পাহাড়ি মেয়ের দেশান্তরের গল্প_°সঞ্জীব দ্রং
অবশেষে পাহাড়ের মেয়েটি চলে গেল দেশান্তরে। আমরা জানি, প্রত্যেক মানুষের জীবনে ভিন্ন ভিন্ন গল্প থাকে। স্বতন্ত্র, হয়তোবা গোপনীয়। এমনকি আপনজনও সব মানুষের সব গল্প পুরোপুরি জানে না। বাইরে থেকে ‘সব জানে’ বলে দাবি করলেও ভেতরে সত্য নয়।
আমরা অনেক সময় পুরো কাহিনি না জেনেই মানুষকে বাছবিচার করি। চলে যাওয়ার কালে পাহাড়ি মেয়েটির সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। ওর বন্ধুদের কাছে শুনেছিলাম, বন্ধুরা তাকে বিদায় জানাতে এই ঢাকা শহরে কয়েকজন জড়ো হয়েছিল।
আমি মেয়েটির খবর জানতাম না। অন্যদের মতো আমি ওর অত ঘনিষ্ঠ ছিলাম না। এই মেয়েটি পার্বত্য চট্টগ্রামের অতি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে উঠে এগিয়ে চলেছিল। খুব সম্ভাবনাময়, মেধাবী, প্রাণোচ্ছল, সক্রিয়। অস্ট্রেলিয়া সরকারের বৃত্তি নিয়ে মাস্টার্স শেষ করে দেশে ফিরে এসেছিল মেয়েটি। নিশ্চয়ই জন্মভূমি দেশমাতাকে কিছু দিতে। জননীর ঋণ কোনো দিন পুরোটা শোধ হওয়ার নয় জেনেও কিছু করার আকাঙ্ক্ষা ছিল মনে। কোনো এক অনুষ্ঠানে পাহাড়ি ভাষায় ওর গানও শুনেছিলাম। ঢাকায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হঠাৎ দেখা হতো। পাঁচ–ছয় বছর আগে একবার জেনেভায় জাতিসংঘ অধিবেশনে ও যোগ দিয়েছিল। আমিও ছিলাম। তখন কিছু কথা হয়েছিল।
মেয়েটি দেশান্তরে চলে গেল এই বর্ষায়। রাজা দেবাশীষ রায় আমাকে মেয়েটির কথা বললেন। তিনি বললেন, কী করে থাকবে আর? পরে রাজা বাবুকে আমি বললাম, আমরা যাঁরা সিনিয়র, আমাদেরও হয়তো অনেক ব্যর্থতা আছে। এই তরুণ বন্ধুদের মনের খবর আমরা হয়তো রাখতে পারিনি। ওদের হতাশায় ও কঠিন সময়ে একটু ভালোবেসে হয়তো পাশে দাঁড়াতে পারিনি। ছুটে চলা এই নিষ্ঠুর শহরে একটু অবসরে, শান্ত নিরিবিলি পরিবেশে প্রাণ খুলে ওদের কথা শুনতে পারিনি। পরে মেয়েটিকে আমি ই-মেইল পত্র লিখেছিলাম। শুভকামনা জানিয়ে বলেছিলাম, তোমার নিকটজন না হলেও খবর পেলে তোমার বিদায়ের অনুষ্ঠানে আমি আসতাম। মেয়েটি অস্ট্রেলিয়া থেকে আমার চিঠির উত্তর দিয়েছিল। ২০১৭ সাল পর্যন্ত তার ভাবনা ছিল সে দেশেই থাকবে, কোথাও যাবে না।
পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে খুব কঠিন সময় পার করছিল সে। মেয়েটি লিখেছে, ‘আমার দেশ ছেড়ে চলে আসাটা দুঃখময়। ইট ইজ স্যাড ফর মি।’ আবার বলেছে, ‘জীবনে অবাক বিস্ময়কর মুহূর্ত আসে, জীবন পরিবর্তনশীল। আমি পরিবর্তনকে সেলিব্রেট করতে চাই।’ ওর উত্তরে আমি লিখলাম, তাই হোক, ওখানে পরবাসে জীবন হোক আনন্দময়।
আবার বললাম, ওখানে কখনো যেন তোমার নিজকে নিঃসঙ্গ, একাকী মনে না হয়। তোমার যেন অনেক বন্ধু, নতুন বন্ধু, ভালো বন্ধু জোটে নতুন দেশে। তোমাকে যেন চারপাশ ঘিরে রাখে তোমার বন্ধুরা, সব সময়। মাদার তেরেসা বলতেন, সবচেয়ে বড় দারিদ্র্য হলো নিঃসঙ্গতা, সঙ্গীহীন মানুষের চেয়ে গরিব ও দুঃখী পৃথিবীতে কেউ নেই।
আজ আমি ভাবি, এখানে, এই পাহাড় দেশে তরুণদের কত অনিশ্চয়তা! গত বছর একটি মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিল, পড়াশোনা শেষে আইন পেশায় ঢুকেছিল উচ্চ আদালতে, হঠাৎ চলে গেল জার্মানি। রাজা দেবাশীষ রায় বললেন, ওর নাম নাকি পাহাড়ে কোনো এক হত্যা মামলায় ঢোকানো হয়েছিল। আমি জানি অস্ট্রেলিয়া সরকারের বৃত্তি নিয়ে যে পাহাড়ের মেধাবী সন্তানেরা উচ্চশিক্ষা শেষে দেশে ফিরে এসেছিলেন অনেক আশা নিয়ে, তাঁদের অনেকেই আবার ফিরে চলে গেছেন অস্ট্রেলিয়া অথবা অন্য কোনো দেশে।
বহু বছর আগে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় শামসুন্নাহার হলের একটি পাহাড়ি মেয়ের কথা লিখেছিলাম ‘কোচপানা রাঙামাটি’ কলামে। পরে জেনেছি, এই মেয়েটিও বিসিএস করে সরকারি চাকরি ছেড়ে চলে গেছে মেলবোর্নে। কী আশায় ওদের খেলাঘর বাঁধতে বলব এখানে বেদনার বালুচরে! কেন, কী করে ওদের বলব, এভাবে যেয়ো না, থাকো?
আজ বুকে বিশাল শূন্যতা অনুভব করি। শূন্যতার করুণ হাহাকার। আমার গ্রামে গেলে দেশের সহজ সরল মানুষদের জীবন দেখি। কত শান্ত ও সহনশীল, নীরব সব মানুষ। একদিকে উন্নয়নের প্রচণ্ড আস্ফালন, অন্যদিকে ব্যাপক বৈষম্যের হাহাকার। হুমায়ুন আজাদের ‘কথা দিয়েছিলাম তোমাকে’ কবিতা আজও মনে পড়ে:
‘কথা দিয়েছিলাম তোমাকে/ রেখে যাব পুষ্ট ধান, মাখনের মতো পলিমাটি, পূর্ণ চাঁদ/ ভাটিয়ালি গান, উড্ডীন উজ্জ্বল মেঘ, দুধের ওলান/ মধুর চাকের মতো গ্রাম/ জলের অনন্ত বেগ, রুই মাছ/ পথপাশে সাদা ফুল, অবনত গান/ আমের হলদে বন/ জলপদ্ম, দোয়েল, মৌমাছি। তোমার জন্য রেখে যাচ্ছি নষ্ট ধানের ভেতরে পুঁজ/ টায়ারের পোড়া গন্ধ, পঙ্কিল তরমুজ/ দুঃস্বপ্ন আক্রান্ত রাত আর আলকাতরার ঘ্রাণ/ পথনারী, বিবস্ত্র ভিখারি। শুকনো নদী, বিষ, আবর্জনা...।’
আমি বহুবার বলেছি, রাষ্ট্র যেন এই ভিন্ন ভিন্ন জাতির মানুষদের পাহাড়ের চোখ দিয়ে শুধু নয়, অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখার চেষ্টা করে। সম্ভব হলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষেরা যেন সংখ্যালঘুদের যন্ত্রণাকে চোখ আর হৃদয় দিয়ে দেখতে শেখে। হয়তো এমন দিন আসবে যখন এই দেশান্তরে চলে যাওয়া মেয়েরা ফিরে ফিরে আসবে জন্মভূমিতে, পাহাড় দেশে, সব অভিমান ভুলে, সাঁঝের বেলা পাখি নীলিমা ভ্রমণ শেষে যেভাবে নীড়ে ফেরে। একটা রিকনসিলিয়েশন হবে। তখন আমাদের রাষ্ট্র হয়ে উঠবে অনেক বেশি মানবিক ও কল্যাণমুখর রাষ্ট্র।
ভেবে কষ্ট পাই, কেন আমাদের প্রিয়জনেরা এভাবে দেশ ছেড়ে চলে যায়? পাকিস্তান রাষ্ট্রে ভিটাবাড়ি ছেড়ে আমার তিন কাকা মেঘালয়ে দেশান্তরি হয়েছিলেন। আর ফেরেননি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে ভিন্নভাবে হলেও কেন আমাদের স্বজন হারানোর পালা শেষ হয় না।
সঞ্জীব দ্রং: কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী
sanjeebdrong@gmail.com
আপডেট: ৩০ জুলাই ২০১৯,
No comments
Post a Comment