মরদেহ সৎকার প্রক্রিয়া আধুনিকায়ন

সুমনপ্রিয় থেরো::
উন্মুক্ত মতামত গ্রহণ: পর্ব- ১
সামাজিক পরিবর্তন দ্রুতই গতিশীল, যা থেমে থাকার নয়। সচেতন ব্যক্তি মাত্রই এই পরিবর্তন উপলব্ধি করতে পারেন। বিশ্বব্যাপী মরদেহ সৎকার একটি অত্যন্ত পবিত্র ও পূন্যচেতনা নিয়ে সম্পন্ন করা হয়, যা বাংলাদেশেও ব্যতিক্রম নয়। বর্তমান আধুনিক বিশ্বে অনেক কিছুরই পরিবর্তন হচ্ছে, যেমন : দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, চিন্তা-চেতনা, খাদ্যাভাস ইত্যাদি। তাই সামাজিক কর্মকা-কে যুগোপযুগী একান্ত প্রয়োজন। বৌদ্ধ
পালি সাহিত্যে কালামা সূত্রে বলা হয়েছে- যাহা কিছু মানুষের জীবন ধারণের অনুপযোগী সংস্কার বিদ্যমান তা সত্তর পরিবর্তন করা উচিত। তিরোকুড্ড সূত্রে বলা হয়েছে-“নহি রুণœং বা সোকো বা যা চ’ঞ্ঞা পরিদেবনা, ন তং পেতানমত্থায এবং তিট্ঠন্তি ঞাতযো।” অর্থাৎ মৃতের জন্য রোদন, শোক কিংবা বিলাপ করলে মৃত ব্যক্তির কোন উপকার হয় না। তাই অপসংস্কৃতি রোধ করা প্রয়োজন। কোন কোন পরিবারে বয়োজ্যেষ্টরা অপসংস্কৃতিতে উৎসাহিত করে। অপসংস্কৃতি বলতে যেমন- শ্বাশুড়ি মা উত্তরসূরী ছেলের স্ত্রীদের বলতে শুনি, “তোমার আত্মীয় মারা গেল, তুমি/তোমরা আরো বেশী কান্না করে চোখের জল ফেলে শেষ বিদায় দিতে পারলে না? অলক্ষুনে মেয়ে, ইত্যাদি।” চোখের জল ফেলে কুশল কামনা করা আদৌ শাস্ত্রগত কোন ভিত্তি নেই।
বৌদ্ধিক রীতি-নীতিকে অনুসরণ করে মৃতদেহ সৎকার বাংলাদেশের একটি পুরাতন ঐতিহ্য। তাই বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে আধুনিক সমাজের গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি চালু করা প্রয়োজন বলে মনে করছি। সাধারনত মৃতদেহ সৎকারের তিনটি পর্যায় রয়েছে, যথা:
ক) স্নান কার্য সম্পন্ন করে সাদা কাপড় পরানো।
খ) পূজনীয় ভিক্ষুসংঘ ও সম্মানিত জ্ঞাতিবর্গের উপস্থিতিতে ধর্মীয় কার্য সম্পন্ন করা ।
গ) শ্মশানে নিয়ে দাহকার্য সম্পন্ন করা।
আমরা জানি যে, কোন ব্যক্তি মৃত্যুর পর অনিত্যানুষ্ঠান সম্পন্ন করার জন্য ভিক্ষুসংঘ এবং জ্ঞাতিবর্গকে আহ্বান করা হয়। ভিক্ষুসংঘের সম্মুখে মৃত ব্যক্তিকে উন্মুক্ত অবস্থায় খাটের ওপর রাখা হয়। অনিত্যানুষ্ঠান সম্পন্ন হতে ১-২ ঘন্টা বা তারও অধিক সময়ের প্রয়োজন হয়। মৃতদেহ ২৪ ঘন্টার পূর্বে দাহ করা উচিত, অধিক সময় রাখলে ভীষণ দূর্গন্ধ ছড়ায়। কিন্তু আমাদের সমাজ প্রেক্ষাপটে অধিক সময়ের প্রয়োজন হয়, কারণ
দূর-দূরান্ত হতে জ্ঞাতিপরিজন দর্শন করতে আসে, আনুষ্ঠানিকতা ও অন্যান্য ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি।
যার ফলশ্রুতিতে অনিত্যানুষ্ঠানে মৃতদেহ হতে ভীষণ দূর্গন্ধ ছড়ায়, তখন ভিক্ষুসংঘ নিরুপায় হয়ে নাক চেপে ধরতে বাধ্য হয়, অন্যত্র সরে যায় বা অনুষ্ঠান শেষ না হতে চলে যায়, যা অনুষ্ঠানে খুবই অশোভনীয়।
লক্ষ্যনীয় যে, পূজনীয় ভিক্ষুসংঘ ধর্মদেশনার মাধ্যমে ক্রন্ধন না করার জন্য যতই বারণ করুক না কেন, সেই ধর্মদেশনাকে খুববেশী গুরুত্ব দেয়া হয় না। অনিত্যসভা শেষ হতে না হতেই মৃতদেহের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে ক্রন্ধন করার প্রবণতা বেশী দেখা যায়।
মৃতদেহ সৎকারের পদ্ধতি:
মৃতদেহ সৎকারের দু’টি পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে, যথা:
(১) উন্মুক্ত পদ্ধতি ঃ মৃত ব্যক্তিকে সাদা কাপড় পরিধান করিয়ে খাটের ওপর শুয়ে রাখা।
(২) বদ্ধ বা বক্স পদ্ধতি ঃ মৃত ব্যক্তিকে সাদা কাপড় পরিধান করিয়ে বক্সের ভেতর রাখা।
আবার কোন কোন অঞ্চলে অর্ধ-বক্স পদ্ধতি দেখা যায়, এই পদ্ধতিতে মৃত ব্যক্তিকে সাদা কাপড় পরিধান করিয়ে বক্সের ভেতর রাখা হয় এবং বক্সের উপরিভাগ উন্মুক্ত বা খোলা রাখা হয়। সমাজের দীর্ঘদিনের প্রচলিত পদ্ধতি হচ্ছে উন্মুক্ত পদ্ধতি। বদ্ধ বা বক্স পদ্ধতি শুধুমাত্র ভিক্ষুসংঘের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।
উন্মুক্ত ও বক্স পদ্ধতির সুবিধা- অসুবিধা ঃ
উন্মুক্ত পদ্ধতির সুবিধা সমূহ:
১. দীর্ঘদিনের প্রচলিত পদ্ধতি হচ্ছে উন্মুক্ত পদ্ধতি।
২. মরদেহ দূর থেকে দৃশ্যমান।
৩. মরদেহের ওপর সরাসরি পুষ্পমাল্য/শ্রদ্ধান্জলি প্রদান করা যায় (যা একান্তই অনুচিত)।
উন্মুক্ত পদ্ধতির অসুবিধা সমূহ:
১. উন্মুক্ত পদ্ধতি বিজ্ঞান সম্মত পদ্ধতি নয়।
২. আধুনিক সমাজের গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি নয়।
৩. সহজে দূর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে।
৪. দূর থেকে দৃশ্যমান যা অনেকের ক্ষতির কারণ হয়ে পড়ে।
৫. ছোট ছেলে-মেয়েদের মানসিক সমস্যা দেখা দেয়।
৬. মরদেহে অধিক পরিমানে সূগন্ধিদ্রব্য (স্প্রে) ছিটানো হয়, যা অন্যদের ক্ষতির কারণ হয় এবং ঘ্রাণ ইন্দ্রিয় দূর্বল হয়ে পড়ে।
৭. শারীরিক ও মানসিক দীর্ঘমেয়াদী রোগ সৃষ্টি হয়।
৮. মৃতদেহ সরাসরি দৃশ্যমান হওয়ায় জ্ঞাতিবর্গের শোক ও ক্রন্ধন বেড়ে যায়, যা বৌদ্ধ মতে সম্পূর্ণ নিষেধ।
৯. ক্রন্ধনরত অবস্থায় অজ্ঞান হয়ে পড়া বা মৃত্যু বরণ করা।
১০.অনুষ্ঠানে শৃঙ্খলা ভঙ্গ হয়ে পড়ে।
১১. দূর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়লে ভিক্ষুসংঘ নাক চেপে ধরতে বাধ্য হয়।
১২. বার্ধক্য ও জরাগ্রস্থ ব্যক্তির বিকৃত চেহারা সরাসরি দৃশ্যমান হওয়ায় অনিত্যানুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার প্রবণতা কমে যায়।
১৩.মৃতদেহ সরাসরি দৃশ্যমান হওয়া, গর্ভবতী মহিলাদের জন্য অন্তরায় সৃষ্টির সম্ভাবনা থাকে।
১৪.আলং (মৃতদেহ বহন করার যান বিশেষ) তৈরিতে দীর্ঘ সময় ও বেশী শ্রমিকের প্রয়োজন হয়।
১৫.দীর্ঘক্ষণ রাখা যায় না।
বদ্ধ বা বক্স পদ্ধতির সুবিধা- অসুবিধা সমূহ ঃ
বক্স পদ্ধতির সুবিধা সমূহ :
১. বদ্ধ বা বক্স পদ্ধতি বিজ্ঞানসম্মত ও আদর্শ পদ্ধতি।
২. বক্স পদ্ধতি সৌন্দর্য ও আকর্ষনীয়।
৩. বাইরে দূর্গন্ধ ছড়ায় না।
৪. দীর্ঘক্ষণ রাখা যায় (১ ঘন্টার বেশী রাখা উচিত নয়)।
৫. উন্নত বিশ্বে গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি।
৬. একটি বক্স দীর্ঘদিন ব্যবহার করা হয়।
৭. অধিকতর সৌন্দর্য ও দৃষ্টিনন্দন করার জন্য বক্সের কভার পরিবর্তন করা যায়।
৮. স্বল্প খরচে বক্সের কভার তৈরী করা যায়, যেমন: সুদৃশ্য কাগজ, কাপড় ইত্যাদি।
৯. বিত্তবান যে কেউ সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে একটি বক্স দান করতে পারেন।
১০.স্বল্প খরচে বা বিনা খরচেও মরদেহ সৎকার করা যায়।
১১. আর্থিকভাবে অসচ্ছল পরিবারও উত্তমরূপে অনিত্যানুষ্ঠান করতে পারে।
১২.নির্ভয়ে মৃতদেহ দেখার আগ্রহ বাড়ে।
১৩.অনিত্যানুষ্ঠানে সকলের উপস্থিতি নিশ্চিত করা যায়।
১৪.পরিশ্রম ও সময় কম লাগে।
১৫.প্রতিবার অধিক অর্থের প্রয়োজন হয় না।
১৬.সবাই মিলে সহজে একটি সুদৃশ্য বক্স তৈরী করতে পারে।
১৭.অনিত্যসভায় ক্রন্ধন রোধের সহজ উপায়।
১৮.সহজে বহন করা যায়।
১৯. দর্শনার্থীর দেখার সুবিধার্থে বক্সের উপরিভাগে কাঁচ (উন্ডো আকৃতি) ব্যবহার করা।
২০.অনিত্যসভায় বক্সের পাশে মৃতব্যক্তির সুদৃশ্য ছবি রাখা যায় ইত্যাদি।
২১.অনিত্যসভায় বক্স (মৃতদেহ) ভিক্ষুসংঘের সম্মুখে না রেখে নির্দিষ্ট দূরত্বে রাখা যায়, যা নিচের ছবিতে
দেখানো হয়েছে।
২২.অনিত্যসভার সুদৃশ্য স্মৃতি (ছবি) দীর্ঘদিন রাখা যায়।
বক্স পদ্ধতির অসুবিধা সমূহ:
১. এককালিন অর্থের প্রয়োজন হয়।
২. দীর্ঘদিন বক্স সংরক্ষণ করতে হয়।
পরিশেষে বলতে চাই, আমাদের সমাজ ব্যবস্থা আগের তুলনায় বর্তমানে অনেক উন্নত হতে সক্ষম হয়েছে। শিক্ষা, অর্থনৈতিক, ব্যবসা-বাণিজ্য, বৈদেশিক অর্থ উপার্জনে, সর্বক্ষেত্রে অবদান রাখতে সক্ষম হচ্ছে। আসুন সবাই মিলে সত্য, সুন্দরের পূজারী হই। সুস্থ্য, সুন্দর, সু-পরিকল্পিত সমাজ গঠন করি।
সবার জয়মঙ্গল কামনা করছি।
আদর্শ ও উদ্দেশ্য ঃ
১. আদর্শ ও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে মৃতানুষ্ঠান সম্পন্ন করা।
২. বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি অনুসরণে জনসচেতনতা সৃষ্টি ও সুশৃঙ্খল সমাজ গঠন করা।
৩. বুদ্ধের শিক্ষাকে আরো বেশী হৃদয়ঙ্গম করা।
৪. পিতা-মাতা, গুরুজন বা আত্মীয়পরিজনের অনিত্যসভা সাড়ম্বরে, দৃষ্টান্তের মাধ্যমে সম্পন্ন করা।
৫. বৌদ্ধ বিশ্বকে অনুস্মরণ করা।
৬. সুশৃঙ্খলভাবে অনিত্যসভা সম্পন্ন করা।
কর্মপদ্ধতি/ ধাপ সমূহ ঃ
১. বৌদ্ধ জনসাধারণের মনোভাব যাচাই- ১ম পর্ব।
২. পর্যালোচনা ও সিদ্ধন্ত গ্রহণ- ২য় পর্ব।
৩. বাস্তবে রূপদান- ৩য় পর্ব।
যোগাযোগ :
Email ID: Cremac2016@gmail.com Facebook ID: Cremation Crema
তথ্যসূত্র: CSB24.Com,  মার্চ ০১, ২০১>৬

Share this:

No comments

Theme images by 5ugarless. Powered by Blogger.