গণপিটুনির দায় রাষ্ট্র ও সমাজের


ড. জিয়া রহমান
কয়েক দিন ধরে যে নির্মম গণপিটুনির অপসংস্কৃতি দেখছি, তা যে কোনো মানুষকে উদ্বিগ্ন না করে পারে না। গণপিটুনির এই অপসংস্কৃতি একেবারে নতুন, তা কিন্তু নয়। পকেটমার, সড়ক দুর্ঘটনায় জড়িত চালক কিংবা চোর-ডাকাতকে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলা দীর্ঘদিন যাবৎই দুর্ভাগ্যক্রমে এই জনপদে স্বাভাবিক সংস্কৃতি হিসেবে প্রচলিত। শুনতে খারাপ শুনলেও গণপিটুনির অপসংস্কৃতি সনাতনী সমাজ ব্যবস্থায় একটি স্বাভাবিক রূপ। এটি সত্য যে, বাংলাদেশ, আফ্রিকা মহাদেশ ও বিশ্বের অনেক মানুষ এই ধরনের ঘটনায় বলপ্রয়োগ ও নিষ্ঠুরতার মাধ্যমে তার আগ্রাসী মনোভাব প্রকাশ করে থাকে। আমরা জানি, মানুষের মধ্যে জীবন প্রবৃত্তি এবং ধ্বংসাত্মক প্রবৃত্তি দুটোই বিরাজমান। সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে উন্নত বিশ্বে ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেম প্রতিষ্ঠা করার মধ্য দিয়ে মানুষের এই নিষ্ঠুর প্রবৃত্তি দমন করা এবং মানুষকে জীবন প্রবৃত্তিতে উৎসাহিত করার পথ প্রশস্ত করে। এর মানে হচ্ছে, প্রাচীনকাল বা মধ্যযুগে মানুষ যে বর্বর নিষ্ঠুরতার মধ্য দিয়ে তার আদিম প্রবৃত্তি চরিতার্থ করত এবং আইন নিজ হাতে তুলে নিত, সেই জায়গা থেকে ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমের তিনটি বিভাগ, যথাক্রমে পুলিশ, আদালত ও কারাগারের মধ্য দিয়ে আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও ব্যবহার এই অধিকারকে সুনিশ্চিত করেছে। এ কারণেই উন্নত বিশ্বে সাধারণ মানুষের মধ্যে অতি সহজে উত্তেজিত হওয়া বা শক্তির প্রয়োগে শারীরিক আঘাতের ব্যবহার একেবারে দেখা যায় না বললেই চলে। দুর্ভাগ্যবশত আমরা আমাদের ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমের প্রকৃত ব্যবহার নিশ্চিত না করে এখনও প্রতিনিয়ত আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে মানুষকে শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা দিয়ে চলেছি এবং একসঙ্গে সাধারণ মানুষের প্রাণ হরণ করে নিচ্ছি।

কাজেই গণপিটুনি নামক যে নিষ্ঠুর অপসংস্কৃতি আমরা গত কয়েক দিন ধরে দেখতে পাচ্ছি, এটা এরই বহিঃপ্রকাশ। এ কারণেই পকেটমার, দুর্ঘটনায় জড়িত চালক কিংবা চোর-ডাকাতকে দীর্ঘদিন ধরে গণপিটুনির শিকার হতে হয়েছে। মোদ্দাকথা হচ্ছে, সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সভ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠা অপরিহার্য, যা আমাদের দেশে একেবারেই অনুপস্থিত।

বর্তমান সমাজ পরিবর্তনের উত্তরণ পর্বে আমরা যে ধরনের উদ্ভট ও অস্বাভাবিক অপরাধ, যেমন- পিতা কর্তৃক পুত্র হত্যা, পুত্র কর্তৃক পিতা হত্যা, স্ত্রী কর্তৃক স্বামী হত্যা কিংবা স্বামী কর্তৃক স্ত্রী হত্যার মতো বীভৎসতা দেখছি, যার পেছনে থাকে সামাজিক উপসর্গ। যেমন- মাদকের ব্যবহার, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক ইত্যাদি অনেক কিছু। এর সঙ্গে গণপিটুনির বিষয়টি একেবারেই ভিন্ন। গণপিটুনি হঠাৎ করেই মূল্যবোধ অবক্ষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়; বরং এটি সনাতনী সমাজ ব্যবস্থায় আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ারই সংস্কৃতি। এর দায় ব্যক্তির নয়, বরং রাষ্ট্র ও সমাজের। এরপর ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমের, বিশেষ করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, আদালত ও কারাগারের নিষ্ফ্ক্রিয়তার মধ্য দিয়ে এ ধরনের গণপিটুনি এক প্রকার বৈধতা দিয়ে আসছে। যার ফলে এই অপসংস্কৃতি এখনও বলবৎ। আমরা আগে কখনও কি দেখেছি যে যারা গণপিটুনিতে অংশ নেন, তাদের বিচারের আওতায় আনা হয়েছে? ফলে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের এ অপসংস্কৃতি থেকে অনুৎসাহিত হতে দেখি না।

গণপিটুনির সঙ্গে আরও দু-একটি বিষয় জড়িত। এর অন্যতম হলো গুজব। আর এই গুজবের সঙ্গে যে বিষয়টি জড়িত, তা হচ্ছে মানুষের প্রাগৈতিহাসিক মনস্তত্ত্ব। এটি অনেকটা গণপিটুনির মনস্তত্ত্বের মতোই। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সত্য যে, উন্নত বিশ্বে মানুষকে এত সহজে গুজবে আকৃষ্ট হতে দেখা যায় না। বাংলাদেশের মানুষের মনস্তত্ত্বে এখনও পূর্বসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস বিরাজমান। যে কারণে ঝাড়ফুঁক, পানিপড়াসহ অসংখ্য উদ্ভট মানসিকতা এখনও প্রচলিত। ফলে যুক্তিহীন, অসাড়, অসত্য বহু ঘটনায় সহজেই এ দেশের নিরীহ মানুষ গুজবসহ নানা অপকর্মে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে। এ কারণেই সাঈদীকে যখন চাঁদে দেখা যায় বলে গুজব ছড়ানো হয়, তখন সংশ্নিষ্ট মূল হোতাদের কুচক্রের ফাঁদে বহু সাধারণ মানুষ বলি হয়ে যায়। অতি সম্প্রতি পদ্মা সেতু নিয়ে যে গুজব রচনা করা হয়েছে, সে ক্ষেত্রেও তাই বহু মানুষ নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে। কিন্তু উন্নত বিশ্বের দিকে তাকালে দেখা যায়, মানুষ তার মনস্তত্ত্বে অসুস্থ, যুক্তিহীন, অসাড়তার বিপরীতে যুক্তিবান, বিবেচনাবোধ ও বিজ্ঞানসম্মত মন দিয়ে তাড়িত। ফলে কখনোই তাকে অসত্য কিংবা বিভ্রান্তকর গুজব দিয়ে বিভ্রান্ত করা যায় না।

গণপিটুনির আরেকটি দুর্ভাগ্যজনক দিক হচ্ছে এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ক্ষমতার সম্পর্ক। গণপিটুনিতে আজ পর্যন্ত যারাই মারা গেছেন, তারা কমবেশি সাধারণ মানুষ। সে কারণেই রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনকারী, ব্যাংক লুণ্ঠনকারী কিংবা শেয়ারবাজার লোপাটকারীদের মতো ক্ষমতাবানদের আমরা কখনই নিহত হতে দেখি না। এটিও গণপিটুনির বক্রাঘাত এবং এ কারণে সমাজতান্ত্রিকভাবে চিন্তা করলে গণপিটুনির সঙ্গে সামাজিক বৈষম্য ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য যে, যতদিন পর্যন্ত আমরা আধুনিক সমাজ ব্যবস্থার মতো ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমকে কার্যকর করতে না পারব এবং যতদিন পর্যন্ত আমরা আমাদের মনস্তত্ত্বের ধ্বংসাত্মক প্রবৃত্তি দূর করে যুক্তিগ্রাহ্য মনস্তত্ত্ব তৈরি করতে ব্যর্থ হব, ততদিন পর্যন্ত আমাদের গণপিটুনির মতো ভয়াবহ অপসংস্কৃতি সমাজ থেকে দূর করা একেবারে কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়াবে। এখানেই সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা। গণসচেতনতা তৈরি করা যেমন একদিকে এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি জরুরি, তেমনি গণপিটুনিতে অংশগ্রহণকারীদের চিহ্নিত করে কার্যকর ব্যবস্থার মাধ্যমে আইনের আওতায় এনে এ সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ বের করতে হবে।

অপরাধবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক অপরাধবিজ্ঞান বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Copy : samakal

No comments

Theme images by 5ugarless. Powered by Blogger.