বৌদ্ধধর্ম ও আজকের বিশ্ব
আজ সর্বত্র বিজ্ঞানের বিজয় বৈজয়ন্তী। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অভূতপূর্ব অগ্রগতি হওয়া সত্ত্বেও নানা সমস্যায় জর্জরিত আজকের বিশ্ব। ক্ষুধা-দারিদ্র্য তো আছেই, তার সাথে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে হিংসা-বিদ্বেষ, দ্বন্ধ-সংঘাত, যুদ্ধ-হানাহানি প্রভৃতি। বলা বাহুল্য, বিশ্বের সমকালীন আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ হতাশাব্যঞ্জকভাবে উত্তপ্ত ও অশান্ত। এটা বিশেষভাবে উদ্বেগজনক এ কারণে যে, শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিশ্ব ইতিহাস এক ব্যর্থতার ইতিহাস।
মাত্র পঁচিশটি বছরের ব্যবধানে দু’দুটো বিশ্বযুদ্ধ মানবসভ্যতার ইতিহাসকে কলঙ্কিত করে রেখেছে চিরতরে। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় যথেষ্ট সুযোগ ছিল, প্রচেষ্টাও যে ছিল না তা নয়; কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯১৯ সালে স্থাপিত জাতিসংঘ (League of Nations) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে রোধ করতে পারেনি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ১৯৪৫ সালে স্থাপিত সম্মিলিত জাতিসংঘ (UNO) বিশ্বকে তৃতীয় মহাযুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হলেও এ পর্যন্ত একাধিক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ যেমন ভিয়েতনাম যুদ্ধ। আরব-ইসরাইল যুদ্ধ, ইরান-ইরাক যুদ্ধ, পাক-ভারত যুদ্ধ এবং সামপ্রতিককালে আমেরিকা কর্তৃক ইরাক-আক্রমণ রোধ করা সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে যে স্নায়ুযুদ্ধ (Cold war) বিদ্যমান ছিল, তাতে সমগ্র বিশ্ববাসী তৃতীয় মহাযুদ্ধের ভয়ে ছিল আতঙ্কিত। সে স্নায়ুযুদ্ধের এখন অবসান ঘটেছে ঠিকই; কিন্তু আমেরিকার সাথে ইরান ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে বিদ্যমান দ্বন্ধ এখনো বিশ্বশান্তির জন্য এক বড় হুমকি।
বিশ্ব রাজনীতির জগৎ আজ নানা কারণে এবং নানাভাবে দ্বিধাবিভক্ত। ধনী ও ক্ষমতাবান রাষ্ট্র বা নেতৃবৃন্দ বিশ্ব-অর্থনীতিকে পরিচালিত করে এবং বিশ্বের দেশসমূহ আজ বিভিন্ন অর্থনৈতিক ফোরামে বিভক্ত। উন্নত-উন্নয়নশীল, অনুন্নত বা স্বল্প উন্নত দেশসমূহের মধ্যে ব্যবধান আশঙ্কাজনকভাবে দিন দিন বেড়েই চলেছে।
শুধু রাজনৈতিক দ্বন্ধ বা অর্থনৈতিক বৈষম্য নয়, আজকের বিশ্বে অশান্ত ও অস্থির পরিস্থিতির পিছনে ধর্মের যে একটা দুঃখজনকভাবে নেতিবাচক ভূমিকা রয়েছে, তা নিঃসন্দেহে খুবই উদ্বেগজনক। ধর্মে ধর্মে সংঘাত যে কত মারাত্মক ও ধ্বংসাত্মক হতে পারে তার বড় প্রমাণ হলো প্রায় দু’শো বছর (১০৯৬-১২৭০) ধরে পবিত্র জেরুজালেমকে কেন্দ্র করে মুসলিম-খ্রিষ্টানদের মধ্যে ক্রুশেদ বা ধর্মযুদ্ধ; উত্তর আয়ারল্যান্ডে দীর্ঘ ষোল বছর (১৯৬৮-১৯৯৪) ক্যাথলিক ও প্রোটেষ্টাইন খ্রিষ্টানদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ এবং পনের বছর (১৯৭৫-১৯৯১) ধরে লেবাননের খ্রিস্টান ও মুসলিম সমপ্রদায়ের মধ্যে আত্মঘাতী যুদ্ধ। এখন আর ক্রুশেদ নেই সত্যি, কিন্তু পবিত্র জেরুজালেমকে নিয়ে প্যালেষ্টাইন ও ইসরাইলের মধ্যে বিরাজমান রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ এখনো সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ। শুধু তা নয়, ইরান-ইরাকসহ আমাদের এ উপমহাদেশে শিয়া-সুন্নি-আহম্মদীয়া এবং হিন্দু-মুসলিম সমপ্রদায়ের মধ্যে অন্তর্নিহিত হিংসা-বিদ্বেষ ধর্মীয়-সম্প্রীতির পথে এক বিরাট অন্তরায়।
এখানে বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে যে, বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে, এমনকি একই ধর্মের বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে যে সংঘাত ও হানাহানি, তা কিন্তু বুদ্ধধর্মের বেলায় প্রযোজ্য নয় কখনো। বুদ্ধধর্মের সমগ্র ইতিহাস অহিংসা, মৈত্রী ও সহনশীলতার ইতিহাস। বুদ্ধধর্মের ইতিহাসে ধর্ম বিশ্বাসের কারণে কারও সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া, কাউকে বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করা, অন্য ধর্মের বা ধর্মানুসারীদের উপর কোনো রকম আক্রমণ বা নির্যাতন, অন্য ধর্মের প্রার্থনাস্থান, উপাসনালয় বা ঐতিহাসিক নিদর্শন ধ্বংস করার কোনো নজির নেই।
বর্তমান বিশ্বের ধর্মীয় সংঘাত সমাধানের জন্য বৌদ্ধধর্ম একটি বড় দৃষ্টান্ত হতে পারে। আশার কথা যে, ধর্মীয় সংঘাত নিরসনে এবং ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সৌহার্দ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে আন্ত-ধর্মীয় সংলাপের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে পরিতাপের বিষয় হলো, একদিকে ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ আন্ত-ধর্মীয় সংলাপে লিপ্ত থাকেন, অন্যদিকে তাদের ধর্মের অনুসারীরা সংঘাত ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন। এতে সংলাপের সব উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যায়। হিংসার পথ পরিহার না করলে কখনো পরস্পরের মধ্যে সৌহার্দ-সমপ্রীতি ও শান্তি সম্ভব নয়। এখানে বুদ্ধধর্মের চিরন্তন সত্যটি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্যঃ “হিংসা জন্ম দেয় হিংসার। হিংসা কখনো হিংসার দ্বারা নিবৃত্ত হয় না, একমাত্র ভালোবাসার দ্বারা এর নিবৃত্তি সম্ভব”।
বৌদ্ধধর্মের পঞ্চশীল বা পাঁচটি নৈতিক নিয়মের মধ্যে যে গভীর তাৎপর্য নিহিত আছে, তা আজকের বিশ্বের পরিস্থিতিতে বিশেষভাবে অর্থবহ ও প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। ১৯৫৫-৫৬ সালে ইন্দোনেশিয়ার বান্ডুং শহরে আফ্রো-এশিয়ান সম্মেলনে যে পাঁচটি নীতি গৃহীত হয়েছিল, তার ভিত্তি ছিল এ পঞ্চশীল। ঐ গৃহীত পাঁচটি নীতি হলোঃ (১) প্রত্যেক রাষ্ট্রের ভৌগলিক অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ (২) অনাগ্রাসন (৩) অভ্যন্তরীন বিষয়ে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকা (৪) সমতা ও পারস্পরিক মঙ্গল এবং (৫) শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, আজকের বিশ্বের প্রায় সব রাষ্ট্রেরই বৈদেশিক নীতির মূলমন্ত্র হলো এ পাঁচটি নীতি।
এবার পঞ্চশীলের প্রাসঙ্গিকতা ও প্রায়োগিক তাৎপর্য বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। “কারো ক্ষতিসাধন করা থেকে বিরত থাকা”- পঞ্চশীলের এ প্রথম নিয়মটি অনুসরণে বিশ্বের সব রাষ্ট্রের পরষ্পরের ক্ষতিসাধন করা উচিত নয়; ঠিক তেমনি এক ধর্ম অন্য কোনো ধর্ম বা ধর্মানুসারীদের ক্ষতিসাধন থেকে বিরত থাকা উচিত। অথবা “অপ্রদত্ত বস্তু গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা”- এ দ্বিতীয় শীলটির তাৎপর্য হলো কোনো রাষ্ট্রের অন্য যে কোনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আগ্রাসনে না যাওয়া বা অন্য কোনো রাষ্ট্রের ভূমি দখল না করা। ধর্মের ক্ষেত্রে এ নীতি অনুসরণে বিশ্বের ছোট-বড় সব ধর্মের অনুসারীদের উচিত অন্য কোনো ধর্মের প্রার্থনাস্থান, উপাসনালয় আক্রমণ বা ধ্বংস না করা।
সত্যিকার অর্থে, বুদ্ধধর্মের অহিংসানীতির অনুশীলন, বাস্তবায়ন ও প্রয়োগ ছাড়া বিশ্বের কোথাও শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। দেখা যায়, অনেকেই বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলেন, কিন্তু অন্যদিকে তারা হিংসার পথ বেছে নেন, তাও নাকি আবার শান্তিপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই। এ ধরনের নীতি স্ববিরোধী। হিংসাশক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে যে সমস্যা সমাধান করা হয়, তার অস্তিত্ব খুবই ক্ষণিক। এতে প্রকৃতপক্ষে কোনো শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় না।
লেখক : নীরুকুমার চাকমা, অধ্যাপক দর্শন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, বাংলাদেশ।
No comments
Post a Comment