এদেশের সংবিধান কি রমেল চাকমাদের জন্য নয়?

ড. কামাল হোসেনের ৮০তম জন্মদিন ছিল বৃহস্পতিবার। একাধিক অনুষ্ঠান ছিল, আমি সন্ধ্যার অনুষ্ঠানটিতে গিয়েছি, আমি আর আমার স্ত্রী। আমরা দুইজনেই ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে ওঁর ফার্মে কাজ করেছি, সেই সুবাদে আমন্ত্রিত। ড. হোসেনের সহকর্মী, ওঁর কন্যারা আর কয়েকজন বন্ধু মিলে একটি বড় হোটেলে অনুষ্ঠানটি আয়োজন করেছে। অনেক লোক এসেছিল সেখানে। সবাই যার যার ক্ষেত্রে বিশিষ্ট ব্যক্তি। সুপ্রিম কোর্টের জজ সাহেবেরা, বড় বড় উকিল, রাজনৈতিক নেতা, অর্থনীতিবিদ, পণ্ডিত, এনজিও প্রধান, সম্পাদক, শীর্ষ সাংবাদিক কে নেই!
এসেছিলেন ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম- ড. কামাল হোসেনের দীর্ঘদিনের বন্ধু। আমিরুল ইসলাম সাহেব আশিটি গোলাপ ফুলের একটি মালা নিয়ে এসেছেন ড. কামাল হোসেনের জন্যে। আরেকটি মালা এনেছেন ৪৫টি গাঁদা ফুলের। এই গাঁদা ফুলের মালাটির বৈশিষ্ট্য পরে বলছি। আমিরুল ইসলাম মালা পরিয়ে দিচ্ছেন ড. কামাল হোসেনকে। সে এক আবেগময় দৃশ্য। ইংরেজিতে ফাউন্ডিং ফাদার বলে একটা কথা আছে- এঁরা দুইজন হচ্ছেন আমাদের প্রিয় প্রজাতন্ত্রের ফাউন্ডিং ফাদারদের মধ্যে দুইজন। দুইজন একসাথে।
আমিরুল ইসলাম বললেন গাঁদা ফুলের মালাতে ফুল ৪৫টি কেন সেই কথা। আমাদের সংবিধানের ৪৫ বছর হয়েছে, এদের দুইজনের সারাজীবনের অন্যতম সেরা কাজ এই সংবিধান প্রণয়ন। আমিরুল ইসলাম ওঁদের দুইজনের এই অর্জনের হিসাবটি করে এই মালাটি এনেছেন। আমার বুক ধক করে ওঠে। রাজধানীর বড় একটি পাঁচতারা হোটেলে কয়েকশ বিশিষ্ট ব্যক্তির সমাবেশের একদম পেছনের সারিতে বসে আমি এই দুই বৃদ্ধকে দেখি।
চোখ ভরে আসে জলে। পারেননি ওরা ওদের স্বপ্ন বাস্তব করতে। সংবিধান এখন একটি প্রায় অর্থহীন আনুষ্ঠানিক পুস্তকে পরিণত হয়েছে। আইনের চোখে সমতা, সকলের জন্যে ন্যায়বিচার কিছুই হয়নি। রমেল চাকমাকে পিটিয়ে মেরেছে আর্মির লোকেরা। প্রায় নিশ্চিত জানি এর বিচার হবেনা। স্যার, ড. হোসেন স্যার, আমিরুল ইসলাম স্যার, আপনারা পারেননি- সে ব্যথা কি আপনাদের বুকে বাজে?

আমার বুকে বাজে, কাঁটার মত বিদ্ধ হয় আমাদের এই ব্যর্থতা। নান্যারচরের একটি কিশোর, রমেল চাকমা, সেই ছেলেটির কথা ভাবুন। আর্মির লোকেরা সকলের সামনে থেকে তুলে নিয়ে গেছে, ইচ্ছামত পিটিয়েছে ছেলেটিকে। ছেলেটির পরীক্ষা চলছিল। এইচএসসি পরীক্ষা। ওকে এমনভাবে পিটিয়েছে যে ওর মৃতপ্রায় অবস্থা হয়ে গেছে। ঝামেলা দেখে আর্মির লোকেরা চেষ্টা করেছে ওকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলতে। পুলিশ ওকে নেয়নি। মৃতপ্রায় একটি ছেলেকে নিয়ে ঝামেলা কাঁধে নেবেনা ওরা। আর্মিরা ওকে চিটাগাং মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে গেছে। চেষ্টা করেছে চিকিৎসা করে ওকে বাঁচাতে। পারেনি।
সকালে যখন অফিসে যাই, তখন খবর পেয়েছিলাম যে রমেল মারা গেছে। কিন্তু তখনো পর্যন্ত ওর লাশ পায়নি পরিবারের লোকেরা। আনুষ্ঠানিকভাবে ওদেরকে খবরও দেওয়া হয়নি। বিকেলে যখন অফিস থেকে বের হচ্ছি, রমেলের লাশ এসেছে ওর গ্রামে। ছবি দেখছিলাম ফেসবুকে, রাস্তা জুড়ে হাজার হাজার মানুষ চোখের জলে ভিজিয়ে ফুল দিচ্ছে ওর লাশবাহী গাড়িতে।
আর একটু আগে মাত্র খবর পেলাম, সেনাবাহিনীর লোকেরা নাকি ওর লাশটি ওর বাড়ীর উঠানে পৌঁছানোর আগেই ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। হতভাগা বাবা ওর পুত্রের লাশটাও পাবে না!
আমার লজ্জা লাগে। ক্রোধে গ্লানিতে আমার গা ঠাণ্ডা হয়ে আসে। অসহায় লাগে। এই বাচ্চা ছেলেটিকে পিটিয়ে মেরে ফেলল, আমি পঞ্চাশ পার হওয়া একজন প্রায় বুড়া হাবড়া ঢাকা শহরে আরামে গাড়ির ভিতর শীতল হাওয়ায় বসে ফেসবুকে লাশবাহী গাড়িতে ছুড়ে দেওয়া ফুলের সৌন্দর্য দেখি। নিজেকে নপুংসক ক্লীব কাপুরুষ মনে হয়। আমার সন্তানের বয়সী এই ছেলেটিকে যারা মেরেছে, ওদের নাম সবাই জানে, ওদের চেহারা সবাই চেনে, কিন্তু ওদের কোন বিচার হবে না। কোন বিচার হবে না।
আমার পুত্রসম এই ছেলেটিকে যারা মেরেছে, ওদের আমি কিছুই ছিঁড়তে পারবো না। একটা ফেসবুক পোস্ট দিব, একদিন মন খারাপ করে থাকবো, আর এর পরের উইকএন্ডে সন্ধ্যায় ঠিকই পার্টি করবো আর তারপর ভুলে যাবো। ধিক আমাকে। নিজের মুখে নিজেই থুথু মারতে ইচ্ছা করে। থুঃ।

ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম স্যার, আপনার কতো স্বপ্ন নিয়েই না সংবিধানে ২৭ নং অনুচ্ছেদ লিখেছিলেন, 'All citizens are equal before law and are entitled to equal protection of law'। আনিসুজ্জামান স্যার বাংলা করেছিলেন 'সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী'। হাহ, তামাশার মতো লাগে। আইনের দৃষ্টিতে সমান! পাহাড়ের সাধারণ আদিবাসীগুলি কোন দৃষ্টিতে আপনার সমান স্যার? সেনাবাহিনীর সামান্য একজন হাবিলদার পাহাড়ে যেন একেকজন রাজা-মহারাজা। সমান না কচু।
কি কায়দা করেই না আপনারা ৩১ নং অনুচ্ছেদে লিখেছিলেন, 'আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহারলাভ যে কোন স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষত: আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।' এটা নাকি মৌলিক অধিকার the protection of the law, and to be treated in accordance with law, and only in accordance with law!
এই যে ছেলেটাকে পিটিয়ে মেরে ফেলল, কোথায় ইকুয়ালিটি বিফোর ল? কোথায় রাইট টু বি ট্রিটেড ইন একরডেন্স উইথ ল? কি করেছিল রমেল? মানুষ মেরেছে? আরে, ও যদি তেত্রিশটা মানুষও খুন করে তবুও তো ওকে কেউ এইভাবে মারতে পারে না। আর এই ছেলে তো নির্দোষ, কোথাকার কোন পাহাড়ের চিপায় কোন এক কলেজের একটি সাধারণ ছাত্র, ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিচ্ছিল। গরীব বাবা মায়ের ছেলে। আইন কি ওকে আর দশজনের মত বা সমতলের একটি বাঙালি ছেলের মত সমান নজরে দেখবে? দেখবে না।
এই ঘটনা যদি আজকে ঢাকায় ঘটতো বা কুমিল্লায় বা রাজশাহীতে, তাহলে দেখতেন। সরকার তৎপর হতো, খবরের কাগজগুলি বড় বড় হেডলাইন করতো, টেলিভিশনে বড় খবর হতো। রমেলের জন্যে ইসব কিছুই হবে না। সমান না ঠ্যাঙ্গা।

রমেলকে যারা এইভাবে পিটিয়ে মেরে ফেললো, ওদের সম্ভবত কিছুই হবে না। কোন বিচার হবে না। সবাই সেই মেজর সাহেবের নাম জানে। কিন্তু দেখবেন আইন আদালত অপরাধীকে খুঁজেই পাবে না। কি করে পাবে? মরেছে তো আমার আদিবাসী কিশোর। ওর জীবনের আবার দাম কি? একটা চাকমা বাচ্চাকে ওরা পিটিয়ে মেরে ফেলল, এর জন্যে একজন মেজর বা একজন ক্যাপ্টেন বা এমনকি একটা সিপাহীর বিচার হবে? সে কি করে হয়? চাকমা ছেলে না হয় একটা মরেছেই, তার জন্যে একজন মেজরকে ধরবে পুলিশ? হাহ, সে কি হয় নাকি?
বুড়াগুলিকে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করে- ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম, প্রফেসর আনিসুজ্জামান স্যার, এইই চেয়েছিলেন আপনারা? এই সংবিধান লিখে কি লাভ হয়েছে আমাদের? পাহাড়ে আমার আদিবাসী কিশোর ছেলেটিকে ওরা মানুষ বিবেচনা করে? করে না। মানুষই বিবেচনা করে না, আবার সমান আর অসমান। ঐগুলি শুধু বইতেই লেখা থাকবে।
হয়না। আদিবাসী পাহাড়িদের ওপর অত্যাচারের বিচার হয়না। আমার বোন কল্পনাকে যে ধরে নিয়েছিল, সেই অফিসারটির নামও তো আমরা সকলেই জানি। কোন বিচার হয়েছে? হয়নি। লোগাং হত্যাকাণ্ড, বিচার হয়েছে? হয়নি। রমেল হত্যারও বিচার হবেনা।
তরুণ বন্ধুরা, সমতলের বাঙালি বন্ধুরা, ঐ যে আগে নাম বললাম, এইসব বৃদ্ধ ভদ্রলোকেরা, এঁরা তো চেষ্টা করেছেন। একটা সংবিধান বানিয়ে, আইন করে বিধানগুলি তৈরি করেছেন। আমরা ওদের পরের প্রজন্ম, আমরা কি করেছি? আপনারা, আমাদের পরের প্রজন্ম, আপনারা কি করেছেন? একটু কি চোখ খুলবেন? দেখবেন আমাদের পাহাড়ে কি হচ্ছে? দেখবেন? দেখবেন আমাদের পাহাড়ি ভাইদের সাথে বোনদের সাথে, ছেলেমেয়েদের সাথে কি আচরণ করছে আমাদের রাষ্ট্র?

তরুণ বন্ধুরা, তরুণ বাঙালি বন্ধুরা, সমতলের বন্ধুরা, এখনো সময় আছে কিনা জানিনা- তবুও সোচ্চার হোন প্লিজ। নাহলে এই অপরাধ, এই পাপ, এই অপরাধের গ্লানির দায় আমাদের সবাইকে বহন করতে হবে। আমাদের সবাইকে। এই অপরাধের দায় থেকে কেউ রেহাই পাবেন না।
ইমতিয়াজ মাহমুদ, এডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট। ইমেইল: mahmood.imtiaz@gmail.com 
তথ্যসূত্র:sylhettoday24.com প্রকাশিত : ২০১৭-০৪-২১ ০০:৫২:২৬

No comments

Theme images by 5ugarless. Powered by Blogger.