পার্বত্য চট্টগ্রাম কি ‘পানিশমেন্ট জোন’?
সরকারি
কর্মকর্তাদের জন্য শাস্তিমূলক বদলির (পানিশমেন্ট ট্রান্সফার হিসেবে পরিচিত)
প্রধানতম জায়গা পার্বত্য চট্টগ্রাম। গত ৩১ মে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস ২০১৬
পালনের মূল অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম
বলেছেন, ‘অনেক ডাক্তার আছেন যাঁরা সিগারেট খান, স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে
আমি ঘোষণা দিচ্ছি, যদি শুনি কোনো ডাক্তার সিগারেট খান, আমি তাঁর পোস্টিং
বাতিল করে দেব, তাঁকে বান্দরবানে পাঠিয়ে দেব।’
স্বাস্থ্যসচেতন একজন নাগরিক হিসেবে এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী
হিসেবে অন্যকে ধূমপান না করার বিষয়ে উৎসাহ তিনি দিতেই পারেন, কিন্তু এর
সঙ্গে বান্দরবানের সম্পর্ক কী? কেন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের
বান্দরবানে পাঠানোর হুমকি? এর মাধ্যমে সরকার বান্দরবান সম্পর্কে কী ধরনের
বার্তা দিতে চায়? কী সমস্যা বান্দরবানের? বান্দরবানে গেলে কার কী ক্ষতি হবে
বা হয়? কেন সেখানে যাওয়া মানেই শাস্তি?
সরকারি চাকরিজীবীদের ‘পানিশমেন্ট ট্রান্সফার’ মানেই
পার্বত্য চট্টগ্রাম—এ ধারণা নতুন নয়। সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তারাও এটা
জানেন। এটা অনুচ্চারিত কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে চর্চিত একটা বিষয়। খুব
ছোটবেলাতেই আমি শুনেছিলাম, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম দুর্গম, সেখানে গেলে পাহাড়ি
জ্বর হয়, সেখানে মানুষজনকে মেরে ফেলা হয়।’ ২০১৩ সালে পিএইচডির গবেষণা করতে
খাগড়াছড়ি যাওয়ার সময় বাসে পরিচয় হয়েছিল একজন চিকিৎসকের সঙ্গে। আলাপের
একপর্যায়ে তিনি আমাকে বলেছিলেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায়
তাঁকে বদলি করা হয়েছে খাগড়াছড়ির জালিয়াপাড়ায়। বস নাকি আগেই তাঁকে হুমকি
দিয়ে বলেছিলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে বদলি করা হবে, তখন সে মজা বুঝবে!’
আমার গবেষণা এলাকায় পরিচিত ইউএনওর সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, তাঁকেও সেখানে বদলি করা হয়েছে ‘পানিশমেন্ট’ হিসেবে।
আর আমার এক পাহাড়ি বন্ধু একবার বলেছিল, ‘রাষ্ট্র আমাদের
খারাপ ভাবে, তা না হলে সব খারাপ মানুষকে কেন এখানে বদলি করা হয়?’ সহজ
প্রশ্ন, স্বাভাবিক প্রশ্ন।
কেন কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে শাস্তি দিতে হলে তাঁকে
পার্বত্য চট্টগ্রামে পাঠাতে হবে? কেন জনমনে ধারণা দেওয়া হবে যে বান্দরবান
তথা পার্বত্য চট্টগ্রাম একটা ভয়ের জায়গা? কী সেই ভয়? কী করে দীর্ঘদিন ধরে
একটি ‘সাম্প্রদায়িক’ রাজনীতির চর্চা এ দেশে হয় একটি অঞ্চলকে কেন্দ্র করে?
এটি কি শুধু ঔপনিবেশিক মানসিকতার ফসল? নাকি এই হুমকির পেছনে প্রকাশ পায় ওই
অঞ্চলের সঙ্গে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির এক ঐতিহাসিক ভিন্নতা বা ‘অন্যতা’র
সম্পর্ক।
সাংস্কৃতিক ভিন্নতাকে ‘অন্যতা’র রাজনীতি হিসেবে ব্যবহার
করা হচ্ছে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীরা তা প্রচার করছেন। এই
দৃষ্টিভঙ্গির একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগত চর্চা হলো শুধু একটি বিশেষ
অঞ্চলে পাঠানো ‘শাস্তিমূলক’ বদলি। তাহলে আমরা ধরেই নিতে পারি, এটিই হলো এই
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে রাষ্ট্রের মূল দৃষ্টিভঙ্গি।
দুই.
পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে রাষ্ট্রের এ ধরনের মতাদর্শিক
বাহাস দীর্ঘদিনের। অথচ যে জায়গাকে কেন্দ্র করে সরকারি কর্মকর্তাদের বদলির
ভয় দেখানো হয়, সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতিতে উসকে দেওয়া হয়, সেই পার্বত্যাঞ্চলকে
কেন্দ্র করেই সরকার তৈরি করে পয়সা রোজগারের নানা পথঘাট। বিদেশি পর্যটকদের
আকৃষ্ট করতে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন পার্বত্য চট্টগ্রামের নানা বাহারি
ছবি দিয়ে সাজিয়েছে পর্যটন করপোরেশনের ওয়েবসাইট পেজ। রয়েছে নানা পোস্টকার্ড।
বাংলাদেশের কান্ট্রি ব্র্যান্ডিং ‘বিউটিফুল বাংলাদেশ’-এ স্থান পেয়েছে
পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চল এবং পাহাড়ি সংস্কৃতি। এই চর্চারই
সাম্প্রতিক সংস্করণ পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি নারীদের ছবি দিয়ে সাজানো
পোস্ট অফিস থেকে মুদ্রিত ডাকটিকিটের পসরা। সবই পর্যটনকেন্দ্রিক। পার্বত্য
চট্টগ্রামকে পুঁজি করে বাংলাদেেশ পর্যটনশিল্প বিস্তার ঘটাতে চাওয়াও অতি
পুরোনো। এর পাশাপাশি চলছে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘শাস্তি’ পাওয়ার জন্য যোগ্য
স্থান হিসেবে জারি রাখা। অনেকের কাছে আপাতত বিষয়টি গোলমেলে এবং বিরোধপূর্ণ
মনে হলেও এর পেছনে আছে রাজনীতি। স্বয়ং মন্ত্রী যখন পার্বত্য চট্টগ্রাম
সম্পর্কে এ ধরনের বয়ান প্রচার করেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম মানেই ভয়ের জায়গা
এই ধারণা জনমনে দেন, তখন সেই অঞ্চল এবং সেখানে বসবাসরত মানুষের প্রতি
সাধারণ নাগরিকদের নিঃসন্দেহে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়।
তিন.
বহু আগে আন্দামান দ্বীপে পাঠানো হতো রাজবন্দীদের।
আন্দামানে বসবাসই ছিল তাঁদের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি। বাংলাদেশেও সরকারি চোখে
একটি আন্দামান আছে, সেটি সাধারণ জনগণ না জানলেও সরকারি
কর্মচারী-কর্মকর্তাদের অজানা নয়। আর বাংলাদেশে সরকারের প্রমাণিত
দুর্নীতিগ্রস্ত কিংবা ‘সরকারের কথা না শোনা’ কর্মকর্তাদের শাস্তিস্বরূপ
পাঠানো হয় পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে। সন্দেহ নেই, এটি পার্বত্য
চট্টগ্রামবিষয়ক একটি নেতিবাচক ধারণারই ফল।
তবে প্রতিবাদ শুরু হয়েছে খোদ পার্বত্যাঞ্চল থেকেই। কিছুদিন আগে এ রকম আরও একটি খবর পড়েছিলাম প্রথম আলো পত্রিকাতেই।
খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরীর প্রবল আপত্তির মুখে বহুল
আলোচিত ‘বাঁশ পিডি’ সাদেক ইবনে শামছ সেখানে যোগ দিতে পারেননি। সেটিও ছিল
সেই পরিচিত ‘পানিশমেন্ট ট্রান্সফার’। সম্প্রতি ২ কোটি ৪১ লাখ টাকা ব্যয়ে
দর্শনা উদ্ভিদ সংগ নিরোধ কেন্দ্রের অতিরিক্ত কার্যালয়-কাম ল্যাবরেটরি ভবন
নির্মাণে রডের বদলে নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহারের ঘটনায় দুর্নীতি ধরা পড়ে এবং
তাতেই সাদেক ইবনে শামছকে খাগড়াছড়িতে বদলি করা হয়। কংজরী মারমা এ বিষয়ে
শুধু আপত্তি উত্থাপন করেই চুপ ছিলেন না, সরাসরি কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে
দিয়েছিলেন, তিনি সাদেক ইবনে শামছকে গ্রহণ করবেন না। তিনি আরও বলেছিলেন,
‘খাগড়াছড়ি ভালো মানুষের বাস। এখানে কোনো খারাপ মানুষের কর্মস্থল হতে পারে
না।’ একজন কংজরী চৌধুরী ফিরিয়ে দিয়েছেন সাদেক ইবনে শামছকে। কিন্তু সরকারের
মানসিকতা পাল্টাবে কে?
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments
Post a Comment