নিরলস গবেষণার স্বীকৃতি পেলেন মংছেনচীং

পাহাড় ও সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে প্রথম ব্যক্তি হিসেবে একুশে পদক পাচ্ছেন মংছেনচীং মংছিন
খাগড়াছড়ি জেলার মহালছড়ি উপজেলা সদরের উত্তর–পশ্চিমে পাহাড়ের মধ্যে মানিক ডাক্তারপাড়া। সেখানে টিন আর বাঁশের তৈরি পুরোনো ছোট একটি বাড়ি। বাড়ির বসার ঘরে কয়েকটি আলমারি বোঝাই বই এবং দেশি–বিদেশি পত্রপত্রিকা। বোঝাই যায়, এখানে বসবাস করেন বইপাগল মানুষ। আর বইপাগল মানুষটি হলেন এ বছর একুশে পদকের জন্য মনোনীত মংছেনচীং মংছিন। গবেষণায় অবদান রাখার জন্য দেশের পাহাড় ও সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে প্রথম ব্যক্তি হিসেবে এই পদক পাচ্ছেন তিনি।
১৬ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২টার দিকে ওই বাড়ির ভেতর ঢুকতেই মংছেনচীং ও তাঁর স্ত্রী শোভা রানী আন্তরিক অভ্যর্থনা জানান। ২০ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে একুশে পদ নিতে ঢাকায় যাবেন তাঁরা। তারই প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন। কেমন লাগছে জানতে চাইলে মংছেনচীং বলেন, ‘একুশে পদক পাওয়ায় খুবই খুশি। আমি দীর্ঘদিন ধরে সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চা ও গবেষণায় জড়িত। আগেও পদক পেয়েছি। তবে এ ধরনের সম্মানজনক রাষ্ট্রীয় পদক এই প্রথম। আমি সরকারকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’
মংছেনচীং মংছিন ছাত্রজীবনে বিভিন্ন দেশি–বিদেশি পত্রপত্রিকায় রাখাইন জাতির ইতিহাস, ধর্ম,
মংছেনচীংয়ের স্ত্রী শোভা রানী ত্রিপুরাও দীর্ঘদিন লেখালিখির সঙ্গে জড়িত। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১২। তিনি জানান, তাঁদের দুজনের গবেষণা ও সাহিত্য বিষয়ে বেশ কিছু অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি রয়েছে।
লেখালিখির পরিচয় সূত্রে সমুদ্র উপকূল কক্সবাজারের ছেলে মংছেনচীং মংছিনের সঙ্গে পাহাড়ের মেয়ে শোভা রানী ত্রিপুরার পরিচয় হয়। সে সূত্র ধরেই ১৯৮৪ সালে বিয়ে করেন তাঁরা। রাখাইন ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বন্ধনের প্রতীক যেন তাঁরা দুজন। আর সে কারণেই মহালছড়ির মানিক ডাক্তারপাড়ায় তাঁদের বাড়ির সামনেই পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের অর্থায়নে তিন কক্ষবিশিষ্ট মহালছড়ি রাখাইন-ত্রিপুরা প্রকাশনা সমিতি ভবন নির্মিত হয়েছে। ভবনের তিনটি কক্ষেই রয়েছে প্রচুর বই। রয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, রবীন্দ্র-নজরুলসহ বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত কবি সাহিত্যিকদের ছবি।
মংছেনচীংয়ের পরিবারে রাখাইন সাহিত্য ও সংস্কৃতির দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। মা–বাবা ও ভাইবোন সবাই সাহিত্য ও সমাজসেবায় যুক্ত ছিলেন। তিনি জানান, তাঁর মা–বাবা এবং চার ভাই, এক বোনের কেউ আর বেঁচে নেই। মংছেনচীং মংছিন ১৯৬১ সালের ১৬ জুলাই কক্সবাজার পৌরসভার চাল বাজার সড়কের সম্ভ্রান্ত রাখাইন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার উ অংচাথোয়েন ও মা উ মাক্যচীং। পাঁচ ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। তাঁর স্ত্রী শোভা ত্রিপুরা মহালছড়ি উপজেলার চৌংড়াছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তাঁদের দুই মেয়ের মধ্যে জ্যেষ্ঠ কন্যা উ এনু বিবাহিত। তিনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। ছোট মেয়ে চেন চেননু একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে পড়াশোনা করছে।
সংস্কৃতি, সাহিত্য, কৃষ্টিসহ নানা বিষয়ে লেখালেখি শুরু করেন। উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর তিনি বাইবেল বিষয়ে ডিপ্লোমা পাস করেন। ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের পপুলেশন কনসার্ন পরিচালিত রাখাইন সমন্বিত পরিবারকল্যাণ প্রকল্পের কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলার প্রকল্প পরিদর্শক পদে কর্মরত ছিলেন তিনি। এ ছাড়া বাংলাদেশ বেতারের জন্য কথিকা লেখেন ও পড়েন তিনি। তিনি ঢাকাস্থ বাংলাদেশ গ্রামীণ লোকসাহিত্য সোসাইটি ও বিশ্ব বাংলা সাহিত্য পরিষদের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর উৎসব ও সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা গ্রন্থসহ তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১৭। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের বইও সম্পাদনা করেছেন তিনি। বর্তমানে রাখাইন সাময়িকীর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। রাঙামাটি থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বনভূমি ও দৈনিক গিরি দর্পণ পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত আছেন।

তথ্যসূত্র: প্রথম আলো, হরি কিশোর চাকমা, রাঙামাটি | আপডেট: |

No comments

Theme images by 5ugarless. Powered by Blogger.