উজ্জ্বল মুখ, তৃষ্ণা ও অনুপকুমার চাকমা
২০০৩ সালে খাগড়াছড়িতে বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রতিভা অন্বেষণের আবিষ্কার তৃষ্ণা চাকমা। পরের বছর দক্ষিণ কোরিয়ায় এএফসি অনূর্ধ্ব-১৭ চ্যাম্পিয়নশিপ দিয়ে পথচলার শুরু বাংলাদেশ ফুটবলে। এরপর একটা একটা করে ধাপ পেরিয়ে হয়ে যান মহিলা ফুটবল দলের অধিনায়ক। ২০১০ সালে কক্সবাজারে প্রথম সাফ মহিলা ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ তৃতীয় হয় দেশসেরা এই ডিফেন্ডারের নেতৃত্বে। বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ২০১২ সালে শ্রীলঙ্কার কলম্বোয় অনুষ্ঠিত সাফের দ্বিতীয় আসরেও। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি হয়েছে দুবার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন। শেখ জামাল ধানমণ্ডি ক্লাব ২০১১ সালে ঢাকা মহানগরী ক্লাব লিগ চ্যাম্পিয়ন ও শেলটেক করপোরেট লিগে রানার্সআপ হয় তৃষ্ণার জাদুকরী ফুটবলেই। এরপর ২০১৩ সালে তৃষ্ণা নাম লিখিয়েছিলেন মোহামেডানে। মেয়েদের ফুটবলের প্রত্যাশামতো উন্নতি না হওয়ায় তৃষ্ণার আক্ষেপ, ‘সেই ২০০৭ সালে জেলা ফুটবল লিগ করেছিল মহিলা ক্রীড়া সংস্থা। এরপর খবর নেই। শেখ জামালের মতো দলও শিরোপা জেতার পর ২০১৩ সালের লিগ খেলেনি। বেশি দল নিয়ে লিগ নিয়মিত হলে আর মহিলা ক্রীড়া সংস্থা টুর্নামেন্ট আয়োজন করলে দ্রুত উন্নতি করতাম আমরা।’ ফুটবলের পাশাপাশি তৃষ্ণা ভালো খেলেন ভলিবলও। বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপির হয়ে তিনবার জাতীয় ভলিবল চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়ে শিরোপা জিতেছেন দুবার। তবে সবচেয়ে বড় অর্জন হয়তো ফুটবল খেলে সংসার চালানো যায়—এই ধারণাটি পাহাড়ি মেয়েদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া। তাই তৃষ্ণাকে অনুসরণ করে ফুটবলে নাম লিখিয়েছে খাগড়াছড়ির অনেকে। একটা সময় তো জাতীয় দলের অর্ধেকই থাকত এই জেলার।
ক্রিকেটে জেলার অন্যতম প্রতিভাবান তরুণ ছিলেন মুজাহিদ চৌধুরী বাবু। কিন্তু পাহাড়ের বাঘের গর্জন পৌঁছেনি ঢাকায়। ২০০৭ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ জাতীয় দলের ক্যাম্পে ডাক পেয়েও থাকা হয়নি চূড়ান্ত তালিকায়। অথচ তাঁরই বন্ধু সাব্বির রহমান এখন জাতীয় দলের নিয়মিত মুখ। বন্ধুকে শুভ কামনা জানিয়ে কিছুটা আফসোস ঝরল মুজাহিদের কণ্ঠে, ‘অনেক স্বপ্ন ছিল পাহাড়ি এই অঞ্চল থেকে প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে জাতীয় দলে খেলার। সব স্বপ্ন তো আর পূরণ হয় না।’ নিজের অপূর্ণ স্বপ্ন পূরণ করতে মুজাহিদ চৌধুরী গড়ে তুলেছেন খাগড়াছড়ি ক্রিকেট একাডেমি। ৫০ জন ক্রিকেটার নিয়ে ১২-১২-১২ তারিখে যাত্রা শুরু করা এই একাডেমি নিয়েই এখন দিন কাটছে তাঁর। পাশাপাশি বিসিবি তাঁকে কোচ নিয়োগ করেছে খাগড়াছড়ি জেলা ক্রিকেট দলের।
২০০৯-১০ মৌসুমে ইন্দিরা রোডের হয়ে ঢাকা প্রথম বিভাগ লিগে খেলেছিলেন মুজাহিদ চৌধুরী বাবু। এই অলরাউন্ডার চট্টগ্রাম লিগে দীর্ঘ দিন খেলেছেন ফ্রেন্ডস ক্লাবে। খাগড়াছড়িতে স্থানীয় পর্যায়ে ২০০২ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ক্রিকেট লিগ না হওয়াটাও তাঁর পিছিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। এখন ক্রিকেট ফেরায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ঝরল বাবুর কণ্ঠে, ‘নতুন কমিটি দায়িত্ব নেওয়ার পর খেলার পরিবেশ ফিরে এসেছে। এটাই বড় কথা। এ জন্য আমার একাডেমিও অনেকে ভালো করছে।’
এই ভালো করাদের অন্যতম অলরাউন্ডার আল মুমিন। অনূর্ধ্ব-১৬ জাতীয় দলে খেলার পর ৫ ফুট ৮ ইঞ্চির এই ক্রিকেটার ডাক পেয়েছিলেন অনূর্ধ্ব-১৭ দলের ক্যাম্পেও। এ ছাড়া মেয়েদের ক্রিকেটে রায়েরবাজারের হয়ে খেলেছেন এই একাডেমির সুমিতা চাকমা।
আশির দশক থেকে খাগড়াছড়ি জেলা ফুটবল দলে ২০ বছর খেলেছেন তুহিন কুমার দে। চট্টগ্রাম লিগে দীর্ঘ দিন খেলেছেন পিডিবি ও ওয়াপদায়। ১৯৯১ সালে সুযোগ পেয়েছিলেন জাতীয় অনূর্ধ্ব-১৬ দলেও। সেবার ম্যানিলা যাওয়ার কথা থাকলেও ফিলিপাইনের রাজনৈতিক সমস্যার কারণে বাতিল হয়েছিল সফরটা। একটা সময় ডাক পেয়েছিলেন জাতীয় দলের ক্যাম্পেও। ফুটবলার হলেও তুহিন কুমার দের জাতীয় পদক আছে আবার অ্যাথলেটিকসে! ১৯৮৯ সালে বয়সভিত্তিক অ্যাথলেটিকসের ১০০ মিটারে পেয়েছিলেন রুপা। খাগড়াছড়ির জেলা অ্যাথলেটিকসে দ্রুততম মানবও ছিলেন ছয় বছর। এখন তুহিন কুমার দে দায়িত্ব পালন করছেন জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদকের।
ফুটবল, সাইক্লিং, ব্যাডমিন্টন, টেবিল টেনিস, ভলিবল, অ্যাথলেটিক্স—সবখানেই পদচারণা ছিল অনুপ কুমার চাকমার। জেলার ফুটবলে আলো ছড়িয়ে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম একাদশে খেলার সুযোগ পান ১৯৭৮ সালে। ১৯৮১ সালে কুমিল্লা বোর্ড একাদশের হয়ে শক্তিশালী ঢাকা বোর্ড একাদশকে হারানোর স্মৃতি হাতড়ে এখনো গর্ব হয় তাঁর। পার্বত্য অঞ্চলের অ্যাথলেটিকসে ১০০, ২০০ ও ৪০০ মিটারে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন একাধিকবার। ভলিবল, টেবিল টেনিস, সাইক্লিং, ব্যাডমিন্টনেও আছে সাফল্য। ১৯৮৬ সালে সরকারি চাকরিতে যোগদানের পরও তিনি ফুটবল, ভলিবলে কোচিং নিয়েছেন। এখন দায়িত্ব পালন করছেন জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির। বাফুফের এই কাউন্সিলর জেলা রেফারি অ্যাসোসিয়েশন ও ফুটবল কোচেস অ্যাসোসিয়েশনেরও সভাপতি। জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের দায়িত্বে থাকতেই খাগড়াছড়িতে প্রথমবারের মতো জাতীয় মহিলা ফুটবলের ভেন্যু আনতে সমর্থ হয়েছিলেন অনুপ কুমার চাকমা। জেলা ক্রীড়া সংস্থার বেশির ভাগ কর্তা তাঁরই ছাত্র।
এ ছাড়া রূপায়ন চাকমা, ক্যহ্লাচাই চৌধুরী, একে মগ, বিশ্বজিৎ চাকমা, মোহাম্মদ আলী, রুপন দে, নুরুল আজমরাও উজ্জ্বল মুখ ছিলেন খাগড়াছড়ির ক্রীড়াঙ্গনে।
তথ্যসূত্র: কালের কন্ঠ,
No comments
Post a Comment