নান্যাচরে সেনাবাহিনীর নির্যাতনে গুরুতর আহত এইচএসসি পরীক্ষার্থী রমেল চাকমার মৃত্যু!


রাঙামাটির নান্যাচরে গত ৫ এপ্রিল ২০১৭, বুধবার সকালে সেনাবাহিনী কর্তৃক অন্যায়ভাবে আটক ও অমানুষিক নির্যাতনে গুরুতর আহত নান্যাচর কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী রমেল চাকমা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বুধবার (১৯ এপ্রিল) দুপুরে মারা গেছেন বলে একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে খবর পাওয়া গেছে। সেনাবাহিনীর নজরদারি ও পুলিশের পাহারায় দু’সপ্তাহ ধরে তিনি সেখানে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তবে লাশটি এখনো পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি।
রমেল চাকমা নান্যাচর উপজেলার পূর্ব হাতিমারা গ্রামের কান্তি চাকমার ছেলে। তিনি আংশিক দৃষ্টি প্রতিবন্ধীও।  ডানচোখে তিনি দেখতে পান না। এ বছর ২ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া এইচএসসি পরীক্ষায় তিনি অংশ নিয়েছিলেন এবং নান্যাচর উপজেলা পরিষদ এলাকায় বাসা ভাড়ায় থেকে পরীক্ষা দিচ্ছিলেন।

আটকের দিন (৫ এপ্রিল) পরীক্ষা না থাকায় রমেল চাকমা তরিতরকারি ও প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে নান্যাচর বাজারে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে বাসায় ফেরার পথে উপজেলা পরিষদ এলাকা থেকে আনুমানিক সকাল ১০টার সময় সেনাবাহিনীর নান্যাচর জোনের মেজর তানভির-এর নেতৃত্বে একদল সেনা সদস্য তাকে আটক করে টেনে হিঁচড়ে জোনে নিয়ে যায়। সেখানে নেওয়ার পর দিনভর তার উপর অমানুষিকভাবে শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়।
এতে রমেল চাকমা গুরুতর অসুস্থ ও অজ্ঞান হয়ে পড়লে সেনা সদস্যরা সন্ধ্যায় তাকে থানায় হস্তান্তরের চেষ্টা করে। কিন্তু থানার কর্তৃপক্ষ তার শারীরিক অবস্থা দেখে তাকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। এরপর সেনারা তাকে স্থানীয় উপজেলা হাসপাতালে ভর্তি করাতে চাইলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে সেখানে ভর্তি না করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণের পরামর্শ দেয়। সেনারা সেদিনই তাকে মুমুর্ষ অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে সেনা নজরদারি ও পুলিশী পাহারায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা গেলেন।

উক্ত ঘটনার পর রমেল চাকমার পিতা কান্তি চাকমা ছেলেকে নির্যাতনের বিচার চেয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের বরাবরে লিখিত আবেদন জানান। কিন্তু কমিশনের পক্ষ থেকে প্রতিকারমূলক কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এছাড়া তিনি নান্যাচর থানায়ও একটি লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছিলেন।
উল্লেখ্য,গত বৃহস্পতিবার (৬ এপ্রিল) জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের রাঙামাটি জেলা অফিসে গিয়ে কমিশনের চেয়ারম্যানের বরাবরে তার বাবা শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ করে এর বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আবেদন করেন।এতে তিনি (কান্তি চাকমা) বলেন, “আমার পুত্র রমেল চাকমা চলতি শিক্ষা বর্ষের এইচএসসি পরীক্ষার্থী, তার পরীক্ষার রোল নং-৩২৬১৭৯।

সে নানিয়াচর কলেজ থেকে এবারে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে। ০৫/০৪/২০১৭ খ্রিঃ বুধবার নানিয়াচর বাজারে হাটবার ছিল। ঐ দিন পরীক্ষা না থাকায় সে বাজারে বাজার করতে গিয়েছিল। তথ্য অনুযায়ী জানা গেছে যে, সে নানিয়াচর উপজেলা কার্যালয়ের দিকে যাবার পথে পার্শ্বোক্ত সেনা ক্যাম্পের [নানিয়াচর জোন, ৭ ই. বেঙ্গল রেজিমেন্ট, রাঙামাটি) সদস্যগণ আনুমানিক সকাল ১০ ঘটিকায় তাকে ধরে ক্যাম্পে নিয়ে যান।

সেখানে কোন প্রকার বাছ-বিচার না করে নির্বিচারে বেপরোয়াভাবে মারধর করেন। তাদের আঘাতে রমেল চাকমা অজ্ঞান হয়ে পড়লে নিকস্থ থানায় সৈন্যরা হস্তান্তর করার চেষ্টা করেন। কিন্তু রমেলের অবস্থা বেগতিক দেখে থানা হস্তান্তর গ্রহণে অস্বীকার জানান। পরে নিকটস্থ হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়ার জন্য সৈন্যরা নিয়ে গেলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে তাদের হাসপাতালে ভর্তি করে নাই।”

তিনি আরো বলেন, “আমার বাড়ি নানিয়াচর উপজেলা থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার ব্যবধান হওয়ায় এই দুঃসংবাদ আমার নিকট পৌঁছতে দেরী হয়ে যায়। বিলম্বে পাওয়া তথ্য মতে জানতে পারি যে, আমার পুত্র রমেল চাকমাকে বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সেনাবাহিনীর দ্বারা [নজরদারিতে] চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। জানিনা এখন সে কি অবস্থায় আছে।”

তিনি বলেন, “বিনা দোষে একজন পরীক্ষার্থী ছাত্রকে বেপরোয়া শারীরিক নির্যাতনে আমি একজন অভিভাবক হিসেবে অসহায় ও বিপদগ্রস্ত।  অমনিভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের আনাচে-কানাচে প্রায়ই সৈন্যরা ঘটনা ঘটাচ্ছেন বলে ধারণা করা যেতে পারে।”

তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, “পার্শ্বোক্ত সেনা ক্যাম্পের সৈন্যরা বিনা কারণে এমন অমানুষিক নির্যাতন করায় আমার পুত্রের অবস্থা সংকটাপন্ন হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাছাড়া তার শিক্ষা জীবনে দীর্ঘ মেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। অবশেষে তার অপূরণীয় ক্ষতি হলো।”

তিনি কমিশনের আইনানুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে দোষী সৈন্যদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণসহ যাবতীয় ক্ষতিপূরণের নিমিত্তে ন্যায়তঃ প্রতিকার বিধানের দাবি জানিয়েছেন।
এদিকে অদ্য, সেনাবাহিনী কর্তৃক অন্যায়ভাবে আটক ও অমানুষিক নির্যাতনে গুরুতর আহত নান্যাচর কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী রমেল চাকমা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বুধবার (১৯ এপ্রিল) দুপুরে মারা গেছেন বলে একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে খবর পাওয়া গেছে।
তথ্যসূত্র: ডেইলি সিএইচটি, প্রকাশিত: ২০১৭-০৪-১৯ ২০:৫৩:৩৮

No comments

Theme images by 5ugarless. Powered by Blogger.