মৃতের সংখ্যা ৫০ ছাড়াল, ৬২ জেলায় ডেঙ্গু রোগী

ফুটফুটে একটি মেয়ের শখ ছিল নাজমুল আলমের। তাঁর এই ইচ্ছা অপূর্ণ থাকেনি। গত রোববার মেয়েসন্তানের বাবা হন তিনি। তবে সন্তান জন্মের সময় স্ত্রীর পাশে থাকার সুযোগ হয়নি তাঁর। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়ায় সেদিনই হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে। ২৪ ঘণ্টা পার না হতেই সোমবার বিকেলে মারা যান তিনি। মেয়ের মুখ আর দেখা হয়নি তাঁর। মেয়েও আর কখনোই দেখা পাবে না বাবার।
নাজমুল রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা ছিলেন। তাঁর ছোট ভাই সাইফুল আলম বলেন, ভাবি এখনো হাসপাতালে। ভাই মারা যাওয়ার আগের দিন তাঁর মেয়ের জন্ম হয়েছে।

চলতি বছর ডেঙ্গু জ্বরে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৩ জনে। এর মধ্যে আজ বুধবার ও গতকাল মঙ্গলবার ঢাকায় তিনজন এবং বরিশালে দুজনের মৃত্যু হয়েছ ।এই তথ্যের সাথে অবশ্য সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যের ব্যাপক ফারাক রয়েছে। অধিদপ্তর বলছে, এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে।
এবার ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যই বলছে, গতকাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে ১৫ হাজার ৩৬৯ জন রোগী। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়া ১ হাজার ৩৩৫ জন রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, যা চলতি বছর এক দিনে ভর্তি হওয়া রোগীর দিক থেকে সর্বোচ্চ।
এবার ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে
চলতি বছর ডেঙ্গু জ্বরে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৩ জনে 
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ৮ জন মারা গেছে 
২৪ ঘণ্টায় দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি ১,৩৩৫ জন

সরকারি হিসাবে গতকাল পর্যন্ত দেশের ৬০টি জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগী ভর্তি ছিল। জয়পুরহাট, বরগুনা, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা জেলায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী না থাকার কথা জানিয়েছে সরকার। তবে প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গতকাল ১০ জন ও বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে ৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি ছিল। সে হিসাবে ৬৪ জেলার মধ্যে ৬২ জেলাতেই ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে। গতকাল বেশ কয়েকটি জেলায় ডেঙ্গু আক্রান্ত এমন রোগী পাওয়া গেছে, যারা গত কয়েক মাসেও ঢাকায় আসেনি। এর আগে দেখা গিয়েছিল, আক্রান্ত ব্যক্তিদের বেশির ভাগ ঢাকা থেকে ওই সব এলাকায় গিয়েছিল।
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে আজ সকালে ঢাকায় পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) উপপরিদর্শক (এসআই) কোহিনুর আক্তার মারা যান। সোমবার দিবাগত রাতে ও মঙ্গলবার সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ফারজানা হোসেন (৪৩) ও মো. লিটন (২৫)। স্বজনেরা হাসপাতাল থেকে তাঁদের লাশ নিয়ে গেছেন। এ নিয়ে ঢামেক হাসপাতালে চলতি মাসে ডেঙ্গু জ্বরে মৃত মানুষের সংখ্যা দাঁড়াল আটে।
হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) নাছির উদ্দীন সাংবাদিকদের বলেন, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়া ৫৯৩ জন ভর্তি রয়েছে।
এদিকে বরিশালে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত দুই রোগীর মৃত্যু হয়েছে। বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত সোমবার দিবাগত রাতে একজন এবং গতকাল ভোরে আরেকজনের মৃত্যু হয়। তাঁরা হলেন বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার শ্যামপুর এলাকার আসলাম খান (২৪) ও পিরোজপুর জেলার কাউখালী উপজেলার গোসনতারা এলাকার মো. সোহেল (১৮)। এই হাসপাতালে গতকাল দুপুর পর্যন্ত ২৫ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি ছিল।
শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক মো. বাকির হোসেন বলেন, আসলাম খানকে সোমবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগে ভর্তি করা হয়। তাঁর কিডনি ও লিভার কাজ করছিল না। আর সোহেলের স্পন্দন পাওয়া যাচ্ছিল না। দুজনই ঢাকায় ছিলেন। সেখানে ডেঙ্গু জ্বর শনাক্ত হওয়ার পরও চিকিৎসা না নিয়ে বাড়িতে চলে আসেন। পরে অবস্থা গুরুতর হওয়ার পর তাঁদের হাসপাতালে আনা হয়। বরিশাল অঞ্চলে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর ঘটনা এটাই প্রথম।
হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নেওয়া ডেঙ্গু রোগীর তথ্য ২০০০ সাল থেকে সংরক্ষণ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম। তারা বলছে, এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি ছিল ২০১৮ সালে। ওই বছর ১০ হাজার ১৪৮ জন আক্রান্ত রোগী চিকিৎসা নেয়। এবার সেই রেকর্ড ভেঙেছে। কন্ট্রোল রুম জানিয়েছে, এ বছর গতকাল পর্যন্ত ১৫ হাজার ৩৬৯ জন রোগী চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। আর গতকাল বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ৪ হাজার ৪০৮ রোগী ভর্তি ছিল।
তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মাত্র ৩৫টি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর তথ্য প্রকাশ করে। এর বাইরে ঢাকা শহরের প্রায় সব বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে এখন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিচ্ছে। এ রকম প্রতিষ্ঠান আছে প্রায় সাড়ে ৩০০।  বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া বিপুলসংখ্যক রোগী সরকারের হিসাবের বাইরে থেকে যাচ্ছে। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের বহির্বিভাগে ও চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে কত রোগী চিকিৎসা নিচ্ছে, সেই হিসাব সরকার বা কারও কাছে নেই।
স্বাস্থ্য বিভাগের ছুটি বাতিল
ডেঙ্গু ও বন্যা পরিস্থিতির কারণে স্বাস্থ্য বিভাগের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করা হয়েছে। একই সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণে থাকা চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ স্থগিত করে তাঁদের চিকিৎসাকাজে যোগদান করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ ছাড়া আসন্ন ঈদের ছুটিতে ঢাকায় থাকা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঢাকা ছাড়তে সরকার নিরুৎসাহিত করছে।
গতকাল সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে ডেঙ্গু, বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলা ও গুজব প্রতিরোধ-সংক্রান্ত পর্যালোচনা সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানান মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব (সমন্বয় ও সংস্কার) শেখ মুজিবুর রহমান। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।



No comments

Theme images by 5ugarless. Powered by Blogger.