃষ্টিতে মূল্যায়ন করতেন। এ ধর্মাচার্যদের মতবাদ সম্পর্কে পালি ত্রিপিটক গ্রন্থে সুত্তপিটকের অন্তর্গত দীর্ঘনিকায়ে শ্রামণ্যফল সূত্রে বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে। ভগবান বুদ্ধের দুইজন অগ্রশ্রাবক সারিপুত্র ও মৌদ্গল্যায়ন পুণ্যভূমি রাজগীরে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হন। রাজগীর ভগবান বুদ্ধের কাছে অত্যন্ত প্রিয় ছিল। সম্বোধি লাভের পূর্বে তিনি রাজগৃহে এসে এখানকার সৌন্দর্য ও নাগরিকদের আচার ব্যবহারে অভিভূত হয়েছিলেন। তরুণ সন্ন্যাসী সিদ্ধার্থের রাজগীরে আগমণ বার্তা শ্রবণ করে স্বয়ং মগধের সম্রাট বিম্বিসার তাঁকে স্বাগত জানাতে দেখে তিনি বিমুগ্ধ হন। রাজা বিম্বিসার জেনে অতীব বিস্মিত হন যে, তরুণ সন্ন্যাসী সিদ্ধার্থ গৌতম ক্ষত্রিয় বংশোদ্ভূত রাজকুমার। মহারাজ বিম্বিসার তাঁর রাজ্যের অর্ধেক সিদ্ধার্থকে অর্পন করতে চাইলে সিদ্ধার্থ তা গ্রহণ করতে অস্বীকৃত হন। তাতে মহারাজ বিম্বিসার এক শর্তে ক্ষান্ত হয়েছিলেন, সিদ্ধার্থ বুদ্ধত্ব লাভ করার পর নিশ্চয়ই রাজগীরে প্রথম পদার্পন করবেন। এতে সিদ্ধার্থ সম্মত হয়েছিলেন। ললিত বিস্তর গ্রন্থে উল্লেখ আছে-“যখন আপনি সম্বোধি জ্ঞান প্রাপ্ত হবেন আমাদেরকে এর অংশীদার করবেন। এ বলে মহারাজ বিম্বিসার ভাবী বুদ্ধকে বন্দনান্তে প্রদক্ষিণ করে চলে গিয়েছিলেন।” মহারাজ বিম্বিসারের অনুরোধে বুদ্ধত্ব লাভের পর বুদ্ধ রাজগীরে এসেছিলেন এবং তাঁর নব আবিষ্কৃত ধর্মোপদেশ প্রদান করে রাজগৃহবাসীকে ধন্য করেছিলেন। তখনকার ষোড়শ মহাজনপদের রাজণ্যবর্গের মধ্যে মহারাজ বিম্বিসার-ই সর্ব প্রথম বুদ্ধের ধর্মে দীক্ষিত হন। এছাড়াও বুদ্ধ তাঁর ধর্মাভিযানে বহুবার রাজগৃহে এসেছেন। বৌদ্ধ সাহিত্য পাঠে জানা যায়, বুদ্ধ রাজগৃহে বহু সূত্র দেশনা করেছিলেন। অধিকন্তু মগধ সা¤্রাজ্যকে বুদ্ধ অন্যান্য রাজ্যগুলোর চেয়ে আলাদা দৃষ্টি ভঙ্গিতে দেখতেন। রাজগৃহ মগধের প্রাণকেন্দ্র হওয়ায় বুদ্ধের ধর্ম প্রচার ও প্রসারে এ নগরীর অবদান ছিল অপরিসীম। তাই স্বাভাবিকভাবে রাজগৃহের প্রতি বুদ্ধের আলাদা আকর্ষণ থাকবে বৈকি? পালি সাহিত্যের বর্ণনানুসারে রাজগৃহে কয়েকটি জায়গা বুদ্ধের অত্যধিক প্রিয় ছিল যার মধ্যে গিরিধ্রকুট অথবা গৃধ্রকুট পর্বত ছিল অন্যতম। বুদ্ধ যখন রাজগৃহে আসতেন তিনি অবশ্যই গৃধ্রকুট পবর্তে যেতেন। অজাতশত্রু যখন তার পিতা বিম্বিসারকে কারাবন্ধী করে রাখেন তখন বুদ্ধ সশিষ্য নিয়ে গৃধ্রকুট পর্বতে অবস্থান করছিলেন। কারাবন্ধী সম্রাট বিম্বিসার কারাগারের জালানা দিয়ে পরম আরাধ্য ভগবান বুদ্ধকে দর্শন করে সন্তুষ্টি লাভ করতেন। গৃধ্রকুট পর্বত ছাড়াও গৌতম ন্যগ্রোধ, চৌরপ্রপাত, সত্তপন্নী(সপ্তপর্নী) গুহা, কালশিলা, সত্তসৌন্দিক, কলন্দ নিবাপ তথা জীবকের আম্রকানন বুদ্ধের কাছে খুবই প্রিয় ছিল। রাজগৃহে জীবকের আম্রকাননে ভগবান বুদ্ধ সম্রাট অজাতশত্রুকে উপলক্ষ করে শ্রামণ্যফল(সামাঞ্ঞফল) সূত্র দেশনা করেন।
ঔষধি ক্ষেত্র হিসেবেও সে সময় রাজগৃহ প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। তখনকার সময় রাজগৃহের বনে জঙ্গলে ঔষধ হিসেবে ব্যবহার হতো এক ধরণের অনেক গাছ-গাছলি পাওয়া যেত। প্রসিদ্ধ রাজ-বৈধ্য জীবক ঐ সময় অভিজ্ঞ চিকিৎসক ছিলেন, যাঁকে আয়ুর্বৈদিক শাস্ত্রের জনক বলা সারা ভারতবর্ষে তখন তাঁর সমকক্ষ চিকিৎসক দ্বিতীয় আর কেউ ছিলেন না। উজ্জয়নীর শাসক চন্দ্র প্রদৌত যখন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন তখন সম্রাট বিম্বিসারের নির্দেশে জীবক উজ্জয়নীতে গিয়ে রাজা চন্দ্র প্রদ্যুতকে জীবন দান করেন।
প্রথম বৌদ্ধ মহাসঙ্গীতি রাজগৃহে অনুষ্ঠিত হওয়ার কারণে অন্যান্য স্থানের তুলনায় ঐতিহাসিকভাবেও এ নগরীর আলাদা গুরুত্ব বহন করে। মগধের সম্রাট অজাতশত্রুর ঐকান্তিক পৃষ্ঠপোষকতায় এ মহাসঙ্গীতি সম্পন্ন হয়। রাজগৃহের সপ্তপর্ণী গুহায় মহাকাশ্যপ থেরোর সভাপতিত্বে পাঁচ শত অর্হৎ ভিক্ষুর উপস্থিতিতে প্রথম বৌদ্ধমহাসঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এ সঙ্গীতিতে অর্হৎ ভিক্ষুগণ বৌদ্ধধর্মের মূল বিষয়বস্তু “সুত্ত” ও “বিনয়”কে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়ার জন্য একত্রিত হয়েছিলেন। অতএব আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে, একদিকে বৌদ্ধধর্মকে প্রচার-প্রসার এবং অন্যদিকে সঙ্গায়নের মাধ্যমে এ ধর্মকে চিরস্থিতি করার ক্ষেত্রে রাজগৃহের অবদান ছিল অপরিসীম। রাজগৃহের অতীত বিত্ত বৈভব ঃ বুদ্ধের সময়ে রাজগৃহকে ভারতবর্ষের সবচেয়ে অর্থ-বিত্ত, ধন-সম্পদ, প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য্যে ভরপুর ও সমৃদ্ধশালী নগর রূপে গণ্য করা হতো। প্রাচীনতম রাজগৃহের বর্ণনা রামায়ণ, মহাভারত তথা অন্যান্য প্রাচীন ধর্মগ্রন্থেও উল্লেখ পাওয়া যায়। ঐ সমস্ত ধর্মগ্রন্থ পাঠ করলে জানা যায় যে, রাজগৃহের প্রাকৃতিক নৈসর্গিক সৌন্দর্য্য, অঢেল ঐশ্বর্য ও মনোমুগ্ধকর পরিবেশ হওয়ার কারণে বহু শতাব্দীকাল পর্যন্ত ভারতবর্ষের রাজা, মহারাজাদের এ নগরীর প্রতি একটা লোভনীয় দৃষ্টি ছিল। রামায়ণে উল্লেখ আছে, ব্রহ্মার পুত্র বসুর নামানুারে এ নগরের নাম রাখা হয় “বসুমতি”। মহাভারতের বর্ণনানুসারে রাজা বৃহদ্রথ সর্ব প্রথম এখানে রাজধানী স্থাপন করেন। রাজা বৃহদ্রথের বংশধরেরা কয়েক শতাব্দীকাল রাজত্বের পর কুশাগ্র নামে এক রাজা হন। তাঁর শাসন কালেই তিনি এ নগরের নতুন নাম রাখেন কুশাগ্রপুরী। মতান্তরে রাজগৃহ কেন কুশাগ্রপুরী নাম হলো ? এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে-“রাজগৃহে ঐ সময় কুশ নামক এক প্রকার ঘাস প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হতো। এ ঘাস দূর থেকে দেখতে খুবই দৃষ্টি নন্দন ও আকর্ষণীয় ছিল। অতএব, এখানে কুশ নামক ঘাস প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হওয়ার কারণে এ স্থানের নাম কুশাগ্রপুরী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।” কারণ যাই হোক না কেন, আমরা এতটুকু বলতে পারি যে, কালের বিবর্তনে ক্ষমতা পালাবদলের সাথে সাথেই এ নগরীর নাম এক এক সময় এক এক নাম ধারণ করে। মহাভারত গ্রন্থে মগধের সম্রাট জরাসন্ধের নাম পাওয়া যায়। জরাসন্ধের রাজধানীও ছিল রাজগৃহে। তাঁর শাসনামলে রাজগৃহ এত নিñিদ্র কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল কোন অপরিচিত লোককে অনুমতি ব্যতীত ঢুকতে-ই দেওয়া হতো না। এভাবে আমরা দেখতে পায় রাজগৃহ শুধু ভগবান বুদ্ধের সময় প্রসিদ্ধ ছিলনা বরং এর অতীত ইতিহাস আরো অত্যুজ্জ্বল। শ্রী এম.এস পান্ডে তাঁর “দি হিস্ট্রিক্যল জিওগ্রাফী এন্ড টোপোগ্রাফী অফ বিহার” গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, “পঞ্চ পর্বত চতুর্দিকে প্রাচীরের মত নগরীকে ঘিরে রয়েছে। এ কারণে গিরিব্রজ নামেই এ নগরী পরিচিতি লাভ করে। সম্ভবতঃ গিরিব্রজই এ নগরীর সবচেয়ে প্রাচীনতম নাম ছিল। অধুনা রাজগীর-এর নাম কেন রাজগৃহ হলো? তার পেছনে একটা কারণ আছে। রাজ+গৃহ শব্দদ্বয়ের অর্থ করলে দাঁড়ায়- ‘রাজার গৃহ’, ‘রাজার ঘর’ অথবা ‘রাজার আবাস স্থল’। এখানে বহু শতাব্দীকাল পর্যন্ত অনেক প্রভাবশালী রাজা, মহারাজা তথা সম্রাটগণের রাজধানী ছিল। যুগ যুগ ধরে অনেক নরপতি তথা রাজন্যবর্গ এখানে অবস্থান করেছিলেন। অতএব, ঐ সমস্ত প্রভাব প্রতিপত্তিশালী রাজা তথা সম্রাটগণের আবাস স্থান হওয়ার কারণে এ নগরীকে রাজগৃহ বলা হতো। ”ভগবান বুদ্ধের সময়েও রাজগৃহ অথবা রাজগীরকে ভিন্ন ভিন্ন নামে বিভিন্ন গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। তখনকার রাজগৃহের রাজা ছিলেন বিম্বিসার। তিনি তাঁর শাসনামলে পঞ্চ পাহাড়ের ঘেরা অভ্যন্তরীণ নগরী ছাড়াও এর বাইরে একটা নতুন নগর নির্মাণ করেন। রাজা বিম্বিসার দ্বারা এ নগরী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে ইহা বিম্বিসারপুরী নামে পরিচিতি লাভ করে। জৈনধর্ম গ্রন্থের মতে, রাজা বিম্বিসার যে স্থানে নতুন নগরী প্রতিষ্ঠা করেন সেখানে প্রথম অবস্থায় প্রচুর পরিমাণে চনা অথবা বুট উৎপন্ন হতো। অতএব এখানে যে নতুন নগরীটি প্রতিষ্ঠিত হয় তা চনকপুরী নামে পরিচিতি লাভ করে।
ভগবান বুদ্ধের সময় রাজগৃহ ধনধান্যে পরিপূর্ণ ছিল। তৎকালীন ভারতবর্ষে চম্পা,কাশী, কৌশাম্বী, সাকেত ও শ্রাবস্তী নগরীকে প্রসিদ্ধ নগরী হিসেবে গণ্য করা হতো। এ সমস্ত নগরীর সাথে রাজগৃহের ব্যবসা বানিজ্যের ক্ষেত্রে ঘনিষ্ট ও নিবির সম্পর্ক ছিল। মূলতঃ জল ও স্থল পথে উপরোক্ত প্রসিদ্ধ নগরীর সাথে রাজগৃহের ব্যবসা বানিজ্য চলতো। তখন গঙ্গা নদীর অর্ধেক মগধ সা¤্রাজ্যের অধীনে এবং অর্ধেক বজ্জীসংঘের অধীনে ছিল। মগধ ও বজ্জীসংঘ দুই রাজ্যের রাজধানী বৈশালী ও রাজগৃহ উভয় নগরীর ব্যবসায়ীদের মধ্যে গঙ্গা নদী বন্দর নিয়ে ব্যবসা বানিজ্য প্রতিযোগিতার জন্য যে বিরোধ দেখা দিয়েছিল তা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। সম্ভবতঃ এ বিরোধের জের ধরে মগধের স¤্রাট অজাতশত্রু বৈশালীতে আক্রমণ করে তাদের সমূলে বিনাশ করেন। তার ফলস্বরূপ রাজগৃহের ব্যবসায়ীরা অধিকতর লাভবান হন।
বুদ্ধের সময় রাজগৃহে বিপুল পরিমাণে প্রসিদ্ধ নগর শ্রেষ্ঠী অথবা সেট্ঠী (ধনকুবের) ছিলেন। তাঁদের অঢেল ধন সম্পত্তির কারণে গোটা দেশ খ্যাতি লাভ করেছিল। সেই সময় কোন একটা রাজ্যকে অর্থনৈতিকভাবে কত সমৃদ্ধ ও ঐশ্বর্যশালী তার পরিমাপ নির্ধারণ করা হয় শ্রেষ্ঠীদের সংখ্যার উপর। তখনকার সময়ে মগধের রাজধানী রাজগৃহে যে পরিমাণ নগর শ্রেষ্ঠী ছিল, সম্ভবতঃ অন্য কোন রাজ্য বা জনপদে এত নগর শ্রেষ্ঠী ছিল না। শ্রাবস্তীর প্রসিদ্ধ শ্রেষ্ঠী অনাথ পিন্ডিকের শ্বশুর বাড়ী ছিল রাজগৃহে। সেই সুবাদে তিনি যখন রাজগৃহে বেড়াতে আসতেন তাঁকে রাজকীয়ভাবে সম্মান প্রদান করা হতো। অনাথ পিন্ডিক শ্রেষ্ঠী প্রতি বছর স্বীয় রাজ্যের রাজ কোষাগারে বিপুল পরিমাণে অর্থ দান করে রাজ্য পরিচালনা করার জন্য সহায়তা করতেন তথা বুদ্ধ প্রমুখ ভিক্ষু সংঘকে অকাতরে দান দিয়ে বৌদ্ধ সাহিত্যের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। রাজগৃহে অবস্থানরত এক একজন শ্রেষ্ঠীদের ঘর বাড়ী প্রায় রাজ প্রাসাদের সমতুল্য ছিল।রাজগৃহ অর্থ-বিত্ত ও ধন সম্পত্তির দিক দিয়ে যেমন সমৃদ্ধশালী তেমনি প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যও এখানে কম ছিল না। রাজগৃহকে যেন প্রকৃতির অবারিত বরদানে স্বয়ং সম্পূর্ণ নগরী হিসেবে গড়ে তুলেছে। এখানকার পর্বতমালা, গিরিগুহা, সবুজে ভরপুর বনজঙ্গল, কল কল শব্দে প্রবাহমান বনগঙ্গা নদী, গরম পানির ঝর্ণা (উঞ্চ প্র¯্রবন) ইত্যাদি প্রাকৃতিক সম্পদে রাজগৃহকে যেন পূর্ণাঙ্গরূপ দিয়েছে। রাজগৃহে প্রকৃতির প্রদত্ত যে সম্পদ রয়েছে তা কারোর দ্বারা ছিনতাই অথবা নষ্ট করা সম্ভব নয়। বস্তুত রাজগৃহকে সাংসারিক ধনদৌলতের চেয়েও প্রাকৃতিক সম্পদের জন্য এ স্থানের গুরুত্ব অধিকতর বৃদ্ধি করেছে। রাজগৃহ সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ নগরী ছিল।
তখনকার সময়ে ষোড়শ জনপদের মধ্যে রাজগৃহ এমন একটি জায়গা ছিল, যেখানে বিভিন্ন ধর্মের আচার্যরা স্থায়ীরূপে বসবাস করতেন এবং তাঁরা তাঁদের ধর্ম বাণী রাজগৃহের আনাচে কানাচে প্রচার করে আপামর জন সাধারণের কাছে নতুন নতুন প্রেরণা ও জ্ঞানের সঞ্চার বৃদ্ধি করতেন। ভগবান বুদ্ধ এবং ভগবান মহাবীর তাঁরা উভয়ে রাজগৃহে অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করেছিলেন। যে সমস্ত ধর্মাচার্যরা রাজগৃহে স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন তাঁদের মধ্যে পূরণ কস্সপ (পূর্ণ কাশ্যপ), মক্খলি গোসাল (মস্করিন গোশাল), অজিত কেসকম্বলী (অজিত কেশকম্বলিন), পকুধ কাচ্চায়ন (ককুদ কাত্যায়ন), নিগণ্ঠনাথপুত্ত (নির্গ্রন্থ জ্ঞাতৃপুত্র) ও সঞ্জয় বেলট্ঠিপুত্ত (সঞ্জয় বেলষ্টিপুত্র) অন্যতম। রাজগৃহের এ সমস্ত ধর্মাচার্যদেরকে ষোড়শ জনপদের সাধারণ মানুষ অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতেন এমনি অনেক রাজা তাদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র হিসেবেও রাজগৃহ এক গৌরবজনক স্থান দখল করে আছে। নৃত্য, সংগীত তথা নাটকের অভিনেতা, অভিনেত্রী এবং শিল্পী ছাড়াও বিভিন্ন পেশা জীবির লোক এখানে বসবাস করতেন। এভাবে আমরা জানতে পারি যে, বুদ্ধের সময়ের রাজগৃহ অতীতের গৌরবজনক অগাধ ধন-সম্পদ এবং এর অফুরন্ত প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য তথা বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে অদ্বিতীয় নগরী ছিল।
রাজগৃহের দুই নগরী : প্রখ্যাত চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ ও ফাহিয়েনের ভ্রমণ বিবরণীতে উল্লেখ আছে যে, বুদ্ধের সময় রাজগৃহে দু’টি নগরী ছিল। একটি নগরী পঞ্চপর্বতের ঘেরার ভেতরে ছিল। ইহাকে অন্তঃনগরী (ইন্টার সিটি) বলা হয়। পঞ্চপর্বতের বেষ্টনীর বাহিরে যে নগরীটি ছিল ইহাকে বহিঃনগরী (আউটার সিটি) বলা হয়।
রাজগৃহের বহিঃনগরীর অপেক্ষা অন্তঃনগরী অধিকতর পুরাতন ছিল এবং ইহা ভগবান বুদ্ধ আভির্ভাবের বহু আগেই স্থাপিত হয়েছিল। সম্ভবতঃ এ প্রাচীন নগরীতে রাজা বসু, রাজা বৃহদ্রথ, রাজা কুশাগ্র তথা স¤্রাট জরাসন্ধের নিবাসস্থান ছিল বলে অনুমান করা হয়। মগধপুরী, বৃহদ্রথপুরী, গিরিব্রজ, কুশাগ্রপুরী অথবা রাজগৃহ ইত্যাদি নামে বিভিন্ন সময় এ প্রাচীন নগরীকে আখ্যায়িত করা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। এর কারণ হলো, রাজগৃহ অতীব প্রাচীন নগরী বুদ্ধের কয়েক শতাব্দী আগেই এ নগরী নির্মাণ করা হয়। এ স্থানের যে বিভিন্ন নামের উল্লেখ পাওয়া যায়, তা বুদ্ধের অনেক আগ থেকেই প্রচলিত ছিল।
উপরে উল্লেখিত পুরাণো নামগুলো রাজগৃহের ইতিহাসের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। অতএব এ সমস্ত অকাট্য যুক্তিসংগত কারণে ইহাকে কেন অতি প্রাচীনতম নগরী হিসেবে গণ্য করা হবে না ? যে স্থানে নতুন নগরী স্থাপন করা হয়, সেখানে প্রথম অবস্থায় প্রচুর পরিমাণে চনা উৎপন্ন হতো, এ কারণে নতুন নগরীটি চনকপুরী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ভগবান বুদ্ধের সময় রাজগৃহের রাজা ছিলেন বিম্বিসার ও তাঁর পুত্র অজাতশত্রু। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক শ্রী এম.এস পান্ডের লিখিত সবচেয়ে তথ্যবহুল ও নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ “দি হিস্ট্রিক্যল জিওগ্রাফী এন্ড টোপোগ্রাফী অফ বিহার”-এ উল্লেখ আছে যে, রাজগৃহের নতুন নগরীটি মহারাজ বিম্বিসার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু এখানে প্রশ্ন হচ্ছে রাজগৃহে একটা স্বয়ং সম্পূর্ণ নগরী থাকা সত্ত্বেও দ্বিতীয় নগরী প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজন হয়ে পড়লো কেন ? এর কারণ হিসেবে শ্রী পান্ডে উল্লেখ করেছেন- রাজগৃহের প্রাচীন নগরীর চতুর্দিকে পাহাড়ে ঘেরা ছিল। ধীরে ধীরে যখন জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় তখন চতুর্দিকে পাহাড়ের বেষ্টনীর কারণে পুরাণো নগরীকে সম্প্রসারণ করা সম্ভব ছিল না। তাই স্বাভাবিকভাবে যুগের প্রয়োজনে চাহিদা অনুসারে নতুন নগর পত্তন অনিবার্য হয়ে পড়ে। এ কারণে তখনকার রাজগৃহের রাজা বিম্বিসার পাহাড়ের ঘেরার বাইরে এক নতুন নগর নির্মাণ করেন। এ নতুন নগরী রাজা বিম্বিসার কর্তৃক নির্মিত হওয়ায় ইহা বিম্বিসারপুরী হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। কিন্তু কিছু কিছু ইতিহাসবিদ তথা পুরাতত্ত্ববিদ এর ভিন্ন মত পোষণ করেন, তাঁদের মতে রাজগৃহের নতুন নগরীটি বিম্বিসার নয় বরং তাঁর পুত্র অজাতশত্রু নির্মাণ করেন। রাজা বিম্বিসার ও অজাতশত্রু উভয়ে ভগবান বুদ্ধের সময় রাজগৃহের রাজা ছিলেন। এ দুই জনের মধ্যে যে কেউ নতুন নগরীটি নির্মাণ করুক নাকেন, আমরা নিঃসন্দেহে ধরে নিতে পারি বুদ্ধের সময় অথবা তার সমসাময়িককালেই রাজগৃহের নতুন নগরীটি নির্মাণ করা হয়। নতুন নগরীর প্রাচীরের ব্যাপ্তি প্রায় তিন (৩) মাইল বিস্তৃত ছিল। রাজগৃহের এ নগরীর চার দেওয়ালের ধ্বংসাবশেষ এখনও ইতিহাসের স্বাক্ষীরূপে বিদ্যমান।
চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ ও ফাহিয়েন তারা তাদের ভারতবর্ষ ভ্রমন কাহিনীতে বুদ্ধের সময় রাজগৃহে যে দুটি নগরীর বিবরণ দিয়েছেন তা নিয়ে পুরাতত্ত্ববিদদের মধ্যে যথেষ্ট মতানৈক্য রয়েছে। বিখ্যাত পুরাতত্ত্ববিদ জেনারেল কানিংহাম হিউয়েন সাঙ ও ফাহিয়েন এ দুই জনের ভ্রমণ বিবরণীর উপর চুলচেরা বিচার বিশ্লেষণ, গবেষণা ও অনেক অনুসন্ধানের পর তিনি এ সিদ্ধান্তে উপনিত হন যে, বাস্তবরূপে বুদ্ধের সময়ে রাজগৃহে দুটি নগরী ছিল। কানিংহামের মতকে সমর্থক করে কিছু কিছু প্রতœতাত্ত্বিক বলেছেন, “রাজগৃহের গরম পানির ঝর্ণার (উঞ্চ প্রসবণ) পার্শ্ববর্তী এলাকা যেখান থেকে দুই পর্বত শ্রেণির পাদদেশ আরম্ভ হয়েছে এখানেই পুরাতন নগরীর সীমানা অবস্থিত। ইহা মোটামুটি তিন পাহাড়ের ঘেরার মধ্যবর্তী স্থান ছিল এবং নগরীতে প্রবেশ দ্বার ছিল গরম পানির ঝর্ণার নিকটবর্তী। এই প্রবেশ দ্বারের চওড়া প্রায় অর্ধ মাইলের কাছাকাছি ছিল।” জনশ্রুতি আছে, প্রকৃতির দ্বারা সৃষ্ট প্রবেশ দ্বারের অর্ধ মাইল দূরত্বকে কোন এক মুণীঋষির ঋদ্ধির (অলৌকিক শক্তি) দ্বারা সম্ভবত এর দূরত্ব কমিয়ে আনেন, যাতে করে ইহা নগরের মুখ্য প্রবেশ দ্বার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। প্রাচীন নগরী প্রকৃতির দানে প্রাপ্ত যে সুরক্ষার ব্যবস্থা ছিল তা অপর এক মুণীঋষির ঋদ্ধির দ্বারা আরো অধিকতর সুদৃঢ় করেছে।
(চলবে)
তখনকার মগধ সাম্রাজ্যের সীমানা পূর্বে চম্পা নদী, পশ্চিমে সোন নদী, উত্তরে গঙ্গা নদীর অপর পার এবং দক্ষিণে বিন্ধ্য পর্বত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এভাবে আমরা জানতে পারি যে, বুদ্ধের সময় মগধ সাম্রাজ্য প্রচ- শক্তিশালী ও সমৃদ্ধশালী ছিল, যার শাসন কার্য পরিচালনা করার গৌরব অর্জন করেছিল পবিত্র ভূমি রাজগীর।
পালি সাহিত্যের বিভিন্ন স্থানে রাজগীরের বর্ণনা পাওয়া যায়। কুটদন্ডসূত্রের বর্ণনানুসারে তৎকালীন পুণ্যভূমি রাজগীর খুবই উর্বর ছিল বিধায় এখানে প্রচুর পরিমানে শষ্য উৎপন্ন হতো এবং দেখতে এই নগরী অনিন্দ্য সুন্দর ছিল। রাজগীরের সমতল ভূমি ছাড়াও ঐতিহাসিক পর্বত, গুহা, ঝর্ণা, বন ও নদ-নদীর বর্ণনা পালি সাহিত্যের ছত্রে ছত্রে উল্লেখ পাওয়া যায়।
বুদ্ধের সময়ে ব্যবসা-বানিজ্যের ক্ষেত্রেও রাজগীর অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ নগরী ছিল। রাজগীর তখনকার প্রসিদ্ধ বানিজ্যিক নগরীর প্রধান প্রধান সড়কগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। এ সড়ক দিয়ে চম্পা, সাকেত, কৌশাম্বী, শ্রাবস্তী এবং কাশী ইত্যাদি বানিজ্যিক নগরী থেকে ব্যবসায়ীরা জিনিসপত্র নিয়ে এসে রাজগীরের সাথে ব্যবসা-বানিজ্য করতেন। রাজগীরের ব্যবসায়ীরাও উপরোক্ত স্থান সমূহের সাথে স্থলপথে ব্যবসা-বানিজ্য করতেন। এছাড়া জলপথেও ব্যবসা-বানিজ্য চলতো। বিভিন্ন জনপদের ব্যবসায়ীরা গঙ্গা নদীর নৌপথে জিনিজ পত্র নিয়ে আসতেন। ঐ সমস্ত মালামাল ক্রয়ের জন্য মগধ ও বজ্জীসংঘের (বৃজিদের) মধ্যে রীতিমত প্রতিযোগিতা চলতো। বজ্জীসংঘের রাজধানী বৈশালী গঙ্গা নদী বন্দরের নিকটবর্তী হওয়ার সুবাধে বৈশালীর ব্যবসায়ীরা রাজগীরের ব্যবসায়ীরা পৌঁছার আগেই নিজেদের পছন্দমত জিনিসপত্র বেছে বেছে কিনে নিয়ে যেত। পরে এসে রাজগৃহের ব্যবসায়ীরা অবশিষ্ট মালপত্র ক্রয় করলে তারা তেমন লাভবান হতো না। প্রায় সময় তাদের লোকসান হতো। এতে করে বৈশালী ও রাজগৃহ ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। মগধ ও বজ্জীসংঘের মধ্যে যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল তার কয়েকটি কারণের মধ্যে এটিও ছিল অন্যতম কারণ। এ যুদ্ধে মগধ জয়ী হয়। অধুনা পাটলিপুত্র ঐ সময় বিরান পাটলিগ্রাম ছিল।বজ্জীদের আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য সেই সময় মগধের সম্রাট অজাতশত্রু পাটলিগ্রামে এক দুর্গ নির্মাণ করেন। এই দুর্গ নির্মাণের পর এলাকাটি আবাদ হয় এবং এই পাটলিগ্রাম থেকে পাটলিপুত্রের উৎপত্তি। পাটলিপুত্র থেকে পাটনা নাম ধারণ করে বর্তমানে ইহা বিহার প্রদেশের রাজধানী। যে কোন সমৃদ্ধশালী রাজ্যের প্রাণকেন্দ্র রাজধানীকে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য একটি সুদৃঢ় দুর্গ অপরিহার্য। প্রকৃতির দানে রাজগৃহকে যেন এক অপ্রতিরোধ্য মনোরম দুর্গে পরিণত করেছে। রাজগৃহ এমন একটি জায়গায় অবস্থিত যার চতুর্দিকে পাহাড়ের প্রাচীরে ঘেরা, এখানে পাহাড় অতিক্রম না করে প্রবেশ করা যায় না। একারণে বাহিরের কোন শত্রু রাজগৃহকে আক্রমণ করা দুঃসাধ্য ছিল। তৎকালীন ভারতবর্ষে ষোড়শ মহাজনপদের যতগুলো রাজধানী ছিল, তার মধ্যে রাজগৃহ এমন একটি উপযুক্ত ও মনোমুগ্ধকর স্থান, যা এই নগরের সমস্ত কিছু প্রকৃতিগত ভাবে প্রাপ্ত। কিন্তু তা সত্ত্বেও তখনকার মগধ সা¤্রাজ্যের সম্রাটগণ শুধু প্রকৃতি দানের উপরই নির্ভর করেননি, পাহাড়ের অভ্যন্তরে এ রাজধানীকে তাঁরা নিজেদের পছন্দ মত করে অপূর্ব সৌর্ন্দয্যে সাজিয়েছেন, এর প্রবেশ দ্বারে ছিল বিশাল বিশাল কয়েকটি লৌহার ফটক। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে প্রবেশ দ্বার সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেওয়া হতো, যাতে করে রাত্রির অন্ধকারে চুপিসারে কেউ যেন ঢুকতে না পারে, ফটক বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর অনুমতি ব্যতিত কাউকে রাজধানীতে প্রবেশ করতে দেওয়া হতো না। একদিন কোশল রাজ প্রসেনজিৎ যখন স্বীয় পুত্র বিঢ়–ড়ব কর্তৃক প্রতারণার স্বীকার হয়ে ক্ষমতা চ্যুত হন, তখন তিনি নিরুপায় হয়ে সহযোগিতার প্রত্যাশায় রাজগৃহে চলে আসেন। ক্ষুধা-তৃষ্ণার্থ ও ক্লান্ত শরীর নিয়ে রাজা প্রসেনজিৎ যখন রাত্রিতে রাজগৃহে পৌঁছেন, ততক্ষণেই প্রবেশ দ্বারের প্রধান ফটক বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। যার কারণে বৃদ্ধ রাজা প্রসেনজিৎ সারারাত বাইরে অবস্থান করাতে ভোর না হতেই তাঁর জীবন প্রদীপ নিভে যায়। সকালে রাজা অজাতশত্রু প্রকৃত বিষয় জ্ঞাত হলে তিনি খুবই অনুতপ্ত হন। রাজগৃহে ক্ষমতা চ্যুত রাজা প্রসেনজিতের অন্তিম সৎকার করা হয়।
প্রাগৈতিহাসিক যুগ হতেই বিভিন্ন নামে রাজগীরকে পালি সাহিত্য ও অন্যান্য ধর্মগ্রন্থে বর্ণনা করা হয়েছে। প্রসিদ্ধ চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ তাঁর ভ্রমন কাহিনীতে রাজগীরকে কুশাগ্রপুরী নামে অভিহিত করেন। কোন কোন প-িত ইহাকে গিরিব্রজ নামেও বর্ণনা করেছেন। এদের মধ্যে রাজগীর, রাজগৃহ নামে সর্বাধিক পরিচিত ছিল। কারণ, কয়েক শতাব্দীকাল পর্যন্ত মগধ সা¤্রাজ্যের রাজধানী ছিল এ নামেই। ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকেও রাজগীর অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। তখন রাজত্ব করতেন ধর্মপ্রাণ রাজা বিম্বিসার এবং তাঁর পুত্র অজাতশত্রু। রাজগীরের পর্বতমালা ও এর গুহাসমূহে জড়বাদী চার্বাক থেকে শুরু করে উপনিষদিক অধিবিদ্যক (গবঃধঢ়যুংরপং ) দার্শনিক ও অনেক আধ্যাত্মিক সাধন ভজনকারী সাধু মহাত্মাদের সাধন ক্ষেত্ররুপে পরিণত হয়েছিল। এদের মধ্যে বিভিন্ন ধর্মের ছয়জন আচার্য বিশেষভাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। এ ধর্মাচার্যগণের অনেক শিষ্যম-লী ছিল।
তাঁরা স্ব স্ব মতবাদ স্বাধীনভাবে প্রচার করতেন। তখনকার সম্রাটগণ প্রত্যেক ধর্মাবলম্বীদেরকে সমদৃষ্টিতে মূল্যায়ন করতেন। এ ধর্মাচার্যদের মতবাদ সম্পর্কে পালি ত্রিপিটক গ্রন্থে সুত্তপিটকের অন্তর্গত দীর্ঘনিকায়ে শ্রামণ্যফল সূত্রে বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে। ভগবান বুদ্ধের দুইজন অগ্রশ্রাবক সারিপুত্র ও মৌদ্গল্যায়ন পুণ্যভূমি রাজগীরে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হন। রাজগীর ভগবান বুদ্ধের কাছে অত্যন্ত প্রিয় ছিল। সম্বোধি লাভের পূর্বে তিনি রাজগৃহে এসে এখানকার সৌন্দর্য ও নাগরিকদের আচার ব্যবহারে অভিভূত হয়েছিলেন। তরুণ সন্ন্যাসী সিদ্ধার্থের রাজগীরে আগমণ বার্তা শ্রবণ করে স্বয়ং মগধের সম্রাট বিম্বিসার তাঁকে স্বাগত জানাতে দেখে তিনি বিমুগ্ধ হন। রাজা বিম্বিসার জেনে অতীব বিস্মিত হন যে, তরুণ সন্ন্যাসী সিদ্ধার্থ গৌতম ক্ষত্রিয় বংশোদ্ভূত রাজকুমার। মহারাজ বিম্বিসার তাঁর রাজ্যের অর্ধেক সিদ্ধার্থকে অর্পন করতে চাইলে সিদ্ধার্থ তা গ্রহণ করতে অস্বীকৃত হন। তাতে মহারাজ বিম্বিসার এক শর্তে ক্ষান্ত হয়েছিলেন, সিদ্ধার্থ বুদ্ধত্ব লাভ করার পর নিশ্চয়ই রাজগীরে প্রথম পদার্পন করবেন। এতে সিদ্ধার্থ সম্মত হয়েছিলেন। ললিত বিস্তর গ্রন্থে উল্লেখ আছে-“যখন আপনি সম্বোধি জ্ঞান প্রাপ্ত হবেন আমাদেরকে এর অংশীদার করবেন। এ বলে মহারাজ বিম্বিসার ভাবী বুদ্ধকে বন্দনান্তে প্রদক্ষিণ করে চলে গিয়েছিলেন।” মহারাজ বিম্বিসারের অনুরোধে বুদ্ধত্ব লাভের পর বুদ্ধ রাজগীরে এসেছিলেন এবং তাঁর নব আবিষ্কৃত ধর্মোপদেশ প্রদান করে রাজগৃহবাসীকে ধন্য করেছিলেন। তখনকার ষোড়শ মহাজনপদের রাজণ্যবর্গের মধ্যে মহারাজ বিম্বিসার-ই সর্ব প্রথম বুদ্ধের ধর্মে দীক্ষিত হন। এছাড়াও বুদ্ধ তাঁর ধর্মাভিযানে বহুবার রাজগৃহে এসেছেন। বৌদ্ধ সাহিত্য পাঠে জানা যায়, বুদ্ধ রাজগৃহে বহু সূত্র দেশনা করেছিলেন। অধিকন্তু মগধ সা¤্রাজ্যকে বুদ্ধ অন্যান্য রাজ্যগুলোর চেয়ে আলাদা দৃষ্টি ভঙ্গিতে দেখতেন। রাজগৃহ মগধের প্রাণকেন্দ্র হওয়ায় বুদ্ধের ধর্ম প্রচার ও প্রসারে এ নগরীর অবদান ছিল অপরিসীম। তাই স্বাভাবিকভাবে রাজগৃহের প্রতি বুদ্ধের আলাদা আকর্ষণ থাকবে বৈকি? পালি সাহিত্যের বর্ণনানুসারে রাজগৃহে কয়েকটি জায়গা বুদ্ধের অত্যধিক প্রিয় ছিল যার মধ্যে গিরিধ্রকুট অথবা গৃধ্রকুট পর্বত ছিল অন্যতম। বুদ্ধ যখন রাজগৃহে আসতেন তিনি অবশ্যই গৃধ্রকুট পবর্তে যেতেন। অজাতশত্রু যখন তার পিতা বিম্বিসারকে কারাবন্ধী করে রাখেন তখন বুদ্ধ সশিষ্য নিয়ে গৃধ্রকুট পর্বতে অবস্থান করছিলেন। কারাবন্ধী সম্রাট বিম্বিসার কারাগারের জালানা দিয়ে পরম আরাধ্য ভগবান বুদ্ধকে দর্শন করে সন্তুষ্টি লাভ করতেন। গৃধ্রকুট পর্বত ছাড়াও গৌতম ন্যগ্রোধ, চৌরপ্রপাত, সত্তপন্নী(সপ্তপর্নী) গুহা, কালশিলা, সত্তসৌন্দিক, কলন্দ নিবাপ তথা জীবকের আম্রকানন বুদ্ধের কাছে খুবই প্রিয় ছিল। রাজগৃহে জীবকের আম্রকাননে ভগবান বুদ্ধ সম্রাট অজাতশত্রুকে উপলক্ষ করে শ্রামণ্যফল(সামাঞ্ঞফল) সূত্র দেশনা করেন।
ঔষধি ক্ষেত্র হিসেবেও সে সময় রাজগৃহ প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। তখনকার সময় রাজগৃহের বনে জঙ্গলে ঔষধ হিসেবে ব্যবহার হতো এক ধরণের অনেক গাছ-গাছলি পাওয়া যেত। প্রসিদ্ধ রাজ-বৈধ্য জীবক ঐ সময় অভিজ্ঞ চিকিৎসক ছিলেন, যাঁকে আয়ুর্বৈদিক শাস্ত্রের জনক বলা সারা ভারতবর্ষে তখন তাঁর সমকক্ষ চিকিৎসক দ্বিতীয় আর কেউ ছিলেন না। উজ্জয়নীর শাসক চন্দ্র প্রদৌত যখন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন তখন সম্রাট বিম্বিসারের নির্দেশে জীবক উজ্জয়নীতে গিয়ে রাজা চন্দ্র প্রদ্যুতকে জীবন দান করেন।
প্রথম বৌদ্ধ মহাসঙ্গীতি রাজগৃহে অনুষ্ঠিত হওয়ার কারণে অন্যান্য স্থানের তুলনায় ঐতিহাসিকভাবেও এ নগরীর আলাদা গুরুত্ব বহন করে। মগধের সম্রাট অজাতশত্রুর ঐকান্তিক পৃষ্ঠপোষকতায় এ মহাসঙ্গীতি সম্পন্ন হয়। রাজগৃহের সপ্তপর্ণী গুহায় মহাকাশ্যপ থেরোর সভাপতিত্বে পাঁচ শত অর্হৎ ভিক্ষুর উপস্থিতিতে প্রথম বৌদ্ধমহাসঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এ সঙ্গীতিতে অর্হৎ ভিক্ষুগণ বৌদ্ধধর্মের মূল বিষয়বস্তু “সুত্ত” ও “বিনয়”কে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়ার জন্য একত্রিত হয়েছিলেন। অতএব আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে, একদিকে বৌদ্ধধর্মকে প্রচার-প্রসার এবং অন্যদিকে সঙ্গায়নের মাধ্যমে এ ধর্মকে চিরস্থিতি করার ক্ষেত্রে রাজগৃহের অবদান ছিল অপরিসীম। রাজগৃহের অতীত বিত্ত বৈভব ঃ বুদ্ধের সময়ে রাজগৃহকে ভারতবর্ষের সবচেয়ে অর্থ-বিত্ত, ধন-সম্পদ, প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য্যে ভরপুর ও সমৃদ্ধশালী নগর রূপে গণ্য করা হতো। প্রাচীনতম রাজগৃহের বর্ণনা রামায়ণ, মহাভারত তথা অন্যান্য প্রাচীন ধর্মগ্রন্থেও উল্লেখ পাওয়া যায়। ঐ সমস্ত ধর্মগ্রন্থ পাঠ করলে জানা যায় যে, রাজগৃহের প্রাকৃতিক নৈসর্গিক সৌন্দর্য্য, অঢেল ঐশ্বর্য ও মনোমুগ্ধকর পরিবেশ হওয়ার কারণে বহু শতাব্দীকাল পর্যন্ত ভারতবর্ষের রাজা, মহারাজাদের এ নগরীর প্রতি একটা লোভনীয় দৃষ্টি ছিল। রামায়ণে উল্লেখ আছে, ব্রহ্মার পুত্র বসুর নামানুারে এ নগরের নাম রাখা হয় “বসুমতি”। মহাভারতের বর্ণনানুসারে রাজা বৃহদ্রথ সর্ব প্রথম এখানে রাজধানী স্থাপন করেন। রাজা বৃহদ্রথের বংশধরেরা কয়েক শতাব্দীকাল রাজত্বের পর কুশাগ্র নামে এক রাজা হন। তাঁর শাসন কালেই তিনি এ নগরের নতুন নাম রাখেন কুশাগ্রপুরী। মতান্তরে রাজগৃহ কেন কুশাগ্রপুরী নাম হলো ? এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে-“রাজগৃহে ঐ সময় কুশ নামক এক প্রকার ঘাস প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হতো। এ ঘাস দূর থেকে দেখতে খুবই দৃষ্টি নন্দন ও আকর্ষণীয় ছিল। অতএব, এখানে কুশ নামক ঘাস প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হওয়ার কারণে এ স্থানের নাম কুশাগ্রপুরী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।” কারণ যাই হোক না কেন, আমরা এতটুকু বলতে পারি যে, কালের বিবর্তনে ক্ষমতা পালাবদলের সাথে সাথেই এ নগরীর নাম এক এক সময় এক এক নাম ধারণ করে। মহাভারত গ্রন্থে মগধের সম্রাট জরাসন্ধের নাম পাওয়া যায়। জরাসন্ধের রাজধানীও ছিল রাজগৃহে। তাঁর শাসনামলে রাজগৃহ এত নিñিদ্র কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল কোন অপরিচিত লোককে অনুমতি ব্যতীত ঢুকতে-ই দেওয়া হতো না। এভাবে আমরা দেখতে পায় রাজগৃহ শুধু ভগবান বুদ্ধের সময় প্রসিদ্ধ ছিলনা বরং এর অতীত ইতিহাস আরো অত্যুজ্জ্বল। শ্রী এম.এস পান্ডে তাঁর “দি হিস্ট্রিক্যল জিওগ্রাফী এন্ড টোপোগ্রাফী অফ বিহার” গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, “পঞ্চ পর্বত চতুর্দিকে প্রাচীরের মত নগরীকে ঘিরে রয়েছে। এ কারণে গিরিব্রজ নামেই এ নগরী পরিচিতি লাভ করে। সম্ভবতঃ গিরিব্রজই এ নগরীর সবচেয়ে প্রাচীনতম নাম ছিল। অধুনা রাজগীর-এর নাম কেন রাজগৃহ হলো? তার পেছনে একটা কারণ আছে। রাজ+গৃহ শব্দদ্বয়ের অর্থ করলে দাঁড়ায়- ‘রাজার গৃহ’, ‘রাজার ঘর’ অথবা ‘রাজার আবাস স্থল’। এখানে বহু শতাব্দীকাল পর্যন্ত অনেক প্রভাবশালী রাজা, মহারাজা তথা সম্রাটগণের রাজধানী ছিল। যুগ যুগ ধরে অনেক নরপতি তথা রাজন্যবর্গ এখানে অবস্থান করেছিলেন। অতএব, ঐ সমস্ত প্রভাব প্রতিপত্তিশালী রাজা তথা সম্রাটগণের আবাস স্থান হওয়ার কারণে এ নগরীকে রাজগৃহ বলা হতো। ”ভগবান বুদ্ধের সময়েও রাজগৃহ অথবা রাজগীরকে ভিন্ন ভিন্ন নামে বিভিন্ন গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। তখনকার রাজগৃহের রাজা ছিলেন বিম্বিসার। তিনি তাঁর শাসনামলে পঞ্চ পাহাড়ের ঘেরা অভ্যন্তরীণ নগরী ছাড়াও এর বাইরে একটা নতুন নগর নির্মাণ করেন। রাজা বিম্বিসার দ্বারা এ নগরী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে ইহা বিম্বিসারপুরী নামে পরিচিতি লাভ করে। জৈনধর্ম গ্রন্থের মতে, রাজা বিম্বিসার যে স্থানে নতুন নগরী প্রতিষ্ঠা করেন সেখানে প্রথম অবস্থায় প্রচুর পরিমাণে চনা অথবা বুট উৎপন্ন হতো। অতএব এখানে যে নতুন নগরীটি প্রতিষ্ঠিত হয় তা চনকপুরী নামে পরিচিতি লাভ করে।
ভগবান বুদ্ধের সময় রাজগৃহ ধনধান্যে পরিপূর্ণ ছিল। তৎকালীন ভারতবর্ষে চম্পা,কাশী, কৌশাম্বী, সাকেত ও শ্রাবস্তী নগরীকে প্রসিদ্ধ নগরী হিসেবে গণ্য করা হতো। এ সমস্ত নগরীর সাথে রাজগৃহের ব্যবসা বানিজ্যের ক্ষেত্রে ঘনিষ্ট ও নিবির সম্পর্ক ছিল। মূলতঃ জল ও স্থল পথে উপরোক্ত প্রসিদ্ধ নগরীর সাথে রাজগৃহের ব্যবসা বানিজ্য চলতো। তখন গঙ্গা নদীর অর্ধেক মগধ সা¤্রাজ্যের অধীনে এবং অর্ধেক বজ্জীসংঘের অধীনে ছিল। মগধ ও বজ্জীসংঘ দুই রাজ্যের রাজধানী বৈশালী ও রাজগৃহ উভয় নগরীর ব্যবসায়ীদের মধ্যে গঙ্গা নদী বন্দর নিয়ে ব্যবসা বানিজ্য প্রতিযোগিতার জন্য যে বিরোধ দেখা দিয়েছিল তা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। সম্ভবতঃ এ বিরোধের জের ধরে মগধের স¤্রাট অজাতশত্রু বৈশালীতে আক্রমণ করে তাদের সমূলে বিনাশ করেন। তার ফলস্বরূপ রাজগৃহের ব্যবসায়ীরা অধিকতর লাভবান হন।
বুদ্ধের সময় রাজগৃহে বিপুল পরিমাণে প্রসিদ্ধ নগর শ্রেষ্ঠী অথবা সেট্ঠী (ধনকুবের) ছিলেন। তাঁদের অঢেল ধন সম্পত্তির কারণে গোটা দেশ খ্যাতি লাভ করেছিল। সেই সময় কোন একটা রাজ্যকে অর্থনৈতিকভাবে কত সমৃদ্ধ ও ঐশ্বর্যশালী তার পরিমাপ নির্ধারণ করা হয় শ্রেষ্ঠীদের সংখ্যার উপর। তখনকার সময়ে মগধের রাজধানী রাজগৃহে যে পরিমাণ নগর শ্রেষ্ঠী ছিল, সম্ভবতঃ অন্য কোন রাজ্য বা জনপদে এত নগর শ্রেষ্ঠী ছিল না। শ্রাবস্তীর প্রসিদ্ধ শ্রেষ্ঠী অনাথ পিন্ডিকের শ্বশুর বাড়ী ছিল রাজগৃহে। সেই সুবাদে তিনি যখন রাজগৃহে বেড়াতে আসতেন তাঁকে রাজকীয়ভাবে সম্মান প্রদান করা হতো। অনাথ পিন্ডিক শ্রেষ্ঠী প্রতি বছর স্বীয় রাজ্যের রাজ কোষাগারে বিপুল পরিমাণে অর্থ দান করে রাজ্য পরিচালনা করার জন্য সহায়তা করতেন তথা বুদ্ধ প্রমুখ ভিক্ষু সংঘকে অকাতরে দান দিয়ে বৌদ্ধ সাহিত্যের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। রাজগৃহে অবস্থানরত এক একজন শ্রেষ্ঠীদের ঘর বাড়ী প্রায় রাজ প্রাসাদের সমতুল্য ছিল।রাজগৃহ অর্থ-বিত্ত ও ধন সম্পত্তির দিক দিয়ে যেমন সমৃদ্ধশালী তেমনি প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যও এখানে কম ছিল না। রাজগৃহকে যেন প্রকৃতির অবারিত বরদানে স্বয়ং সম্পূর্ণ নগরী হিসেবে গড়ে তুলেছে। এখানকার পর্বতমালা, গিরিগুহা, সবুজে ভরপুর বনজঙ্গল, কল কল শব্দে প্রবাহমান বনগঙ্গা নদী, গরম পানির ঝর্ণা (উঞ্চ প্র¯্রবন) ইত্যাদি প্রাকৃতিক সম্পদে রাজগৃহকে যেন পূর্ণাঙ্গরূপ দিয়েছে। রাজগৃহে প্রকৃতির প্রদত্ত যে সম্পদ রয়েছে তা কারোর দ্বারা ছিনতাই অথবা নষ্ট করা সম্ভব নয়। বস্তুত রাজগৃহকে সাংসারিক ধনদৌলতের চেয়েও প্রাকৃতিক সম্পদের জন্য এ স্থানের গুরুত্ব অধিকতর বৃদ্ধি করেছে। রাজগৃহ সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ নগরী ছিল।
তখনকার সময়ে ষোড়শ জনপদের মধ্যে রাজগৃহ এমন একটি জায়গা ছিল, যেখানে বিভিন্ন ধর্মের আচার্যরা স্থায়ীরূপে বসবাস করতেন এবং তাঁরা তাঁদের ধর্ম বাণী রাজগৃহের আনাচে কানাচে প্রচার করে আপামর জন সাধারণের কাছে নতুন নতুন প্রেরণা ও জ্ঞানের সঞ্চার বৃদ্ধি করতেন। ভগবান বুদ্ধ এবং ভগবান মহাবীর তাঁরা উভয়ে রাজগৃহে অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করেছিলেন। যে সমস্ত ধর্মাচার্যরা রাজগৃহে স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন তাঁদের মধ্যে পূরণ কস্সপ (পূর্ণ কাশ্যপ), মক্খলি গোসাল (মস্করিন গোশাল), অজিত কেসকম্বলী (অজিত কেশকম্বলিন), পকুধ কাচ্চায়ন (ককুদ কাত্যায়ন), নিগণ্ঠনাথপুত্ত (নির্গ্রন্থ জ্ঞাতৃপুত্র) ও সঞ্জয় বেলট্ঠিপুত্ত (সঞ্জয় বেলষ্টিপুত্র) অন্যতম। রাজগৃহের এ সমস্ত ধর্মাচার্যদেরকে ষোড়শ জনপদের সাধারণ মানুষ অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতেন এমনি অনেক রাজা তাদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র হিসেবেও রাজগৃহ এক গৌরবজনক স্থান দখল করে আছে। নৃত্য, সংগীত তথা নাটকের অভিনেতা, অভিনেত্রী এবং শিল্পী ছাড়াও বিভিন্ন পেশা জীবির লোক এখানে বসবাস করতেন। এভাবে আমরা জানতে পারি যে, বুদ্ধের সময়ের রাজগৃহ অতীতের গৌরবজনক অগাধ ধন-সম্পদ এবং এর অফুরন্ত প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য তথা বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে অদ্বিতীয় নগরী ছিল।
রাজগৃহের দুই নগরী : প্রখ্যাত চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ ও ফাহিয়েনের ভ্রমণ বিবরণীতে উল্লেখ আছে যে, বুদ্ধের সময় রাজগৃহে দু’টি নগরী ছিল। একটি নগরী পঞ্চপর্বতের ঘেরার ভেতরে ছিল। ইহাকে অন্তঃনগরী (ইন্টার সিটি) বলা হয়। পঞ্চপর্বতের বেষ্টনীর বাহিরে যে নগরীটি ছিল ইহাকে বহিঃনগরী (আউটার সিটি) বলা হয়।
রাজগৃহের বহিঃনগরীর অপেক্ষা অন্তঃনগরী অধিকতর পুরাতন ছিল এবং ইহা ভগবান বুদ্ধ আভির্ভাবের বহু আগেই স্থাপিত হয়েছিল। সম্ভবতঃ এ প্রাচীন নগরীতে রাজা বসু, রাজা বৃহদ্রথ, রাজা কুশাগ্র তথা স¤্রাট জরাসন্ধের নিবাসস্থান ছিল বলে অনুমান করা হয়। মগধপুরী, বৃহদ্রথপুরী, গিরিব্রজ, কুশাগ্রপুরী অথবা রাজগৃহ ইত্যাদি নামে বিভিন্ন সময় এ প্রাচীন নগরীকে আখ্যায়িত করা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। এর কারণ হলো, রাজগৃহ অতীব প্রাচীন নগরী বুদ্ধের কয়েক শতাব্দী আগেই এ নগরী নির্মাণ করা হয়। এ স্থানের যে বিভিন্ন নামের উল্লেখ পাওয়া যায়, তা বুদ্ধের অনেক আগ থেকেই প্রচলিত ছিল।
উপরে উল্লেখিত পুরাণো নামগুলো রাজগৃহের ইতিহাসের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। অতএব এ সমস্ত অকাট্য যুক্তিসংগত কারণে ইহাকে কেন অতি প্রাচীনতম নগরী হিসেবে গণ্য করা হবে না ? যে স্থানে নতুন নগরী স্থাপন করা হয়, সেখানে প্রথম অবস্থায় প্রচুর পরিমাণে চনা উৎপন্ন হতো, এ কারণে নতুন নগরীটি চনকপুরী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ভগবান বুদ্ধের সময় রাজগৃহের রাজা ছিলেন বিম্বিসার ও তাঁর পুত্র অজাতশত্রু। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক শ্রী এম.এস পান্ডের লিখিত সবচেয়ে তথ্যবহুল ও নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ “দি হিস্ট্রিক্যল জিওগ্রাফী এন্ড টোপোগ্রাফী অফ বিহার”-এ উল্লেখ আছে যে, রাজগৃহের নতুন নগরীটি মহারাজ বিম্বিসার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু এখানে প্রশ্ন হচ্ছে রাজগৃহে একটা স্বয়ং সম্পূর্ণ নগরী থাকা সত্ত্বেও দ্বিতীয় নগরী প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজন হয়ে পড়লো কেন ? এর কারণ হিসেবে শ্রী পান্ডে উল্লেখ করেছেন- রাজগৃহের প্রাচীন নগরীর চতুর্দিকে পাহাড়ে ঘেরা ছিল। ধীরে ধীরে যখন জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় তখন চতুর্দিকে পাহাড়ের বেষ্টনীর কারণে পুরাণো নগরীকে সম্প্রসারণ করা সম্ভব ছিল না। তাই স্বাভাবিকভাবে যুগের প্রয়োজনে চাহিদা অনুসারে নতুন নগর পত্তন অনিবার্য হয়ে পড়ে। এ কারণে তখনকার রাজগৃহের রাজা বিম্বিসার পাহাড়ের ঘেরার বাইরে এক নতুন নগর নির্মাণ করেন। এ নতুন নগরী রাজা বিম্বিসার কর্তৃক নির্মিত হওয়ায় ইহা বিম্বিসারপুরী হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। কিন্তু কিছু কিছু ইতিহাসবিদ তথা পুরাতত্ত্ববিদ এর ভিন্ন মত পোষণ করেন, তাঁদের মতে রাজগৃহের নতুন নগরীটি বিম্বিসার নয় বরং তাঁর পুত্র অজাতশত্রু নির্মাণ করেন। রাজা বিম্বিসার ও অজাতশত্রু উভয়ে ভগবান বুদ্ধের সময় রাজগৃহের রাজা ছিলেন। এ দুই জনের মধ্যে যে কেউ নতুন নগরীটি নির্মাণ করুক নাকেন, আমরা নিঃসন্দেহে ধরে নিতে পারি বুদ্ধের সময় অথবা তার সমসাময়িককালেই রাজগৃহের নতুন নগরীটি নির্মাণ করা হয়। নতুন নগরীর প্রাচীরের ব্যাপ্তি প্রায় তিন (৩) মাইল বিস্তৃত ছিল। রাজগৃহের এ নগরীর চার দেওয়ালের ধ্বংসাবশেষ এখনও ইতিহাসের স্বাক্ষীরূপে বিদ্যমান।
চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ ও ফাহিয়েন তারা তাদের ভারতবর্ষ ভ্রমন কাহিনীতে বুদ্ধের সময় রাজগৃহে যে দুটি নগরীর বিবরণ দিয়েছেন তা নিয়ে পুরাতত্ত্ববিদদের মধ্যে যথেষ্ট মতানৈক্য রয়েছে। বিখ্যাত পুরাতত্ত্ববিদ জেনারেল কানিংহাম হিউয়েন সাঙ ও ফাহিয়েন এ দুই জনের ভ্রমণ বিবরণীর উপর চুলচেরা বিচার বিশ্লেষণ, গবেষণা ও অনেক অনুসন্ধানের পর তিনি এ সিদ্ধান্তে উপনিত হন যে, বাস্তবরূপে বুদ্ধের সময়ে রাজগৃহে দুটি নগরী ছিল। কানিংহামের মতকে সমর্থক করে কিছু কিছু প্রতœতাত্ত্বিক বলেছেন, “রাজগৃহের গরম পানির ঝর্ণার (উঞ্চ প্রসবণ) পার্শ্ববর্তী এলাকা যেখান থেকে দুই পর্বত শ্রেণির পাদদেশ আরম্ভ হয়েছে এখানেই পুরাতন নগরীর সীমানা অবস্থিত। ইহা মোটামুটি তিন পাহাড়ের ঘেরার মধ্যবর্তী স্থান ছিল এবং নগরীতে প্রবেশ দ্বার ছিল গরম পানির ঝর্ণার নিকটবর্তী। এই প্রবেশ দ্বারের চওড়া প্রায় অর্ধ মাইলের কাছাকাছি ছিল।” জনশ্রুতি আছে, প্রকৃতির দ্বারা সৃষ্ট প্রবেশ দ্বারের অর্ধ মাইল দূরত্বকে কোন এক মুণীঋষির ঋদ্ধির (অলৌকিক শক্তি) দ্বারা সম্ভবত এর দূরত্ব কমিয়ে আনেন, যাতে করে ইহা নগরের মুখ্য প্রবেশ দ্বার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। প্রাচীন নগরী প্রকৃতির দানে প্রাপ্ত যে সুরক্ষার ব্যবস্থা ছিল তা অপর এক মুণীঋষির ঋদ্ধির দ্বারা আরো অধিকতর সুদৃঢ় করেছে।
(চলবে)
No comments
Post a Comment